ঝুরা মাংসের বাকরখানি: শুধু কোরবানি ঈদেই পাওয়া যায় পুরান ঢাকায়

আমিনুল ইসলাম নাবিল
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৩, ১০: ০০
আপডেট : ১৭ জুলাই ২০২৩, ১৬: ৫৯

ভোজনরসিক হিসেবে ঢাকাইয়াদের খ্যাতি আছে। বিশেষ কিছু খাবার আছে যা ঢাকাইয়া ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে যুগ যুগ ধরে। তেমনই একটি খাবার বাকরখানি। পুরান ঢাকার অলিগলি ধরে হাঁটলেই দেখা মেলে বাকরখানির দোকানের। এসব দোকানে ভিড়ও চোখে পড়ার মতো। অনেক ঢাকাইয়া পরিবার এখনো গরম চায়ের সঙ্গে মচমচে বাকরখানি খেয়ে সকাল শুরু করেন। 

পুরান ঢাকায় হরেক পদের বাকরখানি পাওয়া যায় সারা বছর ধরে। এর মধ্যে— নোনতা বাকরখানি, মিষ্টি বাকরখানি, পনিরের বাকরখানি ও ঘিয়ে ভাজা বাকরখানি বেশ প্রসিদ্ধ। তবে এক ধরনের বিশেষ বাখরখানি আছে যেটার স্বাদ নিতে অপেক্ষা করতে হয় এক বছর। শুধু কোরবানির ঈদ এলেই পাওয়া যায় সেই বাকরখানির স্বাদ। কোরবানির গরুর মাংসের কোরমা চুলায় জ্বাল দিতে দিতে যখন ঝুরা হয়ে যায় তখন সেই ঝুরা মাংস দিয়ে তৈরি করা হয় এই বাকরখানি। 

আটার খামির তৈরি করছেন কারিগর। ছবি: লেখকতবে এই বাকরখানি অন্যগুলোর মতো বিক্রি হয় না। বাসা থেকে ঝুরা মাংস নিয়ে গেলে কারিগরেরা তাঁদের নিপুণ হাতে তৈরি করে দেন ঝুরা মাংসের বাকরখানি। মূলত কোরবানির ঈদের চার–পাঁচ দিন পর থেকে ঢাকাইয়া পরিবারে চলে ঝুরা মাংসের বাকরখানি খাওয়ার ধুম। 

পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক (৫২) আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রতি বছর কোরবানি এলেই আমরা ঢাকাইয়ারা বিশেষ এই ঝুরা মাংসের বাকরখানি খেয়ে থাকি। এর স্বাদ ভাষায় প্রকাশের মতো নয়! কোরবানির কোরমার মাংস চার–পাঁচ দিন চুলায় জ্বাল দিতে দিতে যে ঝুরা মাংস বের হয় সেটা দিয়েই তৈরি হয় মজাদার এই বাকরখানি।’ 

চুল্লির ভেতর তৈরি হচ্ছে বাকরখানি। ছবি: লেখকঝুরা মাংসের সঙ্গে আর কোনো উপকরণ মেশানো হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোরবানির কোরমার মাংস কয়েক দিন চুলায় জ্বাল দিলে সেটা থেকে ঝুরা মাংস বের হয়। ঝুরা মাংসে এমনিতেই ঘি, আদা বাটা, রসুন বাটা, পেঁয়াজ, গরম মসলা, জয়ফল, জয়ত্রীসহ নানা উপকরণ থাকে। তাই এটির সঙ্গে নতুন করে আর কোনো উপকরণ মেশানোর প্রয়োজন হয় না। আর বাকরখানির কারিগরেরা তৈরির সময় সামান্য তেল ব্যবহার করে, আটা–ময়দার গুঁড়া মিক্সড করে। তাই বাসা থেকে শুধু ঝুরা মাংস নিয়ে গেলেই হয়। এরপর বাকি কাজটা বাকরখানি তৈরির কারিগরেরাই করে থাকেন।’ তবে ঝুরা মাংস নেওয়ার সময় তেল–চর্বি যতটা সম্ভব চিপে বের করে ফেলার পরামর্শ দেন তিনি। 

থরে থরে সাজানো মচমচে বাকরখানি। ছবি: লেখকঝুরা বাকরখানির আসল স্বাদ পেতে এটি গরম-গরম খেতে হয়। ঠান্ডা করে খেলে কিংবা পরে ওভেনে গরম করে খেলে এটির আসল স্বাদ পাওয়া যাবে না বলে জানান আবু বকর সিদ্দিক। 

কোরবানির ঈদে ঝুরা মাংসের বাকরখানি খাওয়া কখনোই মিস হয় না জানিয়ে আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘শৈশব থেকেই পারিবারিকভাবে এই ধারা চলছে। কোনো বছরই ঝুরা মাংসের বাকরখানি খাওয়া আমাদের মিস হয় না।’

হরেক পদের বাকরখানির সমাহার। ছবি: লেখক আধা কেজি ঝুরা মাংসে কত পিস বাকরখানি তৈরি হয় এরও একটি ধারণা দেন পুরান ঢাকার এই বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘আধা কেজি ঝুরা মাংসে আনুমানিক ১০–১৫ পিস বাকরখানি তৈরি হয়। বাকরখানির ভেতর মাংসে ভরপুর থাকে। প্রতি পিস বাকরখানির বর্তমান বাজারমূল্য ১০ টাকা। ঝুরা মাংসের বাকরখানি আকারে একটু বড় হয়, ফলে এই বছর সেটির দাম ১৫ টাকা হতে পারে।’

পুরান ঢাকার অলিগলিতে রয়েছে এমন অসংখ্য বাকরখানির দোকান। ছবি: লেখকপুরান ঢাকার ওয়ারীর বনগ্রাম এলাকায় দীর্ঘ ২২ বছর ধরে বাকরখানির দোকান পরিচালনা করছেন মোহাম্মদ শরীফ। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘ঝুরা মাংসের বিশেষ বাকরখানি বছরে একবারই আমরা তৈরি করি। ক্রেতারা বাসা থেকে কোরবানির ঝুরা মাংস নিয়ে এলে আমরা ঝুরা মাংসের বাকরখানি বানিয়ে দেই।’ 

কোরবানির ঈদের স্পেশাল ঝুরা মাংস। ছবি: সংগৃহীতপ্রতি ঈদে আনুমানিক কত পিস ঝুরা মাংসের বাকরখানির অর্ডার আসে জানতে চাইলে এই দোকানি বলেন, ‘প্রতি কোরবানির ঈদে আনুমানিক ৪০০–৫০০ পিসের মতো অর্ডার আসে। তবে দিন দিন সংখ্যা কমে আসছে।’ কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক দিকে কোরবানির পশুর দাম বাড়ছে। আর অন্যদিকে মানুষের হাতে টাকাও নাই তেমন। ফলে আগের চেয়ে মানুষ এখন কোরবানি কম দিতে পারে। তাই এটার প্রভাবটা এসে পড়ছে।’ 

কীভাবে ঝুরা মাংসের বাকরখানি তৈরি করেন জানতে চাইলে শরীফ বলেন, ‘বিশেষ কোনো নিয়ম নেই। সাধারণ বাকরখানি যেভাবে বানাই সেভাবেই বানিয়ে থাকি। আটার খামিরের ভেতর শুধু ঝুরা মাংস পুরে দিলেই হয়।’

ঝুরা মাংসের বাকরখানি। ছবি: সংগৃহীত ঝুরা মাংসের বাকরখানি কেজি হিসাবে নিলে ২০০ টাকা। আর পিস হিসেবে প্রতিটা ১৫ টাকা করে নেন বলে জানান এই দোকানি। কোরবানির ঈদ ছাড়াও অন্য সময়ে কেউ যদি ঝুরা মাংস নিয়ে আসেন তাহলেও এই বাকরখানি বানিয়ে দেওয়া যাবে। তবে সাধারণত কোরবানির ঈদ ছাড়া ঝুরা মাংসের বাকরখানির অর্ডার আসে না বলে জানান মোহাম্মদ শরীফ।

 

আরও পড়ুন—

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত