বিজু উৎসবে রঙিন পাহাড়

হিমেল চাকমা, রাঙামাটি
Thumbnail image

টুরু টুরু বাঁশির সুর,/ বাঁশি বাজছে,/ পাড়ায় বেড়াব সবাই মিলে/ আজ বিজু, আজ বিজু।…

(টুরু টুরু বাজি র-অ,/ বাজি বাজেত্তে,/ পাড়ায় পাড়ায় বেড়েবং বেক্কুন মিলিনেই,/ ইচ্ছা বিজু, ইচ্ছা বিজু।…)
বর্ষবরণের চাকমা সংগীত

হ্রদ-পাহাড়ের শহর রাঙামাটিতে এখন বাঁশির সুর ভাসছে। বৈসাবি আসছে। তাই এই আবাহনী গানের সুর তুমুল আলোড়ন তুলছে হ্রদ আর পাহাড়ে। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা হাতে হাত ধরে পাড়ায় পাড়ায় বেড়াতে শুরু করেছে। মূল ভূরিভোজের আয়োজন দেরি থাকলেও বাড়িতে বাড়িতে চলছে খাওয়াদাওয়া। নতুন বছর বরণ করার উৎসব শুরু হয়ে গেছে পাহাড়ে। গত সোমবার আনন্দ শোভাযাত্রা আর বেলুন-কবুতর উড়িয়ে এ উৎসবের সূচনা করা হয়।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বর্ণিল সংস্কৃতি আর প্রকৃতি যেন এ শহরে একে অন্যের পরিপূরক। রাঙামাটিতে বসবাস করে চাকমা, মারমা, লুসাই, ত্রিপুরা, পাঙ্খোয়া ও খিয়াং জনগোষ্ঠী। এই প্রতিটি সম্প্রদায়ের রয়েছে বর্ষবরণের নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব প্রথা। বর্ষবরণের উৎসবকে চাকমা সম্প্রদায় বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, লুসাইরা বিষু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক, পাঙ্খোয়া সম্প্রদায় বিহু বা বিষু এবং খিয়াংরা বিষু নামে অভিহিত করে থাকে। তবে এসব উৎসব একত্রে বৈসাবি নামে পরিচিত। এ বিশাল ও বর্ণাঢ্য আয়োজনের অংশ হতে পারেন আপনিও।

বিজু মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমবেত নৃত্য।বৈসাবি উৎসবের প্রথম পর্বে পাঁচ দিনের বিজু উৎসব আয়োজন করেছে রাঙামাটি জেলা পরিষদ ও রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনস্টিটিউট। ৩ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া উৎসব চলবে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের উৎসব শুরু হবে।

বৈসাবি উপলক্ষে রাঙামাটিতে শুরু হয়েছে আদিবাসী সাংস্কৃতিক মেলা। এ মেলার স্টলগুলোতে জায়গা পেয়েছে আদিবাসীদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান। এ ছাড়া আছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার প্রতিযোগিতা, পাজন রান্না প্রতিযোগিতা, বয়োজ্যেষ্ঠদের স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠান, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার নাটক মঞ্চায়ন।

তবে বৈসাবির মূল উৎসব হবে ৩০ চৈত্র অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল। এর আগের দিন অর্থাৎ ২৯ চৈত্র পানিতে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে পুরোনো বছরকে বিদায় জানাবে পাহাড়িরা। পরের দিন মূল বিজুতে চলবে পাহাড়িদের ঘরে ঘরে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। এ দিন প্রধান আকর্ষণ থাকে হরেক রকম সবজি দিয়ে বানানো পাজন। সর্বনিম্ন সাত প্রকারের সবজি দিয়ে রান্না করা হয় পাজন। পাহাড়িরা বলে থাকে বিজুর দিন সাতটি বাড়িতে পাজন খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বিজুর দিন সবার ঘর অতিথি আপ্যায়নে উন্মুক্ত থাকে। পরের দিন নতুন বছর। এ দিন পাজনের প্রধান উপকরণ কাঁঠাল। এর সঙ্গে প্রায় অর্ধশতাধিক প্রজাতির সবজি মেশানো হয়।

বিজুর প্রধান আকর্ষণ পাজন।নতুন বছরের প্রথম দিনকে চাকমারা বলে গোজ্জেপোজ্জা। ত্রিপুরারা বলে বিচি কাঁঠাল। মারমারা বলে সাংগ্রাই। চাকমা ও ত্রিপুরারা বাংলা নববর্ষ অনুযায়ী বর্ষবরণ করলেও মারমারা করে বর্মিজ বর্ষ পঞ্জিকা অনুসারে। গুরুজনসহ অতিথি আমন্ত্রণ করা হয়। সকালে বিহার ও মন্দিরে ধর্মীয় পুরোহিতদের বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়। সন্ধ্যায় পরলোকগত আত্মীয়স্বজনের আত্মার শান্তি কামনা করে বিহার-মন্দির, ঘরে ঘরে এবং বুদ্ধের উদ্দেশে নদীতে মোমবাতি জ্বালানো হয়। এ দিন আদিবাসীরা তাদের ধর্মীয় পুরোহিত এনে নিজেদের আত্মশুদ্ধি করে নেয়। সারা বছর যেন সুখ-শান্তিতে জীবন চলে এ জন্য প্রার্থনা করে পাহাড়িরা।
মারমা সাংগ্রাই দিনে জল উৎসবে মেতে ওঠে। বর্মিজ পঞ্জিকার শেষ দিন বৌদ্ধমন্দিরগুলোতে বুদ্ধমূর্তি স্নান করায় মারমারা। তাদের বিশ্বাস, বুদ্ধকে স্নানের মাধ্যমে পৃথিবীর সব পানি পবিত্র হয়ে ওঠে।

এ পবিত্র জলে জলকেলিতে মেতে ওঠে মারমারা। এ বছর ১৬ এপ্রিল রাঙামাটির রাজস্থলীর বাঙাল হালিয়ায় মারমাদের জল উৎসবের মধ্যে শেষ হবে পাহাড়ের এ উৎসব।

ঘিলা খেলায় মেতেছে তঞ্চঙ্গা তরুণ-তরুণী।এ উৎসবে দেখতে হলে
পাহাড়ে চলমান এ উৎসব দেখতে হলে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে পর্যটকদের রাঙামাটিতে আসতে হবে। ঢাকা থেকে প্রতিদিন বাস আসে রাঙামাটিতে। পান্থপথ, কলাবাগান, ফকিরাপুল থেকে বিভিন্ন পরিবহনের বাস ছাড়ে। শ্যামলী, ডলফিন, হানিফ, সেন্ট মার্টিন, ইউনিক, এস আলম পরিবহনের এসি ও নন-এসি বাস যায় রাঙামাটি। রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে সব বাস ঢাকা থেকে রাঙামাটির উদ্দেশে রওনা দেয়। ঢাকা থেকে রাঙামাটি পৌঁছাতে সময় লাগবে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। আকাশ বা রেলপথে রাঙামাটি যেতে হলে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট বা রেলস্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে বাস কিংবা রিজার্ভ কোনো পরিবহনে রাঙামাটি যাওয়া যাবে। চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকে ৪০ মিনিট পরপর বিরতিহীন পাহাড়িকা বাস ছাড়ে রাঙামাটির উদ্দেশে।

রাঙামাটিতে থাকার জন্য শতাধিক আবাসিক হোটেল আছে। সুফিয়া ইন্টারন্যাশনাল, সাংহাই, হিল অ্যাম্বাসেডর, গ্রিন ক্যাসেল, লেকসিটি, হোটেল সৈকত, রাঙামাটি পর্যটন করপোরেশন ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি রেস্ট হাউসে থাকার বন্দোবস্ত আছে এ শহরে।

সতর্কতা

  • পাহাড়ের এ উৎসব একান্তই সে অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর। ফলে বৈসাবি উৎসব দেখতে গিয়ে সাংস্কৃতিকভাবে অসহনশীল হওয়া যাবে না।
  • স্থানীয় সংস্কৃতি ও সমাজের প্রতি যথাযথ সম্মান বজায় রাখতে হবে।
  • আগে থেকে হোটেল, মোটেল বা রিসোর্টে রুম বুকিং দিয়ে তারপর যাওয়া ভালো।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত