তেরো শ বছরের পুরোনো মসজিদে

ইয়াসির আরাফাত
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৪, ০৭: ৩৪

আজ জাইতুন মসজিদ। এর অর্থ অলিভ মসজিদ।

তিউনিস শহরের সৌন্দর্য কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে খুঁজলে হবে না! আপনাকে হারিয়ে যেতে হবে মদিনার ভিড়ের মাঝে। কোনো রাস্তার মাথায় গিয়ে যদি দেখেন আপনার পথ দুটি দিকে বেঁকে গেছে, তাহলে নির্দ্বিধায় যেকোনো একটি পথে পা বাড়াতে পারেন আপনি। দুই জায়গাতেই কোনো না কোনো দর্শনীয় জায়গা খুঁজে পাবেন। পুরো মদিনাকেই তারা খুব সুন্দর করে ঐতিহ্যগতভাবে সাজিয়ে রেখেছে।

তিউনিস খুবই পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন শহর। সাধারণত এই শহরের মতো লোকে গিজগিজ করা পুরোনো শহরের বাজার কিংবা রাস্তাঘাট এত পরিষ্কার হয় না। তিউনিস সে দিক দিয়েও উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আমাকে স্বীকার করতে হচ্ছে, সাধারণত ইউরোপের অনেক শহর এত পরিষ্কার নয়।

নির্দিষ্ট গন্তব্যহীন এ শহরে এসেও পেয়ে গেলাম এক দারুণ গন্তব্য। আজ জাইতুন মসজিদ। ১২৯২ বছর বা প্রায় ১৩০০ বছর আগে এই মসজিদ তৈরি হয়েছিল। তাই এর পরতে পরতে বয়সের যেমন স্তর পড়েছে, তেমনি লেগে আছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের গল্প। আর সেই গল্পের সঙ্গে মিশে আছে ইসলামের ইতিহাস।

আজ জাইতুন মসজিদের একাংশ। ছবি: লেখকআজ জাইতুন মসজিদ, অর্থাৎ অলিভ বা জলপাই মসজিদ। এর নাম এমন হওয়ার কারণ হলো, যে জায়গায় মসজিদটি তৈরি হয়েছে, সেখানে একসময় একটি অলিভ বা জলপাইবাগান ছিল। সে জন্যই এর নাম আজ জাইতুন মসজিদ। এটি তিউনিসিয়ার তিউনিস শহরের সবচেয়ে পুরোনো ও গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ।

তিউনিসিয়ার তিউনিস শহর ও সংলগ্ন এলাকাগুলো মুসলমানদের অধীনে আসার পর, ৭৩২ সালে এই অলিভ মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এরপর নবম শতকে খলিফা হারুন অর রশিদের আমলে সেই পুরোনো মসজিদের ওপর বর্তমান মসজিদের ভীত স্থাপন করেন এখানকার সেই সময়ের গভর্নর ইব্রাহিম ইবন আল আগলাব। এই গভর্নর তৈরি করেছিলেন আগলাবাদ রাজ্য।

মাগরিবের এ অঞ্চলটি ছিল খারিজিদের ঘাঁটি। খেলাফতের কেন্দ্র বাগদাদ কিংবা দামেস্ক থেকে এই অঞ্চল অনেক দূরে হওয়ার কারণে খলিফার পক্ষে শক্তহাতে খারিজিদের দমন করা সম্ভব ছিল না। খারিজিদের দমনের জন্য খলিফা হারুন অর রশিদ এখানে পাঠান বনু তামিম গোত্রের সেনাপ্রধান ইব্রাহিম ইবন আগলাবকে। খেলাফত থেকে তাঁকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় এই অঞ্চল নিজের মতো করে পরিচালনার জন্য। সেই সূত্রেই জন্ম নেয় আগলাবাদ রাজ্য। খেলাফতের অধীনে থাকলেও এ অঞ্চলটি ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। শুধু বার্ষিক নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা পাঠাতে হতো বাগদাদে।

সে সময় এই অঞ্চলের নাম ছিল ইফ্রিকিয়া। ইব্রাহিম ইবনে আগলাবকে যখন এই অঞ্চলে পাঠানো হয়, তখন প্রায় এক লাখের মতো আরব মুসলিম এখানে বসবাস করত, যাদের অধিকাংশই এসেছিল সিরিয়া ও ইরাক থেকে। বর্তমান তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ও লিবিয়ার একটি অংশ মিলিয়ে ছিল আগলাবিদ রাজ্যের সীমানা। এ রাজ্য কার্যত স্বাধীন হলেও আব্বাসীয় খেলাফতকে কখনো অস্বীকার করেনি এবং আব্বাসিদের বিপক্ষে কখনো কোনো ধরনের বিদ্রোহ করেনি। আগলাবিদরা প্রতিবছর আব্বাসি খলিফার কাছে ৮ লাখ দিরহাম ট্যাক্স পাঠাত। জুমার খুতবা আব্বাসি খলিফার নামেই দেওয়া হতো, যেটা ছিল সেকালের প্রচলিত রীতি।

ইফ্রিকিয়া অঞ্চলকে পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার পর এই আগলাবিদেরাই ৮২৭ সালে আন্দালুস মুসলিমদের সহযোগিতায় জয় করেছিল সিসিলি আইল্যান্ড ও মাল্টা। প্রায় ২০০ বছর সিসিলি ও মাল্টা ছিল মুসলিম ভূমি।

আজ জাইতুন মসজিদের একাংশ। ছবি: লেখকইব্রাহিম ইবন আগলাব এই মসজিদের ভিত স্থাপন করেন, সেটা আগেই বলেছি। পরে সেই ভিত্তির ওপর ১৪ শতকে তৈরি হয় বাকি অংশ, যেটুকু আমরা এখন দেখি। এই মসজিদ হচ্ছে গোটা মাগরেব অঞ্চলের দ্বিতীয় পুরোনো এবং তিউনিস শহরের প্রথম মসজিদ।

মসজিদটির ভেতরের কারুকাজ ও বাইরের উদ্যান দুটোই অসম্ভব সুন্দর। এর স্থাপত্যরীতি হলো ঐতিহ্যবাহী আগলাবাদী রীতি। আগলাবাদীরা সাধারণ দুর্গের মতো করে মসজিদ নির্মাণ করত। কারণ তারা মসজিদকে শুধু নামাজের জায়গা হিসেবে ভাবত না। প্রার্থনা ছাড়াও দুর্গ ও যোদ্ধাদের অনুশীলনের কাজেও ব্যবহার হতো আগলাবাদী মসজিদগুলো। 

তিউনিসিয়ার অন্য সব মসজিদের মতো এই মসজিদেও অমুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে মসজিদের খোলা উদ্যান যে কেউ ঘুরে দেখতে পারে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত