ফিরে দেখা ২০২৪ /ওলটপালট বিচার বিভাগ, বিচারপতিদের পদত্যাগ ও নিয়োগে রেকর্ড

এস এম নূর মোহাম্মদ, ঢাকা
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭: ৩০
আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০: ৫১
Thumbnail image
ফাইল ছবি

২০২৪ সাল দেশের মতো বিচার বিভাগও খুবই ঘটনাবহুল; বলা যায় বিচার বিভাগ ওলটপালট হয়েছে। একসঙ্গে আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতির পদত্যাগ এবং হাইকোর্ট থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ঘটনা বাংলাদেশের বিচার বিভাগে প্রথম। শুধু তা-ই নয়, গুরুত্বপূর্ণ রায়সহ নানা কারণে বিদায়ী বছরের প্রায় পুরোটা সময় আলোচনায় ছিল দেশের বিচার বিভাগ।

একদিকে কোটা বাতিলসংক্রান্ত রায়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের রায়সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করেছে। অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টে নতুন বিচারপতি নিয়োগ, বিচার বিভাগ সচিবালয় গঠন এবং কুইক রেন্টাল আইনের কয়েকটি ধারা অবৈধ ঘোষণা ছিল বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এসব ঘটনা বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও আইনি কাঠামোয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

চাকরিতে কোটা নিয়ে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়

সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে গত ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। ওই দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ জানান। পরে এই ইস্যুতে দানা বাধে আন্দোলন, যা পরে দেশজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ ছাড়া রায় স্থগিত চেয়ে পৃথক আবেদন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীও। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আপিল বিভাগ ১০ জুলাই হাইকোর্টের রায়ে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারি করেন।

আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থার পরও কমেনি আন্দোলনের তীব্রতা; বরং তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। আন্দোলনে যুক্ত হয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে দমাতে কঠোর হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী; চলে গুলির ঘটনাও। একপর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে কারফিউ জারি করে সরকার। আর কারফিউর মাঝেই ২১ জুলাই আপিল বিভাগ বসে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে নতুন রায় দেন।

আপিল বিভাগের রায়ের পরও চলতে থাকে আন্দোলন। একপর্যায়ে তাতে যোগ দেন নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ব্যাপক প্রাণহানির পর অবশেষে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে যান চলে শেখ হাসিনা। একটানা দেড় দশকের বেশি সময় দেশ শাসন করা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে আপিল বিভাগের মত

আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে ৫ আগস্ট। পরদিন সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি। ওই মুহূর্তে দেশে কোনো সরকার না থাকায় সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয়। এরপরই রাষ্ট্রপতি অন্তবর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে আপিল বিভাগের মতামত চান। তাতে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পক্ষে মত দেন আপিল বিভাগ। এরপর উপদেষ্টাদের শপথ পড়ানো হয়।

ছয় বিচারপতির পদত্যাগ

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ১০ আগস্ট তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগপত্র জমা দেন। অপর পাঁচ বিচারপতি হলেন এম ইনায়েতুর রহিম, মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. শাহিনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেন।

হাইকোর্ট বিভাগ থেকে প্রধান বিচারপতি

প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতি পদত্যাগের পর ওই দিনই বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। পরদিন বঙ্গভবনে তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর ১২ আগস্ট আরও চার বিচারপতিকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিচার বিভাগ সচিবালয় ও বিচারপতি নিয়োগে কমিশন

বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠন করতে ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়। প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা অনুসারে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন ধারণাপত্রসহ এই প্রস্তাব পাঠায়। এ ছাড়া বিচারপতি নিয়োগে ‘জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ গঠন করতে ২৮ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে, যা নিয়ে কাজ করছে সরকার।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল

বিচারপতিদের অপসারণ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের রিভিউ বা পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন ২০ অক্টোবর পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দেন আপিল বিভাগ। আদালত ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ থেকে ৮ উপ-অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন করতে বলেন। রায়ের ফলে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসমর্থতা ও পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান পুনর্বহাল হয়।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে ১ ডিসেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্স নাকচ করে এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে এই রায় দেওয়া হয়। এর ফলে এই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ দণ্ডিত সব আসামি খালাস পান।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা

পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারার মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তির বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল এবং আইনের আরও চারটি ধারা বাতিল করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ও আইনের কয়েকটি ধারার বৈধতা নিয়ে করা পৃথক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ১৭ ডিসেম্বর ওই রায় দেন হাইকোর্ট।

১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা

২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় করা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ছয়জনকে খালাস দেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর ৬ আসামির সাজা কমিয়ে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি পরেশ বড়ুয়ার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে রায়ে। এ ছাড়া ওই মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী মারা যাওয়ায় তাঁর আপিল মেরিটে নিষ্পত্তি করে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে ১৮ ডিসেম্বর এই রায় দেওয়া হয়।

তিন বিচারপতির পদত্যাগ ও ১২ জনকে বেঞ্চ না দেওয়া

দীর্ঘ ৫ বছর বিচারকাজ থেকে বিরত থাকার পর অবশেষে পদত্যাগ করেন হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতি। তাঁরা হলেন বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক। গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ ওঠার পর ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট থেকে তাঁদের বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছিল।

তিন বিচারপতির পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতি গ্রহণ করেন বলে ১৯ নভেম্বর আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে বলা হয়, সংবিধানের ৯৬(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, তিন বিচারপতি রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ করেছেন। রাষ্ট্রপতি তা গ্রহণ করেছেন।

এদিকে আওয়ামী লীগের সময়ের বিচারপতিদের পদত্যাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে ১২ বিচারপতিকে গত ১৬ অক্টোবর বেঞ্চ না দেওয়ার কথা জানানো হয়। ওই দিন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, ১২ বিচারপতিকে আপাতত বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে তাঁদেরকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে।

কুইক রেন্টালের দায় মুক্তির বিধান অবৈধ ঘোষণা

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর ৬(২) ও ৯ ধারা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সরকারি মালিকানাধীন পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর পুরোপুরি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এই সংক্রান্ত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে ১৪ নভেম্বর এ রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ে আদালত বলেন, বলতে দ্বিধা নেই যে, আইনের ৬(২) ধারা সংবিধানের ম্যান্ডেটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই এটি বাতিল ঘোষণা করা হলো।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত