বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
মালিবাগ মোড় থেকে গ্রিনলাইন বাস কাউন্টারের দিকে কয়েক পা যেতেই বাঁ দিকে চোখে পড়ে একসময়ের বিশাল এনজিও কারিতাসের কার্যালয়। সেখানকার একটি একতলা টিনের ঘরে বসতেন নটর ডেম কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রিচার্ড উইলিয়াম টিম, যিনি ফাদার টিম নামে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর ফাদার টিম প্রথমে ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ’ নামে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একটি মোর্চা গড়ে তোলেন। শুরুতে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও কিছুদিন যেতেই নেতৃত্ব নিয়ে সংগঠনগুলোর ভেতরে কোন্দল দেখা দেয়। এরপর তিনি সমন্বয় পরিষদের পাশাপাশি গড়ে তোলেন ‘হটলাইন বাংলাদেশ’ নামে আরেকটি এনজিও। ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা। তাঁর ছোট বোন রোজালিন ডি কস্তা ছিলেন ফাদার টিমের প্রধান সহকারী। একই সঙ্গে তিনি হটলাইন বাংলাদেশের মানবাধিকার সমন্বয়কারী হিসেবেও কাজ করতেন।
রোজালিন কিছুটা খিটখিটে মেজাজের হলেও মানুষ হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। আমি তাঁকে ডাকতাম ‘রোজিদি’ বলে। কেন জানি না, আমার প্রতি তাঁর ছিল অপত্যস্নেহ। কোনো কাজে গেলেই তিনি নিজে চা বানিয়ে হাতে ধরিয়ে দিতেন। তাঁর হাতের লাল চায়ের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। সেই রোজালিন একদিন জরুরি খবর দিলেন দেখা করার জন্য। এটা ছিল ২০০৬ সালের ২২ আগস্টের সকাল।
গিয়ে দেখি ফাদার টিম অফিসে নেই। রোজালিন একাই আছেন। তাঁর সামনে মলিন পোশাকের এক বয়স্ক লোক, হাতে অনেকগুলো কাগজপত্র। লোকটাকে দেখিয়ে রোজালিন বললেন, ওনার জীবনে বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে। একটু অপেক্ষা করেন, সবই দেখতে পাবেন।
সেদিন আমার তেমন কোনো তাড়া ছিল না, এই ফাঁকে লাল চা এসে গেল। আমি আয়েশে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললাম, তিনি কী করেন? রোজালিন বললেন, আগে রিকশা চালাতেন, এখন বারডেম হাসপাতালে ছোট চাকরি করেন। বাড়ি ফরিদপুরে। এটুকু শুনে আমার কোনো আগ্রহ জন্মাল না। রোজালিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সন্দেহ করলেন, বিষয়টি আমি কম গুরুত্ব দিচ্ছি। তিনি বললেন, আগে পুরো ঘটনা শোনেন তারপর বুঝবেন। রোজালিন বলতে থাকলেন।
নেদারল্যান্ডস থেকে এক দম্পতি এল ঢাকায়—রিনা ও ড্যানিশ। সামনে দিয়ে কোনো রিকশাচালক গেলেই তাঁরা উৎসুক চোখে তাকাতেন। কাকে যেন খোঁজেন। আমি বললাম, কাকে খুঁজতেন? রোজালিন বললেন, ২৬ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বাবাকে! এতক্ষণ আমার যে বিরক্তি ছিল, এক লহমায় উবে গেল। রোজালিনও বুঝলেন তাঁর প্রতি আমার মনোযোগ বেড়েছে। রোজালিন বলেই চলেছেন।
রিনা পেশায় আইনজীবী। তবে জন্মগতভাবে কিন্তু মেয়েটা ওলন্দাজ নয়। তো? প্রশ্ন করতেই বললেন, সে বাঙালি। ১৯৮০ সালে ঢাকার একটি বেবি হোম থেকে রিনাকে দত্তক নিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসের (তখন নাম ছিল হল্যান্ড) নাগরিক ভ্যান ডার মির। তখন কাগজে-কলমে মেয়েটির নাম ছিল রিনা আক্তার। সেই বছরের মার্চ কিংবা এপ্রিলে রিনাকে নিয়ে উড়োজাহাজে চড়ে বসেন ভ্যান ডার মির। রিনার বয়স তখন মোটে ছয় মাস। তারপর একে একে পেরিয়ে যায় ২৬ বছর। রিনা বড় হয়েছেন, পড়াশোনা শেষ করে আইন পেশায় ঢুকেছেন। বিয়ে করেছেন, স্বামী পেশায় শিক্ষক। রিনার যখন বিয়ে হয়, তখন একদিন তাঁর পালক বাবা ভ্যান ডার মির রিনাকে বলে বসেন বাংলাদেশ নামের একটা দেশের সঙ্গে তাঁর অচ্ছেদ্য বন্ধনের কথা।
এমন এক দেশের নাম বলছেন বাবা, জ্ঞান হওয়ার পর যে দেশটিকে কখনোই চোখে দেখেননি রিনা। কিন্তু রিনা তখনো জানেন না তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় বিস্ময়। ভ্যান ডার মির তাঁকে জানালেন, তিনি তাঁর আসল বাবা নন, তার আসল বাবা একজন বাংলাদেশি, নাম মতিউর রহমান। বাড়ি ফরিদপুরে, পেশায় রিকশাওয়ালা। রিনাকে তাঁর নানি একটি হোমে রেখে গিয়েছিলেন।
নিজের প্রকৃত পরিচয় জানার পর রিনাকে গ্রাস করে বসে এক বিপন্ন বিস্ময়। তিনি পণ করেন, নিজের অতীত জানবেন। একদিন আলাপের ছলে স্বামী ড্যানিশের কাছে সেই ইচ্ছার কথা পেড়ে বসেন। ড্যানিশ সেদিন রিনাকে অবাক করে দিয়ে বলেন, চলো বাংলাদেশে যাব।
‘বাবার নাম মতিউর রহমান, পেশায় রিকশাওয়ালা, বাড়ি ফরিদপুর’—শুধু এটুকু তথ্য নিয়ে ১৫ দিনের ভিসায় ২০০৬ সালের ৩ আগস্ট দুজনে ঢাকায় আসেন। সোজা চলে যান ফরিদপুরে। সেখানে সংবাদ সম্মেলন করে হতদরিদ্র বাবা মতিউর রহমানকে খুঁজে দেওয়ার আকুতি জানান।
এই সংবাদ সম্মেলনের পর ফরিদপুর শহরের উপকণ্ঠ আলীপুরের আবদুল জব্বার মোল্লার বাড়ি থেকে তাঁদের ডাক আসে। জব্বার মোল্লা ও তাঁর স্ত্রী রিজিয়া বেগম তাঁদের মেয়েকে হল্যান্ডের এক দম্পতির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। রিজিয়া বেগম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন রিনাকে। রিনার বুকে আশা, হয়তো তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর বাবা-মাকে। কিন্তু হতাশ হতে হয় তাঁকে। জব্বার-রিজিয়া দম্পতি তাঁদের মেয়েকে দত্তক দেন ১৯৭৫ সালে। হতাশ হন দুজনে। এভাবে গাইড আবু তাহের বাবলুকে নিয়ে যেখান থেকেই ডাক আসে, দুজনে ছুটে যান।
খবরের কাগজে এই সংবাদ দেখে বারডেম হাসপাতালের কর্মচারী মতিউর রহমান ছুটে আসেন রোজালিনের কাছে। তিনি বলেন, এই মেয়ের তিনিই বাবা। রোজালিনও সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন, তিনি জেরা করতে থাকেন মতিউরকে। মতিউর তাঁকে জানান, স্বাধীনতার আগে থেকেই পুরান ঢাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। সেখানে হাসিনা নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। সেই সংসারে তিন সন্তান। বছর পাঁচেক পর তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর তিনি হালিমা নামের আরেকজনকে বিয়ে করেন। তাঁদের কোলজুড়ে আসে এক মেয়ে। নাম রাখেন রিনা। সরকারি বরাদ্দের সুবাদে টঙ্গীতে একটি কক্ষে স্বামী-স্ত্রীর মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়। চরম দারিদ্র্য আর নিঃসীম বঞ্চনার সুযোগে একটি সাহায্য সংস্থার স্থানীয় কিছু কর্মী মতিউরকে লোভ দেখান। সেই লোভে পড়ে আগের স্ত্রীর দুই সন্তান নীলু, লাইলি আর রিনাকে টঙ্গীর একটি বেসরকারি শিশু আশ্রমে পাঠিয়ে দেন। সেখানে স্ট্যাম্প লাগানো সাদা কাগজে সইও করেন। কিছুদিন পর বুঝতে পারেন, সমাজকর্মী পরিচয়ের আড়ালে ওরা আসলে পাচারকারী। তাঁর সন্তানেরা বিক্রি হয়ে গেছে।
মতিউর সেই আশ্রমে গিয়ে সন্তানদের ফিরিয়ে দিতে পীড়াপীড়ি শুরু করেন। এরপর কয়েকজন সেখানকার একটি কক্ষে তাঁকে আটকে রাখেন। পরে কোনো রকমে বেরিয়ে বাড়ি এসে মামলা করতে চাইলে বাদ সাধেন তাঁর স্ত্রী। তারপরও মতিউর দমে যাওয়ার লোক নন। নিজের সন্তানদের পাচারের অভিযোগ করে ১৯৮০ সালে সামরিক আদালতে মামলা দায়ের করেন তিনি। মামলায় মোসলেম আলী খান, শামসুল হুসাইন, হুমায়ুন কবির, আবদুর রব ও আবদুস সালামকে আসামি করেন। সিআইডি এই মামলা তদন্ত করে ১৯৮২ সালে অভিযোগপত্র জমা দেয় (মামলা নম্বর ৮২, তারিখ: ১৭-১০-১৯৮২)। তবে পরে এই মামলার কী হয়েছে তিনি আর জানেন না। মামলা দায়ের করার পর মোসলেম আলী খান ও তাঁর সহযোগীরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে নিয়ে মতিউরকে হত্যার চেষ্টাও করেন। রোজালিন এ পর্যন্ত বলে মতিউরের দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বলেন, এই সেই মতিউর।
রোজালিনের কথা শুনে আমি মতিউর রহমানের দিকে তাকাই। তিনি আমার হাতে একটি পত্রিকা ধরিয়ে দেন। সেটা ছিল ১৯৮১ সালের ৭ ডিসেম্বরে প্রকাশিত মার্কিন সাময়িকী দ্য পিপলস। মতিউর বলেন, হল্যান্ড থেকে এক সাংবাদিক তাঁর কাছে এসেছিলেন। তিনি তাঁর এক মেয়ে লাইলির ছবিসহ একটি পত্রিকা তাঁকে দেখিয়ে বলেন, ভালো থাকা-খাওয়ার কথা বলে এই মেয়েকে পাচার করা হয়েছিল।
একপর্যায়ে মতিউরের সব কথায় বিশ্বাস করেন রোজালিন। এরপর তিনি রিনা-ড্যানিশ দম্পতির খোঁজ করতে শুরু করেন। এই দম্পতি তখন ফরিদপুর থেকে সিলেট হয়ে চট্টগ্রামে চলে গেছেন। দুই দিনের মধ্যে রোজালিন তাঁদের খুঁজে বের করেন। ২০০৬ সালের ২২ আগস্ট তাঁদের আসতে বলেন মালীবাগে হটলাইন কার্যালয়ে। সেই ঘটনার সাক্ষী হতে আমাকেও ডাকেন।
মতিউরের গল্প শুনতে শুনতে দুপুর হয়ে যায়। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি রিনা আর ড্যানিশের জন্য। চট্টগ্রাম থেকে তাঁরা আসেন দুপুরের পরে। রিনা খুবই নির্লিপ্ত, দেখে মনে হয় তাঁর ভেতরে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। এই কয়েক দিনে বাবা দাবি করা আরও অনেক লোকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। কাউকেই তাঁর বাবা মনে হয়নি। মতিউর সম্পর্কে হয়তো সে রকমই ভেবেছিলেন।
রিনা আর ড্যানিশ এসে বসলেন রোজালিনের সামনের চেয়ারে। শুরু হলো কথোপকথন। মতিউরের কাছ থেকে নেওয়া কিছু কাগজ রিনার হাতে ধরিয়ে দিলেন রোজালিন। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর মনে হলো, হালে পানি পেয়েছেন রিনা। খুব আগ্রহ নিয়ে মতিউরকে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে থাকলেন। রোজালিন সেই সব অনুবাদ করে দিচ্ছেন। কথার ফাঁকে মতিউর মার্কিন সাময়িকী দ্য পিপলস রিনার হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেই সাময়িকীতে থাকা ছবিটি দেখেই চিৎকার করে উঠল রিনা, ‘আমি তো একে চিনি। সে আমার সঙ্গে স্কুলে পড়েছে।’ মতিউর বললেন, এটা তাঁর পাচার হওয়া আরেক মেয়ে। মতিউরের কাছে তাঁর স্ত্রীর কথা জানতে চাইলেন রিনা। মতিউর বললেন, স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই।
আমি একবার রিনার দিকে, আরেকবার মতিউরের দিকে তাকাই। পেশাদার আইনজীবী রিনার চোখ-মুখ চিকচিক করছে। তিনি মতিউরের কাছে থাকা সব কাগজপত্র আরও ভালো করে দেখছেন। একবার, দুবার, বারবার। এক মুহূর্তে মনে হল রিনার চোখেমুখে অন্য রকম অভিব্যক্তি। রিনা তার স্বামী ড্যানিশের দিকে তাকালেন, তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি নিশ্চিত, মতিউরই তাঁর পিতা। এক রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তার মধ্যে নিমেষে পিতা-কন্যার কান্নাঝরা পুনর্মিলন হয়ে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছলেন হটলাইনের কর্মীরা। পিতা-কন্যার স্বর্গীয় এই মিলন স্পর্শ করল সবার মতো ড্যানিশকেও। তাঁর দুই চোখজুড়ে পদ্মা-মেঘনা।
আমার কাজ শেষ। এবার আমাকে উঠতে হবে। ওঠার আগে রোজালিন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন রিনার সঙ্গে। রিনা আমার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বললেন, ‘এ দেশে কেউই আমার চেনা ছিল না। অথচ আজ সবাইকে বড় আপন মনে হচ্ছে, তোমাকেও।’ আসলে রক্তের টান বড় বিচিত্র!
আরও পড়ুন:
মালিবাগ মোড় থেকে গ্রিনলাইন বাস কাউন্টারের দিকে কয়েক পা যেতেই বাঁ দিকে চোখে পড়ে একসময়ের বিশাল এনজিও কারিতাসের কার্যালয়। সেখানকার একটি একতলা টিনের ঘরে বসতেন নটর ডেম কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রিচার্ড উইলিয়াম টিম, যিনি ফাদার টিম নামে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর ফাদার টিম প্রথমে ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ’ নামে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একটি মোর্চা গড়ে তোলেন। শুরুতে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও কিছুদিন যেতেই নেতৃত্ব নিয়ে সংগঠনগুলোর ভেতরে কোন্দল দেখা দেয়। এরপর তিনি সমন্বয় পরিষদের পাশাপাশি গড়ে তোলেন ‘হটলাইন বাংলাদেশ’ নামে আরেকটি এনজিও। ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা। তাঁর ছোট বোন রোজালিন ডি কস্তা ছিলেন ফাদার টিমের প্রধান সহকারী। একই সঙ্গে তিনি হটলাইন বাংলাদেশের মানবাধিকার সমন্বয়কারী হিসেবেও কাজ করতেন।
রোজালিন কিছুটা খিটখিটে মেজাজের হলেও মানুষ হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। আমি তাঁকে ডাকতাম ‘রোজিদি’ বলে। কেন জানি না, আমার প্রতি তাঁর ছিল অপত্যস্নেহ। কোনো কাজে গেলেই তিনি নিজে চা বানিয়ে হাতে ধরিয়ে দিতেন। তাঁর হাতের লাল চায়ের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। সেই রোজালিন একদিন জরুরি খবর দিলেন দেখা করার জন্য। এটা ছিল ২০০৬ সালের ২২ আগস্টের সকাল।
গিয়ে দেখি ফাদার টিম অফিসে নেই। রোজালিন একাই আছেন। তাঁর সামনে মলিন পোশাকের এক বয়স্ক লোক, হাতে অনেকগুলো কাগজপত্র। লোকটাকে দেখিয়ে রোজালিন বললেন, ওনার জীবনে বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে। একটু অপেক্ষা করেন, সবই দেখতে পাবেন।
সেদিন আমার তেমন কোনো তাড়া ছিল না, এই ফাঁকে লাল চা এসে গেল। আমি আয়েশে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললাম, তিনি কী করেন? রোজালিন বললেন, আগে রিকশা চালাতেন, এখন বারডেম হাসপাতালে ছোট চাকরি করেন। বাড়ি ফরিদপুরে। এটুকু শুনে আমার কোনো আগ্রহ জন্মাল না। রোজালিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সন্দেহ করলেন, বিষয়টি আমি কম গুরুত্ব দিচ্ছি। তিনি বললেন, আগে পুরো ঘটনা শোনেন তারপর বুঝবেন। রোজালিন বলতে থাকলেন।
নেদারল্যান্ডস থেকে এক দম্পতি এল ঢাকায়—রিনা ও ড্যানিশ। সামনে দিয়ে কোনো রিকশাচালক গেলেই তাঁরা উৎসুক চোখে তাকাতেন। কাকে যেন খোঁজেন। আমি বললাম, কাকে খুঁজতেন? রোজালিন বললেন, ২৬ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বাবাকে! এতক্ষণ আমার যে বিরক্তি ছিল, এক লহমায় উবে গেল। রোজালিনও বুঝলেন তাঁর প্রতি আমার মনোযোগ বেড়েছে। রোজালিন বলেই চলেছেন।
রিনা পেশায় আইনজীবী। তবে জন্মগতভাবে কিন্তু মেয়েটা ওলন্দাজ নয়। তো? প্রশ্ন করতেই বললেন, সে বাঙালি। ১৯৮০ সালে ঢাকার একটি বেবি হোম থেকে রিনাকে দত্তক নিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসের (তখন নাম ছিল হল্যান্ড) নাগরিক ভ্যান ডার মির। তখন কাগজে-কলমে মেয়েটির নাম ছিল রিনা আক্তার। সেই বছরের মার্চ কিংবা এপ্রিলে রিনাকে নিয়ে উড়োজাহাজে চড়ে বসেন ভ্যান ডার মির। রিনার বয়স তখন মোটে ছয় মাস। তারপর একে একে পেরিয়ে যায় ২৬ বছর। রিনা বড় হয়েছেন, পড়াশোনা শেষ করে আইন পেশায় ঢুকেছেন। বিয়ে করেছেন, স্বামী পেশায় শিক্ষক। রিনার যখন বিয়ে হয়, তখন একদিন তাঁর পালক বাবা ভ্যান ডার মির রিনাকে বলে বসেন বাংলাদেশ নামের একটা দেশের সঙ্গে তাঁর অচ্ছেদ্য বন্ধনের কথা।
এমন এক দেশের নাম বলছেন বাবা, জ্ঞান হওয়ার পর যে দেশটিকে কখনোই চোখে দেখেননি রিনা। কিন্তু রিনা তখনো জানেন না তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় বিস্ময়। ভ্যান ডার মির তাঁকে জানালেন, তিনি তাঁর আসল বাবা নন, তার আসল বাবা একজন বাংলাদেশি, নাম মতিউর রহমান। বাড়ি ফরিদপুরে, পেশায় রিকশাওয়ালা। রিনাকে তাঁর নানি একটি হোমে রেখে গিয়েছিলেন।
নিজের প্রকৃত পরিচয় জানার পর রিনাকে গ্রাস করে বসে এক বিপন্ন বিস্ময়। তিনি পণ করেন, নিজের অতীত জানবেন। একদিন আলাপের ছলে স্বামী ড্যানিশের কাছে সেই ইচ্ছার কথা পেড়ে বসেন। ড্যানিশ সেদিন রিনাকে অবাক করে দিয়ে বলেন, চলো বাংলাদেশে যাব।
‘বাবার নাম মতিউর রহমান, পেশায় রিকশাওয়ালা, বাড়ি ফরিদপুর’—শুধু এটুকু তথ্য নিয়ে ১৫ দিনের ভিসায় ২০০৬ সালের ৩ আগস্ট দুজনে ঢাকায় আসেন। সোজা চলে যান ফরিদপুরে। সেখানে সংবাদ সম্মেলন করে হতদরিদ্র বাবা মতিউর রহমানকে খুঁজে দেওয়ার আকুতি জানান।
এই সংবাদ সম্মেলনের পর ফরিদপুর শহরের উপকণ্ঠ আলীপুরের আবদুল জব্বার মোল্লার বাড়ি থেকে তাঁদের ডাক আসে। জব্বার মোল্লা ও তাঁর স্ত্রী রিজিয়া বেগম তাঁদের মেয়েকে হল্যান্ডের এক দম্পতির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। রিজিয়া বেগম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন রিনাকে। রিনার বুকে আশা, হয়তো তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর বাবা-মাকে। কিন্তু হতাশ হতে হয় তাঁকে। জব্বার-রিজিয়া দম্পতি তাঁদের মেয়েকে দত্তক দেন ১৯৭৫ সালে। হতাশ হন দুজনে। এভাবে গাইড আবু তাহের বাবলুকে নিয়ে যেখান থেকেই ডাক আসে, দুজনে ছুটে যান।
খবরের কাগজে এই সংবাদ দেখে বারডেম হাসপাতালের কর্মচারী মতিউর রহমান ছুটে আসেন রোজালিনের কাছে। তিনি বলেন, এই মেয়ের তিনিই বাবা। রোজালিনও সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন, তিনি জেরা করতে থাকেন মতিউরকে। মতিউর তাঁকে জানান, স্বাধীনতার আগে থেকেই পুরান ঢাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। সেখানে হাসিনা নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। সেই সংসারে তিন সন্তান। বছর পাঁচেক পর তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর তিনি হালিমা নামের আরেকজনকে বিয়ে করেন। তাঁদের কোলজুড়ে আসে এক মেয়ে। নাম রাখেন রিনা। সরকারি বরাদ্দের সুবাদে টঙ্গীতে একটি কক্ষে স্বামী-স্ত্রীর মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়। চরম দারিদ্র্য আর নিঃসীম বঞ্চনার সুযোগে একটি সাহায্য সংস্থার স্থানীয় কিছু কর্মী মতিউরকে লোভ দেখান। সেই লোভে পড়ে আগের স্ত্রীর দুই সন্তান নীলু, লাইলি আর রিনাকে টঙ্গীর একটি বেসরকারি শিশু আশ্রমে পাঠিয়ে দেন। সেখানে স্ট্যাম্প লাগানো সাদা কাগজে সইও করেন। কিছুদিন পর বুঝতে পারেন, সমাজকর্মী পরিচয়ের আড়ালে ওরা আসলে পাচারকারী। তাঁর সন্তানেরা বিক্রি হয়ে গেছে।
মতিউর সেই আশ্রমে গিয়ে সন্তানদের ফিরিয়ে দিতে পীড়াপীড়ি শুরু করেন। এরপর কয়েকজন সেখানকার একটি কক্ষে তাঁকে আটকে রাখেন। পরে কোনো রকমে বেরিয়ে বাড়ি এসে মামলা করতে চাইলে বাদ সাধেন তাঁর স্ত্রী। তারপরও মতিউর দমে যাওয়ার লোক নন। নিজের সন্তানদের পাচারের অভিযোগ করে ১৯৮০ সালে সামরিক আদালতে মামলা দায়ের করেন তিনি। মামলায় মোসলেম আলী খান, শামসুল হুসাইন, হুমায়ুন কবির, আবদুর রব ও আবদুস সালামকে আসামি করেন। সিআইডি এই মামলা তদন্ত করে ১৯৮২ সালে অভিযোগপত্র জমা দেয় (মামলা নম্বর ৮২, তারিখ: ১৭-১০-১৯৮২)। তবে পরে এই মামলার কী হয়েছে তিনি আর জানেন না। মামলা দায়ের করার পর মোসলেম আলী খান ও তাঁর সহযোগীরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে নিয়ে মতিউরকে হত্যার চেষ্টাও করেন। রোজালিন এ পর্যন্ত বলে মতিউরের দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বলেন, এই সেই মতিউর।
রোজালিনের কথা শুনে আমি মতিউর রহমানের দিকে তাকাই। তিনি আমার হাতে একটি পত্রিকা ধরিয়ে দেন। সেটা ছিল ১৯৮১ সালের ৭ ডিসেম্বরে প্রকাশিত মার্কিন সাময়িকী দ্য পিপলস। মতিউর বলেন, হল্যান্ড থেকে এক সাংবাদিক তাঁর কাছে এসেছিলেন। তিনি তাঁর এক মেয়ে লাইলির ছবিসহ একটি পত্রিকা তাঁকে দেখিয়ে বলেন, ভালো থাকা-খাওয়ার কথা বলে এই মেয়েকে পাচার করা হয়েছিল।
একপর্যায়ে মতিউরের সব কথায় বিশ্বাস করেন রোজালিন। এরপর তিনি রিনা-ড্যানিশ দম্পতির খোঁজ করতে শুরু করেন। এই দম্পতি তখন ফরিদপুর থেকে সিলেট হয়ে চট্টগ্রামে চলে গেছেন। দুই দিনের মধ্যে রোজালিন তাঁদের খুঁজে বের করেন। ২০০৬ সালের ২২ আগস্ট তাঁদের আসতে বলেন মালীবাগে হটলাইন কার্যালয়ে। সেই ঘটনার সাক্ষী হতে আমাকেও ডাকেন।
মতিউরের গল্প শুনতে শুনতে দুপুর হয়ে যায়। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি রিনা আর ড্যানিশের জন্য। চট্টগ্রাম থেকে তাঁরা আসেন দুপুরের পরে। রিনা খুবই নির্লিপ্ত, দেখে মনে হয় তাঁর ভেতরে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। এই কয়েক দিনে বাবা দাবি করা আরও অনেক লোকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। কাউকেই তাঁর বাবা মনে হয়নি। মতিউর সম্পর্কে হয়তো সে রকমই ভেবেছিলেন।
রিনা আর ড্যানিশ এসে বসলেন রোজালিনের সামনের চেয়ারে। শুরু হলো কথোপকথন। মতিউরের কাছ থেকে নেওয়া কিছু কাগজ রিনার হাতে ধরিয়ে দিলেন রোজালিন। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর মনে হলো, হালে পানি পেয়েছেন রিনা। খুব আগ্রহ নিয়ে মতিউরকে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে থাকলেন। রোজালিন সেই সব অনুবাদ করে দিচ্ছেন। কথার ফাঁকে মতিউর মার্কিন সাময়িকী দ্য পিপলস রিনার হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেই সাময়িকীতে থাকা ছবিটি দেখেই চিৎকার করে উঠল রিনা, ‘আমি তো একে চিনি। সে আমার সঙ্গে স্কুলে পড়েছে।’ মতিউর বললেন, এটা তাঁর পাচার হওয়া আরেক মেয়ে। মতিউরের কাছে তাঁর স্ত্রীর কথা জানতে চাইলেন রিনা। মতিউর বললেন, স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই।
আমি একবার রিনার দিকে, আরেকবার মতিউরের দিকে তাকাই। পেশাদার আইনজীবী রিনার চোখ-মুখ চিকচিক করছে। তিনি মতিউরের কাছে থাকা সব কাগজপত্র আরও ভালো করে দেখছেন। একবার, দুবার, বারবার। এক মুহূর্তে মনে হল রিনার চোখেমুখে অন্য রকম অভিব্যক্তি। রিনা তার স্বামী ড্যানিশের দিকে তাকালেন, তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি নিশ্চিত, মতিউরই তাঁর পিতা। এক রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তার মধ্যে নিমেষে পিতা-কন্যার কান্নাঝরা পুনর্মিলন হয়ে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছলেন হটলাইনের কর্মীরা। পিতা-কন্যার স্বর্গীয় এই মিলন স্পর্শ করল সবার মতো ড্যানিশকেও। তাঁর দুই চোখজুড়ে পদ্মা-মেঘনা।
আমার কাজ শেষ। এবার আমাকে উঠতে হবে। ওঠার আগে রোজালিন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন রিনার সঙ্গে। রিনা আমার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বললেন, ‘এ দেশে কেউই আমার চেনা ছিল না। অথচ আজ সবাইকে বড় আপন মনে হচ্ছে, তোমাকেও।’ আসলে রক্তের টান বড় বিচিত্র!
আরও পড়ুন:
থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় ভ্রমণের ব্যাপারে বাংলাদেশি নাগরিকদের সতর্ক করেছে সরকার। স্ক্যাম চক্রের প্রতারণা এড়াতে নিয়োগ যাচাই এবং সাইবার নিরাপত্তা মেনে চলার পরামর্শ।
১ ঘণ্টা আগেহজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর তাঁদের অভ্যর্থনা জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, এবং আইওএমের কর্মকর্তারা। এ সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক মোস্তফা জামিল খান ফেরত আসা বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন।
৮ ঘণ্টা আগেজাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল, সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোট গ্রহণ, প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগসহ বিভিন্ন সুপারিশ করেছেন সংবাদপত্রের সম্পাদকেরা। গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন তাঁরা।
৮ ঘণ্টা আগেপরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান এখন সময়ের দাবি। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের চাওয়া দ্রুত নির্বাচন। এ অবস্থায় নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছেন দলগুলোর নেতারা। তাঁরা বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়
৮ ঘণ্টা আগে