বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
ডাক বিভাগের বৈদেশিক শাখায় তখন খুব চুরি হতো। ডিএইচএল বা ফেডএক্সের মতো আন্তর্জাতিক কুরিয়ার অত সহজলভ্য ছিল না। সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসা ছিল ডাক বিভাগের পার্সেল সার্ভিস। প্রবাসীরা পার্সেল সার্ভিসে যেসব পণ্য দেশে স্বজনদের কাছে পাঠাতেন, ডাক বিভাগের কিছু অসাধু কর্মচারী সেসবের কিছু কিছু অনায়াসে সাবাড় করে দিতেন। ছোটখাটো ঘটনা প্রায়ই ঘটত, তবে বড় চুরির ঘটনা হলে থানা-পুলিশ করা হতো। তখন ক্রাইম রিপোর্টাররাও খবর পেতেন।
এ রকম একটি চুরির ঘটনা কাভার করতে গেছি ডাক বিভাগের বৈদেশিক শাখায়। তো সব দেখেশুনে কর্মকর্তাদের বক্তব্য নিতে গেলাম ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেলের (ডিপিএমজি) রুমে। এই পদে তখন ছিলেন নামকরা রম্যলেখক আতাউর রহমান। তাঁর কক্ষের দরজা খোলা দেখে ঢুকে পড়লাম। তিনিও খুব ভালো ব্যবহার করলেন এবং সময় দিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
কথা শেষে বেরিয়ে আসার মুখে একটা ভিজিটিং কার্ড চাইলেন। মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে তাঁর হাতে দিতেই সেটার দিকে তাকিয়ে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন। ডান হাত দিয়ে টেবিলের ওপর একটি চাটি মেরে বেশ উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন, ‘আরে...আপনি ক্রাইম রিপোর্টার? আমি জীবনে প্রথম ক্রাইম রিপোর্টার দেখলাম। আমার ধারণা ছিল, ক্রাইম রিপোর্টাররা দেখতে চোর চোর!’
এ রকম একজন উচ্চপদস্থ আমলা ও লেখকের মুখে এমন কথা শুনে খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তো আমি দেখতে কী রকম?’ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে চট করে বলে দিলেন, ‘আপনি দেখতে বোকা বোকা।’
আমি ভেবেছিলাম, মুখের সামনে আমাকে নিয়ে হয়তো ভালো কিছু বলবেন। তখন বয়স কম, একটুতেই মন খারাপ হয়। সেই খারাপ মন নিয়ে অফিসে গিয়ে এক সহকর্মীকে বললাম। তিনি শুনে বললেন, ‘মন খারাপ কইরেন না। ক্রাইম রিপোর্টারদের ভাবমূর্তি অনেকটা পুলিশের মতো, কেউ ভালো চোখে দেখে না।’ এ ঘটনার বছর চারেক পরে এক শীর্ষ সন্ত্রাসীও আমাকে সেই একই কথা বলেছিলেন। সেবার অবশ্য অত মন খারাপ হয়নি।
সেই মন খারাপ নিয়ে পরদিন আবার গেলাম ডাক বিভাগে সেই বড় চুরির ঘটনার ফলোআপ করতে। আবারও সেই আতাউর রহমানের কক্ষে। তবে আগের দিনের চেয়ে তিনি আরও ভালো ব্যবহার করলেন। বায়তুল মোকাররম থেকে স্যান্ডউইচ আর লাচ্ছি এনে খাওয়ালেন। পাশে বসিয়ে এটা-সেটা জানতে চাইলেন। খুশি হয়ে বারবার বলছিলেন, আমার নিউজ তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। আমি একটু অবাক হলাম; কারণ, পুরো নিউজটা ছিল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ডিপিএমজি হিসেবে তার দায় আতাউর রহমানের ওপরও বর্তায়। সেই দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। কিন্তু তিনি সেসবে মাতলেন না। আমাকে বললেন, ‘আজ ডাক বিভাগের একটি মজার জিনিস আপনাকে দেখাব।’ বললাম, কী জিনিস? চলেন—বলেই তিনি হাঁটতে শুরু করলেন।
গুলিস্তানে জিপিও ভবনের ভেতরটা অনেকটা পুরোনো স্কুল ভবনের মতো। মাঝখানে বিশাল ফাঁকা জায়গা রেখে চারদিকে ভবন উঠেছে। বাইরে থেকে সেটা একেবারেই বোঝা যায় না। আতাউর রহমান বসতেন জিপিওর পূর্ব দিকে, যেটা বায়তুল মোকাররমের উল্টো দিকে। আর আমরা গেলাম পশ্চিম দিকের শেষ মাথার দোতলায়। সামনে আতাউর রহমান আর পেছনে আমি। যে কক্ষটির সামনে গেলাম, তার সামনে লেখা আরএলও—রিটার্ন লেটার অফিস। ডাক বিভাগে এর আগে আমি অনেকবার এসেছি, কিন্তু এ রকম কোনো বিভাগের নাম শুনিনি, দেখিনি। সেই অফিসের ভেতরে ডিপিএমজিকে দেখে হুলুস্থুল পড়ে গেল। তিনি আরএলওর ম্যানেজারকে ডেকে বললেন, আমি যা জানতে চাই, সব যেন বলা হয়। এরপর আমাকে তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বললেন, ‘আপনি কথা বলেন, সব বুঝতে পারবেন।’
আগেই বলেছি, আরএলও নিয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। প্রথমেই জানতে চাইলাম, এই অফিসের কাজ কী? ম্যানেজার আমাকে বললেন, সারা দেশের মানুষ যেসব চিঠি পাঠায়, সেগুলোর মধ্যে অনেক চিঠি কখনো প্রাপকের হাতে পৌঁছায় না ভুল বা অস্পষ্ট ঠিকানার কারণে। সেসব চিঠি ফেরত আসে জিপিওতে। আরএলও শাখা এসব চিঠি খুলে পড়ে দেখে, প্রাপক বা প্রেরকের নাম-ঠিকানা পেলে তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। আর কারও ঠিকানা না থাকলে সেই চিঠি বছর শেষে পুড়িয়ে ফেলা হয়। তখন চিঠির ভেতরে নানা পণ্য পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। ঠিকানাবিহীন সেসব পণ্য বছর শেষে নিলামে তোলা হয়। ম্যানেজারের কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। মনে হলো, এ নিয়ে ভালো একটি ফিচার হতে পারে—‘যে চিঠি কোনো দিন পৌঁছাবে না প্রাপকের হাতে’। ম্যানেজারকে বললাম, এই অফিসের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে চাই। ব্যবস্থা করে দিলেন।
ম্যানেজারের পাশের একটি কক্ষে ঢুকে দেখি বিশাল কক্ষটির টেবিলের ওপরে হাজার হাজার চিঠির স্তূপ। ছয়-সাতজন মিলে সেই সব চিঠি পড়ছেন। কথা শুনে বুঝলাম, এঁদের কাজই হলো চিঠি পড়া। সারা দিন ধরে তাঁরা শুধু মানুষের চিঠিই পড়েন। আমি কিছু চিঠি পড়তে চাইলে কেউ আপত্তি করলেন না। একটি চিঠির খামের ওপরে লেখা—তারিন, রোকেয়া হল। রোকেয়া হলের বহু তারিনের ভিড়ে প্রকৃত তারিনকে খুঁজে পায়নি ডাকপিয়ন। আরেক চিঠির ঠিকানা—গেদু চাচা, ঢাকা। একটির ঠিকানা মামুন, আজিমপুর; আরেকটির ঠিকানা তাহমিনা, বাসাবো। কেউ চিঠিতে পাঠিয়েছেন বিদেশি মুদ্রা, কেউবা ইমিটেশনের গয়না। নতুন স্ত্রীর জন্য শাড়ি-ব্লাউজ পাঠিয়েছেন একজন ভুল ঠিকানায়। এক প্রেমিকা প্রিয়জনের জন্য পাঠিয়েছেন সোহাগী ঠোঁটের লিপস্টিকের ছাপ। একজন রক্ত দিয়ে নাম লিখেছেন ‘ছালেহা’।
আরএলওর লোকেরা বললেন, প্রেমের বেশির ভাগ চিঠিতে থাকে ফুলের পাপড়ি, একটি বা দুটি করে। গ্রামের এক স্ত্রী অভিমান করে শহরের স্বামীকে লিখেছেন, ‘তুমি কেমন জানি হয়ে যাচ্ছ’। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছেন হারাগাছার রুবিনা। নোয়াখালীর জয়নাল শহরে চাকরিজীবী ছেলেকে লিখেছেন, ‘টাকা না পাঠালে আমরা না খেয়ে মরে যাব, বাবা’। কেউ একজন বোনের আত্মহত্যার খবর দিয়েছেন চিঠিতে। লেখাপড়া না জানা এক মায়ের পক্ষে একজন লিখেছেন, ‘তোমার মায়ের শরীরটা খুব খারাপ, দেখতে চাইলে শিগগির বাড়ি এসো’। চিঠিগুলো পড়তে পড়তে মন খারাপ হয়ে গেল।
এসব আকুতিভরা চিঠি পড়তে পড়তে পাশে বসা একজন চিঠি নিয়ে একটি মজার গল্পও শোনালেন। বললেন, কয়েক বছর আগে এক বেকার যুবক আকাশের ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তাতে লিখেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাকে তিন শ টাকা দাও, না দিলে আমি না খেয়ে মরে যাব।’ তো সেই চিঠি দেখে সবার দয়া হলো। তাঁরা ১০ টাকা করে চাঁদা তুলে ২০০ টাকা সেই যুবকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর আবার চিঠি এল। সেই যুবক এবার আল্লাহর কাছে লিখেছেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমার কষ্টের কথা শুনে ঠিকই ৩০০ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু ডাক বিভাগের চোরের দল তা থেকে ১০০ টাকা মেরে দিয়েছে।’ আমি এ চিঠির কথা শুনে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলাম।
আরএলও শাখা নিয়ে ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে একটি ফিচার ছাপা হয়েছিল জনকণ্ঠে। আতাউর রহমান সে জন্য ফোন করে ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন। তারপর অনেক বছর আর জিপিওতে যাওয়া হয়নি। বছর চারেক আগে বায়তুল মোকাররমের সামনে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা না পেয়ে ঢুকলাম জিপিওর ভেতরে, সেখানে অনেক জায়গা। মনে হলো একবার আরএলও শাখাটা ঘুরে আসি। গিয়ে দেখি, পুরো চিঠির দপ্তরটা একটা ভাঙা রঙ্গমঞ্চ। সব ফাঁকা, কোনো চিঠি নেই কারও হাতে। সবাই বললেন, বোনের আদরমাখা আর মায়ের আকুতিভরা চিঠি কেউ আর ডাক বিভাগে দেন না। হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ই-মেইলের যুগে আরএলও বড্ড সেকেলে হয়ে গেছে। মহাদেব সাহার মতো কেউ আর বলেন না, ‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বলো, ভালোবাসি’। মনে হলো, হাতে লেখা চিঠির যেন মৃত্যু ঘটেছে। শুধু শেষ যাত্রাটাই বাকি।
আরও পড়ুন:
ডাক বিভাগের বৈদেশিক শাখায় তখন খুব চুরি হতো। ডিএইচএল বা ফেডএক্সের মতো আন্তর্জাতিক কুরিয়ার অত সহজলভ্য ছিল না। সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসা ছিল ডাক বিভাগের পার্সেল সার্ভিস। প্রবাসীরা পার্সেল সার্ভিসে যেসব পণ্য দেশে স্বজনদের কাছে পাঠাতেন, ডাক বিভাগের কিছু অসাধু কর্মচারী সেসবের কিছু কিছু অনায়াসে সাবাড় করে দিতেন। ছোটখাটো ঘটনা প্রায়ই ঘটত, তবে বড় চুরির ঘটনা হলে থানা-পুলিশ করা হতো। তখন ক্রাইম রিপোর্টাররাও খবর পেতেন।
এ রকম একটি চুরির ঘটনা কাভার করতে গেছি ডাক বিভাগের বৈদেশিক শাখায়। তো সব দেখেশুনে কর্মকর্তাদের বক্তব্য নিতে গেলাম ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেলের (ডিপিএমজি) রুমে। এই পদে তখন ছিলেন নামকরা রম্যলেখক আতাউর রহমান। তাঁর কক্ষের দরজা খোলা দেখে ঢুকে পড়লাম। তিনিও খুব ভালো ব্যবহার করলেন এবং সময় দিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
কথা শেষে বেরিয়ে আসার মুখে একটা ভিজিটিং কার্ড চাইলেন। মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে তাঁর হাতে দিতেই সেটার দিকে তাকিয়ে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন। ডান হাত দিয়ে টেবিলের ওপর একটি চাটি মেরে বেশ উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন, ‘আরে...আপনি ক্রাইম রিপোর্টার? আমি জীবনে প্রথম ক্রাইম রিপোর্টার দেখলাম। আমার ধারণা ছিল, ক্রাইম রিপোর্টাররা দেখতে চোর চোর!’
এ রকম একজন উচ্চপদস্থ আমলা ও লেখকের মুখে এমন কথা শুনে খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তো আমি দেখতে কী রকম?’ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে চট করে বলে দিলেন, ‘আপনি দেখতে বোকা বোকা।’
আমি ভেবেছিলাম, মুখের সামনে আমাকে নিয়ে হয়তো ভালো কিছু বলবেন। তখন বয়স কম, একটুতেই মন খারাপ হয়। সেই খারাপ মন নিয়ে অফিসে গিয়ে এক সহকর্মীকে বললাম। তিনি শুনে বললেন, ‘মন খারাপ কইরেন না। ক্রাইম রিপোর্টারদের ভাবমূর্তি অনেকটা পুলিশের মতো, কেউ ভালো চোখে দেখে না।’ এ ঘটনার বছর চারেক পরে এক শীর্ষ সন্ত্রাসীও আমাকে সেই একই কথা বলেছিলেন। সেবার অবশ্য অত মন খারাপ হয়নি।
সেই মন খারাপ নিয়ে পরদিন আবার গেলাম ডাক বিভাগে সেই বড় চুরির ঘটনার ফলোআপ করতে। আবারও সেই আতাউর রহমানের কক্ষে। তবে আগের দিনের চেয়ে তিনি আরও ভালো ব্যবহার করলেন। বায়তুল মোকাররম থেকে স্যান্ডউইচ আর লাচ্ছি এনে খাওয়ালেন। পাশে বসিয়ে এটা-সেটা জানতে চাইলেন। খুশি হয়ে বারবার বলছিলেন, আমার নিউজ তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। আমি একটু অবাক হলাম; কারণ, পুরো নিউজটা ছিল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ডিপিএমজি হিসেবে তার দায় আতাউর রহমানের ওপরও বর্তায়। সেই দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। কিন্তু তিনি সেসবে মাতলেন না। আমাকে বললেন, ‘আজ ডাক বিভাগের একটি মজার জিনিস আপনাকে দেখাব।’ বললাম, কী জিনিস? চলেন—বলেই তিনি হাঁটতে শুরু করলেন।
গুলিস্তানে জিপিও ভবনের ভেতরটা অনেকটা পুরোনো স্কুল ভবনের মতো। মাঝখানে বিশাল ফাঁকা জায়গা রেখে চারদিকে ভবন উঠেছে। বাইরে থেকে সেটা একেবারেই বোঝা যায় না। আতাউর রহমান বসতেন জিপিওর পূর্ব দিকে, যেটা বায়তুল মোকাররমের উল্টো দিকে। আর আমরা গেলাম পশ্চিম দিকের শেষ মাথার দোতলায়। সামনে আতাউর রহমান আর পেছনে আমি। যে কক্ষটির সামনে গেলাম, তার সামনে লেখা আরএলও—রিটার্ন লেটার অফিস। ডাক বিভাগে এর আগে আমি অনেকবার এসেছি, কিন্তু এ রকম কোনো বিভাগের নাম শুনিনি, দেখিনি। সেই অফিসের ভেতরে ডিপিএমজিকে দেখে হুলুস্থুল পড়ে গেল। তিনি আরএলওর ম্যানেজারকে ডেকে বললেন, আমি যা জানতে চাই, সব যেন বলা হয়। এরপর আমাকে তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বললেন, ‘আপনি কথা বলেন, সব বুঝতে পারবেন।’
আগেই বলেছি, আরএলও নিয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। প্রথমেই জানতে চাইলাম, এই অফিসের কাজ কী? ম্যানেজার আমাকে বললেন, সারা দেশের মানুষ যেসব চিঠি পাঠায়, সেগুলোর মধ্যে অনেক চিঠি কখনো প্রাপকের হাতে পৌঁছায় না ভুল বা অস্পষ্ট ঠিকানার কারণে। সেসব চিঠি ফেরত আসে জিপিওতে। আরএলও শাখা এসব চিঠি খুলে পড়ে দেখে, প্রাপক বা প্রেরকের নাম-ঠিকানা পেলে তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। আর কারও ঠিকানা না থাকলে সেই চিঠি বছর শেষে পুড়িয়ে ফেলা হয়। তখন চিঠির ভেতরে নানা পণ্য পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। ঠিকানাবিহীন সেসব পণ্য বছর শেষে নিলামে তোলা হয়। ম্যানেজারের কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। মনে হলো, এ নিয়ে ভালো একটি ফিচার হতে পারে—‘যে চিঠি কোনো দিন পৌঁছাবে না প্রাপকের হাতে’। ম্যানেজারকে বললাম, এই অফিসের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে চাই। ব্যবস্থা করে দিলেন।
ম্যানেজারের পাশের একটি কক্ষে ঢুকে দেখি বিশাল কক্ষটির টেবিলের ওপরে হাজার হাজার চিঠির স্তূপ। ছয়-সাতজন মিলে সেই সব চিঠি পড়ছেন। কথা শুনে বুঝলাম, এঁদের কাজই হলো চিঠি পড়া। সারা দিন ধরে তাঁরা শুধু মানুষের চিঠিই পড়েন। আমি কিছু চিঠি পড়তে চাইলে কেউ আপত্তি করলেন না। একটি চিঠির খামের ওপরে লেখা—তারিন, রোকেয়া হল। রোকেয়া হলের বহু তারিনের ভিড়ে প্রকৃত তারিনকে খুঁজে পায়নি ডাকপিয়ন। আরেক চিঠির ঠিকানা—গেদু চাচা, ঢাকা। একটির ঠিকানা মামুন, আজিমপুর; আরেকটির ঠিকানা তাহমিনা, বাসাবো। কেউ চিঠিতে পাঠিয়েছেন বিদেশি মুদ্রা, কেউবা ইমিটেশনের গয়না। নতুন স্ত্রীর জন্য শাড়ি-ব্লাউজ পাঠিয়েছেন একজন ভুল ঠিকানায়। এক প্রেমিকা প্রিয়জনের জন্য পাঠিয়েছেন সোহাগী ঠোঁটের লিপস্টিকের ছাপ। একজন রক্ত দিয়ে নাম লিখেছেন ‘ছালেহা’।
আরএলওর লোকেরা বললেন, প্রেমের বেশির ভাগ চিঠিতে থাকে ফুলের পাপড়ি, একটি বা দুটি করে। গ্রামের এক স্ত্রী অভিমান করে শহরের স্বামীকে লিখেছেন, ‘তুমি কেমন জানি হয়ে যাচ্ছ’। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছেন হারাগাছার রুবিনা। নোয়াখালীর জয়নাল শহরে চাকরিজীবী ছেলেকে লিখেছেন, ‘টাকা না পাঠালে আমরা না খেয়ে মরে যাব, বাবা’। কেউ একজন বোনের আত্মহত্যার খবর দিয়েছেন চিঠিতে। লেখাপড়া না জানা এক মায়ের পক্ষে একজন লিখেছেন, ‘তোমার মায়ের শরীরটা খুব খারাপ, দেখতে চাইলে শিগগির বাড়ি এসো’। চিঠিগুলো পড়তে পড়তে মন খারাপ হয়ে গেল।
এসব আকুতিভরা চিঠি পড়তে পড়তে পাশে বসা একজন চিঠি নিয়ে একটি মজার গল্পও শোনালেন। বললেন, কয়েক বছর আগে এক বেকার যুবক আকাশের ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তাতে লিখেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাকে তিন শ টাকা দাও, না দিলে আমি না খেয়ে মরে যাব।’ তো সেই চিঠি দেখে সবার দয়া হলো। তাঁরা ১০ টাকা করে চাঁদা তুলে ২০০ টাকা সেই যুবকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর আবার চিঠি এল। সেই যুবক এবার আল্লাহর কাছে লিখেছেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমার কষ্টের কথা শুনে ঠিকই ৩০০ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু ডাক বিভাগের চোরের দল তা থেকে ১০০ টাকা মেরে দিয়েছে।’ আমি এ চিঠির কথা শুনে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলাম।
আরএলও শাখা নিয়ে ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে একটি ফিচার ছাপা হয়েছিল জনকণ্ঠে। আতাউর রহমান সে জন্য ফোন করে ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন। তারপর অনেক বছর আর জিপিওতে যাওয়া হয়নি। বছর চারেক আগে বায়তুল মোকাররমের সামনে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা না পেয়ে ঢুকলাম জিপিওর ভেতরে, সেখানে অনেক জায়গা। মনে হলো একবার আরএলও শাখাটা ঘুরে আসি। গিয়ে দেখি, পুরো চিঠির দপ্তরটা একটা ভাঙা রঙ্গমঞ্চ। সব ফাঁকা, কোনো চিঠি নেই কারও হাতে। সবাই বললেন, বোনের আদরমাখা আর মায়ের আকুতিভরা চিঠি কেউ আর ডাক বিভাগে দেন না। হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ই-মেইলের যুগে আরএলও বড্ড সেকেলে হয়ে গেছে। মহাদেব সাহার মতো কেউ আর বলেন না, ‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বলো, ভালোবাসি’। মনে হলো, হাতে লেখা চিঠির যেন মৃত্যু ঘটেছে। শুধু শেষ যাত্রাটাই বাকি।
আরও পড়ুন:
নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন ও অপর চার নির্বাচন কমিশনারের শপথ আগামী রোববার অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ রোববার বেলা দেড়টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে তাঁদের শপথ পাঠ করাবেন। সুপ্রিম কোর্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে এ কথা জানান।
২৩ মিনিট আগেনির্বাচনের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে সরকার বলে জানিয়েছেন ভূমি, পর্যটন ও বেসামরিক বিমান উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। আজ শুক্রবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিআইসিসিতে এশিয়ান আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা-২০২৪ পরিদর্শন শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা জানান।
১ ঘণ্টা আগেঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ভিসা আবেদনকারীদের জন্য নতুন ঘোষণা দিয়েছে। সহজ হয়েছে সাক্ষাৎকারবিহীন ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া। বিস্তারিত জানুন।
১ ঘণ্টা আগেথাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় ভ্রমণের ব্যাপারে বাংলাদেশি নাগরিকদের সতর্ক করেছে সরকার। স্ক্যাম চক্রের প্রতারণা এড়াতে নিয়োগ যাচাই এবং সাইবার নিরাপত্তা মেনে চলার পরামর্শ।
৩ ঘণ্টা আগে