দেশি মদও বোতলজাত করার অনুমতি কেরুকে

  • বিদ্যমান বিধি লঙ্ঘনের আশঙ্কা।
  • বিশেষ ভোক্তা শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
  • ‘সিন্ডিকেটের’ তৎপরতার অভিযোগ।
 শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা
আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭: ৪১
Thumbnail image
ছবি: সংগৃহীত

দেশের একমাত্র অ্যালকোহল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চুয়াডাঙায় অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানিকে দেশি মদ বোতলজাত করে বিক্রির অনুমতি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ব্রিটিশ আমল থেকে বিদ্যমান অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা পরিবর্তন ছাড়াই কর্তৃপক্ষ ‘তড়িঘড়ি করে’ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অনেকে বলছেন, কেরু চিঠি দেওয়ার এক মাস পরই তাদের এই অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা অস্বাভাবিক দ্রুত।

অনুমোদনে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি ১ লিটার ও আধা লিটারের বোতলে দেশি মদ বাজারজাত করতে পারবে বলে জানানো হয়েছে।

দেশি মদের প্রধান ভোক্তা ডোম, মেথর, মুচি ও চা-শ্রমিকদের মতো সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ। তাঁরা নির্ধারিত বিক্রয়কেন্দ্র থেকে খোলা মদ অল্প পরিমাণে কিনে থাকেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনুমোদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এসব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মতামত যাচাই করা হয়নি।

দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ব্যবস্থা অনুযায়ী সরকারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়িত্বে থাকা পণ্যাগারগুলো দেশি মদ বিক্রয়কেন্দ্রে সরবরাহ করে থাকে। সারা দেশে এমন ১১৪টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সেখান থেকে নিম্ন আয়ের ভোক্তারা ১৫০ গ্রাম বা ২৫০ গ্রাম করে দেশি মদ কিনতে পারেন। কিন্তু বোতলজাত করার ফলে দাম বেড়ে গেলে মদ তাঁদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে। এই শ্রেণির মানুষের ব্যক্তিগত বিনোদন বা সামাজিক উদ্‌যাপনের অপরিহার্য অঙ্গ দেশি মদ।

২০১৮ সালের অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার ৩০ অনুচ্ছেদের ৫ ধারা অনুযায়ী, উৎপাদিত দেশি মদ অধিদপ্তরের পণ্যাগারে পৌঁছানোর পর পানের উপযোগী করতে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় ‘গেজিং’ ও ‘প্লাম্বিং’ করা বাধ্যতামূলক। পণ্যাগারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এ কাজ করবেন বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। অধিদপ্তরের একটি সূত্র আজকের পত্রিকাকে বলেছে, কেরু কোম্পানি বোতলজাত দেশি মদ তৈরি করলে বর্তমান বিধিমালার আওতায় কীভাবে পণ্যটি পণ্যাগারে সরবরাহ ও পান করার উপযোগিতা পরীক্ষা করা যাবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।

প্লাস্টিকের বোতলে সরবরাহ করা হলে এর পরিবেশগত দিক নিয়েও কথা উঠতে পারে। এ ছাড়া বোতলের কারণে বাধ্যতামূলক আধা লিটার বা এক লিটার কিনতে হলে নিম্ন আয়ের ক্রেতাদের জন্য তা বোঝা হতে পারে।

অভিযোগ উঠেছে, অধিদপ্তর ও কেরু অ্যান্ড কোম্পানির কিছু কর্মকর্তার ‘সিন্ডিকেট’ অনেকটা গোপন তৎপরতার মাধ্যমে এই অনুমোদন আদায় করেছে। এতে কেরু কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ লাভবান হলেও অধিদপ্তরের দীর্ঘদিনের বিতরণব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্নভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভোক্তা শ্রেণির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেরুর দেশি মদ বোতলজাত করার সিদ্ধান্ত বা এর অনুমোদনের ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো সংগঠন বা প্রতিনিধির মতামত নেওয়া হয়নি। এর কারণে দেশি মদের দাম বাড়লে তাঁরা বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হতে পারেন। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এই জনগোষ্ঠী অন্যান্য ক্ষতিকর মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়ার পর এত দ্রুত দেশি মদ বোতলজাত করার অনুমতি পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাব্বিক হাসানের কাছে। তিনি অনুমতি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করলেও দ্রুতগতিতে অনুমতি পাওয়ার বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।

অধিদপ্তরের চুয়াডাঙ্গার সহকারী পরিচালক শিরিন আক্তার এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক উল্লেখ করে বলেন, এতে পানকারীরা ভেজালমুক্ত মদ পাবেন। সাময়িকভাবে কিছুটা অসন্তোষ দেখা দিলেও ভোক্তাদের জন্য এটি ভালো সিদ্ধান্ত।

অধিদপ্তরের অন্য কর্মকর্তারা বলেন, কেরুকে দেওয়া অনুমোদনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে। কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ নারকোটিকস কন্ট্রোল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএনসিএসএ) সভাপতি ও উপপরিচালক আবুল হোসেনের মতে, দেশি মদ বোতলজাত করার সিদ্ধান্তে কেরুর লাভ হলেও ভোক্তাদের জন্য তা কিছুটা অসুবিধাজনক। বিধিমালা পরিবর্তন ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত কীভাবে কার্যকর হবে, তা স্পষ্ট করতে পারেননি তিনি।

জানা গেছে, অধিদপ্তরের অধিকাংশ কর্মকর্তা মনে করেন, কেরুকে সুবিধা দিতে গোপন সিন্ডিকেট এই অনুমোদন আদায় করেছে। এর ফলে কোম্পানিটি লাভবান হলেও অধিদপ্তর তথা সরকার বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত