Ajker Patrika

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো ১০০ এজেন্সির পেটে ২৪ হাজার কোটি টাকা

  • দেড় বছরে পাঠানো হয় পৌনে পাঁচ লাখ কর্মী
  • জনপ্রতি অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে দেড় লাখ টাকা
  • ১০০ এজেন্সির চক্রে ছিলেন চার সাবেক এমপি
  • বঞ্চিত করা হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার এজেন্সিকে
মাহফুজুল ইসলাম, ঢাকা
আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮: ৫৫
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী পাঠিয়ে ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির চক্র দেড় বছরেই হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। প্রায় পৌনে ৫ লাখ কর্মীর কাছ থেকে অতিরিক্ত এই অর্থ নিয়ে নিজেদের পকেটে ভরেছে চক্রটি। চাহিদার বেশি কর্মী পাঠানোর অভিযোগও রয়েছে। এই অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বন্ধ হয়ে যায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শ্রমবাজার।

এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের চার সংসদ সদস্যের নামও এসেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতিমধ্যে সাবেক চার এমপির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তাঁরা হলেন সাবেক মন্ত্রী ও এমপি আ হ ম মুস্তফা কামাল, নিজাম উদ্দিন হাজারী, বেনজীর আহমেদ এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। প্রথম তিনজন আওয়ামী লীগের এবং মাসুদ উদ্দিন জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন।

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়ার এই তথ্য এসেছে ‘একটি উন্নয়ন বয়ানের ব্যবচ্ছেদ’ নামের শ্বেতপত্রে। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি সম্প্রতি দেশের অর্থনীতি নিয়ে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে, সেখানে এটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

জানতে চাইলে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য (অভিবাসন) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিগত সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে ২৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে দেশি-বিদেশিরাও যুক্ত ছিলেন।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেট মুভমেন্ট রিসার্চার ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, দেশে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ রিক্রুটিং এজেন্সি থাকলেও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর জন্য অনিয়মের মাধ্যমে মাত্র ১০০ এজেন্সিকে অনুমোদন দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। এই এজেন্সিগুলো প্রত্যেক শ্রমিকের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা অতিরিক্ত নিয়েছে। অনিয়মের কারণে পরে মালয়েশিয়া সরকার জনশক্তি নেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে।

শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বন্ধ হওয়ার পর ২০২১ সালে নতুন করে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়ে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে চুক্তি হয়। মালয়েশিয়ার দাতো আমিন (প্রবাসী) তাঁর নতুন এন্টারপ্রাইজ বেস্টিনেট ও সহযোগী ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফডব্লিউসিএমএস) মাধ্যমে তাঁর বাংলাদেশি সহযোগী রুহুল আমীনের সঙ্গে ১০ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট (চক্র) তৈরি করেন। পরে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সদস্যদের প্রতিবাদের মুখে ১০ জন থেকে বাড়িয়ে এটি ২৫ জন করা হয়। তৃতীয় দফায় এই চক্রের সদস্য আরও ৭৫ জন বাড়িয়ে ১০০ করা হয়। এই ১০০ এজেন্সিই শুধু মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে পারবে এমন নিয়মও করা হয়। এতে বঞ্চিত হয় বাকি ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ রিক্রুটিং এজেন্সি। বঞ্চিত এসব এজেন্সির কাছ থেকে কর্মী পাঠানো বাবদ জনপ্রতি অতিরিক্ত ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা আদায় করে চক্রটি।

শ্বেতপত্রে আরও বলা হয়, মালয়েশিয়া সরকার বিনা খরচে ৪ লাখ লোক নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুমোদন দেয়। কিন্তু ২০২২ সালের ৮ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ৪ লাখ ৭৮ হাজার শ্রমিককে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। প্রতি শ্রমিকের কাছ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা (৫ হাজার ৪৬ মার্কিন ডলার) নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে চক্রটি দুই বিলিয়নের বেশি মার্কিন ডলার বা ২৩ হাজার ৮৯৯ কোটি ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করে। এই টাকা এমআরটি-৬ (মেট্রোরেল)-এর প্রাথমিক বাজেটের দ্বিগুণ এবং চূড়ান্ত নির্মাণ ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ। কিন্তু এরপরও তৎকালীন সরকার দায়ী এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর সিন্ডিকেটে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক চার সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২৪ অক্টোবর সরকার মালয়েশিয়ার কাছে জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ জানায়, মানি লন্ডারিং, চাঁদাবাজি এবং অভিবাসীদের পাচারের অভিযোগে দাতো আমিন এবং রুহুল আমিনকে গ্রেপ্তার ও বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

তবে এই চক্রে কারা জড়িত, সে বিষয়ে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চক্রে রয়েছেন সাবেক চার এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ ও আ হ ম মুস্তফা কামাল। চক্রে থাকা দুটি প্রতিষ্ঠানের একটি সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের নামে, অন্যটি মেয়ে নাফিসা কামালের নামে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তাঁরা সবাই আত্মগোপনে আছেন। মুস্তফা কামাল সিঙ্গাপুরে আছেন বলে জানা গেছে।

রাঘববোয়ালদের চক্রের কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার হাতছাড়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার নামের রিক্রুটিং এজেন্সির ম্যানেজিং পার্টনার ফখরুল ইসলাম। তিনি বায়বার যুগ্ম সম্পাদক। তিনি বলেন, এফডব্লিউসিএমসি পদ্ধতির কারণে শ্রমিকের অর্থ লোপাট হয়েছে। জনপ্রতি ১ লাখ ৭ হাজার টাকা লোপাট করেছেন মন্ত্রী-এমপির লোকজন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আড়াই হাজার রিক্রুটিং এজেন্সির সব কটি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বায়রার এক সদস্য বলেন, শ্রমিকদের বিদেশ যেতে সরকার ৮০ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে জনপ্রতি সাড়ে ৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমদ, মুস্তফা কামাল, নিজাম উদ্দিন হাজারী, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদরা মিলে শ্রমিকদের টাকা লোপাট করেছেন। ভিসা, মেডিকেল এবং উড়োজাহাজ ভাড়া থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই দুর্নীতি করা হয়েছে। যেখানে ৫০ জনের কাজের জায়গা রয়েছে, সেখানে ৫০০ লোক নিয়েছে। ফলে সেখানে গিয়ে শ্রমিকেরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।

শ্বেতপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে বায়রার সাধারণ সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি উপকমিটির সদস্য আলী হায়দার চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, শ্বেতপত্রে অনিয়ম ও লুটপাটের কথা বলা হয়েছে। কিছু না কিছু লোপাট হয়েছে, এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। তবে কে বা কারা, কীভাবে অনিয়ম করেছে, তা বিস্তারিত বলা হয়নি। তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির কথা চিন্তা করে হলেও আমাদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি হলে ভালো হতো। কথা বললে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হতো, দেশবাসী সবকিছু জানতে পারত।’

দুদকের তথ্যমতে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে গঠিত চক্রে ঢুকে বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে চার সাবেক এমপির বিরুদ্ধে। চক্রটি দেড় বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে। দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি এই অভিযোগের অনুসন্ধান করবে। অভিযোগের বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে দুদক।

যে চার সাবেক এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকার পতনের পর তাঁরা আত্মগোপনে থাকায় কারও বক্তব্য নেওয়া যায়নি।

বিষয়টি জানতে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফরের সঙ্গে মোবাইলে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে পরিচয় দিয়ে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।

পরে বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক শাহ্ আবদুল তারিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকারের কাজ সরকার করবে। তিনি শ্বেতপত্রের বিষয়ে শ্বেতপত্র কমিটির কাছে জানতে পরামর্শ দেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মডেল মেঘনাকে আটকের দিনই ঢাকা ছাড়েন সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা

সৌদি রাষ্ট্রদূতের অভিযোগের ভিত্তিতেই মডেল মেঘনা কারাগারে

মডেল মেঘনার পরিবারের মাধ্যমে সুরাহার চেষ্টা করেছিল পুলিশ

হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি জানা যাবে মাত্র ৮০০ টাকার রক্ত পরীক্ষায়

জুলাই অভ্যুত্থান-সংক্রান্ত মামলায় ঊর্ধ্বতনের অনুমতি ছাড়া আসামি গ্রেপ্তার নয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত