জাহীদ রেজা নূর

জেলের ভেতর মুনীর চৌধুরী একটা চিরকুট পেলেন। রণেশ দাশগুপ্তের লেখা। সেটা ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাস। চিরকুটে মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য। একাঙ্কিকা। জেলের ভেতরেই যেন তার অভিনয় করা যায়, এ রকমভাবে লিখতে হবে।
মুনীর চৌধুরী এই অনুরোধটি রাখলেন এবং যা সৃষ্টি করলেন, তা হয়ে রইল আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অক্ষয় দলিল।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জেলখানাতেই নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল।
রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিলেন, সে কথায় কার কী এসে যায়?
দুই.
রণেশ দাশগুপ্ত ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটক লেখার জন্য মুনীর চৌধুরীকে চিঠিটি লিখেছিলেন কি স্বাধীন পাকিস্তানের মুক্ত ভূমি থেকে, নাকি তিনিও ছিলেন জেলে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, আমরা এই কমরেডের জীবনী পড়তে গেলে পাই যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর বিপজ্জনক বিবেচনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ছাড়া পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চার মাস পর আবার বন্দী হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চলছিল, তখন তিনি জেলেই ছিলেন। জেল থেকেই লিখেছিলেন এই চিরকুট। বিনা বিচারে আটক রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্ত মুক্তি লাভ করেছিলেন ১৯৫৫ সালে।
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠিত হলে অনেক কমিউনিস্টই সে দলে যোগ দেন। সে সময় রণেশ দাশগুপ্ত বামপন্থীদের পত্রিকা দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। যত দিন বাংলাদেশে ছিলেন, তত দিন দৈনিক সংবাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল।
তিন
ঢাকার সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়া ১৯৩৪ সাল থেকে। এর আগে ১৯৩১ সালে একবার ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সে সময় ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত সারা বাংলার কলেজছাত্রদের জন্য একটি প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। সে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেই পুরস্কার আনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
জীবনী লিখছি না। শুধু জানিয়ে রাখি, তাঁর জন্ম হয়েছিল ভারতের আসামের ডিব্রুগড়ে, ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। ডিব্রুগড় ছিল রণেশের মা ইন্দুপ্রভা (সেন) দাশগুপ্তের পিত্রালয়। ইন্দুপ্রভার বাবা কালীমোহন সেনের আদিনিবাস ছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে।
রণেশের বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। রাঁচিতেই তাঁর চাকরি হয়।
রণেশের ডাকনাম ছিল খোকা। রাঁচি জেলা স্কুল থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। বিজ্ঞানে পড়বেন বলে ভর্তি হন বাঁকুড়া খ্রিস্টিয়ান কলেজে। দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন আইএসসি। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে, সেখানে ব্রজমোহন কলেজ বা বিএম কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি।
বরিশালে তিনি উঠেছিলেন তাঁর জেঠু সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন রণেশ দাশগুপ্তের জেঠতুতো দাদা। এখানে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের চোখ পড়ে তাঁর দিকে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে ওঠেন। বিএ পাস না করেই ১৯৩৩ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বিক্রমপুরের বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। এর আগে বাবা আহত হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে বাবার মৃত্যু হলে তাঁরা চলে আসেন তাঁতীবাজারে।
৪
একবার যখন কলকাতায় এলেন, তখন যোগানন্দ জ্যাঠামশাই বললেন, তাঁর বউদিকে নিয়ে বরিশালে যেতে হবে। এই বউদি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী। শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেখানেই আসবেন বউদি। বউদিকে খুঁজতে খুঁজতে ট্রেনের একটা কামরার সামনে এলেন রণেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন যোগানন্দ দাশ। বউদি চোখ ইশারায় যোগানন্দ দাশকে প্রণাম করতে বললেন। রণেশ খুব উদ্ধত ছিলেন। প্রণাম তিনি করলেন না। যোগানন্দ দাশ বললেন, ‘ও কি প্রণাম করবে? ও তো বলশেভিক!’
রণেশ তখনো বলশেভিক ব্যাপারটি ভালোমতো জানতেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নে কিছু একটা হচ্ছে সে ব্যাপারটি বুঝতেন কিন্তু সেই দেশ থেকে খুব বেশি খবর আসত না।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি রণেশ দাশগুপ্তকে খুব আকৃষ্ট করে।
৫
রবীন্দ্রনাথের কথা আসায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সে সময় তিনি বরিশালে ছিলেন। কলেজ হোস্টেলে। রবীন্দ্রনাথের ৭০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। কলেজ হোস্টেলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রণেশ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা পড়লেন। তাতে বরিশালের নবীন কবি হিসেবে নাম হলো রণেশের। বিভিন্ন জায়গা থেকে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন।
একবার সরস্বতী সমাজের আমন্ত্রণে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে গিয়েছিলেন, সেটি ছিল গীতা জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। সে সভায় সভাপতি ছিলেন বরিশালের রাশভারী উকিল রায়বাহাদুর গণেশ দাশগুপ্ত। রণেশ তাঁর নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতা পাঠ করার সময় পেছন থেকে শুনতে পেলেন ‘ও মশায়’ ‘ও মশায়’ বলে চিৎকার। প্রথমে রণেশ বুঝতে পারেননি কে কাকে ডাকছে। পরে আরও কয়েকবার ডাকার পর পেছন ফিরে দেখলেন সভাপতি মশাই ডাকছেন। তিনি বলছেন, ‘এটা রাজনীতির সভা নয়, আপনি পড়া বন্ধ করুন।’
রণেশ কবিতায় বলছিলেন বিপ্লবের কথা এবং তা গীতার ভাষ্য হিসেবে। সভাপতির কথায় তিনি মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। দর্শক-শ্রোতারা সে কবিতা শুনতে চাইছিল। রণেশ চলে যাওয়ায় হল হয়ে গেল খালি। প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এলেন দর্শক-শ্রোতারা।
৬
বিভিন্ন সময়ে যেসব দাঙ্গা হয়েছে, রণেশ দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার এবং লেখায় তা নিয়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। মনোযোগী পাঠক সে সময়ের একটা চিত্র খুঁজে পাবেন তাতে। সে আলোচনায় না গিয়ে সাহিত্যে দাঙ্গাবিষয়ক যে ভাবনার জন্ম হচ্ছিল এবং তা অনুপ্রাণিত করেছিল রণেশ দাশগুপ্তকে, সে কথা বলি।
সোমেন চন্দের বিখ্যাত ‘দাঙ্গা’ গল্পটির কথা তো বলতেই হয়। বলতে হয় সমরেশ বসুর ‘আদাব’ নামের গল্পটির কথা। অসীম রায়ের ‘বিক্ষোভ’ উপন্যাসের কথা। সাদাত হাসান মান্টো, কীষণ চন্দর দাঙ্গা এবং দেশভাগ নিয়ে প্রচুর মহাকাব্যিক লেখা লিখেছেন। দাঙ্গার বিষয়ে জীবনানন্দ দাশের বেশ কিছু কালজয়ী কবিতা রয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ওপর শওকত ওসমানের লেখা ‘আর্তনাদ’ উপন্যাসটার কথাও বলতে হয়।
সে সময় পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু পরিবারগুলো দলে দলে চলে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। তেমনি মুসলিম পরিবারগুলো পশ্চিম বাংলা থেকে চলে এসেছিল পূর্ব বাংলায়। কলকাতা থেকে আসা বাঙালি মুসলমানেরা মূলত খুলনা, যশোর ও সৈয়দপুরে এসেছিলেন বেশি। সে সময়ের কিছু কথা রণেশ দাশগুপ্তের লেখায় মূর্ত হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশের নতুন ধরনের কবিতাগুলো মানুষকে পরিচিত গণ্ডির কবিতার আবেশ থেকে বের করে আনছিল। কিন্তু জীবনানন্দের গদ্য সম্ভারের সন্ধান তখনো পাওয়া যায়নি। জীবনানন্দ মার্ক্সিস্ট ছিলেন বলে কখনোই প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর অন্তত দুটি উপন্যাসে মার্ক্স, লেনিন ও কমিউনিস্টরা উঠে এসেছেন। উপন্যাস দুটির নাম ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ আর ‘জলপাইহাটি’। রণেশ দাশগুপ্তের ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ বইটিতে জীবনানন্দের এই দুটি উপন্যাস নিয়ে বৃহৎ আলোচনা আছে।
৭
‘দোটানা’ নামে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ বা ফিচার আছে রণেশ দাশগুপ্তের লেখা ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’ নামের বইটিতে। সরাসরি সাম্যবাদের কোনো কথা সেখানে নেই। কিন্তু বর্ণনার সহজতায় পাঠক বুঝে নিতে পারবেন রণেশ দাশগুপ্তের লেখার মর্মার্থ। প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন এ রকম:
‘বদলাব বদলাব করে সাত দিন ধরে পরা সার্ট পায়জামা বদলানো হয়নি। সার্টটার হাতে দুটো ভয়ানকভাবে ময়লা হয়ে গেছে। পাজামাটা চটের থলে। হলঘরে অতগুলি লোকের দশা কি হতে পারে, সে কথা না ভেবেই নেহায়েত স্বার্থপরের মত মনে মনে বললাম, “ধরণী দ্বিধা হও”।
‘মুশকিলটা হয়েছে এই যে, আজ অফিসে কাজে আসার সময়ও দুদিন আগে পরা সার্ট পাজামা ভয়ানক ময়লা লাগল। না বদলে পারলাম না। অথচ আসতে আসতে যেসব মেহনতি মানুষ চোখে পড়েছে, তাদের অনেকেরই গায়ে কাজের জামা, আধ ময়লা জামা, নোংরা জামা, ছেঁড়া জামা। একজন আমার চেনা। সে একজন ফিটার। তার গায়ে দেখলাম, তেল কালিমাখা একটা হাফসার্ট। অথচ আমি জানি, উৎসবের দিনে এই লোকটি যে পোশাক পরিচ্ছদ পরে তা যেমন রুচিসম্মত, তেমনি প্রদীপ্ত। মানায়ও তাকে। মনে হয়, এ সম্পূর্ণ পৃথক একটি লোক, এর কিন্তু কাজের জামা পরতে মোটেই দ্বিধা জাগে বলে মনে হয় না। স্বচ্ছন্দে চলে গেল বুক ফুলিয়ে মহানগরীর ভিড় ঠেলে।’
‘বড় দোটানায় পড়ে গিয়েছি। ভাবছি, পকেট এ কলম, তার বদলে যদি হাতে একটা হাতুড়ি আর কিছু করার থাকতো তাহলে সম্ভবত এমন ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হতাম না। হয়েছি কলমজীবী, না ঘরকা না ঘাটকা।'
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। আমার মনে হয়, এ সময় রণেশ দাশগুপ্ত বেঁচে থাকলে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরও কিছুটা পাল্টাত। মানুষ দিনে দিনে আরও বেশি চতুর, দুর্নীতিবাজ, তেলবাজ হয়ে উঠেছে, সেটা দেখে তিনি হয়তো আরও বেশি কষ্ট পেতেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর যে বিশ্বাস ছিল, সে বিশ্বাসে আঘাত আসত কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যাঁরা পোড় খাওয়া মন ও শরীর নিয়ে পার্টি করে গেছেন, তাঁদের অনেকেই জীবিতাবস্থায় পার্টির নতুন নেতৃত্বের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তার ব্যতিক্রম নয়। নয়া নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে যেভাবে দল চালিয়েছেন, তাতে আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে বড়সড় ভাবনা থাকলেও নিজ দেশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আলোচনার বাইরে। অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রণেশ দাশগুপ্তদের মতো গুণী মানুষদের এড়িয়ে।
একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক জগতে ঝ্দানোভ চালিয়েছিলেন এক বীভৎস পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সৃজনশীলতার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন। লেখক, সাহিত্যিক, কবি পার্টির নির্দেশে লেখালেখি করতেন। সৃজনশীল মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় আঘাত আর কিছুই হতে পারে না। এই বীভৎসতার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তার বিষে জর্জরিত হয়েছিল খোলা মনের মানুষ। এখন নানাভাবে সেই বীভৎসতার চিত্রগুলো তুলে আনা হচ্ছে। কিন্তু সে সময় এই নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির পক্ষেই গুণগান গাইছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতারা। ভারতবর্ষেও সেই চপেটাঘাত পড়েছিল। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ নামে যে অশ্বডিম্বটি পাড়া হয়েছিল, সেটি যে মানবিক বিকাশের অন্তরায়, সে কথা বুঝতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। এ কারণেই বুঝি কমরেড ফরহাদ যখন ‘নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তখন তার সমালোচনা করতে হলো সনজীদা খাতুনকে।
সন্জীদা খাতুন তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি লেখার আগে রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো কোনো কথা জিজ্ঞেস করে না।’
কিন্তু পার্টির প্রতি অগাধ মমত্বের কারণে তিনি মলিনমুখে বলেছিলেন, ‘সেম সাইড হয়ে যায় না?’ অর্থাৎ কমরেড ফরহাদের লেখার বিরুদ্ধে সন্জীদা খাতুন লিখলে সেটা পার্টি লাইনের বাইরের কিছু হয় কি না, সে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি।
সে সময় যদি প্রতিবাদ করতেন তিনি বা তাঁর মতো বিচক্ষণ মানুষেরা, তাহলে পার্টি হয়তো তাঁদের দিকনির্দেশনায় ঋদ্ধ হতে পারত।
৮
রণেশ দাশগুপ্তের অসাধারণ একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ নামের বইয়ে। প্রবন্ধটির নাম, ‘বাংলাদেশ নয় এ মধুর খেলা রচয়িত্রীরা’।
মূলত বাংলাদেশের নারী লেখকদের নিয়ে প্রবন্ধটি। বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমামকে নিয়ে যখন তিনি এই প্রবন্ধ লিখছেন, তখন প্রথমজনের বয়স ৯২ এবং দ্বিতীয়জনের ৮২। এখন বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ বিভাজন মানা হয় না। সে সময় মানা হতো বলে লেখার শব্দগুলোকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। তিনি লিখছেন, ‘বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমাম।... এই দুই প্রবীণা বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিভাবিকারূপে বিবেচিতা। বেগম সুফিয়া কামাল বিশ্বের দশক থেকেই বিশিষ্টা কবি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিষ্যা ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা সুফিয়া কামাল বরাবরই প্রগতিবাদিনী। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকা। যে মুক্তি ধারায় স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটল, তার সঙ্গে আপন চিন্তাভাবনা ও নারী সমাজের অন্তরঙ্গতা ও একাত্মতা প্রকাশের সহজ সরল বাণীরূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার জগত।... বেগম জাহানারা ইমাম ’৪৬-এ কলকাতা লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। রংপুরের মেয়ে জাহানারা ইমাম দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলায় চলে যান এবং বিবাহিত সাংসারিক জীবনযাপন করেন স্কুলশিক্ষকের কাজের পাশাপাশি। এই অবস্থান থেকেই বেগম জাহানারা ইমাম বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ও ব্যাপক গণহত্যা পতাকাবাহী নিরুপায় সামনে এসে গিয়েছেন।’
এ দুজনের কথা বলার পর রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে। তিনি লিখছেন, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত কলাম বইটিতে লেনিনের অনুসারী কমিউনিস্টদের যে উল্লেখ রয়েছে, তাতে কমিউনিস্টদের পুরুষ হিসেবে দেখিয়ে নারীদের ভালো-মন্দের প্রতি উদাসীন বলে ধিক্কার দেয়া হয়েছে। ঊনিশ শতকের জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলকে নারীর ভোটাধিকার বিরোধী বলে উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু কলকাতা থেকে প্রকাশিত “নির্বাচিত কলাম” বইটিতে “যাব না কেন? যাব”কে যুক্ত করে যে সার্বিক বা পরিপূরক বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে, তাতে ’৯০-৯১–এর সমাজতন্ত্রের সংকট ও লেনিনের অবমাননার এক বিস্ময়কর আবেগময় প্রস্তাবনা বেরিয়ে এসেছে লেখিকার কলম থেকে। এ ধরনের বক্তব্যকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি বলে মনে করে নিলে ভুল হবে। এই কলামটিতে তসলিমা নাসরিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনে লেনিনের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় শোকাহত মস্তক অবনত করেছেন।’
এরপর তিনি লেখক মতিয়া চৌধুরীর কথা বলেছেন। স্বনামধন্য এই রাজনীতির মানুষটি ষাটের দশকের শেষে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দৈনিক সংবাদে তিনি ধারাবাহিকভাবে জেলের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘মতিয়া চৌধুরী প্রধানত বাংলাদেশের বিপ্লবের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রতিনিধিরূপে বাংলাদেশের মুক্তির ধারাভাষ্য উপস্থিত করেছেন মুখ্যত বিশাল বিশাল জনসমাবেশ প্রদত্ত ভাষণে। সেই কারণে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে তার কোনো ভাষ্যকে পাওয়া যাবে না, তবে তার লেখা কারা কাহিনীটি দলিত বঞ্চিত নারী জীবনের ছবি দেশবাসীকে বিবেকের কাছে তীব্র ও তীক্ষ্ণতাবোধ উপস্থিত করেছিল।’
এরপর তিনি বলেছেন মালেকা বেগমের কথা, সেলিনা হোসেনের কথা, পান্না কায়সারের কথা।
এই প্রবন্ধটি পাঠ করতে বলব শুধু এই কারণে যে একজন লেখক তাঁর পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে নির্মোহ ভঙ্গিতে কীভাবে কোনো বই বা মানুষের বিশ্লেষণ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
৯
অগাধ পড়াশোনা করেছেন তিনি। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই ছিলেন পারদর্শী। রাজনীতির মাঠে তিনি একজন নান্দনিক শিল্পী। সংস্কৃতিই ছিল তাঁর শক্তিমত্তার বড় জায়গা। রাজনীতির কথা বলতে গেলে ১৯৫৮ সালের মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনের কথা বলতে হয়। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ৩৫টি পদের মধ্যে ২৫টিতে জয়ী হয় মুসলিম লীগ, বাকি পদগুলো পায় আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল।
একটি মাত্র পদে নির্বাচিত হয় কমিউনিস্ট প্রার্থী। নির্বাচিত প্রার্থীর নাম রণেশ দাশগুপ্ত।
১০.
বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তির আরেকটি অসামান্য কাজের কথা বলে লেখাটি শেষ করব।
তাঁর ছদ্মনাম ছিল জমিল শরাফী। দৈনিক সংবাদে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি বিভিন্ন বই সম্পাদনা করতেন। ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংকলন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল জমিল শরাফীর সম্পাদনায়।
তবে দাদা জীবনানন্দ দাশের ওপর বই সম্পাদনা করেছেন তিনি স্বনামেই। ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার’ নামের বইটিই ছিল বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চার প্রথম উদ্যোগ। এই বইটিতেই জীবনানন্দের পুরো কাব্যসম্ভার এক মলাটের মধ্যে পায় বাংলাদেশের অধিবাসীরা।
১১
১৯৭৫ সালে এ দেশের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তা দেখেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। সে বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি ফিরতি বিমান টিকিটসহ কলকাতায় গিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড। কলকাতায় থাকা অবস্থাতেই নভেম্বরের জেলহত্যার কথা শুনতে পান। বন্ধুরা এ সময় তাঁকে বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করেন। সেই থেকে শুরু হয় কলকাতার জীবন। কিন্তু নিজেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষ ভাবতেই পছন্দ করতেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। ভারতীয় সরকারের কোনো ভাতা নেননি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। অনেক ঠিকানা বদলের পর তাঁর থাকার জায়গা হয় লেনিন স্কুলে। কায়ক্লেশে সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। বাংলাদেশ-ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। ঢাকায়ই হয় তাঁর শেষকৃত্য। তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হলে শহীদ মিনারে বিপুল জনসমাগম হয়।

জেলের ভেতর মুনীর চৌধুরী একটা চিরকুট পেলেন। রণেশ দাশগুপ্তের লেখা। সেটা ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাস। চিরকুটে মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য। একাঙ্কিকা। জেলের ভেতরেই যেন তার অভিনয় করা যায়, এ রকমভাবে লিখতে হবে।
মুনীর চৌধুরী এই অনুরোধটি রাখলেন এবং যা সৃষ্টি করলেন, তা হয়ে রইল আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অক্ষয় দলিল।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জেলখানাতেই নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল।
রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিলেন, সে কথায় কার কী এসে যায়?
দুই.
রণেশ দাশগুপ্ত ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটক লেখার জন্য মুনীর চৌধুরীকে চিঠিটি লিখেছিলেন কি স্বাধীন পাকিস্তানের মুক্ত ভূমি থেকে, নাকি তিনিও ছিলেন জেলে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, আমরা এই কমরেডের জীবনী পড়তে গেলে পাই যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর বিপজ্জনক বিবেচনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ছাড়া পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চার মাস পর আবার বন্দী হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চলছিল, তখন তিনি জেলেই ছিলেন। জেল থেকেই লিখেছিলেন এই চিরকুট। বিনা বিচারে আটক রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্ত মুক্তি লাভ করেছিলেন ১৯৫৫ সালে।
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠিত হলে অনেক কমিউনিস্টই সে দলে যোগ দেন। সে সময় রণেশ দাশগুপ্ত বামপন্থীদের পত্রিকা দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। যত দিন বাংলাদেশে ছিলেন, তত দিন দৈনিক সংবাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল।
তিন
ঢাকার সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়া ১৯৩৪ সাল থেকে। এর আগে ১৯৩১ সালে একবার ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সে সময় ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত সারা বাংলার কলেজছাত্রদের জন্য একটি প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। সে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেই পুরস্কার আনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
জীবনী লিখছি না। শুধু জানিয়ে রাখি, তাঁর জন্ম হয়েছিল ভারতের আসামের ডিব্রুগড়ে, ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। ডিব্রুগড় ছিল রণেশের মা ইন্দুপ্রভা (সেন) দাশগুপ্তের পিত্রালয়। ইন্দুপ্রভার বাবা কালীমোহন সেনের আদিনিবাস ছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে।
রণেশের বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। রাঁচিতেই তাঁর চাকরি হয়।
রণেশের ডাকনাম ছিল খোকা। রাঁচি জেলা স্কুল থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। বিজ্ঞানে পড়বেন বলে ভর্তি হন বাঁকুড়া খ্রিস্টিয়ান কলেজে। দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন আইএসসি। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে, সেখানে ব্রজমোহন কলেজ বা বিএম কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি।
বরিশালে তিনি উঠেছিলেন তাঁর জেঠু সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন রণেশ দাশগুপ্তের জেঠতুতো দাদা। এখানে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের চোখ পড়ে তাঁর দিকে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে ওঠেন। বিএ পাস না করেই ১৯৩৩ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বিক্রমপুরের বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। এর আগে বাবা আহত হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে বাবার মৃত্যু হলে তাঁরা চলে আসেন তাঁতীবাজারে।
৪
একবার যখন কলকাতায় এলেন, তখন যোগানন্দ জ্যাঠামশাই বললেন, তাঁর বউদিকে নিয়ে বরিশালে যেতে হবে। এই বউদি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী। শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেখানেই আসবেন বউদি। বউদিকে খুঁজতে খুঁজতে ট্রেনের একটা কামরার সামনে এলেন রণেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন যোগানন্দ দাশ। বউদি চোখ ইশারায় যোগানন্দ দাশকে প্রণাম করতে বললেন। রণেশ খুব উদ্ধত ছিলেন। প্রণাম তিনি করলেন না। যোগানন্দ দাশ বললেন, ‘ও কি প্রণাম করবে? ও তো বলশেভিক!’
রণেশ তখনো বলশেভিক ব্যাপারটি ভালোমতো জানতেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নে কিছু একটা হচ্ছে সে ব্যাপারটি বুঝতেন কিন্তু সেই দেশ থেকে খুব বেশি খবর আসত না।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি রণেশ দাশগুপ্তকে খুব আকৃষ্ট করে।
৫
রবীন্দ্রনাথের কথা আসায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সে সময় তিনি বরিশালে ছিলেন। কলেজ হোস্টেলে। রবীন্দ্রনাথের ৭০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। কলেজ হোস্টেলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রণেশ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা পড়লেন। তাতে বরিশালের নবীন কবি হিসেবে নাম হলো রণেশের। বিভিন্ন জায়গা থেকে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন।
একবার সরস্বতী সমাজের আমন্ত্রণে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে গিয়েছিলেন, সেটি ছিল গীতা জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। সে সভায় সভাপতি ছিলেন বরিশালের রাশভারী উকিল রায়বাহাদুর গণেশ দাশগুপ্ত। রণেশ তাঁর নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতা পাঠ করার সময় পেছন থেকে শুনতে পেলেন ‘ও মশায়’ ‘ও মশায়’ বলে চিৎকার। প্রথমে রণেশ বুঝতে পারেননি কে কাকে ডাকছে। পরে আরও কয়েকবার ডাকার পর পেছন ফিরে দেখলেন সভাপতি মশাই ডাকছেন। তিনি বলছেন, ‘এটা রাজনীতির সভা নয়, আপনি পড়া বন্ধ করুন।’
রণেশ কবিতায় বলছিলেন বিপ্লবের কথা এবং তা গীতার ভাষ্য হিসেবে। সভাপতির কথায় তিনি মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। দর্শক-শ্রোতারা সে কবিতা শুনতে চাইছিল। রণেশ চলে যাওয়ায় হল হয়ে গেল খালি। প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এলেন দর্শক-শ্রোতারা।
৬
বিভিন্ন সময়ে যেসব দাঙ্গা হয়েছে, রণেশ দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার এবং লেখায় তা নিয়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। মনোযোগী পাঠক সে সময়ের একটা চিত্র খুঁজে পাবেন তাতে। সে আলোচনায় না গিয়ে সাহিত্যে দাঙ্গাবিষয়ক যে ভাবনার জন্ম হচ্ছিল এবং তা অনুপ্রাণিত করেছিল রণেশ দাশগুপ্তকে, সে কথা বলি।
সোমেন চন্দের বিখ্যাত ‘দাঙ্গা’ গল্পটির কথা তো বলতেই হয়। বলতে হয় সমরেশ বসুর ‘আদাব’ নামের গল্পটির কথা। অসীম রায়ের ‘বিক্ষোভ’ উপন্যাসের কথা। সাদাত হাসান মান্টো, কীষণ চন্দর দাঙ্গা এবং দেশভাগ নিয়ে প্রচুর মহাকাব্যিক লেখা লিখেছেন। দাঙ্গার বিষয়ে জীবনানন্দ দাশের বেশ কিছু কালজয়ী কবিতা রয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ওপর শওকত ওসমানের লেখা ‘আর্তনাদ’ উপন্যাসটার কথাও বলতে হয়।
সে সময় পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু পরিবারগুলো দলে দলে চলে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। তেমনি মুসলিম পরিবারগুলো পশ্চিম বাংলা থেকে চলে এসেছিল পূর্ব বাংলায়। কলকাতা থেকে আসা বাঙালি মুসলমানেরা মূলত খুলনা, যশোর ও সৈয়দপুরে এসেছিলেন বেশি। সে সময়ের কিছু কথা রণেশ দাশগুপ্তের লেখায় মূর্ত হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশের নতুন ধরনের কবিতাগুলো মানুষকে পরিচিত গণ্ডির কবিতার আবেশ থেকে বের করে আনছিল। কিন্তু জীবনানন্দের গদ্য সম্ভারের সন্ধান তখনো পাওয়া যায়নি। জীবনানন্দ মার্ক্সিস্ট ছিলেন বলে কখনোই প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর অন্তত দুটি উপন্যাসে মার্ক্স, লেনিন ও কমিউনিস্টরা উঠে এসেছেন। উপন্যাস দুটির নাম ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ আর ‘জলপাইহাটি’। রণেশ দাশগুপ্তের ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ বইটিতে জীবনানন্দের এই দুটি উপন্যাস নিয়ে বৃহৎ আলোচনা আছে।
৭
‘দোটানা’ নামে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ বা ফিচার আছে রণেশ দাশগুপ্তের লেখা ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’ নামের বইটিতে। সরাসরি সাম্যবাদের কোনো কথা সেখানে নেই। কিন্তু বর্ণনার সহজতায় পাঠক বুঝে নিতে পারবেন রণেশ দাশগুপ্তের লেখার মর্মার্থ। প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন এ রকম:
‘বদলাব বদলাব করে সাত দিন ধরে পরা সার্ট পায়জামা বদলানো হয়নি। সার্টটার হাতে দুটো ভয়ানকভাবে ময়লা হয়ে গেছে। পাজামাটা চটের থলে। হলঘরে অতগুলি লোকের দশা কি হতে পারে, সে কথা না ভেবেই নেহায়েত স্বার্থপরের মত মনে মনে বললাম, “ধরণী দ্বিধা হও”।
‘মুশকিলটা হয়েছে এই যে, আজ অফিসে কাজে আসার সময়ও দুদিন আগে পরা সার্ট পাজামা ভয়ানক ময়লা লাগল। না বদলে পারলাম না। অথচ আসতে আসতে যেসব মেহনতি মানুষ চোখে পড়েছে, তাদের অনেকেরই গায়ে কাজের জামা, আধ ময়লা জামা, নোংরা জামা, ছেঁড়া জামা। একজন আমার চেনা। সে একজন ফিটার। তার গায়ে দেখলাম, তেল কালিমাখা একটা হাফসার্ট। অথচ আমি জানি, উৎসবের দিনে এই লোকটি যে পোশাক পরিচ্ছদ পরে তা যেমন রুচিসম্মত, তেমনি প্রদীপ্ত। মানায়ও তাকে। মনে হয়, এ সম্পূর্ণ পৃথক একটি লোক, এর কিন্তু কাজের জামা পরতে মোটেই দ্বিধা জাগে বলে মনে হয় না। স্বচ্ছন্দে চলে গেল বুক ফুলিয়ে মহানগরীর ভিড় ঠেলে।’
‘বড় দোটানায় পড়ে গিয়েছি। ভাবছি, পকেট এ কলম, তার বদলে যদি হাতে একটা হাতুড়ি আর কিছু করার থাকতো তাহলে সম্ভবত এমন ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হতাম না। হয়েছি কলমজীবী, না ঘরকা না ঘাটকা।'
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। আমার মনে হয়, এ সময় রণেশ দাশগুপ্ত বেঁচে থাকলে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরও কিছুটা পাল্টাত। মানুষ দিনে দিনে আরও বেশি চতুর, দুর্নীতিবাজ, তেলবাজ হয়ে উঠেছে, সেটা দেখে তিনি হয়তো আরও বেশি কষ্ট পেতেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর যে বিশ্বাস ছিল, সে বিশ্বাসে আঘাত আসত কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যাঁরা পোড় খাওয়া মন ও শরীর নিয়ে পার্টি করে গেছেন, তাঁদের অনেকেই জীবিতাবস্থায় পার্টির নতুন নেতৃত্বের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তার ব্যতিক্রম নয়। নয়া নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে যেভাবে দল চালিয়েছেন, তাতে আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে বড়সড় ভাবনা থাকলেও নিজ দেশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আলোচনার বাইরে। অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রণেশ দাশগুপ্তদের মতো গুণী মানুষদের এড়িয়ে।
একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক জগতে ঝ্দানোভ চালিয়েছিলেন এক বীভৎস পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সৃজনশীলতার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন। লেখক, সাহিত্যিক, কবি পার্টির নির্দেশে লেখালেখি করতেন। সৃজনশীল মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় আঘাত আর কিছুই হতে পারে না। এই বীভৎসতার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তার বিষে জর্জরিত হয়েছিল খোলা মনের মানুষ। এখন নানাভাবে সেই বীভৎসতার চিত্রগুলো তুলে আনা হচ্ছে। কিন্তু সে সময় এই নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির পক্ষেই গুণগান গাইছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতারা। ভারতবর্ষেও সেই চপেটাঘাত পড়েছিল। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ নামে যে অশ্বডিম্বটি পাড়া হয়েছিল, সেটি যে মানবিক বিকাশের অন্তরায়, সে কথা বুঝতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। এ কারণেই বুঝি কমরেড ফরহাদ যখন ‘নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তখন তার সমালোচনা করতে হলো সনজীদা খাতুনকে।
সন্জীদা খাতুন তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি লেখার আগে রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো কোনো কথা জিজ্ঞেস করে না।’
কিন্তু পার্টির প্রতি অগাধ মমত্বের কারণে তিনি মলিনমুখে বলেছিলেন, ‘সেম সাইড হয়ে যায় না?’ অর্থাৎ কমরেড ফরহাদের লেখার বিরুদ্ধে সন্জীদা খাতুন লিখলে সেটা পার্টি লাইনের বাইরের কিছু হয় কি না, সে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি।
সে সময় যদি প্রতিবাদ করতেন তিনি বা তাঁর মতো বিচক্ষণ মানুষেরা, তাহলে পার্টি হয়তো তাঁদের দিকনির্দেশনায় ঋদ্ধ হতে পারত।
৮
রণেশ দাশগুপ্তের অসাধারণ একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ নামের বইয়ে। প্রবন্ধটির নাম, ‘বাংলাদেশ নয় এ মধুর খেলা রচয়িত্রীরা’।
মূলত বাংলাদেশের নারী লেখকদের নিয়ে প্রবন্ধটি। বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমামকে নিয়ে যখন তিনি এই প্রবন্ধ লিখছেন, তখন প্রথমজনের বয়স ৯২ এবং দ্বিতীয়জনের ৮২। এখন বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ বিভাজন মানা হয় না। সে সময় মানা হতো বলে লেখার শব্দগুলোকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। তিনি লিখছেন, ‘বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমাম।... এই দুই প্রবীণা বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিভাবিকারূপে বিবেচিতা। বেগম সুফিয়া কামাল বিশ্বের দশক থেকেই বিশিষ্টা কবি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিষ্যা ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা সুফিয়া কামাল বরাবরই প্রগতিবাদিনী। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকা। যে মুক্তি ধারায় স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটল, তার সঙ্গে আপন চিন্তাভাবনা ও নারী সমাজের অন্তরঙ্গতা ও একাত্মতা প্রকাশের সহজ সরল বাণীরূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার জগত।... বেগম জাহানারা ইমাম ’৪৬-এ কলকাতা লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। রংপুরের মেয়ে জাহানারা ইমাম দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলায় চলে যান এবং বিবাহিত সাংসারিক জীবনযাপন করেন স্কুলশিক্ষকের কাজের পাশাপাশি। এই অবস্থান থেকেই বেগম জাহানারা ইমাম বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ও ব্যাপক গণহত্যা পতাকাবাহী নিরুপায় সামনে এসে গিয়েছেন।’
এ দুজনের কথা বলার পর রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে। তিনি লিখছেন, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত কলাম বইটিতে লেনিনের অনুসারী কমিউনিস্টদের যে উল্লেখ রয়েছে, তাতে কমিউনিস্টদের পুরুষ হিসেবে দেখিয়ে নারীদের ভালো-মন্দের প্রতি উদাসীন বলে ধিক্কার দেয়া হয়েছে। ঊনিশ শতকের জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলকে নারীর ভোটাধিকার বিরোধী বলে উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু কলকাতা থেকে প্রকাশিত “নির্বাচিত কলাম” বইটিতে “যাব না কেন? যাব”কে যুক্ত করে যে সার্বিক বা পরিপূরক বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে, তাতে ’৯০-৯১–এর সমাজতন্ত্রের সংকট ও লেনিনের অবমাননার এক বিস্ময়কর আবেগময় প্রস্তাবনা বেরিয়ে এসেছে লেখিকার কলম থেকে। এ ধরনের বক্তব্যকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি বলে মনে করে নিলে ভুল হবে। এই কলামটিতে তসলিমা নাসরিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনে লেনিনের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় শোকাহত মস্তক অবনত করেছেন।’
এরপর তিনি লেখক মতিয়া চৌধুরীর কথা বলেছেন। স্বনামধন্য এই রাজনীতির মানুষটি ষাটের দশকের শেষে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দৈনিক সংবাদে তিনি ধারাবাহিকভাবে জেলের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘মতিয়া চৌধুরী প্রধানত বাংলাদেশের বিপ্লবের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রতিনিধিরূপে বাংলাদেশের মুক্তির ধারাভাষ্য উপস্থিত করেছেন মুখ্যত বিশাল বিশাল জনসমাবেশ প্রদত্ত ভাষণে। সেই কারণে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে তার কোনো ভাষ্যকে পাওয়া যাবে না, তবে তার লেখা কারা কাহিনীটি দলিত বঞ্চিত নারী জীবনের ছবি দেশবাসীকে বিবেকের কাছে তীব্র ও তীক্ষ্ণতাবোধ উপস্থিত করেছিল।’
এরপর তিনি বলেছেন মালেকা বেগমের কথা, সেলিনা হোসেনের কথা, পান্না কায়সারের কথা।
এই প্রবন্ধটি পাঠ করতে বলব শুধু এই কারণে যে একজন লেখক তাঁর পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে নির্মোহ ভঙ্গিতে কীভাবে কোনো বই বা মানুষের বিশ্লেষণ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
৯
অগাধ পড়াশোনা করেছেন তিনি। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই ছিলেন পারদর্শী। রাজনীতির মাঠে তিনি একজন নান্দনিক শিল্পী। সংস্কৃতিই ছিল তাঁর শক্তিমত্তার বড় জায়গা। রাজনীতির কথা বলতে গেলে ১৯৫৮ সালের মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনের কথা বলতে হয়। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ৩৫টি পদের মধ্যে ২৫টিতে জয়ী হয় মুসলিম লীগ, বাকি পদগুলো পায় আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল।
একটি মাত্র পদে নির্বাচিত হয় কমিউনিস্ট প্রার্থী। নির্বাচিত প্রার্থীর নাম রণেশ দাশগুপ্ত।
১০.
বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তির আরেকটি অসামান্য কাজের কথা বলে লেখাটি শেষ করব।
তাঁর ছদ্মনাম ছিল জমিল শরাফী। দৈনিক সংবাদে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি বিভিন্ন বই সম্পাদনা করতেন। ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংকলন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল জমিল শরাফীর সম্পাদনায়।
তবে দাদা জীবনানন্দ দাশের ওপর বই সম্পাদনা করেছেন তিনি স্বনামেই। ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার’ নামের বইটিই ছিল বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চার প্রথম উদ্যোগ। এই বইটিতেই জীবনানন্দের পুরো কাব্যসম্ভার এক মলাটের মধ্যে পায় বাংলাদেশের অধিবাসীরা।
১১
১৯৭৫ সালে এ দেশের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তা দেখেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। সে বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি ফিরতি বিমান টিকিটসহ কলকাতায় গিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড। কলকাতায় থাকা অবস্থাতেই নভেম্বরের জেলহত্যার কথা শুনতে পান। বন্ধুরা এ সময় তাঁকে বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করেন। সেই থেকে শুরু হয় কলকাতার জীবন। কিন্তু নিজেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষ ভাবতেই পছন্দ করতেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। ভারতীয় সরকারের কোনো ভাতা নেননি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। অনেক ঠিকানা বদলের পর তাঁর থাকার জায়গা হয় লেনিন স্কুলে। কায়ক্লেশে সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। বাংলাদেশ-ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। ঢাকায়ই হয় তাঁর শেষকৃত্য। তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হলে শহীদ মিনারে বিপুল জনসমাগম হয়।
জাহীদ রেজা নূর

জেলের ভেতর মুনীর চৌধুরী একটা চিরকুট পেলেন। রণেশ দাশগুপ্তের লেখা। সেটা ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাস। চিরকুটে মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য। একাঙ্কিকা। জেলের ভেতরেই যেন তার অভিনয় করা যায়, এ রকমভাবে লিখতে হবে।
মুনীর চৌধুরী এই অনুরোধটি রাখলেন এবং যা সৃষ্টি করলেন, তা হয়ে রইল আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অক্ষয় দলিল।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জেলখানাতেই নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল।
রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিলেন, সে কথায় কার কী এসে যায়?
দুই.
রণেশ দাশগুপ্ত ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটক লেখার জন্য মুনীর চৌধুরীকে চিঠিটি লিখেছিলেন কি স্বাধীন পাকিস্তানের মুক্ত ভূমি থেকে, নাকি তিনিও ছিলেন জেলে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, আমরা এই কমরেডের জীবনী পড়তে গেলে পাই যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর বিপজ্জনক বিবেচনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ছাড়া পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চার মাস পর আবার বন্দী হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চলছিল, তখন তিনি জেলেই ছিলেন। জেল থেকেই লিখেছিলেন এই চিরকুট। বিনা বিচারে আটক রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্ত মুক্তি লাভ করেছিলেন ১৯৫৫ সালে।
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠিত হলে অনেক কমিউনিস্টই সে দলে যোগ দেন। সে সময় রণেশ দাশগুপ্ত বামপন্থীদের পত্রিকা দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। যত দিন বাংলাদেশে ছিলেন, তত দিন দৈনিক সংবাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল।
তিন
ঢাকার সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়া ১৯৩৪ সাল থেকে। এর আগে ১৯৩১ সালে একবার ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সে সময় ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত সারা বাংলার কলেজছাত্রদের জন্য একটি প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। সে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেই পুরস্কার আনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
জীবনী লিখছি না। শুধু জানিয়ে রাখি, তাঁর জন্ম হয়েছিল ভারতের আসামের ডিব্রুগড়ে, ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। ডিব্রুগড় ছিল রণেশের মা ইন্দুপ্রভা (সেন) দাশগুপ্তের পিত্রালয়। ইন্দুপ্রভার বাবা কালীমোহন সেনের আদিনিবাস ছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে।
রণেশের বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। রাঁচিতেই তাঁর চাকরি হয়।
রণেশের ডাকনাম ছিল খোকা। রাঁচি জেলা স্কুল থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। বিজ্ঞানে পড়বেন বলে ভর্তি হন বাঁকুড়া খ্রিস্টিয়ান কলেজে। দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন আইএসসি। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে, সেখানে ব্রজমোহন কলেজ বা বিএম কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি।
বরিশালে তিনি উঠেছিলেন তাঁর জেঠু সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন রণেশ দাশগুপ্তের জেঠতুতো দাদা। এখানে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের চোখ পড়ে তাঁর দিকে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে ওঠেন। বিএ পাস না করেই ১৯৩৩ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বিক্রমপুরের বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। এর আগে বাবা আহত হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে বাবার মৃত্যু হলে তাঁরা চলে আসেন তাঁতীবাজারে।
৪
একবার যখন কলকাতায় এলেন, তখন যোগানন্দ জ্যাঠামশাই বললেন, তাঁর বউদিকে নিয়ে বরিশালে যেতে হবে। এই বউদি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী। শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেখানেই আসবেন বউদি। বউদিকে খুঁজতে খুঁজতে ট্রেনের একটা কামরার সামনে এলেন রণেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন যোগানন্দ দাশ। বউদি চোখ ইশারায় যোগানন্দ দাশকে প্রণাম করতে বললেন। রণেশ খুব উদ্ধত ছিলেন। প্রণাম তিনি করলেন না। যোগানন্দ দাশ বললেন, ‘ও কি প্রণাম করবে? ও তো বলশেভিক!’
রণেশ তখনো বলশেভিক ব্যাপারটি ভালোমতো জানতেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নে কিছু একটা হচ্ছে সে ব্যাপারটি বুঝতেন কিন্তু সেই দেশ থেকে খুব বেশি খবর আসত না।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি রণেশ দাশগুপ্তকে খুব আকৃষ্ট করে।
৫
রবীন্দ্রনাথের কথা আসায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সে সময় তিনি বরিশালে ছিলেন। কলেজ হোস্টেলে। রবীন্দ্রনাথের ৭০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। কলেজ হোস্টেলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রণেশ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা পড়লেন। তাতে বরিশালের নবীন কবি হিসেবে নাম হলো রণেশের। বিভিন্ন জায়গা থেকে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন।
একবার সরস্বতী সমাজের আমন্ত্রণে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে গিয়েছিলেন, সেটি ছিল গীতা জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। সে সভায় সভাপতি ছিলেন বরিশালের রাশভারী উকিল রায়বাহাদুর গণেশ দাশগুপ্ত। রণেশ তাঁর নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতা পাঠ করার সময় পেছন থেকে শুনতে পেলেন ‘ও মশায়’ ‘ও মশায়’ বলে চিৎকার। প্রথমে রণেশ বুঝতে পারেননি কে কাকে ডাকছে। পরে আরও কয়েকবার ডাকার পর পেছন ফিরে দেখলেন সভাপতি মশাই ডাকছেন। তিনি বলছেন, ‘এটা রাজনীতির সভা নয়, আপনি পড়া বন্ধ করুন।’
রণেশ কবিতায় বলছিলেন বিপ্লবের কথা এবং তা গীতার ভাষ্য হিসেবে। সভাপতির কথায় তিনি মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। দর্শক-শ্রোতারা সে কবিতা শুনতে চাইছিল। রণেশ চলে যাওয়ায় হল হয়ে গেল খালি। প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এলেন দর্শক-শ্রোতারা।
৬
বিভিন্ন সময়ে যেসব দাঙ্গা হয়েছে, রণেশ দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার এবং লেখায় তা নিয়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। মনোযোগী পাঠক সে সময়ের একটা চিত্র খুঁজে পাবেন তাতে। সে আলোচনায় না গিয়ে সাহিত্যে দাঙ্গাবিষয়ক যে ভাবনার জন্ম হচ্ছিল এবং তা অনুপ্রাণিত করেছিল রণেশ দাশগুপ্তকে, সে কথা বলি।
সোমেন চন্দের বিখ্যাত ‘দাঙ্গা’ গল্পটির কথা তো বলতেই হয়। বলতে হয় সমরেশ বসুর ‘আদাব’ নামের গল্পটির কথা। অসীম রায়ের ‘বিক্ষোভ’ উপন্যাসের কথা। সাদাত হাসান মান্টো, কীষণ চন্দর দাঙ্গা এবং দেশভাগ নিয়ে প্রচুর মহাকাব্যিক লেখা লিখেছেন। দাঙ্গার বিষয়ে জীবনানন্দ দাশের বেশ কিছু কালজয়ী কবিতা রয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ওপর শওকত ওসমানের লেখা ‘আর্তনাদ’ উপন্যাসটার কথাও বলতে হয়।
সে সময় পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু পরিবারগুলো দলে দলে চলে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। তেমনি মুসলিম পরিবারগুলো পশ্চিম বাংলা থেকে চলে এসেছিল পূর্ব বাংলায়। কলকাতা থেকে আসা বাঙালি মুসলমানেরা মূলত খুলনা, যশোর ও সৈয়দপুরে এসেছিলেন বেশি। সে সময়ের কিছু কথা রণেশ দাশগুপ্তের লেখায় মূর্ত হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশের নতুন ধরনের কবিতাগুলো মানুষকে পরিচিত গণ্ডির কবিতার আবেশ থেকে বের করে আনছিল। কিন্তু জীবনানন্দের গদ্য সম্ভারের সন্ধান তখনো পাওয়া যায়নি। জীবনানন্দ মার্ক্সিস্ট ছিলেন বলে কখনোই প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর অন্তত দুটি উপন্যাসে মার্ক্স, লেনিন ও কমিউনিস্টরা উঠে এসেছেন। উপন্যাস দুটির নাম ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ আর ‘জলপাইহাটি’। রণেশ দাশগুপ্তের ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ বইটিতে জীবনানন্দের এই দুটি উপন্যাস নিয়ে বৃহৎ আলোচনা আছে।
৭
‘দোটানা’ নামে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ বা ফিচার আছে রণেশ দাশগুপ্তের লেখা ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’ নামের বইটিতে। সরাসরি সাম্যবাদের কোনো কথা সেখানে নেই। কিন্তু বর্ণনার সহজতায় পাঠক বুঝে নিতে পারবেন রণেশ দাশগুপ্তের লেখার মর্মার্থ। প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন এ রকম:
‘বদলাব বদলাব করে সাত দিন ধরে পরা সার্ট পায়জামা বদলানো হয়নি। সার্টটার হাতে দুটো ভয়ানকভাবে ময়লা হয়ে গেছে। পাজামাটা চটের থলে। হলঘরে অতগুলি লোকের দশা কি হতে পারে, সে কথা না ভেবেই নেহায়েত স্বার্থপরের মত মনে মনে বললাম, “ধরণী দ্বিধা হও”।
‘মুশকিলটা হয়েছে এই যে, আজ অফিসে কাজে আসার সময়ও দুদিন আগে পরা সার্ট পাজামা ভয়ানক ময়লা লাগল। না বদলে পারলাম না। অথচ আসতে আসতে যেসব মেহনতি মানুষ চোখে পড়েছে, তাদের অনেকেরই গায়ে কাজের জামা, আধ ময়লা জামা, নোংরা জামা, ছেঁড়া জামা। একজন আমার চেনা। সে একজন ফিটার। তার গায়ে দেখলাম, তেল কালিমাখা একটা হাফসার্ট। অথচ আমি জানি, উৎসবের দিনে এই লোকটি যে পোশাক পরিচ্ছদ পরে তা যেমন রুচিসম্মত, তেমনি প্রদীপ্ত। মানায়ও তাকে। মনে হয়, এ সম্পূর্ণ পৃথক একটি লোক, এর কিন্তু কাজের জামা পরতে মোটেই দ্বিধা জাগে বলে মনে হয় না। স্বচ্ছন্দে চলে গেল বুক ফুলিয়ে মহানগরীর ভিড় ঠেলে।’
‘বড় দোটানায় পড়ে গিয়েছি। ভাবছি, পকেট এ কলম, তার বদলে যদি হাতে একটা হাতুড়ি আর কিছু করার থাকতো তাহলে সম্ভবত এমন ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হতাম না। হয়েছি কলমজীবী, না ঘরকা না ঘাটকা।'
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। আমার মনে হয়, এ সময় রণেশ দাশগুপ্ত বেঁচে থাকলে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরও কিছুটা পাল্টাত। মানুষ দিনে দিনে আরও বেশি চতুর, দুর্নীতিবাজ, তেলবাজ হয়ে উঠেছে, সেটা দেখে তিনি হয়তো আরও বেশি কষ্ট পেতেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর যে বিশ্বাস ছিল, সে বিশ্বাসে আঘাত আসত কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যাঁরা পোড় খাওয়া মন ও শরীর নিয়ে পার্টি করে গেছেন, তাঁদের অনেকেই জীবিতাবস্থায় পার্টির নতুন নেতৃত্বের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তার ব্যতিক্রম নয়। নয়া নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে যেভাবে দল চালিয়েছেন, তাতে আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে বড়সড় ভাবনা থাকলেও নিজ দেশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আলোচনার বাইরে। অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রণেশ দাশগুপ্তদের মতো গুণী মানুষদের এড়িয়ে।
একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক জগতে ঝ্দানোভ চালিয়েছিলেন এক বীভৎস পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সৃজনশীলতার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন। লেখক, সাহিত্যিক, কবি পার্টির নির্দেশে লেখালেখি করতেন। সৃজনশীল মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় আঘাত আর কিছুই হতে পারে না। এই বীভৎসতার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তার বিষে জর্জরিত হয়েছিল খোলা মনের মানুষ। এখন নানাভাবে সেই বীভৎসতার চিত্রগুলো তুলে আনা হচ্ছে। কিন্তু সে সময় এই নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির পক্ষেই গুণগান গাইছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতারা। ভারতবর্ষেও সেই চপেটাঘাত পড়েছিল। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ নামে যে অশ্বডিম্বটি পাড়া হয়েছিল, সেটি যে মানবিক বিকাশের অন্তরায়, সে কথা বুঝতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। এ কারণেই বুঝি কমরেড ফরহাদ যখন ‘নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তখন তার সমালোচনা করতে হলো সনজীদা খাতুনকে।
সন্জীদা খাতুন তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি লেখার আগে রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো কোনো কথা জিজ্ঞেস করে না।’
কিন্তু পার্টির প্রতি অগাধ মমত্বের কারণে তিনি মলিনমুখে বলেছিলেন, ‘সেম সাইড হয়ে যায় না?’ অর্থাৎ কমরেড ফরহাদের লেখার বিরুদ্ধে সন্জীদা খাতুন লিখলে সেটা পার্টি লাইনের বাইরের কিছু হয় কি না, সে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি।
সে সময় যদি প্রতিবাদ করতেন তিনি বা তাঁর মতো বিচক্ষণ মানুষেরা, তাহলে পার্টি হয়তো তাঁদের দিকনির্দেশনায় ঋদ্ধ হতে পারত।
৮
রণেশ দাশগুপ্তের অসাধারণ একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ নামের বইয়ে। প্রবন্ধটির নাম, ‘বাংলাদেশ নয় এ মধুর খেলা রচয়িত্রীরা’।
মূলত বাংলাদেশের নারী লেখকদের নিয়ে প্রবন্ধটি। বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমামকে নিয়ে যখন তিনি এই প্রবন্ধ লিখছেন, তখন প্রথমজনের বয়স ৯২ এবং দ্বিতীয়জনের ৮২। এখন বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ বিভাজন মানা হয় না। সে সময় মানা হতো বলে লেখার শব্দগুলোকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। তিনি লিখছেন, ‘বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমাম।... এই দুই প্রবীণা বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিভাবিকারূপে বিবেচিতা। বেগম সুফিয়া কামাল বিশ্বের দশক থেকেই বিশিষ্টা কবি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিষ্যা ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা সুফিয়া কামাল বরাবরই প্রগতিবাদিনী। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকা। যে মুক্তি ধারায় স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটল, তার সঙ্গে আপন চিন্তাভাবনা ও নারী সমাজের অন্তরঙ্গতা ও একাত্মতা প্রকাশের সহজ সরল বাণীরূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার জগত।... বেগম জাহানারা ইমাম ’৪৬-এ কলকাতা লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। রংপুরের মেয়ে জাহানারা ইমাম দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলায় চলে যান এবং বিবাহিত সাংসারিক জীবনযাপন করেন স্কুলশিক্ষকের কাজের পাশাপাশি। এই অবস্থান থেকেই বেগম জাহানারা ইমাম বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ও ব্যাপক গণহত্যা পতাকাবাহী নিরুপায় সামনে এসে গিয়েছেন।’
এ দুজনের কথা বলার পর রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে। তিনি লিখছেন, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত কলাম বইটিতে লেনিনের অনুসারী কমিউনিস্টদের যে উল্লেখ রয়েছে, তাতে কমিউনিস্টদের পুরুষ হিসেবে দেখিয়ে নারীদের ভালো-মন্দের প্রতি উদাসীন বলে ধিক্কার দেয়া হয়েছে। ঊনিশ শতকের জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলকে নারীর ভোটাধিকার বিরোধী বলে উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু কলকাতা থেকে প্রকাশিত “নির্বাচিত কলাম” বইটিতে “যাব না কেন? যাব”কে যুক্ত করে যে সার্বিক বা পরিপূরক বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে, তাতে ’৯০-৯১–এর সমাজতন্ত্রের সংকট ও লেনিনের অবমাননার এক বিস্ময়কর আবেগময় প্রস্তাবনা বেরিয়ে এসেছে লেখিকার কলম থেকে। এ ধরনের বক্তব্যকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি বলে মনে করে নিলে ভুল হবে। এই কলামটিতে তসলিমা নাসরিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনে লেনিনের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় শোকাহত মস্তক অবনত করেছেন।’
এরপর তিনি লেখক মতিয়া চৌধুরীর কথা বলেছেন। স্বনামধন্য এই রাজনীতির মানুষটি ষাটের দশকের শেষে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দৈনিক সংবাদে তিনি ধারাবাহিকভাবে জেলের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘মতিয়া চৌধুরী প্রধানত বাংলাদেশের বিপ্লবের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রতিনিধিরূপে বাংলাদেশের মুক্তির ধারাভাষ্য উপস্থিত করেছেন মুখ্যত বিশাল বিশাল জনসমাবেশ প্রদত্ত ভাষণে। সেই কারণে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে তার কোনো ভাষ্যকে পাওয়া যাবে না, তবে তার লেখা কারা কাহিনীটি দলিত বঞ্চিত নারী জীবনের ছবি দেশবাসীকে বিবেকের কাছে তীব্র ও তীক্ষ্ণতাবোধ উপস্থিত করেছিল।’
এরপর তিনি বলেছেন মালেকা বেগমের কথা, সেলিনা হোসেনের কথা, পান্না কায়সারের কথা।
এই প্রবন্ধটি পাঠ করতে বলব শুধু এই কারণে যে একজন লেখক তাঁর পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে নির্মোহ ভঙ্গিতে কীভাবে কোনো বই বা মানুষের বিশ্লেষণ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
৯
অগাধ পড়াশোনা করেছেন তিনি। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই ছিলেন পারদর্শী। রাজনীতির মাঠে তিনি একজন নান্দনিক শিল্পী। সংস্কৃতিই ছিল তাঁর শক্তিমত্তার বড় জায়গা। রাজনীতির কথা বলতে গেলে ১৯৫৮ সালের মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনের কথা বলতে হয়। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ৩৫টি পদের মধ্যে ২৫টিতে জয়ী হয় মুসলিম লীগ, বাকি পদগুলো পায় আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল।
একটি মাত্র পদে নির্বাচিত হয় কমিউনিস্ট প্রার্থী। নির্বাচিত প্রার্থীর নাম রণেশ দাশগুপ্ত।
১০.
বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তির আরেকটি অসামান্য কাজের কথা বলে লেখাটি শেষ করব।
তাঁর ছদ্মনাম ছিল জমিল শরাফী। দৈনিক সংবাদে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি বিভিন্ন বই সম্পাদনা করতেন। ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংকলন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল জমিল শরাফীর সম্পাদনায়।
তবে দাদা জীবনানন্দ দাশের ওপর বই সম্পাদনা করেছেন তিনি স্বনামেই। ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার’ নামের বইটিই ছিল বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চার প্রথম উদ্যোগ। এই বইটিতেই জীবনানন্দের পুরো কাব্যসম্ভার এক মলাটের মধ্যে পায় বাংলাদেশের অধিবাসীরা।
১১
১৯৭৫ সালে এ দেশের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তা দেখেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। সে বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি ফিরতি বিমান টিকিটসহ কলকাতায় গিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড। কলকাতায় থাকা অবস্থাতেই নভেম্বরের জেলহত্যার কথা শুনতে পান। বন্ধুরা এ সময় তাঁকে বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করেন। সেই থেকে শুরু হয় কলকাতার জীবন। কিন্তু নিজেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষ ভাবতেই পছন্দ করতেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। ভারতীয় সরকারের কোনো ভাতা নেননি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। অনেক ঠিকানা বদলের পর তাঁর থাকার জায়গা হয় লেনিন স্কুলে। কায়ক্লেশে সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। বাংলাদেশ-ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। ঢাকায়ই হয় তাঁর শেষকৃত্য। তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হলে শহীদ মিনারে বিপুল জনসমাগম হয়।

জেলের ভেতর মুনীর চৌধুরী একটা চিরকুট পেলেন। রণেশ দাশগুপ্তের লেখা। সেটা ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাস। চিরকুটে মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য। একাঙ্কিকা। জেলের ভেতরেই যেন তার অভিনয় করা যায়, এ রকমভাবে লিখতে হবে।
মুনীর চৌধুরী এই অনুরোধটি রাখলেন এবং যা সৃষ্টি করলেন, তা হয়ে রইল আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অক্ষয় দলিল।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জেলখানাতেই নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল।
রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিলেন, সে কথায় কার কী এসে যায়?
দুই.
রণেশ দাশগুপ্ত ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটক লেখার জন্য মুনীর চৌধুরীকে চিঠিটি লিখেছিলেন কি স্বাধীন পাকিস্তানের মুক্ত ভূমি থেকে, নাকি তিনিও ছিলেন জেলে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, আমরা এই কমরেডের জীবনী পড়তে গেলে পাই যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর বিপজ্জনক বিবেচনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ছাড়া পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চার মাস পর আবার বন্দী হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চলছিল, তখন তিনি জেলেই ছিলেন। জেল থেকেই লিখেছিলেন এই চিরকুট। বিনা বিচারে আটক রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্ত মুক্তি লাভ করেছিলেন ১৯৫৫ সালে।
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠিত হলে অনেক কমিউনিস্টই সে দলে যোগ দেন। সে সময় রণেশ দাশগুপ্ত বামপন্থীদের পত্রিকা দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। যত দিন বাংলাদেশে ছিলেন, তত দিন দৈনিক সংবাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল।
তিন
ঢাকার সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়া ১৯৩৪ সাল থেকে। এর আগে ১৯৩১ সালে একবার ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সে সময় ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত সারা বাংলার কলেজছাত্রদের জন্য একটি প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। সে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেই পুরস্কার আনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
জীবনী লিখছি না। শুধু জানিয়ে রাখি, তাঁর জন্ম হয়েছিল ভারতের আসামের ডিব্রুগড়ে, ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। ডিব্রুগড় ছিল রণেশের মা ইন্দুপ্রভা (সেন) দাশগুপ্তের পিত্রালয়। ইন্দুপ্রভার বাবা কালীমোহন সেনের আদিনিবাস ছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে।
রণেশের বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। রাঁচিতেই তাঁর চাকরি হয়।
রণেশের ডাকনাম ছিল খোকা। রাঁচি জেলা স্কুল থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। বিজ্ঞানে পড়বেন বলে ভর্তি হন বাঁকুড়া খ্রিস্টিয়ান কলেজে। দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন আইএসসি। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে, সেখানে ব্রজমোহন কলেজ বা বিএম কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি।
বরিশালে তিনি উঠেছিলেন তাঁর জেঠু সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন রণেশ দাশগুপ্তের জেঠতুতো দাদা। এখানে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের চোখ পড়ে তাঁর দিকে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে ওঠেন। বিএ পাস না করেই ১৯৩৩ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বিক্রমপুরের বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। এর আগে বাবা আহত হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে বাবার মৃত্যু হলে তাঁরা চলে আসেন তাঁতীবাজারে।
৪
একবার যখন কলকাতায় এলেন, তখন যোগানন্দ জ্যাঠামশাই বললেন, তাঁর বউদিকে নিয়ে বরিশালে যেতে হবে। এই বউদি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী। শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেখানেই আসবেন বউদি। বউদিকে খুঁজতে খুঁজতে ট্রেনের একটা কামরার সামনে এলেন রণেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন যোগানন্দ দাশ। বউদি চোখ ইশারায় যোগানন্দ দাশকে প্রণাম করতে বললেন। রণেশ খুব উদ্ধত ছিলেন। প্রণাম তিনি করলেন না। যোগানন্দ দাশ বললেন, ‘ও কি প্রণাম করবে? ও তো বলশেভিক!’
রণেশ তখনো বলশেভিক ব্যাপারটি ভালোমতো জানতেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নে কিছু একটা হচ্ছে সে ব্যাপারটি বুঝতেন কিন্তু সেই দেশ থেকে খুব বেশি খবর আসত না।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি রণেশ দাশগুপ্তকে খুব আকৃষ্ট করে।
৫
রবীন্দ্রনাথের কথা আসায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সে সময় তিনি বরিশালে ছিলেন। কলেজ হোস্টেলে। রবীন্দ্রনাথের ৭০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। কলেজ হোস্টেলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রণেশ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা পড়লেন। তাতে বরিশালের নবীন কবি হিসেবে নাম হলো রণেশের। বিভিন্ন জায়গা থেকে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন।
একবার সরস্বতী সমাজের আমন্ত্রণে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে গিয়েছিলেন, সেটি ছিল গীতা জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। সে সভায় সভাপতি ছিলেন বরিশালের রাশভারী উকিল রায়বাহাদুর গণেশ দাশগুপ্ত। রণেশ তাঁর নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতা পাঠ করার সময় পেছন থেকে শুনতে পেলেন ‘ও মশায়’ ‘ও মশায়’ বলে চিৎকার। প্রথমে রণেশ বুঝতে পারেননি কে কাকে ডাকছে। পরে আরও কয়েকবার ডাকার পর পেছন ফিরে দেখলেন সভাপতি মশাই ডাকছেন। তিনি বলছেন, ‘এটা রাজনীতির সভা নয়, আপনি পড়া বন্ধ করুন।’
রণেশ কবিতায় বলছিলেন বিপ্লবের কথা এবং তা গীতার ভাষ্য হিসেবে। সভাপতির কথায় তিনি মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। দর্শক-শ্রোতারা সে কবিতা শুনতে চাইছিল। রণেশ চলে যাওয়ায় হল হয়ে গেল খালি। প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এলেন দর্শক-শ্রোতারা।
৬
বিভিন্ন সময়ে যেসব দাঙ্গা হয়েছে, রণেশ দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার এবং লেখায় তা নিয়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। মনোযোগী পাঠক সে সময়ের একটা চিত্র খুঁজে পাবেন তাতে। সে আলোচনায় না গিয়ে সাহিত্যে দাঙ্গাবিষয়ক যে ভাবনার জন্ম হচ্ছিল এবং তা অনুপ্রাণিত করেছিল রণেশ দাশগুপ্তকে, সে কথা বলি।
সোমেন চন্দের বিখ্যাত ‘দাঙ্গা’ গল্পটির কথা তো বলতেই হয়। বলতে হয় সমরেশ বসুর ‘আদাব’ নামের গল্পটির কথা। অসীম রায়ের ‘বিক্ষোভ’ উপন্যাসের কথা। সাদাত হাসান মান্টো, কীষণ চন্দর দাঙ্গা এবং দেশভাগ নিয়ে প্রচুর মহাকাব্যিক লেখা লিখেছেন। দাঙ্গার বিষয়ে জীবনানন্দ দাশের বেশ কিছু কালজয়ী কবিতা রয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ওপর শওকত ওসমানের লেখা ‘আর্তনাদ’ উপন্যাসটার কথাও বলতে হয়।
সে সময় পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু পরিবারগুলো দলে দলে চলে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। তেমনি মুসলিম পরিবারগুলো পশ্চিম বাংলা থেকে চলে এসেছিল পূর্ব বাংলায়। কলকাতা থেকে আসা বাঙালি মুসলমানেরা মূলত খুলনা, যশোর ও সৈয়দপুরে এসেছিলেন বেশি। সে সময়ের কিছু কথা রণেশ দাশগুপ্তের লেখায় মূর্ত হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশের নতুন ধরনের কবিতাগুলো মানুষকে পরিচিত গণ্ডির কবিতার আবেশ থেকে বের করে আনছিল। কিন্তু জীবনানন্দের গদ্য সম্ভারের সন্ধান তখনো পাওয়া যায়নি। জীবনানন্দ মার্ক্সিস্ট ছিলেন বলে কখনোই প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর অন্তত দুটি উপন্যাসে মার্ক্স, লেনিন ও কমিউনিস্টরা উঠে এসেছেন। উপন্যাস দুটির নাম ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ আর ‘জলপাইহাটি’। রণেশ দাশগুপ্তের ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ বইটিতে জীবনানন্দের এই দুটি উপন্যাস নিয়ে বৃহৎ আলোচনা আছে।
৭
‘দোটানা’ নামে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ বা ফিচার আছে রণেশ দাশগুপ্তের লেখা ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’ নামের বইটিতে। সরাসরি সাম্যবাদের কোনো কথা সেখানে নেই। কিন্তু বর্ণনার সহজতায় পাঠক বুঝে নিতে পারবেন রণেশ দাশগুপ্তের লেখার মর্মার্থ। প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন এ রকম:
‘বদলাব বদলাব করে সাত দিন ধরে পরা সার্ট পায়জামা বদলানো হয়নি। সার্টটার হাতে দুটো ভয়ানকভাবে ময়লা হয়ে গেছে। পাজামাটা চটের থলে। হলঘরে অতগুলি লোকের দশা কি হতে পারে, সে কথা না ভেবেই নেহায়েত স্বার্থপরের মত মনে মনে বললাম, “ধরণী দ্বিধা হও”।
‘মুশকিলটা হয়েছে এই যে, আজ অফিসে কাজে আসার সময়ও দুদিন আগে পরা সার্ট পাজামা ভয়ানক ময়লা লাগল। না বদলে পারলাম না। অথচ আসতে আসতে যেসব মেহনতি মানুষ চোখে পড়েছে, তাদের অনেকেরই গায়ে কাজের জামা, আধ ময়লা জামা, নোংরা জামা, ছেঁড়া জামা। একজন আমার চেনা। সে একজন ফিটার। তার গায়ে দেখলাম, তেল কালিমাখা একটা হাফসার্ট। অথচ আমি জানি, উৎসবের দিনে এই লোকটি যে পোশাক পরিচ্ছদ পরে তা যেমন রুচিসম্মত, তেমনি প্রদীপ্ত। মানায়ও তাকে। মনে হয়, এ সম্পূর্ণ পৃথক একটি লোক, এর কিন্তু কাজের জামা পরতে মোটেই দ্বিধা জাগে বলে মনে হয় না। স্বচ্ছন্দে চলে গেল বুক ফুলিয়ে মহানগরীর ভিড় ঠেলে।’
‘বড় দোটানায় পড়ে গিয়েছি। ভাবছি, পকেট এ কলম, তার বদলে যদি হাতে একটা হাতুড়ি আর কিছু করার থাকতো তাহলে সম্ভবত এমন ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হতাম না। হয়েছি কলমজীবী, না ঘরকা না ঘাটকা।'
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। আমার মনে হয়, এ সময় রণেশ দাশগুপ্ত বেঁচে থাকলে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরও কিছুটা পাল্টাত। মানুষ দিনে দিনে আরও বেশি চতুর, দুর্নীতিবাজ, তেলবাজ হয়ে উঠেছে, সেটা দেখে তিনি হয়তো আরও বেশি কষ্ট পেতেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর যে বিশ্বাস ছিল, সে বিশ্বাসে আঘাত আসত কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যাঁরা পোড় খাওয়া মন ও শরীর নিয়ে পার্টি করে গেছেন, তাঁদের অনেকেই জীবিতাবস্থায় পার্টির নতুন নেতৃত্বের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তার ব্যতিক্রম নয়। নয়া নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে যেভাবে দল চালিয়েছেন, তাতে আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে বড়সড় ভাবনা থাকলেও নিজ দেশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আলোচনার বাইরে। অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রণেশ দাশগুপ্তদের মতো গুণী মানুষদের এড়িয়ে।
একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক জগতে ঝ্দানোভ চালিয়েছিলেন এক বীভৎস পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সৃজনশীলতার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন। লেখক, সাহিত্যিক, কবি পার্টির নির্দেশে লেখালেখি করতেন। সৃজনশীল মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় আঘাত আর কিছুই হতে পারে না। এই বীভৎসতার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তার বিষে জর্জরিত হয়েছিল খোলা মনের মানুষ। এখন নানাভাবে সেই বীভৎসতার চিত্রগুলো তুলে আনা হচ্ছে। কিন্তু সে সময় এই নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির পক্ষেই গুণগান গাইছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতারা। ভারতবর্ষেও সেই চপেটাঘাত পড়েছিল। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ নামে যে অশ্বডিম্বটি পাড়া হয়েছিল, সেটি যে মানবিক বিকাশের অন্তরায়, সে কথা বুঝতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। এ কারণেই বুঝি কমরেড ফরহাদ যখন ‘নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তখন তার সমালোচনা করতে হলো সনজীদা খাতুনকে।
সন্জীদা খাতুন তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি লেখার আগে রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো কোনো কথা জিজ্ঞেস করে না।’
কিন্তু পার্টির প্রতি অগাধ মমত্বের কারণে তিনি মলিনমুখে বলেছিলেন, ‘সেম সাইড হয়ে যায় না?’ অর্থাৎ কমরেড ফরহাদের লেখার বিরুদ্ধে সন্জীদা খাতুন লিখলে সেটা পার্টি লাইনের বাইরের কিছু হয় কি না, সে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি।
সে সময় যদি প্রতিবাদ করতেন তিনি বা তাঁর মতো বিচক্ষণ মানুষেরা, তাহলে পার্টি হয়তো তাঁদের দিকনির্দেশনায় ঋদ্ধ হতে পারত।
৮
রণেশ দাশগুপ্তের অসাধারণ একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ নামের বইয়ে। প্রবন্ধটির নাম, ‘বাংলাদেশ নয় এ মধুর খেলা রচয়িত্রীরা’।
মূলত বাংলাদেশের নারী লেখকদের নিয়ে প্রবন্ধটি। বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমামকে নিয়ে যখন তিনি এই প্রবন্ধ লিখছেন, তখন প্রথমজনের বয়স ৯২ এবং দ্বিতীয়জনের ৮২। এখন বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ বিভাজন মানা হয় না। সে সময় মানা হতো বলে লেখার শব্দগুলোকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। তিনি লিখছেন, ‘বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমাম।... এই দুই প্রবীণা বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিভাবিকারূপে বিবেচিতা। বেগম সুফিয়া কামাল বিশ্বের দশক থেকেই বিশিষ্টা কবি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিষ্যা ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা সুফিয়া কামাল বরাবরই প্রগতিবাদিনী। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকা। যে মুক্তি ধারায় স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটল, তার সঙ্গে আপন চিন্তাভাবনা ও নারী সমাজের অন্তরঙ্গতা ও একাত্মতা প্রকাশের সহজ সরল বাণীরূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার জগত।... বেগম জাহানারা ইমাম ’৪৬-এ কলকাতা লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। রংপুরের মেয়ে জাহানারা ইমাম দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলায় চলে যান এবং বিবাহিত সাংসারিক জীবনযাপন করেন স্কুলশিক্ষকের কাজের পাশাপাশি। এই অবস্থান থেকেই বেগম জাহানারা ইমাম বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ও ব্যাপক গণহত্যা পতাকাবাহী নিরুপায় সামনে এসে গিয়েছেন।’
এ দুজনের কথা বলার পর রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে। তিনি লিখছেন, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত কলাম বইটিতে লেনিনের অনুসারী কমিউনিস্টদের যে উল্লেখ রয়েছে, তাতে কমিউনিস্টদের পুরুষ হিসেবে দেখিয়ে নারীদের ভালো-মন্দের প্রতি উদাসীন বলে ধিক্কার দেয়া হয়েছে। ঊনিশ শতকের জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলকে নারীর ভোটাধিকার বিরোধী বলে উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু কলকাতা থেকে প্রকাশিত “নির্বাচিত কলাম” বইটিতে “যাব না কেন? যাব”কে যুক্ত করে যে সার্বিক বা পরিপূরক বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে, তাতে ’৯০-৯১–এর সমাজতন্ত্রের সংকট ও লেনিনের অবমাননার এক বিস্ময়কর আবেগময় প্রস্তাবনা বেরিয়ে এসেছে লেখিকার কলম থেকে। এ ধরনের বক্তব্যকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি বলে মনে করে নিলে ভুল হবে। এই কলামটিতে তসলিমা নাসরিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনে লেনিনের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় শোকাহত মস্তক অবনত করেছেন।’
এরপর তিনি লেখক মতিয়া চৌধুরীর কথা বলেছেন। স্বনামধন্য এই রাজনীতির মানুষটি ষাটের দশকের শেষে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দৈনিক সংবাদে তিনি ধারাবাহিকভাবে জেলের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘মতিয়া চৌধুরী প্রধানত বাংলাদেশের বিপ্লবের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রতিনিধিরূপে বাংলাদেশের মুক্তির ধারাভাষ্য উপস্থিত করেছেন মুখ্যত বিশাল বিশাল জনসমাবেশ প্রদত্ত ভাষণে। সেই কারণে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে তার কোনো ভাষ্যকে পাওয়া যাবে না, তবে তার লেখা কারা কাহিনীটি দলিত বঞ্চিত নারী জীবনের ছবি দেশবাসীকে বিবেকের কাছে তীব্র ও তীক্ষ্ণতাবোধ উপস্থিত করেছিল।’
এরপর তিনি বলেছেন মালেকা বেগমের কথা, সেলিনা হোসেনের কথা, পান্না কায়সারের কথা।
এই প্রবন্ধটি পাঠ করতে বলব শুধু এই কারণে যে একজন লেখক তাঁর পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে নির্মোহ ভঙ্গিতে কীভাবে কোনো বই বা মানুষের বিশ্লেষণ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
৯
অগাধ পড়াশোনা করেছেন তিনি। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই ছিলেন পারদর্শী। রাজনীতির মাঠে তিনি একজন নান্দনিক শিল্পী। সংস্কৃতিই ছিল তাঁর শক্তিমত্তার বড় জায়গা। রাজনীতির কথা বলতে গেলে ১৯৫৮ সালের মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনের কথা বলতে হয়। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ৩৫টি পদের মধ্যে ২৫টিতে জয়ী হয় মুসলিম লীগ, বাকি পদগুলো পায় আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল।
একটি মাত্র পদে নির্বাচিত হয় কমিউনিস্ট প্রার্থী। নির্বাচিত প্রার্থীর নাম রণেশ দাশগুপ্ত।
১০.
বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তির আরেকটি অসামান্য কাজের কথা বলে লেখাটি শেষ করব।
তাঁর ছদ্মনাম ছিল জমিল শরাফী। দৈনিক সংবাদে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি বিভিন্ন বই সম্পাদনা করতেন। ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংকলন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল জমিল শরাফীর সম্পাদনায়।
তবে দাদা জীবনানন্দ দাশের ওপর বই সম্পাদনা করেছেন তিনি স্বনামেই। ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার’ নামের বইটিই ছিল বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চার প্রথম উদ্যোগ। এই বইটিতেই জীবনানন্দের পুরো কাব্যসম্ভার এক মলাটের মধ্যে পায় বাংলাদেশের অধিবাসীরা।
১১
১৯৭৫ সালে এ দেশের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তা দেখেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। সে বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি ফিরতি বিমান টিকিটসহ কলকাতায় গিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড। কলকাতায় থাকা অবস্থাতেই নভেম্বরের জেলহত্যার কথা শুনতে পান। বন্ধুরা এ সময় তাঁকে বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করেন। সেই থেকে শুরু হয় কলকাতার জীবন। কিন্তু নিজেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষ ভাবতেই পছন্দ করতেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। ভারতীয় সরকারের কোনো ভাতা নেননি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। অনেক ঠিকানা বদলের পর তাঁর থাকার জায়গা হয় লেনিন স্কুলে। কায়ক্লেশে সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। বাংলাদেশ-ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। ঢাকায়ই হয় তাঁর শেষকৃত্য। তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হলে শহীদ মিনারে বিপুল জনসমাগম হয়।

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১৭ ঘণ্টা আগে
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা।
১৭ ঘণ্টা আগে
এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত।
১৭ ঘণ্টা আগে
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
২ দিন আগেশহীদ বুদ্বিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য।
সেলিম জাহান

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।
পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।
তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয্যা।
পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।
একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।
শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।
পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।
তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয্যা।
পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।
একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।
শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিল
০৪ নভেম্বর ২০২১
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা।
১৭ ঘণ্টা আগে
এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত।
১৭ ঘণ্টা আগে
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
২ দিন আগেমৃত্যুঞ্জয় রায়

৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা। সেখান থেকে আবার আরেকটি উড়োজাহাজ ধরে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানো। যুগপৎ আনন্দ ও বিরক্তিকর সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মধ্যেই মাথায় মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি কথা—এত লম্বা পথে প্রায় ৪০০ মানুষ আর তাদের ব্যাগেজ নিয়ে এই মহাযানকে উড়ান দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ৫০০ মাইল বেগে ছুটে চলতে কী পরিমাণ শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে! আর সে শক্তির জন্য কী পরিমাণ জ্বালানি বয়ে নিতে হচ্ছে, তা পোড়াতেও হচ্ছে।
সব সময় তো আমরা পৃথিবীর বুকে চলা লাখ লাখ গাড়িকে দুষছি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর অন্যতম প্রধান খলনায়ক হিসেবে, উড়োজাহাজগুলোর কথা কি আমরা কখনো সেভাবে ভাবি? উড়োজাহাজগুলো কি সত্যিই পরিবেশ দূষণ করছে? সরল জবাব হলো, হ্যাঁ, করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুমণ্ডলে নন-কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। উড়োজাহাজগুলো পরিবেশের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে। কী পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি সেসব যান পুড়িয়ে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ করছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনে তার প্রভাব পড়ছে কতটুকু—এসব প্রশ্নও মাথার মধ্যে বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল। জানা গেল, উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনে প্রায় আড়াই শতাংশ অবদান রয়েছে উড়োজাহাজ চলাচলে, যা মোট জলবায়ু প্রভাব হিসাবে ৪ শতাংশ নিরূপিত হয়েছে।
এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে মুহূর্তেই সেসব উত্তর পাওয়া যায়। এমনকি কোন ফ্লাইট এখন আকাশের কোথায় অবস্থান করছে, গন্তব্যে পৌঁছাতে কতটুকু সময় লাগবে, তা-ও মানচিত্রে দেখা যায়। কয়েক দিন আগে এ রকম একটি ফ্লাইট নম্বর দিয়ে একটি অ্যাপসের সাহায্যে অনুসন্ধান করতেই ফ্লাইট চলাচলের যে ছবিটি মোবাইল ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল, তা দেখে মনে হলো বিশাল আকাশে আসলে খালি জায়গা কোথায়? সব তো দখল করে ফেলেছে নিত্য চলাচল করা উড়োজাহাজগুলো। জানা গেল, রোজ মানে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর আকাশে প্রায় এক লাখ ফ্লাইট ওঠা-নামা করে। রোজ ১৫ থেকে ২০ হাজার উড়োজাহাজ এসব ফ্লাইট পরিচালনা করে, যার মধ্যে রয়েছে যাত্রী ও মালামাল বহন, সামরিক ও ব্যক্তিগত উড়োজাহাজও। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের সংখ্যাই যে সবচেয়ে বেশি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন সারা বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ যাত্রী উড়োজাহাজে চলাচল করে। উড়োজাহাজের এই পরিষেবা দিতে বছরে ৮৫০০ লাখ টনের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন ঘটছে, ২০৫০ সালে যা আরও অনেক বাড়বে। পৃথিবীতে প্রধান ১০টি কার্বন নিঃসরণকারীর মধ্যে উড়োজাহাজশিল্প একটি।
ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকায় সেখানকার বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে, সেখানকার বায়ুমণ্ডল ঠান্ডা। উড়োজাহাজে চড়ে তার বাইরের তাপমাত্রা কত, তা-ও মনিটরে দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেখছি, এয়ারক্রাফটের বাইরে বাতাসের তাপমাত্রা মাইনাস ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরূপ ঠান্ডায় উড়োজাহাজের ইঞ্জিন থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ও গ্যাস নির্গত হচ্ছে, সেগুলো ঘন মেঘের মতো জমে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে গভীর আকাশে মাঝে মাঝে উড়োজাহাজ চলে যাওয়ার পর আমরা যেসব ঘন সাদা মেঘের মতো সরল রেখা বা দীর্ঘ দাগ দেখি, এগুলো হলো তাই। ইংরেজিতে এগুলোকে বলে কন্ট্রেইল।
ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকার কারণে সেসব উড়োজাহাজ থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য নির্গত হয়, তা এককভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটায়। বিশেষ করে নাইট্রাস অক্সাইড। উড়োজাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া এসব জমাটবদ্ধ বাষ্পের রেখাগুলো তাপ আটকে রাখতে পারে। এ সম্পর্কে আমাদের আগে যেসব ধারণা ছিল, বাস্তবে এখন গবেষণা করে তার চেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া উড়োজাহাজ থেকে নির্গত অন্যান্য বায়ুদূষণের মধ্যে রয়েছে জলীয় বাষ্প, স্যুট এবং সালফেটজাতীয় অ্যারোসল। এগুলোও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে ও ঘন মেঘ গঠন করে। এর কারণে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে যেখানে ওজোনস্তর রয়েছে সেখানেও এর ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু বিষয় যা এসব উড়োজাহাজ চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেগুলোও পরিবেশদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
হাসির কথা হলো, আমরা গবেষণা করে যত বেশি আধুনিক উড়োজাহাজ তৈরি করছি, সেগুলো প্রাচীন উড়োজাহাজের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে। এগুলো যত বেশি উচ্চতা দিয়ে উড়ছে, তত বেশি দীর্ঘস্থায়ী কন্ট্রেইল বা জমাটবদ্ধ ঘন মেঘের রেখা তৈরি করছে, যা তাপ বাড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক মেঘের মতোই এসব কন্ট্রেইল বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত তাপ ধরে রাখে এবং জেট জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে সৃষ্ট কার্বনের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি অবদান রাখে। এ নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণাকাজও করা হয়েছে। সে গবেষণা দলের প্রধান গবেষক ও গবেষণাপত্রের লেখক ড. এডওয়ার্ড গ্রিসপেয়ার্ডট বলেছেন, অনেকে বোঝেন না যে কন্ট্রেইল ও জেট ফুয়েলের কার্বন নির্গমন জলবায়ুকে দ্বিগুণভাবে উষ্ণ করছে।
জেট প্লেনগুলো ওড়ে ৪০ হাজার ফুটের ওপর দিয়ে, আধুনিক প্লেনগুলো ওড়ে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার ফুটের মধ্যে এবং প্রাচীন প্লেনগুলো ওড়ে ৩১ থেকে ৩৮ হাজার ফুটের মধ্যে। উঁচুতে থাকা প্লেনগুলো বেশি কন্ট্রেইল তৈরি করে, নিচুতে থাকাগুলো করে কম। সে গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে কন্ট্রেইল পরিবেশের জন্য উড়োজাহাজের কার্বন নির্গমনের চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষতিকর, যার কারণে উড়োজাহাজ চলাচলের মোট জলবাযু প্রভাবের প্রায় ৬০ শতাংশ ঘটে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে, বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিম লাইনারের মতো আধুনিক উড়োজাহাজের কন্ট্রেইল পুরোনো মডেলের চেয়ে বেশি তৈরি হয়। এই গবেষণায় গবেষকেরা নাসার জিওইএস-আর উপগ্রহ থেকে নেওয়া স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করেছেন, যা উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজগুলোর ৬৪ হাজারের বেশি কন্ট্রেইল ট্র্যাক করতে সাহায্য করেছে।
এ দৃশ্যের বাইরেও রয়েছে আরও এক দৃশ্য। রোজ প্রায় ১৩ লাখ যাত্রীর খাবার থেকে কী পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, সেটি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? উড়োজাহাজভিত্তিক অন-বোর্ড পরিষেবা, টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ, উড়োজাহাজ শিল্পজনিত বর্জ্য ইত্যাদি কারণেও পরিবেশদূষণ বাড়ছে। এ থেকে দ্রুত নিষ্কৃতি পাওয়ার সহজ কোনো রাস্তা আছে বলে মনে হয় না। কার্বনমুক্ত উড়োজাহাজ চালনা এখনো এক স্বপ্নের ব্যাপার। কেননা, গাড়ির মতো আমরা ইলেকট্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কার করতে পারিনি, সেখানে সৌরশক্তি ব্যবহারের সুযোগও তৈরি হয়নি। কেননা, উড়োজাহাজ চালাতে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি লাগে সেটি কখনো ব্যাটারি দিয়ে সম্ভব নয়। উড়োজাহাজের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কেউ কেউ হাইড্রোজেন ব্যবহারের কথা ভাবছেন। কিন্তু জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ঝুঁকি আছে অনেক বেশি। এতে দাহ্যতার কারণে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ফলে উড়োজাহাজে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। উড়োজাহাজ চালনার জন্য টেকসই জ্বালানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এগুলো অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং উৎপাদনের জন্য ব্যাপক জমি ও পানিসম্পদের দরকার হয়। এ মুহূর্তে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষাও দরকার। কাজেই সে লাইনেও যাওয়া ঠিক হবে না।
আশঙ্কার কথা হলো, দিন দিন অন্যান্য পরিবহন খাতের তুলনায় প্রয়োজনেই উড়োজাহাজের চলাচল দ্রুত হারে বাড়ছে। যদি তা কমানো বা নিয়ন্ত্রণের কোনো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনে বা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে তার প্রভাবও বাড়বে। গবেষকদের মতে, এখনই ভাবার সময় এসেছে উড়োজাহাজের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উড়ানে আরও বেশি দক্ষ ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থাপনা গ্রহণ, বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার এবং বিমান চলাচলকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পরিবেশদূষণের ক্ষতিপূরণ আদায় করে তা পরিবেশ উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা। সেখান থেকে আবার আরেকটি উড়োজাহাজ ধরে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানো। যুগপৎ আনন্দ ও বিরক্তিকর সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মধ্যেই মাথায় মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি কথা—এত লম্বা পথে প্রায় ৪০০ মানুষ আর তাদের ব্যাগেজ নিয়ে এই মহাযানকে উড়ান দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ৫০০ মাইল বেগে ছুটে চলতে কী পরিমাণ শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে! আর সে শক্তির জন্য কী পরিমাণ জ্বালানি বয়ে নিতে হচ্ছে, তা পোড়াতেও হচ্ছে।
সব সময় তো আমরা পৃথিবীর বুকে চলা লাখ লাখ গাড়িকে দুষছি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর অন্যতম প্রধান খলনায়ক হিসেবে, উড়োজাহাজগুলোর কথা কি আমরা কখনো সেভাবে ভাবি? উড়োজাহাজগুলো কি সত্যিই পরিবেশ দূষণ করছে? সরল জবাব হলো, হ্যাঁ, করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুমণ্ডলে নন-কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। উড়োজাহাজগুলো পরিবেশের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে। কী পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি সেসব যান পুড়িয়ে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ করছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনে তার প্রভাব পড়ছে কতটুকু—এসব প্রশ্নও মাথার মধ্যে বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল। জানা গেল, উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনে প্রায় আড়াই শতাংশ অবদান রয়েছে উড়োজাহাজ চলাচলে, যা মোট জলবায়ু প্রভাব হিসাবে ৪ শতাংশ নিরূপিত হয়েছে।
এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে মুহূর্তেই সেসব উত্তর পাওয়া যায়। এমনকি কোন ফ্লাইট এখন আকাশের কোথায় অবস্থান করছে, গন্তব্যে পৌঁছাতে কতটুকু সময় লাগবে, তা-ও মানচিত্রে দেখা যায়। কয়েক দিন আগে এ রকম একটি ফ্লাইট নম্বর দিয়ে একটি অ্যাপসের সাহায্যে অনুসন্ধান করতেই ফ্লাইট চলাচলের যে ছবিটি মোবাইল ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল, তা দেখে মনে হলো বিশাল আকাশে আসলে খালি জায়গা কোথায়? সব তো দখল করে ফেলেছে নিত্য চলাচল করা উড়োজাহাজগুলো। জানা গেল, রোজ মানে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর আকাশে প্রায় এক লাখ ফ্লাইট ওঠা-নামা করে। রোজ ১৫ থেকে ২০ হাজার উড়োজাহাজ এসব ফ্লাইট পরিচালনা করে, যার মধ্যে রয়েছে যাত্রী ও মালামাল বহন, সামরিক ও ব্যক্তিগত উড়োজাহাজও। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের সংখ্যাই যে সবচেয়ে বেশি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন সারা বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ যাত্রী উড়োজাহাজে চলাচল করে। উড়োজাহাজের এই পরিষেবা দিতে বছরে ৮৫০০ লাখ টনের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন ঘটছে, ২০৫০ সালে যা আরও অনেক বাড়বে। পৃথিবীতে প্রধান ১০টি কার্বন নিঃসরণকারীর মধ্যে উড়োজাহাজশিল্প একটি।
ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকায় সেখানকার বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে, সেখানকার বায়ুমণ্ডল ঠান্ডা। উড়োজাহাজে চড়ে তার বাইরের তাপমাত্রা কত, তা-ও মনিটরে দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেখছি, এয়ারক্রাফটের বাইরে বাতাসের তাপমাত্রা মাইনাস ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরূপ ঠান্ডায় উড়োজাহাজের ইঞ্জিন থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ও গ্যাস নির্গত হচ্ছে, সেগুলো ঘন মেঘের মতো জমে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে গভীর আকাশে মাঝে মাঝে উড়োজাহাজ চলে যাওয়ার পর আমরা যেসব ঘন সাদা মেঘের মতো সরল রেখা বা দীর্ঘ দাগ দেখি, এগুলো হলো তাই। ইংরেজিতে এগুলোকে বলে কন্ট্রেইল।
ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকার কারণে সেসব উড়োজাহাজ থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য নির্গত হয়, তা এককভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটায়। বিশেষ করে নাইট্রাস অক্সাইড। উড়োজাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া এসব জমাটবদ্ধ বাষ্পের রেখাগুলো তাপ আটকে রাখতে পারে। এ সম্পর্কে আমাদের আগে যেসব ধারণা ছিল, বাস্তবে এখন গবেষণা করে তার চেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া উড়োজাহাজ থেকে নির্গত অন্যান্য বায়ুদূষণের মধ্যে রয়েছে জলীয় বাষ্প, স্যুট এবং সালফেটজাতীয় অ্যারোসল। এগুলোও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে ও ঘন মেঘ গঠন করে। এর কারণে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে যেখানে ওজোনস্তর রয়েছে সেখানেও এর ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু বিষয় যা এসব উড়োজাহাজ চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেগুলোও পরিবেশদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
হাসির কথা হলো, আমরা গবেষণা করে যত বেশি আধুনিক উড়োজাহাজ তৈরি করছি, সেগুলো প্রাচীন উড়োজাহাজের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে। এগুলো যত বেশি উচ্চতা দিয়ে উড়ছে, তত বেশি দীর্ঘস্থায়ী কন্ট্রেইল বা জমাটবদ্ধ ঘন মেঘের রেখা তৈরি করছে, যা তাপ বাড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক মেঘের মতোই এসব কন্ট্রেইল বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত তাপ ধরে রাখে এবং জেট জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে সৃষ্ট কার্বনের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি অবদান রাখে। এ নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণাকাজও করা হয়েছে। সে গবেষণা দলের প্রধান গবেষক ও গবেষণাপত্রের লেখক ড. এডওয়ার্ড গ্রিসপেয়ার্ডট বলেছেন, অনেকে বোঝেন না যে কন্ট্রেইল ও জেট ফুয়েলের কার্বন নির্গমন জলবায়ুকে দ্বিগুণভাবে উষ্ণ করছে।
জেট প্লেনগুলো ওড়ে ৪০ হাজার ফুটের ওপর দিয়ে, আধুনিক প্লেনগুলো ওড়ে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার ফুটের মধ্যে এবং প্রাচীন প্লেনগুলো ওড়ে ৩১ থেকে ৩৮ হাজার ফুটের মধ্যে। উঁচুতে থাকা প্লেনগুলো বেশি কন্ট্রেইল তৈরি করে, নিচুতে থাকাগুলো করে কম। সে গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে কন্ট্রেইল পরিবেশের জন্য উড়োজাহাজের কার্বন নির্গমনের চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষতিকর, যার কারণে উড়োজাহাজ চলাচলের মোট জলবাযু প্রভাবের প্রায় ৬০ শতাংশ ঘটে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে, বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিম লাইনারের মতো আধুনিক উড়োজাহাজের কন্ট্রেইল পুরোনো মডেলের চেয়ে বেশি তৈরি হয়। এই গবেষণায় গবেষকেরা নাসার জিওইএস-আর উপগ্রহ থেকে নেওয়া স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করেছেন, যা উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজগুলোর ৬৪ হাজারের বেশি কন্ট্রেইল ট্র্যাক করতে সাহায্য করেছে।
এ দৃশ্যের বাইরেও রয়েছে আরও এক দৃশ্য। রোজ প্রায় ১৩ লাখ যাত্রীর খাবার থেকে কী পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, সেটি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? উড়োজাহাজভিত্তিক অন-বোর্ড পরিষেবা, টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ, উড়োজাহাজ শিল্পজনিত বর্জ্য ইত্যাদি কারণেও পরিবেশদূষণ বাড়ছে। এ থেকে দ্রুত নিষ্কৃতি পাওয়ার সহজ কোনো রাস্তা আছে বলে মনে হয় না। কার্বনমুক্ত উড়োজাহাজ চালনা এখনো এক স্বপ্নের ব্যাপার। কেননা, গাড়ির মতো আমরা ইলেকট্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কার করতে পারিনি, সেখানে সৌরশক্তি ব্যবহারের সুযোগও তৈরি হয়নি। কেননা, উড়োজাহাজ চালাতে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি লাগে সেটি কখনো ব্যাটারি দিয়ে সম্ভব নয়। উড়োজাহাজের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কেউ কেউ হাইড্রোজেন ব্যবহারের কথা ভাবছেন। কিন্তু জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ঝুঁকি আছে অনেক বেশি। এতে দাহ্যতার কারণে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ফলে উড়োজাহাজে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। উড়োজাহাজ চালনার জন্য টেকসই জ্বালানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এগুলো অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং উৎপাদনের জন্য ব্যাপক জমি ও পানিসম্পদের দরকার হয়। এ মুহূর্তে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষাও দরকার। কাজেই সে লাইনেও যাওয়া ঠিক হবে না।
আশঙ্কার কথা হলো, দিন দিন অন্যান্য পরিবহন খাতের তুলনায় প্রয়োজনেই উড়োজাহাজের চলাচল দ্রুত হারে বাড়ছে। যদি তা কমানো বা নিয়ন্ত্রণের কোনো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনে বা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে তার প্রভাবও বাড়বে। গবেষকদের মতে, এখনই ভাবার সময় এসেছে উড়োজাহাজের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উড়ানে আরও বেশি দক্ষ ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থাপনা গ্রহণ, বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার এবং বিমান চলাচলকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পরিবেশদূষণের ক্ষতিপূরণ আদায় করে তা পরিবেশ উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিল
০৪ নভেম্বর ২০২১
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১৭ ঘণ্টা আগে
এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত।
১৭ ঘণ্টা আগে
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সবাই দেখেছেন। কে এই আততায়ী, তা নিয়ে পুলিশি তদন্ত চলছে। কেউ কেউ বলছেন, মোটরসাইকেলে থাকা দুই দুর্বৃত্ত ওসমান হাদির সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশও নিয়েছিল।
তফসিল ঘোষণার পরদিন এ রকম এক সহিংসতার ঘটনা ঘটায় অনেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। যে উৎসবের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সে নির্বাচনের পথে যাত্রার সময়টা এ রকম ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল কেন, সে প্রশ্ন উঠেছে। ওসমান হাদির মতো একজন সুপরিচিত নেতার জীবনের নিরাপত্তা নেই, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা এই হত্যাচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই।
টার্গেট কিলিং নিয়ে কেউ কেউ কথা বলছেন। একজন নেতা বলেছেন, অন্তত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ৫০ জন নেতা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হতে পারেন। এ ধরনের তথ্য দেওয়া হলে তার উৎস ও প্রমাণও হাজির করা উচিত। যদি কেউ সে রকম ষড়যন্ত্র করে থাকে, তবে তার মুখোশ উন্মোচন করাও জরুরি।
একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা কঠিন কাজ। কিন্তু সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজগুলো করা হলে এবং যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো পরিচালনা করলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি সত্যিই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অনুকূল হয়ে উঠতে পেরেছে—এই প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে তাদের নৈতিক মনোবল যে জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, তাতে তাদের কাছ থেকে সত্যিই কি দক্ষ সেবা পাওয়া সম্ভব? মনোবলহীন একটি বাহিনী কতটা সাহসী পদক্ষেপ রাখতে পারে?
কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে বিএনপির একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর ওপরও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের পর বিষয়টিকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনী ময়দানকে বিশৃঙ্খল করে তোলার জন্য শক্তিশালী কোনো মহল কি এসব কাজে মদদ দিচ্ছে? কারা এসব ঘটাচ্ছে, তা নিয়ে নিবিড় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কোনো গায়েবি হত্যাকারীর গল্প তৈরি করে সত্যিকারের খুনিদের আড়াল করার চেষ্টা হলে এই সহিংসতা আরও বাড়বে। সত্যিকারের অপরাধীরা ধরা পড়লেই কেবল তাদের লক্ষ্য, তাদের পেছনে কারা সক্রিয় ইত্যাদি বেরিয়ে আসবে। আর সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করে কীভাবে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, সে কৌশল নিয়ে ভাবতে পারবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রার্থীকে ঘিরে তাঁর সমর্থকদেরও একটা নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করতে হবে। যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে বলিষ্ঠভাবে—এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটবে না।

এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সবাই দেখেছেন। কে এই আততায়ী, তা নিয়ে পুলিশি তদন্ত চলছে। কেউ কেউ বলছেন, মোটরসাইকেলে থাকা দুই দুর্বৃত্ত ওসমান হাদির সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশও নিয়েছিল।
তফসিল ঘোষণার পরদিন এ রকম এক সহিংসতার ঘটনা ঘটায় অনেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। যে উৎসবের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সে নির্বাচনের পথে যাত্রার সময়টা এ রকম ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল কেন, সে প্রশ্ন উঠেছে। ওসমান হাদির মতো একজন সুপরিচিত নেতার জীবনের নিরাপত্তা নেই, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা এই হত্যাচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই।
টার্গেট কিলিং নিয়ে কেউ কেউ কথা বলছেন। একজন নেতা বলেছেন, অন্তত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ৫০ জন নেতা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হতে পারেন। এ ধরনের তথ্য দেওয়া হলে তার উৎস ও প্রমাণও হাজির করা উচিত। যদি কেউ সে রকম ষড়যন্ত্র করে থাকে, তবে তার মুখোশ উন্মোচন করাও জরুরি।
একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা কঠিন কাজ। কিন্তু সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজগুলো করা হলে এবং যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো পরিচালনা করলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি সত্যিই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অনুকূল হয়ে উঠতে পেরেছে—এই প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে তাদের নৈতিক মনোবল যে জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, তাতে তাদের কাছ থেকে সত্যিই কি দক্ষ সেবা পাওয়া সম্ভব? মনোবলহীন একটি বাহিনী কতটা সাহসী পদক্ষেপ রাখতে পারে?
কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে বিএনপির একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর ওপরও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের পর বিষয়টিকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনী ময়দানকে বিশৃঙ্খল করে তোলার জন্য শক্তিশালী কোনো মহল কি এসব কাজে মদদ দিচ্ছে? কারা এসব ঘটাচ্ছে, তা নিয়ে নিবিড় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কোনো গায়েবি হত্যাকারীর গল্প তৈরি করে সত্যিকারের খুনিদের আড়াল করার চেষ্টা হলে এই সহিংসতা আরও বাড়বে। সত্যিকারের অপরাধীরা ধরা পড়লেই কেবল তাদের লক্ষ্য, তাদের পেছনে কারা সক্রিয় ইত্যাদি বেরিয়ে আসবে। আর সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করে কীভাবে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, সে কৌশল নিয়ে ভাবতে পারবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রার্থীকে ঘিরে তাঁর সমর্থকদেরও একটা নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করতে হবে। যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে বলিষ্ঠভাবে—এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটবে না।

রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিল
০৪ নভেম্বর ২০২১
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১৭ ঘণ্টা আগে
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা।
১৭ ঘণ্টা আগে
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিল
০৪ নভেম্বর ২০২১
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১৭ ঘণ্টা আগে
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা।
১৭ ঘণ্টা আগে
এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত।
১৭ ঘণ্টা আগে