Ajker Patrika

তৈরি পোশাক রপ্তানির বাজারে ভারতের চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ

হুসাইন আহমদ
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫: ০০
Thumbnail image
বাংলাদেশের একটি গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করেছেন শ্রমিকেরা। ছবি: সংগৃহীত

তৈরি পোশাক খাতের বৈশ্বিক বাজারে সম্ভবত বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে পোশাক রপ্তানির বাজারে নিজের অংশীদারত্ব বাড়ানোর জোর চেষ্টা চালাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। দেশটি পোশাক রপ্তানিকারকদের আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশের মতো ভারতেও রয়েছে সস্তা শ্রম। তুলা উৎপাদনের পাশাপাশি বস্ত্রশিল্পে জোরালো অবস্থান ভারতের জন্য বাড়তি সুবিধা। সে কারণে নিকট ভবিষ্যতে রপ্তানির বাজারে দখল বাড়ানোর দৌড়ে বেশ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে পারে বাংলাদেশ।

গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে অর্থনীতি একরকম স্থবির হয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির মধ্যে কারখানা পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নির্বিচারে ব্যবসায়ীদের ওপর বিধিনিষেধের কারণে শতাধিক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের অর্ডার তুলে নিয়ে ভারতের দ্বারস্থ হয়েছেন। আর এই পরস্থিতিকে ৮০ হাজার কোটি ডলারের তৈরি পোশাকের বাজারের বড় দখল নেওয়ার বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে ভারত।

গত জুলাই মাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, পোশাক রপ্তানিতে সমস্যার শুরু তখন থেকেই। রপ্তানিকারকরা সময়মতো উৎপাদন, পণ্য পরিবহন, কাঁচামাল আমদানি ও সরবরাহ নিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হয়। তখন অনেক বিদেশি ক্রেতা, বিক্রেতা ও ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির অর্ডার প্রত্যাহার করে নেয়।

কোটার আন্দোলন সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের পরিণত হলে নজিরবিহীন সহিংসতার মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। তারপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, শ্রমিক অসন্তোষ ও কয়েক মাস ধরে কারখানা বন্ধ থাকায় রপ্তানি কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। দুই বছর ধরে চলমান গ্যাস সংকটের সঙ্গে নতুন সমস্যা মিলে পোশাক উৎপাদন সক্ষমতা অনেক নিচে নামিয়ে দিয়েছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ পোশাক খাতের জন্য খুব খারাপ সময় নিয়ে এসেছে। কারণ জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসকে ক্রিসমাস ঘিরে পশ্চিমের বাজারে তৈরি পোশাক পণ্য বিক্রির সেরা মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এমন সময়ে অস্থিরতা দেশের রপ্তানিকারকদের সংকটে ফেলেছে। কেউ কেউ অর্ডারের সময়সীমা পূরণে বাড়তি খরচ করে উড়োজাহাজে পণ্য পাঠিয়েছেন।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রধান বাজারগুলোতে রপ্তানি কমছে, কারণ খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো বিকল্প গন্তব্য খুঁজছে। অন্যদিকে ইউরোপের দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের পোশাক রপ্তানি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে।

২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে দশমিক ৪৬ শতাংশ কমে ৬৭০ কোটি ডলারে নেমেছে। যেখানে ভারতের রপ্তানি ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়ে ৪৪০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।

বহুদিন ধরে পোশাক খাতে আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে আসা ভারত সরকার এটাকে বড় সুযোগ ধরে তা কাজে লাগাতে আগ্রহী। ভারতে টেক্সটাইল বা বস্ত্র খাতের উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে বহু প্রকল্প চলমান আছে। পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের জন্য প্রণোদনা ও শুল্ক ছাড়ের সুবিধাও রাখা হয়েছে।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর সেক্রেটারি জেনারেল মিথিলেশ্বর ঠাকুর সম্প্রতি রয়টার্সকে বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কাজের অর্ডারের চাপে হিমশিম খাচ্ছে ভারতের রপ্তানিকারকরা। বাংলাদেশের পোশাকের ক্রেতা বহু
মার্কিন কোম্পানি বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজছে।

এমন পরিস্থিতিতে ভারতের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে পোশাক খাতের সহায়তায় নতুন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রয়টার্সের তথ্য বলছে, বাজেটে ভারতের বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১০-১৫ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা হচ্ছে, যা এখন ৪ হাজার ৪১৭ কোটি রুপি (৫১ কোটি ১০ লাখ ডলার)।

চলতি অর্থবছরে বস্ত্র খাতের প্রোডাকশন-লিঙ্কড ইনসেনটিভ (পিএলআই) বা উৎপাদন খাতের প্রণোদনা ৪৫ কোটি রুপি থেকে বাড়িয়ে ৬০ কোটি রুপি বরাদ্দের পরিকল্পনাও করছে ভারত। এই প্রকল্পে স্থানীয়ভাবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর ছাড়সহ অন্যান্য সুবিধা দেয় সরকার।

রয়টার্স বলছে, পোশাকের কাঁচামাল পলিয়েস্টার ও ভিসকস স্ট্যাপল ফাইবার ও টেক্সটাইল যন্ত্রপাতির ওপর শুল্ক কমাতে পারে ভারত। এখন ফাইবারের ওপর ১১-২৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক আছে। যেখানে বাংলাদেশে এটি প্রায় শূন্য। এই শুল্কের কারণে ভারতীয় পোশাক রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বাংলাদেশ থেকে পণ্য সংগ্রহকারী ইউরোপের এক খুচরা পোশাক বিক্রেতা জানান, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তাঁদের কিছু রপ্তানি কার্যাদেশ বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে ভারতে দেওয়া হয়েছে।

ওই পোশাক বিক্রেতা রয়টার্সকে জানান, তাঁরা অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসবেন।

এদিকে প্রায় সব খাতেই রপ্তানি ভর্তুকি কমিয়েছে বাংলাদেশ। এর দুটি কারণ দেখিয়েছে সরকার। এক. রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর চাপ কমানো। দুই. ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদা হারানোর পর বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রস্তুত করা।

তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা বাড়াতে রপ্তানিকারকরা যে নগদ সহায়তা পেত তাও কমানো হয়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটি সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়।।

আর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই সুবিধা আরও কমিয়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়াও উৎপাদন ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সুবিধাও কমানো হয়েছে।

চীনের পর বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্য অনুযায়ী, বছরে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে তৈরি পোশাকের বাজারের ৭.৪ শতাংশ দখল রেখেছে বাংলাদেশ। বিপরীতে, ভারত পঞ্চম বৃহত্তম অবস্থানে থেকে বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে ৩ শতাংশের বেশি দখলে রেখেছে। বাজারে এই আরও বাড়াতে চায় দেশটি।

পোশাক
পোশাক

বাংলাদেশের অর্ডার ভারতে চলে যাওয়ার প্রধান কারণ রাজনৈতিক সংকট হলেও এক্ষেত্রে চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চ শুল্ক আরোপের সম্ভাবনা ভূমিকা রাখতে পারে।

আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো ঝুঁকি নিতে চায় না। সেই কারণে দুই বছর আগেও ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও ইথিওপিয়া থেকে বিপুল রপ্তানি আদেশ বাংলাদেশে এসেছিল। কারণ তখন ভালো দাম, গুণমান ও অনুকূল ব্যবসার পরিবেশ ছিল।

একইভাবে এখন বাংলাদেশের অর্ডার চলে যাচ্ছে, ভারতও তা লুফে নিচ্ছে। শুধু আর্থিক সহায়তা দিয়েই শেষ করেনি ভারত, বিশ্ববাজারে দখল বাড়াতে আগ্রাসী অভিযানে নেমেছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে বড় বস্ত্রমেলার আয়োজন করছে ভারত। ‘ভারত টেক্স ২০২৫’ নামে এই মেলা হবে সবচেয়ে বড় টেক্সটাইল প্রদর্শনী। সেখানে বিশ্বের নামীদামি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের টানার চেষ্টা করবে ভারত।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

এমন সংকটে তৈরি পোশাকের বাজারে দেশের দখল ধরে রাখা ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনী কৌশল যেমন জরুরি, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা খুবই জরুরি। এখন নজিরবিহীন এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি পার করছে বাংলাদেশ। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা কমাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা অপরহিার্য।

পোশাক রপ্তানি অব্যাহত রাখতে সরকারের সহায়তা বেশি প্রয়োজন ছিল এখন। কিন্তু সে জায়গায় বড় ঘাটতি রয়েছে। রাজনৈতিক পালাবদলের যে ধাক্কা, তা নির্বিচারে ব্যবসায়ীদের ওপর গিয়ে পড়ছে। এখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। বিগত সরকারের সমর্থক ধরে নিয়ে নির্বিচারে ব্যবসায়ীদের ওপর খড়্গহস্ত হলে তা অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। সেক্ষেত্রে পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে।

তৈরি পোশাকের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে ঢালাও অভিযোগে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করে সন্ত্রস্ত পরিবেশ তৈরি করা চলবে না, তাহলে দেশের অর্থনীতি টিকবে না। তবে কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে অবশ্যই যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত করে বিচার করতে হবে। কিন্তু ব্যবসা খাতে ‘মব জাস্টিস’ ঠেকাতে না পারলে দেশ ধ্বংসের মুখে পড়বে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে, ব্যবসায়ীরাও অনিয়ম করেছেন। কিন্তু তার জন্য নির্বিচারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হলে কলকারখানা চলবে না। একই সঙ্গে ঋণ না পেলেও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উদ্ভাবন কোনোটাই সম্ভব নয়। দেশের তৈরি পোশাকের বাজারে ভারতের দখল ঠেকাতে হলে এই জরুরি পদক্ষেপগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত