একেএম শামসুদ্দিন
‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে!’ এটি একটি প্রবাদ বাক্য। আমরা অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু বোঝাতে গিয়ে প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করে থাকি। যে বাক্য বা উক্তি সংক্ষিপ্ত আকারে এবং রূপক আকারে বিশেষ অর্থ বহন করে, যার মাঝে কোনো বাস্তব সত্য নিহিত রয়েছে এবং দীর্ঘদিন ধরে লোকের মুখে মুখে চলে আসছে, তাকেই আমরা প্রবাদ বাক্য বলে থাকি। প্রবাদ হলো লোকসমাজের অভিজ্ঞতার নির্যাস; জীবন, জগৎ ও সমাজ সম্পর্কে মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত উক্তি। এই প্রবাদ আমাদের লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ। প্রবাদ অতীতের বিষয় হয়েও সমকালকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করে।
আমি শিরোনামে যে প্রবাদ বাক্যটি উল্লেখ করেছি, তার অর্থ হলো, সত্য কখনো গোপন থাকে না। অর্থাৎ অন্যায় করে কেউ সাময়িকভাবে সত্যকে ধামাচাপা দিতে পারে, কিন্তু একটা সময় সত্য প্রকাশ পাবেই। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির যে কিচ্ছাকাহিনি বেরিয়ে আসছে, তার প্রতি ইঙ্গিত করেই এই শিরোনাম বেছে নেওয়া। শেখ হাসিনার পরিবারের অর্থ লোপাটের কাহিনি অনেক আগে থেকেই মানুষ শুনেছে। তবে এখন যেমনভাবে শোনা যাচ্ছে আগে সেভাবে শোনার কোনো সুযোগ ছিল না। তথাকথিত ডিজিটাল আইন দিয়ে শেখ হাসিনা যেভাবে বাক্স্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরে রেখেছিলেন, তাতে কারও সাধ্য ছিল না তাঁর পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি নিয়ে এমনভাবে প্রকাশ্যে কথা বলা বা লেখালেখি করা। আগে তাঁর পরিবারের কারও কারও অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে কদাচিৎ খবর শোনা গেলেও, শেখ হাসিনার নিজের অর্থলুটের কোনো ঘটনা নিয়ে কথা বলা কল্পনাও করা যেত না। তাঁকে নিয়ে
সাধারণ কোনো নেগেটিভ মন্তব্য করলেই সরকারি সংস্থার রোষানলে পড়তে হয়েছে। জেল-জুলুম থেকে শুরু করে নানা অত্যাচার মানুষকে সহ্য করতে হয়েছে। এখন তাঁদের সেসব কেলেঙ্কারি জনসমক্ষে বেরিয়ে আসছে।
এসব কেলেঙ্কারি নিয়ে শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছেন শেখ হাসিনার ভাগনি এবং শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক। দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ এবং লন্ডনে উপহার পাওয়া দুটি ফ্ল্যাটের তথ্য গোপন করায় ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে ব্রিটেনের সিটি ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের একাধিক গণমাধ্যম বলেছে, হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ ডেভেলপার আব্দুল মোতালিফ ও আইনজীবী মঈন গণির কাছে থেকে টিউলিপ ও তাঁর বোন উপহার হিসেবে দুটি ফ্ল্যাট পান। দুটি ফ্লাটের একটি ছিল তাঁর বোন আজমিনারের। তবে সেটিও টিউলিপ ব্যবহার করেছেন।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক রূপপুরে রাশিয়ার অর্থায়নে পরিচালিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাতের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তাঁর পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। এই অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় টিউলিপও জড়িত বলে অভিযোগ আছে। অভিযোগ উঠেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, তাতে মধ্যস্থতা করেছেন টিউলিপ। বিনিময়ে তিনি, তাঁর খালা শেখ হাসিনা, মা শেখ রেহানা ও খালাতো ভাই সজীব ওয়াজেদ জয় ৫ বিলিয়ন ডলার মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। গত মাসেই দুর্নীতির এই তদন্তে যুক্ত হয় টিউলিপ সিদ্দিকের নাম। তারপর তদন্তের অংশ হিসেবে দেশের যেসব ব্যাংকে টিউলিপের অ্যাকাউন্ট আছে, সেই ব্যাংকগুলোকে তাঁর লেনদেনের বিবরণ জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
টিউলিপের এ ঘটনার সঙ্গে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারও কিছুটা সমস্যায় পড়েছেন। ব্রিটেনের গণমাধ্যম অবশ্য এটাকে বলছে, রাজনীতির কাদায় টিউলিপের সঙ্গে আটকে গেছেন স্টারমার। সেখানকার বিরোধী দল থেকে শুরু করে গণমাধ্যমেও সমালোচনা উঠেছে, টিউলিপকে ছায়া দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। টিউলিপকে বরখাস্ত না করে তাঁকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে স্টারমার তাঁর দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন বলে সমালোচনা করেছে বিরোধী কনজারভেটিভরা। তাঁরা বলেছেন, টিউলিপকে বরখাস্ত করার সাহস দেখাননি প্রধানমন্ত্রী। তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু টিউলিপকে সুরক্ষিত রাখার জন্য সময়ক্ষেপণ করেছেন। বাংলাদেশে যখন টিউলিপের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে, তখন স্টারমার তাঁর পদত্যাগে নিজের বেদনা প্রকাশ করে চিঠিও দিয়েছেন। স্টারমার নিজ দলের সদস্যদের তোপের মুখেও পড়েছেন। তাঁর দলের একজন এমপি বলেছেন, টিউলিপকে মন্ত্রী বানানোর সিদ্ধান্ত ছিল স্টারমারের আত্মঘাতী গোল। টিউলিপ বাংলাদেশি রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের একজন সদস্য। তাঁদের এই রাজনৈতিক ডাইনেস্টির সঙ্গে বিপুল ক্ষমতা এবং অর্থের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
টিউলিপ সিদ্দিকের এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নিয়ে শুরু হয়েছে আরেক অধ্যায়। নানা অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালকের পদ পাওয়া নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। দুদক থেকে বলা হচ্ছে, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল দুর্নীতির মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর মেয়ে পুতুলকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে তাঁর ক্ষমতাকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই পদের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যখন পুতুলকে মনোনীত করা হয়, তখনই বেশ বিতর্ক হয়েছিল। এই পদের জন্য তিনি কতটা যোগ্য, সে প্রশ্ন উঠেছিল। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেট-এর সম্পাদকীয়তে পুতুলের মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। সে সময় ব্রিটেনের ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনেও একই প্রশ্ন তোলা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নির্বাচন হয় প্রতি পাঁচ বছর পর। সদস্যরাষ্ট্রগুলো তাদের প্রার্থী মনোনীত করে এই নির্বাচনের জন্য। ল্যানসেটের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, কয়েকটি অঞ্চলে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই পদে বাংলাদেশ যে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে, সেখানে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। কারণ, প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে।
এ পদের জন্য সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে আরেকজন প্রার্থী ছিলেন নেপালের শম্ভু আচার্য। তিনি ছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, যিনি ৩০ বছর যাবৎ সেখানে কাজ করেছেন। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্যের ওপর তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি ছিল। অপরদিকে, পুতুল স্কুল সাইকোলজিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তিনি একটি দাতব্য ও গবেষণা সংস্থা দেখাশোনা করেন। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার বড় বাজেট নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই আঞ্চলিক পরিচালকের পদটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক পরিচালক ১১টি দেশের ২০০ কোটি মানুষের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বাজেট দেখাশোনা করতে হয়। সে সময় নির্বাচনের আগে পুতুল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক সফরে তাঁর মা শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। এই সফরের মধ্যে ছিল নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন, দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলন। এসব সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। প্রচারের অংশ হিসেবে তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টও করেছিলেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পুতুলের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে পাশ কাটিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল অফিসের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকার পুতুলকে নিয়ে যে আপত্তি তুলেছে, তার নিরসন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেই করতে হবে। উল্লেখ, কোনো আঞ্চলিক পরিচালককে নিয়ে তাঁর নিজ দেশের ভেতর থেকে আপত্তি ওঠার বিষয়টি নজিরবিহীন। অতীতে এ ধরনের নজির আর দেখা যায়নি।
দুদক শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মোট ৯টি মেগা প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তদন্ত শুরু করেছে। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫৯ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ। আর আশ্রয়ণ প্রকল্প, বিডা এবং বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল, মিরসরাই প্রথম পর্যায়, মিরসরাইয়ে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের মতো ৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নের আড়ালে ২১ হাজার কোটি টাকা লোপাট করার অভিযোগ রয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ কেলেঙ্কারি এ তালিকার বাইরে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে শুধু নিজ পরিবার নয়, তাঁর বৃহত্তর পরিবারের সদস্যরাও দুর্নীতি ও অর্থ লুটপাটে নিমগ্ন ছিলেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধারণা, শেখ পরিবারের এমন কোনো সদস্য নেই যিনি বিগত ১৫ বছরে অর্থ লুটপাট করে হাজার কোটি টাকার মালিক হননি। তাঁদের এই কেলেঙ্কারির কাহিনি ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে!’ এটি একটি প্রবাদ বাক্য। আমরা অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু বোঝাতে গিয়ে প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করে থাকি। যে বাক্য বা উক্তি সংক্ষিপ্ত আকারে এবং রূপক আকারে বিশেষ অর্থ বহন করে, যার মাঝে কোনো বাস্তব সত্য নিহিত রয়েছে এবং দীর্ঘদিন ধরে লোকের মুখে মুখে চলে আসছে, তাকেই আমরা প্রবাদ বাক্য বলে থাকি। প্রবাদ হলো লোকসমাজের অভিজ্ঞতার নির্যাস; জীবন, জগৎ ও সমাজ সম্পর্কে মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত উক্তি। এই প্রবাদ আমাদের লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ। প্রবাদ অতীতের বিষয় হয়েও সমকালকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করে।
আমি শিরোনামে যে প্রবাদ বাক্যটি উল্লেখ করেছি, তার অর্থ হলো, সত্য কখনো গোপন থাকে না। অর্থাৎ অন্যায় করে কেউ সাময়িকভাবে সত্যকে ধামাচাপা দিতে পারে, কিন্তু একটা সময় সত্য প্রকাশ পাবেই। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির যে কিচ্ছাকাহিনি বেরিয়ে আসছে, তার প্রতি ইঙ্গিত করেই এই শিরোনাম বেছে নেওয়া। শেখ হাসিনার পরিবারের অর্থ লোপাটের কাহিনি অনেক আগে থেকেই মানুষ শুনেছে। তবে এখন যেমনভাবে শোনা যাচ্ছে আগে সেভাবে শোনার কোনো সুযোগ ছিল না। তথাকথিত ডিজিটাল আইন দিয়ে শেখ হাসিনা যেভাবে বাক্স্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরে রেখেছিলেন, তাতে কারও সাধ্য ছিল না তাঁর পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি নিয়ে এমনভাবে প্রকাশ্যে কথা বলা বা লেখালেখি করা। আগে তাঁর পরিবারের কারও কারও অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে কদাচিৎ খবর শোনা গেলেও, শেখ হাসিনার নিজের অর্থলুটের কোনো ঘটনা নিয়ে কথা বলা কল্পনাও করা যেত না। তাঁকে নিয়ে
সাধারণ কোনো নেগেটিভ মন্তব্য করলেই সরকারি সংস্থার রোষানলে পড়তে হয়েছে। জেল-জুলুম থেকে শুরু করে নানা অত্যাচার মানুষকে সহ্য করতে হয়েছে। এখন তাঁদের সেসব কেলেঙ্কারি জনসমক্ষে বেরিয়ে আসছে।
এসব কেলেঙ্কারি নিয়ে শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছেন শেখ হাসিনার ভাগনি এবং শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক। দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ এবং লন্ডনে উপহার পাওয়া দুটি ফ্ল্যাটের তথ্য গোপন করায় ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে ব্রিটেনের সিটি ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের একাধিক গণমাধ্যম বলেছে, হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ ডেভেলপার আব্দুল মোতালিফ ও আইনজীবী মঈন গণির কাছে থেকে টিউলিপ ও তাঁর বোন উপহার হিসেবে দুটি ফ্ল্যাট পান। দুটি ফ্লাটের একটি ছিল তাঁর বোন আজমিনারের। তবে সেটিও টিউলিপ ব্যবহার করেছেন।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক রূপপুরে রাশিয়ার অর্থায়নে পরিচালিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাতের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তাঁর পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। এই অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় টিউলিপও জড়িত বলে অভিযোগ আছে। অভিযোগ উঠেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, তাতে মধ্যস্থতা করেছেন টিউলিপ। বিনিময়ে তিনি, তাঁর খালা শেখ হাসিনা, মা শেখ রেহানা ও খালাতো ভাই সজীব ওয়াজেদ জয় ৫ বিলিয়ন ডলার মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। গত মাসেই দুর্নীতির এই তদন্তে যুক্ত হয় টিউলিপ সিদ্দিকের নাম। তারপর তদন্তের অংশ হিসেবে দেশের যেসব ব্যাংকে টিউলিপের অ্যাকাউন্ট আছে, সেই ব্যাংকগুলোকে তাঁর লেনদেনের বিবরণ জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
টিউলিপের এ ঘটনার সঙ্গে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারও কিছুটা সমস্যায় পড়েছেন। ব্রিটেনের গণমাধ্যম অবশ্য এটাকে বলছে, রাজনীতির কাদায় টিউলিপের সঙ্গে আটকে গেছেন স্টারমার। সেখানকার বিরোধী দল থেকে শুরু করে গণমাধ্যমেও সমালোচনা উঠেছে, টিউলিপকে ছায়া দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। টিউলিপকে বরখাস্ত না করে তাঁকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে স্টারমার তাঁর দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন বলে সমালোচনা করেছে বিরোধী কনজারভেটিভরা। তাঁরা বলেছেন, টিউলিপকে বরখাস্ত করার সাহস দেখাননি প্রধানমন্ত্রী। তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু টিউলিপকে সুরক্ষিত রাখার জন্য সময়ক্ষেপণ করেছেন। বাংলাদেশে যখন টিউলিপের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে, তখন স্টারমার তাঁর পদত্যাগে নিজের বেদনা প্রকাশ করে চিঠিও দিয়েছেন। স্টারমার নিজ দলের সদস্যদের তোপের মুখেও পড়েছেন। তাঁর দলের একজন এমপি বলেছেন, টিউলিপকে মন্ত্রী বানানোর সিদ্ধান্ত ছিল স্টারমারের আত্মঘাতী গোল। টিউলিপ বাংলাদেশি রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের একজন সদস্য। তাঁদের এই রাজনৈতিক ডাইনেস্টির সঙ্গে বিপুল ক্ষমতা এবং অর্থের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
টিউলিপ সিদ্দিকের এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নিয়ে শুরু হয়েছে আরেক অধ্যায়। নানা অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালকের পদ পাওয়া নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। দুদক থেকে বলা হচ্ছে, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল দুর্নীতির মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর মেয়ে পুতুলকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে তাঁর ক্ষমতাকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই পদের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যখন পুতুলকে মনোনীত করা হয়, তখনই বেশ বিতর্ক হয়েছিল। এই পদের জন্য তিনি কতটা যোগ্য, সে প্রশ্ন উঠেছিল। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেট-এর সম্পাদকীয়তে পুতুলের মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। সে সময় ব্রিটেনের ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনেও একই প্রশ্ন তোলা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নির্বাচন হয় প্রতি পাঁচ বছর পর। সদস্যরাষ্ট্রগুলো তাদের প্রার্থী মনোনীত করে এই নির্বাচনের জন্য। ল্যানসেটের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, কয়েকটি অঞ্চলে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই পদে বাংলাদেশ যে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে, সেখানে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। কারণ, প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে।
এ পদের জন্য সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে আরেকজন প্রার্থী ছিলেন নেপালের শম্ভু আচার্য। তিনি ছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, যিনি ৩০ বছর যাবৎ সেখানে কাজ করেছেন। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্যের ওপর তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি ছিল। অপরদিকে, পুতুল স্কুল সাইকোলজিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তিনি একটি দাতব্য ও গবেষণা সংস্থা দেখাশোনা করেন। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার বড় বাজেট নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই আঞ্চলিক পরিচালকের পদটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক পরিচালক ১১টি দেশের ২০০ কোটি মানুষের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বাজেট দেখাশোনা করতে হয়। সে সময় নির্বাচনের আগে পুতুল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক সফরে তাঁর মা শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। এই সফরের মধ্যে ছিল নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন, দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলন। এসব সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। প্রচারের অংশ হিসেবে তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টও করেছিলেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পুতুলের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে পাশ কাটিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল অফিসের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকার পুতুলকে নিয়ে যে আপত্তি তুলেছে, তার নিরসন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেই করতে হবে। উল্লেখ, কোনো আঞ্চলিক পরিচালককে নিয়ে তাঁর নিজ দেশের ভেতর থেকে আপত্তি ওঠার বিষয়টি নজিরবিহীন। অতীতে এ ধরনের নজির আর দেখা যায়নি।
দুদক শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মোট ৯টি মেগা প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তদন্ত শুরু করেছে। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫৯ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ। আর আশ্রয়ণ প্রকল্প, বিডা এবং বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল, মিরসরাই প্রথম পর্যায়, মিরসরাইয়ে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের মতো ৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নের আড়ালে ২১ হাজার কোটি টাকা লোপাট করার অভিযোগ রয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ কেলেঙ্কারি এ তালিকার বাইরে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে শুধু নিজ পরিবার নয়, তাঁর বৃহত্তর পরিবারের সদস্যরাও দুর্নীতি ও অর্থ লুটপাটে নিমগ্ন ছিলেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধারণা, শেখ পরিবারের এমন কোনো সদস্য নেই যিনি বিগত ১৫ বছরে অর্থ লুটপাট করে হাজার কোটি টাকার মালিক হননি। তাঁদের এই কেলেঙ্কারির কাহিনি ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
টানাপোড়েন যে একটা সৃষ্টি হবে, সে ইঙ্গিত শুরু থেকেই ছিল। সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিকতায় এখন তা স্পষ্টতর হয়েছে। মূল প্রতিপাদ্য একটাই। সংস্কার করে জাতীয় নির্বাচন, নাকি জাতীয় নির্বাচনের পরে সংস্কার? যদি সংস্কার করে নির্বাচন হয়, তাহলে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সব সংস্কার কার্যক্রম শেষ করার পরে নির্বাচন...
৪ ঘণ্টা আগেবার্ধক্য হলো ষাটোর্ধ্ব জীবন। সারকোপেনিয়া হলো একধরনের পেশি ক্ষয় যা সাধারণত বার্ধক্যে ঘটে। সারকোপেনিয়া সাধারণত বয়স্ক বা পরিশ্রম না করে বসে থাকা জনগণ এবং রোগীদের প্রভাবিত করে, যাদের অন্যান্য অসুস্থতা রয়েছে। এটা মানব দেহের পেশির সিস্টেমকে প্রভাবিত করে বা শারীরিক কার্যকলাপকে ব্যাহত করে।
৪ ঘণ্টা আগেদেশজুড়ে এখন সবচেয়ে মুখরোচক আলোচনা হচ্ছে নির্বাচন ঘিরে। কেউ চাইছে নির্বাচন হোক সংস্কারের পর, কেউ চাইছে এ বছরের মাঝামাঝি। কেউ বলছে আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ নির্বাচন হবে। অভিজ্ঞ মহল বলছে, সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া, নির্বাচন হওয়ার পরও তা চলতে থাকবে। সুতরাং সংস্কারের কথা বলে নির্বাচন আটকে রাখা...
৪ ঘণ্টা আগেরাজনীতি একটি নির্মম ক্ষেত্র। টিউলিপ এমন দুটি জগতের অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন, যেখানে আলাদা নিয়মে খেলা চলে। এখন তাঁর পরিবারের সুনাম বাংলাদেশ এবং ব্রিটেন—উভয় জায়গায়ই কলঙ্কিত। আর তিনি কোনো জায়গাতেই সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন না...
১ দিন আগে