একাত্তরকে ভুলতে পারে উন্মাদ ও বিকৃত মানুষ

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭: ১৫
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বর্তমানের মধ্যে প্রবহমান রয়েছে। ছবি সৌজন্য: মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ

জাতীয় ঐক্যের কথা বলতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে কার বিরুদ্ধে ঐক্য এবং কিসের জন্য ঐক্য। কার বিরুদ্ধে ঐক্য সেটা একাত্তর সালে আমরা জানতাম, ঐক্য ছিল পাকিস্তানি শোষকের বিরুদ্ধে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার জন্য ঐক্য। এখন ওই ঐক্য নেই। এখন প্রতিটি মানুষ কেবল নিজের সমৃদ্ধি নিয়ে ভাবছে। নিজের স্বার্থ দেখছে। অন্য কোনো আদর্শ নেই। মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ, সে আদর্শকে সামনে আনতে হবে। সে আদর্শটা ছিল একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ওই আদর্শে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই ঐক্যটা শুধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলে আসবে না। একাত্তর সালে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হওয়ার নিরিখ নয়। নিরিখটা হচ্ছে, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যার পৃষ্ঠপোষক সাম্রাজ্যবাদ।

এটা অবিশ্বাস্য, লজ্জাজনক ও দুঃখজনক যে অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে অপ্রত্যক্ষে জামায়াত কী করে এই রাষ্ট্রের শাসনে আসে? এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা ছিল, সেই অবস্থান তারা যে পরিত্যাগ করেছে, এমন কোনো ঘোষণা তারা দেয়নি। একাত্তর সালে তাদের ভূমিকার জন্য তারা জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি। অথচ জামায়াত নেতারা অবলীলায় দেশবাসীকে জ্ঞান দিয়ে চলেছেন। বর্তমান সরকার এদের মেনে নিচ্ছে কোন যুক্তিতে? জামায়াত রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। এ কারণেই তাদের একাত্তরের ভূমিকার কথা ভুলে যেতে হবে? ভুলে যেতে হবে বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জামায়াতের প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার কথা? জনসমর্থনের দিক থেকেও জামায়াত একাত্তরে খুব এগিয়ে ছিল না, এখনো নেই। আমাদের জনগণ কিন্তু ঐতিহাসিকভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ, এই অর্থে যে তারা রাষ্ট্র ও ধর্মকে এক করে দেখে না।

নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেও মৌলবাদের বিকাশের ক্ষেত্রটা নষ্ট হচ্ছে না। বরং সেটা তাজা হচ্ছে দিন দিন, বিশেষভাবে দারিদ্র্যের কারণে। দরিদ্র মানুষ মুক্তির কোনো পথ পাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে যাঁরা নিজেদের মনে করেন, তাঁদের আচরণ আদর্শ আচরণ নয়। ব্যক্তিগত স্বার্থকে তাঁরাও বড় করে দেখছেন। কাজেই মানুষের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে মাদ্রাসাশিক্ষাকে ক্রমাগত সব সরকারই উৎসাহিত করেছে। মাদ্রাসার শিক্ষা পেয়ে গরিব মানুষ আরও গরিব হচ্ছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভটাও প্রকাশের পথ খুঁজে পাচ্ছে না। যার ফলে মানুষ মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এটা আন্তর্জাতিকভাবেও সত্য। আমরা তুরস্ক এবং আলজেরিয়াতেও সেটা দেখছি। ওসব দেশে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে মানুষের যে বিক্ষোভ, সে বিক্ষোভ প্রকাশের জন্য গণতান্ত্রিক পথ খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে সেটা অন্ধকারের দিকে চলে যাচ্ছে।

আমাদের শাসকশ্রেণি মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য থেকে সরে এসেছে। যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার ফলে আমাদের যে নৈতিক জয়টা অবশ্যম্ভাবী ছিল, তা অনেকাংশেই খর্ব হয়ে গেল। সব অপরাধীর না হোক, মূল অপরাধীদের যদি বিচার করতে পারতাম, তাহলে আমাদের নৈতিক শক্তি অনেক বাড়ত। এটা প্রতিহিংসার ব্যাপার নয়। একটা অন্যায় হয়েছে, যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম ছিল, এটা সে সংগ্রামেরই অংশ। অন্যায়ের তো বিচার হতে হবে। অন্যায়কারীরা চিহ্নিত হবে, তাদের বিচার হবে, তাদের অপরাধ জানা যাবে, এটা ওই যুদ্ধেরই অংশ। জয় অসম্পূর্ণই রয়ে গেল, কেননা আমরা তাদের বিচার করতে পারলাম না। বলা হচ্ছে, ক্ষমা করে দিচ্ছি। কে ক্ষমা করবে? এটা তো ক্ষমার কোনো ব্যাপারই না। খুনের অপরাধীকে ক্ষমা করা যায়? যে রাষ্ট্রে এত বড় অপরাধীর শাস্তি হয় না, সে রাষ্ট্রে ছোট ছোট অপরাধের শাস্তি হবে কী করে? এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। মনে হবে, এখানে অপরাধ করে পার পাওয়া যায়। অপরাধ জিনিসটা তাই সেভাবে চিহ্নিত হচ্ছে না। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এটা প্রতিষ্ঠিত হলো যে এখানে বিচার পাওয়া যাবে না।

একটা গণতান্ত্রিক সরকার হচ্ছে নির্বাচিত সরকার, কিন্তু নির্বাচিত সরকার মানেই গণতান্ত্রিক সরকার নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন পরস্পর সহনশীলতা, মূল্যবোধ, মর্যাদা, সেটা এই বড় দুই দলের মধ্যে নেই। যাঁরা নির্বাচিত হচ্ছেন, তাঁরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আসেননি। আর দলেই যদি গণতন্ত্র না থাকে, তাহলে সংসদে গণতন্ত্র আসবে কীভাবে? শাসকশ্রেণির দলের আদর্শগত অবস্থানও মৌলিকভাবে এক। তারা আসলে ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে, ক্ষমতা দখল করা মূল ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালে সহনশীলতা বা ধৈর্য থাকে না।

সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল সংসদে অংশ নেবে। সরকার একটি মন্ত্রিসভা গঠন করবে, বিরোধী দল মন্ত্রিসভার পাল্টা একটা ছায়া সরকার গঠন করবে। তারা সরকারের ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিয়ে বিকল্প কী হওয়া উচিত, সেটা বলবে। এ জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে স্বতন্ত্র গবেষণা সেল থাকবে। এরপর আসে সংসদীয় কমিটি। অনেক বিষয় সংসদীয় কমিটির আলোচনাতেই মীমাংসা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে সংসদীয় কমিটিগুলো কাজ করে না। এ ছাড়া কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল আছেন, যিনি অডিট করেন। সেই অডিট রিপোর্ট সংসদে পেশ করার কথা, আলোচনা হওয়ার কথা, সেটা সংসদে করা হয় না। আমাদের সংসদে বিরোধী দল তো আসেই না। যে-ই পরাজিত হয়, সে-ই মনে করে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, তাই তারা সংসদে অংশগ্রহণ করবে না। আর যিনি স্পিকার থাকেন, তিনি নিরপেক্ষ থাকেন না। বিরোধী দল সংসদে না থাকায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা পায় না। এটা আদায় করার দায়িত্ব বিরোধী দলের। সরকারি দল বাইরে যা-ই বলুক, আমার মনে হয় তারাও চায় না যে বিরোধী দল সংসদে থাকুক। আর দেখা যায়, সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ এলাকার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। জাতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন না। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়েই সেখানে আলোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয় না। সেদিক থেকেও সংসদ কার্যকর হয় না। তাই আমরা কখনো দেখি নির্বাচিত বা বৈধ স্বৈরাচার এবং কখনো দেখি অবৈধ, অসাংবিধানিক স্বৈরাচার মানে সামরিক স্বৈরাচার। স্বৈরাচার থাকছেই।

দেশের মানুষের ভাবমূর্তি খবরের কাগজে কী লেখা হলো, তার ওপর নির্ভর করে না। আজকের যুগে সবচেয়ে শক্তিশালী মিডিয়া হচ্ছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া। আমাদের দেশের সরকারি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তো খোলাখুলি আলোচনাই হতে পারে না। কিন্তু বিদেশি ইলেকট্রনিক মিডিয়া যে সংবাদ আমাদের দিচ্ছে, তাতে তো সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই সংবাদ আমরাও পাচ্ছি, বিদেশিরাও পাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই যুগে ভাবমূর্তির ব্যাপারে অতিরিক্ত স্পর্শকাতর হলে ভাবমূর্তি আরও নষ্ট হয়। তখন মনে হয়, অনেক কিছু লুকানোর আছে, যা প্রকাশ করা যাবে না। ভাবমূর্তি নির্ভর করবে আমরা কী করছি তার ওপরে। সমষ্টিগতভাবে আমরা কী করছি, সেটাই বিবেচ্য। সারা পৃথিবী এখন আমাদের চেনে সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ দেশ হিসেবে। আমাদের দেখে ভিক্ষুকের জাত হিসেবে। আমাদের এখানে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে চাপা পড়ে মানুষ মারা যায়। মানুষের জীবনের চেয়ে শাড়ির দাম বেশি। লঞ্চডুবিতে প্রতিবছর কত মানুষ মারা যাচ্ছে। বোমা ফুটেছে সিনেমা হলে, চার্চে, সিপিবির সমাবেশে, রমনা বটমূলে, মিছিলে। এগুলো তো গোটা পৃথিবী দেখছে। ভাবমূর্তি তো এখানেই নষ্ট হচ্ছে। নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত সরকারের দুঃশাসন যত দিন থাকবে, তত দিন ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে না।

প্রত্যাশা হচ্ছে, সমাজ গড়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ তা বাস্তবায়ন করার জন্য আন্দোলন অব্যাহত রাখা। এ আদর্শ বাস্তবায়িত হলে মানুষ ওই চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হবে। এই ঐক্য তখন শাসকশ্রেণি দলের বাইরে একটা নতুন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে পুষ্ট করবে। শাসকশ্রেণি দলেরই বিকল্প দরকার এবং কোনো অবস্থাতেই তা দক্ষিণপন্থীদের কাছ থেকে আসবে না, সেটা আসতে হবে বামপন্থীদের কাছ থেকে।

একাত্তরকে ভোলার তো প্রশ্নই ওঠে না। গণহত্যা এবং হানাদারদের অক্সিলারি ফোর্স আলবদর রাজাকার, জামায়াতে ইসলামীর অনাচার ভুলতে পারে উন্মাদ বা বিকৃত মনের মানুষ। স্মৃতিভ্রংশ মানুষ যেমন স্বাভাবিক মানুষ নয়, স্মৃতিভ্রংশ জাতিও তেমন স্বাভাবিক জাতি নয়। চাইলেই কি আমরা একাত্তরকে ভুলে যেতে পারব? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের বর্তমানের মধ্যে প্রবহমান রয়েছে। সে কারণে একাত্তরকে ভোলার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের দুটো কাজ করতে হবে। অতীতে যে ভালো কাজগুলো ছিল, সেগুলো বিকশিত করতে হবে। অতীতে যে গণতান্ত্রিক উপাদান, ঐক্য, যে সংগ্রামী চেতনা ছিল, তার বিকাশ চাই। আর যে খারাপ দিকগুলো ছিল, সংকীর্ণতা ছিল, পশ্চাৎপদতা ছিল, সেগুলোকে পরিহার করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইসরায়েলের ‘হৃৎপিণ্ড’ তেল আবিবে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

সাগরে নিম্নচাপ, কত দিন বৃষ্টি হতে পারে জানাল আবহাওয়া দপ্তর

শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান যার যার স্থানে শ্রেষ্ঠ: গয়েশ্বর

র‌্যাব বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি: নূর খান লিটন

হাসিনার আমলে রাশিয়ার সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি, জড়াল টিউলিপের নামও

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত