Ajker Patrika

হায় পাসপোর্ট অফিস, হায় ব্যাকরণ ক্লাস!

ফজলুল কবির
আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০২২, ১৪: ২৭
হায় পাসপোর্ট অফিস, হায় ব্যাকরণ ক্লাস!

কেরানীগঞ্জের পাসপোর্ট অফিসের গেটে থাকা নিরাপত্তারক্ষী জানালেন, ফরম জমা দিতে হবে দোতলায়। সঙ্গে কক্ষ নম্বরও জানালেন। কিন্তু দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখেই দুজনের ডাকে থমকে যেতে হলো। বললেন, ‘ভাই এটাই লাইন।’ অগত্যা তাঁদের পেছনে দাঁড়াতে হলো। যদিও মনে কেমন ‘কিন্তু কিন্তু’ করছিল। দেখতে দেখতে লাইনের শেষ ব্যক্তির পরিচয়ও ঘুচে গেল। পেছনে ততক্ষণে পাঁচ-সাতজন দাঁড়িয়ে গেছেন। নারী-পুরুষ সবাই এক লাইনে। তখনো জানি না, এমন লাইন আরও কপালে আছে। আর লাইনের শেষে অপেক্ষা করছে ‘ব্যাকরণ ক্লাস’।

মনে ঘাঁটি গাড়া ওই ‘কিন্তু কিন্তু’র কাছে হার মানতে হলো শেষে। সামনে ও পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনকে জায়গাটা দেখার কথা বলে সিঁড়ি ধরে প্রথমবারের মতো দোতলায় গিয়ে এক হুজ্জতের দেখা মিলল। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত কিছু লোক পুরো দেশ-জাতি উদ্ধারে ব্যস্ত। তাঁরা আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে আগ্রহী নন। জটলা পাকিয়ে ‘নষ্ট হয়ে যাওয়া ব্যবস্থার’ গোষ্ঠী উদ্ধার করছেন। এর মধ্যেই সবাইকে লাইনে দাঁড়াতে বেশ চোটপাট করতে দেখা গেল একজন আনসার সদস্যকে। বেলা তখন ১২টা ৫০। লাইনে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে উত্তেজনা। কারণ, কিছুক্ষণের মধ্যেই মধ্যাহ্নভোজের বিরতি শুরু হবে। আশঙ্কা সত্যি হলো। বিরতি শুরু হলো, কিন্তু শেষ হলো না। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত লাইনে ‘নো নড়ন-চড়ন’।

এর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই অনেকে দুশ্চিন্তায় জেরবার হয়ে গেল। কারণ, প্রত্যেকেরই আবেদন ফরমে একটা নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ আছে, যা অনেক আগেই অতিক্রান্ত। আর যাঁদের সময় হয়েছে, তাঁরা পড়েছেন অনেক পেছনে। এক কথায় মোটা দাগে সবাই হতবিহ্বল। এর মধ্য আরেকটি অংশ পাওয়া গেল, যাঁরা টানা কয়েক দিন লাইনে দাঁড়িয়ে বেশ অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। নিজ দায়িত্বে তাঁরা বাকিদের এখানকার নিয়ম-রীতি বিষয়ে নসিহত করছেন।

আড়াইটায় লাইন সচল হওয়ার পর অবশ্য বেশ অল্প সময়েই ভেতরে ডাক পড়ল। সেখানে একজন কর্মকর্তা ফরম দেখছেন। প্রতি দফায় দুজন করে ভেতরে ডাক পাচ্ছেন। একজন দাঁড়িয়ে থাকছেন, অন্যজনের কাগজপত্র দেখে দিচ্ছেন ওই কর্মকর্তা। অনেকটা হেডমাস্টারের রুমে ছাত্র-ছাত্রীরা যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, সেভাবে। বেশ লাগল। ডাক পড়তেই এগিয়ে দিলাম ফরমসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র। সেগুলো দেখে ওই কর্মকর্তা জানালেন, এনআইডি ও আগের পাসপোর্টে মায়ের নাম আলাদা আছে। ঠিক করতে হবে। আরেকটি কক্ষ থেকে এ সম্পর্কিত ফরম নিয়ে তা পূরণ করে জমা দিতে বললেন। দ্রুত ছুটতে হলো। কিন্তু সহজ ছিল না। কারণ, ওই রুম থেকে বেরোতেই দু-তিনজন ছেঁকে ধরলেন। তাঁদের সরাসরি প্রস্তাব—এত টাকার বিনিময়ে সব ঠিক করে দেওয়া হবে। সঙ্গে অভয়—ভাববেন না। যদিও সভয়ে তখন মনে পড়ল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সম্প্রতি প্রকাশিত খানা জরিপে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের তালিকার শীর্ষ তিনে পাসপোর্ট দপ্তরের অবস্থানের কথা।

সেসব ডিঙিয়ে অন্য কক্ষ থেকে সংশোধনীর আবেদন ফরম নেওয়ার সময় তাঁর কাছ থেকেই জেনে নিলাম, মায়ের নামের প্রমাণপত্র হিসেবে কী কী জমা দিতে হবে? সব জেনে বোঝা গেল, এর জন্য নিজের একাডেমিক সনদ ও মায়ের এনআইডি জমা দিলেই হবে। সেসব সঙ্গে নেই। কিন্তু এতেই হবে কি না, জানতে আবার আগের কক্ষে যেতে হলো। বলার অপেক্ষা রাখে না, এবারও সেই একই লাইন, যার লেজ কেন যেন সব সময় সিঁড়িতেই থাকে। যখন ওই কক্ষে প্রবেশের সৌভাগ্য হলো, তখন বিকেল পৌনে ৫টা। সেখানকার কর্মকর্তা তখন যাই যাই করছেন। এক ঝলক কাগজপত্র দেখে যা জানালেন, তাতে বোঝা গেল যে আগের জানা-বোঝায় কোনো গরমিল নেই।

পরদিন আবার যাত্রা। সুদূর কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল প্রজেক্টের পাসপোর্ট অফিসে, যেখানে ঢাকা দক্ষিণের নাগরিকদের পাসপোর্টের কাজ করা হয়। আবারও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হলো। দেখে-শুনে মনে হলো—এখানে লোকে শুধু লাইন দিতে ভোরে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন, যার সঙ্গে তাল মেলানো সহজ নয়। সে যাক। এবার সব কাগজ হাতে আছে। সংশ্লিষ্ট অন্য সবকিছু সঙ্গে নিয়ে এসেছি; ফলত কিছুটা নির্ভয় বলা যায়। এর মধ্যেই বেশ একটা হট্টগোল শুরু হলো। এক উত্তেজিত তরুণ বেশ ইংরেজিতে বকছে। তরুণটিকে চিনি। রাজধানীর যে এলাকায় থাকি, সেখানকারই অনুজ। ঠিক-ভুল ইংরেজিতে সে যা বলছে, তা হলো—সে একজন ফার্স্টক্লাস গেজেটেড কর্মকর্তা (জানামতে তথ্যটি ভুল) হয়েও এমন হেনস্তার শিকার কেন হতে হবে? দায়িত্বরত আনসার সদস্যটিকে বেশ নরম হতে দেখা গেল। তিনি এবার স্বভাবের (অন্তত দুই দিনে যেমনটা দেখেছি তাঁকে) বাইরে গিয়ে ওই তরুণকে ম্যানেজ করতে ব্যস্ত। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অনেককেই তরুণের এই প্রশ্নকে খুবই যৌক্তিক বলে মেনে নিতে দেখা গেল। কিন্তু কেউ এই প্রশ্ন করলেন না যে, হয়রানি যদি সাধারণের বাস্তবতা হয়, তবে ফার্স্টক্লাস গেজেটেড কর্মকর্তা কেন সেই বাস্তবতায় থাকবেন না? যাক, এই গ্যাঞ্জাম নিয়ে দু-একজন অবশ্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উদাস। তরুণটির সঙ্গে চোখাচোখি হলো একবার। ছেলেটি লজ্জা পেল।

দীর্ঘ লাইন শেষে আবার সেই কর্মকর্তার কক্ষে ছাত্ররূপ দাঁড়িয়ে। তাঁর কপালে বিরক্তির ভাঁজ। লহমার বিরতিতে মনে হলো—তবে কি পোশাক বা চেহারায় কোনো গড়বড়? একটা আয়না থাকলে বেশ হতো। কিন্তু হায়, পাসপোর্ট অফিসে তো আর আয়না থাকে না।

সে যাক, আবার ওই কর্মকর্তা সব কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখলেন। দেখে বললেন—
-এমনিতে ঠিক আছে সব। তবে অ্যাফিডেভিট লাগবে।
-আমি তো সনদ দিলাম। সেখানে সব ঠিক আছে।
-যা বলছি করেন।
-এই নিয়ে তিনবার এলাম। প্রতিবার একটি করে অসংগতির কথা বলছেন। একবারে কেন বলেন না? আর যাদের প্রমাণ দেওয়ার মতো কাগজ নেই বা থাকলেও সেখানে একেকটিতে একেক রকম তথ্য, তাদের জন্য অ্যাফিডেভিট লাগতে পারে। আমার কেন লাগবে? 
-ঠিক আছে। আপনি পাঁচতলায় পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি যদি লিখে দেন, তাহলে লাগবে না।

বেশ বিরক্তি নিয়েই শেষ কথাগুলো বললেন ওই কর্মকর্তা। বের হতেই এবার অ্যাফিডেভিট করে দেওয়ার জন্য কয়েকজন সাহায্যের হাত বাড়াল। দু-একজন তাদের কার্ড গছিয়ে দিল হাতে। বুঝলাম, পাসপোর্ট অফিসের রাস্তায় ঢোকার মুখে যে ফটোকপি দোকানগুলো আছে, যারা পাসপোর্ট ফিসহ নানা কাজে গায়ে পড়ে সাহায্য করতে উদ্‌গ্রীব থাকে, তাদেরই প্রতিনিধি এরা। নিজের কিছু কাগজ ফটোকপি করানোর সময় তাদের বিস্তর সেবা-তালিকা নজরে পড়েছে। কিন্তু আমিও নাছোড়। কার্ড নিলাম, কিন্তু কথা দিলাম না।

এবার সেই পরিচালকের কক্ষে প্রবেশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, নাতিদীর্ঘ লাইন ডিঙিয়েই ঢুকতে হলো সেই কক্ষে। অবশ্য সেই কক্ষের ভেতরেও একটি বাচ্চা-লাইন আছে। বেলাইন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই একেবারে। কাচে ঘেরা বিরাট টেবিল নিয়ে পরিচালক বসে আছেন। কক্ষটি সুপরিসর। সোফায় বেশ কয়েকজন বসে আছেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপের ফাঁকে সেবাগ্রহীতাদের সেবা দিচ্ছেন তিনি। বোঝা গেল, সোফায় উপবিষ্টরা পরিচালকের বন্ধুস্থানীয়।

অবশেষে পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ এল। ফরমটি দেখালাম। উদাসভাবে বললেন—
-অ্যাফিডেভিট কই?
-কেন লাগবে?
-লাগবে।
-তাহলে সংশোধনের আবেদন ফরমে তার উল্লেখ নেই কেন?
-বাংলা পড়তে পারেন না? পরিষ্কার লেখা আছে।
-ফরমে বলা আছে, সংশোধনের প্রমাণপত্র হিসেবে তালিকায় থাকা ছয়টি বিকল্পের যেকোনোটি দিলেই হবে। আমি দুটি দিয়েছি।
-সেখানে অ্যাফিডেভিটের কথাও বলা আছে।
-কিন্তু এটা যে অবশ্যই দিতে হবে—এমন বলা নেই। আমি তিনবার লাইনে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়তলা থেকে জেনেছি, এটা লাগবে। এটা একবারে বলা যাবে না কেন? 
-আপনি বাংলা কথা বোঝেন না? এটা লাগবে।
-কেন? যদি লাগেই, তবে কেন তা স্পষ্ট ভাষায় লেখা থাকবে না? নির্দেশনাটি কেন ঠিকভাবে লেখা হবে না?? এর জন্য হয়রানি হচ্ছে। অনেকেই এমন হয়রানির শিকার।
-আমরা হয়রানি করি না।
-কিন্তু আমি তো হয়রান বোধ করছি।
-আপনি হয়রানি হননি।
-আশ্চর্য! আমি হয়রান হয়েছি কি না, তাও আপনি ঠিক করে দেবেন?
-আমি বাংলায় লেটার পাওয়া ছাত্র। আপনার চেয়ে ভালো বাংলা জানি।

আচমকা এ কথায় একটু দমে যেতে হলো। বিরাট বিপদে পড়েছি বলে মনে হলো। পেছনে লোক জমে যাচ্ছে। সোফায় উপবিষ্ট পরিচালকের বন্ধুস্থানীয়রা উসখুস করছেন। এসব দেখেও মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেল—
-আপনি ভালো বাংলা জানেন—এই দাবি আপনি করতে পারেন। কিন্তু আমার চেয়ে ভালো কি না, সে দাবি আপনি করতে পারেন না। কারণ, আমি কতটা জানি, তা আপনি জানেন না।
-আমি বাংলায় লেটার পেয়েছি।
-সে আপনি পেতেই পারেন। কিন্তু আমি পেয়েছিলাম কি না, তা তো আপনি জানেন না। যখন জানেন না, তখন তুলনা কীভাবে করবেন?
-বলেন—এক পাল হাতি আকাশে উড়ে যাচ্ছে। এই বাক্যে ভুল কোথায়?
-যোগ্যতায়।

এবার মহামান্য সেই পরিচালক রীতিমতো অগ্নিশর্মা। তিনি ভুল বুঝে হয়তো ভেবে নিলেন—আমি তাঁর যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছি। কিন্তু আদতে তাঁর বলা বাক্যটিতে ব্যাকরণ বিবেচনায় ‘যোগ্যতা’রই অভাব। এবার তাঁর বন্ধুস্থানীয়রা মঞ্চে হাজির হলেন। পাশের কক্ষ থেকে আরেক কর্মকর্তা এলেন। পরিস্থিতি ঘোলাটে হচ্ছে। এর মধ্যেই বলে ফেললাম, ‘আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়েছি। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।’ আন্তরিক সেই পরিচালক বললেন, ‘বলুন।’

মনে ততক্ষণে যথেষ্ট ক্ষোভ জমা হয়েছে, যা বিক্ষোভে রূপান্তরের অপেক্ষায়। ফলে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম—
-বিক্ষোভ শব্দের উৎপত্তি কোথা থেকে? 
-কী? 
-বিক্ষোভ শব্দটি কোথা থেকে এসেছে?

কিছুক্ষণ ভাবলেন পরিচালক মহোদয়। তারপর তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, ‘গ্রিক থেকে।’ উত্তরে আমি শুধু নই, অনেকেই নড়ে উঠলেন বলে মনে হলো। আমার চোখ বিস্ফারিত। আবার প্রশ্ন—কী? তিনি অটল—গ্রিক থেকে। এমন উত্তরে আমার পায়ে যেন খিল পড়ে গেছে। নড়া যাচ্ছে না। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তবে ভুল বলেছেন! এমন নানা কিছু যখন ভাবছি, পাশের কক্ষ থেকে আসা অন্য কর্মকর্তাটি তখন আমাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন, ‘স্যার, দেখি কী সমস্যা? আমি দেখে দিচ্ছি।’ আমার মুখে তখন কি একটু হাসির রেখা দেখা দিয়েছিল—সেটা অন্যরা বলতে পারবে। তবে তাদের অস্বস্তি আমি প্রত্যক্ষ করেছি।

ঘটনা এখানে শেষ নয়। এরপর পরিচালকের পাশের ঘরে বসা অন্য কর্মকর্তাটি আমাকে বললেন, ‘অ্যাফিডেভিট ছাড়া দিলেও হয়। তবে হেড অফিস ঝামেলা করতে পারে। আপনি অ্যাফিডেভিট ছাড়াই জমা দিন। ওরা চাইলে পরে আপনাকে অবশ্য এসে অ্যাফিডেভিট জমা দিতে হবে।’ বললাম, ‘আমি আজই জমা দেব।’

এরপর গন্তব্য জমাকক্ষের সামনে। সেখানে তখন বিস্তর লোক গোমড়া মুখে বসে ও দাঁড়িয়ে। একটা টেবিলে ফরম জমা হচ্ছে। তারপর সেখান থেকে সিরিয়াল করে ভেতরে ডাক পড়ে। সুতরাং ওই টেবিলে জমা দিয়ে এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ানো গেল। কিন্তু ডাক আর আসে না। সন্ধ্যা পেরিয়ে ছবি তোলার কক্ষে প্রবেশ। সেখানে পাঁচ-সাতজন লাইনে দাঁড়ানো। ছবি তোলার জন্য চারটি টেবিল দেখা গেল। যদিও লোক আছেন দুজন। দুজন মিলেই এত লোককে সামাল দিচ্ছেন। দিন বৃহস্পতিবার বলে তাঁদের মধ্যেও তাড়া দেখা গেল। অফিস আওয়ার আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু লাইনে থাকা লোকেদের সবারটা শেষ করে তবেই তাঁরা যেতে পারবেন। আমার পালা এল—কাগজ দেখে বললেন—করেছেন কী? আপনাকে তো আরও টাকা জমা দিতে হবে। কেউ বলেনি?
-না। 
-এখন তো ব্যাংক বন্ধ। পারবেন না। আহা, পুরা দিন দাঁড়াইলেন!
-এখন? 
-আপনি রোববার আসেন। আপনার ফরম আমার কাছেই থাক। ওই দিন লাইন ধরবেন না। গেটে বলবেন, ভেতরে আপনার ফরম আছে।

তর্ক বা অন্য কিছুর আর প্রবৃত্তি হলো না। নিজেকে গাড়ল মনে হলো। বেরিয়ে আসছি, এ সময় ওই ব্যক্তি ডেকে আমিসহ আরও কয়েকজনকে বললেন, ‘আপনারা একসঙ্গে যাবেন। বের হয়ে একসঙ্গে গিয়ে সিএনজি বা অটোতে উঠবেন।’
-কেন? 
-এলাকা ভালো না। ছিনতাই হয়। বাইরেই দাঁড়ানো থাকে। পুলিশও থাকে না। একলা থাকলে বিপদ হতে পারে। আমরাও রাতে যারা বের হই, একসাথে বের হই।

কারও মুখে আর কথা সরল না। তখন রাত পৌনে ৮টা। আমার সঙ্গে যাঁরা বের হলেন, তাঁরা একই পরিবারের। দুটি মেয়ে ও একটি ছেলেসন্তান নিয়ে মা-বাবা এসেছেন পাসপোর্ট করাতে। তাঁদের চোখে ভয়। আর আমি ভাবছি—এটুকুই বাকি ছিল কপালে। বেরিয়ে তাঁদের অটো ঠিক করে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। আমার গন্তব্য আলাদা। মনে তখন গ্রিক দেশ থেকে আগত ‘বিক্ষোভ’ শব্দটি কেবলই নড়ছে।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সংযোগ সড়কহীন সেতু

সম্পাদকীয়
সংযোগ সড়কহীন সেতু

সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার করতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়েছেন বৃদ্ধ, নারী ও স্কুলগামী শিশুরা। সংযোগ সড়ক না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা টাকা তুলে মইয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আবার মই বেয়ে উঠতে গিয়ে কয়েকজন গুরুতর দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে।

সংবাদ সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৪ ফুট প্রস্থের সেতুটি নির্মাণের কার্যাদেশ পায় মিথুন এন্টারপ্রাইজ। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যটি আরও কৌতূহল উদ্দীপক। প্রকল্পের ঠিকাদারের দাবি, মাটি না পাওয়ায় তাঁরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে পারেননি।

অতীতেও আমাদের দেশে এ রকম অসংখ্য সেতুর হদিস পাওয়া গেছে। যেখানে কোনো জনবসতি বা রাস্তা নেই, সেখানে সেতু তৈরি করার অনেক নজির রয়েছে। যাঁরা এসব সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পাচ্ছেন তাঁরা জনগণের কথা যে ভাবেন না, সেটা স্পষ্ট। সেতুর নামে যেখানে খুশি সেখানে একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে জনগণের করের টাকা কীভাবে নিজেদের পকেটে ঢোকানো যায়, তাঁরা সেই চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন। অথচ দেশের অনেক জায়গায় সেতুর প্রয়োজন হলেও সেসব জায়গায় সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে না। এতে বছরের পর বছর চলে গেলেও কারও কোনো দুশ্চিন্তা হয় না। ফলে বাধ্য হয়েই ওই সব এলাকার জনগণকে বাঁশের সাঁকো, কাঠের সেতু কিংবা নৌকায় করে ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে দেখা যায়। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক সেতু জরাজীর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

দেশের মানুষের যোগাযোগের কথা চিন্তা করে সরকারি উদ্যোগে অনেক সেতুই নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব সেতু আদৌ জনগণের কল্যাণে আসছে কি না, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের যেন কোনো ভাবনা নেই। তবে সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী যে নিজেদের লাভের জন্য এ ধরনের অপকর্ম করছে, তা ব্যাখ্যা না করলেও চলে।

সেতু নির্মাণের নামে জনগণের অর্থের অপচয় বন্ধ করতে হবে। সেতু নির্মাণ করতে হবে প্রকৃত অর্থেই জনগণের কথা মাথায় রেখে। আর যে সেতু নির্মাণ করে এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসে না, উল্টো দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, তা নির্মাণের কোনো প্রয়োজন নেই। এখন সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ঠিকাদারকে বাধ্য করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অবহেলার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

জাহীদ রেজা নূর
এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি। একজন প্রার্থী ছিলেন, তাঁকেই উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা বেছে নিয়েছি!’

ভোটারের ভোটের স্বাধীনতা বলতে এ রকম একটি আবহই বিরাজ করত সেখানে। আমাদের দেশে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে নির্বাচন। নানা রাজনৈতিক মতাবলম্বী দল অংশ নেবে নির্বাচনে। ফলে, আমাদের নির্বাচন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একপেশে হবে না। তাই তা নিয়ে কৌতুক করার সুযোগই থাকবে না নিশ্চয়ই।

রাশিয়ায় নির্বাচন নিয়ে ইদানীং নতুন নতুন কৌতুকের জন্ম হচ্ছে। একটু হালকা চালে সে কৌতুকগুলো বলে আমাদের দেশের নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু কথা বলব। সেগুলো অবশ্য কৌতুককর হবে না।

রাশিয়ার মানুষ নিজেদেরই প্রশ্ন করে, ‘আমাদের দেশে নির্বাচন আর লটারির মধ্যে পার্থক্য কী?’ নিজেকে এই প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ ভেবে নিজেই উত্তর দেয়, ‘লটারিতে অন্তত ভিন্ন ফল হওয়ার একটা সুযোগ থাকে।’

আরেকটি প্রশ্ন-উত্তর:

— রাশিয়ায় নির্বাচন সব সময় ‘সৎ’ভাবে হয় কেন?

— কারণ ভোট শুরু হওয়ার আগেই সবাই জানে ফল কী হবে।

পরের কৌতুকটা রাজনীতির একটা মোক্ষম জায়গায় হাত দিয়েছে। কোন দেশের জন্য তা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন যেমন, উত্তরও তেমন:

— নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর রূপকথার মধ্যে পার্থক্য কী?

— রূপকথায় শেষ পর্যন্ত ভালোই জেতে।

স্বৈরাচারী নির্বাচনে কীভাবে প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়, তা নিয়ে কৌতুকে বলা হচ্ছে:

নির্বাচনে একজনই প্রার্থী ছিল। তবু

ব্যালট পেপারে দুইটা অপশন ছিল: ‘পক্ষে’ আর ‘খুবই পক্ষে’।

রাশিয়াকে সরিয়ে রাখা যাক। জর্জ অরওয়েলের নামে একটা উদ্ধৃতি ঘুরে বেড়ায় অন্তর্জালে। তিনি বলেছেন, ‘যারা ব্যর্থ লোক, চোর, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারকদের পক্ষে ভোট দেয়, তারা তাদের শিকার নয়—তারা তাদের সহযোগী।’

কিন্তু জর্জ অরওয়েল এ রকম কথা কোথাও বলেছেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেউ না কেউ এ রকম কিছু বলে তা অরওয়েলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। অরওয়েল বলে থাকুন আর না-ই থাকুন, কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল কাছাকাছি এ ধরনের কথা অনেকেই বলেছেন। যেমন মার্কিন উদ্ভাবক, ভিডিও গেম ডিজাইনার, প্রকৌশলী রালফ বেয়ার বলেছিলেন, ‘শৈশবের প্রধান সুবিধা হলো অজ্ঞানতা। তুমি এখনো জানো না যে পৃথিবীটি চালায় প্রতারক, চোর, মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক, খুনি এবং দুষ্টজনেরা।’

একটু ভিন্নভাবে মেক্সিকোর বিপ্লবের নেতা এমিলিয়ানো সাপাতা বলেছিলেন, ‘আমি চোর এবং খুনিকে ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু বিশ্বাসঘাতককে কখনো না।’

এ রকম অনেক কথাই আছে যেগুলো শুনতে ভালো লাগে। বিশ্বাসও হয়। কিন্তু সৎ মানুষের খোঁজ করতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।

এই জায়গায় এসেই আমাদের একটু সতর্ক হতে হয়। কৌতুক থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হয়। আমাদের দেশে ভালো নির্বাচন একেবারে হয়নি, তা নয়। কিন্তু রাজনীতির মাঠে দিনের পর দিন সংসদে যাওয়ার জন্য যে মানুষগুলো প্রস্তুত হয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কালোটাকার মালিক। এভাবে কথাটা বললে অবশ্য সেটাও হয়ে ওঠে কৌতুক। বরং বলা যায়, কালোটাকা ছাড়া নির্বাচন করা খুবই কঠিন, আর তাতে জেতা প্রায় অসম্ভব।

কালোটাকার মালিকদের কথা বললে আবার আমাকে নস্টালজিয়া পেয়ে বসে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমি রাশিয়ায় ছিলাম। দশকের শুরুতেই ধরাশায়ী হয়েছিল কমিউনিস্ট শাসন। সারা বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোয় তখন চলছিল ভাঙন। পশ্চিমা বিশ্বের মদদ ছিল তাতে, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্থবিরতা এবং স্বৈরাচারও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী—এ কথা না বললে সত্যের অপলাপ হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর একটা সময় এসেছিল, যখন হঠাৎ করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল নব্য রুশরা। এই নব্য রুশদের কেউ বেরিয়ে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি থেকে, কেউ তাদের ছাত্রসংগঠন কমসোমল থেকে, কেউ পার্টি না করলেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমিয়ে পুঁজির পাহাড়ে উঠে বসে পড়েছিল। এই নব্য রুশরা ‘জাতে’ উঠতে চাইত। তারা সে সময়ের বিলাসবহুল ‘মার্সিডিস ৬০০’ গাড়ি কিনত, সেটাই চালাত। এ রকম গাড়ি দেখলেই বোঝা যেত, এই লোক নির্ঘাত নব্য রুশ। তারা গলায় পরত মোটা সোনার চেইন। আর শরীরে জড়াত গাঢ় গোলাপি জ্যাকেট। এক পুরুষে অভিজাত হওয়ার খায়েশ মেটাতে

চাইত তারা। তাদের নিয়ে একটা কৌতুক বলে নেওয়া যাক।

দুই নব্য রুশের দেখা হয়েছে মস্কোতে। প্রথমজনের নিখুঁত স্যুটের সঙ্গে একটি মানানসই টাই দেখে দ্বিতীয় নব্য রুশ প্রশ্ন করছে, ‘এই টাই তুমি কোথায় কিনেছ? কত দিয়ে কিনেছ?’

প্রথম নব্য রুশ বলল, ‘টাইটা আমি কিনেছি প্যারিস থেকে, ১০০০ ডলার পড়েছে দাম।’

চুক চুক করে দ্বিতীয়জন বলল, ‘আরে! কী বোকা তুমি! লন্ডনে কিনলে এই একই টাই তুমি ২০০০ ডলারে কিনতে পারতে!’

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। নতুন গোঁফ উঠলে যেমন বারবার আয়নার সামনে দাঁড়ায় সদ্য তরুণ, তেমনি নব্য ক্ষমতার স্বাদ পেলে নব্য রাজনীতিবিদেরাও এমন সব কাণ্ড করতে থাকেন, যা অনেক কৌতুকের জন্ম দেয়।

বলে রাখা ভালো, সেই নব্য রুশরা এখন ইতিহাস। তারা বর্তমানে অচল। তাই তাদের নিয়ে নতুন কোনো কৌতুক তৈরি হয় না।

২. নির্বাচন নিয়ে কথা বলার আগে একটু হালকা আলাপ করে নিলাম। রাজনৈতিকভাবে জটিল হয়ে উঠছে পরিস্থিতি, এ অবস্থায় মানসিক চাপ নেওয়া ঠিক হবে না। নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে, নির্বাচিত দল ক্ষমতা হাতে নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, অর্থনীতিতে গতি আনা, জনমনে নিরাপত্তা দেওয়ার কাজগুলো তারা করবে নিশ্চয়ই। এর জন্য সবচেয়ে আগে দরকার নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে দেশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

ভালো নির্বাচন করতে হলে ভোটারদের আশ্বস্ত করতে হবে যে তাঁরা ভয়ভীতি ছাড়াই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন। প্রত্যেকে সমান সুযোগ পাবেন, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। কোনো শক্তি ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিলে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকছে কি না। এগুলো খুবই জরুরি প্রশ্ন। দেশের মানুষকে বিভাজিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে।

ভোটকেন্দ্রে ও তার আশপাশের এলাকার পরিবেশও অনেক কথা বলে দেবে। এবারের নির্বাচনের দিকে বিশ্ববাসীর নজর থাকবে। গায়ের জোরে কিংবা কৌশল করে কেউ যদি নির্বাচনী রায় ছিনতাই করতে চায়, তাহলে সেই নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

নজর রাখতে হবে প্রশাসনের দিকে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি দলনিরপেক্ষ আচরণ না করে, কিংবা কোনো না কোনো দলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে সে নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সব দলের প্রতি নির্বাচনী বিধির একই রকম প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

বিরোধী মতের কণ্ঠ রোধ করার কথা আগের জামানায় যেমন শোনা গেছে, এই জামানায়ও শোনা যায়। ফলে সব দলের জন্য সমান প্রচারের সুযোগ, সভা-সমাবেশ, পোস্টার ইত্যাদির ব্যাপারে নির্দেশনা থাকতে হবে, যেন সবাই নির্ভয়ে তার কাজটা করতে পারে।

নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন ও কার্যকর থাকবে, সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ভোট গ্রহণ, গণনা ও ফল ঘোষণায় স্বচ্ছতা না থাকলে পরবর্তীকালে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদেরই তার জবাবদিহি করতে হবে। নিকট-অতীতে এই অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, তাদের স্বচ্ছতা বজায় রাখা, কাউকে ছাড় না দেওয়া।

নির্বাচন আসছে। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীল সরকার ক্ষমতায় আসুক। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হোক, ক্ষমতার রদবদল হোক সাংবিধানিকভাবে। আবার নির্বাচন হোক, সবাই তাতে যুক্ত হোক, উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই নির্বাচনী প্রচারণা চালাক, ভোটার নির্ভয়ে তাঁর রায় প্রদান করুন। ফিরে আসুক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এবং সেই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিক নির্বাচিত সরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করার প্রবণতা বন্ধ হোক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

শোয়েব সাম্য সিদ্দিক
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। ফাইল ছবি
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। ফাইল ছবি

২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে একই সময়ে মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম স্থির হয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রেই আরও বেড়েছে। এই অদ্ভুত বৈপরীত্যই আমাদের বাজারব্যবস্থার গভীর সমস্যার দিকগুলো তুলে ধরে।

এই প্রশ্ন আমার কাছে অর্থনীতির শুষ্ক বিশ্লেষণ নয়, এটি মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রামের বাস্তব গল্প। বাজারে যাওয়ার আগে মানুষ ভাবে আজ কি একটু স্বস্তি মিলবে? মাছ, চাল, ডাল, তেল—এসবের দাম গত পাঁচ বছরে যে মাত্রায় বেড়েছে, তা কেবল সংখ্যা নয়, তা মানুষের জীবনমানের ক্ষয়, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশে কেন কমছে না—এই সাধারণ প্রশ্নটাই এখন নীতিনির্ধারণের সবচেয়ে জরুরি আলোচ্য হওয়া উচিত।

আমার পর্যবেক্ষণে প্রধান সমস্যা শুরু হয় আমদানি ও সরবরাহব্যবস্থার অদক্ষতা দিয়ে। যেসব দেশে বৈশ্বিক মূল্যহ্রাস দ্রুত বাজারে প্রতিফলিত হয়, সেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় গড়ে দুই থেকে পাঁচ দিন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে একই কাজ সম্পন্ন করতে গড়ে ১০ থেকে ১২ দিন লাগে। বন্দরে অতিরিক্ত অপেক্ষা, ডেমারেজ চার্জ, শিপিং বিলম্ব এবং কাগজপত্রের জটিলতা যোগ হতে হতে আমদানি করা পণ্যের খরচ বাড়তেই থাকে। ফলে বিদেশে দাম কমলেও দেশে খুচরা পর্যায়ে সেই সুবিধা ভোক্তার সামনে পৌঁছায় না।

দ্বিতীয় সমস্যা টাকার অবমূল্যায়ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাকার মান ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ২০২৪ থেকে ২০২৫ সময়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে তেলের দাম কমেনি। কারণ, আমদানি মূল্য ডলারে নির্ধারিত হয়। টাকার অবমূল্যায়ন বৈশ্বিক মূল্যহ্রাসকে দেশের বাজারে প্রায় নিষ্ফল করে দেয়।

তৃতীয় সমস্যা প্রতিযোগিতাহীন বাজার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ দেখিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সময়ে চাল, তেল, চিনি, ডালসহ প্রধান পণ্যের বাজার কিছুসংখ্যক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাজারে নতুন আমদানিকারক বা পরিবেশকদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হলে মূল্যহ্রাসের চাপ তৈরি হয় না। প্রতিযোগিতা না থাকলে দাম কমার বদলে একই থাকে। আমার মতে, এই বাজারসংকোচনই মূলধারার ভোক্তামূল্যকে দীর্ঘমেয়াদি অস্থির অবস্থায় আটকে রাখে।

চতুর্থ বড় সমস্যা তদারকি দুর্বলতা। ভোক্তা অধিদপ্তর বা প্রশাসনের হঠাৎ অভিযান বাজারে সাময়িক প্রভাব ফেলে, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সব আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কারণ, একটি স্থায়ী, তথ্যভিত্তিক, নিয়মচালিত তদারকি ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি বাজারে মূল্য পরিবর্তনের তথ্য নিয়মিত বিশ্লেষণ এবং কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে সিন্ডিকেটের পক্ষে কৃত্রিম মূল্য নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সহজ হয়ে পড়ে।

পঞ্চমত, তথ্যের অস্বচ্ছতা। বিবিএস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং টিসিবির মূল্যতথ্য একই সময়ে এক নয়। কোন জেলায় কত স্টক আছে, আমদানি করা পণ্য বন্দরে কোথায় আছে, কোন ব্যবসায়ী কতটুকু মজুত রেখেছে—এসব তথ্যের কেন্দ্রীয় ড্যাশবোর্ড বাংলাদেশে নেই। ফলে নীতিনির্ধারকেরা অনেক সময় অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তথ্যহীনতা বাজারের স্বচ্ছতাকে দুর্বল করে এবং সিন্ডিকেটকে সুবিধা দেয়।

অনেকে বলবেন, শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়; রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সুয়েজ খাল-সংকট, পরিবহন ব্যয় ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলে। সেটি সত্য। তবে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে যখন খাদ্যমূল্য বিশ্বব্যাপী টানা নিম্নমুখী, তখন দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ এই সুবিধা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ পারেনি, কারণ অভ্যন্তরীণ কাঠামো দুর্বল এবং নীতি সমন্বয় অনুপস্থিত।

২০২৫ সালে বাংলাদেশের ভোক্তারা কিছু মৌলিক পণ্যের জন্য এখনো আন্তর্জাতিক মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ মূল্য দিচ্ছেন। সিপিডি জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে চিনির গড় দাম কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হলেও বাংলাদেশে সেটি ছিল ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারে ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা কেজি থাকলেও বাংলাদেশে একই সময়ে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা মানুষের জীবনযাত্রাকে চরম অনিরাপদ করে তুলছে। আমার নিজের পর্যবেক্ষণ বলে, মধ্যবিত্তের মাস শেষে ঘাটতি স্থায়ী রূপ নিয়েছে, নিম্নবিত্তের খাদ্য গ্রহণ কমেছে, আর দরিদ্র মানুষের হাতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সামর্থ্য কমে গেছে।

আমার মতে সমাধান সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য। কাস্টমস ও আমদানি প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন জরুরি, কারণ বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হয় বন্দরের অকার্যকারিতা ও কাগজপত্রের জটিলতা থেকে। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় যদি বর্তমান ১০ থেকে ১২ দিন থেকে কমিয়ে ৪৮ ঘণ্টায় আনা যায়, তবে আমদানি করা পণ্যের মোট ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। ডিজিটাল ট্র্যাকিং, অটোমেটেড ডকুমেন্ট যাচাই এবং ঝামেলামুক্ত অনলাইন অনুমোদনব্যবস্থা চালু করলে পণ্যের প্রবাহ দ্রুত হবে, মজুত ব্যয় কমবে এবং খুচরা বাজারে দাম স্বাভাবিকভাবে নেমে আসবে। একইভাবে বাজারে নতুন আমদানিকারক ও পরিবেশকের প্রবেশ সহজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমান বাজারকাঠামোতে কিছু গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে এবং নতুন উদ্যোক্তারা আমদানি লাইসেন্স, এলসি বা বিতরণ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়েন। এই বাধা দূর করতে পারলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দাম কমার স্বাভাবিক চাপ তৈরি হবে, যেটি দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। পাশাপাশি একটি কেন্দ্রীয় মূল্যতথ্য ড্যাশবোর্ড তৈরি করা জরুরি, কারণ কোথায় কত স্টক আছে, কোন পণ্য কখন বন্দরে এসেছে বা ছাড় হয়েছে এবং কোন স্তরে দাম বাড়ছে বা কমছে—এসব তথ্য বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় নীতি গ্রহণে বিলম্ব হয়। একক ড্যাশবোর্ডে আমদানি থেকে খুচরা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ রিয়েল-টাইমে দেখা গেলে সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া সম্ভব হবে, অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি শনাক্ত করা সহজ হবে এবং বাজারে কারসাজির সুযোগ কমে যাবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিদপ্তরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্থায়ী, পেশাদার ও তথ্যনির্ভর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবহার, ক্ষমতায়ন এবং বড় ব্যবসা-গোষ্ঠীর অনিয়ম শনাক্তের পর দ্রুত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এমন স্থায়ী নজরদারি নিশ্চিত করা গেলে কোনো সিন্ডিকেট দীর্ঘ সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না এবং দাম স্বাভাবিকভাবেই নেমে আসবে।

সবশেষে বলতে হয়, বাজার কেবল অর্থনীতির হিসাব নয়, এটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, নিম্নবিত্তের অপূর্ণতা এবং দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন লড়াই, সবকিছু মিলেই বাজারকে মানবিকভাবে বুঝতে হবে। নীতি যদি মানুষের মুখের আহার না বোঝে, তবে সেই নীতি অর্থনীতিকে নিরাপদ রাখতে পারে না। বিশ্ববাজারে দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। এটি বাজারের সমস্যা নয়, নীতির সমস্যা। আমরা চাইলে এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে মানুষের কষ্ট কমবে, বাজার ঠিক হবে এবং অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল পথে ফিরবে। এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

যা করণীয়

সম্পাদকীয়
যা করণীয়

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন পর্যন্ত এতটাই সজীব যে, ইচ্ছে করলেই এই ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অতি সুকৌশলে এমন সব প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, যার উত্তর তারা নিজেরা জানলেও সে উত্তরকে আড়ালে রেখে নতুন বয়ান তৈরির ধূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর, আলশামসের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই কাজটি মূলত তারাই করতে চাইছে, যারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি এখনো হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বাংলাদেশের সূত্রের কাছে না গেলেও চলবে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এবং সে সময়ের ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠা রাও ফরমান আলী তাদের বইগুলোয় একে অপরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। নিয়াজির অফিসের সামনে রাও ফরমান আলী দেখেছেন কাদালেপা মাইক্রোবাস, রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। কেউ কেউ রাও ফরমান আলীকে অনুরোধ করে সেই তালিকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম কাটিয়েছেন বলেও প্রমাণ আছে। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশেরই শিক্ষিত কোনো মানুষ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না বলে মত প্রকাশ করলে তা সত্যের অপলাপই হয়। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ন্যক্কারজনক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।

বাংলা ও বাঙালির বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। দেশের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, সে-ই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস রচনা করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়, ইতিহাসের সত্যগুলো প্রকাশিত হবেই। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে আসা স্বাধীনতার সময়টিতে কার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কার ওপর দেশবাসী রেখেছিল আস্থা, পাকিস্তানিদের চালানো অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা পাওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাঙালির এই জনযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর মহিমাকীর্তন কোনো ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে পারবে না। সব পক্ষের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে আড়াল না করে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা।

আমাদের দেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। এই সময়টিতে পুরো জাতির ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এত বেশি বিভক্ত হয়ে রয়েছে যে তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় সব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আসবে—এমন আশা এখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে না। ন্যূনতম কিছু বিষয়ে একমত হতে হলে জাতিকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। সেদিকেই হতে হবে দেশের যাত্রা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত