মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
বঙ্গবন্ধুর সরকারের শাসনামলের মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, ভারত প্রত্যাগত প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, পাকিস্তান থেকে ৫ লক্ষাধিক বাঙালিকে ফিরিয়ে আনা, ১২১টি দেশের স্বীকৃতি অর্জন, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সদস্যপদ লাভ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, ভারতের সাথে বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয় নিষ্পত্তির লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর, দেশের অভ্যন্তরে অব্যাহত সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরী, চোরাচালানি এবং সব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবস্থা গ্রহণ, বন্যা-দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি মোকাবিলা করে দেশে যখন শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে যখন অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেমে আসে এক অকল্পনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ।
মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ তাঁর পরিবার, মন্ত্রিসভা, আওয়ামী লীগের নেতারাসহ দেশের আপামর জনতা যা কোনো দিন কল্পনাও করেনি, ইতিহাসের নির্মম ও জঘন্য সেই হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত হলো ১৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে। অন্যান্য কর্মব্যস্ত দিনের মতো ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখেও বঙ্গবন্ধু রাত ৮-৯টায় গণভবন থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসায় ফেরেন। তারপর যথারীতি আহার ও অন্যান্য কার্য শেষ করে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু ঘুমাতে গেলেন। ১৫ আগস্ট সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করতে যাবেন। সে জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
পূর্বপরিকল্পনামতো ঘাতক দলের অপারেশন কমান্ডার আর্মার্ড কোরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রশিদ, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর নূর চৌধুরী, মেজর বজলুল হুদা, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর আজিজ পাশা প্রমুখ তাঁদের অধীন সৈন্য, ট্যাংক, কামান, মেশিনগান, স্টেনগান নিয়ে ১৪ আগস্ট রাত থেকেই অভিযানের প্রস্তুতি নেন। তাঁরা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৫ আগস্ট ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তিনটি দল ধানমন্ডি ও সংলগ্ন এলাকায় রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়ি ও ভগ্নিপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাড়ি ঘেরাও করে আক্রমণ করে। শেষোক্ত দুজনের বাড়িতে ভোর ৫টার আগেই আক্রমণ করে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর স্ত্রী আরজু মণি, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর কন্যা বেবী ও পুত্র আরিফ, নাতি সুকান্তসহ সেরানিবাতের বাড়িতে সেই রাতে অবস্থানরত আরও কয়েকজন আত্মীয় ও আশ্রিতজন এবং গৃহপরিচারিকাকে হত্যা করে। এই অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন মেজর ডালিম ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন।
বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানের বিশ্বস্ত মেজর মহিউদ্দিন। সঙ্গে ছিলেন মেজর নূর, মেজর হুদা ও আরও অনেকে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হলে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে আক্রমণকারী সেনাদের তুমুল গোলাগুলি হয়। তখন ভোর সাড়ে ৫টা। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন দিকে বেশ কয়েকটি ফোন করেন। তিনি তাঁর মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন। সেনাবাহিনীপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকেও খবর দিতে বলেন যেন সেনাপ্রধান ফোর্স পাঠান। কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসার পথে সোবহানবাগ মসজিদের কাছে বিদ্রোহী সৈনিকদের গুলিতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেনাপ্রধানের কথা হয়। জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, ক্যান ইউ গেটআউট। আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং।’ কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই সেনাসদস্যরা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। সফিউল্লাহ ফোনে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল বাড়ির গেটের সামনে গোলমাল ও উত্তেজনা দেখে নিচে নেমে আসেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে ঘাতক সৈনিকেরা শেখ কামালকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার পথে মেজর নূরসহ কয়েকজনের মুখোমুখি হন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস?’ অমনি অতর্কিত ব্রাশফায়ারে তাঁর বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। তিনি সিঁড়িতে পড়ে গেলেন। তারপর একে একে হত্যা করা হয় শেখ জামাল ও তাঁর স্ত্রী রোজীকে, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকি, বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের এবং সর্বশেষে কনিষ্ঠ পুত্র ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেলকে। আক্রমণকালে ওই বাড়িতে বেশ কিছুসংখ্যক পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষী নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। সে জন্য তাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক ট্যাংক নিয়ে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিরোধের দায়িত্বে ছিলেন। অন্য অফিসাররা টার্গেট করা বাড়িগুলোর চারদিকে সম্ভাব্য বাধাদানে আসা কোনো পুলিশ বা সৈন্যদের প্রতিরোধে নিয়োজিত ছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদের দায়িত্ব ছিল অপারেশন-পরবর্তী অবস্থা সামাল দেওয়া ও সার্বিক রাজনৈতিক সমন্বয়সাধন।
জেনারেল সফিউল্লাহ যখন বঙ্গবন্ধুর ফোনের জবাব দিচ্ছিলেন, তখন ভোর আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিট। সেনাপ্রধান বিভিন্ন দিকে ফোন করতে থাকেন। ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে ফোন করে প্রথম বেঙ্গল ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুভ করতে বলেন। তাঁর নির্দেশ সত্ত্বেও শাফায়াত জামিল কোনো ব্যবস্থা নেননি। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ প্রমুখকেও ফোন করেছিলেন, কিন্তু কোনো ট্রুপস মুভ করাতে পারেননি। তিনি নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গেও কথা বলেন।
অপারেশন শেষ করে মেজর ডালিম ঢাকা বেতার কেন্দ্র দখল করেন এবং নিজেই বেতারে প্রচার করলেন ‘স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ সকাল ৭টায় ঢাকা বেতারে ফারুক হোসেইনের নিয়মিত সংবাদ পাঠে জানা গেল, খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।
গোটা জাতি এই হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। যে মানুষটি তাঁর সারা জীবন বাংলার মানুষের অধিকার আদায়, তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, পাকিস্তানের কারাগারে নিঃসঙ্গ, অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, জাতিকে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, তাঁকে কিনা হত্যা করেছে একদল বিপথগামী ষড়যন্ত্রকারী সৈনিক। আর্মার্ড কোরের মাত্র দুটি ইউনিট এ অভিযানে যোগ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও চাইলেই বাংলাদেশের তৎকালীন প্রতিরক্ষা বাহিনী বিদ্রোহীদের কাবু করতে পারত। কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে তারা তা করেনি। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। দেশ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যাঁরা ভালোবাসেন কিংবা তাঁকে নিয়ে গবেষণা করেন বা আলোচনা করেন, তাঁরা অনেক সময় বিস্ময় বোধ করেন বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি শুরু করে, বাংলার মানুষকে ভালোবেসে, তাদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তেরো বছরের অধিক সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারা প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন, বলতে গেলে তাঁর জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয়েছে নির্জন বন্দিশালায়, তিনি জীবনে আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখেননি, দীর্ঘসময় অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, ক্ষমতার লোভ কিংবা সম্পদের উচ্চাভিলাষ তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি, সেই মানুষটিকে বাঙালিরা কীভাবে হত্যা করল? তাহলে ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি, ছলচাতুরী এই সব কি বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য? বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সংস্থাপন বিভাগের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন মাহবুবুর রহমান। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত তাঁর রচিত ‘কিছু স্মৃতি কিছু ধৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এ কেমন দেশ বা এ কেমন জাতি? যার মুখের কথা শোনার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক জমা হতো, আর যাকে লক্ষ লক্ষ লোক মিছিল করে অভ্যর্থনা করত, যার জয়ধ্বনিতে গগন বিদারিত হতো, তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, মনে কোনো দুঃখ হলো না। যার জন্ম না হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ হতো না, আর বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না, তার হত্যার সাথে সাথে সবাই তার কথা হেলায় মন থেকে মুছে ফেলল। এ ঘটনার নজির খুঁজে বের করা কঠিন। এ ব্যাপারে আজও অনেকের আত্মজিজ্ঞাসা রয়ে গেছে।’
বঙ্গবন্ধু নিজ বাড়িতে সাধারণ নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে থাকতেন। দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রাপ্য কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা তিনি নেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন, ‘বাঙালি আমাকে মারবে না। তাঁর এ বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল তাঁর দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম। বাংলাদেশকে ও বাঙালিদের তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। এর প্রকাশ দেখা যায় বাংলায় ১৯৫০-এর মন্বন্তরের সময় মুসলিম যুব কর্মীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ, দুর্গতদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ও সেবাদান করার মধ্যে। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আহতদের সেবা করেছেন। ১৯৫৪ সালে আদমজী জুট মিলের দাঙ্গা হামলার সময়, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তিনি দলীয় কর্মীদের নিয়ে বাংলার মানুষকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেছেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দিয়ে তিনি বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন, স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে তিনি যেমন এ দেশের মানুষকে ভালোবাসেন, বাংলার মানুষও তাঁকে ভালোবাসে। তাঁর ডাকে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, দেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করেছে। তাঁর একটি স্বপ্ন বাংলার মানুষ খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে বাস করুক। আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে নিজের স্থান করে নিক। তিনি বলতেন, ‘ভিক্ষুক জাতির পৃথিবীতে কোনো সম্মান নেই।’
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের প্রারম্ভে উল্লিখিত তাঁর নোটবুকে ৩০.০৫.৭৩ তারিখে ইংরেজিতে লেখা একটি উক্তির বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ: ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তন সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বাংলার মানুষের প্রতি হৃদয়ের এই উষ্ণতা ও ভালোবাসার কারণে সব চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের মুখে এই বিশ্বাস প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন যে কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে না। তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে সন্দিহান ও চিন্তিত হয়ে অনেকে তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ তাদের সোর্স মারফত জানতে পারে যে বাংলাদেশে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি নিয়ে ‘র’-এর অন্যতম নীতিনির্ধারক আর এন কাড ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করলে বঙ্গবন্ধু তা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সবাই আমার সন্তান, আমাকে কেউ মারবে না।’
বাংলার মানুষের প্রতি এই অবিচল ও সীমাহীন বিশ্বাসই তাঁর উত্তম চরিত্রের ও মহৎ গুণাবলির বৈশিষ্ট্য। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস একদল বিপথগামী বাঙালিই তাঁকে হত্যা করেছে। তবে হত্যাকারীরা বাঙালি হলেও তারা ছিল বহিঃশত্রুর মদদপুষ্ট ও বেতনভুক্ত জল্লাদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ‘মোশতাক-ফারুক-রশীদরা চেয়েছিলেন’ যেকোনোভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন। ফারুক-রশীদ পাকিস্তান থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধেও যোগদান করেছেন বিলম্বে। তাঁরা কোনো সেক্টরে যুদ্ধ করেননি। কলকাতায় অবস্থান করেছেন।
জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে সিআইএর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। পৃথিবীর কোটি কোটি দরিদ্র, শোষিত, নির্যাতিত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দের হত্যাকাণ্ডের (১৯৭৩) পর অবশ্য বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একে একে আমাদের সবাইকে এভাবে শেষ করা হবে। এবার টার্গেট করা হবে আমাকে।’
কী আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী! হয়তো মনের অগোচরে তিনি এ কথাটি বলে ফেলেছিলেন।
ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা ছিল দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফসল। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লব ও একদলীয় শাসন প্রবর্তনের সময় খন্দকার মোশতাক এর বিরোধিতা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসে তাঁর সঙ্গে উত্তেজিতভাবে তর্কাতর্কি করেন, কিন্তু জেনারেল এমএজি ওসমানী বা ব্যারিস্টার মইনুলের মতো পদত্যাগ করেননি। তিনি পার্লামেন্টেও ছিলেন, মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থেকে ঘাতকদের হত্যাকাণ্ডের সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আছে যে খন্দকার মোশতাক ১৪ আগস্ট বাসা থেকে খাবার রান্না করে এনে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে খাইয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর লাশ নিয়ে কবরে নেমেছিলেন, এ ছাড়া শেখ কামালের বিবাহের উকিলও ছিলেন খন্দকার মোশতাক। বিশ্বাসঘাতক আর কাকে বলে!
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্বাসন দেওয়ার প্রয়াস চলে। কিন্তু ঘন কালো মেঘের আড়ালে লুকায়িত সূর্যের উদয়কে যেমন ঠেকানো যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় পর্বতপ্রমাণ অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে এবং ২০০৯ থেকে একনাগাড়ে আরও তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকে যেমন পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে, তেমনি তাঁর আদর্শ ও পথ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, বৈরী সময়ের ঘটনাবহুল শাসনামলের আজ নতুনভাবে পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে। কীভাবে একটি দেশ ও জাতিকে শূন্যাবস্থা থেকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, উপর্যুপরি বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, সন্ত্রাস, উগ্রবাদী তৎপরতা, দুর্নীতি ইত্যাদি কাটিয়ে উঠে অর্থনীতিকে একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, তা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
পঁচাত্তরে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট কোনো এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি কী?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল।’ পরের প্রশ্ন ‘আপনার দুর্বলতা কী?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল টু মাচ। আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার হানি না ঘটে।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উৎসই ছিল জনগণ। এ রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়েছে গ্রাম বাংলার হাটে-ঘাটে, প্রতারিত, শোষিত বাঙালির পর্ণকুটিরে। মানুষের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা, আন্দোলন-সংগ্রাম নিঃস্বার্থ ত্যাগের ওপর রচিত এবং ত্যাগেই ভালোবাসা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আজীবন সংগ্রামী এ মানুষটি তাঁর আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার আগেই ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের নির্মম হত্যার শিকার হন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরদিন লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়, ‘সবকিছু সত্ত্বেও শেখ মুজিব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ জন্য যে তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশ কখনো বাস্তবে পরিণত হতো না’ (১৬.৮.১৯৭৫)।
কিউবার সংগ্রামী প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল হিমালয়ের মতোই বিশাল।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ বিবিসি প্রচার করে, শেখ মুজিব নিহত হলেন তাঁর নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচ বোধ করেছে।
ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত মন্তব্য করেন আপসহীন-সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডট মন্তব্য করেন, মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে, তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার সংবাদ বেতারে শোনার পর তাৎক্ষণিকভাবে সাহিত্যিক সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীন তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে শক্তিশালীরূপে আবির্ভূত হবেন।’
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ। আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর জার্মানিতে অবস্থানরত তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশায় ভারতে আসার পথে ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন অফিসারকে শেখ হাসিনা তাঁর পাসপোর্ট দেখালে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে সেই অফিসার শেখ হাসিনাকে বললেন, ‘ছিঃ, তোমরা বাংলাদেশিরা জঘন্য জাতি। যে মানুষটি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, তাঁকেই তোমরা হত্যা করে ফেললে?’ শেখ হাসিনা চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এয়ারপোর্টের লোক দেখল দুই বোনের আহাজারি।
বিবিসি বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের জনমত জরিপে ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল, ১৪১১ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ উপাধিতে ভূষিত হন। যুগে যুগে যেসব বাঙালি মনীষী, কবি সাহিত্যিক বাংলাকে ভালোবেসে অমরত্ব লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তাই বলা যায়:
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
(রচনাটি লেখকের ‘চিরঞ্জীব শেখ মুজিব-জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত পাঠ’ গ্রন্থের অংশবিশেষ)
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত
বঙ্গবন্ধুর সরকারের শাসনামলের মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, ভারত প্রত্যাগত প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, পাকিস্তান থেকে ৫ লক্ষাধিক বাঙালিকে ফিরিয়ে আনা, ১২১টি দেশের স্বীকৃতি অর্জন, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সদস্যপদ লাভ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, ভারতের সাথে বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয় নিষ্পত্তির লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর, দেশের অভ্যন্তরে অব্যাহত সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরী, চোরাচালানি এবং সব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবস্থা গ্রহণ, বন্যা-দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি মোকাবিলা করে দেশে যখন শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে যখন অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেমে আসে এক অকল্পনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ।
মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ তাঁর পরিবার, মন্ত্রিসভা, আওয়ামী লীগের নেতারাসহ দেশের আপামর জনতা যা কোনো দিন কল্পনাও করেনি, ইতিহাসের নির্মম ও জঘন্য সেই হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত হলো ১৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে। অন্যান্য কর্মব্যস্ত দিনের মতো ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখেও বঙ্গবন্ধু রাত ৮-৯টায় গণভবন থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসায় ফেরেন। তারপর যথারীতি আহার ও অন্যান্য কার্য শেষ করে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু ঘুমাতে গেলেন। ১৫ আগস্ট সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করতে যাবেন। সে জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
পূর্বপরিকল্পনামতো ঘাতক দলের অপারেশন কমান্ডার আর্মার্ড কোরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রশিদ, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর নূর চৌধুরী, মেজর বজলুল হুদা, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর আজিজ পাশা প্রমুখ তাঁদের অধীন সৈন্য, ট্যাংক, কামান, মেশিনগান, স্টেনগান নিয়ে ১৪ আগস্ট রাত থেকেই অভিযানের প্রস্তুতি নেন। তাঁরা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৫ আগস্ট ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তিনটি দল ধানমন্ডি ও সংলগ্ন এলাকায় রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়ি ও ভগ্নিপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাড়ি ঘেরাও করে আক্রমণ করে। শেষোক্ত দুজনের বাড়িতে ভোর ৫টার আগেই আক্রমণ করে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর স্ত্রী আরজু মণি, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর কন্যা বেবী ও পুত্র আরিফ, নাতি সুকান্তসহ সেরানিবাতের বাড়িতে সেই রাতে অবস্থানরত আরও কয়েকজন আত্মীয় ও আশ্রিতজন এবং গৃহপরিচারিকাকে হত্যা করে। এই অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন মেজর ডালিম ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন।
বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানের বিশ্বস্ত মেজর মহিউদ্দিন। সঙ্গে ছিলেন মেজর নূর, মেজর হুদা ও আরও অনেকে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হলে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে আক্রমণকারী সেনাদের তুমুল গোলাগুলি হয়। তখন ভোর সাড়ে ৫টা। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন দিকে বেশ কয়েকটি ফোন করেন। তিনি তাঁর মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন। সেনাবাহিনীপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকেও খবর দিতে বলেন যেন সেনাপ্রধান ফোর্স পাঠান। কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসার পথে সোবহানবাগ মসজিদের কাছে বিদ্রোহী সৈনিকদের গুলিতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেনাপ্রধানের কথা হয়। জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, ক্যান ইউ গেটআউট। আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং।’ কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই সেনাসদস্যরা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। সফিউল্লাহ ফোনে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল বাড়ির গেটের সামনে গোলমাল ও উত্তেজনা দেখে নিচে নেমে আসেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে ঘাতক সৈনিকেরা শেখ কামালকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার পথে মেজর নূরসহ কয়েকজনের মুখোমুখি হন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস?’ অমনি অতর্কিত ব্রাশফায়ারে তাঁর বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। তিনি সিঁড়িতে পড়ে গেলেন। তারপর একে একে হত্যা করা হয় শেখ জামাল ও তাঁর স্ত্রী রোজীকে, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকি, বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের এবং সর্বশেষে কনিষ্ঠ পুত্র ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেলকে। আক্রমণকালে ওই বাড়িতে বেশ কিছুসংখ্যক পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষী নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। সে জন্য তাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক ট্যাংক নিয়ে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিরোধের দায়িত্বে ছিলেন। অন্য অফিসাররা টার্গেট করা বাড়িগুলোর চারদিকে সম্ভাব্য বাধাদানে আসা কোনো পুলিশ বা সৈন্যদের প্রতিরোধে নিয়োজিত ছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদের দায়িত্ব ছিল অপারেশন-পরবর্তী অবস্থা সামাল দেওয়া ও সার্বিক রাজনৈতিক সমন্বয়সাধন।
জেনারেল সফিউল্লাহ যখন বঙ্গবন্ধুর ফোনের জবাব দিচ্ছিলেন, তখন ভোর আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিট। সেনাপ্রধান বিভিন্ন দিকে ফোন করতে থাকেন। ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে ফোন করে প্রথম বেঙ্গল ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুভ করতে বলেন। তাঁর নির্দেশ সত্ত্বেও শাফায়াত জামিল কোনো ব্যবস্থা নেননি। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ প্রমুখকেও ফোন করেছিলেন, কিন্তু কোনো ট্রুপস মুভ করাতে পারেননি। তিনি নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গেও কথা বলেন।
অপারেশন শেষ করে মেজর ডালিম ঢাকা বেতার কেন্দ্র দখল করেন এবং নিজেই বেতারে প্রচার করলেন ‘স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ সকাল ৭টায় ঢাকা বেতারে ফারুক হোসেইনের নিয়মিত সংবাদ পাঠে জানা গেল, খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।
গোটা জাতি এই হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। যে মানুষটি তাঁর সারা জীবন বাংলার মানুষের অধিকার আদায়, তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, পাকিস্তানের কারাগারে নিঃসঙ্গ, অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, জাতিকে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, তাঁকে কিনা হত্যা করেছে একদল বিপথগামী ষড়যন্ত্রকারী সৈনিক। আর্মার্ড কোরের মাত্র দুটি ইউনিট এ অভিযানে যোগ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও চাইলেই বাংলাদেশের তৎকালীন প্রতিরক্ষা বাহিনী বিদ্রোহীদের কাবু করতে পারত। কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে তারা তা করেনি। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। দেশ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যাঁরা ভালোবাসেন কিংবা তাঁকে নিয়ে গবেষণা করেন বা আলোচনা করেন, তাঁরা অনেক সময় বিস্ময় বোধ করেন বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি শুরু করে, বাংলার মানুষকে ভালোবেসে, তাদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তেরো বছরের অধিক সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারা প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন, বলতে গেলে তাঁর জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয়েছে নির্জন বন্দিশালায়, তিনি জীবনে আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখেননি, দীর্ঘসময় অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, ক্ষমতার লোভ কিংবা সম্পদের উচ্চাভিলাষ তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি, সেই মানুষটিকে বাঙালিরা কীভাবে হত্যা করল? তাহলে ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি, ছলচাতুরী এই সব কি বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য? বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সংস্থাপন বিভাগের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন মাহবুবুর রহমান। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত তাঁর রচিত ‘কিছু স্মৃতি কিছু ধৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এ কেমন দেশ বা এ কেমন জাতি? যার মুখের কথা শোনার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক জমা হতো, আর যাকে লক্ষ লক্ষ লোক মিছিল করে অভ্যর্থনা করত, যার জয়ধ্বনিতে গগন বিদারিত হতো, তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, মনে কোনো দুঃখ হলো না। যার জন্ম না হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ হতো না, আর বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না, তার হত্যার সাথে সাথে সবাই তার কথা হেলায় মন থেকে মুছে ফেলল। এ ঘটনার নজির খুঁজে বের করা কঠিন। এ ব্যাপারে আজও অনেকের আত্মজিজ্ঞাসা রয়ে গেছে।’
বঙ্গবন্ধু নিজ বাড়িতে সাধারণ নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে থাকতেন। দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রাপ্য কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা তিনি নেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন, ‘বাঙালি আমাকে মারবে না। তাঁর এ বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল তাঁর দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম। বাংলাদেশকে ও বাঙালিদের তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। এর প্রকাশ দেখা যায় বাংলায় ১৯৫০-এর মন্বন্তরের সময় মুসলিম যুব কর্মীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ, দুর্গতদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ও সেবাদান করার মধ্যে। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আহতদের সেবা করেছেন। ১৯৫৪ সালে আদমজী জুট মিলের দাঙ্গা হামলার সময়, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তিনি দলীয় কর্মীদের নিয়ে বাংলার মানুষকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেছেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দিয়ে তিনি বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন, স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে তিনি যেমন এ দেশের মানুষকে ভালোবাসেন, বাংলার মানুষও তাঁকে ভালোবাসে। তাঁর ডাকে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, দেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করেছে। তাঁর একটি স্বপ্ন বাংলার মানুষ খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে বাস করুক। আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে নিজের স্থান করে নিক। তিনি বলতেন, ‘ভিক্ষুক জাতির পৃথিবীতে কোনো সম্মান নেই।’
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের প্রারম্ভে উল্লিখিত তাঁর নোটবুকে ৩০.০৫.৭৩ তারিখে ইংরেজিতে লেখা একটি উক্তির বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ: ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তন সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বাংলার মানুষের প্রতি হৃদয়ের এই উষ্ণতা ও ভালোবাসার কারণে সব চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের মুখে এই বিশ্বাস প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন যে কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে না। তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে সন্দিহান ও চিন্তিত হয়ে অনেকে তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ তাদের সোর্স মারফত জানতে পারে যে বাংলাদেশে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি নিয়ে ‘র’-এর অন্যতম নীতিনির্ধারক আর এন কাড ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করলে বঙ্গবন্ধু তা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সবাই আমার সন্তান, আমাকে কেউ মারবে না।’
বাংলার মানুষের প্রতি এই অবিচল ও সীমাহীন বিশ্বাসই তাঁর উত্তম চরিত্রের ও মহৎ গুণাবলির বৈশিষ্ট্য। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস একদল বিপথগামী বাঙালিই তাঁকে হত্যা করেছে। তবে হত্যাকারীরা বাঙালি হলেও তারা ছিল বহিঃশত্রুর মদদপুষ্ট ও বেতনভুক্ত জল্লাদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ‘মোশতাক-ফারুক-রশীদরা চেয়েছিলেন’ যেকোনোভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন। ফারুক-রশীদ পাকিস্তান থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধেও যোগদান করেছেন বিলম্বে। তাঁরা কোনো সেক্টরে যুদ্ধ করেননি। কলকাতায় অবস্থান করেছেন।
জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে সিআইএর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। পৃথিবীর কোটি কোটি দরিদ্র, শোষিত, নির্যাতিত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দের হত্যাকাণ্ডের (১৯৭৩) পর অবশ্য বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একে একে আমাদের সবাইকে এভাবে শেষ করা হবে। এবার টার্গেট করা হবে আমাকে।’
কী আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী! হয়তো মনের অগোচরে তিনি এ কথাটি বলে ফেলেছিলেন।
ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা ছিল দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফসল। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লব ও একদলীয় শাসন প্রবর্তনের সময় খন্দকার মোশতাক এর বিরোধিতা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসে তাঁর সঙ্গে উত্তেজিতভাবে তর্কাতর্কি করেন, কিন্তু জেনারেল এমএজি ওসমানী বা ব্যারিস্টার মইনুলের মতো পদত্যাগ করেননি। তিনি পার্লামেন্টেও ছিলেন, মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থেকে ঘাতকদের হত্যাকাণ্ডের সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আছে যে খন্দকার মোশতাক ১৪ আগস্ট বাসা থেকে খাবার রান্না করে এনে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে খাইয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর লাশ নিয়ে কবরে নেমেছিলেন, এ ছাড়া শেখ কামালের বিবাহের উকিলও ছিলেন খন্দকার মোশতাক। বিশ্বাসঘাতক আর কাকে বলে!
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্বাসন দেওয়ার প্রয়াস চলে। কিন্তু ঘন কালো মেঘের আড়ালে লুকায়িত সূর্যের উদয়কে যেমন ঠেকানো যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় পর্বতপ্রমাণ অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে এবং ২০০৯ থেকে একনাগাড়ে আরও তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকে যেমন পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে, তেমনি তাঁর আদর্শ ও পথ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, বৈরী সময়ের ঘটনাবহুল শাসনামলের আজ নতুনভাবে পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে। কীভাবে একটি দেশ ও জাতিকে শূন্যাবস্থা থেকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, উপর্যুপরি বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, সন্ত্রাস, উগ্রবাদী তৎপরতা, দুর্নীতি ইত্যাদি কাটিয়ে উঠে অর্থনীতিকে একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, তা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
পঁচাত্তরে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট কোনো এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি কী?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল।’ পরের প্রশ্ন ‘আপনার দুর্বলতা কী?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল টু মাচ। আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার হানি না ঘটে।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উৎসই ছিল জনগণ। এ রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়েছে গ্রাম বাংলার হাটে-ঘাটে, প্রতারিত, শোষিত বাঙালির পর্ণকুটিরে। মানুষের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা, আন্দোলন-সংগ্রাম নিঃস্বার্থ ত্যাগের ওপর রচিত এবং ত্যাগেই ভালোবাসা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আজীবন সংগ্রামী এ মানুষটি তাঁর আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার আগেই ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের নির্মম হত্যার শিকার হন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরদিন লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়, ‘সবকিছু সত্ত্বেও শেখ মুজিব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ জন্য যে তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশ কখনো বাস্তবে পরিণত হতো না’ (১৬.৮.১৯৭৫)।
কিউবার সংগ্রামী প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল হিমালয়ের মতোই বিশাল।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ বিবিসি প্রচার করে, শেখ মুজিব নিহত হলেন তাঁর নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচ বোধ করেছে।
ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত মন্তব্য করেন আপসহীন-সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডট মন্তব্য করেন, মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে, তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার সংবাদ বেতারে শোনার পর তাৎক্ষণিকভাবে সাহিত্যিক সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীন তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে শক্তিশালীরূপে আবির্ভূত হবেন।’
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ। আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর জার্মানিতে অবস্থানরত তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশায় ভারতে আসার পথে ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন অফিসারকে শেখ হাসিনা তাঁর পাসপোর্ট দেখালে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে সেই অফিসার শেখ হাসিনাকে বললেন, ‘ছিঃ, তোমরা বাংলাদেশিরা জঘন্য জাতি। যে মানুষটি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, তাঁকেই তোমরা হত্যা করে ফেললে?’ শেখ হাসিনা চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এয়ারপোর্টের লোক দেখল দুই বোনের আহাজারি।
বিবিসি বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের জনমত জরিপে ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল, ১৪১১ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ উপাধিতে ভূষিত হন। যুগে যুগে যেসব বাঙালি মনীষী, কবি সাহিত্যিক বাংলাকে ভালোবেসে অমরত্ব লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তাই বলা যায়:
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
(রচনাটি লেখকের ‘চিরঞ্জীব শেখ মুজিব-জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত পাঠ’ গ্রন্থের অংশবিশেষ)
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত
সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তিন দিনের মধ্যে অটোরিকশা বন্ধের প্রস্তাবে চালকদের রাস্তায় নেমে আসা এবং শহর কার্যত অচল হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ অবরোধে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়।
১৫ ঘণ্টা আগেআগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে কী পারবে না, তাদেরকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে কী হবে না—এ নিয়ে গরম এখন রাজনীতির মাঠ। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক হিসেবে দাবিদার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি তো আরও একধাপ বেশি। আওয়ামী লীগকে কেবল নির্বাচনের বাইরে রাখাই নয়, দাবি তাদের দেশের প্রাচী
১ দিন আগেহুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওনের ছেলে নিষাদ হুমায়ূনের একটা ভাইরাল ভিডিও ক্লিপ দেখলাম। বেশ মজা পেলাম। সত্যি বললে মজার চেয়েও ছোট্ট বাচ্চার কথায় ভাবনার উদ্রেক হলো। চিন্তার দুয়ার উন্মুক্ত হলো।
১ দিন আগেপরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে সার্কুলার অর্থনীতি বা বৃত্তাকার অর্থনীতি এক নবদিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। বাংলাদেশে স্বল্প সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে সার্কুলার অর্থনীতির বিকল্প নেই।
১ দিন আগে