Ajker Patrika

গরম কমাতে গাছ লাগানো হিতে বিপরীতও হতে পারে

জাহাঙ্গীর আলম, ঢাকা
আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২৪, ১৮: ০৬
গরম কমাতে গাছ লাগানো হিতে বিপরীতও হতে পারে

গাছ লাগানো ভালো। প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে নানা দেশেই আজকাল গাছ রোপণের রেকর্ড হচ্ছে। কিন্তু এভাবে গাছ রোপণ কি আসলেই জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট? এতে কি গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরম সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব।

প্রকৃতপক্ষে রেকর্ডের উদ্দেশ্যে গাছ রোপণের কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। ধরেই নেওয়া হয় এসব চারার মাত্র ৪০ শতাংশ শেষ পর্যন্ত টিকে যায়।

কিন্তু আসলেই কত শতাংশ টিকে থাকে, সে খবর তো আর নেওয়া হয় না। কারণ, চারা রোপণের পরবর্তী কয়েক মাস যে নিবিড় যত্নের প্রয়োজন হয়—সেটি করার মতো জনবল, অর্থবল ও ধৈর্য কোনোটাই সাধারণত দেখা যায় না। চারায় পানি দেওয়া, ছোট অবস্থায় গরু-ছাগলের মতো তৃণভোজী প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা করা ইত্যাদি যত্নআত্তি সাধারণত হয় না। তা ছাড়া এসব রেকর্ডের বৃক্ষ রোপণে দেখা যায়, চারাগুলোর মাঝখানে যথেষ্ট দূরত্ব রাখা হয় না। ফলে এগুলো সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না।

এই সময়ের সবচেয়ে বড় পরিবেশগত দুটি চ্যালেঞ্জ হলো, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্যের ক্রম অবনতি। আয়োজন করে বৃক্ষরোপণ, কিন্তু এই ইস্যুতে খুব কমই কাজে আসে।

‘জলবায়ু পরিবর্তন’ বলতে মূলত একটি সামগ্রিক পরিস্থিতিকে বোঝানো হয়। যখন বায়ুমণ্ডলে এমন সব গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যায়, যা মাত্রাতিরিক্ত তাপ ধরে রাখে। ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা এবং আবহাওয়ায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এটি ঘটে মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদনের কারণে। এই প্রক্রিয়া বন্ধ করার সহজ সমাধান হলো পরিবেশ থেকে বিদ্যমান কার্বন ডাই-অক্সাইড কমানো। যৌক্তিক কারণেই মোক্ষম উপায় হিসেবে বেশি বেশি গাছ লাগানোর কথা বলা হয়। কারণ, গাছের খাদ্য উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল কার্বন ডাই-অক্সাইড। এই কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রক্রিয়াজাত করে গাছ কাণ্ডে-শাখায় পুষ্ট হয়।

কিন্তু গাছ রোপণের ধারণায় যে বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়, সেটি হলো যখন কোনো প্রাকৃতিক কারণেই একটি গাছের মৃত্যু ঘটে, ধীরে ধীরে সেই কার্বন দেহটি আবার বায়ুমণ্ডলেই ফিরে আসে। অথচ সেটি কোনো প্রাকৃতিক বনে জঙ্গলে ঘটলে মৃত গাছের ওপর অসংখ্য ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণের সমাহার ঘটে, এরা কার্বন দেহটি হাইড্রো-কার্বন গ্যাস রূপে বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসতে দেয় না। আটকা পড়ে যায়। তার মানে, গাছ যে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করছে, সেটি স্থায়ীভাবে ধরে রাখা সম্ভব শুধু প্রাকৃতিক বনেই।

বৃক্ষরোপণের আরেকটি বড় নেতিবাচক দিক হলো, এই পদক্ষেপ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কোনো কাজে আসে না, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিও হতে পারে। এ ধরনের বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রে সাধারণত দ্রুত বর্ধনশীল, পাতা দ্রুত পচনশীল এবং চিরহরিৎ—এমন বৈশিষ্ট্যের গাছ পছন্দ করা হয়। ফলে সাধারণত স্থানীয় প্রজাতি উপেক্ষিত হয়। আমাদের দেশে ইউক্যালিপটাস, শিশু, রেইনট্রি, মেহগনি ইত্যাদি গাছ এভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। এসব গাছ পাখিদের খাবার ও বাসস্থানের জন্য উপযোগী নয়। এসব গাছ প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি শোষণ করে। জীববৈচিত্র্যের জন্যও কোনো উপকারে আসে না। বাতাসে প্রচুর রেণু ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আশপাশে অ্যালার্জির সমস্যা বাড়ে।

এর মধ্যে কিছু গাছ আছে, অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে স্থানীয় বৃক্ষ প্রজাতি হুমকির মুখে পড়ে। এ কারণে আজকাল অবশ্য এসব বিদেশি গাছ রোপণ নিরুৎসাহিত করা হয়।

মজার বিষয় হলো, গ্রীষ্মকালে এসব গাছ তাপমাত্রা না কমিয়ে উল্টো বাড়িয়ে দিতে পারে। আবহাওয়া বিজ্ঞানে ‘ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার’ বলে একটি কথা আছে। বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকলে, অর্থাৎ বাতাস যদি সম্পৃক্ত হয়; তাহলে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে ঠান্ডা হওয়ার সুযোগ কমে যায়। এই কারণেই কিন্তু আর্দ্রতা বেশি থাকলে অস্বস্তি বাড়ে। শরীর ঘামলেও তাপমাত্রা কমে না। এতে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ে।

ওই সব বিদেশি গাছের প্রস্বেদনের হার স্থানীয় জাতের অনেক গাছের চেয়ে ঢের বেশি। ফলে এসব গাছ বেশি থাকলে সেই এলাকায় ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হাতে গোনা কয়েক প্রজাতির গাছ রোপণের মাধ্যমে বন তৈরি করা কখনো সম্ভব নয়। একটি বনের যে জটিল বাস্তুতন্ত্র থাকে, যার মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য রক্ষিত হয়—সেটি এই তথাকথিত কৃত্রিম বনায়নের মাধ্যমে অসম্ভব।

একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত, গাছ লাগানো প্রাকৃতিক বনের বিকল্প হতে পারে। ২০১৯ সালের দিকে ‘ফ্রন্টিয়ার ইন ফরেস্ট অ্যান্ড গ্লোবাল চেঞ্জ’ সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখানো হয়, বিদ্যমান বনগুলোকে সেগুলোর পরিবেশগত সম্ভাবনা অক্ষত রেখে বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়াই বেশি কার্যকর উপায়। এটিকে বলে ‘প্রোফরেস্টেশন’। এই কৌশল বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিন হাউস গ্যাস অপসারণ এবং সংরক্ষণের জন্য বেশি কার্যকর। আর এতে ব্যয়ও কম।

জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) একটি প্রতিবেদনে সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের বিশাল এলাকা গত দুই শতাব্দীতে ধানের খেত এবং সম্প্রতি চিংড়ির ঘেরে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, ম্যানগ্রোভ বন ও জলাভূমি ধ্বংসের ফলে উপকূলীয় ভূমি ক্ষয় ত্বরান্বিত হতে পারে।

নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সংকুচিত হয়ে আসা বনের প্রাকৃতিক পুনর্জন্মের মাধ্যমে ক্যানোপি কভার (গাছের আচ্ছাদন) বৃদ্ধি করা, নতুন বৃক্ষরোপণের চেয়ে বেশি উপকারী হতে পারে। অন্তত এক শতাব্দীর মধ্যে জলবায়ু সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য সুফল এনে দিতে পারে।

এ কারণে প্রাকৃতিক বন পুনরুদ্ধারই এখন বিজ্ঞানী এবং নীতিনির্ধারকদের কাছে বেশি মনোযোগ পাচ্ছে। জার্মান সরকার এবং ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৫ কোটি হেক্টর বন পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ ছাড়া গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলের ৪৩টি দেশ বন পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম ১ কোটি ৪৬ লাখ হেক্টর প্রাকৃতিক বন পুনরুদ্ধার করবে।

বাংলাদেশও এই প্রতিশ্রুতির বাইরে নেই। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গত ২০ বছরে ৪ দশমিক ১ শতাংশ প্রাথমিক বনাঞ্চল কমেছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশই কমেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। যদিও ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে ট্রি কভার (ক্যানোপি) বাড়ছে বলে দাবি করছে সরকার।

দুঃখের বিষয় হলো, বন রক্ষা এ দেশে সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিতে পারেনি। প্রতিবছর গ্রীষ্মে যখন গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকে মানুষ, তখনই বৃক্ষ নিধন নিয়ে বিলাপ, আর বেশি বেশি গাছ লাগানোর নছিহত চলতে থাকে।

এই ক্যাম্পেইন শহরে রীতিমতো ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। রাজধানীতে এক ইঞ্চি জায়গাও কেউ ছাড়তে চায় না। সেখানে বৃক্ষরোপণের আলাপ বিলাসিতা। যাঁদের বিলাসিতার সামর্থ্য আছে, তাঁরা তো বাড়ির সামনে গোছানো লন রাখেন। কিন্তু শহরের এই সুন্দর লনে তো প্রাণপ্রকৃতি রক্ষা পাবে না। অনেকেই এখন ছাদে বারান্দায় বাগান করছেন। কে জানে শৌখিন শহুরে মানুষের এই শখের ছাদবাগান থেকে উড়ে আসা এডিস মশার কামড়ে প্রতিবছর ডেঙ্গুতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুতে হচ্ছে কি না!

গ্রীষ্মকালকে আবার সহনীয় করতে চাইলে আমাদের বরং উচিত, নির্বিচারে বন নিধনের পরও এখনো যতখানি টিকে আছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিসংখ্যান ও মানচিত্র তৈরি করে সেগুলো সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার ও বর্ধনে জোর দেওয়া। বিভিন্ন এলাকায় এখনো পুরোনো ও বৃহৎ বৃক্ষ টিকে রয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণে নজর দিতে হবে। বাড়াতে হবে জলাধার, উন্মুক্ত মাটি। সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণে দায়বদ্ধতা। আরও দরকার ব্যক্তিগত পরিবহন কমিয়ে গণপরিবহন এবং হাঁটার উপযোগী ফুটপাত।

লেখক: আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত