শেখ ফজলে শামস পরশ

খুব ভোরে প্রচণ্ড ভাঙচুরের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙে। উঠে দেখি মা নেই পাশে। বিছানায় শুধু আমরা দুই ভাই। জানালা দিয়ে ঝড়ের মতো গোলাগুলি হচ্ছে। গুলিগুলো দেয়াল ফুটো করে মেঝেতে আছড়ে পড়ছে। সিঁড়িঘরে অনেক কান্নাকাটির আওয়াজ, হইচই। আমরা দুই ভাই ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়িঘরের দিকে গিয়ে দেখি বাবা-মা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়া। মায়ের পা দুটো বাবার বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা। দাদির শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোপুটি যাচ্ছে, আর দাদি পাগলের মতো প্রলাপ বকছেন, দেয়ালে কপাল ঠুকছেন।
এ অবস্থায় উনি আমার বড় চাচিকে বললেন, ‘ফাতু (শেখ সেলিম কাকার সহধর্মিণী ফাতেমা চাচি), আরজুর পা দুটি মণির বুকের ওপর থেকে সরাও।’
সেলিম কাকা (শেখ সেলিম কাকা) আর চাচি বাবা-মার পাশে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছেন। আর বাবা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। মুখে কোনো কষ্টের চিহ্ন নাই। মনে হচ্ছে উনি যেন শান্তির নিদ্রায় বিভোর। শুধু গলায় কণ্ঠমণির নিচে চামড়া উঠে যাওয়ার একটা চিহ্ন। বাবার শরীরের অন্য কোথাও কোনো ক্ষত আমার মনে নাই। আমরা দুই ভাই কান্নাকাটি করছিলাম। মনে হয় আমরা ভয়েই কাঁদছিলাম; কারণ, মৃত্যু কাকে বলে তখনো আমরা জানি না। মৃত্যুর পর যে মানুষকে আর পাওয়া যায় না, সেটাও আমার জানা ছিল না। মৃত্যুর সাথে ওই আমার প্রথম পরিচয়। একসাথে অনেকগুলো মৃত্যু।
মায়ের মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ।
মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’
ওটাই বোধ হয় মায়ের শেষ কথা। এর পর কী হলো আমি জানি না। গুলির আওয়াজ অনেক বেড়ে যাচ্ছিল এবং কারা যেন এদিকে আবার আসছিল। আমার চাচি তখন আমাদের নিয়ে তাঁর ড্রেসিংরুমে পালালেন। আমাদের মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিলেন, যাতে গুলি না লাগে। গুলি মনে হয় বাথরুমের জানালা দিয়ে ড্রেসিংরুমেও ঢুকে যাচ্ছিল।
এর পর আর বাবা-মার সঙ্গে আমাদের আর দেখা হয় নাই। শুনেছি সেলিম কাকা একটা গাড়িতে করে মাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর মারুফ কাকা অন্য এক গাড়িতে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
এর পর সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পর আমরা দুই ভাই, চাচি, দাদি, আর রেখা ফুফু এক কাপড়ে আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে যাই। তখনো বুঝি নাই যে, ওটাই নিজেদের বাসা থেকে আমাদের শেষ প্রস্থান। আর কখনো ওই বাসায় ফিরতে পারব না। আমার বয়স তখন পাঁচ বছর, আর আমার ভাই তাপসের বয়স চার বছর। আমাদের বাসাটা ছিল ধানমন্ডি ১৩ নম্বর রোডে একটা কানাগলির রাস্তায়। বাসা থেকে বের হয়ে পাশেই ছিল এক বিদেশি রাষ্ট্রদূত ভবন। আমরা সেখানেই আশ্রয় নিই। ওখান থেকে আমরা দেখতে পাই, আমাদের বাসায় আর্মিদের আনাগোনা, লুটতরাজ। এর পর শুরু হয় আমাদের ভবঘুরে জীবনযাপন; একেক দিন একেক বাসায়।
কোনো বাসায় দুদিন, কোনো বাসায় চার দিন। আশ্রয়ার্থী হিসেবে এভাবেই চলতে থাকে বেশ কয়েক মাস। আমার কোনো ধারণা ছিল না, কেন আমরা নিজের বাসায় ফেরত যেতে পারছি না। পরে দাদি-চাচিদের মাধ্যমে বুঝলাম যে আর্মিরা আমাদের খুঁজছিল। কয়েকটি বাসায় আর্মিরা আমাদের খুঁজতেও এসেছিল। ভাগ্যিস আমরা সময়মতো সেই বাসা থেকে পালিয়ে অন্য বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম।
মাহুতটুলিতে মঞ্জু খালার বাসায় আমরা মনে হয় বেশ কিছুদিন ছিলাম। মঞ্জু খালা আমাদের পেয়ে অস্থির! আদর-যত্নেই ছিলাম। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে সে বাসায়ও শান্তিতে থাকতে পারিনি। চলে আসার সময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মঞ্জু খালা ভীষণ কেঁদেছিলেন। তখনো জানতাম না ওই কান্নার আড়ালের অন্তর্নিহিত কারণ।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মঞ্জু খালাও ১৫ আগস্ট তাঁর বাবা (আবদুর রব সেরনিয়াবাত), দুই বোন (আমার মা ও বেবি খালা), ভাই (আরিফ মামা) ও চার বছরের ভাতিজাকে (সুকান্ত বাবু) হারিয়েছেন। তারপর আবার আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাওয়াই তো ওনাদের জন্য প্রচণ্ড মানসিক চাপ ছিল।
আমার চাচির আব্বা, মরহুম সুলতান আহমেদ চৌধুরীর (শেখ সেলিম কাকার শ্বশুর) বাসায়ও আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই বাসায় আর্মিরা রেইডও করেছিল। চাচির বড়বোন, আনু খালার পাঁচ বছর বয়সী সন্তান লিমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিল।
পরে অনেক কসরত করে এবং ধস্তাধস্তি করে লিমাকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয় ওর বাবা আজাদ আংকেল। চাচির মেজো ভাই, বাচ্চু মামাকেও আর্মিরা তুলে নিয়ে যায়। বাচ্চু মামা, সেলিম কাকা, মারুফ কাকাদের সীমানা পার করে দিয়ে আসার পরই তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যান কর্নেল শাহরিয়ার। আর তাঁকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর লাশটাও ওরা ফেরত দেয়নি।
সবাই তখন সারাক্ষণ শুধু কাঁদত। কারও সন্তান হারানোর ব্যথা, কারও ভাইবোন হারানোর কষ্ট, আর আমাদের বাবা-মা হারানোর অন্তহীন কান্না। তবে কেউ কারও সামনে কাঁদতে পারত না। আড়ালে গিয়ে বোবা কান্না কাঁদত। আমাদের সামনে সবাই কান্না আড়াল করে ফেলত। কারণ, তখনো আমদের বলা হয়নি যে, আমাদের বাবা-মা আর নেই। এভাবেই জীবননাশের হুমকি আর ভয়ভীতিকে সঙ্গী করে আমাদের শোকাহত পরিবারের জীবনের গাড়ি চলতে থাকে।
সেলিম কাকা আর মারুফ কাকার জীবনে তখন চরম ঝুঁকি। মারুফ কাকা তখন খুনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগ দিতে মেঘালয় চলে যান। সেলিম কাকাকে তো গুলিই করা হয়েছিল। অল্পের জন্য অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। শুনেছি খুনিরা যখন বাবাকে মারতে আসে, চাচি সেলিম কাকাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খবর দেন। সেলিম কাকা হুড়মুড় করে গিয়ে দেখে ওরা বন্দুক তাক করে আছে বাবার দিকে। সেলিম কাকা ওদের ধাক্কা দিলে ওরাও তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়িঘরের কোনায় ফেলে দেয়।
ঠিক তখনই ওরা গুলি শুরু করে। রুমের কোনায় এবং নিচে পড়েছিলেন বলে হয়তো–বা গুলি তাঁর গায়ে লাগেনি। ওই মুহূর্তে মা তখন রুম থেকে বের হয়ে এসে বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। আমার মা মনে হয় বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। তাই প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই মা বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তে তিনি আমাদের কথাও ভাবেননি। মা স্বামীর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উদাহরণ রেখে গেছেন। হয়তো গুলি লাগার পর তাঁর আমাদের দুই ভাইয়ের কথা মনে হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফিরে আসার আর উপায় ছিল না।
১৫ আগস্টের পর অনেকে আমাদের আশ্রয় দিতে ভয় পেতেন। আবার অনেকে জীবনের অনেক ঝুঁকি নিয়েও আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সবার কথা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না বলে আমি দুঃখিত। তবে তখন আমদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইত না। কয়েক মাস পর অনেক কষ্টে রেবা ফুফু (মেজো ফুফু) আরামবাগে আমাদের জন্য একটি বাসা ভাড়া নেন। ওই বাসায় আমরা কয়েক মাস থাকি। তত দিনে সেলিম কাকা, মারুফ কাকাসহ আমার মামারাও (আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও আবুল খায়ের আবদুল্লাহ) জীবন বাঁচাতে ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। কারণ, বাংলাদেশে তাঁদের জীবন বাঁচানো অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আরামবাগের বাসায় মঞ্জু ফুপার সাথে খেলা করতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনায় আমার মাথা ফেটে যায়। বাসায় ডাক্তার এনে মাথায় সেলাই দিতে হয়েছিল। মনে হয় হাসপাতালে নেওয়ার মতো পরিবেশ ছিল না, অথবা সাহস পাননি নিয়ে যেতে আমার দাদি-ফুফুরা।
যেহেতু চাচা-মামারা তত দিনে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, আমরাও প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। প্রস্তুতিটা বেশ কঠিন ছিল। প্রথমত, বর্ডার দিয়ে যেতে হবে। কারণ, স্বাভাবিক উপায়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মোশতাক সরকার যদি ধরতে পারে, তাহলে মেরে ফেলবে। নিজের রাষ্ট্র থেকে যখন পালিয়ে বেড়াতে হয়, সে অভিজ্ঞতা যে কী পরিমাণ আতঙ্কের হতে পারে, সেটা তখন অনুধাবন না করলেও এখন বুঝতে পারি। চিন্তা করলে আমার পরিবারের সবার জন্য বুক ফেটে যায়। সারা জীবন এই দেশটা সৃষ্টি করতে গিয়ে এবং এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, জেল-জুলুম আর নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন আমাদের দাদু, বঙ্গবন্ধু। শুধু তাই নয়, তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের অনেক রকম হয়রানিও করেছে পাকিস্তানি সরকার। আর সেই দেশ সৃষ্টির মাত্র তিন বছর পরই এই কী পরিণতি! এটা কী রকম বিচার!
দ্বিতীয়ত, বর্ডার পার হয়ে যেতে পারব কি–না, সেটার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। পথে পথে ভয়। প্রথম প্রচেষ্টায় আমরা যাওয়ার চেষ্টা করেও যেতে পারিনি। আগরতলা বর্ডারের একদম পাশে যে বাসায় আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম, তারা আমাদের গবাদিপশুর সাথে গোয়ালঘরে থাকতে দিয়েছিল। তারা আমাদের ধরিয়ে দেওয়া, আর লুট করার পরিকল্পনা করেছিল। দাদি আড়ি পেতে সেই পরিকল্পনার কথা শুনতে পেয়ে পরদিন সকালে জিনিসপত্র ওই বাসায় রেখে, মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে আমাদের নিয়ে পালিয়ে ফেরত আসেন।
দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় আমরা বর্ডার পাড়ি দিই। এবার আমরা মেহেরপুর দিয়ে যাই। মেহেরপুরের সাবেক এমপি সহিউদ্দিন সাহেবের বাসায় আমরা আশ্রয় নিই। তাঁর ছেলে, ফরহাদ হোসেনের (বর্তমান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী) সাথে আমি দুটি কুকুরের বাচ্চা লালু-ভুলুকে নিয়ে খেলা করি। ফরহাদ আমাদের বয়সী ছিল।
সব ধরনের যানবাহনেই চলতে হয়েছিল বর্ডার পার হতে গিয়ে। গরুর গাড়ি, নৌকা, এমনকি রাতের অন্ধকারে পায়ে হেঁটে ডোবানালাও অতিক্রম করতে হয়েছিল। সবচেয়ে কষ্ট হয়েছিল গরুর গাড়ি চড়া, ছাউনিঅলা গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িতে অনেক ঝাঁকি খেতে হয়, মাথায় আঘাত লাগে। আমি কান্নাকাটি করছিলাম, আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দাদি আর রেখা ফুফু (ছোট ফুফু) আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন যে, ‘আর একটু পথ, এই তো চলে এসেছি।’ কিন্তু পথ আর শেষ হয় না। সহ্য করেছিলাম শুধু জেনে যে, ওপারে পৌঁছালে বাবা-মাকে পাব। তখনো আমরা জানি না—বাবা-মা নেই। আমাদের বলা হয়েছিল বাবা-মা আহত হয়েছে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে আছে। ওপারে পৌঁছালে সেলিম কাকা আর মারুফ কাকা আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবেন।
এমনকি ছোট্ট তাপসও আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। বলছিল, ‘পরশ দাদা আরেকটু কষ্ট করো। ওপারে গেলেই সেলিম কাকা, মারুফ কাকা আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবে।’ ওটাই ছিল আমার আর তাপসের একমাত্র ভরসা, একমাত্র আশার সম্বল।
ঠিক বর্ডারের কাছেই আমরা একটা চরের মতো জায়গায় আশ্রয় নিলাম। চারদিকে থইথই পানি; ঘন অন্ধকার রাত। আমরা অনেক ভয় পেয়েছিলাম। জায়গাটা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। আমাদের সাথে সেলিম কাকা নজরুল নামে এক লোক ঠিক করে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক আমাদের সম্পূর্ণ সহায়তা করেছেন। উনি না থাকলে হয়তোবা আমরা আসতেই পারতাম না। একটা সময় ইঙ্গিত এল—এখন ফাঁকা আছে, আমাদের দৌড় দিতে হবে। তাপসকে কোলে নিয়ে আমরা রাতের অন্ধকারে দৌড় দিলাম। হাঁটু পর্যন্ত পানি অতিক্রম করে আমরা বিএসএফ বর্ডারে পৌঁছলাম। সেখানে একটা অফিসে আমাদের বসানো হলো। ওখানে উর্দি পরা মানুষজন ঘোরাফেরা করছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে অনেকক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হলো। তবে ওরা অনেক আদর-যত্ন করেছে। আমাদের নাশতাও খেতে দিয়েছিল।
সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাকে দেখে আমাদের আনন্দ আর ধরে না! আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। আমাদের সকল কষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটবে, এবং আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবে। আমাদের আর পায় কে? সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাও আমাদের বুকে জড়িয়ে ভীষণ কান্না করছিলেন।
তাদের কান্না দেখে আশপাশের সবার চোখেই পানি এসেছিল সেই দিন। তাঁরা আমাদের কলকাতার বাঙ্গর নামক এলাকায়, সিনড্রেলার বাসায় নিয়ে এলেন। বাসাটি সংলগ্ন সিনড্রেলা নামে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল। এ কারণেই বাসাটি সিনড্রেলার বাসা নামে পরিচিত। ওই বাসায় আমরা দুই ভাই বাবা-মাকে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি সেখানে চাচি, মামি, কান্তা আপু ও শিশু সাদেকও (বর্তমান বরিশালের মেয়র) আছে।
কান্তা আপু আমাদের থেকে দু-তিন বছরের বড়। এ ছাড়া ওখানে তত দিনে বেশ কিছু আমাদের বাংলাদেশি আত্মীয়স্বজন, যাদের হয়রানি করছিল মোশতাক সরকার বিভিন্নভাবে, তাঁরাও পালিয়ে এসেছিলেন। অনেকে ছিলেন; কিন্তু বাবা-মা ছিল না।
আস্তে আস্তে আমাদের না পাওয়ার যন্ত্রণা সয়ে আসছিল কি না জানি না। কিন্তু আমার মধ্যে এক ধরনের বিরক্তি কাজ করছিল। আমি যেন বাবা-মাকে চাইতে চাইতে আর না পেতে পেতে অতিষ্ঠ। জিদ করে বাবা-মার কাছে যেতে চাওয়াও কমিয়ে দিই এক সময়। তবু অবচেতন মনে একটা আশা ছিল হয়তোবা বাবা-মা আসলেই লন্ডনে আছেন। কারণ, আমাদের সেটাই বলে সান্ত্বনা দেওয়া হতো।
আমি মনে হয়, ১৯৭৯ সালে দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত আশা করতাম বাবা-মাকে কোনো একদিন ফেরত পাব। একসময় বুঝতে পারলাম, বাবা-মা লন্ডনে থাকার কথাটা একটা অবাস্তব কল্পনা।
যেহেতু এক বাসায় বেশি মানুষ হয়ে গিয়েছিল, কিছু মাস পর আমরা বাসা বদলি করে আরেকটি বাসায় উঠি। ছোট্ট একটা তিন রুমের একতলা বাসা। পাশেই দুই কামরার অন্য একটা বাসা। ওখানে আরেকটি পরিবার থাকত। দুই বাসার মাঝখানে শুধু কলাপসিবল গেটের একটা দেয়াল। ওখানে এক সনাতন ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করত। ভদ্রলোক চাকরিজীবী ছিলেন, নিয়মতান্ত্রিক এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। মৃদুভাষী ওই ভদ্রলোকের নামটা আমার মনে নেই। তবে তাঁর স্ত্রী, তন্দ্রা কাকি আমাদের পড়াতেন এবং অনেক আদর করতেন। তাঁদের দুই সন্তান—নান্টু আর মালি। মালি আমার বয়সী হবে, আর নান্টু আমার থেকে দু-এক বছরের বড়। শিগগিরই ওদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওদের প্রতি মাসেই কোনো-না-কোনো ধর্মীয় উৎসব থাকত। প্রথমটাতে যাওয়ার পর আমার লোভ হয়ে গেল। আমি তারপর থেকে সবগুলো পূজার উৎসবে যেতে বায়না ধরতাম। দাদি ভয় পেতেন, যেতে দিতে চাইতেন না। আমিও জিদ করতাম। চাচি দাদিকে বুঝিয়ে ব্যবস্থা করে দিতেন। পূজা উৎসবগুলোর গানবাজনা আর আনন্দমুখর পরিবেশ আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগত।
কান্তা আপুও মাঝেমধ্যে আসতেন। আমরা একসঙ্গে খেলা করতাম। একদিন আমি, কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু এক অভিযানে বের হলাম—আমরা চিরাচরিত গণ্ডি পেরিয়ে দূরে যে দমদম বিমানবন্দর দেখা যায়, ওখানে যাব। আমরা মাঠঘাট পেরিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। আমি সবার আগে আগে দৌড়াচ্ছিলাম। সামনে দেখি কালো চকচকে নিচু একটা পিচঢালা জায়গা। পা দিতেই হঠাৎ করে আমি অনুভব করলাম যে আমি কাদায় পা দিয়েছি। কিন্তু কাদা থেকে পা ওঠাতে পারছি না।
দেখলাম, যতই চেষ্টা করছি, আমি কাদার ভেতরে আরও ঢুকে যাচ্ছি। এরই মধ্যে কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু এসে দেখে—আমি প্রায় কোমর পর্যন্ত ঢুকে গিয়েছি। তাপস আমার এই অবস্থা দেখে কেঁদেই ফেলল। ওর কান্না দেখে আমিও কান্না শুরু করলাম। কান্তা আপু আর নান্টু আমাদের মধ্যে বড়। এরা দুজন আমাকে ওঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। যেহেতু আমরা অভিযানের জন্য শর্টকাট পথ বেছে নিয়েছিলাম, জায়গাটা ভীষণ জনশূন্য ছিল। অনেক কসরত করে ওরা আমাকে চোরাবালি থেকে উদ্ধার করল। আমাকে তুলতে গিয়ে নান্টুর একটা পাও চোরাবালিতে পড়ে গিয়েছিল। পা ওঠাতে গিয়ে ওর স্যান্ডেলটা খোয়া যায়। এই ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিযানের ফলাফল। আর দাদির কথার অবাধ্য হওয়ার শাস্তি। ফেরার পথে আমরা সবাই খুবই ভীত ও মন খারাপ করছিলাম।
স্যান্ডেল হারিয়ে নান্টুর কী পেরেশানি! স্যান্ডেল–জোড়া গত মাসে পূজার সময় ওর বাবা কিনে দেন এবং সামনের বছরের পূজার আগে ওকে আর স্যান্ডেল কিনে দেওয়া হবে না। এই হচ্ছে ওর ডিলেমা। কথাটা শুনে আমি বুঝতে পারিনি প্রথমে। পরে বুঝলাম, ওর বাবা চাকরিজীবী, সীমিত আয়। তাই আর এক জোড়া স্যান্ডেল কিনতে ওর সামনের বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই নিয়মটা আমাকে ভাবায় এবং অবাকও করে।
আমরা একদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে সামনের ঘরে খেলছি। হঠাৎ দেখি, কে যেন বাইরের দরজায় করা নাড়ছে। শুনলাম পাশের ঘরে কান্নার আওয়াজ। দৌড়ে দাদির ঘরে গিয়ে দেখি দাদি একটা দাঁড়ি ও লম্বা চুলঅলা অল্প বয়সী লোককে ধরে কাঁদছেন। আমার বেশ খানিকটা সময় লাগল চিনতে যে লোকটা আমার মারুফ কাকা। ১৫ আগস্টের পর মারুফ কাকার সাথে মনে হয় ওই প্রথম আমার দেখা। মারুফ কাকাকে চেনাই যাচ্ছিল না। তাঁর যে জংলি অবস্থা! সারা শরীরে তাঁর দাগ আর ক্ষত। পরে শুনলাম মারুফ কাকা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তিনি কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মারুফ কাকা’ ৭১ আর’ ৭৫-এ মোট দুবার যুদ্ধ করেছেন। শুধু’ ৭৫-এ তিনি দুবার তাঁর বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। দুর্ভাগ্যবশত দুবারই সেই প্রচেষ্টা বিফল হয়।
চাচি আমাদের বিভিন্নভাবে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করতেন। চাচির প্রধান লক্ষ্য ছিল, আমাদের যেন মন খারাপ না হয়; কান্নাকাটি না করি। সুভাষ (শেখ ফাহিম, এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট) তখন ছয় মাসের হবে। সেলিম কাকা আর দাদির কাছে সুভাষকে রেখে আমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সার্কাস দেখতে, অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা দেখতে, আর শিশুপার্কে নিয়ে যেতেন। আমরা কোনো কিছুতেই ‘না’ করতাম না। চাচি আমাদের মায়ের মতোই ভালোবাসতেন। কারও বোঝার উপায় ছিল না যে, আমরা চাচির সন্তান নই। ২৪ ঘণ্টা চাচি আমাদের পেছনে সময় দিতেন। শুধু রাতে ঘুমাতাম দাদি আর রেখা ফুফুর সাথে। চাচি সারাক্ষণ আমাদের আগলে রাখতেন।
মায়ের শেষ কথাটা—‘আমার পরশ-তাপসকে তুমি দেইখো’, চাচি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।
একদিন চাচি আর রেখা ফুফু আমাদের নিয়ে বের হয়েছেন। ব্যস্ত রাস্তাঘাট। রেখা ফুফুও তখন ছোট, ১৫ বছর বয়স হবে। চাচি আর রেখা ফুফু আমাদের দুই ভাইয়ের হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অস্থির আমি, চাচির হাত থেকে ছুটে দৌড় দিই একটা বাসের সামনে দিয়ে রাস্তার ওপারে। বাসটা বিকট আওয়াজ করে কষে ব্রেক করে। চাচি আর রেখা ফুফু সেদিন বড্ড ভয় পেয়েছিলেন। চাচি তো রীতিমতো কাঁপছিলেন। তিনি কেঁদে বলছিলেন, ‘আমার শাশুড়িকে আমি কি জবাব দিতাম, যদি কিছু হইতো।’
তখন বুঝলাম যে আমার এমনটা করা উচিত হয়নি। দেখতে দেখতে এভাবে প্রায় বছর খানেক পেরিয়ে যায়। আমাদেরও বাসা পরিবর্তন করার সময় চলে আসে। বাসা পরিবর্তন করা মানেই মায়ার টানাপোড়েন। আমার তন্দ্রা কাকি, আর নান্টুকে ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছিল। আমরা বাঙ্গরের আরেকটা এলাকায় বাসা নিই। নতুন বাসাটা দোতলা। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, আর নতুন এলাকা। আশপাশের প্রতিবেশীরা বন্ধুত্বপূর্ণভাবে আমাদের গ্রহণ করল। আমাদের মা-বাবা না থাকার ঘটনাটা মনে হয় ওরা জানত।
আমরা নিজেরাই তখনো সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত নই ব্যাপারটাতে। আমি শুধু এটুকু বুঝতাম যে, মানুষজন আমাদের একটু আলাদা চোখেই দেখত, আর আমাদের একটু বেশি মায়া করত। ওখানে আশপাশে অনেকগুলো পরিবার, বেশির ভাগই অল্পবয়স্ক মেয়েরা। চাচি ও রেখা ফুফুর সাথে ওদের ভালো সখ্য হয়ে গেল। আমার বয়সী মনে হয় তেমন ছেলেপেলে ছিল না বা থাকলেও ওদের সাথে আমার নান্টুর মতো বন্ধুত্ব হলো না।
তবে ওখানে পেলাম অন্যরকম আকর্ষণ। আমাদের ঠিক সামনের বাসাটা একটি বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ি। এই বাসায় একটা তেজি সেবেল জার্মান শেফার্ড কুকুর ছিল, নাম মিকি। মিকিকে ঠিক সন্ধ্যার সময় বের করে রাস্তায় ছাড়ত। মিকি আমাদের গেটের সামনে আসত আর আমি ওকে বাসা থেকে এনে পাউরুটি খাওয়াতাম। আমার দারুণ ভালো লাগত। মিকিকে বল ছুড়ে মারলে ও বল নিয়ে আসতে পারত।
মিকিদের পাশের বাসাটা একটা দোতলা বাসা। ওই বাসায় একজন বয়স্ক মহিলা থাকতেন। তারও একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর ছিল। ওর নামটা আমার মনে নেই। সাদা আর হালকা বাদামি এই শেফার্ডটার মধ্যে একটা আভিজাত্য ছিল। ও কারও সাথে খেলত না।
সেই বাসায় থাকতে আমি দুটি খরগোশ পালতাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, খরগোশ দুটির রক্তাক্ত অর্ধাংশ; ওপরের অংশটা শুধু আছে। বড়রা বোঝালেন, বিড়াল এসে খাঁচা ভেঙে আমার খরগোশ দুটি খেয়ে গেছে। আমি বিস্মিত হলাম আর সারা দিন কাঁদলাম। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি শিক্ষা নিলাম যে আমার আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল; ওদের ঘরের ভেতরে আরও নিরাপদে রাখা দরকার ছিল। এটা তখন আমার কল্পনার বাইরে ছিল যে, বাইরের বিড়াল খরগোশ খাবে।
আরও ছোটবেলা থেকেই আমার পশুপাখির প্রতি অনেক ঝোঁক। একবার আমি টুঙ্গিপাড়া থেকে আসার সময় জিদ ও বায়না করে কুকুরের বাচ্চা নিয়ে এসেছিলাম লঞ্চে করে ঢাকায়। ওরাও ১৫ আগস্টের শিকার হয়েছিল। আমার নানা, আবদুর রব সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায়ও দুটি লাল গরু ছিল। একবার আমি গরুগুলোকে ঘাস খাওয়াতে কাছে গিয়েছি। হঠাৎ একটা গরু ছুটে আমাকে তাড়া করেছিল এবং গুঁতাও মেরেছিল। মায়ের কী পেরেশানি! তিনি অনেক ভয় পেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু দাদার বাসায় যেতে পছন্দ করার অন্যতম কারণ ছিল, ওখানে অনেক ধরনের জীবজন্তু ছিল। কবুতর, কুকুর, মোরগ-মুরগি এবং অন্যান্য। একবার ওই বাসায় গিয়ে দেখি, একটা মুরগি অনেকগুলো বাচ্চা দিয়েছে। আমি ওদের নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে গেলাম এবং ওদের ছেড়ে আসতে চাচ্ছিলাম না। বায়না ধরলাম, আমারও ওগুলো লাগবে। মা তো মহা–মুসিবতে পড়লেন। আমি কিছুতেই ওদের পিছ ছাড়ি না। মা আমাকে একরকম জোর করে নিয়ে এলেন।
আমি কাঁদতে কাঁদতে ও-বাসা থেকে চলে এলাম। বাসায় আসার পর বিকেলে দেখি আপন দাদি (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) মুরগি আর মুরগির বাচ্চাগুলো আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওই বাসায় আমি আপন দাদির অনেক ভক্ত ছিলাম। উনি আমাকে সবকিছুতে প্রশ্রয় দিতেন। আমার নিজের দাদিকে বাদ দিয়ে তাঁকেই ‘আপন দাদি’ বলে ডাকতাম। এই ছিল আমাদের মধুর সম্পর্ক।
আরেকজনের আমি খুব ভক্ত ছিলাম, যিনি হচ্ছেন হাসুমণি (জননেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা)। তিনি আমার মায়ের শুধু মামাতো বোনই ছিলেন না, মায়ের বান্ধবীও ছিলেন। তাই হাসুমণির কোলে জয়কে (সজীব ওয়াজেদ জয়, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য) দেখলে আমি অভিযোগের সুরে জিজ্ঞেস করতাম, ‘হাসুমণির কোলে জয় কেন?’
হাসুমণির যেই গুনটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত, তা হচ্ছে তাঁর মমত্ববোধ। প্রান্তিক মানুষের প্রতি তাঁর বিশেষ সমবেদনা ছিল। শিশুদের থেকে শুরু করে গৃহকর্মীদের প্রতি, এমনকি পশুপাখি ও জীবজন্তুর প্রতিও হাসুমণির প্রচণ্ড মায়া ছিল। এই মানবিক বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় তিনি সবার থেকে আলাদা। তিনি আমাদের বাচ্চাদের সাথে অত্যন্ত সদয় ছিলেন। বাচ্চাদের তিনি অনেক সময় দিতেন, এবং সত্যিকার অর্থে যত্নশীল ছিলেন শিশুদের মত ও মতামতের প্রতি।
একবার আমরা দিল্লি গেলাম। দাদি-নানি (আমার দাদি আর নানি দুই বোন), রেখা ফুফু আর আমরা দুই ভাই। হাসুমণি, রেহানা ফুফু আমাদের পেয়ে প্রচণ্ড আদর-যত্ন করলেন। তাঁরা মনে হয় আমাদের পেয়ে তাঁদের নিজ শোক সংবরণ করার শক্তি পেলেন। আমার সব দুষ্টামি তাঁরা মেনে নিতেন। জয় অনেক ঠান্ডা প্রকৃতির এবং সৃষ্টিশীল ছিল। সারাক্ষণ প্লেডো দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানাত। ওর ধৈর্য দেখে আমি অস্থির হয়ে যেতাম। আমি ওর সাথে দৌড়াদৌড়ি বা ছোঁয়া-ছুঁয়ি খেলতে চাইতাম। কিন্তু ওর ওসব খেলার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। অনেক শৃঙ্খলার সাথে জীবনযাপন করত। আমি অস্থির হয়ে ওর তৈরি করা সবকিছু ভেঙে দিতাম। ও রাগ করে আমার পিছে দৌড়াত, এতে আমার উদ্দেশ্যও হাসিল হতো। আমি পালাতাম। দাদি আর নানি আমাদের গোলমাল ঠেকাতে এসে মাঝেমধ্যে ব্যথাও পেতেন।
জয় সেটাতে অনেক বিচলিত হয়ে আমার নানিকে বলত, ‘আপনে কেন মাঝখানে এসে ব্যথা পেলেন?’ দাদিকে দেখিয়ে বলত, ‘উনি তো ঠেকাতে আসে না!’ হাসুমণি রেহানা ফুফু কিছুই বলত না। আমাদের এসব কার্যকলাপ দেখে মনে হয় মজা পেতেন। তাঁদের অনেক ধৈর্যশক্তি।
এভাবে প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেল। আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম বাবা-মা ছাড়া জীবনে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যবস্থা নেওয়া হলো। আবার সীমানা পেরিয়ে ফিরে আসা। আমাদের বাঙ্গরের প্রতিবেশীরা অনেক মন খারাপ করল। ওদের সাথে আমাদের খুব আন্তরিকতা হয়ে গিয়েছিল, পরিবারের মতো। ঠিক হলো আমি, তাপস, রেখা ফুফু, দাদি আগে ফিরব। পরে চাচারা আসবে। ফিরে আসতে আসল কষ্টটা ছিল কঠোর বাস্তবতার অনুধাবন যে, বাবা-মা আসলে লন্ডনেও নাই; তাঁরা আকাশে হারিয়ে গেছে অজস্র তারার মাঝে। এই বাস্তবতায় মন মানতে না চাইলেও আমাদের কোনো কিছু করার ছিল না। কাকে কী বলব? কেউ তো ভালো নেই। খামাখা সবাইকে এ ব্যাপারে বিরক্ত করে লাভ কী? তাঁরা তো বাবা-মাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না, পারলে তো আগেই দিতেন।
আমার মা গান গাইতে অনেক ভালোবাসতেন। আমাদের ঘুম পাড়ানোর সময় গাইতেন আঞ্জুমান আরা বেগমের সেই বিখ্যাত ঘুমপাড়ানি গান—‘খোকন সোনা বলি শোন/থাকবে না আর দুঃখ কোনো/মানুষ যদি হতে পারো।/এই কথাটি মনে রেখ/দুঃখীজনের সহায় থেকো।’ আমরা দুই ভাই বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ হওয়ার সেই নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যেন ঘুমপাড়ানি এই গানের মধ্য দিয়ে, মা জীবনের সকল উপদেশ দিয়ে গেছেন। শুধু আফসোস মা দেখতে পারলেন না! দেখতে পারলেন না যে, আমরা পড়াশোনা শিখে তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেছি।
মায়ের লেখাপড়ার প্রতি অনেক ঝোঁক ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর এমএ পরীক্ষার ফল বের হয়। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেছিলেন।
আগস্ট মাস এলে মানুষ জানতে চায়, বাবা-মা হারা আমাদের ছোটবেলা কীভাবে কেটেছে। কেমন ছিল আমাদের বেড়ে ওঠা? তাঁদের জন্যই আমার এই লেখা। অবশ্যই আমাদের বেড়ে ওঠা আর দশটা বাচ্চার মতো ছিল না। অত্যন্ত কোমল বয়সেই আমরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার। আমি এও জানি, নির্বাসিত শিশু হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতা এক আকর্ষণীয় একাডেমিক আলোচনা হিসেবে জায়গা পেতে পারে। তবুও বলব, তুলনামূলকভাবে অনেক এতিম বাচ্চার তুলনায় আমাদের শৈশব কেটেছে পরিবার-পরিজনের মায়া-মমতায়। আমার আত্মীয়-স্বজনদের আমাদের প্রতি মমত্ববোধ আর ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। বরং আমরা একদিক দিয়ে ভাগ্যবান যে, বাবা-মায়ের ভালোবাসায় বঞ্চিত হলেও অন্য স্বজনদের স্নেহ-মমতা আমরা অনেক বেশিই পেয়েছি। যেটা কেউই পায় না। তবে এত আদর-যত্ন, ভালোবাসার মধ্যেও আমি অবশ্যই বাবা-মাকে খুঁজেছি।
মায়ের গাওয়া নির্মলা মিশ্রার আরেকটি গানের কথা মনে হয়—‘ও তোতা পাখীরে/শিকল খুলে উড়িয়ে দিব/আমার মাকে যদি এনে দাও/… ঘুমিয়ে ছিলাম মায়ের কোলে,/কখন যে মা গেল চলে? সবাই বলে ওই আকাশে/লুকিয়ে আছে খুঁজে নাও।’ যতই অনুভূতি রুদ্ধ করে রাখি, যতই খেলাধুলায় মেতে থাকি, শিশুরা যে মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াবে—এটাই প্রকৃতির রীতি।
[বি. দ্র. : এই লেখা সম্পূর্ণরূপে আমার শিশুকালের স্মরণশক্তির ওপর ভিত্তি করে লেখা। তাই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই মর্মে যে, যদি ভুলবশত কাউকে আমি ভুলে গিয়ে থাকি। এখানে অনেক ঘটনা অসম্পূর্ণ ও আংশিক সত্য হতে পারে। কারণ, অপরিপক্ব এক ছয় বছরের শিশুর খণ্ড খণ্ড স্মৃতির ওপর এই কাহিনি গাথা। তাই পরিপূর্ণ সত্যতার কোনো দাবি এখানে আমি করছি না। ]
শেখ ফজলে শামস পরশ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি ও আরজু মণির বড় ছেলে। চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

খুব ভোরে প্রচণ্ড ভাঙচুরের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙে। উঠে দেখি মা নেই পাশে। বিছানায় শুধু আমরা দুই ভাই। জানালা দিয়ে ঝড়ের মতো গোলাগুলি হচ্ছে। গুলিগুলো দেয়াল ফুটো করে মেঝেতে আছড়ে পড়ছে। সিঁড়িঘরে অনেক কান্নাকাটির আওয়াজ, হইচই। আমরা দুই ভাই ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়িঘরের দিকে গিয়ে দেখি বাবা-মা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়া। মায়ের পা দুটো বাবার বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা। দাদির শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোপুটি যাচ্ছে, আর দাদি পাগলের মতো প্রলাপ বকছেন, দেয়ালে কপাল ঠুকছেন।
এ অবস্থায় উনি আমার বড় চাচিকে বললেন, ‘ফাতু (শেখ সেলিম কাকার সহধর্মিণী ফাতেমা চাচি), আরজুর পা দুটি মণির বুকের ওপর থেকে সরাও।’
সেলিম কাকা (শেখ সেলিম কাকা) আর চাচি বাবা-মার পাশে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছেন। আর বাবা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। মুখে কোনো কষ্টের চিহ্ন নাই। মনে হচ্ছে উনি যেন শান্তির নিদ্রায় বিভোর। শুধু গলায় কণ্ঠমণির নিচে চামড়া উঠে যাওয়ার একটা চিহ্ন। বাবার শরীরের অন্য কোথাও কোনো ক্ষত আমার মনে নাই। আমরা দুই ভাই কান্নাকাটি করছিলাম। মনে হয় আমরা ভয়েই কাঁদছিলাম; কারণ, মৃত্যু কাকে বলে তখনো আমরা জানি না। মৃত্যুর পর যে মানুষকে আর পাওয়া যায় না, সেটাও আমার জানা ছিল না। মৃত্যুর সাথে ওই আমার প্রথম পরিচয়। একসাথে অনেকগুলো মৃত্যু।
মায়ের মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ।
মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’
ওটাই বোধ হয় মায়ের শেষ কথা। এর পর কী হলো আমি জানি না। গুলির আওয়াজ অনেক বেড়ে যাচ্ছিল এবং কারা যেন এদিকে আবার আসছিল। আমার চাচি তখন আমাদের নিয়ে তাঁর ড্রেসিংরুমে পালালেন। আমাদের মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিলেন, যাতে গুলি না লাগে। গুলি মনে হয় বাথরুমের জানালা দিয়ে ড্রেসিংরুমেও ঢুকে যাচ্ছিল।
এর পর আর বাবা-মার সঙ্গে আমাদের আর দেখা হয় নাই। শুনেছি সেলিম কাকা একটা গাড়িতে করে মাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর মারুফ কাকা অন্য এক গাড়িতে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
এর পর সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পর আমরা দুই ভাই, চাচি, দাদি, আর রেখা ফুফু এক কাপড়ে আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে যাই। তখনো বুঝি নাই যে, ওটাই নিজেদের বাসা থেকে আমাদের শেষ প্রস্থান। আর কখনো ওই বাসায় ফিরতে পারব না। আমার বয়স তখন পাঁচ বছর, আর আমার ভাই তাপসের বয়স চার বছর। আমাদের বাসাটা ছিল ধানমন্ডি ১৩ নম্বর রোডে একটা কানাগলির রাস্তায়। বাসা থেকে বের হয়ে পাশেই ছিল এক বিদেশি রাষ্ট্রদূত ভবন। আমরা সেখানেই আশ্রয় নিই। ওখান থেকে আমরা দেখতে পাই, আমাদের বাসায় আর্মিদের আনাগোনা, লুটতরাজ। এর পর শুরু হয় আমাদের ভবঘুরে জীবনযাপন; একেক দিন একেক বাসায়।
কোনো বাসায় দুদিন, কোনো বাসায় চার দিন। আশ্রয়ার্থী হিসেবে এভাবেই চলতে থাকে বেশ কয়েক মাস। আমার কোনো ধারণা ছিল না, কেন আমরা নিজের বাসায় ফেরত যেতে পারছি না। পরে দাদি-চাচিদের মাধ্যমে বুঝলাম যে আর্মিরা আমাদের খুঁজছিল। কয়েকটি বাসায় আর্মিরা আমাদের খুঁজতেও এসেছিল। ভাগ্যিস আমরা সময়মতো সেই বাসা থেকে পালিয়ে অন্য বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম।
মাহুতটুলিতে মঞ্জু খালার বাসায় আমরা মনে হয় বেশ কিছুদিন ছিলাম। মঞ্জু খালা আমাদের পেয়ে অস্থির! আদর-যত্নেই ছিলাম। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে সে বাসায়ও শান্তিতে থাকতে পারিনি। চলে আসার সময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মঞ্জু খালা ভীষণ কেঁদেছিলেন। তখনো জানতাম না ওই কান্নার আড়ালের অন্তর্নিহিত কারণ।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মঞ্জু খালাও ১৫ আগস্ট তাঁর বাবা (আবদুর রব সেরনিয়াবাত), দুই বোন (আমার মা ও বেবি খালা), ভাই (আরিফ মামা) ও চার বছরের ভাতিজাকে (সুকান্ত বাবু) হারিয়েছেন। তারপর আবার আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাওয়াই তো ওনাদের জন্য প্রচণ্ড মানসিক চাপ ছিল।
আমার চাচির আব্বা, মরহুম সুলতান আহমেদ চৌধুরীর (শেখ সেলিম কাকার শ্বশুর) বাসায়ও আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই বাসায় আর্মিরা রেইডও করেছিল। চাচির বড়বোন, আনু খালার পাঁচ বছর বয়সী সন্তান লিমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিল।
পরে অনেক কসরত করে এবং ধস্তাধস্তি করে লিমাকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয় ওর বাবা আজাদ আংকেল। চাচির মেজো ভাই, বাচ্চু মামাকেও আর্মিরা তুলে নিয়ে যায়। বাচ্চু মামা, সেলিম কাকা, মারুফ কাকাদের সীমানা পার করে দিয়ে আসার পরই তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যান কর্নেল শাহরিয়ার। আর তাঁকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর লাশটাও ওরা ফেরত দেয়নি।
সবাই তখন সারাক্ষণ শুধু কাঁদত। কারও সন্তান হারানোর ব্যথা, কারও ভাইবোন হারানোর কষ্ট, আর আমাদের বাবা-মা হারানোর অন্তহীন কান্না। তবে কেউ কারও সামনে কাঁদতে পারত না। আড়ালে গিয়ে বোবা কান্না কাঁদত। আমাদের সামনে সবাই কান্না আড়াল করে ফেলত। কারণ, তখনো আমদের বলা হয়নি যে, আমাদের বাবা-মা আর নেই। এভাবেই জীবননাশের হুমকি আর ভয়ভীতিকে সঙ্গী করে আমাদের শোকাহত পরিবারের জীবনের গাড়ি চলতে থাকে।
সেলিম কাকা আর মারুফ কাকার জীবনে তখন চরম ঝুঁকি। মারুফ কাকা তখন খুনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগ দিতে মেঘালয় চলে যান। সেলিম কাকাকে তো গুলিই করা হয়েছিল। অল্পের জন্য অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। শুনেছি খুনিরা যখন বাবাকে মারতে আসে, চাচি সেলিম কাকাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খবর দেন। সেলিম কাকা হুড়মুড় করে গিয়ে দেখে ওরা বন্দুক তাক করে আছে বাবার দিকে। সেলিম কাকা ওদের ধাক্কা দিলে ওরাও তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়িঘরের কোনায় ফেলে দেয়।
ঠিক তখনই ওরা গুলি শুরু করে। রুমের কোনায় এবং নিচে পড়েছিলেন বলে হয়তো–বা গুলি তাঁর গায়ে লাগেনি। ওই মুহূর্তে মা তখন রুম থেকে বের হয়ে এসে বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। আমার মা মনে হয় বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। তাই প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই মা বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তে তিনি আমাদের কথাও ভাবেননি। মা স্বামীর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উদাহরণ রেখে গেছেন। হয়তো গুলি লাগার পর তাঁর আমাদের দুই ভাইয়ের কথা মনে হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফিরে আসার আর উপায় ছিল না।
১৫ আগস্টের পর অনেকে আমাদের আশ্রয় দিতে ভয় পেতেন। আবার অনেকে জীবনের অনেক ঝুঁকি নিয়েও আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সবার কথা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না বলে আমি দুঃখিত। তবে তখন আমদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইত না। কয়েক মাস পর অনেক কষ্টে রেবা ফুফু (মেজো ফুফু) আরামবাগে আমাদের জন্য একটি বাসা ভাড়া নেন। ওই বাসায় আমরা কয়েক মাস থাকি। তত দিনে সেলিম কাকা, মারুফ কাকাসহ আমার মামারাও (আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও আবুল খায়ের আবদুল্লাহ) জীবন বাঁচাতে ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। কারণ, বাংলাদেশে তাঁদের জীবন বাঁচানো অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আরামবাগের বাসায় মঞ্জু ফুপার সাথে খেলা করতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনায় আমার মাথা ফেটে যায়। বাসায় ডাক্তার এনে মাথায় সেলাই দিতে হয়েছিল। মনে হয় হাসপাতালে নেওয়ার মতো পরিবেশ ছিল না, অথবা সাহস পাননি নিয়ে যেতে আমার দাদি-ফুফুরা।
যেহেতু চাচা-মামারা তত দিনে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, আমরাও প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। প্রস্তুতিটা বেশ কঠিন ছিল। প্রথমত, বর্ডার দিয়ে যেতে হবে। কারণ, স্বাভাবিক উপায়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মোশতাক সরকার যদি ধরতে পারে, তাহলে মেরে ফেলবে। নিজের রাষ্ট্র থেকে যখন পালিয়ে বেড়াতে হয়, সে অভিজ্ঞতা যে কী পরিমাণ আতঙ্কের হতে পারে, সেটা তখন অনুধাবন না করলেও এখন বুঝতে পারি। চিন্তা করলে আমার পরিবারের সবার জন্য বুক ফেটে যায়। সারা জীবন এই দেশটা সৃষ্টি করতে গিয়ে এবং এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, জেল-জুলুম আর নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন আমাদের দাদু, বঙ্গবন্ধু। শুধু তাই নয়, তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের অনেক রকম হয়রানিও করেছে পাকিস্তানি সরকার। আর সেই দেশ সৃষ্টির মাত্র তিন বছর পরই এই কী পরিণতি! এটা কী রকম বিচার!
দ্বিতীয়ত, বর্ডার পার হয়ে যেতে পারব কি–না, সেটার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। পথে পথে ভয়। প্রথম প্রচেষ্টায় আমরা যাওয়ার চেষ্টা করেও যেতে পারিনি। আগরতলা বর্ডারের একদম পাশে যে বাসায় আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম, তারা আমাদের গবাদিপশুর সাথে গোয়ালঘরে থাকতে দিয়েছিল। তারা আমাদের ধরিয়ে দেওয়া, আর লুট করার পরিকল্পনা করেছিল। দাদি আড়ি পেতে সেই পরিকল্পনার কথা শুনতে পেয়ে পরদিন সকালে জিনিসপত্র ওই বাসায় রেখে, মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে আমাদের নিয়ে পালিয়ে ফেরত আসেন।
দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় আমরা বর্ডার পাড়ি দিই। এবার আমরা মেহেরপুর দিয়ে যাই। মেহেরপুরের সাবেক এমপি সহিউদ্দিন সাহেবের বাসায় আমরা আশ্রয় নিই। তাঁর ছেলে, ফরহাদ হোসেনের (বর্তমান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী) সাথে আমি দুটি কুকুরের বাচ্চা লালু-ভুলুকে নিয়ে খেলা করি। ফরহাদ আমাদের বয়সী ছিল।
সব ধরনের যানবাহনেই চলতে হয়েছিল বর্ডার পার হতে গিয়ে। গরুর গাড়ি, নৌকা, এমনকি রাতের অন্ধকারে পায়ে হেঁটে ডোবানালাও অতিক্রম করতে হয়েছিল। সবচেয়ে কষ্ট হয়েছিল গরুর গাড়ি চড়া, ছাউনিঅলা গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িতে অনেক ঝাঁকি খেতে হয়, মাথায় আঘাত লাগে। আমি কান্নাকাটি করছিলাম, আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দাদি আর রেখা ফুফু (ছোট ফুফু) আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন যে, ‘আর একটু পথ, এই তো চলে এসেছি।’ কিন্তু পথ আর শেষ হয় না। সহ্য করেছিলাম শুধু জেনে যে, ওপারে পৌঁছালে বাবা-মাকে পাব। তখনো আমরা জানি না—বাবা-মা নেই। আমাদের বলা হয়েছিল বাবা-মা আহত হয়েছে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে আছে। ওপারে পৌঁছালে সেলিম কাকা আর মারুফ কাকা আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবেন।
এমনকি ছোট্ট তাপসও আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। বলছিল, ‘পরশ দাদা আরেকটু কষ্ট করো। ওপারে গেলেই সেলিম কাকা, মারুফ কাকা আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবে।’ ওটাই ছিল আমার আর তাপসের একমাত্র ভরসা, একমাত্র আশার সম্বল।
ঠিক বর্ডারের কাছেই আমরা একটা চরের মতো জায়গায় আশ্রয় নিলাম। চারদিকে থইথই পানি; ঘন অন্ধকার রাত। আমরা অনেক ভয় পেয়েছিলাম। জায়গাটা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। আমাদের সাথে সেলিম কাকা নজরুল নামে এক লোক ঠিক করে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক আমাদের সম্পূর্ণ সহায়তা করেছেন। উনি না থাকলে হয়তোবা আমরা আসতেই পারতাম না। একটা সময় ইঙ্গিত এল—এখন ফাঁকা আছে, আমাদের দৌড় দিতে হবে। তাপসকে কোলে নিয়ে আমরা রাতের অন্ধকারে দৌড় দিলাম। হাঁটু পর্যন্ত পানি অতিক্রম করে আমরা বিএসএফ বর্ডারে পৌঁছলাম। সেখানে একটা অফিসে আমাদের বসানো হলো। ওখানে উর্দি পরা মানুষজন ঘোরাফেরা করছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে অনেকক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হলো। তবে ওরা অনেক আদর-যত্ন করেছে। আমাদের নাশতাও খেতে দিয়েছিল।
সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাকে দেখে আমাদের আনন্দ আর ধরে না! আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। আমাদের সকল কষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটবে, এবং আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবে। আমাদের আর পায় কে? সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাও আমাদের বুকে জড়িয়ে ভীষণ কান্না করছিলেন।
তাদের কান্না দেখে আশপাশের সবার চোখেই পানি এসেছিল সেই দিন। তাঁরা আমাদের কলকাতার বাঙ্গর নামক এলাকায়, সিনড্রেলার বাসায় নিয়ে এলেন। বাসাটি সংলগ্ন সিনড্রেলা নামে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল। এ কারণেই বাসাটি সিনড্রেলার বাসা নামে পরিচিত। ওই বাসায় আমরা দুই ভাই বাবা-মাকে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি সেখানে চাচি, মামি, কান্তা আপু ও শিশু সাদেকও (বর্তমান বরিশালের মেয়র) আছে।
কান্তা আপু আমাদের থেকে দু-তিন বছরের বড়। এ ছাড়া ওখানে তত দিনে বেশ কিছু আমাদের বাংলাদেশি আত্মীয়স্বজন, যাদের হয়রানি করছিল মোশতাক সরকার বিভিন্নভাবে, তাঁরাও পালিয়ে এসেছিলেন। অনেকে ছিলেন; কিন্তু বাবা-মা ছিল না।
আস্তে আস্তে আমাদের না পাওয়ার যন্ত্রণা সয়ে আসছিল কি না জানি না। কিন্তু আমার মধ্যে এক ধরনের বিরক্তি কাজ করছিল। আমি যেন বাবা-মাকে চাইতে চাইতে আর না পেতে পেতে অতিষ্ঠ। জিদ করে বাবা-মার কাছে যেতে চাওয়াও কমিয়ে দিই এক সময়। তবু অবচেতন মনে একটা আশা ছিল হয়তোবা বাবা-মা আসলেই লন্ডনে আছেন। কারণ, আমাদের সেটাই বলে সান্ত্বনা দেওয়া হতো।
আমি মনে হয়, ১৯৭৯ সালে দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত আশা করতাম বাবা-মাকে কোনো একদিন ফেরত পাব। একসময় বুঝতে পারলাম, বাবা-মা লন্ডনে থাকার কথাটা একটা অবাস্তব কল্পনা।
যেহেতু এক বাসায় বেশি মানুষ হয়ে গিয়েছিল, কিছু মাস পর আমরা বাসা বদলি করে আরেকটি বাসায় উঠি। ছোট্ট একটা তিন রুমের একতলা বাসা। পাশেই দুই কামরার অন্য একটা বাসা। ওখানে আরেকটি পরিবার থাকত। দুই বাসার মাঝখানে শুধু কলাপসিবল গেটের একটা দেয়াল। ওখানে এক সনাতন ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করত। ভদ্রলোক চাকরিজীবী ছিলেন, নিয়মতান্ত্রিক এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। মৃদুভাষী ওই ভদ্রলোকের নামটা আমার মনে নেই। তবে তাঁর স্ত্রী, তন্দ্রা কাকি আমাদের পড়াতেন এবং অনেক আদর করতেন। তাঁদের দুই সন্তান—নান্টু আর মালি। মালি আমার বয়সী হবে, আর নান্টু আমার থেকে দু-এক বছরের বড়। শিগগিরই ওদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওদের প্রতি মাসেই কোনো-না-কোনো ধর্মীয় উৎসব থাকত। প্রথমটাতে যাওয়ার পর আমার লোভ হয়ে গেল। আমি তারপর থেকে সবগুলো পূজার উৎসবে যেতে বায়না ধরতাম। দাদি ভয় পেতেন, যেতে দিতে চাইতেন না। আমিও জিদ করতাম। চাচি দাদিকে বুঝিয়ে ব্যবস্থা করে দিতেন। পূজা উৎসবগুলোর গানবাজনা আর আনন্দমুখর পরিবেশ আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগত।
কান্তা আপুও মাঝেমধ্যে আসতেন। আমরা একসঙ্গে খেলা করতাম। একদিন আমি, কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু এক অভিযানে বের হলাম—আমরা চিরাচরিত গণ্ডি পেরিয়ে দূরে যে দমদম বিমানবন্দর দেখা যায়, ওখানে যাব। আমরা মাঠঘাট পেরিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। আমি সবার আগে আগে দৌড়াচ্ছিলাম। সামনে দেখি কালো চকচকে নিচু একটা পিচঢালা জায়গা। পা দিতেই হঠাৎ করে আমি অনুভব করলাম যে আমি কাদায় পা দিয়েছি। কিন্তু কাদা থেকে পা ওঠাতে পারছি না।
দেখলাম, যতই চেষ্টা করছি, আমি কাদার ভেতরে আরও ঢুকে যাচ্ছি। এরই মধ্যে কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু এসে দেখে—আমি প্রায় কোমর পর্যন্ত ঢুকে গিয়েছি। তাপস আমার এই অবস্থা দেখে কেঁদেই ফেলল। ওর কান্না দেখে আমিও কান্না শুরু করলাম। কান্তা আপু আর নান্টু আমাদের মধ্যে বড়। এরা দুজন আমাকে ওঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। যেহেতু আমরা অভিযানের জন্য শর্টকাট পথ বেছে নিয়েছিলাম, জায়গাটা ভীষণ জনশূন্য ছিল। অনেক কসরত করে ওরা আমাকে চোরাবালি থেকে উদ্ধার করল। আমাকে তুলতে গিয়ে নান্টুর একটা পাও চোরাবালিতে পড়ে গিয়েছিল। পা ওঠাতে গিয়ে ওর স্যান্ডেলটা খোয়া যায়। এই ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিযানের ফলাফল। আর দাদির কথার অবাধ্য হওয়ার শাস্তি। ফেরার পথে আমরা সবাই খুবই ভীত ও মন খারাপ করছিলাম।
স্যান্ডেল হারিয়ে নান্টুর কী পেরেশানি! স্যান্ডেল–জোড়া গত মাসে পূজার সময় ওর বাবা কিনে দেন এবং সামনের বছরের পূজার আগে ওকে আর স্যান্ডেল কিনে দেওয়া হবে না। এই হচ্ছে ওর ডিলেমা। কথাটা শুনে আমি বুঝতে পারিনি প্রথমে। পরে বুঝলাম, ওর বাবা চাকরিজীবী, সীমিত আয়। তাই আর এক জোড়া স্যান্ডেল কিনতে ওর সামনের বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই নিয়মটা আমাকে ভাবায় এবং অবাকও করে।
আমরা একদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে সামনের ঘরে খেলছি। হঠাৎ দেখি, কে যেন বাইরের দরজায় করা নাড়ছে। শুনলাম পাশের ঘরে কান্নার আওয়াজ। দৌড়ে দাদির ঘরে গিয়ে দেখি দাদি একটা দাঁড়ি ও লম্বা চুলঅলা অল্প বয়সী লোককে ধরে কাঁদছেন। আমার বেশ খানিকটা সময় লাগল চিনতে যে লোকটা আমার মারুফ কাকা। ১৫ আগস্টের পর মারুফ কাকার সাথে মনে হয় ওই প্রথম আমার দেখা। মারুফ কাকাকে চেনাই যাচ্ছিল না। তাঁর যে জংলি অবস্থা! সারা শরীরে তাঁর দাগ আর ক্ষত। পরে শুনলাম মারুফ কাকা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তিনি কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মারুফ কাকা’ ৭১ আর’ ৭৫-এ মোট দুবার যুদ্ধ করেছেন। শুধু’ ৭৫-এ তিনি দুবার তাঁর বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। দুর্ভাগ্যবশত দুবারই সেই প্রচেষ্টা বিফল হয়।
চাচি আমাদের বিভিন্নভাবে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করতেন। চাচির প্রধান লক্ষ্য ছিল, আমাদের যেন মন খারাপ না হয়; কান্নাকাটি না করি। সুভাষ (শেখ ফাহিম, এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট) তখন ছয় মাসের হবে। সেলিম কাকা আর দাদির কাছে সুভাষকে রেখে আমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সার্কাস দেখতে, অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা দেখতে, আর শিশুপার্কে নিয়ে যেতেন। আমরা কোনো কিছুতেই ‘না’ করতাম না। চাচি আমাদের মায়ের মতোই ভালোবাসতেন। কারও বোঝার উপায় ছিল না যে, আমরা চাচির সন্তান নই। ২৪ ঘণ্টা চাচি আমাদের পেছনে সময় দিতেন। শুধু রাতে ঘুমাতাম দাদি আর রেখা ফুফুর সাথে। চাচি সারাক্ষণ আমাদের আগলে রাখতেন।
মায়ের শেষ কথাটা—‘আমার পরশ-তাপসকে তুমি দেইখো’, চাচি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।
একদিন চাচি আর রেখা ফুফু আমাদের নিয়ে বের হয়েছেন। ব্যস্ত রাস্তাঘাট। রেখা ফুফুও তখন ছোট, ১৫ বছর বয়স হবে। চাচি আর রেখা ফুফু আমাদের দুই ভাইয়ের হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অস্থির আমি, চাচির হাত থেকে ছুটে দৌড় দিই একটা বাসের সামনে দিয়ে রাস্তার ওপারে। বাসটা বিকট আওয়াজ করে কষে ব্রেক করে। চাচি আর রেখা ফুফু সেদিন বড্ড ভয় পেয়েছিলেন। চাচি তো রীতিমতো কাঁপছিলেন। তিনি কেঁদে বলছিলেন, ‘আমার শাশুড়িকে আমি কি জবাব দিতাম, যদি কিছু হইতো।’
তখন বুঝলাম যে আমার এমনটা করা উচিত হয়নি। দেখতে দেখতে এভাবে প্রায় বছর খানেক পেরিয়ে যায়। আমাদেরও বাসা পরিবর্তন করার সময় চলে আসে। বাসা পরিবর্তন করা মানেই মায়ার টানাপোড়েন। আমার তন্দ্রা কাকি, আর নান্টুকে ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছিল। আমরা বাঙ্গরের আরেকটা এলাকায় বাসা নিই। নতুন বাসাটা দোতলা। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, আর নতুন এলাকা। আশপাশের প্রতিবেশীরা বন্ধুত্বপূর্ণভাবে আমাদের গ্রহণ করল। আমাদের মা-বাবা না থাকার ঘটনাটা মনে হয় ওরা জানত।
আমরা নিজেরাই তখনো সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত নই ব্যাপারটাতে। আমি শুধু এটুকু বুঝতাম যে, মানুষজন আমাদের একটু আলাদা চোখেই দেখত, আর আমাদের একটু বেশি মায়া করত। ওখানে আশপাশে অনেকগুলো পরিবার, বেশির ভাগই অল্পবয়স্ক মেয়েরা। চাচি ও রেখা ফুফুর সাথে ওদের ভালো সখ্য হয়ে গেল। আমার বয়সী মনে হয় তেমন ছেলেপেলে ছিল না বা থাকলেও ওদের সাথে আমার নান্টুর মতো বন্ধুত্ব হলো না।
তবে ওখানে পেলাম অন্যরকম আকর্ষণ। আমাদের ঠিক সামনের বাসাটা একটি বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ি। এই বাসায় একটা তেজি সেবেল জার্মান শেফার্ড কুকুর ছিল, নাম মিকি। মিকিকে ঠিক সন্ধ্যার সময় বের করে রাস্তায় ছাড়ত। মিকি আমাদের গেটের সামনে আসত আর আমি ওকে বাসা থেকে এনে পাউরুটি খাওয়াতাম। আমার দারুণ ভালো লাগত। মিকিকে বল ছুড়ে মারলে ও বল নিয়ে আসতে পারত।
মিকিদের পাশের বাসাটা একটা দোতলা বাসা। ওই বাসায় একজন বয়স্ক মহিলা থাকতেন। তারও একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর ছিল। ওর নামটা আমার মনে নেই। সাদা আর হালকা বাদামি এই শেফার্ডটার মধ্যে একটা আভিজাত্য ছিল। ও কারও সাথে খেলত না।
সেই বাসায় থাকতে আমি দুটি খরগোশ পালতাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, খরগোশ দুটির রক্তাক্ত অর্ধাংশ; ওপরের অংশটা শুধু আছে। বড়রা বোঝালেন, বিড়াল এসে খাঁচা ভেঙে আমার খরগোশ দুটি খেয়ে গেছে। আমি বিস্মিত হলাম আর সারা দিন কাঁদলাম। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি শিক্ষা নিলাম যে আমার আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল; ওদের ঘরের ভেতরে আরও নিরাপদে রাখা দরকার ছিল। এটা তখন আমার কল্পনার বাইরে ছিল যে, বাইরের বিড়াল খরগোশ খাবে।
আরও ছোটবেলা থেকেই আমার পশুপাখির প্রতি অনেক ঝোঁক। একবার আমি টুঙ্গিপাড়া থেকে আসার সময় জিদ ও বায়না করে কুকুরের বাচ্চা নিয়ে এসেছিলাম লঞ্চে করে ঢাকায়। ওরাও ১৫ আগস্টের শিকার হয়েছিল। আমার নানা, আবদুর রব সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায়ও দুটি লাল গরু ছিল। একবার আমি গরুগুলোকে ঘাস খাওয়াতে কাছে গিয়েছি। হঠাৎ একটা গরু ছুটে আমাকে তাড়া করেছিল এবং গুঁতাও মেরেছিল। মায়ের কী পেরেশানি! তিনি অনেক ভয় পেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু দাদার বাসায় যেতে পছন্দ করার অন্যতম কারণ ছিল, ওখানে অনেক ধরনের জীবজন্তু ছিল। কবুতর, কুকুর, মোরগ-মুরগি এবং অন্যান্য। একবার ওই বাসায় গিয়ে দেখি, একটা মুরগি অনেকগুলো বাচ্চা দিয়েছে। আমি ওদের নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে গেলাম এবং ওদের ছেড়ে আসতে চাচ্ছিলাম না। বায়না ধরলাম, আমারও ওগুলো লাগবে। মা তো মহা–মুসিবতে পড়লেন। আমি কিছুতেই ওদের পিছ ছাড়ি না। মা আমাকে একরকম জোর করে নিয়ে এলেন।
আমি কাঁদতে কাঁদতে ও-বাসা থেকে চলে এলাম। বাসায় আসার পর বিকেলে দেখি আপন দাদি (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) মুরগি আর মুরগির বাচ্চাগুলো আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওই বাসায় আমি আপন দাদির অনেক ভক্ত ছিলাম। উনি আমাকে সবকিছুতে প্রশ্রয় দিতেন। আমার নিজের দাদিকে বাদ দিয়ে তাঁকেই ‘আপন দাদি’ বলে ডাকতাম। এই ছিল আমাদের মধুর সম্পর্ক।
আরেকজনের আমি খুব ভক্ত ছিলাম, যিনি হচ্ছেন হাসুমণি (জননেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা)। তিনি আমার মায়ের শুধু মামাতো বোনই ছিলেন না, মায়ের বান্ধবীও ছিলেন। তাই হাসুমণির কোলে জয়কে (সজীব ওয়াজেদ জয়, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য) দেখলে আমি অভিযোগের সুরে জিজ্ঞেস করতাম, ‘হাসুমণির কোলে জয় কেন?’
হাসুমণির যেই গুনটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত, তা হচ্ছে তাঁর মমত্ববোধ। প্রান্তিক মানুষের প্রতি তাঁর বিশেষ সমবেদনা ছিল। শিশুদের থেকে শুরু করে গৃহকর্মীদের প্রতি, এমনকি পশুপাখি ও জীবজন্তুর প্রতিও হাসুমণির প্রচণ্ড মায়া ছিল। এই মানবিক বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় তিনি সবার থেকে আলাদা। তিনি আমাদের বাচ্চাদের সাথে অত্যন্ত সদয় ছিলেন। বাচ্চাদের তিনি অনেক সময় দিতেন, এবং সত্যিকার অর্থে যত্নশীল ছিলেন শিশুদের মত ও মতামতের প্রতি।
একবার আমরা দিল্লি গেলাম। দাদি-নানি (আমার দাদি আর নানি দুই বোন), রেখা ফুফু আর আমরা দুই ভাই। হাসুমণি, রেহানা ফুফু আমাদের পেয়ে প্রচণ্ড আদর-যত্ন করলেন। তাঁরা মনে হয় আমাদের পেয়ে তাঁদের নিজ শোক সংবরণ করার শক্তি পেলেন। আমার সব দুষ্টামি তাঁরা মেনে নিতেন। জয় অনেক ঠান্ডা প্রকৃতির এবং সৃষ্টিশীল ছিল। সারাক্ষণ প্লেডো দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানাত। ওর ধৈর্য দেখে আমি অস্থির হয়ে যেতাম। আমি ওর সাথে দৌড়াদৌড়ি বা ছোঁয়া-ছুঁয়ি খেলতে চাইতাম। কিন্তু ওর ওসব খেলার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। অনেক শৃঙ্খলার সাথে জীবনযাপন করত। আমি অস্থির হয়ে ওর তৈরি করা সবকিছু ভেঙে দিতাম। ও রাগ করে আমার পিছে দৌড়াত, এতে আমার উদ্দেশ্যও হাসিল হতো। আমি পালাতাম। দাদি আর নানি আমাদের গোলমাল ঠেকাতে এসে মাঝেমধ্যে ব্যথাও পেতেন।
জয় সেটাতে অনেক বিচলিত হয়ে আমার নানিকে বলত, ‘আপনে কেন মাঝখানে এসে ব্যথা পেলেন?’ দাদিকে দেখিয়ে বলত, ‘উনি তো ঠেকাতে আসে না!’ হাসুমণি রেহানা ফুফু কিছুই বলত না। আমাদের এসব কার্যকলাপ দেখে মনে হয় মজা পেতেন। তাঁদের অনেক ধৈর্যশক্তি।
এভাবে প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেল। আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম বাবা-মা ছাড়া জীবনে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যবস্থা নেওয়া হলো। আবার সীমানা পেরিয়ে ফিরে আসা। আমাদের বাঙ্গরের প্রতিবেশীরা অনেক মন খারাপ করল। ওদের সাথে আমাদের খুব আন্তরিকতা হয়ে গিয়েছিল, পরিবারের মতো। ঠিক হলো আমি, তাপস, রেখা ফুফু, দাদি আগে ফিরব। পরে চাচারা আসবে। ফিরে আসতে আসল কষ্টটা ছিল কঠোর বাস্তবতার অনুধাবন যে, বাবা-মা আসলে লন্ডনেও নাই; তাঁরা আকাশে হারিয়ে গেছে অজস্র তারার মাঝে। এই বাস্তবতায় মন মানতে না চাইলেও আমাদের কোনো কিছু করার ছিল না। কাকে কী বলব? কেউ তো ভালো নেই। খামাখা সবাইকে এ ব্যাপারে বিরক্ত করে লাভ কী? তাঁরা তো বাবা-মাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না, পারলে তো আগেই দিতেন।
আমার মা গান গাইতে অনেক ভালোবাসতেন। আমাদের ঘুম পাড়ানোর সময় গাইতেন আঞ্জুমান আরা বেগমের সেই বিখ্যাত ঘুমপাড়ানি গান—‘খোকন সোনা বলি শোন/থাকবে না আর দুঃখ কোনো/মানুষ যদি হতে পারো।/এই কথাটি মনে রেখ/দুঃখীজনের সহায় থেকো।’ আমরা দুই ভাই বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ হওয়ার সেই নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যেন ঘুমপাড়ানি এই গানের মধ্য দিয়ে, মা জীবনের সকল উপদেশ দিয়ে গেছেন। শুধু আফসোস মা দেখতে পারলেন না! দেখতে পারলেন না যে, আমরা পড়াশোনা শিখে তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেছি।
মায়ের লেখাপড়ার প্রতি অনেক ঝোঁক ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর এমএ পরীক্ষার ফল বের হয়। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেছিলেন।
আগস্ট মাস এলে মানুষ জানতে চায়, বাবা-মা হারা আমাদের ছোটবেলা কীভাবে কেটেছে। কেমন ছিল আমাদের বেড়ে ওঠা? তাঁদের জন্যই আমার এই লেখা। অবশ্যই আমাদের বেড়ে ওঠা আর দশটা বাচ্চার মতো ছিল না। অত্যন্ত কোমল বয়সেই আমরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার। আমি এও জানি, নির্বাসিত শিশু হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতা এক আকর্ষণীয় একাডেমিক আলোচনা হিসেবে জায়গা পেতে পারে। তবুও বলব, তুলনামূলকভাবে অনেক এতিম বাচ্চার তুলনায় আমাদের শৈশব কেটেছে পরিবার-পরিজনের মায়া-মমতায়। আমার আত্মীয়-স্বজনদের আমাদের প্রতি মমত্ববোধ আর ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। বরং আমরা একদিক দিয়ে ভাগ্যবান যে, বাবা-মায়ের ভালোবাসায় বঞ্চিত হলেও অন্য স্বজনদের স্নেহ-মমতা আমরা অনেক বেশিই পেয়েছি। যেটা কেউই পায় না। তবে এত আদর-যত্ন, ভালোবাসার মধ্যেও আমি অবশ্যই বাবা-মাকে খুঁজেছি।
মায়ের গাওয়া নির্মলা মিশ্রার আরেকটি গানের কথা মনে হয়—‘ও তোতা পাখীরে/শিকল খুলে উড়িয়ে দিব/আমার মাকে যদি এনে দাও/… ঘুমিয়ে ছিলাম মায়ের কোলে,/কখন যে মা গেল চলে? সবাই বলে ওই আকাশে/লুকিয়ে আছে খুঁজে নাও।’ যতই অনুভূতি রুদ্ধ করে রাখি, যতই খেলাধুলায় মেতে থাকি, শিশুরা যে মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াবে—এটাই প্রকৃতির রীতি।
[বি. দ্র. : এই লেখা সম্পূর্ণরূপে আমার শিশুকালের স্মরণশক্তির ওপর ভিত্তি করে লেখা। তাই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই মর্মে যে, যদি ভুলবশত কাউকে আমি ভুলে গিয়ে থাকি। এখানে অনেক ঘটনা অসম্পূর্ণ ও আংশিক সত্য হতে পারে। কারণ, অপরিপক্ব এক ছয় বছরের শিশুর খণ্ড খণ্ড স্মৃতির ওপর এই কাহিনি গাথা। তাই পরিপূর্ণ সত্যতার কোনো দাবি এখানে আমি করছি না। ]
শেখ ফজলে শামস পরশ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি ও আরজু মণির বড় ছেলে। চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

বাংলাদেশ আবারও একটি সংবেদনশীল সময় অতিক্রম করছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন—যা শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া নয়; বরং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। এই নির্বাচন ঘিরে জনগণের প্রত্যাশা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে গভীর উদ্বেগও।
১৭ ঘণ্টা আগে
শুরুটা ছিল বেশ আশাজাগানিয়া। বিধি অনুযায়ী আমাদের দেশে মন্ত্রিসভার সদস্যদের কী বেতন বা সম্মানী এবং ভাতা ও সুবিধাদি এক্ষণে জানা নেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েই নিশ্চয় তা নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রী ছাড়া যাঁরা সংসদ সদস্য, তাঁদের বেলায়ও একই কথা; মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা এবং বলতে গেলে অবাধ সুযোগ-সুবিধা আছে বলেই
১৭ ঘণ্টা আগে
বিজয়ের মাস চলছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিনটি ছিল গতকাল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন ‘বিজয়’। এদিন বাঙালির আত্মপরিচয় লাভের দিন।
১৭ ঘণ্টা আগে
দেশের মানুষ যখন উৎসবমুখর পরিবেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছে, তখন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নির্বাচনে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ১৫ ডিসেম্বর একটা উদ্বেগজনক ‘ভোটের আগে আতঙ্ক জনমনে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
১৭ ঘণ্টা আগেএই কঠিন সময়েও বিজয় দিবস আমাদের আশার কথা শোনায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশ সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে জানে। কিন্তু সেই সক্ষমতা কাজে লাগাতে হলে আমাদের সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে হবে— আমরা কি সহিংসতার পুরোনো বৃত্তেই ঘুরপাক খাব, নাকি দায়িত্বশীল রাজনীতি ও সহনশীলতার পথে এগিয়ে যাব। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই।
কামরুল হাসান

বাংলাদেশ আবারও একটি সংবেদনশীল সময় অতিক্রম করছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন—যা শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া নয়; বরং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। এই নির্বাচন ঘিরে জনগণের প্রত্যাশা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে গভীর উদ্বেগও। রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত, সামাজিক পরিসরে উৎকণ্ঠা, আর সাধারণ মানুষের মনে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার দোলাচল স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
এই শঙ্কা ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচনের সম্ভাব্য এক প্রার্থীর ওপর নৃশংস হামলার ঘটনা দেশকে নতুন করে নাড়া দিয়েছে। এমন ঘটনা শুধু একজন ব্যক্তির ওপর আঘাত নয়; এটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নির্বাচনকালীন নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের সামগ্রিক সক্ষমতার ওপর একটি গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে সাধারণ ভোটারের নিরাপত্তা এবং আস্থার জায়গাটি কতটা সুদৃঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই প্রশ্ন এড়ানোর সুযোগ নেই।
এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল হামলার মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, একটি পরিকল্পিত আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সেই ধারাবাহিকতায় সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা নির্বাচন ঘিরে সামগ্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতাকে নতুন করে সামনে এনেছে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়; বরং নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার একটি সুপরিকল্পিত অপচেষ্টা বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকে মনে করছেন, ওসমান হাদির ওপর হামলার লক্ষ্য ছিল শুধু একজন ব্যক্তিকে ভয় দেখানো নয়; বরং নির্বাচনকেই অনিশ্চয়তায় ফেলা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র নির্বাচন বানচালের হুমকি দিয়ে আসছে। সহিংসতার এই ধারাবাহিকতা সেই হুমকিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার ঘটনাটিকে নির্বাচনবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে যে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের সহিংসতা বরদাশত করা হবে না। জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া এবং প্রার্থীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব—এই অবস্থান জোরালোভাবে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
কিন্তু বক্তব্যের দৃঢ়তা বাস্তব পদক্ষেপে প্রতিফলিত না হলে জনমনে আস্থা ফিরবে না। নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের এখন প্রধান কর্তব্য হলো, কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ, দলমত-নির্বিশেষে দোষীদের দ্রুত শনাক্ত ও বিচারের আওতায় আনা এবং নির্বাচনী পরিবেশের ওপর আস্থা নিশ্চিত করা। গণতন্ত্রের পথ কখনোই ভয় আর সহিংসতার ওপর দাঁড়াতে পারে না।
এ মুহূর্তে সরকারের কঠোর ও নিরপেক্ষ অবস্থানই পারে নির্বাচনকে সুরক্ষিত রাখতে এবং জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে।
আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে সবাই স্বীকার করবেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সংকট নতুন কিছু নয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সহিংস আন্দোলন, অবিশ্বাসের চর্চা—এসব উপাদান বহুবার নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করেছে। কোনো কোনো সময় নির্বাচন হয়ে উঠেছে জনগণের উৎসব, আবার কোনো কোনো সময় তা রূপ নিয়েছে আতঙ্ক ও শঙ্কার আভাসে। ফলে প্রতিবার ভোটের আগে মানুষের মনে একটি স্বাভাবিক সংশয় সৃষ্টি হয়, সেটি হলো—এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে তো? নাকি আবারও সহিংসতার ছায়া পড়বে?
গণতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্যই হলো মতভিন্নতা। প্রতিযোগিতা থাকবে, মতের সংঘাত হবে—এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা যখন অস্ত্র, হামলা কিংবা ভয়ভীতির হয়, তখন তা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে না; বরং তাকে দুর্বল করে দেয়। রাজনীতির শক্তি হওয়া উচিত যুক্তি, কর্মসূচি ও জনসমর্থন। সহিংসতা কখনোই রাজনৈতিক সমাধান নয়। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, সহিংসতার পথ বেছে নিলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র, সমাজ এবং সাধারণ মানুষ।
এই বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা অনেকাংশে নির্ভর করে তাদের নিরপেক্ষতা এবং দৃঢ়তার ওপর। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেশাদার ও পক্ষপাতহীন ভূমিকা ছাড়া নির্বাচনকালীন সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কোনো ধরনের শিথিলতা কিংবা পক্ষপাত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো যে ধরনের নাজুক অবস্থায় রয়েছে, তাতে তাদের পুরো মনোবল ফিরিয়ে আনতে না পারলে রাষ্ট্র হয়তো বিপদে পড়ে যাবে।
দায়িত্ব অবশ্য শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরই বর্তায় না; সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতায় থাকা কিংবা ক্ষমতার বাইরে থাকা—উভয় অবস্থানেই দায়িত্বশীল আচরণ গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। উসকানিমূলক বক্তব্য, গুজব ছড়ানো কিংবা সহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত জাতির জন্য ক্ষতিকর হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা খুশি তা লেখা যায় বলে গুজব ছড়ানো সহজ। অনেকে কোনো প্রমাণ ছাড়াই এমন সব ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে থাকেন, যা আদতে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস এমনকি সংঘাতের জন্ম দেয়।
এমনই অস্থির এক সময়ে জাতীয় জীবনে ফিরে এল মহান বিজয় দিবস—১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার এদিনটি আমাদের মনে করিয়ে দিল, বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং অপরিসীম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালে একটি জাতি প্রমাণ করেছিল, তারা অন্যায়ের কাছে মাথানত করতে জানে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের বাংলাদেশ—এই দীর্ঘ পথচলায় রয়েছে রক্ত, বেদনা ও গৌরবের ইতিহাস।
বিজয় দিবস তাই শুধু উৎসবের দিন নয়; এটি আত্মজিজ্ঞাসার সময়ও। স্বাধীনতার এত বছর পর এসে আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা জরুরি—আমরা কি সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে পেরেছি? একটি সহনশীল, নিরাপদ ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র কি গড়ে তুলতে পেরেছি? রাজনৈতিক মতভিন্নতা কি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মেনে নিতে শিখেছি?
দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো পুরোপুরি ইতিবাচক নয়। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দায়িত্বহীন আচরণ আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। নির্বাচনের সময় এসব প্রবণতা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। অথচ নির্বাচন হওয়া উচিত জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের সবচেয়ে বড় উৎসব; ভয়ের উপলক্ষ নয়।
এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো সংযম। রাজনৈতিক দলগুলোর সংযম, প্রশাসনের সংযম এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীলতা। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কোনো একক পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সরকার, বিরোধী দল, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ—সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। পাশাপাশি এটিও আমাদের ভাবতে হবে, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন বলতে আমরা কী বুঝব। কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা তার সমর্থকদের নির্বাচনের বাইরে রাখা হলে তা কি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হতে পারে?
সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারলে জনগণের পক্ষে তাদের রায় দেওয়া সহজ হয়। যদি কারও আচরণে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তাহলে ব্যালটের মাধ্যমে তা সহজে জানিয়ে দিতে পারবে। ওপর থেকে চাপিয়ে না দিয়ে জনগণকেই এ বিষয়ে বোঝাপড়ার দায়িত্ব দেওয়া উচিত।
গণমাধ্যমের ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা জনগণের সঠিক তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করে এবং গুজব ও অপপ্রচার রোধে ভূমিকা রাখে। একইভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়িত্বশীল আচরণ এখন সময়ের দাবি। যাচাইহীন তথ্য, উসকানিমূলক বক্তব্য বা বিভ্রান্তিকর প্রচার পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এবারের নির্বাচন নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় গণমাধ্যমের উচিত নৈর্ব্যক্তিকভাবে পর্যালোচনা করে সংবাদ পরিবেশন করা। কোনো কারণেই পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন করা উচিত নয়। সেই অঙ্গীকার পালন করা হচ্ছে কি না, সেদিকে জনগণও নজর রাখবে।
এই কঠিন সময়েও বিজয় দিবস আমাদের আশার কথা শোনায়। বাংলাদেশ সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে জানে।
কিন্তু সেই সক্ষমতা কাজে লাগাতে হলে আমাদের সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি সহিংসতার পুরোনো বৃত্তে ঘুরপাক খাব, নাকি দায়িত্বশীল রাজনীতি ও সহনশীলতার পথে এগিয়ে যাব, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই।
জাতির আকাঙ্ক্ষা খুব সহজ, কিন্তু গভীর—ভালো থাকুক বাংলাদেশ। রক্তপাত নয়, ব্যালটের মাধ্যমে হোক ক্ষমতার পরিবর্তন। আতঙ্ক নয়, আস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠুক আগামী দিনের পথচলা। স্বাধীনতার চেতনার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখাতে হলে আমাদের এ পথই কিন্তু বেছে নিতে হবে।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আজকের পত্রিকা

বাংলাদেশ আবারও একটি সংবেদনশীল সময় অতিক্রম করছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন—যা শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া নয়; বরং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। এই নির্বাচন ঘিরে জনগণের প্রত্যাশা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে গভীর উদ্বেগও। রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত, সামাজিক পরিসরে উৎকণ্ঠা, আর সাধারণ মানুষের মনে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার দোলাচল স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
এই শঙ্কা ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচনের সম্ভাব্য এক প্রার্থীর ওপর নৃশংস হামলার ঘটনা দেশকে নতুন করে নাড়া দিয়েছে। এমন ঘটনা শুধু একজন ব্যক্তির ওপর আঘাত নয়; এটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নির্বাচনকালীন নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের সামগ্রিক সক্ষমতার ওপর একটি গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে সাধারণ ভোটারের নিরাপত্তা এবং আস্থার জায়গাটি কতটা সুদৃঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই প্রশ্ন এড়ানোর সুযোগ নেই।
এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল হামলার মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, একটি পরিকল্পিত আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সেই ধারাবাহিকতায় সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা নির্বাচন ঘিরে সামগ্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতাকে নতুন করে সামনে এনেছে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়; বরং নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার একটি সুপরিকল্পিত অপচেষ্টা বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকে মনে করছেন, ওসমান হাদির ওপর হামলার লক্ষ্য ছিল শুধু একজন ব্যক্তিকে ভয় দেখানো নয়; বরং নির্বাচনকেই অনিশ্চয়তায় ফেলা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র নির্বাচন বানচালের হুমকি দিয়ে আসছে। সহিংসতার এই ধারাবাহিকতা সেই হুমকিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার ঘটনাটিকে নির্বাচনবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে যে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের সহিংসতা বরদাশত করা হবে না। জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া এবং প্রার্থীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব—এই অবস্থান জোরালোভাবে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
কিন্তু বক্তব্যের দৃঢ়তা বাস্তব পদক্ষেপে প্রতিফলিত না হলে জনমনে আস্থা ফিরবে না। নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের এখন প্রধান কর্তব্য হলো, কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ, দলমত-নির্বিশেষে দোষীদের দ্রুত শনাক্ত ও বিচারের আওতায় আনা এবং নির্বাচনী পরিবেশের ওপর আস্থা নিশ্চিত করা। গণতন্ত্রের পথ কখনোই ভয় আর সহিংসতার ওপর দাঁড়াতে পারে না।
এ মুহূর্তে সরকারের কঠোর ও নিরপেক্ষ অবস্থানই পারে নির্বাচনকে সুরক্ষিত রাখতে এবং জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে।
আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে সবাই স্বীকার করবেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সংকট নতুন কিছু নয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সহিংস আন্দোলন, অবিশ্বাসের চর্চা—এসব উপাদান বহুবার নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করেছে। কোনো কোনো সময় নির্বাচন হয়ে উঠেছে জনগণের উৎসব, আবার কোনো কোনো সময় তা রূপ নিয়েছে আতঙ্ক ও শঙ্কার আভাসে। ফলে প্রতিবার ভোটের আগে মানুষের মনে একটি স্বাভাবিক সংশয় সৃষ্টি হয়, সেটি হলো—এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে তো? নাকি আবারও সহিংসতার ছায়া পড়বে?
গণতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্যই হলো মতভিন্নতা। প্রতিযোগিতা থাকবে, মতের সংঘাত হবে—এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা যখন অস্ত্র, হামলা কিংবা ভয়ভীতির হয়, তখন তা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে না; বরং তাকে দুর্বল করে দেয়। রাজনীতির শক্তি হওয়া উচিত যুক্তি, কর্মসূচি ও জনসমর্থন। সহিংসতা কখনোই রাজনৈতিক সমাধান নয়। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, সহিংসতার পথ বেছে নিলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র, সমাজ এবং সাধারণ মানুষ।
এই বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা অনেকাংশে নির্ভর করে তাদের নিরপেক্ষতা এবং দৃঢ়তার ওপর। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেশাদার ও পক্ষপাতহীন ভূমিকা ছাড়া নির্বাচনকালীন সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কোনো ধরনের শিথিলতা কিংবা পক্ষপাত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো যে ধরনের নাজুক অবস্থায় রয়েছে, তাতে তাদের পুরো মনোবল ফিরিয়ে আনতে না পারলে রাষ্ট্র হয়তো বিপদে পড়ে যাবে।
দায়িত্ব অবশ্য শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরই বর্তায় না; সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতায় থাকা কিংবা ক্ষমতার বাইরে থাকা—উভয় অবস্থানেই দায়িত্বশীল আচরণ গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। উসকানিমূলক বক্তব্য, গুজব ছড়ানো কিংবা সহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত জাতির জন্য ক্ষতিকর হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা খুশি তা লেখা যায় বলে গুজব ছড়ানো সহজ। অনেকে কোনো প্রমাণ ছাড়াই এমন সব ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে থাকেন, যা আদতে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস এমনকি সংঘাতের জন্ম দেয়।
এমনই অস্থির এক সময়ে জাতীয় জীবনে ফিরে এল মহান বিজয় দিবস—১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার এদিনটি আমাদের মনে করিয়ে দিল, বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং অপরিসীম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালে একটি জাতি প্রমাণ করেছিল, তারা অন্যায়ের কাছে মাথানত করতে জানে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের বাংলাদেশ—এই দীর্ঘ পথচলায় রয়েছে রক্ত, বেদনা ও গৌরবের ইতিহাস।
বিজয় দিবস তাই শুধু উৎসবের দিন নয়; এটি আত্মজিজ্ঞাসার সময়ও। স্বাধীনতার এত বছর পর এসে আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা জরুরি—আমরা কি সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে পেরেছি? একটি সহনশীল, নিরাপদ ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র কি গড়ে তুলতে পেরেছি? রাজনৈতিক মতভিন্নতা কি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মেনে নিতে শিখেছি?
দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো পুরোপুরি ইতিবাচক নয়। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দায়িত্বহীন আচরণ আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। নির্বাচনের সময় এসব প্রবণতা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। অথচ নির্বাচন হওয়া উচিত জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের সবচেয়ে বড় উৎসব; ভয়ের উপলক্ষ নয়।
এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো সংযম। রাজনৈতিক দলগুলোর সংযম, প্রশাসনের সংযম এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীলতা। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কোনো একক পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সরকার, বিরোধী দল, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ—সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। পাশাপাশি এটিও আমাদের ভাবতে হবে, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন বলতে আমরা কী বুঝব। কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা তার সমর্থকদের নির্বাচনের বাইরে রাখা হলে তা কি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হতে পারে?
সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারলে জনগণের পক্ষে তাদের রায় দেওয়া সহজ হয়। যদি কারও আচরণে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তাহলে ব্যালটের মাধ্যমে তা সহজে জানিয়ে দিতে পারবে। ওপর থেকে চাপিয়ে না দিয়ে জনগণকেই এ বিষয়ে বোঝাপড়ার দায়িত্ব দেওয়া উচিত।
গণমাধ্যমের ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা জনগণের সঠিক তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করে এবং গুজব ও অপপ্রচার রোধে ভূমিকা রাখে। একইভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়িত্বশীল আচরণ এখন সময়ের দাবি। যাচাইহীন তথ্য, উসকানিমূলক বক্তব্য বা বিভ্রান্তিকর প্রচার পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এবারের নির্বাচন নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় গণমাধ্যমের উচিত নৈর্ব্যক্তিকভাবে পর্যালোচনা করে সংবাদ পরিবেশন করা। কোনো কারণেই পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন করা উচিত নয়। সেই অঙ্গীকার পালন করা হচ্ছে কি না, সেদিকে জনগণও নজর রাখবে।
এই কঠিন সময়েও বিজয় দিবস আমাদের আশার কথা শোনায়। বাংলাদেশ সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে জানে।
কিন্তু সেই সক্ষমতা কাজে লাগাতে হলে আমাদের সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি সহিংসতার পুরোনো বৃত্তে ঘুরপাক খাব, নাকি দায়িত্বশীল রাজনীতি ও সহনশীলতার পথে এগিয়ে যাব, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই।
জাতির আকাঙ্ক্ষা খুব সহজ, কিন্তু গভীর—ভালো থাকুক বাংলাদেশ। রক্তপাত নয়, ব্যালটের মাধ্যমে হোক ক্ষমতার পরিবর্তন। আতঙ্ক নয়, আস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠুক আগামী দিনের পথচলা। স্বাধীনতার চেতনার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখাতে হলে আমাদের এ পথই কিন্তু বেছে নিতে হবে।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আজকের পত্রিকা

মায়ের মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ। মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’
১৪ আগস্ট ২০২১
শুরুটা ছিল বেশ আশাজাগানিয়া। বিধি অনুযায়ী আমাদের দেশে মন্ত্রিসভার সদস্যদের কী বেতন বা সম্মানী এবং ভাতা ও সুবিধাদি এক্ষণে জানা নেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েই নিশ্চয় তা নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রী ছাড়া যাঁরা সংসদ সদস্য, তাঁদের বেলায়ও একই কথা; মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা এবং বলতে গেলে অবাধ সুযোগ-সুবিধা আছে বলেই
১৭ ঘণ্টা আগে
বিজয়ের মাস চলছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিনটি ছিল গতকাল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন ‘বিজয়’। এদিন বাঙালির আত্মপরিচয় লাভের দিন।
১৭ ঘণ্টা আগে
দেশের মানুষ যখন উৎসবমুখর পরিবেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছে, তখন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নির্বাচনে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ১৫ ডিসেম্বর একটা উদ্বেগজনক ‘ভোটের আগে আতঙ্ক জনমনে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
১৭ ঘণ্টা আগেমুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত মুজিবনগর বা প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ প্রত্যেককে কিছু সম্মানী দেওয়া হতো। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের জন্য কিছু বেশি; তবে সংসদ সদস্যদের জন্য ৪০০ টাকা করে বেতন-ভাতা নির্ধারিত ছিল।
বিমল সরকার

শুরুটা ছিল বেশ আশাজাগানিয়া। বিধি অনুযায়ী আমাদের দেশে মন্ত্রিসভার সদস্যদের কী বেতন বা সম্মানী এবং ভাতা ও সুবিধাদি এক্ষণে জানা নেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েই নিশ্চয় তা নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রী ছাড়া যাঁরা সংসদ সদস্য, তাঁদের বেলায়ও একই কথা; মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা এবং বলতে গেলে অবাধ সুযোগ-সুবিধা আছে বলেই মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য একেকজনের কী আগ্রহ, তোড়জোড় ও প্রাণান্ত চেষ্টা-তদবির; তা নির্বাচনের আগমুহূর্তে বেশি টের পাওয়া যায়!
পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশে প্রথমে ছিল গভর্নর জেনারেল ও পরে রাষ্ট্রপতিশাসিত (প্রেসিডেনশিয়াল) পদ্ধতির সরকার। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট (১৯৭১ সাল পর্যন্ত)। প্রদেশে ছিলেন গভর্নর। স্বাধীনতার পর ব্যবস্থা পরিবর্তন করে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করা হয়।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে সদ্য স্বাধীন দেশের শাসনদণ্ডভার কাঁধে তুলে নেন শেখ মুজিবুর রহমান। সংসদীয় পদ্ধতিতে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিবের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও কপর্দকশূন্য একটি দেশের কান্ডারি হলেন তিনি। স্বাধীন-সার্বভৌম নবীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যাত্রা হলো শুরু। সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে তিনি প্রথমেই নাগরিক জীবনে কৃচ্ছ্রসাধনের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি নবগঠিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের বেতন নির্ধারণ করেন পাকিস্তান আমলের তুলনায় অন্তত এক-তৃতীয়াংশ কম। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে একজন মন্ত্রীর মাসিক বেতন নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া আপ্যায়ন ভাতা হিসেবে রাখা হয় আরও ৫০০ টাকা। উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান বা ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রিসভার সদস্যরা ২ হাজার ২০০ টাকা করে বেতন এবং প্রত্যেকে মাসিক আপ্যায়ন ভাতা হিসেবে পেতেন আরও ১ হাজার টাকা। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে একজন মন্ত্রী যেখানে ৩ হাজার ২০০ টাকা (বেতন ২২০০ + আপ্যায়ন ভাতা ১০০০) বেতন-ভাতা পেয়েছেন, সেখানে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীর জন্য বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় সাকল্যে ২ হাজার (বেতন ১৫০০ + ভাতা ৫০০) টাকা।
কিন্তু মন্ত্রীদের জন্য এই বেতন-ভাতা নির্ধারণের পর মাস তো দূরের কথা, সপ্তাহটি কোনোরকমে কেটেছে। পাকিস্তানিদের ৯ মাসব্যাপী তাণ্ডব চালানোর পর একদম শূন্য থেকে বাংলাদেশের পথচলা শুরু। সাহায্য হিসেবে অর্থ, খাদ্যসামগ্রীসহ নানা কিছু আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। এমতাবস্থায় মন্ত্রীদের এত
বেশি বেতন নেওয়া ঠিক হবে না। এ ব্যাপারে ঘনিষ্ঠ দু-চারজন সহকর্মী-মন্ত্রীর সঙ্গে কথাও বলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে
২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে নতুন করে আবারও সরকারি নির্দেশনা জারি করা হলো। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ত্রীদের বেতনের পরিমাণ আরও কমিয়ে ১ হাজার ৫০০ টাকার স্থলে ঠিক ১ হাজার টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। আপ্যায়ন ভাতা আগের ৫০০ টাকাতেই স্থির থাকে।
১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের দুঃশাসনের বিপরীতে যুক্তফ্রন্ট তাদের ২১ দফা নির্বাচনী অঙ্গীকারনামা (মেনিফেস্টো) ঘোষণা করে। ওই অঙ্গীকারনামাকে শাসন-শোষণ আর বৈষম্যের শিকার হতভাগ্য পূর্ববঙ্গবাসী তাদের ‘মুক্তির সনদ’ হিসেবে গ্রহণ এবং নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে যুক্তফ্রন্টকে বিজয়ী করে। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার অন্তর্ভুক্ত প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক অনেক অঙ্গীকারের মধ্যে ছিল:
১. শাসনব্যয় হ্রাস এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারের কোনো মন্ত্রীর ১ হাজার টাকার বেশি বেতন গ্রহণ না করা (১২ নম্বর দফা)।
২. দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ-রিসওয়াত বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ (১৩ নম্বর দফা)।
৩. বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে কম বিলাসের বাড়িতে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান করা এবং বর্ধমান হাউসকে প্রথমে ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা (১৪ নম্বর দফা)। বাঙালির দুর্ভাগ্য যে শেরেবাংলার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে মন্ত্রিসভার কার্যক্রম শুরু করতে না করতেই কেন্দ্রীয় সরকার নানা ছুতায় মাত্র ৫৬ দিনের মাথায় প্রাদেশিক যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে।
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত মুজিবনগর বা প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণকে কিছু সম্মানী দেওয়া হতো। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের জন্য কিছু বেশি; তবে সংসদ সদস্যদের জন্য ৪০০ টাকা করে বেতন-ভাতা নির্ধারিত ছিল (যা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত একই হারে বহাল থাকে)। অর্থাৎ বলতে গেলে সত্তরের দশকজুড়ে টিএ-ডিএসহ সামান্য সুবিধা ও সম্মানী হিসেবে ৪০০ টাকা ভাতা পান একজন সংসদ সদস্য।
মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের সম্মানী এবং বেতন-ভাতাদি নিয়ে মানুষের বেশ কৌতূহল। বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে রয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। আবারও নিজের সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করি; আমার জানা নেই ৫০ বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে বর্তমান ব্যবস্থা অনুযায়ী সরকারের একজন মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যের সম্মানী কিংবা বেতন-ভাতার পরিমাণ কী। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের আগেই রাজনীতিকেরা বেতন-ভাতার ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করেছিলেন। ১৯৭২ সালে সরকার গঠনের অব্যবহিত পর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দফায় দফায় তাঁদের বেতন-ভাতা কমানো হয়। ত্রয়োদশ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রত্যাশা, নিজ নিজ ঘোষিতব্য মেনিফেস্টোতে বেতন-ভাতার বিষয়টিও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হোক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক

শুরুটা ছিল বেশ আশাজাগানিয়া। বিধি অনুযায়ী আমাদের দেশে মন্ত্রিসভার সদস্যদের কী বেতন বা সম্মানী এবং ভাতা ও সুবিধাদি এক্ষণে জানা নেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েই নিশ্চয় তা নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রী ছাড়া যাঁরা সংসদ সদস্য, তাঁদের বেলায়ও একই কথা; মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা এবং বলতে গেলে অবাধ সুযোগ-সুবিধা আছে বলেই মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য একেকজনের কী আগ্রহ, তোড়জোড় ও প্রাণান্ত চেষ্টা-তদবির; তা নির্বাচনের আগমুহূর্তে বেশি টের পাওয়া যায়!
পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশে প্রথমে ছিল গভর্নর জেনারেল ও পরে রাষ্ট্রপতিশাসিত (প্রেসিডেনশিয়াল) পদ্ধতির সরকার। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট (১৯৭১ সাল পর্যন্ত)। প্রদেশে ছিলেন গভর্নর। স্বাধীনতার পর ব্যবস্থা পরিবর্তন করে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করা হয়।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে সদ্য স্বাধীন দেশের শাসনদণ্ডভার কাঁধে তুলে নেন শেখ মুজিবুর রহমান। সংসদীয় পদ্ধতিতে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিবের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও কপর্দকশূন্য একটি দেশের কান্ডারি হলেন তিনি। স্বাধীন-সার্বভৌম নবীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যাত্রা হলো শুরু। সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে তিনি প্রথমেই নাগরিক জীবনে কৃচ্ছ্রসাধনের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি নবগঠিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের বেতন নির্ধারণ করেন পাকিস্তান আমলের তুলনায় অন্তত এক-তৃতীয়াংশ কম। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে একজন মন্ত্রীর মাসিক বেতন নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া আপ্যায়ন ভাতা হিসেবে রাখা হয় আরও ৫০০ টাকা। উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান বা ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রিসভার সদস্যরা ২ হাজার ২০০ টাকা করে বেতন এবং প্রত্যেকে মাসিক আপ্যায়ন ভাতা হিসেবে পেতেন আরও ১ হাজার টাকা। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে একজন মন্ত্রী যেখানে ৩ হাজার ২০০ টাকা (বেতন ২২০০ + আপ্যায়ন ভাতা ১০০০) বেতন-ভাতা পেয়েছেন, সেখানে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীর জন্য বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় সাকল্যে ২ হাজার (বেতন ১৫০০ + ভাতা ৫০০) টাকা।
কিন্তু মন্ত্রীদের জন্য এই বেতন-ভাতা নির্ধারণের পর মাস তো দূরের কথা, সপ্তাহটি কোনোরকমে কেটেছে। পাকিস্তানিদের ৯ মাসব্যাপী তাণ্ডব চালানোর পর একদম শূন্য থেকে বাংলাদেশের পথচলা শুরু। সাহায্য হিসেবে অর্থ, খাদ্যসামগ্রীসহ নানা কিছু আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। এমতাবস্থায় মন্ত্রীদের এত
বেশি বেতন নেওয়া ঠিক হবে না। এ ব্যাপারে ঘনিষ্ঠ দু-চারজন সহকর্মী-মন্ত্রীর সঙ্গে কথাও বলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে
২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে নতুন করে আবারও সরকারি নির্দেশনা জারি করা হলো। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ত্রীদের বেতনের পরিমাণ আরও কমিয়ে ১ হাজার ৫০০ টাকার স্থলে ঠিক ১ হাজার টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। আপ্যায়ন ভাতা আগের ৫০০ টাকাতেই স্থির থাকে।
১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের দুঃশাসনের বিপরীতে যুক্তফ্রন্ট তাদের ২১ দফা নির্বাচনী অঙ্গীকারনামা (মেনিফেস্টো) ঘোষণা করে। ওই অঙ্গীকারনামাকে শাসন-শোষণ আর বৈষম্যের শিকার হতভাগ্য পূর্ববঙ্গবাসী তাদের ‘মুক্তির সনদ’ হিসেবে গ্রহণ এবং নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে যুক্তফ্রন্টকে বিজয়ী করে। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার অন্তর্ভুক্ত প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক অনেক অঙ্গীকারের মধ্যে ছিল:
১. শাসনব্যয় হ্রাস এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারের কোনো মন্ত্রীর ১ হাজার টাকার বেশি বেতন গ্রহণ না করা (১২ নম্বর দফা)।
২. দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ-রিসওয়াত বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ (১৩ নম্বর দফা)।
৩. বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে কম বিলাসের বাড়িতে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান করা এবং বর্ধমান হাউসকে প্রথমে ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা (১৪ নম্বর দফা)। বাঙালির দুর্ভাগ্য যে শেরেবাংলার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে মন্ত্রিসভার কার্যক্রম শুরু করতে না করতেই কেন্দ্রীয় সরকার নানা ছুতায় মাত্র ৫৬ দিনের মাথায় প্রাদেশিক যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে।
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত মুজিবনগর বা প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণকে কিছু সম্মানী দেওয়া হতো। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের জন্য কিছু বেশি; তবে সংসদ সদস্যদের জন্য ৪০০ টাকা করে বেতন-ভাতা নির্ধারিত ছিল (যা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত একই হারে বহাল থাকে)। অর্থাৎ বলতে গেলে সত্তরের দশকজুড়ে টিএ-ডিএসহ সামান্য সুবিধা ও সম্মানী হিসেবে ৪০০ টাকা ভাতা পান একজন সংসদ সদস্য।
মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের সম্মানী এবং বেতন-ভাতাদি নিয়ে মানুষের বেশ কৌতূহল। বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে রয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। আবারও নিজের সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করি; আমার জানা নেই ৫০ বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে বর্তমান ব্যবস্থা অনুযায়ী সরকারের একজন মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যের সম্মানী কিংবা বেতন-ভাতার পরিমাণ কী। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের আগেই রাজনীতিকেরা বেতন-ভাতার ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করেছিলেন। ১৯৭২ সালে সরকার গঠনের অব্যবহিত পর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দফায় দফায় তাঁদের বেতন-ভাতা কমানো হয়। ত্রয়োদশ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রত্যাশা, নিজ নিজ ঘোষিতব্য মেনিফেস্টোতে বেতন-ভাতার বিষয়টিও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হোক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক

মায়ের মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ। মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’
১৪ আগস্ট ২০২১
বাংলাদেশ আবারও একটি সংবেদনশীল সময় অতিক্রম করছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন—যা শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া নয়; বরং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। এই নির্বাচন ঘিরে জনগণের প্রত্যাশা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে গভীর উদ্বেগও।
১৭ ঘণ্টা আগে
বিজয়ের মাস চলছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিনটি ছিল গতকাল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন ‘বিজয়’। এদিন বাঙালির আত্মপরিচয় লাভের দিন।
১৭ ঘণ্টা আগে
দেশের মানুষ যখন উৎসবমুখর পরিবেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছে, তখন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নির্বাচনে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ১৫ ডিসেম্বর একটা উদ্বেগজনক ‘ভোটের আগে আতঙ্ক জনমনে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
১৭ ঘণ্টা আগেডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

বিজয়ের মাস চলছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিনটি ছিল গতকাল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন ‘বিজয়’। এদিন বাঙালির আত্মপরিচয় লাভের দিন।
ডিসেম্বর এলেই বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এক ভিন্ন আবহ তৈরি হয়। শীতের সকালের কুয়াশার ভেতর দিয়ে উড়তে থাকা লাল-সবুজ পতাকা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এক রক্তাক্ত কিন্তু গৌরবময় ইতিহাসের কথা। আজ বিজয় দিবসে দাঁড়িয়ে আমরা গর্বের সঙ্গে সেই ইতিহাস স্মরণ করি, একই সঙ্গে নিজেদের দায়িত্বের দিকে ফিরে তাকাই।
এই বিজয় কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। পাকিস্তানি শাসনামলের দীর্ঘ বৈষম্য, রাজনৈতিক বঞ্চনা এবং সাংস্কৃতিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিবাদ ধীরে ধীরে এক অনিবার্য সংগ্রামে রূপ নেয়। ভাষা আন্দোলন থেকে ছয় দফা, গণ-অভ্যুত্থান থেকে অসহযোগ—এই ধারাবাহিক লড়াইই মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি তৈরি করেছিল। ২৫ মার্চের কালরাতে নির্বিচার গণহত্যা সেই সংগ্রামকে চূড়ান্ত রূপ দেয়। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই বাঙালি জাতি অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল সাধারণ মানুষ। এটি কোনো পেশাদার বাহিনীর একক যুদ্ধ ছিল না; বরং গ্রাম ও শহরের মানুষ মিলেই গড়ে তুলেছিল প্রতিরোধ। কৃষক যেমন লড়েছেন, তেমনি লড়েছেন শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা। নারীরা শুধু সহযোদ্ধাই নন, অনেক ক্ষেত্রে সম্মুখযোদ্ধার ভূমিকাও পালন করেছেন। এই সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণই মুক্তিযুদ্ধকে একটি সর্বজনীন জাতীয় সংগ্রামে পরিণত করে।
এই বিজয়ের মূল্য ছিল ভয়াবহ। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, লাখো মানুষের বাস্তুচ্যুতি—সব মিলিয়ে স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। এই ইতিহাস আমাদের গৌরবের, কিন্তু একই সঙ্গে বেদনারও। বিজয় দিবস তাই শুধু উৎসবের নয়, নীরব শ্রদ্ধা ও আত্মসমালোচনারও দিন।
৫৪ বছর পর বাংলাদেশের দিকে তাকালে অগ্রগতির চিত্র অস্বীকার করা যায় না। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ আজ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রগতি, সড়ক-সেতু ও যোগাযোগ অবকাঠামোর বিস্তার দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়িয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সূচকে উন্নতি, নারীশিক্ষা ও নারী অংশগ্রহণ বৃদ্ধি সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
আন্তর্জাতিক পরিসরেও বাংলাদেশের অবস্থান এখন দৃশ্যমান। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সোচ্চার অবস্থান এবং মানবিক সহায়তায় অংশগ্রহণ দেশটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। একসময় যে দেশটিকে অবহেলার চোখে দেখা হতো, আজ সেই দেশ সম্ভাবনার নাম।
তবু বিজয়ের এই সাফল্যের আড়ালে কিছু বাস্তবতা আমাদের বিব্রত করে। সমাজে বৈষম্য এখনো বড় সমস্যা। ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান কমার বদলে অনেক ক্ষেত্রে বেড়েছে। শহরের সুযোগ-সুবিধা গ্রাম পর্যন্ত সমানভাবে পৌঁছায়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সমতার প্রশ্ন আজও জোরালোভাবে উপস্থিত।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার। এই জায়গায় ঘাটতি থাকলে মানুষের রাষ্ট্রের ওপর আস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেকোনো সমাজকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দেয়। বিজয়ের চেতনা তখনই অর্থবহ হয়, যখন সাধারণ মানুষ নিরাপদ বোধ করে এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা রাখতে পারে।
গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। ভিন্নমতকে শত্রুতা হিসেবে দেখার প্রবণতা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। একটি পরিণত রাষ্ট্রে মতভিন্নতা থাকবে, কিন্তু সেটিকে সহনশীলতার মধ্য দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। যুক্তি ও আলোচনার সংস্কৃতি শক্তিশালী না হলে বিজয়ের চেতনা দুর্বল হয়ে পড়ে।
দুর্নীতি আজ আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এটি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয় নয়; বরং নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীক। দুর্নীতির সঙ্গে আপস করা মানেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে আপস করা। সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা ছাড়া উন্নয়ন কখনোই টেকসই হতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রেও দায়িত্বশীলতা জরুরি। ইতিহাস বিকৃতি বা রাজনৈতিক সুবিধার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বিজয়ের চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ইতিহাস কোনো ব্যক্তি বা দলের সম্পত্তি নয়; এটি পুরো জাতির। সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথ দেখাতে পারে।
আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ অনেক সময় বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ একটি অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়। অথচ মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি মূল্যবোধের সংগ্রাম—ন্যায়, সমতা ও মানবিকতার জন্য লড়াই। এই মূল্যবোধ তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে না পারলে উন্নয়নের অর্জনও একসময় অর্থহীন হয়ে পড়বে।
উন্নয়ন মানে শুধু বড় প্রকল্প নয়। মানুষের জীবনমানের উন্নয়নই রাষ্ট্রের সাফল্যের আসল মাপকাঠি। গ্রামবাংলা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত থাকলে স্বাধীনতার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়। কৃষক ন্যায্য দাম না পেলে, শ্রমিক নিরাপত্তাহীন থাকলে বিজয়ের অর্থ প্রশ্নের মুখে পড়ে।
নারী ও শিশুর নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা স্বাধীন রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীরা যে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা আমাদের এই দায়িত্ব আরও গভীরভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিজয় দিবস আমাদের শেখায়, স্বাধীনতা কোনো স্থির অর্জন নয়। এটি প্রতিদিন রক্ষা করার বিষয়। দেশপ্রেম মানে কেবল স্লোগান দেওয়া নয়; আইন মেনে চলা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা আর মানবিক আচরণ করাই দেশপ্রেমের প্রকৃত রূপ।

বিজয়ের মাস চলছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিনটি ছিল গতকাল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন ‘বিজয়’। এদিন বাঙালির আত্মপরিচয় লাভের দিন।
ডিসেম্বর এলেই বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এক ভিন্ন আবহ তৈরি হয়। শীতের সকালের কুয়াশার ভেতর দিয়ে উড়তে থাকা লাল-সবুজ পতাকা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এক রক্তাক্ত কিন্তু গৌরবময় ইতিহাসের কথা। আজ বিজয় দিবসে দাঁড়িয়ে আমরা গর্বের সঙ্গে সেই ইতিহাস স্মরণ করি, একই সঙ্গে নিজেদের দায়িত্বের দিকে ফিরে তাকাই।
এই বিজয় কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। পাকিস্তানি শাসনামলের দীর্ঘ বৈষম্য, রাজনৈতিক বঞ্চনা এবং সাংস্কৃতিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিবাদ ধীরে ধীরে এক অনিবার্য সংগ্রামে রূপ নেয়। ভাষা আন্দোলন থেকে ছয় দফা, গণ-অভ্যুত্থান থেকে অসহযোগ—এই ধারাবাহিক লড়াইই মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি তৈরি করেছিল। ২৫ মার্চের কালরাতে নির্বিচার গণহত্যা সেই সংগ্রামকে চূড়ান্ত রূপ দেয়। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই বাঙালি জাতি অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল সাধারণ মানুষ। এটি কোনো পেশাদার বাহিনীর একক যুদ্ধ ছিল না; বরং গ্রাম ও শহরের মানুষ মিলেই গড়ে তুলেছিল প্রতিরোধ। কৃষক যেমন লড়েছেন, তেমনি লড়েছেন শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা। নারীরা শুধু সহযোদ্ধাই নন, অনেক ক্ষেত্রে সম্মুখযোদ্ধার ভূমিকাও পালন করেছেন। এই সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণই মুক্তিযুদ্ধকে একটি সর্বজনীন জাতীয় সংগ্রামে পরিণত করে।
এই বিজয়ের মূল্য ছিল ভয়াবহ। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, লাখো মানুষের বাস্তুচ্যুতি—সব মিলিয়ে স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। এই ইতিহাস আমাদের গৌরবের, কিন্তু একই সঙ্গে বেদনারও। বিজয় দিবস তাই শুধু উৎসবের নয়, নীরব শ্রদ্ধা ও আত্মসমালোচনারও দিন।
৫৪ বছর পর বাংলাদেশের দিকে তাকালে অগ্রগতির চিত্র অস্বীকার করা যায় না। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ আজ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রগতি, সড়ক-সেতু ও যোগাযোগ অবকাঠামোর বিস্তার দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়িয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সূচকে উন্নতি, নারীশিক্ষা ও নারী অংশগ্রহণ বৃদ্ধি সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
আন্তর্জাতিক পরিসরেও বাংলাদেশের অবস্থান এখন দৃশ্যমান। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সোচ্চার অবস্থান এবং মানবিক সহায়তায় অংশগ্রহণ দেশটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। একসময় যে দেশটিকে অবহেলার চোখে দেখা হতো, আজ সেই দেশ সম্ভাবনার নাম।
তবু বিজয়ের এই সাফল্যের আড়ালে কিছু বাস্তবতা আমাদের বিব্রত করে। সমাজে বৈষম্য এখনো বড় সমস্যা। ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান কমার বদলে অনেক ক্ষেত্রে বেড়েছে। শহরের সুযোগ-সুবিধা গ্রাম পর্যন্ত সমানভাবে পৌঁছায়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সমতার প্রশ্ন আজও জোরালোভাবে উপস্থিত।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার। এই জায়গায় ঘাটতি থাকলে মানুষের রাষ্ট্রের ওপর আস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেকোনো সমাজকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দেয়। বিজয়ের চেতনা তখনই অর্থবহ হয়, যখন সাধারণ মানুষ নিরাপদ বোধ করে এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা রাখতে পারে।
গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। ভিন্নমতকে শত্রুতা হিসেবে দেখার প্রবণতা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। একটি পরিণত রাষ্ট্রে মতভিন্নতা থাকবে, কিন্তু সেটিকে সহনশীলতার মধ্য দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। যুক্তি ও আলোচনার সংস্কৃতি শক্তিশালী না হলে বিজয়ের চেতনা দুর্বল হয়ে পড়ে।
দুর্নীতি আজ আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এটি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয় নয়; বরং নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীক। দুর্নীতির সঙ্গে আপস করা মানেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে আপস করা। সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা ছাড়া উন্নয়ন কখনোই টেকসই হতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রেও দায়িত্বশীলতা জরুরি। ইতিহাস বিকৃতি বা রাজনৈতিক সুবিধার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বিজয়ের চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ইতিহাস কোনো ব্যক্তি বা দলের সম্পত্তি নয়; এটি পুরো জাতির। সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথ দেখাতে পারে।
আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ অনেক সময় বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ একটি অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়। অথচ মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি মূল্যবোধের সংগ্রাম—ন্যায়, সমতা ও মানবিকতার জন্য লড়াই। এই মূল্যবোধ তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে না পারলে উন্নয়নের অর্জনও একসময় অর্থহীন হয়ে পড়বে।
উন্নয়ন মানে শুধু বড় প্রকল্প নয়। মানুষের জীবনমানের উন্নয়নই রাষ্ট্রের সাফল্যের আসল মাপকাঠি। গ্রামবাংলা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত থাকলে স্বাধীনতার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়। কৃষক ন্যায্য দাম না পেলে, শ্রমিক নিরাপত্তাহীন থাকলে বিজয়ের অর্থ প্রশ্নের মুখে পড়ে।
নারী ও শিশুর নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা স্বাধীন রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীরা যে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা আমাদের এই দায়িত্ব আরও গভীরভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিজয় দিবস আমাদের শেখায়, স্বাধীনতা কোনো স্থির অর্জন নয়। এটি প্রতিদিন রক্ষা করার বিষয়। দেশপ্রেম মানে কেবল স্লোগান দেওয়া নয়; আইন মেনে চলা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা আর মানবিক আচরণ করাই দেশপ্রেমের প্রকৃত রূপ।

মায়ের মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ। মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’
১৪ আগস্ট ২০২১
বাংলাদেশ আবারও একটি সংবেদনশীল সময় অতিক্রম করছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন—যা শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া নয়; বরং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। এই নির্বাচন ঘিরে জনগণের প্রত্যাশা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে গভীর উদ্বেগও।
১৭ ঘণ্টা আগে
শুরুটা ছিল বেশ আশাজাগানিয়া। বিধি অনুযায়ী আমাদের দেশে মন্ত্রিসভার সদস্যদের কী বেতন বা সম্মানী এবং ভাতা ও সুবিধাদি এক্ষণে জানা নেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েই নিশ্চয় তা নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রী ছাড়া যাঁরা সংসদ সদস্য, তাঁদের বেলায়ও একই কথা; মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা এবং বলতে গেলে অবাধ সুযোগ-সুবিধা আছে বলেই
১৭ ঘণ্টা আগে
দেশের মানুষ যখন উৎসবমুখর পরিবেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছে, তখন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নির্বাচনে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ১৫ ডিসেম্বর একটা উদ্বেগজনক ‘ভোটের আগে আতঙ্ক জনমনে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
১৭ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

দেশের মানুষ যখন উৎসবমুখর পরিবেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছে, তখন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নির্বাচনে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ১৫ ডিসেম্বর একটা উদ্বেগজনক ‘ভোটের আগে আতঙ্ক জনমনে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
মূলত তফসিল ঘোষণার পরের দিন ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করার ঘটনা সেই আশঙ্কাকে জোরালো করেছে। ফলে ওই ঘটনা সম্ভাব্য প্রার্থীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক তৈরি করেছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন রাজনৈতিক নেতারাসহ জুলাই যোদ্ধারা। সরকার নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দিলেও এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনী প্রচার নিয়ে আশঙ্কা করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
প্রকাশ্যে এই হামলা প্রমাণ করেছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির হাল অত্যন্ত নাজুক। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অভিমত অনুযায়ী, সময়মতো কার্যকর উদ্যোগের অভাবই এই অবস্থার জন্য দায়ী। নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরও যদি সম্ভাব্য প্রার্থীরা জীবন নিয়ে শঙ্কায় থাকেন, তবে তা একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে।
এই ঘটনা শুধু যে একটি বিচ্ছিন্ন হামলা নয়; এটি পুরো নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। প্রশ্ন হলো, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কখনো স্বাভাবিক ছিল না। একের পর এক মবের ঘটনা ঘটার পরেও এসব নিয়ন্ত্রণে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এরপর জুলাই আন্দোলনের পর দেশের অনেক থানার অস্ত্র লুট হয়েছিল। সে সময় অধিকাংশ অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ৫ আগস্টের পর একে একে অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। যে পরিস্থিতি আজ দাঁড়িয়েছে, তার সবটাই আগের ঘটনার ধারাবাহিকতা।
কিন্তু সরকার প্রথম থেকে বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে সক্রিয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তার আড়ালে জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি সব সময় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
এখন নির্বাচনের আগে প্রায় দেড় বছরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সংকট কীভাবে কাটানো সম্ভব? একটি ঘটনা ঘটার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নানা কথার ফুলঝুরি শোনান, কিন্তু কিছুদিন পর পরিস্থিতি পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
নির্বাচন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে শুধু আশ্বাস নয়, বরং কঠোর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখাতে হবে। এখন দরকার দ্রুত বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। এই হামলার তদন্ত এবং অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার নিশ্চিত করে জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনাটাই এখন সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো, একটি শঙ্কামুক্ত পরিবেশ তৈরি করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাই এখন নির্বাচনের প্রধান পূর্বশর্ত।

দেশের মানুষ যখন উৎসবমুখর পরিবেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছে, তখন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নির্বাচনে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ১৫ ডিসেম্বর একটা উদ্বেগজনক ‘ভোটের আগে আতঙ্ক জনমনে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
মূলত তফসিল ঘোষণার পরের দিন ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করার ঘটনা সেই আশঙ্কাকে জোরালো করেছে। ফলে ওই ঘটনা সম্ভাব্য প্রার্থীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক তৈরি করেছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন রাজনৈতিক নেতারাসহ জুলাই যোদ্ধারা। সরকার নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দিলেও এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনী প্রচার নিয়ে আশঙ্কা করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
প্রকাশ্যে এই হামলা প্রমাণ করেছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির হাল অত্যন্ত নাজুক। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অভিমত অনুযায়ী, সময়মতো কার্যকর উদ্যোগের অভাবই এই অবস্থার জন্য দায়ী। নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরও যদি সম্ভাব্য প্রার্থীরা জীবন নিয়ে শঙ্কায় থাকেন, তবে তা একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে।
এই ঘটনা শুধু যে একটি বিচ্ছিন্ন হামলা নয়; এটি পুরো নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। প্রশ্ন হলো, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কখনো স্বাভাবিক ছিল না। একের পর এক মবের ঘটনা ঘটার পরেও এসব নিয়ন্ত্রণে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এরপর জুলাই আন্দোলনের পর দেশের অনেক থানার অস্ত্র লুট হয়েছিল। সে সময় অধিকাংশ অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ৫ আগস্টের পর একে একে অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। যে পরিস্থিতি আজ দাঁড়িয়েছে, তার সবটাই আগের ঘটনার ধারাবাহিকতা।
কিন্তু সরকার প্রথম থেকে বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে সক্রিয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তার আড়ালে জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি সব সময় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
এখন নির্বাচনের আগে প্রায় দেড় বছরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সংকট কীভাবে কাটানো সম্ভব? একটি ঘটনা ঘটার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নানা কথার ফুলঝুরি শোনান, কিন্তু কিছুদিন পর পরিস্থিতি পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
নির্বাচন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে শুধু আশ্বাস নয়, বরং কঠোর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখাতে হবে। এখন দরকার দ্রুত বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। এই হামলার তদন্ত এবং অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার নিশ্চিত করে জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনাটাই এখন সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো, একটি শঙ্কামুক্ত পরিবেশ তৈরি করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাই এখন নির্বাচনের প্রধান পূর্বশর্ত।

মায়ের মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ। মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’
১৪ আগস্ট ২০২১
বাংলাদেশ আবারও একটি সংবেদনশীল সময় অতিক্রম করছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন—যা শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া নয়; বরং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। এই নির্বাচন ঘিরে জনগণের প্রত্যাশা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে গভীর উদ্বেগও।
১৭ ঘণ্টা আগে
শুরুটা ছিল বেশ আশাজাগানিয়া। বিধি অনুযায়ী আমাদের দেশে মন্ত্রিসভার সদস্যদের কী বেতন বা সম্মানী এবং ভাতা ও সুবিধাদি এক্ষণে জানা নেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েই নিশ্চয় তা নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রী ছাড়া যাঁরা সংসদ সদস্য, তাঁদের বেলায়ও একই কথা; মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা এবং বলতে গেলে অবাধ সুযোগ-সুবিধা আছে বলেই
১৭ ঘণ্টা আগে
বিজয়ের মাস চলছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিনটি ছিল গতকাল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন ‘বিজয়’। এদিন বাঙালির আত্মপরিচয় লাভের দিন।
১৭ ঘণ্টা আগে