জাহীদ রেজা নূর
সায়ীদ স্যারকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে একটা পটভূমি বর্ণনার প্রয়োজন আছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কোন পথে আমাদের হৃদয়ে ঢুকলেন, সেটা বলার আগে তাই সে সময়ের কিছু ব্যাপারের ব্যাখ্যা দেওয়া জরুরি। সে চেষ্টাই করছি।
টেলিভিশন নাটকে তাঁর দাপট শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই আল মনসুর, মানে বেলাল ভাই আমাদের মন জয় করে নিয়েছেন। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তাঁর সুতীক্ষ্ণ রসিকতার জন্য পড়ালেখা ভুলে আমরা তাঁদের আড্ডায় যোগ দিতাম। আড্ডাটা বসত ১৯ নং নিউ ইস্কাটনের লাল মেঝের ঘরটায়। কিংবা ডিম্বাকৃতির বারান্দাটায়, যেটাকে শাহীন ভাই নিজের ঘর বানিয়ে নিয়েছিলেন।
তখন সাদাকালো টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলোর জন্য অপেক্ষা করতাম। সপ্তাহে একটিই নাটক হতো, আমরা দেখতাম। একটি সিনেমা হতো। বেশির ভাগ ছবিই ছিল ইংরেজি। বাংলা ছবি দেখাত কালে–ভদ্রে। আর ছিল সিরিয়াল। শুরুতে ডেঞ্জারম্যান, ফিউজিটিভ। এই পথ ধরে হাওয়াই ফাইভ ও, লুসি, ডেনিস দ্য মেনিস, ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়ে স্ট। রোববার ছোটদের জন্য ছিল একটি ইংরেজি হাসির সিরিয়াল। সম্ভবত ডাবল ডেকার ছিল নাম। এর পর ছিল সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, বায়োনিক ওম্যান, ইনক্রেডিবল হাল্ক। নাহ, বলে শেষ করা যাবে না। কোনটার পর কোনটা, সেটাও হয়তো গুলিয়ে ফেলব। তাই আর নাম লেখার দরকার নেই। গানের অনুষ্ঠান হতো। রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতির সঙ্গে হতো লোকগানের অনুষ্ঠান, সে অনুষ্ঠানের নাম ছিল হিজল তমাল। তখনো বুঝতাম না, এই নাম দিয়ে দুটো গাছকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনেক পরে হিজল গাছের সারি দেখেছি। তমাল আর দেখা হয়নি।
সে রকমই কোনো এক দিনে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘সপ্তবর্ণা শুরু হলো। সপ্তবর্ণার উপস্থাপক ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তখনো আমরা জানতাম না, তিনি ঢাকা কলেজের শিক্ষক। জানতাম না, ক্লাসে তাঁর লেকচার শুনতে অন্য বিভাগ থেকেও ছাত্ররা উপচে পড়ে। জানতাম না, একটা ছোট্ট বিষয় নিয়ে তিনি দিনের পর দিন কথা বলতে পারেন এবং তাঁর জাদুকরী ভাষার মোহে পড়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ভুলে যায়, শুধু কণ্ঠনিঃসৃত শব্দাবলির টানেই বারে বারে তাঁর কাছে ফিরে আসে।
আমরা তখন জানতাম, এমন একটি পরিচ্ছন্ন, সৃজনশীল ম্যাগাজিন দেখতে পাব, যা মনকে চাঙা রাখবে সামনের কয়েকটা দিন। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপে–সালাপে বারবার এই অনুষ্ঠান ফিরে ফিরে আসবে।
দুই.
‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’ নিয়ে একদল মানুষ উচ্ছ্বসিত। তাদের জীবনের দিক–নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্র। ‘আলোকিত মানুষ’ গড়ার কারিগর হিসেবে পরিচিত হয়েছেন সায়ীদ স্যার। বইয়ের মধ্যে যে রসের নহর রয়েছে, তাতেই তিনি ভাসাতে চেয়েছেন একটা প্রজন্মকে। কিন্তু আমি কোনো দিন তাঁর এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হইনি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাতায়াত ছিল না আমার। হতে পারে, ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেশের বাইরে পড়াশোনা করেছিলাম বলে সে সময় যেসব ঘটনা ডালপালা মেলেছে, তার ঠিকানা আমার জানা ছিল না। ছোট ভাই তৌহীদের কাছে শুনেছি, কেন্দ্রের সঙ্গে ওদের যুক্ততার কথা। গাণ্ডিব নামের যে ছোট কাগজ প্রকাশিত হতো, তার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাঁদের কথাও ওর মুখেই শুনেছি। আর ছিলেন রিটন ভাই (লুৎফর রহমান রিটন), আমীরুল ভাই (আমীরুল ইসলাম), আর মাযহার ভাই (আহমদ মাযহার)। তাঁদের মাধ্যমেই বই প্রকাশের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শুরু।
অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে কেন্দ্র থেকে। অন্যান্য প্রকাশনালয়ের তুলনায় কেন্দ্রের বইয়ের দাম কম এখনো। মানও ভালো।
তিন.
যে সময় একতলা ভবনটি ছিল, তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গেছি কোনো না কোনো সভায় যোগ দিতে। তাও খুব বেশি দিন নয়। সেখানে কোনো দিন সায়ীদ স্যারকে দেখিনি। তাঁকে মূলত দেখেছি টেলিভিশন পর্দায়, আর তাঁর বইয়ের মধ্যে। আমি তুলনামূলক সাহিত্যের ক্লাসে মূলত ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। হোমার থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের সাহিত্য পড়েছি। দেশে এসে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ততার কারণে সৃজনশীল সাহিত্যের প্রতি যে আকর্ষণ ছিল, সেটা কাটেনি বটে, কিন্তু তা নিয়ে কাজ খুব একটা এগোয়নি। কিন্তু সাহিত্য পড়ায় ছেদ পড়েনি। আর তা পড়তে পড়তেই আবিষ্কার করেছিলাম, বড় ও উঁচুমানের লেখকদের সঙ্গে মধ্যম মানের লেখকদের কী পার্থক্য।
‘আমাকে দেখো’ বলেই যারা সাহিত্যের জগতে আলোড়ন তুলতে চান, তাঁদেরও নানা প্ল্যাটফর্ম থাকে এবং সেখানে পরস্পর পিঠ চুলকানির মাধ্যমে তাঁরা একে অন্যকে ‘বিশ্বসেরা’ আখ্যা দিতে থাকেন। সে রকমই একটা সাহিত্য–আবহ দেখে অবাক হয়েছি। নানা ঘরানায় বিভক্ত দুর্বল সাহিত্যিকেরাও গর্জেছে অনেক, বর্ষেনি বেশি। এগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে, আলোকিত মানুষ হতে হলে যে সৃজন ও মননশীল মন দরকার, তার চাষবাস না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই পয়দা হয়েছে আগাছা। আর সেই আগাছাতে অগ্রাহ্য করেও গড়ে উঠেছে শক্তিমান লেখকেরা।
আলোকিত মানুষ কি সবাই হয়ে উঠছে? সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে স্যারের কাছেই। তাঁরই একটা উক্তি এখানে উল্লেখ করা যায়। খায়রুল আলম সবুজের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে না, কথাটার মানে একটাই: আলো সে হয়তো কিছুটা পেয়েছে, কিন্তু আগুনটা পায়নি। আসলে তার ভিতরটা জ্বলছে না। অল্প আলো যা সে পেয়েছে, সেটা চাঁদের আলোর মতোই প্রতিফলিত আলো। নিজের নয়। সত্যিকার আলোকিত মানুষ কিন্তু তা নয়। আলো তো আসে আগুন থেকে। নিজের আগুনে আলোকিত মানুষ জ্বলে ছাই হয় বলেই না তার আলো অমন অপরূপ হয়ে ফুটে ওঠে। নিজেকে নিষ্ঠুরভাবে দগ্ধ করতে না পারলে ওটা মেলে না।’ (সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৩)।
চার.
সায়ীদ স্যার ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে জনপ্রিয় উপস্থাপকদের অন্যতম। এর পর ফজলে লোহানীও খানিকটা ভিন্নধারার ম্যাগাজিনের মাধ্যমে দর্শকদের মন কেড়ে নেন। এর পর হানিফ সংকেত, আনিসুল হক, আবদুন নূর তুষার প্রমুখ উপস্থাপনায় ভালো করেছেন।
সায়ীদ স্যারকে আলাদা করা যেত তাঁর ভাবনার উচ্চমনতা দিয়ে। এ কথা সত্য, যেকোনো সরকারি অফিসের মতোই বিটিভি শ্লথ। সৃজনশীলতার শত্রু। সেই বিরোধিতার মধ্যেই একের পর এক উচ্চমানের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করা চাট্টিখানি কথা ছিল না। সায়ীদ স্যার সে পরীক্ষায় উতরে গেছেন।
এখানে একটা প্রসঙ্গ আনব, যার সঙ্গে কেউ কেউ হয়তো একমত হবেন না। আজ যদি সায়ীদ স্যার তাঁর সেই সপ্তবর্ণা নিয়ে আবার টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেন, তাহলে তিনি দর্শকপ্রিয় হতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না। কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, দর্শক রুচি নেমে গেছে অনেকটা। হাসানোর জন্য ভাঁড়ামি আমদানি হয়েছে অনেক আগেই। সায়ীদ স্যারের সূক্ষ্ম রসবোধ এখন নতুন ধরনের নানা রকম স্থূলতার কাছে মার খেয়ে যাবে। কী জানি, ঠিক বললাম কিনা।
পাঁচ.
সায়ীদ স্যারের কোনো কোনো লেখা পড়ে পড়াশোনার অর্থ নিয়ে আবার ভাবতে হয়। চারদিকে যখন কেজো মানুষের ভিড়, তখন অকাজে বা বিনা কাজে জীবনের সুখ লাভ করার মতো পরিবেশ কি আছে? আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সে রকমই একটা জীবনের স্বপ্ন দেখেন এবং দেখান। সবাই তাঁর কথা বোঝে, এমন নয়।
তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ বহুবার এনেছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার মধ্যে বিনা কাজের প্রাবল্য দেখে খুশি হয়েছেন। সৌন্দর্যতত্ত্বের ‘অপ্রয়োজনীয়’র সাফাই তিনিও গেয়েছেন। আর হ্যাঁ, বস্তু–সর্বস্বতার প্রতি বেশি মনোযোগ যে মানুষের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত করে, সেটাও তিনি বলেছেন।
এ রকম কথা আমরা মুস্তাফা মনোয়ারের কাছেও শুনেছি। তিনি যখন নন্দনতত্ত্বের ক্লাস নিতেন, তখন প্রায় একই রকম কথা বলতেন। ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানি, দেব খোঁপায় তারার ফুল’ বলে বলতেন, তারার ফুল সে পাবে কোথায়? কবি তো বাড়িয়ে বলছেন। কোনো দিনই তিনি তারার ফুল এনে প্রিয়াকে দিতে পারবেন না। কিন্তু এই বাড়িয়ে বলার মধ্যেই থাকে সৌন্দর্য। সত্যিকারের ধরাছোঁয়ার মধ্যে ওই তারাটি থাকলে তা আর এত আকর্ষণীয় হতো না।
ছয়.
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ বইটি নিয়ে তাঁর একটা বক্তৃতা পড়েছিলাম। সেখানেও তিনি ‘অপ্রয়োজনের’ জয়গান গেয়েছিলেন। অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকা তৈরি করেছিলেন, যা দরকারি নয়। যেমন চিত্রকর্ম, যেমন মহাকাব্য, যেমন নৃত্যকলা। কিন্তু এইগুলো কিছুই জাগতিক চাহিদা মেটায় না। কিন্তু তা জগৎ ও মানুষকে সুন্দর ও লাবণ্যময় করেছে। এসব মানুষের স্বপ্ন আর গৌরবকে পৌঁছে দেয় এক উচ্চ স্থানে।
সান্তিয়াগোর অহংকার ছিল ওই বিশাল মাছটি শিকার করা। তাতে সে সফল হয়েছে। শুধু মাছের কঙ্কালটাই এসেছে, মাছ নয়, তাতে কিছু যায় আসে না। দীর্ঘ চুরাশি দিন সমুদ্রে ছিল সে, লড়াই করেছে এবং সে অপরাজিত—এটাই যথেষ্ট। এখানেই তাঁর বিজয়।
সায়ীদ স্যারের দিকে তাকালেও মনে হয়, তাঁর বিজয়ও সেখানেই। মানুষের এবং নিজের জীবনকে সুন্দর আর লাবণ্যময় করে তোলার পথেই তিনি পা বাড়িয়েছেন। চলছেন সে পথেই।
সাত.
প্রথম আলোর সম্পাদকের ঘরে একদিন দীর্ঘক্ষণ তাঁর কথা শুনেছিলাম। অনুবাদে আমার আগ্রহ আছে শুনে একদিন তিনি ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, কয়েকটি বই অনুবাদ করে দিতে পারব কিনা। তখন পত্রিকার চাকরিকে মনে করতাম জীবন। এর বাইরে সময় কোথায় সময় নষ্ট করবার? তাই কাজটা করিনি। এখন আফসোস হয়। স্যারের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা হারিয়েছি।
শুরুতে আল মনসুর বা বেলাল ভাইয়ের প্রসঙ্গ এমনিতে আনিনি। যেদিন জানতে পারলাম, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বেলাল ভাইয়ের অগ্রজ, সেদিন থেকেই বেলাল ভাই আরও অনেক বড় মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন আমাদের কাছে। কোনো এক টেলিভিশন চ্যানেলে দুই ভাইয়ের কথোপকথন, আড্ডা দেখেছিলাম। তাতে বড় ভাইয়ের প্রতি ছোট ভাইয়ের সম্মান ও ভক্তির যে প্রকাশ দেখেছি, তাতে বড় ভাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছোট ভাইও এক ‘অপ্রয়োজনীয়’ সম্মান অর্জন করেছেন। অন্তত আমার কাছে।
সায়ীদ স্যার আলোর দিশারি হতে চেয়েছেন। সবাই হয়তো তাঁর কাছ থেকে আগুন নিয়ে নিজের আগুনে নিজে জ্বলতে পারেনি, কিন্তু তাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, সে কথা বলার উপায় নেই। কারণ, তিনি তো তাঁর কাজটাই করে গেছেন। যারা আগুন নিয়েছে, তাঁরা আগুন জ্বালিয়ে না রেখে কেরানি হওয়ার মধ্যে, ক্ষমতাবান হওয়ার মধ্যে জীবনের মাধুর্য আবিষ্কার করলে তাতে স্যারের কী যায়–আসে? সেই গুটিকয় কেরানি ছাড়া অন্যরা তো পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হওয়ারই চেষ্টা করেছেন—সেটা কি কম কিছু?
সায়ীদ স্যারকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে একটা পটভূমি বর্ণনার প্রয়োজন আছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কোন পথে আমাদের হৃদয়ে ঢুকলেন, সেটা বলার আগে তাই সে সময়ের কিছু ব্যাপারের ব্যাখ্যা দেওয়া জরুরি। সে চেষ্টাই করছি।
টেলিভিশন নাটকে তাঁর দাপট শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই আল মনসুর, মানে বেলাল ভাই আমাদের মন জয় করে নিয়েছেন। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তাঁর সুতীক্ষ্ণ রসিকতার জন্য পড়ালেখা ভুলে আমরা তাঁদের আড্ডায় যোগ দিতাম। আড্ডাটা বসত ১৯ নং নিউ ইস্কাটনের লাল মেঝের ঘরটায়। কিংবা ডিম্বাকৃতির বারান্দাটায়, যেটাকে শাহীন ভাই নিজের ঘর বানিয়ে নিয়েছিলেন।
তখন সাদাকালো টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলোর জন্য অপেক্ষা করতাম। সপ্তাহে একটিই নাটক হতো, আমরা দেখতাম। একটি সিনেমা হতো। বেশির ভাগ ছবিই ছিল ইংরেজি। বাংলা ছবি দেখাত কালে–ভদ্রে। আর ছিল সিরিয়াল। শুরুতে ডেঞ্জারম্যান, ফিউজিটিভ। এই পথ ধরে হাওয়াই ফাইভ ও, লুসি, ডেনিস দ্য মেনিস, ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়ে স্ট। রোববার ছোটদের জন্য ছিল একটি ইংরেজি হাসির সিরিয়াল। সম্ভবত ডাবল ডেকার ছিল নাম। এর পর ছিল সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, বায়োনিক ওম্যান, ইনক্রেডিবল হাল্ক। নাহ, বলে শেষ করা যাবে না। কোনটার পর কোনটা, সেটাও হয়তো গুলিয়ে ফেলব। তাই আর নাম লেখার দরকার নেই। গানের অনুষ্ঠান হতো। রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতির সঙ্গে হতো লোকগানের অনুষ্ঠান, সে অনুষ্ঠানের নাম ছিল হিজল তমাল। তখনো বুঝতাম না, এই নাম দিয়ে দুটো গাছকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনেক পরে হিজল গাছের সারি দেখেছি। তমাল আর দেখা হয়নি।
সে রকমই কোনো এক দিনে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘সপ্তবর্ণা শুরু হলো। সপ্তবর্ণার উপস্থাপক ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তখনো আমরা জানতাম না, তিনি ঢাকা কলেজের শিক্ষক। জানতাম না, ক্লাসে তাঁর লেকচার শুনতে অন্য বিভাগ থেকেও ছাত্ররা উপচে পড়ে। জানতাম না, একটা ছোট্ট বিষয় নিয়ে তিনি দিনের পর দিন কথা বলতে পারেন এবং তাঁর জাদুকরী ভাষার মোহে পড়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ভুলে যায়, শুধু কণ্ঠনিঃসৃত শব্দাবলির টানেই বারে বারে তাঁর কাছে ফিরে আসে।
আমরা তখন জানতাম, এমন একটি পরিচ্ছন্ন, সৃজনশীল ম্যাগাজিন দেখতে পাব, যা মনকে চাঙা রাখবে সামনের কয়েকটা দিন। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপে–সালাপে বারবার এই অনুষ্ঠান ফিরে ফিরে আসবে।
দুই.
‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’ নিয়ে একদল মানুষ উচ্ছ্বসিত। তাদের জীবনের দিক–নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্র। ‘আলোকিত মানুষ’ গড়ার কারিগর হিসেবে পরিচিত হয়েছেন সায়ীদ স্যার। বইয়ের মধ্যে যে রসের নহর রয়েছে, তাতেই তিনি ভাসাতে চেয়েছেন একটা প্রজন্মকে। কিন্তু আমি কোনো দিন তাঁর এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হইনি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাতায়াত ছিল না আমার। হতে পারে, ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেশের বাইরে পড়াশোনা করেছিলাম বলে সে সময় যেসব ঘটনা ডালপালা মেলেছে, তার ঠিকানা আমার জানা ছিল না। ছোট ভাই তৌহীদের কাছে শুনেছি, কেন্দ্রের সঙ্গে ওদের যুক্ততার কথা। গাণ্ডিব নামের যে ছোট কাগজ প্রকাশিত হতো, তার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাঁদের কথাও ওর মুখেই শুনেছি। আর ছিলেন রিটন ভাই (লুৎফর রহমান রিটন), আমীরুল ভাই (আমীরুল ইসলাম), আর মাযহার ভাই (আহমদ মাযহার)। তাঁদের মাধ্যমেই বই প্রকাশের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শুরু।
অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে কেন্দ্র থেকে। অন্যান্য প্রকাশনালয়ের তুলনায় কেন্দ্রের বইয়ের দাম কম এখনো। মানও ভালো।
তিন.
যে সময় একতলা ভবনটি ছিল, তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গেছি কোনো না কোনো সভায় যোগ দিতে। তাও খুব বেশি দিন নয়। সেখানে কোনো দিন সায়ীদ স্যারকে দেখিনি। তাঁকে মূলত দেখেছি টেলিভিশন পর্দায়, আর তাঁর বইয়ের মধ্যে। আমি তুলনামূলক সাহিত্যের ক্লাসে মূলত ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। হোমার থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের সাহিত্য পড়েছি। দেশে এসে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ততার কারণে সৃজনশীল সাহিত্যের প্রতি যে আকর্ষণ ছিল, সেটা কাটেনি বটে, কিন্তু তা নিয়ে কাজ খুব একটা এগোয়নি। কিন্তু সাহিত্য পড়ায় ছেদ পড়েনি। আর তা পড়তে পড়তেই আবিষ্কার করেছিলাম, বড় ও উঁচুমানের লেখকদের সঙ্গে মধ্যম মানের লেখকদের কী পার্থক্য।
‘আমাকে দেখো’ বলেই যারা সাহিত্যের জগতে আলোড়ন তুলতে চান, তাঁদেরও নানা প্ল্যাটফর্ম থাকে এবং সেখানে পরস্পর পিঠ চুলকানির মাধ্যমে তাঁরা একে অন্যকে ‘বিশ্বসেরা’ আখ্যা দিতে থাকেন। সে রকমই একটা সাহিত্য–আবহ দেখে অবাক হয়েছি। নানা ঘরানায় বিভক্ত দুর্বল সাহিত্যিকেরাও গর্জেছে অনেক, বর্ষেনি বেশি। এগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে, আলোকিত মানুষ হতে হলে যে সৃজন ও মননশীল মন দরকার, তার চাষবাস না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই পয়দা হয়েছে আগাছা। আর সেই আগাছাতে অগ্রাহ্য করেও গড়ে উঠেছে শক্তিমান লেখকেরা।
আলোকিত মানুষ কি সবাই হয়ে উঠছে? সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে স্যারের কাছেই। তাঁরই একটা উক্তি এখানে উল্লেখ করা যায়। খায়রুল আলম সবুজের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে না, কথাটার মানে একটাই: আলো সে হয়তো কিছুটা পেয়েছে, কিন্তু আগুনটা পায়নি। আসলে তার ভিতরটা জ্বলছে না। অল্প আলো যা সে পেয়েছে, সেটা চাঁদের আলোর মতোই প্রতিফলিত আলো। নিজের নয়। সত্যিকার আলোকিত মানুষ কিন্তু তা নয়। আলো তো আসে আগুন থেকে। নিজের আগুনে আলোকিত মানুষ জ্বলে ছাই হয় বলেই না তার আলো অমন অপরূপ হয়ে ফুটে ওঠে। নিজেকে নিষ্ঠুরভাবে দগ্ধ করতে না পারলে ওটা মেলে না।’ (সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৩)।
চার.
সায়ীদ স্যার ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে জনপ্রিয় উপস্থাপকদের অন্যতম। এর পর ফজলে লোহানীও খানিকটা ভিন্নধারার ম্যাগাজিনের মাধ্যমে দর্শকদের মন কেড়ে নেন। এর পর হানিফ সংকেত, আনিসুল হক, আবদুন নূর তুষার প্রমুখ উপস্থাপনায় ভালো করেছেন।
সায়ীদ স্যারকে আলাদা করা যেত তাঁর ভাবনার উচ্চমনতা দিয়ে। এ কথা সত্য, যেকোনো সরকারি অফিসের মতোই বিটিভি শ্লথ। সৃজনশীলতার শত্রু। সেই বিরোধিতার মধ্যেই একের পর এক উচ্চমানের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করা চাট্টিখানি কথা ছিল না। সায়ীদ স্যার সে পরীক্ষায় উতরে গেছেন।
এখানে একটা প্রসঙ্গ আনব, যার সঙ্গে কেউ কেউ হয়তো একমত হবেন না। আজ যদি সায়ীদ স্যার তাঁর সেই সপ্তবর্ণা নিয়ে আবার টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেন, তাহলে তিনি দর্শকপ্রিয় হতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না। কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, দর্শক রুচি নেমে গেছে অনেকটা। হাসানোর জন্য ভাঁড়ামি আমদানি হয়েছে অনেক আগেই। সায়ীদ স্যারের সূক্ষ্ম রসবোধ এখন নতুন ধরনের নানা রকম স্থূলতার কাছে মার খেয়ে যাবে। কী জানি, ঠিক বললাম কিনা।
পাঁচ.
সায়ীদ স্যারের কোনো কোনো লেখা পড়ে পড়াশোনার অর্থ নিয়ে আবার ভাবতে হয়। চারদিকে যখন কেজো মানুষের ভিড়, তখন অকাজে বা বিনা কাজে জীবনের সুখ লাভ করার মতো পরিবেশ কি আছে? আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সে রকমই একটা জীবনের স্বপ্ন দেখেন এবং দেখান। সবাই তাঁর কথা বোঝে, এমন নয়।
তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ বহুবার এনেছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার মধ্যে বিনা কাজের প্রাবল্য দেখে খুশি হয়েছেন। সৌন্দর্যতত্ত্বের ‘অপ্রয়োজনীয়’র সাফাই তিনিও গেয়েছেন। আর হ্যাঁ, বস্তু–সর্বস্বতার প্রতি বেশি মনোযোগ যে মানুষের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত করে, সেটাও তিনি বলেছেন।
এ রকম কথা আমরা মুস্তাফা মনোয়ারের কাছেও শুনেছি। তিনি যখন নন্দনতত্ত্বের ক্লাস নিতেন, তখন প্রায় একই রকম কথা বলতেন। ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানি, দেব খোঁপায় তারার ফুল’ বলে বলতেন, তারার ফুল সে পাবে কোথায়? কবি তো বাড়িয়ে বলছেন। কোনো দিনই তিনি তারার ফুল এনে প্রিয়াকে দিতে পারবেন না। কিন্তু এই বাড়িয়ে বলার মধ্যেই থাকে সৌন্দর্য। সত্যিকারের ধরাছোঁয়ার মধ্যে ওই তারাটি থাকলে তা আর এত আকর্ষণীয় হতো না।
ছয়.
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ বইটি নিয়ে তাঁর একটা বক্তৃতা পড়েছিলাম। সেখানেও তিনি ‘অপ্রয়োজনের’ জয়গান গেয়েছিলেন। অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকা তৈরি করেছিলেন, যা দরকারি নয়। যেমন চিত্রকর্ম, যেমন মহাকাব্য, যেমন নৃত্যকলা। কিন্তু এইগুলো কিছুই জাগতিক চাহিদা মেটায় না। কিন্তু তা জগৎ ও মানুষকে সুন্দর ও লাবণ্যময় করেছে। এসব মানুষের স্বপ্ন আর গৌরবকে পৌঁছে দেয় এক উচ্চ স্থানে।
সান্তিয়াগোর অহংকার ছিল ওই বিশাল মাছটি শিকার করা। তাতে সে সফল হয়েছে। শুধু মাছের কঙ্কালটাই এসেছে, মাছ নয়, তাতে কিছু যায় আসে না। দীর্ঘ চুরাশি দিন সমুদ্রে ছিল সে, লড়াই করেছে এবং সে অপরাজিত—এটাই যথেষ্ট। এখানেই তাঁর বিজয়।
সায়ীদ স্যারের দিকে তাকালেও মনে হয়, তাঁর বিজয়ও সেখানেই। মানুষের এবং নিজের জীবনকে সুন্দর আর লাবণ্যময় করে তোলার পথেই তিনি পা বাড়িয়েছেন। চলছেন সে পথেই।
সাত.
প্রথম আলোর সম্পাদকের ঘরে একদিন দীর্ঘক্ষণ তাঁর কথা শুনেছিলাম। অনুবাদে আমার আগ্রহ আছে শুনে একদিন তিনি ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, কয়েকটি বই অনুবাদ করে দিতে পারব কিনা। তখন পত্রিকার চাকরিকে মনে করতাম জীবন। এর বাইরে সময় কোথায় সময় নষ্ট করবার? তাই কাজটা করিনি। এখন আফসোস হয়। স্যারের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা হারিয়েছি।
শুরুতে আল মনসুর বা বেলাল ভাইয়ের প্রসঙ্গ এমনিতে আনিনি। যেদিন জানতে পারলাম, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বেলাল ভাইয়ের অগ্রজ, সেদিন থেকেই বেলাল ভাই আরও অনেক বড় মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন আমাদের কাছে। কোনো এক টেলিভিশন চ্যানেলে দুই ভাইয়ের কথোপকথন, আড্ডা দেখেছিলাম। তাতে বড় ভাইয়ের প্রতি ছোট ভাইয়ের সম্মান ও ভক্তির যে প্রকাশ দেখেছি, তাতে বড় ভাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছোট ভাইও এক ‘অপ্রয়োজনীয়’ সম্মান অর্জন করেছেন। অন্তত আমার কাছে।
সায়ীদ স্যার আলোর দিশারি হতে চেয়েছেন। সবাই হয়তো তাঁর কাছ থেকে আগুন নিয়ে নিজের আগুনে নিজে জ্বলতে পারেনি, কিন্তু তাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, সে কথা বলার উপায় নেই। কারণ, তিনি তো তাঁর কাজটাই করে গেছেন। যারা আগুন নিয়েছে, তাঁরা আগুন জ্বালিয়ে না রেখে কেরানি হওয়ার মধ্যে, ক্ষমতাবান হওয়ার মধ্যে জীবনের মাধুর্য আবিষ্কার করলে তাতে স্যারের কী যায়–আসে? সেই গুটিকয় কেরানি ছাড়া অন্যরা তো পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হওয়ারই চেষ্টা করেছেন—সেটা কি কম কিছু?
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে কি পারবে না, তাদেরকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে কি হবে না—এ নিয়ে গরম এখন রাজনীতির মাঠ। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক হিসেবে দাবিদার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি তো আরও একধাপ বেশি। আওয়ামী লীগকে কেবল নির্বাচনের বাইরে রাখাই নয়, দাবি তাদের দেশের প্রাচী
৪ ঘণ্টা আগেহুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওনের ছেলে নিষাদ হুমায়ূনের একটা ভাইরাল ভিডিও ক্লিপ দেখলাম। বেশ মজা পেলাম। সত্যি বললে মজার চেয়েও ছোট্ট বাচ্চার কথায় ভাবনার উদ্রেক হলো। চিন্তার দুয়ার উন্মুক্ত হলো।
৪ ঘণ্টা আগেপরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে সার্কুলার অর্থনীতি বা বৃত্তাকার অর্থনীতি এক নবদিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। বাংলাদেশে স্বল্প সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে সার্কুলার অর্থনীতির বিকল্প নেই।
৪ ঘণ্টা আগেবগুড়ার শিবগঞ্জে ৪২০ টাকা কেজি দরে নতুন আলু বিক্রি হয়েছে। আজকের পত্রিকায় খবরটি দেখা গেছে ১৮ নভেম্বর। এই দামে বেচাকেনাও হচ্ছে। ক্রেতারাও নাকি এই দামে আলু কিনতে পেরে সন্তুষ্ট!
৫ ঘণ্টা আগে