Ajker Patrika

কুলুঙ্গি

রাজীব কুমার সাহা
কুলুঙ্গি

আমাদের আবহমান গ্রামীণ ঐতিহ্যে একটি অতিপরিচিত শব্দ হলো কুলুঙ্গি। শব্দটি শুনলে মনের অজান্তেই চোখে ভাসতে থাকে চিরচেনা গ্রামবাংলা, আমাদের গ্রামীণ ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। আমাদের গ্রামীণ জনপদের নিত্যব্যবহার্য একটি শব্দ হলো কুলুঙ্গি। আমরা কি জানি বাংলা ভাষায় শব্দটি কীভাবে প্রবেশ করল?

কীভাবে কুলুঙ্গি শব্দটি শৈশবের সব স্মৃতির আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল? তবে চলুন আজ জানব কুলুঙ্গি শব্দের ইতিবৃত্ত।

কুলুঙ্গি দেশি শব্দ। এর অর্থ হলো জিনিসপত্র রাখার জন্য দেয়াল কেটে নির্মিত ছোট খোপবিশেষ। কুল শব্দের একটি অর্থ হলো আবাস। এই কুল শব্দ থেকেই ক্রম বিবর্তনের ধারায় কুলুঙ্গি শব্দটি জাত। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘কুলুঙ্গি বা কুলুঙ্গী হলো দেওয়ালে কৃত ত্রিভুজাকৃতি গর্ত।’ মহাভারতে আছে, ‘লোহার দেওয়ালময়, চারিভিতে কাটিল কুলুঙ্গী।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস এবং ‘চিঠিপত্র ৫’ প্রবন্ধে আমরা কুলুঙ্গি শব্দের প্রয়োগ দেখতে পাই। সংসদ সমার্থক শব্দকোষে কুলুঙ্গির সমার্থক শব্দ দেওয়া হয়েছে আলমারি, দেয়াল আলমারি, খোপ, কোলাঙ্গ, কুলঙ্গি প্রভৃতি। বাঙালি বাড়ির তুলসীবেদিতে প্রদীপ জ্বালানোর জন্য যে খোপের মতো জায়গা তৈরি করা হয়, মূলত সে রকম নকশা থেকেই কুলুঙ্গি তৈরির ভাবনা সঞ্চরণশীল।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ‘মনসামঙ্গল’ খ্যাত দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতী (বাংলা ভাষার প্রথম নারী কবি) ষোড়শ শতকের শেষে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজকাপন ইউনিয়নের ফুলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত যে অষ্টকোনাকৃতি শিবমন্দিরে বসে ‘রামায়ণ’ লেখা শুরু করেন, সে মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর যে বিবরণ তিনি দিয়েছেন তাতে কুলুঙ্গির আকর্ষণীয় বর্ণনা পাওয়া যায়। নিচের ধাপের চারদিকে অর্ধবৃত্তাকার খিলানের সাহায্যে নির্মিত প্রশস্ত কুলুঙ্গি এবং ভেতরে সাতটি জানালাসদৃশ কুলুঙ্গি রয়েছে। একদা দ্বিতীয় ধাপে প্রশস্ত কুলুঙ্গির ভেতরে পোড়ামাটির অসংখ্য চিত্রফলকের অলংকরণ ছিল। কুলুঙ্গির বৃত্তান্ত নিয়ে বলতে গেলে বিশেষ করে বলতে হবে মাটির বাড়ির কুলুঙ্গির কথা। ভারতের মুর্শিদাবাদের জগৎ শেঠের বাড়ি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের সেই সময়ের কুলুঙ্গি সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছে। সে সময়ের আধুনিক নকশার উদাহরণ হলো জগৎ শেঠের বাড়ি। তবে চিরাচরিত বাঙালিবাড়ির কুলুঙ্গির মতো নয়। প্রচলিত পুরোনো দিনের কুলুঙ্গিগুলোর নকশায় ছাপ থাকে। কিন্তু জগৎ শেঠের বাড়িতে তা নেই। বরং এখানকার কুলুঙ্গিগুলোর নকশা স্ট্রেট লাইনের। দেখতেও নান্দনিক।

আগের দিনে মাটির বাড়ির দেয়ালে কুলুঙ্গি থাকত। তবে সে সময়ে শুধু সাজিয়ে তোলার জন্য নয়, দরকারি জিনিসপত্রও রাখা হতো কুলুঙ্গিতে। দিন পাল্টে গিয়ে পাকা বাড়ি হলো ধীরে ধীরে। কিন্তু কুলুঙ্গির ভাবনা গেল না। প্রথম প্রথম নানান দরকারি জিনিস রাখতে কুলুঙ্গি ব্যবহার হতে শুরু করে, পরে আস্তে আস্তে নানানভাবে সাজিয়ে তোলা হতে থাকে। পুরোনো আমল থেকে বাংলায় মাটির বাড়ি ছিল, তখন থেকেই মাটির দেয়ালের মধ্যেও এই কুলুঙ্গির চল ছিল। মাটির দেয়ালগুলো ছিল বেশ চওড়া। কখনো কখনো ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত হতো। সেই চওড়া দেয়ালের কিছুটা কেটে কুলুঙ্গি বানিয়ে নেওয়া হতো। কুলুঙ্গির মধ্যে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সবকিছুই রাখা হতো। গ্রামাঞ্চলে কুলুঙ্গির ধার ঘিরে কী সুন্দর লতাপাতা আলপনা করা হতো! কখনো মাটির স্থায়ী আলপনা করা থাকত। পুজোর সময় গোবর আর মাটি দিয়ে নিকিয়ে পিটুলিগোলা আর তেল দিয়ে গোলা সিঁদুর বুলিয়ে অলংকরণ করা হতো।

বর্তমানে ঘরের অন্দরসজ্জায় কোথাও কোথাও কুলুঙ্গির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। দেয়ালের মধ্যে ছোট কোনো খোপ, পিলারকে ঢেকে দেওয়ার জন্য ফল্স প্লাইয়ের প্যানেলিং কিংবা ডেকোরেশনের জন্য দেয়ালের কিছুটা কেটে কুলুঙ্গি বানিয়ে নেওয়া হয়। তারপর তার ভেতরে স্থাপন করা হয় আধুনিক আলোকসজ্জা। এটি নিঃসন্দেহে ঘরের নান্দনিক সজ্জা বাড়িয়ে তুলছে।

যাপিত জীবনের নাগরিক সভ্যতায় কুলুঙ্গি তার চিরাচরিত ঐতিহ্য হারিয়েছে। নতুন নতুন আসবাবপত্রের পাশে বেমানান মনে করে আজকাল পাকা বাড়িতে আক্ষরিক অর্থে গ্রামীণ যে কুলুঙ্গি, সেটি আর দেখা যায় না। দেয়াল আলমারি, শোকেস আর কাপবোর্ডের পাশে নিতান্ত দরিদ্র কুলুঙ্গি সত্যিই বড় বেমানান। তবে প্রায়োগিক অর্থের নিরিখে কুলুঙ্গি শব্দটি আমাদের হৃদয়পটে শৈশবের স্মৃতিমেদুরতায় পরম যত্নে গচ্ছিত রয়েছে।

লেখক: আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করে যা বলল ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

দুই মামলা থেকে মির্জা আব্বাস-আমান-গয়েশ্বরসহ ৪৫ জনকে অব্যাহতি

হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, হেলমেট ও ভুয়া নম্বরপ্লেট উদ্ধার

বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব

মেসিকে ১৫ কোটি টাকার ঘড়ি উপহার দিলেন আম্বানি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ