বিভুরঞ্জন সরকার
দত্তবাড়ির পর বোদার চন্দবাড়ির কথা না লিখলে চলে না। দত্তবাড়ির মতো চন্দবাড়িতেও আছে আমার সহপাঠী ও বন্ধু। আবার দত্ত ও চন্দবাড়ির মধ্যেও আছে পারস্পরিক আত্মীয়তার সম্পর্ক।
বোদার থানাপাড়া এখন অনেক বড়। অনেক বাড়িঘর। আর আমাদের ছোটবেলায় থানা, ওয়াপদা অফিস এবং একদিকে চন্দবাড়ি, অন্যদিকে হকিকুল ডাক্তার সাহেবের বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়িঘর ছিল বলে মনে পড়ে না।
উমেশ চন্দ্র চন্দ ও মন্মথ চন্দ দুই ভাই। উমেশ চন্দের দুই ছেলে সুধীর চন্দ্র চন্দ ও অধীর চন্দ্র চন্দ। উমেশ বাবুকে আমি দেখিনি। তবে মন্মথ বাবুকে দেখেছি। তাঁর বাড়ি অবশ্য থানাপাড়ায় ছিল না। তাঁর বাড়ি বাজার থেকে সিরাজ সরকার সাহেবের বাড়ি যেতে আগে পড়ত। হাতের বাঁয়ে। এখনো আছে সেই বাড়ি। মন্মথ চন্দের মেয়ে ছায়াদিকে বিয়ে করেন দত্তবাড়ির শিবেন দত্ত।
উমেশ চন্দের দুই ছেলের থানাপাড়ার বাসায় আমার ছিল অবাধ যাতায়াত। বড় ছেলে সুধীর চন্দের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। শিবানী চন্দ, কল্যাণী চন্দ (সুনু), সুধাংশু চন্দ (স্বপন), নারায়ণী চন্দ (বেণু), হিমাংশু চন্দ (তপন/তপু) ও প্রবীর চন্দ (নয়ন)। শিবানী চন্দকে আমি দেখিনি। তিনি অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে মামাবাড়িতে একেবারে ছোট থেকেই বড় হয়েছেন। আর দেশে আসেননি। অন্য সবাই বোদায় ছিলেন বা আছেন। এর মধ্যে স্বপনদা অকালপ্রয়াত। সুনুদি, স্বপনদা ও বেণু আমার বড়। তবে বড় হলেও বেণু আর তপু আমার সহপাঠী। পরে সম্ভবত ক্লাস ফাইভ থেকে বেণু আমার ‘জুনিয়র’ হয়ে যায়। আর তপু হয়ে ওঠে আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন। আমি, তপু ও দত্তবাড়ির বিজন—এই তিনজন ছিলাম (দেখা-সাক্ষাৎ কম হলেও এখনো আছি) ‘এক দেহ, এক প্রাণ’। কত কথাই না মনে পড়ছে। একটি ঘটনার কথা না বলে পারছি না। হাইস্কুলে পড়ার সময় আমরা কয়েকজন (এর মধ্যে বিজন, তপু আর আমি কমন) প্রতি বৃহস্পতিবার টিফিনের সময় স্কুল পালিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে যেতাম সিনেমা দেখার জন্য। শুক্রবার নতুন ছবি শুরু হতো, কাজেই বৃহস্পতিবার আমরা বিদায়ী ছবিটা দেখতাম। বলাকা টকিজ নামের সিনেমা হলটির মালিক ছিলেন মির্জা রুহুল আমিন (চখা মিয়া নামে সমধিক পরিচিত)। তিনি ছিলেন বর্তমান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাবা এবং সাবেক সেনাপ্রধান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের শ্বশুর।
স্কুল থেকে পালিয়ে আমরা একত্রিত হতাম সাতখামারে শামসুদ্দিন ডাক্তার সাহেবের ডিসপেনসারিতে। দুপুরবেলা ওটা ফাঁকা থাকত। আমার বাড়ি ছিল তার পাশেই। ওটা ছিল ঠাকুরগাঁওয়ে যাওয়ার সড়কের একেবারে লাগোয়া। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠলে কেউ দেখে ফেলতে পারে—এই আশঙ্কা থেকেই আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে বাসে উঠতাম। প্রবাদ আছে, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়’। একদিন আমাদের শামসুদ্দিন ডাক্তার চাচার ডিসপেনসারিতে জটলারত অবস্থায় দেখতে পান ডা. ফয়জুল করিম, আমাদের মশিয়ারের (মশিয়ার রহমান, এখন পল্লি কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) বাবা। আমরা যে স্কুল পালিয়ে ওখানে সমবেত হয়েছি, সেটা তিনি বুঝতে পারেন। তিনি সম্ভবত রোগী দেখে সাইকেলে চেপে ফিরছিলেন। তিনি নিজে আমাদের কিছু বললেন না। তবে বাজারে গিয়ে তপুর বাবা সুধীর কাকুকে বিষয়টি অবগত করেন। কাকু দ্রুত ছুটে আসেন এবং আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তপুকে পাকড়াও করে পায়ের কাবলি স্যান্ডেল দিয়ে বেদম পেটাতে থাকেন। তপু চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করে বলতে থাকে, ‘দোহাই বাবা, আর মেরো না।’ কাকু কোনো কথা শোনেন না। একপর্যায়ে পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আমাদের সবাইকে শাসিয়ে তিনি চলে যান। আমরা ভাবলাম, অত পিটুনি খেয়ে তপু হয়তো আর সিনেমা দেখতে যাবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে তপু বলল, ‘মার তো খেয়েই ফেলেছি, তাহলে আর সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হব কেন?’
তপু ছিল আমাদের বন্ধুদের মধ্য সবচেয়ে ছোটখাটো। তাই ওকে নিয়ে কত ধরনের কাণ্ডই না আমরা করতাম। সেই তপু, হিমাংশু চন্দ এখন ঠাকুরগাঁওয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রধান নির্বাহী। তপুও খুব সরল মনের সাদাসিধে মানুষ। জীবনে টাকা-পয়সা যেমন উপার্জন করেছে, তেমন খরচও করেছে। ওর বাবা, আমাদের সুধীর কাকুও ছিলেন অত্যন্ত দরাজ দিল মানুষ। আমি তাঁর কাছ থেকে যে স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না।
আমার বন্ধু তপুর বাবা, আমাদের সুধীর কাকু ছিলেন আমার দেখা ‘অসাধারণ’ মানুষদের একজন। দেখতে ছিলেন সুদর্শন। অমন উন্নত নাক, গৌর বর্ণ, মাথা উঁচু করে হাঁটাচলা করা; দেখলেই মনের মধ্যে একটি সমীহ ভাব চলে আসত। তাঁকে আমরা একধরনের ভয়মিশ্রিত সমীহই করতাম। একেবারে ছোটবেলায় এড়িয়ে চলতাম। আস্তে আস্তে যতই তাঁর নৈকট্য লাভ করেছি, ততই মনে হয়েছে তাঁর মনের ভেতরটা কত নরম। পরিণত বয়সেও তিনি ঝুনা নারকেল না হয়ে কচি ডাবের মতোই ছিলেন।
প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। জলপাইগুড়ি জেলায়ও তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা ছোটবেলায়ও তাঁকে বোদা হাইস্কুল মাঠে শৌখিন খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে দেখেছি। সুধীর কাকু, ডা. ফয়জুল চাচারা মাঠে নামলে জমে উঠত খেলা। তরুণদের উৎসাহিত করার জন্যই সে সময় তাঁরা নিয়মিত মাঠে যেতেন।
তপুর মা, মানে আমাদের কাকি মারা যান সম্ভবত ১৯৫৭ সালে। আমি হয়তো তাঁকে দেখিওনি। শুনেছি নয়নের তখন মাত্র দেড় বছর বয়স। তপুর তিন-সাড়ে তিন। কাজেই মায়ের কোনো স্মৃতি ওদের মনে থাকার কথা নয়। ওরা প্রকৃতপক্ষে মাতৃস্নেহে বড় হয়েছে দিদিমার কাছে। দিদিমা সরজুবালা দেবী ছিলেন সুধীর কাকুর মাসিমা। তিনি বাল্যবিধবা। বিয়ের অল্প পরই স্বামীহারা হয়ে সুধীর কাকুর সংসারে স্থায়ী হয়েছিলেন। তপু ও নয়ন এই দিদিমার কোলেপিঠে মানুষ। তাই তিনি ছিলেন ওদের মা, দিদিমা নয়!
এই মহীয়সী নারীকে যাঁরা না দেখেছেন, তাঁরা তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারবেন না। তিনিই কার্যত চন্দবাড়িতে অভিভাবক ছিলেন। তাঁর ছায়া-মায়ায় তপুরা ভাইবোন মানুষ হয়েছে। আরও একজন তপুদের মায়ের অভাব পূরণে বড় ভূমিকা রেখেছেন—তপুদের কাকিমা, অধীর কাকুর স্ত্রী। এই কাকিমার নাম রেখা রানী চন্দ। নিজের তিন মেয়ে ও দুই ছেলেসন্তানের সঙ্গে ভাশুরের সন্তানদেরও তিনি অকৃপণ স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছেন।
সুধীর কাকুর স্ত্রীবিয়োগের পর অনেকে তাঁকে আবার বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন এমন রেওয়াজ ছিল, কিন্তু প্রথম স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসা তাঁকে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণে নিরুৎসাহিত করেছিল। একসময় আমি চন্দবাড়ির সদস্যের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। ওই বাড়ির হাঁড়িতে আমার জন্য দুমুঠো চাল যেন দেওয়াই থাকত। আমি গেলে দিদিমা, কাকিমা কেউ বিরক্ত না হয়ে খুশি হতেন। হাসিমুখেই আমাকে স্বাগত জানাতেন। দিদিমা আর নেই। প্রায় ৯০ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। কাকিমা এখনো সক্রিয় আছেন, সেঞ্চুরি করার অপেক্ষায়।
তপুর কাকাতো বোন রেবা রানী চন্দ; ডাক নাম পুতুল। আমাদের ছোট। দেখতে অনেকটা পুতুলের মতোই ছিল। আমি একটু বড় হওয়ার পর, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই মনে হয়, কেউ কেউ পুতুলের সঙ্গে আমার বিয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতেন বলে আমি শুনেছি। তবে বিষয়টি জোরালো হয়ে ওঠেনি।
তপুদের ভাইবোনেরা সবাই মুক্ত মনের অধিকারী। তপু আমার বন্ধু। ওর সঙ্গে মাখামাখি সম্পর্ক হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ওর বড় ভাই স্বপনদা এবং ছোট ভাই নয়নের সঙ্গেও গোড়া থেকেই আমার সম্পর্ক অত্যন্ত প্রীতিময়। নয়ন এখন বোদার একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। কলেজে অধ্যাপনা থেকে সম্প্রতি অবসর নিয়ে সংস্কৃতি-সাহিত্য-সমাজ নিয়ে কাজ করেন, লেখালেখি করেন। কবিতা ও গদ্যে সমান পারদর্শী।
এই পরিবারের সঙ্গে আমার অতি ঘনিষ্ঠতার আরেকটি বড় কারণ বোধ হয় এটাই যে, এরা সবাই কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ছিলেন। পার্টির সদস্য না হয়েও এরা ছিলেন পার্টি অন্তপ্রাণ। এ রকম পরিবার বোদায় আরও দু-চারটি ছিল।
চন্দবাড়ির সুধীর চন্দের জন্ম ১৯১৭ সালের কোনো এক বুধবার। ওই বছর পৃথিবীতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। অক্টোবর বিপ্লব বলে পরিচিত সেই বিপ্লবের অভিঘাত তখনই বোদায় গিয়ে পৌঁছানোর কথা নয়। তাই সুধীর চন্দের চেতনায় বিপ্লব আঘাত হানেনি। তবে একধরনের উদার মানবতাবাদী চেতনার বিকাশ তাঁর মধ্যে লক্ষ করা গেছে। তাঁর বাড়ির পরিবেশ যে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন হয়েছিল, সেটা আগে উল্লেখ করেছি। একটি কাকতালীয় ব্যাপার হলো তাঁর জন্ম এবং মৃত্যু একই বারে। বুধবার। ২০০০ সালের এক বুধবার তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। প্রায় ৮৩ বছরের জীবন পেয়েছিলেন তিনি।
সুধীর চন্দ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেছিলেন সম্ভবত ১৯৩৭ সালে। তাঁর সঙ্গে একই বছর প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন বোদা হাইস্কুলের শিক্ষক সেলিমের বাবা সিদ্দিক সাহেব। ম্যাট্রিক পাসের পর সুধীর চন্দ আর পড়াশোনা না করে চাকরিতে ঢোকেন। তিনি অবিভক্ত ভারতেই জুট করপোরেশনে প্রথম চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। বন বিভাগেও নাকি তাঁর চাকরি হয়েছিল। সাপ, মশা ইত্যাদির ভয়ে তিনি সেই চাকরিতে যোগ দেননি।
ব্রিটিশরা ভারত ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত দুই রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ১৯৪৭ সালে বিদায় নেয়। সে সময় সুধীর চন্দ তৎকালীন পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তাঁর চাকরি ন্যস্ত হয় ডিসি কালেক্টরে তহসিল অফিসে, তহসিলদার হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত তিনি ওই চাকরি করেছেন। বোদা ছাড়াও দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড় ও সেতাবগঞ্জে তিনি তহসিলদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি লুথার্ন ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন নামের একটি সাহায্য সংস্থায় চাকরি নেন। পরে এই সংগঠন আরডিআরএস নামে রূপান্তরিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে এই সংস্থা অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিল। তখন ঠাকুরগাঁও কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি বেশ কিছুদিন আরডিআরএসের কনস্ট্রাকশন বিভাগে কাজ করেছে আমার বন্ধু হিমাংশু চন্দ তপন বা তপু। বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিধ্বস্ত ভবন নতুন করে তৈরির কাজ তদারকির দায়িত্ব পালন করেছে তপু। সুধীর কাকু আরডিআরএসের চাকরি করেছেন ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। ফলে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঠাকুরগাঁওয়েই বসবাস করেছেন। বাসা ভাড়া নিয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি থাকতেন। তপু ও নয়ন ঠাকুরগাঁও কলেজে পড়ত। তপু ওই কলেজ থেকে বিএ পাস করেছে আর নয়ন এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। দর্শনশাস্ত্রে মাস্টার্স করে বোদায় ফিরে পাথরাজ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করে। তপু বিয়েশাদি করে ঠাকুরগাঁওয়েই স্থায়ী হয়েছে।
তপুদের ঠাকুরগাঁওয়ের বাসায়ও নানা কারণে আমাকে বহুদিন রাত কাটাতে হয়েছে এবং পাত পাততে হয়েছে। তখন ঢাকায় আসার জন্য আমাকে হয় দিনাজপুর অথবা ঠাকুরগাঁও থেকে গাড়ি ধরতে হতো। পঞ্চগড় থেকে কোনো কোচ ডে কিংবা নাইট তখনো চালু হয়নি। ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়া এবং বাড়ি থেকে ঢাকায় আসার জন্য ঠাকুরগাঁওয়ে আমার রাত্রিকালীন অবস্থান হতো তপুদের বাসায়। রান্নাঘরে একসঙ্গে বসে আমরা চারজন রাতের খাবার খেতাম। সুধীর কাকু পরম মমতায় আমাকে পুত্রবৎ পাশে বসাতেন। আহা, কত প্রীতিময় ছিল সেই দিনগুলো!
আগেই বলেছি, কাকু ছিলেন একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড়। তিনি জলপাইগুড়ি টাউন ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি সাত-আটবার ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ) শিল্ড কাপ খেলেছেন। ট্রফি জিতেছেন। হেড করে গোল করায় তিনি খুব পারদর্শী ছিলেন। তখন মাঝগ্রামের আবদুর রহমান সাহেবও ভালো ফুটবল খেলতেন। তাঁর কর্নার কিক মানেই ছিল অবধারিত গোল। সে জন্যই তখন বলা হতো সুধীর চন্দের হেড আর আব্দুর রহমানের কর্নার কিক ইকুয়াল টু গোল। তিনি রংপুর ও দিনাজপুরে গিয়েও খেলেছেন।
সুধীর কাকু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে অংশ না নিলেও শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের নানা উপায়ে সাহায্য-সহযোগিতায় ছিলেন সদা তৎপর। যেসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী ওপারে গিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য বড় সহায় ছিলেন সুধীর কাকু। কিন্তু কিছু মানুষ যেমন যুদ্ধ শেষের পাওনা বুঝে নেওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন, সুধীর কাকু ছিলেন সেখানে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
চন্দবাড়ির স্বপনদা ছিলেন হাসিখুশি স্বভাবের, একটু যেন আপনভোলা মানুষ। সংসার করেছেন। কিন্তু প্রকৃত সংসারী বলতে যা বোঝায়, তিনি তা ছিলেন কি না, আমার সন্দেহ আছে। মাথার ওপর সুধীর কাকুর মতো বটবৃক্ষসম বাবা থাকলে অমনই বোধ হয় হওয়ার কথা।
স্বপনদা আমার বড়। বন্ধুর বড় ভাই। কিন্তু আমাদের মধ্যে একধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্কই গড়ে উঠেছিল। তিনি আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতেন। রাজনীতি সচেতন ছিলেন। দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তেন।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আমাদের এলাকা থেকে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কামু ভাই, অ্যাডভোকেট কামরুল হোসেন। মনে আছে, ওই নির্বাচনী প্রচারে আমি আর স্বপনদা একসঙ্গে অনেক জায়গায় গিয়েছি। বিভিন্ন গ্রাম বা ইউনিয়নে আমাদের উভয়ের পরিচিতদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেছি। আমি সাইকেল চালাতে পারতাম না। স্বপনদা সাইকেল চালিয়ে আমাকে নিয়ে যেতেন। তখন গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট ভালো ছিল না। আলপথে অনেক কষ্ট করেই আমাদের যেতে হতো। হাসিমুখেই এই কষ্টকর কাজটি স্বপনদা করতেন। আমরা বুঝতে পারতাম, জনমত আমাদের অনুকূলে নয়। তার পরও কিসের আশায়, কিসের নেশায় যে দিনরাত গ্রাম থেকে গ্রামে, বাড়ি থেকে বাড়ি ছুটে বেড়াতাম!
আমি ঢাকায় আসার পর স্বপনদার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। তার পরও ছুটিছাঁটায় বোদায় গেলে স্বপনদা ছুটে আসতেন। কত জিজ্ঞাসা নিয়ে আমার কাছে সেসবের উত্তর জানতে চাইতেন। তাঁর সব কৌতূহল মেটানোর সাধ্য আমার ছিল না। এর মধ্যে একটি দুর্ঘটনায় স্বপনদা একটি পা হারান। তিনি ক্র্যাচে ভর দিয়ে এক পায়ে হাঁটতেন। শেষদিকে সম্ভবত ছাত্র পড়িয়ে উপার্জন করতেন। ২০০৩ সালে স্বপনদার মৃত্যু হয়। তিনি রেখে গেছেন দুই মেয়ে ও এক ছেলেসন্তান। বৌদি তাঁর দেবরদের সহযোগিতায় ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। বড় মেয়ে চৈতালি চন্দ সোমার বর ঝাড়বাড়ি কলেজের অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক। ছোট মেয়ে বিপাশা চন্দ দোলন বরিশালে বিয়ে হলেও এখন সম্ভবত বোদাতেই আছে। ছেলে সৌমিত চন্দ জয়দ্বীপ কৃতী ছাত্র। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ভারতের গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। জয়দ্বীপ জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিল, সভাপতি হয়েছিল। বাম রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ হয়তো এখনো বহাল আছে। গুজরাটে যাওয়ার আগে দৈনিক সমকালে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছে। লেখালেখির হাত ভালো। এর মধ্যেই গবেষণামূলক কিছু গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লিখে সুনাম অর্জন করেছে।
আমার বন্ধু হিমাংশু তপুও একজন সফল মানুষ। ঠাকুরগাঁওয়ে ওর একটি এনজিও আছে। অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। ছাত্রাবস্থাতেই তপু উপার্জনমুখী হয়েছে। প্রথমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, তারপর ঠাকুরগাঁওয়ে একটি কসমেটিকসের দোকান এবং সব শেষে শার্প নামে এনজিও প্রতিষ্ঠা। নানা ধরনের সামাজিক কাজকর্মেও তপু সময় দেয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও ছাত্রাবস্থায় তপুর ভেতরের এত প্রতিভা সম্পর্কে আমরা কিছু আন্দাজ করতে পারিনি। তপুর একমাত্র ছেলে বুদ্ধদেব চন্দ তমাল কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে এসে এখন বগুড়ায় একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছে। তমাল বিয়ে করে এক সন্তানের জনকও হয়েছে। আমার বন্ধু তপু গর্বিত দাদু হিসেবে পরিতৃপ্তি নিয়ে সংসার করছে।
ভাইদের মধ্যে ছোট প্রবীর চন্দ নয়ন। মূলত সে-ই এখন চন্দবাড়ির অভিভাবক। বোদার একজন সচেতন ও সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ। দর্শনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেও সাহিত্যে তাঁর অনুরাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন থেকেই। নিয়মিত কবিতা এবং নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে থাকে। দুটি কবিতার বইও বের হয়েছে। দুটি প্রবন্ধের বই প্রকাশের অপেক্ষায়। তার স্ত্রীও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছেলে শুভ্র প্রতিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে একটি অ্যাড ফার্মে চাকরি করছে। মেয়ে দেবলীনা দৈবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রী।
চন্দবাড়ির মেয়েদের কথা কিছু না বললেই নয়। সুধীর চন্দের বড় মেয়ে জলপাইগুড়িতে থেকেছেন বলে তাঁর সঙ্গে আমার কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দু-তিনবার তিনি বোদায় এসেছেন। আমি তখন বোদা ছেড়েছি। ফলে শিবানী চন্দ আমার অদেখা বড় দিদি। কল্যাণী; অর্থাৎ সুনুদিই হলেন আমাদের দেখা বড় দিদি। কী হাসিখুশি মানুষ সুনুদি! মানুষকে আপন করে নেওয়ার শক্তি যেমন তাঁর আছে, তেমনি আছে প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এগিয়ে চলার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস।
আমাদের ছোটবেলায় সুনুদির বিয়ে হয়। প্রেমের বিয়ে। মধু জামাইবাবুও খুব সুন্দর ছিলেন। সুনুদি তো অবশ্যই সুন্দরী। ভালোই চলছিল সব। সময় গড়িয়ে দুটি ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জনক-জননী হন তাঁরা। তারপর যে কোথা থেকে কী হয়। জামাইবাবুকে আর বোদায় দেখা যায় না। তিনি সংসারত্যাগী হন। কী দুঃসহ মর্মজ্বালা বুকে চেপে সুনুদি তাঁর দুই ছেলে মিহির ও বিজনকে মানুষ করার কাজটি সম্পন্ন করেছেন, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে বোঝা কঠিন। বাবা এবং পরিবারের সহযোগিতা-সমর্থন তিনি পেয়েছেন। কিন্তু আমাদের কুচুটে সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করা যে কত কঠিন, সেটা না বললেও চলে। সুনুদি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর ছোট ছেলে বিজন সরকারও একটি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বড় ছেলে মিহির সরকার একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করত বলে শুনেছিলাম।
চন্দবাড়ির আরেক মেয়ে বেণু ওরফে নারায়ণী চন্দ, আমার বন্ধু এবং মামি। আমার মায়ের কোনো ভাইবোন নেই। তিনি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তবে মায়ের কয়েকজন পাতানো ভাই আছে, যারা আমার মামা। এ রকম একজন হলেন নারায়ণ চন্দ্র সাহা। ঢাকার বিক্রমপুরে বাড়ি। চাকরির সুবাদে বোদায় যান গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তিনি কিছুদিন লজিং থাকতেন আমার পিসার বাসায়; অর্থাৎ কার্তিকদা-জ্যোতিষদাদের বাসায়। তখন অবশ্য পিসেমশাই শরৎ চন্দ্র সরকার জীবিত ছিলেন। যা হোক, ওই বাসায় লজিং থাকার সুবাদেই হয়তো আমার মায়ের ভাই হয়ে যান নারায়ণ সাহা। আমার মামা। এই মামাই বিয়ে করেন চন্দবাড়ির মেয়ে বেণুকে। বন্ধু হেয় গেল মামি। বিয়ের পর নতুন সংসার গোছানোর আগে কিছুদিন তাঁরা আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবারের সঙ্গেও আমার অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একসময় এমনও ছিল যে, ঢাকা থেকে বাড়ি গেলে রাতটা আমি নারায়ণ মামার বাসাতেই কাটাতাম। ততদিনে তাঁদের মেয়ে ও ছেলে বড় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। একটি বিষয় লক্ষণীয়। মামার নাম নারায়ণ আর যাকে বিয়ে করলেন তাঁর নাম নারায়ণী। আমাকে আমার দু-এক বন্ধু তখন ঠাট্টা করে বলত, আমার স্ত্রীর নাম নাকি হবে হয় বিভা, না হয় রঞ্জনা! না, সেটা হয়নি।
বেণুও প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করেছে। ছেলে বাপ্পা ওরফে স্বরূপ সাহা এসএসসি পাস করে কলকাতায় চলে যায়। এমবিএ পাস করে বাপ্পা এখন বেঙ্গালুরুতে আছে বলে শুনেছি। বাপ্পা আমাকে মামা বলে ডাকে। কী অদ্ভুত সামাজিক সম্পর্কগুলো! বেণুর মেয়ে শম্পা কিছুদিন ঢাকায় ছিল। তারপর নাকি আমেরিকায় চলে গেছে। নারায়ণ মামার জীবনাবসান হয়েছে। মামি এখন অবসরজীবন যাপন করছেন।
নটে গাছটি মুড়োল, চন্দবাড়ির গল্প ফুরোল।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দত্তবাড়ির পর বোদার চন্দবাড়ির কথা না লিখলে চলে না। দত্তবাড়ির মতো চন্দবাড়িতেও আছে আমার সহপাঠী ও বন্ধু। আবার দত্ত ও চন্দবাড়ির মধ্যেও আছে পারস্পরিক আত্মীয়তার সম্পর্ক।
বোদার থানাপাড়া এখন অনেক বড়। অনেক বাড়িঘর। আর আমাদের ছোটবেলায় থানা, ওয়াপদা অফিস এবং একদিকে চন্দবাড়ি, অন্যদিকে হকিকুল ডাক্তার সাহেবের বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়িঘর ছিল বলে মনে পড়ে না।
উমেশ চন্দ্র চন্দ ও মন্মথ চন্দ দুই ভাই। উমেশ চন্দের দুই ছেলে সুধীর চন্দ্র চন্দ ও অধীর চন্দ্র চন্দ। উমেশ বাবুকে আমি দেখিনি। তবে মন্মথ বাবুকে দেখেছি। তাঁর বাড়ি অবশ্য থানাপাড়ায় ছিল না। তাঁর বাড়ি বাজার থেকে সিরাজ সরকার সাহেবের বাড়ি যেতে আগে পড়ত। হাতের বাঁয়ে। এখনো আছে সেই বাড়ি। মন্মথ চন্দের মেয়ে ছায়াদিকে বিয়ে করেন দত্তবাড়ির শিবেন দত্ত।
উমেশ চন্দের দুই ছেলের থানাপাড়ার বাসায় আমার ছিল অবাধ যাতায়াত। বড় ছেলে সুধীর চন্দের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। শিবানী চন্দ, কল্যাণী চন্দ (সুনু), সুধাংশু চন্দ (স্বপন), নারায়ণী চন্দ (বেণু), হিমাংশু চন্দ (তপন/তপু) ও প্রবীর চন্দ (নয়ন)। শিবানী চন্দকে আমি দেখিনি। তিনি অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে মামাবাড়িতে একেবারে ছোট থেকেই বড় হয়েছেন। আর দেশে আসেননি। অন্য সবাই বোদায় ছিলেন বা আছেন। এর মধ্যে স্বপনদা অকালপ্রয়াত। সুনুদি, স্বপনদা ও বেণু আমার বড়। তবে বড় হলেও বেণু আর তপু আমার সহপাঠী। পরে সম্ভবত ক্লাস ফাইভ থেকে বেণু আমার ‘জুনিয়র’ হয়ে যায়। আর তপু হয়ে ওঠে আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন। আমি, তপু ও দত্তবাড়ির বিজন—এই তিনজন ছিলাম (দেখা-সাক্ষাৎ কম হলেও এখনো আছি) ‘এক দেহ, এক প্রাণ’। কত কথাই না মনে পড়ছে। একটি ঘটনার কথা না বলে পারছি না। হাইস্কুলে পড়ার সময় আমরা কয়েকজন (এর মধ্যে বিজন, তপু আর আমি কমন) প্রতি বৃহস্পতিবার টিফিনের সময় স্কুল পালিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে যেতাম সিনেমা দেখার জন্য। শুক্রবার নতুন ছবি শুরু হতো, কাজেই বৃহস্পতিবার আমরা বিদায়ী ছবিটা দেখতাম। বলাকা টকিজ নামের সিনেমা হলটির মালিক ছিলেন মির্জা রুহুল আমিন (চখা মিয়া নামে সমধিক পরিচিত)। তিনি ছিলেন বর্তমান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাবা এবং সাবেক সেনাপ্রধান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের শ্বশুর।
স্কুল থেকে পালিয়ে আমরা একত্রিত হতাম সাতখামারে শামসুদ্দিন ডাক্তার সাহেবের ডিসপেনসারিতে। দুপুরবেলা ওটা ফাঁকা থাকত। আমার বাড়ি ছিল তার পাশেই। ওটা ছিল ঠাকুরগাঁওয়ে যাওয়ার সড়কের একেবারে লাগোয়া। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠলে কেউ দেখে ফেলতে পারে—এই আশঙ্কা থেকেই আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে বাসে উঠতাম। প্রবাদ আছে, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়’। একদিন আমাদের শামসুদ্দিন ডাক্তার চাচার ডিসপেনসারিতে জটলারত অবস্থায় দেখতে পান ডা. ফয়জুল করিম, আমাদের মশিয়ারের (মশিয়ার রহমান, এখন পল্লি কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) বাবা। আমরা যে স্কুল পালিয়ে ওখানে সমবেত হয়েছি, সেটা তিনি বুঝতে পারেন। তিনি সম্ভবত রোগী দেখে সাইকেলে চেপে ফিরছিলেন। তিনি নিজে আমাদের কিছু বললেন না। তবে বাজারে গিয়ে তপুর বাবা সুধীর কাকুকে বিষয়টি অবগত করেন। কাকু দ্রুত ছুটে আসেন এবং আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তপুকে পাকড়াও করে পায়ের কাবলি স্যান্ডেল দিয়ে বেদম পেটাতে থাকেন। তপু চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করে বলতে থাকে, ‘দোহাই বাবা, আর মেরো না।’ কাকু কোনো কথা শোনেন না। একপর্যায়ে পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আমাদের সবাইকে শাসিয়ে তিনি চলে যান। আমরা ভাবলাম, অত পিটুনি খেয়ে তপু হয়তো আর সিনেমা দেখতে যাবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে তপু বলল, ‘মার তো খেয়েই ফেলেছি, তাহলে আর সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হব কেন?’
তপু ছিল আমাদের বন্ধুদের মধ্য সবচেয়ে ছোটখাটো। তাই ওকে নিয়ে কত ধরনের কাণ্ডই না আমরা করতাম। সেই তপু, হিমাংশু চন্দ এখন ঠাকুরগাঁওয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রধান নির্বাহী। তপুও খুব সরল মনের সাদাসিধে মানুষ। জীবনে টাকা-পয়সা যেমন উপার্জন করেছে, তেমন খরচও করেছে। ওর বাবা, আমাদের সুধীর কাকুও ছিলেন অত্যন্ত দরাজ দিল মানুষ। আমি তাঁর কাছ থেকে যে স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না।
আমার বন্ধু তপুর বাবা, আমাদের সুধীর কাকু ছিলেন আমার দেখা ‘অসাধারণ’ মানুষদের একজন। দেখতে ছিলেন সুদর্শন। অমন উন্নত নাক, গৌর বর্ণ, মাথা উঁচু করে হাঁটাচলা করা; দেখলেই মনের মধ্যে একটি সমীহ ভাব চলে আসত। তাঁকে আমরা একধরনের ভয়মিশ্রিত সমীহই করতাম। একেবারে ছোটবেলায় এড়িয়ে চলতাম। আস্তে আস্তে যতই তাঁর নৈকট্য লাভ করেছি, ততই মনে হয়েছে তাঁর মনের ভেতরটা কত নরম। পরিণত বয়সেও তিনি ঝুনা নারকেল না হয়ে কচি ডাবের মতোই ছিলেন।
প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। জলপাইগুড়ি জেলায়ও তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা ছোটবেলায়ও তাঁকে বোদা হাইস্কুল মাঠে শৌখিন খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে দেখেছি। সুধীর কাকু, ডা. ফয়জুল চাচারা মাঠে নামলে জমে উঠত খেলা। তরুণদের উৎসাহিত করার জন্যই সে সময় তাঁরা নিয়মিত মাঠে যেতেন।
তপুর মা, মানে আমাদের কাকি মারা যান সম্ভবত ১৯৫৭ সালে। আমি হয়তো তাঁকে দেখিওনি। শুনেছি নয়নের তখন মাত্র দেড় বছর বয়স। তপুর তিন-সাড়ে তিন। কাজেই মায়ের কোনো স্মৃতি ওদের মনে থাকার কথা নয়। ওরা প্রকৃতপক্ষে মাতৃস্নেহে বড় হয়েছে দিদিমার কাছে। দিদিমা সরজুবালা দেবী ছিলেন সুধীর কাকুর মাসিমা। তিনি বাল্যবিধবা। বিয়ের অল্প পরই স্বামীহারা হয়ে সুধীর কাকুর সংসারে স্থায়ী হয়েছিলেন। তপু ও নয়ন এই দিদিমার কোলেপিঠে মানুষ। তাই তিনি ছিলেন ওদের মা, দিদিমা নয়!
এই মহীয়সী নারীকে যাঁরা না দেখেছেন, তাঁরা তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারবেন না। তিনিই কার্যত চন্দবাড়িতে অভিভাবক ছিলেন। তাঁর ছায়া-মায়ায় তপুরা ভাইবোন মানুষ হয়েছে। আরও একজন তপুদের মায়ের অভাব পূরণে বড় ভূমিকা রেখেছেন—তপুদের কাকিমা, অধীর কাকুর স্ত্রী। এই কাকিমার নাম রেখা রানী চন্দ। নিজের তিন মেয়ে ও দুই ছেলেসন্তানের সঙ্গে ভাশুরের সন্তানদেরও তিনি অকৃপণ স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছেন।
সুধীর কাকুর স্ত্রীবিয়োগের পর অনেকে তাঁকে আবার বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন এমন রেওয়াজ ছিল, কিন্তু প্রথম স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসা তাঁকে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণে নিরুৎসাহিত করেছিল। একসময় আমি চন্দবাড়ির সদস্যের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। ওই বাড়ির হাঁড়িতে আমার জন্য দুমুঠো চাল যেন দেওয়াই থাকত। আমি গেলে দিদিমা, কাকিমা কেউ বিরক্ত না হয়ে খুশি হতেন। হাসিমুখেই আমাকে স্বাগত জানাতেন। দিদিমা আর নেই। প্রায় ৯০ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। কাকিমা এখনো সক্রিয় আছেন, সেঞ্চুরি করার অপেক্ষায়।
তপুর কাকাতো বোন রেবা রানী চন্দ; ডাক নাম পুতুল। আমাদের ছোট। দেখতে অনেকটা পুতুলের মতোই ছিল। আমি একটু বড় হওয়ার পর, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই মনে হয়, কেউ কেউ পুতুলের সঙ্গে আমার বিয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতেন বলে আমি শুনেছি। তবে বিষয়টি জোরালো হয়ে ওঠেনি।
তপুদের ভাইবোনেরা সবাই মুক্ত মনের অধিকারী। তপু আমার বন্ধু। ওর সঙ্গে মাখামাখি সম্পর্ক হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ওর বড় ভাই স্বপনদা এবং ছোট ভাই নয়নের সঙ্গেও গোড়া থেকেই আমার সম্পর্ক অত্যন্ত প্রীতিময়। নয়ন এখন বোদার একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। কলেজে অধ্যাপনা থেকে সম্প্রতি অবসর নিয়ে সংস্কৃতি-সাহিত্য-সমাজ নিয়ে কাজ করেন, লেখালেখি করেন। কবিতা ও গদ্যে সমান পারদর্শী।
এই পরিবারের সঙ্গে আমার অতি ঘনিষ্ঠতার আরেকটি বড় কারণ বোধ হয় এটাই যে, এরা সবাই কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ছিলেন। পার্টির সদস্য না হয়েও এরা ছিলেন পার্টি অন্তপ্রাণ। এ রকম পরিবার বোদায় আরও দু-চারটি ছিল।
চন্দবাড়ির সুধীর চন্দের জন্ম ১৯১৭ সালের কোনো এক বুধবার। ওই বছর পৃথিবীতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। অক্টোবর বিপ্লব বলে পরিচিত সেই বিপ্লবের অভিঘাত তখনই বোদায় গিয়ে পৌঁছানোর কথা নয়। তাই সুধীর চন্দের চেতনায় বিপ্লব আঘাত হানেনি। তবে একধরনের উদার মানবতাবাদী চেতনার বিকাশ তাঁর মধ্যে লক্ষ করা গেছে। তাঁর বাড়ির পরিবেশ যে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন হয়েছিল, সেটা আগে উল্লেখ করেছি। একটি কাকতালীয় ব্যাপার হলো তাঁর জন্ম এবং মৃত্যু একই বারে। বুধবার। ২০০০ সালের এক বুধবার তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। প্রায় ৮৩ বছরের জীবন পেয়েছিলেন তিনি।
সুধীর চন্দ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেছিলেন সম্ভবত ১৯৩৭ সালে। তাঁর সঙ্গে একই বছর প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন বোদা হাইস্কুলের শিক্ষক সেলিমের বাবা সিদ্দিক সাহেব। ম্যাট্রিক পাসের পর সুধীর চন্দ আর পড়াশোনা না করে চাকরিতে ঢোকেন। তিনি অবিভক্ত ভারতেই জুট করপোরেশনে প্রথম চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। বন বিভাগেও নাকি তাঁর চাকরি হয়েছিল। সাপ, মশা ইত্যাদির ভয়ে তিনি সেই চাকরিতে যোগ দেননি।
ব্রিটিশরা ভারত ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত দুই রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ১৯৪৭ সালে বিদায় নেয়। সে সময় সুধীর চন্দ তৎকালীন পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তাঁর চাকরি ন্যস্ত হয় ডিসি কালেক্টরে তহসিল অফিসে, তহসিলদার হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত তিনি ওই চাকরি করেছেন। বোদা ছাড়াও দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড় ও সেতাবগঞ্জে তিনি তহসিলদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি লুথার্ন ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন নামের একটি সাহায্য সংস্থায় চাকরি নেন। পরে এই সংগঠন আরডিআরএস নামে রূপান্তরিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে এই সংস্থা অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিল। তখন ঠাকুরগাঁও কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি বেশ কিছুদিন আরডিআরএসের কনস্ট্রাকশন বিভাগে কাজ করেছে আমার বন্ধু হিমাংশু চন্দ তপন বা তপু। বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিধ্বস্ত ভবন নতুন করে তৈরির কাজ তদারকির দায়িত্ব পালন করেছে তপু। সুধীর কাকু আরডিআরএসের চাকরি করেছেন ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। ফলে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঠাকুরগাঁওয়েই বসবাস করেছেন। বাসা ভাড়া নিয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি থাকতেন। তপু ও নয়ন ঠাকুরগাঁও কলেজে পড়ত। তপু ওই কলেজ থেকে বিএ পাস করেছে আর নয়ন এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। দর্শনশাস্ত্রে মাস্টার্স করে বোদায় ফিরে পাথরাজ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করে। তপু বিয়েশাদি করে ঠাকুরগাঁওয়েই স্থায়ী হয়েছে।
তপুদের ঠাকুরগাঁওয়ের বাসায়ও নানা কারণে আমাকে বহুদিন রাত কাটাতে হয়েছে এবং পাত পাততে হয়েছে। তখন ঢাকায় আসার জন্য আমাকে হয় দিনাজপুর অথবা ঠাকুরগাঁও থেকে গাড়ি ধরতে হতো। পঞ্চগড় থেকে কোনো কোচ ডে কিংবা নাইট তখনো চালু হয়নি। ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়া এবং বাড়ি থেকে ঢাকায় আসার জন্য ঠাকুরগাঁওয়ে আমার রাত্রিকালীন অবস্থান হতো তপুদের বাসায়। রান্নাঘরে একসঙ্গে বসে আমরা চারজন রাতের খাবার খেতাম। সুধীর কাকু পরম মমতায় আমাকে পুত্রবৎ পাশে বসাতেন। আহা, কত প্রীতিময় ছিল সেই দিনগুলো!
আগেই বলেছি, কাকু ছিলেন একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড়। তিনি জলপাইগুড়ি টাউন ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি সাত-আটবার ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ) শিল্ড কাপ খেলেছেন। ট্রফি জিতেছেন। হেড করে গোল করায় তিনি খুব পারদর্শী ছিলেন। তখন মাঝগ্রামের আবদুর রহমান সাহেবও ভালো ফুটবল খেলতেন। তাঁর কর্নার কিক মানেই ছিল অবধারিত গোল। সে জন্যই তখন বলা হতো সুধীর চন্দের হেড আর আব্দুর রহমানের কর্নার কিক ইকুয়াল টু গোল। তিনি রংপুর ও দিনাজপুরে গিয়েও খেলেছেন।
সুধীর কাকু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে অংশ না নিলেও শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের নানা উপায়ে সাহায্য-সহযোগিতায় ছিলেন সদা তৎপর। যেসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী ওপারে গিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য বড় সহায় ছিলেন সুধীর কাকু। কিন্তু কিছু মানুষ যেমন যুদ্ধ শেষের পাওনা বুঝে নেওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন, সুধীর কাকু ছিলেন সেখানে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
চন্দবাড়ির স্বপনদা ছিলেন হাসিখুশি স্বভাবের, একটু যেন আপনভোলা মানুষ। সংসার করেছেন। কিন্তু প্রকৃত সংসারী বলতে যা বোঝায়, তিনি তা ছিলেন কি না, আমার সন্দেহ আছে। মাথার ওপর সুধীর কাকুর মতো বটবৃক্ষসম বাবা থাকলে অমনই বোধ হয় হওয়ার কথা।
স্বপনদা আমার বড়। বন্ধুর বড় ভাই। কিন্তু আমাদের মধ্যে একধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্কই গড়ে উঠেছিল। তিনি আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতেন। রাজনীতি সচেতন ছিলেন। দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তেন।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আমাদের এলাকা থেকে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কামু ভাই, অ্যাডভোকেট কামরুল হোসেন। মনে আছে, ওই নির্বাচনী প্রচারে আমি আর স্বপনদা একসঙ্গে অনেক জায়গায় গিয়েছি। বিভিন্ন গ্রাম বা ইউনিয়নে আমাদের উভয়ের পরিচিতদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেছি। আমি সাইকেল চালাতে পারতাম না। স্বপনদা সাইকেল চালিয়ে আমাকে নিয়ে যেতেন। তখন গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট ভালো ছিল না। আলপথে অনেক কষ্ট করেই আমাদের যেতে হতো। হাসিমুখেই এই কষ্টকর কাজটি স্বপনদা করতেন। আমরা বুঝতে পারতাম, জনমত আমাদের অনুকূলে নয়। তার পরও কিসের আশায়, কিসের নেশায় যে দিনরাত গ্রাম থেকে গ্রামে, বাড়ি থেকে বাড়ি ছুটে বেড়াতাম!
আমি ঢাকায় আসার পর স্বপনদার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। তার পরও ছুটিছাঁটায় বোদায় গেলে স্বপনদা ছুটে আসতেন। কত জিজ্ঞাসা নিয়ে আমার কাছে সেসবের উত্তর জানতে চাইতেন। তাঁর সব কৌতূহল মেটানোর সাধ্য আমার ছিল না। এর মধ্যে একটি দুর্ঘটনায় স্বপনদা একটি পা হারান। তিনি ক্র্যাচে ভর দিয়ে এক পায়ে হাঁটতেন। শেষদিকে সম্ভবত ছাত্র পড়িয়ে উপার্জন করতেন। ২০০৩ সালে স্বপনদার মৃত্যু হয়। তিনি রেখে গেছেন দুই মেয়ে ও এক ছেলেসন্তান। বৌদি তাঁর দেবরদের সহযোগিতায় ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। বড় মেয়ে চৈতালি চন্দ সোমার বর ঝাড়বাড়ি কলেজের অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক। ছোট মেয়ে বিপাশা চন্দ দোলন বরিশালে বিয়ে হলেও এখন সম্ভবত বোদাতেই আছে। ছেলে সৌমিত চন্দ জয়দ্বীপ কৃতী ছাত্র। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ভারতের গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। জয়দ্বীপ জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিল, সভাপতি হয়েছিল। বাম রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ হয়তো এখনো বহাল আছে। গুজরাটে যাওয়ার আগে দৈনিক সমকালে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছে। লেখালেখির হাত ভালো। এর মধ্যেই গবেষণামূলক কিছু গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লিখে সুনাম অর্জন করেছে।
আমার বন্ধু হিমাংশু তপুও একজন সফল মানুষ। ঠাকুরগাঁওয়ে ওর একটি এনজিও আছে। অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। ছাত্রাবস্থাতেই তপু উপার্জনমুখী হয়েছে। প্রথমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, তারপর ঠাকুরগাঁওয়ে একটি কসমেটিকসের দোকান এবং সব শেষে শার্প নামে এনজিও প্রতিষ্ঠা। নানা ধরনের সামাজিক কাজকর্মেও তপু সময় দেয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও ছাত্রাবস্থায় তপুর ভেতরের এত প্রতিভা সম্পর্কে আমরা কিছু আন্দাজ করতে পারিনি। তপুর একমাত্র ছেলে বুদ্ধদেব চন্দ তমাল কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে এসে এখন বগুড়ায় একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছে। তমাল বিয়ে করে এক সন্তানের জনকও হয়েছে। আমার বন্ধু তপু গর্বিত দাদু হিসেবে পরিতৃপ্তি নিয়ে সংসার করছে।
ভাইদের মধ্যে ছোট প্রবীর চন্দ নয়ন। মূলত সে-ই এখন চন্দবাড়ির অভিভাবক। বোদার একজন সচেতন ও সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ। দর্শনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেও সাহিত্যে তাঁর অনুরাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন থেকেই। নিয়মিত কবিতা এবং নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে থাকে। দুটি কবিতার বইও বের হয়েছে। দুটি প্রবন্ধের বই প্রকাশের অপেক্ষায়। তার স্ত্রীও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছেলে শুভ্র প্রতিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে একটি অ্যাড ফার্মে চাকরি করছে। মেয়ে দেবলীনা দৈবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রী।
চন্দবাড়ির মেয়েদের কথা কিছু না বললেই নয়। সুধীর চন্দের বড় মেয়ে জলপাইগুড়িতে থেকেছেন বলে তাঁর সঙ্গে আমার কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দু-তিনবার তিনি বোদায় এসেছেন। আমি তখন বোদা ছেড়েছি। ফলে শিবানী চন্দ আমার অদেখা বড় দিদি। কল্যাণী; অর্থাৎ সুনুদিই হলেন আমাদের দেখা বড় দিদি। কী হাসিখুশি মানুষ সুনুদি! মানুষকে আপন করে নেওয়ার শক্তি যেমন তাঁর আছে, তেমনি আছে প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এগিয়ে চলার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস।
আমাদের ছোটবেলায় সুনুদির বিয়ে হয়। প্রেমের বিয়ে। মধু জামাইবাবুও খুব সুন্দর ছিলেন। সুনুদি তো অবশ্যই সুন্দরী। ভালোই চলছিল সব। সময় গড়িয়ে দুটি ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জনক-জননী হন তাঁরা। তারপর যে কোথা থেকে কী হয়। জামাইবাবুকে আর বোদায় দেখা যায় না। তিনি সংসারত্যাগী হন। কী দুঃসহ মর্মজ্বালা বুকে চেপে সুনুদি তাঁর দুই ছেলে মিহির ও বিজনকে মানুষ করার কাজটি সম্পন্ন করেছেন, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে বোঝা কঠিন। বাবা এবং পরিবারের সহযোগিতা-সমর্থন তিনি পেয়েছেন। কিন্তু আমাদের কুচুটে সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করা যে কত কঠিন, সেটা না বললেও চলে। সুনুদি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর ছোট ছেলে বিজন সরকারও একটি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বড় ছেলে মিহির সরকার একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করত বলে শুনেছিলাম।
চন্দবাড়ির আরেক মেয়ে বেণু ওরফে নারায়ণী চন্দ, আমার বন্ধু এবং মামি। আমার মায়ের কোনো ভাইবোন নেই। তিনি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তবে মায়ের কয়েকজন পাতানো ভাই আছে, যারা আমার মামা। এ রকম একজন হলেন নারায়ণ চন্দ্র সাহা। ঢাকার বিক্রমপুরে বাড়ি। চাকরির সুবাদে বোদায় যান গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তিনি কিছুদিন লজিং থাকতেন আমার পিসার বাসায়; অর্থাৎ কার্তিকদা-জ্যোতিষদাদের বাসায়। তখন অবশ্য পিসেমশাই শরৎ চন্দ্র সরকার জীবিত ছিলেন। যা হোক, ওই বাসায় লজিং থাকার সুবাদেই হয়তো আমার মায়ের ভাই হয়ে যান নারায়ণ সাহা। আমার মামা। এই মামাই বিয়ে করেন চন্দবাড়ির মেয়ে বেণুকে। বন্ধু হেয় গেল মামি। বিয়ের পর নতুন সংসার গোছানোর আগে কিছুদিন তাঁরা আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবারের সঙ্গেও আমার অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একসময় এমনও ছিল যে, ঢাকা থেকে বাড়ি গেলে রাতটা আমি নারায়ণ মামার বাসাতেই কাটাতাম। ততদিনে তাঁদের মেয়ে ও ছেলে বড় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। একটি বিষয় লক্ষণীয়। মামার নাম নারায়ণ আর যাকে বিয়ে করলেন তাঁর নাম নারায়ণী। আমাকে আমার দু-এক বন্ধু তখন ঠাট্টা করে বলত, আমার স্ত্রীর নাম নাকি হবে হয় বিভা, না হয় রঞ্জনা! না, সেটা হয়নি।
বেণুও প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করেছে। ছেলে বাপ্পা ওরফে স্বরূপ সাহা এসএসসি পাস করে কলকাতায় চলে যায়। এমবিএ পাস করে বাপ্পা এখন বেঙ্গালুরুতে আছে বলে শুনেছি। বাপ্পা আমাকে মামা বলে ডাকে। কী অদ্ভুত সামাজিক সম্পর্কগুলো! বেণুর মেয়ে শম্পা কিছুদিন ঢাকায় ছিল। তারপর নাকি আমেরিকায় চলে গেছে। নারায়ণ মামার জীবনাবসান হয়েছে। মামি এখন অবসরজীবন যাপন করছেন।
নটে গাছটি মুড়োল, চন্দবাড়ির গল্প ফুরোল।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
একদিন ভোরবেলা জাকারবার্গ লক্ষ করলেন যে পৃথিবীতে একটা ছোট্ট দেশে তাঁর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা হচ্ছে। সামনের ফ্লোরটায় দেখলেন দেশটা ছোট বটে, কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। আর এই দেশের জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। ফেসবুকে দেখতে পেলেন অসংখ্য বার্তা—সবই রাজনৈতিক এবং ছবিতে এ বিষয়ে বিপুল জনগণের
৪ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৩ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তাদের নেতা-কর্মীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে অসংখ্য আন্দোলনকারীকে হত্যা ও অনেকের জীবন বি
৪ ঘণ্টা আগেবেশ কিছুদিন ধরেই অস্থির হয়ে আছে মোহাম্মদপুর। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপর এই অঞ্চলে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে না থাকায় একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী বাড়িতে বাড়িতে ডাকাতি করতে উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। এলাকাবাসী তখন রাত জেগে নিজেদের এলাকা পাহারা দিয়েছিলেন।
৪ ঘণ্টা আগে৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সংস্কারের আহ্বান শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। সব ক্ষেত্রে। চলচ্চিত্রাঙ্গনেও এই সংস্কারের জোয়ার এসে লেগেছে। জোয়ারের আগে মূলধারার চলচ্চিত্রের লোকজন নানাভাবে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে। অভ্যুত্থান শুরুর পর তাঁদের মনে হয়েছে ভবিষ্যৎ বুঝি অন্ধকারে প্রবেশ করতে যাচ্
১ দিন আগে