বিভুরঞ্জন সরকার
উত্তরের ছোট্ট জেলা পঞ্চগড়। আগে অবশ্য জেলা ছিল না। ছিল দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার একটি থানা। গত শতকের আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতায় এসে অনেকগুলো নতুন জেলা বানালে পঞ্চগড় জেলার মর্যাদা পায়। এই জেলার একটি উপজেলা বোদা। এই নামটি নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের কারও কারও আপত্তি আছে। এতে বোদাবাসী কোনো পরোয়া করে না। কারণ, এই নামের একটি ইতিহাস আছে। এক সময় ছিল নদী বন্দর। পাথরাজ ও ঝিনাইকুড়ি নদীর তীরে বোদা বন্দর। ছোটবেলায় আমরাও শুনেছি গ্রামের মানুষ বলতেন, ‘বন্দর যামো’। এই বোদার একটি বাড়ির কথা ঈদের অবসরে পাঠকদের জানানোর লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।
আমাদের বালকবেলায় দূর অঞ্চলের কেউ এই এলাকায় বেড়াতে এসে যদি বোদার কোনো বিখ্যাত বাড়ির কথা জানতে চাইতেন, তাহলে তাঁকে নিশ্চিতভাবে বলা হতো ‘কারকুন বাড়ি’-এর কথা। এই বাড়ি নিয়ে কিছু কথা।
কারকুন বাড়ির কর্তা হিসেবে আমরা পেয়েছি যোগেন চন্দ্র কারকুনকে। যোগেন কারকুনের বাবার নাম ত্রৈলোক্যনাথ খাঁভাদুরী, ছোট ভাইয়ের নাম সুরেন্দ্রনাথ খাঁভাদুরী। এক পরিবারে দু-রকম পদবি হলো কী করে? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়ার লোক এখন আর পাওয়া যাবে কি-না, আমি জানি না। তবে আমার অনুসন্ধানে দুটি তথ্য বেরিয়েছে। ১. যোগেন বাবুও খাঁভাদুরী পদবি লিখতেন। কিন্তু কুচবিহার মহারাজা তাঁকে তাঁর জমিদারি তদারকির জন্য ‘কারকুন’ উপাধি দিয়েছিলেন বলে তিনি খাঁভাদুরী ত্যাগ করে কারকুন ব্যবহার শুরু করেন। ২. জনৈক কারকুন পদবিধারী জমিদার যোগেন বাবুকে তার বালকবেলায় দত্তক নিয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি কারকুন পদবি ব্যবহার করেন। ওই দত্তক গ্রহণকারীর জমিদারি যোগেন বাবু উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। তাঁর বাবার আসলে জমিদারি ছিল না।
এই দুই তথ্য নিয়ে এখন আর বিভ্রান্তি তৈরির কিছু নেই। আমরা যোগেন বাবুকে কারকুন হিসেবেই জানি এবং আমাদের কাছে তাঁর বাড়িটি কারকুন বাড়ি হিসেবেই পরিচিত।
ত্রৈলোক্যনাথ খাঁভাদুরীকে মানুষ ‘পাগলা মাস্টার’ বলে কেন ডাকত? সম্ভবত তিনি কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন। পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে কারও কারও নামের শেষে ‘পাগলা’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন ফইম পাগলা, সিরাজ পাগলা ইত্যাদি।
ত্রৈলোক্যনাথ বাবু ছিলেন পরোপকারী মানুষ। কেউ বিপদে পড়লে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। অভাবী মানুষকে সহায়তা করতেন। কখনো কখনো নিজের সামর্থ্যের কথা খুব একটা চিন্তা না করেও। দুটো ঘটনার কথা বললে তাঁর পাগলামির কিছুটা নমুনা পাওয়া যাবে। বোদা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের কথা বলেছি। স্কুলের আর্থিক সংকট দেখা দিলে তিনি স্থির থাকতে পারতেন না। বলতেন, ‘বেচাও গাছ, বাঁচাও স্কুল’। তাঁদের শাল বাগান ছিল। ওই বাগান থেকে শাল গাছ বিক্রি করে স্কুল তহবিলে টাকা দিতেন। তাঁদের শাল বাগানের কিছু অংশ আমরাও দেখেছি। এখন সম্ভবত কারকুনদের শাল গাছ আর নেই।
একবার যোগেন বাবু বোদা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। হয়তো সেটা দেশ ভাগের আগে। তখন পর্যন্ত সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা চালু হয়নি। মানুষ এক জায়গায় সমবেত হয়ে প্রার্থীর পক্ষের লাইনে দাঁড়ালে মাথা গুনে বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হতো। যোগেন বাবুর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ভাসাইনগরের মহিরউদ্দিন সরকার। ভোটের দিন দেখা গেল দুই প্রার্থীর লাইনে সমানসংখ্যক মানুষ দাঁড়িয়েছেন। যোগেন বাবুর বাবাকে এই খবর দেওয়া হলো। তিনি ভোট দিতে যাননি। তিনি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ছেলের লাইনে দাঁড়ালেই ছেলে প্রেসিডেন্ট; অর্থাৎ, চেয়ারম্যান হয়ে যাবেন। ত্রৈলোক্যনাথ বাবু দৌড়াতে দৌড়াতে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সময় বলছিলেন, ‘এক দিকে পুত্র, আর একদিকে ছাত্র। এখন কী করি?’
সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে তিনি গিয়ে মহিরউদ্দিন সরকারের লাইনে দাঁড়ালেন। ফলে তিনি বিজয়ী হলেন। যোগেন কারকুন পরাজিত হলেন। ত্রৈলোক্য বাবুকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘পুত্র তো প্রেসিডেন্ট হলেও আমার, না হলেও আমার। কিন্তু ছাত্রও যে আমার, সেটা প্রমাণের আর উপায় কী ছিল?’ এমন মানুষকে ‘পাগলা’ না বলে কী বলা হবে!
বাবার রক্তের ধারা বহন করছিলেন বলে যোগেন বাবুও কিছুটা কম বৈষয়িক ছিলেন বলেই মনে হয়। তিনি ছিলেন খুব শৌখিন ও রুচিবান মানুষ। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ ছিল। বাড়িতে নাচ-গানের প্রচলন ছিল। তিনি নিজেও একসময় মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। তাঁর বই পড়ার বাতিক এবং বাড়িতে বইয়ের সমৃদ্ধ সংগ্রহশালার কথা আগেই বলেছি। আর একটি কাজ তিনি করতেন, সেটা হলো ভ্রমণ। জীবনের প্রথম ভাগে তিনি ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করেছেন।
আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, কারকুন বাড়ি ছিল যেন বোদার অনেকের ‘ফুসফুস’। কারকুন বাড়ি কারও কারও কাছে ছিল মন ভালো করার ‘যন্তরমন্তর’। ওই বাড়িতে যাওয়া এবং পাতপেড়ে খাওয়া ছিল একটি নিত্য ঘটনা। কারকুন বাড়িতে গেছেন, অথচ কিছু না খেয়ে এসেছেন—এটা অবিশ্বাস্য। আমারও ছিল অবাধ যাতায়াত। কারণ, কারকুন-গিন্নি, ঊষারানী কারকুন ছিলেন আমার পিসিমা। মার চেয়ে আপনার মাসিমা নয়, মার চেয়ে আপনার পিসিমা। কীভাবে তিনি আমার পিসি হলেন? আমাদের তো কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না। তাহলে?
আমার বাবা-কাকারা ছিলেন তিন ভাই। তাঁদের আপন কোনো বোন ছিল না। সে হিসেবে আমার কোনো পিসি থাকার কথা নয়। তারপরও কারকুন বাড়ির ঊষারানী কারকুন, যোগেন চন্দ্র কারকুনের স্ত্রী, আমার পিসি হয়েছিলেন। আমার বাবা-কাকার কাকাতো বোন, আমার সুনীতি পিসির সঙ্গে ছিল তাঁর দারুণ হৃদ্যতা, বোনের মতো। পিসির বোন, তাই আমারও পিসি। আমার এই পিসি হলেন বোদার কার্তিক সরকার, জ্যোতিষ সরকারের মা। আমার পিসা মহাশয়ের নাম শরৎচন্দ্র সরকার। তিনি ছিলেন আবার যোগেন কারকুনের ভাইতুল্য। এই দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা, যোগাযোগের সূত্রেই আমাদের সঙ্গেও কারকুন পরিবারের পরিচয় ও প্রায়-আত্মীয়তার মতো সম্পর্ক।
কারকুনবাড়ির সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল না—এমন মানুষ অবশ্য সে সময় খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। ওই বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল বোদার গণ্যমান্য বলে পরিচিত সবারই। যোগেন বাবু মিশুকে স্বভাবের ছিলেন। তাঁর মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। ব্রাহ্মণ হলেও তাঁর মধ্যে কোনো গোঁড়ামি ছিল না। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার অবাধ যাতায়াত ছিল কারকুন বাড়িতে। ওই বাড়ির সবাই ছিলেন আধুনিক ও উদার মনের মানুষ। অথচ এই যোগেন বাবুকেও একবার (ষাটের দশকের মাঝামাঝি) বোদা হাইস্কুলের কিছু উগ্র ছাত্রের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল।
যোগেন কারকুন ছিলেন বোদা হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। কমিটির কোনো এক সভায় তিনি নাকি ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তার জের ধরে কয়েকজন শিক্ষক কিছু ছাত্রকে উসকে দিয়েছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে।
কারকুন পরিবারের একটি ট্র্যাজেডি হলো অতি রূপবতী-গুণবতী হওয়া সত্ত্বেও ওই বাড়ির মেয়েদের বিয়ে না হওয়া। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘অতি বড়ো ঘরনি না পায় ঘর, অতি বড়ো সুন্দরী না পায় বর’। কারকুন বাড়ির দিদিদের দেখেও আমার তাই মনে হতো। কিন্তু ব্যতিক্রম একটি ঘটেছিল, যেটা আবার পরিবারকে ফেলেছিল লজ্জায়। ষাটের দশকের শেষ দিকেই কারকুন বাড়ির দ্বিতীয় কন্যা, আমাদের ইরাদি (ইরা রাণী কারকুন) পালিয়ে বিয়ে করলেন বোদা থানা সার্কেল অফিসারকে (উন্নয়ন)। তখন মানুষ বলত সিও (ডেভ.)। আব্দুর রৌফ চৌধুরী ছিল সম্ভবত ভদ্রলোকের নাম। ইরাদির এই বিয়ে ছিল তখন এক ব্যাপক আলোচিত বিষয়। কারকুন পরিবার বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেনি।
মেয়ের এভাবে বিয়ে করা এবং ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার দুটি ঘটনা সম্ভবত যোগেন পিসা মহাশয়কে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল। মানসিকভাবে দারুণ আঘাত পেয়েছিলেন। এর পর তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বাজারে আসা-যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছিলেন। ঝড়ে বিশাল বৃক্ষ উপড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল তাঁর।
যোগেন কারকুন মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আগে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি এবং আমার প্রিয় বন্ধু বিজন দত্ত সকালেই ছুটে গিয়েছিলাম কারকুন বাড়িতে। তাঁকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল তুলসিতলায়। বিশাল দেহের সৌম্যকান্তি মানুষটির অমন শয্যা দেখে আমার ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠেছিল। তার আগে আমি কখনো কোনো মরদেহ দেখতে যাইনি। সে হিসেবে ওটাই আমার প্রথম কোনো মৃতদেহ দেখা। প্রাণহীন একজন মানুষকে ভূমিশয্যায় দেখে আমার ভেতরটা হাহাকার করে উঠেছিল এবং আরও যে বিচিত্র অনুভূতি হয়েছিল, তা এখন আর বর্ণনা করতে পারব না। জীবন-মৃত্যুর যিনি নিপুণ কারিগর সেই বিশ্বস্রষ্টার প্রতি আমার মধ্যে আগে থেকেই ছিল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। একজন প্রিয় ও পছন্দের মানুষের মৃত্যুর পর বিশ্বস্রষ্টার অপার ক্ষমতা সম্পর্কে বিশ্বাস যেন কিছুটা হলেও বেড়েছিল। সংসারের কর্তা চলে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই সব দায়িত্ব পিসিমার কাঁধে বর্তায়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সংসারের হাল ধরেছিলেন।
যোগেন কারকুনের মৃত্যুর অল্প পরেই শুরু হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দেশীয় সহযোগী-অনুচরদের হত্যা-নির্যাতনের মুখে অসংখ্য মানুষকে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। বোদা থেকেও আমরা অনেকেই বাধ্য হয়েই ভারতে গিয়ে শরণার্থীর জীবন বেছে নিয়েছিলাম। পাকিস্তানিদের আক্রমণের প্রধান টার্গেট ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক জনগোষ্ঠী। কারকুন বাড়ি দুই কারণেই টার্গেট ছিল। তারা একদিকে হিন্দু এবং অন্যদিকে বাড়ির বড় ছেলে অনুপ কুমার কারকুন দুলাল ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী, স্বাধীনতার পক্ষের একজন সংগঠক।
যেদিন বোদা প্রথম পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে যায়, সেদিনই তিনজনকে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের একজন আমার দাদাশ্বশুর (পরবর্তী সময়ে) যতীন্দ্র মোহন সাহা। প্রকৃতপক্ষে তিনিই বোদার প্রথম শহীদ। তার পর হত্যা করা হয়েছিল বোদার তখনকার পোস্টমাস্টার আব্দুল মান্নানকে। তৃতীয় যাঁকে হত্যা করা হয়, তিনি আব্দুল লতিফ। লতিফ মেম্বর বলেই তাঁকে সবাই চিনত। তিনি পাকিস্তানিদের সহযোগী হয় হিন্দু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িঘর, দোকানপাট চিনিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কেন পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, সেটা একটা রহস্য। কিছু দালাল হত্যা করে পাকিস্তানিরা বোধ হয় বুঝিয়েছিল যে, বিশ্বাসঘাতকদের বেঁচে থাকার অধিকার না থাকাই ভালো। পাকিস্তানিরা বোদা বাজারে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল ব্যাপক লুটপাট। আমাদের একটি গালা মালের দোকান ছিল। দোকানের সব মালামাল লুট হয়েছিল মুহূর্তের মধ্যে। ওই লুটেরার দল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরেই লুটপাট অব্যাহত রেখেছিল। আমার পরিবারের সবাই বলতে গেলে এক বস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বের হয়ে আর ফিরে আসা হয়নি। আমাদের তখনকার বাড়িটি ছিল দিনাজপুর-পঞ্চগড় হাইওয়ের পাশে পাথরাজ ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে আখ ক্রয়কেন্দ্রের লাগোয়া। আমাদের বাড়িটি একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কারকুন বাড়ির ছেলেমেয়েরা দেশত্যাগ করলেও পিসিমা, ঊষারানী কারকুন জেদ ধরলেন তিনি কিছুতেই সদ্যপ্রয়াত স্বামীর ভিটা ছেড়ে কোথাও যাবেন না। বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র লুট হয়েছে। পাড়াপড়শিরাও লুটে অংশ নিয়েছে। রান্না-খাওয়ার বাসনকোসনও লুট হয়েছে। কিন্তু তাঁকে ভিটে ছাড়া করা যায়নি। তাঁর জেদ কিংবা মনোবলের কাছে ভয়ভীতি পরাজিত হয়েছিল।
তাঁকে হত্যার জন্য রাজাকার কমান্ডার চন্দনবাড়ির হবিবর রহমান একদিন কারকুন বাড়ি গিয়েও উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি। পিসিমা আগেই টের পেয়ে ঘর ছেড়ে বাড়ির পেছন দিকের ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়েছিলেন। তাঁকে খুঁজতে ওই ঝোপের দিকেও গিয়েছিলেন হবিবর রহমান। তিনি পিসিমাকে দেখতেও পেয়েছিলেন। রাইফেল তাক করে গুলি ছোড়ার আগে একটি সাপ তার দিকে ছোবল হানতে গেলে প্রাণভয়ে তিনি দৌড়ে পালান। জীবন রক্ষা হয় পিসিমার।
হবিবর রহমান ছিলেন আনসার কমান্ডার। সে জন্য তাঁকে মানুষ হবিবর কমান্ডার বলেই জানত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে তাঁকে কেউ ভয়াবহ চরিত্রের মানুষ বলে মনে করত না। ২৬ বা ২৭ মার্চ ঠাকুরগাঁও ইপিআর ছাউনি থেকে পালিয়ে আসা একজন পাকিস্তানি সৈনিককে পাকড়াও করে বোদা হাইস্কুল মাঠে বহু মানুষের উপস্থিতিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। যারা গুলি করেছিলেন, তাদের মধ্যে হবিবর কমান্ডারও ছিলেন। তিনি একসময় যাত্রা-নাটকে অভিনয় করতেন। বেশ হাসি-খুশি প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমার বাবা-কাকাদের সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। আমি তাঁকে চাচা বলতাম। তিনিও আমাকে নাম ধরে না ডেকে ‘বাবাজি’ বলে সম্বোধন করতেন। আমরা বন্ধুরা স্কুলে পড়ার সময়ই কিছুদিন বেশ নাটক পাগল হয়ে উঠেছিলাম। এক বছর আমরা চারটি নাটক মঞ্চস্থ করেছি। হবিবর চাচা দু-একটি নাটক নির্দেশনা বা পরিচালনার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। মনে আছে, রিহার্সালের জায়গা না পেয়ে আমরা রাতের বেলা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছে পাথরাজ ব্রিজের ওপরও রিহার্সাল করেছি। তখন অবশ্য জায়গাটি এখনকার মতে ঘিঞ্জি ছিল না।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হবিবর রহমান হয়ে ওঠেন এক ভয়ংকর মানুষ। বোদায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের মধ্য তাঁর নাম ওপরের দিকেই রাখতে হবে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, স্বাধীনতার পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর একসময় প্রকাশ্যে আসেন এবং বোদায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর বাড়ি ছিল বোদা বাজার থেকে কয়েক মাইল দূরের চন্দনবাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালন সত্ত্বেও স্বাধীন দেশে প্রথম স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তিনি বোদা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান বোদা গেলে তাঁর সভামঞ্চে হবিবর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হন। আবার ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ ফরহাদের পক্ষাবলম্বন করে আমাদের লজ্জায় ফেলেছিলেন।
হবিবর কমান্ডার কারকুন-গিন্নিকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর ওপর উপদ্রব একটু কমে আসে। একজন পাকিস্তানি মেজরও তাঁর দেশ ছেড়ে না যাওয়ার কথা শুনে তাঁকে দেখতে আসেন। ওই মেজরও তাঁকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমি পরবর্তী সময়ে জেনেছি যে, পিসিমাকে গোপনে নানাভাবে সাহায্য করেছেন মাঝগ্রাম নিবাসী দবিরউদ্দিন হাজী সাহেব। চাল-ডাল, এমনকি হাড়িপাতিলও দবির চাচাই কারকুন বাড়িতে সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোতে পাঠাতেন। আজিজার রহমানও (যিনি পরে বোদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন) গোপনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, খোঁজ-খবর দিতেন। শত্রুকবলিত দেশে পিসিমা শত্রুর সঙ্গে মিত্রও পেয়েছিলেন। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। সবাই শত্রু ছিল না, আবার মিত্রও সবাই নয়। আমরা আজ শত্রু-মিত্র একাকার করে এক বিপন্ন অবস্থা তৈরি করেছি।
কারকুন বাড়ির সামনের পুকুর এবং মন্দির নিয়ে কিছু মিথ বা কাহিনি শোনা যায়। মন্দিরে শিবের মূর্তি ছিল। সে জন্য শিব মন্দির হিসেবেই ওটা পরিচিতি পেয়েছিল। বোদার হিন্দু নারীরা ফাল্গুন মাসে শিব চতুর্দশীর রাতে সমবেতভাবে ওই মন্দিরে পূজা অর্চনা করতেন। শিব রাত্রিতে ভক্তরা যে বাসনা করেন, তা নাকি ভগবান শিব পূরণ করেন। এই মন্দিরে পূজা দিয়ে অনেকেরই নাকি মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। সে জন্য ওই মন্দিরকে একসময় জাগ্রত মন্দির বলা হতো। তবে এখন সে রামও নেই, নেই সে অযোধ্যাও। পাকিস্তান আমলেই একবার মন্দির থেকে শিবের বিগ্রহ চুরি যাওয়ায় ভক্তরা খুবই অসহায় বোধ করেছিলেন। অবিশ্বাসীরা তখন শিবের ‘ক্ষমতা’ নিয়ে বিদ্রূপ করতেও দ্বিধা করেননি! মন্দিরটি কিছুটা জীর্ণ দশা প্রাপ্ত হলেও এখনো শিবরাত্রি পালনের জন্য বিপুলসংখ্যক হিন্দু নারী ওই মন্দিরে সমবেত হন। ব্রত পালন করেন।
কারকুন বাড়ির সামনের পুকুর বা দিঘিটি কত বছর আগে খনন করা হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য জানা না গেলেও বোদার প্রবীণ লোকদের ধারণা, কমপক্ষে দুই শ বছর আগে পুকুরটি খনন করা হয়ে থাকতে পারে। প্রায় ১৮ বিঘা জমির ওপর ওই বিশাল পুকুরটি একসময় হয়তো শুধু কারকুন বাড়ি নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদেরও দৈনন্দিন জলের সমস্যা মেটাত। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, পুকুরের পাড়জুড়ে কত গাছগাছালি। পুকুরে তখনো ছিল গভীর জল। পুকুরজুড়ে শাপলা ও পদ্ম যখন ফুটত, তখন চমৎকার লাগত দেখতে।
নানা গল্প চালু আছে এই পুকুর নিয়ে। একসময় নাকি মানুষের পূজা-পার্বণ কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানাদির জন্য থালা-বাসন দরকার হলে ওই পুকুরপাড়ে চাহিদাপত্র দিলে পুকুরই তা সরবরাহ করত। মানুষ প্রয়োজন শেষে সেগুলো আবার পুকুরে দিয়ে আসত। আমরা অবশ্য এমন মানুষের সন্ধান পাইনি, যে বা যারা পুকুর থেকে বাসনকোসন নিয়ে প্রয়োজন মিটিয়েছেন! মানুষ এসব ‘গল্প’ একটা সময় পর্যন্ত বিশ্বাস করত বলেই এগুলো চালু ছিল। এখন বিশ্বাস করে না বলেই শোনা যায় না। কথায় আছে: বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহু দূর।
আচ্ছা, শুধু বিশ্বাসের ওপর ভর করে কি সত্যি কিছু অর্জন করা যায়? আমরা কিছু হলেই ‘দোয়া’ ‘প্রার্থনা’ করি। দোয়া কি কাউকে রোগ বা বিপদমুক্ত করতে পারে? জানি না। তবে দোয়ার সঙ্গে ‘দাওয়া’ বলেও একটা কথা আছে। দোয়ার গুণের চেয়ে দাওয়ার গুণ টের পাওয়া যায় বেশি।
কারকুন বাড়িতে আম-কাঁঠালের অনেক গাছ ছিল। ঝড়ের দিনে শুধু মামার বাড়ি আম কুড়াতে সুখ ছিল না, কারকুন বাড়িতেও সে সুখ ছিল। কারকুন বাড়ির ব্যাপার ছিল আরও আলাদা। গাছেরটা খাওয়া এবং তলারটা কুড়ানো—দুটোই চলত। অর্থাৎ, যেগুলো গাছ থেকে ঝরে পড়ত সেগুলো যেমন যে কেউ নিতে পারত, তেমনি গাছের পাকা ফলও চাইলেই পাওয়া যেত। কারকুন বাড়ি থেকে পাকা আম-কাঁঠালের বোঝা আমিও বহন করেছি।
আমাদের ছোটবেলার সময়টা ছিল অন্য রকম। বাড়ি, পরিবার, গ্রামগুলো কেমন সুন্দর মমতায় জড়ানো ছিল। মানুষের মনে এবং চোখে অন্ধকার ছিল। অর্থাৎ, শিক্ষিতের হার কম ছিল, আবার বিদ্যুৎও ছিল না। চোখের অন্ধকার দূর করত কেরোসিনের বাতি। কিন্তু মনের অন্ধকার? সেটা ছিল বলেই মানুষ অলৌকিকতায় বিশ্বাস করত। জিন-ভূতের গল্প বেশি শোনা যেত। এই পথে সন্ধ্যায় যাওয়া যাবে না—ভূতের ভয় আছে, এই পুকুরের এই ক্ষমতা আছে—এসব মানুষ অবলীলায় বিশ্বাস করত।
এখন মানুষের মন এবং চোখ দুটোতেই আলো। কিন্তু কোনো কোনো মানুষকে পেয়ে বসছে এক নতুন ধরনের অন্ধত্ব, যার নাম ধর্মান্ধতা। আমাদের সেইকালে ধর্মবিশ্বাস ছিল, ধর্মান্ধতা ছিল কম। সে জন্য চমৎকার সম্প্রীতির পরিবেশ ছিল। কারকুন বাড়ি ছিল সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের এক মিলনক্ষেত্র।
কারকুনবাড়ির অনেক কিছুই আজ আর নেই। জীবন কারকুন এবং অচিন্ত্য কারকুন—দুই ভাই দিদি শর্বাণীকে নিয়ে আছেন। শর্বাণীদির বিয়ে হয়নি। কিন্তু জীবন-অচিন্ত্য বিয়ে করেছে। জীবনের এক পুত্র সন্তান, অচিন্ত্যর তিন মেয়ে। ওরা নিশ্চয়ই এখন এক হাঁড়িতে খায় না। কত দিন ওই বাড়িতে যাই না। বছর তিনেক আগে বোদা গিয়ে বন্ধু বিজন দত্তকে নিয়ে কারকুন বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে এসেছি। কিন্তু ভেতরে ঢুকিনি। একসময়ের প্রাণময় বাড়িটি কেমন নিষ্প্রাণ মনে হলো। জীবন সম্ভবত আগের ভিটায় আছে। অচিন্ত্য সামনের দিকে নতুন পাকা বাড়ি বানিয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অচিন্ত্য ছিল আমার প্রয়াত ছোট ভাই নিরঞ্জনের ক্লাসফ্রেন্ড। ওরা খুব ভালো বন্ধু ছিল।
আগে বাড়িতে গেলে শোনা যেতো প্রাণের স্পন্দন, এখন মনে হয় ঘুমঘোর।
ভেতরের লম্বা ঘরটি, যেটার বিভিন্ন কক্ষে মাসিমা এবং দিদিরা থাকতেন, সেটাও সেভাবেই আছে, নাকি সেখানেও নতুন ঘর উঠেছে, জানি না। বাইরের পরিবর্তন দেখে মনে হয়েছে, ভেতরেও নিশ্চয়ই অনেক অদলবদল হয়েছে।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো, সেই নানা গল্পগাথার পুকুরটি আর আগের মতো নেই। যে পুকুর খননের সময় পানি না ওঠায় নাকি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নরবলি দিতে হয়েছিল, যে পুকুরের মাঝখানে নাকি ছিল একটি রহস্যময় বড় সিন্দুক জাতীয় কিছু, সেই পুকুরের ওপর দিয়ে এখন হয়েছে মহাসড়ক। পুকুরটি দুই ভাগ হয়েছে, ছোট হয়েছে। আগে পুকুরপাড়ে গেলে কখনো কখনো যেমন গা ছমছম করত, এখন আর তা করে না। অসংখ্য মানুষের যাতায়াত, যোগাযোগ সহজতর করার জন্য একটি পরিবারের ঐতিহ্য, স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করা হয়েছে। এটাই বোধ হয় আধুনিক সভ্যতার নিয়ম। পুরাতনকে আঁকড়ে থাকা নয়, নতুনকে আবাহন করাই যেন প্রগতি ও অগ্রগতির লক্ষণ।
কারকুন বাড়ির বড় ছেলে অনুপ কারকুন, আমাদের দুলালদা, যিনি ছোট-বড় সবার কাছেই একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন, সবাইকে ছেড়ে শেষ বিদায় নেন ১৯৮১ সালে। প্রায় দশ বছরের ব্যবধানে পিতা ও পুত্রের মৃত্যু কারকুন বাড়িতে ভাঙনের যে সুর বাজিয়েছিল, তা কিছুটা দূর হয়েছে ছোট দুই কারকুন বিয়ে করে সংসার শুরুর পর।
পিসিমা, ঊষারানী কারকুন বেঁচে থাকতে ওই বাড়িতে আগের ধারা, মানুষের যাতায়াত, আহার-বিহার অব্যাহত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর সে রকম আছে কি-না, জানি না। পিসির মৃত্যু হয়েছে ২০০৪ সালে। কী আশ্চর্যের ব্যাপার যে, তাঁর বিদায়ের দিনেও আমি বোদায় ছিলাম এবং বিজনকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম।
কারকুন বাড়ির দুই উত্তরাধিকার জীবন ও অচিন্ত্য ওদের ছেলেমেয়ে নিয়ে আর আগের অবস্থায় যেতে চায় কি-না, যেতে চাইলেও আর যেতে পারবে কি-না, জানি না।
শর্বাণী কারকুন, আমাদের বাণীদি, কত দিন তাঁকে দেখি না। কত দিন তাঁর আপ্যায়নবঞ্চিত। কেমন আছেন বাণীদি? বয়স কি তাঁর সৌন্দর্য আড়াল করতে পেরেছে? এর পর বোদা গেলে বাণীদিকে অবশ্যই এক নজর দেখে আসব।
উত্তরের ছোট্ট জেলা পঞ্চগড়। আগে অবশ্য জেলা ছিল না। ছিল দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার একটি থানা। গত শতকের আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতায় এসে অনেকগুলো নতুন জেলা বানালে পঞ্চগড় জেলার মর্যাদা পায়। এই জেলার একটি উপজেলা বোদা। এই নামটি নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের কারও কারও আপত্তি আছে। এতে বোদাবাসী কোনো পরোয়া করে না। কারণ, এই নামের একটি ইতিহাস আছে। এক সময় ছিল নদী বন্দর। পাথরাজ ও ঝিনাইকুড়ি নদীর তীরে বোদা বন্দর। ছোটবেলায় আমরাও শুনেছি গ্রামের মানুষ বলতেন, ‘বন্দর যামো’। এই বোদার একটি বাড়ির কথা ঈদের অবসরে পাঠকদের জানানোর লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।
আমাদের বালকবেলায় দূর অঞ্চলের কেউ এই এলাকায় বেড়াতে এসে যদি বোদার কোনো বিখ্যাত বাড়ির কথা জানতে চাইতেন, তাহলে তাঁকে নিশ্চিতভাবে বলা হতো ‘কারকুন বাড়ি’-এর কথা। এই বাড়ি নিয়ে কিছু কথা।
কারকুন বাড়ির কর্তা হিসেবে আমরা পেয়েছি যোগেন চন্দ্র কারকুনকে। যোগেন কারকুনের বাবার নাম ত্রৈলোক্যনাথ খাঁভাদুরী, ছোট ভাইয়ের নাম সুরেন্দ্রনাথ খাঁভাদুরী। এক পরিবারে দু-রকম পদবি হলো কী করে? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়ার লোক এখন আর পাওয়া যাবে কি-না, আমি জানি না। তবে আমার অনুসন্ধানে দুটি তথ্য বেরিয়েছে। ১. যোগেন বাবুও খাঁভাদুরী পদবি লিখতেন। কিন্তু কুচবিহার মহারাজা তাঁকে তাঁর জমিদারি তদারকির জন্য ‘কারকুন’ উপাধি দিয়েছিলেন বলে তিনি খাঁভাদুরী ত্যাগ করে কারকুন ব্যবহার শুরু করেন। ২. জনৈক কারকুন পদবিধারী জমিদার যোগেন বাবুকে তার বালকবেলায় দত্তক নিয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি কারকুন পদবি ব্যবহার করেন। ওই দত্তক গ্রহণকারীর জমিদারি যোগেন বাবু উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। তাঁর বাবার আসলে জমিদারি ছিল না।
এই দুই তথ্য নিয়ে এখন আর বিভ্রান্তি তৈরির কিছু নেই। আমরা যোগেন বাবুকে কারকুন হিসেবেই জানি এবং আমাদের কাছে তাঁর বাড়িটি কারকুন বাড়ি হিসেবেই পরিচিত।
ত্রৈলোক্যনাথ খাঁভাদুরীকে মানুষ ‘পাগলা মাস্টার’ বলে কেন ডাকত? সম্ভবত তিনি কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন। পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে কারও কারও নামের শেষে ‘পাগলা’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন ফইম পাগলা, সিরাজ পাগলা ইত্যাদি।
ত্রৈলোক্যনাথ বাবু ছিলেন পরোপকারী মানুষ। কেউ বিপদে পড়লে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। অভাবী মানুষকে সহায়তা করতেন। কখনো কখনো নিজের সামর্থ্যের কথা খুব একটা চিন্তা না করেও। দুটো ঘটনার কথা বললে তাঁর পাগলামির কিছুটা নমুনা পাওয়া যাবে। বোদা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের কথা বলেছি। স্কুলের আর্থিক সংকট দেখা দিলে তিনি স্থির থাকতে পারতেন না। বলতেন, ‘বেচাও গাছ, বাঁচাও স্কুল’। তাঁদের শাল বাগান ছিল। ওই বাগান থেকে শাল গাছ বিক্রি করে স্কুল তহবিলে টাকা দিতেন। তাঁদের শাল বাগানের কিছু অংশ আমরাও দেখেছি। এখন সম্ভবত কারকুনদের শাল গাছ আর নেই।
একবার যোগেন বাবু বোদা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। হয়তো সেটা দেশ ভাগের আগে। তখন পর্যন্ত সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা চালু হয়নি। মানুষ এক জায়গায় সমবেত হয়ে প্রার্থীর পক্ষের লাইনে দাঁড়ালে মাথা গুনে বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হতো। যোগেন বাবুর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ভাসাইনগরের মহিরউদ্দিন সরকার। ভোটের দিন দেখা গেল দুই প্রার্থীর লাইনে সমানসংখ্যক মানুষ দাঁড়িয়েছেন। যোগেন বাবুর বাবাকে এই খবর দেওয়া হলো। তিনি ভোট দিতে যাননি। তিনি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ছেলের লাইনে দাঁড়ালেই ছেলে প্রেসিডেন্ট; অর্থাৎ, চেয়ারম্যান হয়ে যাবেন। ত্রৈলোক্যনাথ বাবু দৌড়াতে দৌড়াতে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সময় বলছিলেন, ‘এক দিকে পুত্র, আর একদিকে ছাত্র। এখন কী করি?’
সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে তিনি গিয়ে মহিরউদ্দিন সরকারের লাইনে দাঁড়ালেন। ফলে তিনি বিজয়ী হলেন। যোগেন কারকুন পরাজিত হলেন। ত্রৈলোক্য বাবুকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘পুত্র তো প্রেসিডেন্ট হলেও আমার, না হলেও আমার। কিন্তু ছাত্রও যে আমার, সেটা প্রমাণের আর উপায় কী ছিল?’ এমন মানুষকে ‘পাগলা’ না বলে কী বলা হবে!
বাবার রক্তের ধারা বহন করছিলেন বলে যোগেন বাবুও কিছুটা কম বৈষয়িক ছিলেন বলেই মনে হয়। তিনি ছিলেন খুব শৌখিন ও রুচিবান মানুষ। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ ছিল। বাড়িতে নাচ-গানের প্রচলন ছিল। তিনি নিজেও একসময় মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। তাঁর বই পড়ার বাতিক এবং বাড়িতে বইয়ের সমৃদ্ধ সংগ্রহশালার কথা আগেই বলেছি। আর একটি কাজ তিনি করতেন, সেটা হলো ভ্রমণ। জীবনের প্রথম ভাগে তিনি ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করেছেন।
আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, কারকুন বাড়ি ছিল যেন বোদার অনেকের ‘ফুসফুস’। কারকুন বাড়ি কারও কারও কাছে ছিল মন ভালো করার ‘যন্তরমন্তর’। ওই বাড়িতে যাওয়া এবং পাতপেড়ে খাওয়া ছিল একটি নিত্য ঘটনা। কারকুন বাড়িতে গেছেন, অথচ কিছু না খেয়ে এসেছেন—এটা অবিশ্বাস্য। আমারও ছিল অবাধ যাতায়াত। কারণ, কারকুন-গিন্নি, ঊষারানী কারকুন ছিলেন আমার পিসিমা। মার চেয়ে আপনার মাসিমা নয়, মার চেয়ে আপনার পিসিমা। কীভাবে তিনি আমার পিসি হলেন? আমাদের তো কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না। তাহলে?
আমার বাবা-কাকারা ছিলেন তিন ভাই। তাঁদের আপন কোনো বোন ছিল না। সে হিসেবে আমার কোনো পিসি থাকার কথা নয়। তারপরও কারকুন বাড়ির ঊষারানী কারকুন, যোগেন চন্দ্র কারকুনের স্ত্রী, আমার পিসি হয়েছিলেন। আমার বাবা-কাকার কাকাতো বোন, আমার সুনীতি পিসির সঙ্গে ছিল তাঁর দারুণ হৃদ্যতা, বোনের মতো। পিসির বোন, তাই আমারও পিসি। আমার এই পিসি হলেন বোদার কার্তিক সরকার, জ্যোতিষ সরকারের মা। আমার পিসা মহাশয়ের নাম শরৎচন্দ্র সরকার। তিনি ছিলেন আবার যোগেন কারকুনের ভাইতুল্য। এই দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা, যোগাযোগের সূত্রেই আমাদের সঙ্গেও কারকুন পরিবারের পরিচয় ও প্রায়-আত্মীয়তার মতো সম্পর্ক।
কারকুনবাড়ির সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল না—এমন মানুষ অবশ্য সে সময় খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। ওই বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল বোদার গণ্যমান্য বলে পরিচিত সবারই। যোগেন বাবু মিশুকে স্বভাবের ছিলেন। তাঁর মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। ব্রাহ্মণ হলেও তাঁর মধ্যে কোনো গোঁড়ামি ছিল না। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার অবাধ যাতায়াত ছিল কারকুন বাড়িতে। ওই বাড়ির সবাই ছিলেন আধুনিক ও উদার মনের মানুষ। অথচ এই যোগেন বাবুকেও একবার (ষাটের দশকের মাঝামাঝি) বোদা হাইস্কুলের কিছু উগ্র ছাত্রের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল।
যোগেন কারকুন ছিলেন বোদা হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। কমিটির কোনো এক সভায় তিনি নাকি ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তার জের ধরে কয়েকজন শিক্ষক কিছু ছাত্রকে উসকে দিয়েছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে।
কারকুন পরিবারের একটি ট্র্যাজেডি হলো অতি রূপবতী-গুণবতী হওয়া সত্ত্বেও ওই বাড়ির মেয়েদের বিয়ে না হওয়া। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘অতি বড়ো ঘরনি না পায় ঘর, অতি বড়ো সুন্দরী না পায় বর’। কারকুন বাড়ির দিদিদের দেখেও আমার তাই মনে হতো। কিন্তু ব্যতিক্রম একটি ঘটেছিল, যেটা আবার পরিবারকে ফেলেছিল লজ্জায়। ষাটের দশকের শেষ দিকেই কারকুন বাড়ির দ্বিতীয় কন্যা, আমাদের ইরাদি (ইরা রাণী কারকুন) পালিয়ে বিয়ে করলেন বোদা থানা সার্কেল অফিসারকে (উন্নয়ন)। তখন মানুষ বলত সিও (ডেভ.)। আব্দুর রৌফ চৌধুরী ছিল সম্ভবত ভদ্রলোকের নাম। ইরাদির এই বিয়ে ছিল তখন এক ব্যাপক আলোচিত বিষয়। কারকুন পরিবার বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেনি।
মেয়ের এভাবে বিয়ে করা এবং ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার দুটি ঘটনা সম্ভবত যোগেন পিসা মহাশয়কে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল। মানসিকভাবে দারুণ আঘাত পেয়েছিলেন। এর পর তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বাজারে আসা-যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছিলেন। ঝড়ে বিশাল বৃক্ষ উপড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল তাঁর।
যোগেন কারকুন মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আগে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি এবং আমার প্রিয় বন্ধু বিজন দত্ত সকালেই ছুটে গিয়েছিলাম কারকুন বাড়িতে। তাঁকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল তুলসিতলায়। বিশাল দেহের সৌম্যকান্তি মানুষটির অমন শয্যা দেখে আমার ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠেছিল। তার আগে আমি কখনো কোনো মরদেহ দেখতে যাইনি। সে হিসেবে ওটাই আমার প্রথম কোনো মৃতদেহ দেখা। প্রাণহীন একজন মানুষকে ভূমিশয্যায় দেখে আমার ভেতরটা হাহাকার করে উঠেছিল এবং আরও যে বিচিত্র অনুভূতি হয়েছিল, তা এখন আর বর্ণনা করতে পারব না। জীবন-মৃত্যুর যিনি নিপুণ কারিগর সেই বিশ্বস্রষ্টার প্রতি আমার মধ্যে আগে থেকেই ছিল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। একজন প্রিয় ও পছন্দের মানুষের মৃত্যুর পর বিশ্বস্রষ্টার অপার ক্ষমতা সম্পর্কে বিশ্বাস যেন কিছুটা হলেও বেড়েছিল। সংসারের কর্তা চলে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই সব দায়িত্ব পিসিমার কাঁধে বর্তায়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সংসারের হাল ধরেছিলেন।
যোগেন কারকুনের মৃত্যুর অল্প পরেই শুরু হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দেশীয় সহযোগী-অনুচরদের হত্যা-নির্যাতনের মুখে অসংখ্য মানুষকে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। বোদা থেকেও আমরা অনেকেই বাধ্য হয়েই ভারতে গিয়ে শরণার্থীর জীবন বেছে নিয়েছিলাম। পাকিস্তানিদের আক্রমণের প্রধান টার্গেট ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক জনগোষ্ঠী। কারকুন বাড়ি দুই কারণেই টার্গেট ছিল। তারা একদিকে হিন্দু এবং অন্যদিকে বাড়ির বড় ছেলে অনুপ কুমার কারকুন দুলাল ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী, স্বাধীনতার পক্ষের একজন সংগঠক।
যেদিন বোদা প্রথম পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে যায়, সেদিনই তিনজনকে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের একজন আমার দাদাশ্বশুর (পরবর্তী সময়ে) যতীন্দ্র মোহন সাহা। প্রকৃতপক্ষে তিনিই বোদার প্রথম শহীদ। তার পর হত্যা করা হয়েছিল বোদার তখনকার পোস্টমাস্টার আব্দুল মান্নানকে। তৃতীয় যাঁকে হত্যা করা হয়, তিনি আব্দুল লতিফ। লতিফ মেম্বর বলেই তাঁকে সবাই চিনত। তিনি পাকিস্তানিদের সহযোগী হয় হিন্দু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িঘর, দোকানপাট চিনিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কেন পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, সেটা একটা রহস্য। কিছু দালাল হত্যা করে পাকিস্তানিরা বোধ হয় বুঝিয়েছিল যে, বিশ্বাসঘাতকদের বেঁচে থাকার অধিকার না থাকাই ভালো। পাকিস্তানিরা বোদা বাজারে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল ব্যাপক লুটপাট। আমাদের একটি গালা মালের দোকান ছিল। দোকানের সব মালামাল লুট হয়েছিল মুহূর্তের মধ্যে। ওই লুটেরার দল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরেই লুটপাট অব্যাহত রেখেছিল। আমার পরিবারের সবাই বলতে গেলে এক বস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বের হয়ে আর ফিরে আসা হয়নি। আমাদের তখনকার বাড়িটি ছিল দিনাজপুর-পঞ্চগড় হাইওয়ের পাশে পাথরাজ ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে আখ ক্রয়কেন্দ্রের লাগোয়া। আমাদের বাড়িটি একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কারকুন বাড়ির ছেলেমেয়েরা দেশত্যাগ করলেও পিসিমা, ঊষারানী কারকুন জেদ ধরলেন তিনি কিছুতেই সদ্যপ্রয়াত স্বামীর ভিটা ছেড়ে কোথাও যাবেন না। বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র লুট হয়েছে। পাড়াপড়শিরাও লুটে অংশ নিয়েছে। রান্না-খাওয়ার বাসনকোসনও লুট হয়েছে। কিন্তু তাঁকে ভিটে ছাড়া করা যায়নি। তাঁর জেদ কিংবা মনোবলের কাছে ভয়ভীতি পরাজিত হয়েছিল।
তাঁকে হত্যার জন্য রাজাকার কমান্ডার চন্দনবাড়ির হবিবর রহমান একদিন কারকুন বাড়ি গিয়েও উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি। পিসিমা আগেই টের পেয়ে ঘর ছেড়ে বাড়ির পেছন দিকের ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়েছিলেন। তাঁকে খুঁজতে ওই ঝোপের দিকেও গিয়েছিলেন হবিবর রহমান। তিনি পিসিমাকে দেখতেও পেয়েছিলেন। রাইফেল তাক করে গুলি ছোড়ার আগে একটি সাপ তার দিকে ছোবল হানতে গেলে প্রাণভয়ে তিনি দৌড়ে পালান। জীবন রক্ষা হয় পিসিমার।
হবিবর রহমান ছিলেন আনসার কমান্ডার। সে জন্য তাঁকে মানুষ হবিবর কমান্ডার বলেই জানত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে তাঁকে কেউ ভয়াবহ চরিত্রের মানুষ বলে মনে করত না। ২৬ বা ২৭ মার্চ ঠাকুরগাঁও ইপিআর ছাউনি থেকে পালিয়ে আসা একজন পাকিস্তানি সৈনিককে পাকড়াও করে বোদা হাইস্কুল মাঠে বহু মানুষের উপস্থিতিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। যারা গুলি করেছিলেন, তাদের মধ্যে হবিবর কমান্ডারও ছিলেন। তিনি একসময় যাত্রা-নাটকে অভিনয় করতেন। বেশ হাসি-খুশি প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমার বাবা-কাকাদের সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। আমি তাঁকে চাচা বলতাম। তিনিও আমাকে নাম ধরে না ডেকে ‘বাবাজি’ বলে সম্বোধন করতেন। আমরা বন্ধুরা স্কুলে পড়ার সময়ই কিছুদিন বেশ নাটক পাগল হয়ে উঠেছিলাম। এক বছর আমরা চারটি নাটক মঞ্চস্থ করেছি। হবিবর চাচা দু-একটি নাটক নির্দেশনা বা পরিচালনার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। মনে আছে, রিহার্সালের জায়গা না পেয়ে আমরা রাতের বেলা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছে পাথরাজ ব্রিজের ওপরও রিহার্সাল করেছি। তখন অবশ্য জায়গাটি এখনকার মতে ঘিঞ্জি ছিল না।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হবিবর রহমান হয়ে ওঠেন এক ভয়ংকর মানুষ। বোদায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের মধ্য তাঁর নাম ওপরের দিকেই রাখতে হবে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, স্বাধীনতার পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর একসময় প্রকাশ্যে আসেন এবং বোদায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর বাড়ি ছিল বোদা বাজার থেকে কয়েক মাইল দূরের চন্দনবাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালন সত্ত্বেও স্বাধীন দেশে প্রথম স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তিনি বোদা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান বোদা গেলে তাঁর সভামঞ্চে হবিবর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হন। আবার ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ ফরহাদের পক্ষাবলম্বন করে আমাদের লজ্জায় ফেলেছিলেন।
হবিবর কমান্ডার কারকুন-গিন্নিকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর ওপর উপদ্রব একটু কমে আসে। একজন পাকিস্তানি মেজরও তাঁর দেশ ছেড়ে না যাওয়ার কথা শুনে তাঁকে দেখতে আসেন। ওই মেজরও তাঁকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমি পরবর্তী সময়ে জেনেছি যে, পিসিমাকে গোপনে নানাভাবে সাহায্য করেছেন মাঝগ্রাম নিবাসী দবিরউদ্দিন হাজী সাহেব। চাল-ডাল, এমনকি হাড়িপাতিলও দবির চাচাই কারকুন বাড়িতে সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোতে পাঠাতেন। আজিজার রহমানও (যিনি পরে বোদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন) গোপনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, খোঁজ-খবর দিতেন। শত্রুকবলিত দেশে পিসিমা শত্রুর সঙ্গে মিত্রও পেয়েছিলেন। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। সবাই শত্রু ছিল না, আবার মিত্রও সবাই নয়। আমরা আজ শত্রু-মিত্র একাকার করে এক বিপন্ন অবস্থা তৈরি করেছি।
কারকুন বাড়ির সামনের পুকুর এবং মন্দির নিয়ে কিছু মিথ বা কাহিনি শোনা যায়। মন্দিরে শিবের মূর্তি ছিল। সে জন্য শিব মন্দির হিসেবেই ওটা পরিচিতি পেয়েছিল। বোদার হিন্দু নারীরা ফাল্গুন মাসে শিব চতুর্দশীর রাতে সমবেতভাবে ওই মন্দিরে পূজা অর্চনা করতেন। শিব রাত্রিতে ভক্তরা যে বাসনা করেন, তা নাকি ভগবান শিব পূরণ করেন। এই মন্দিরে পূজা দিয়ে অনেকেরই নাকি মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। সে জন্য ওই মন্দিরকে একসময় জাগ্রত মন্দির বলা হতো। তবে এখন সে রামও নেই, নেই সে অযোধ্যাও। পাকিস্তান আমলেই একবার মন্দির থেকে শিবের বিগ্রহ চুরি যাওয়ায় ভক্তরা খুবই অসহায় বোধ করেছিলেন। অবিশ্বাসীরা তখন শিবের ‘ক্ষমতা’ নিয়ে বিদ্রূপ করতেও দ্বিধা করেননি! মন্দিরটি কিছুটা জীর্ণ দশা প্রাপ্ত হলেও এখনো শিবরাত্রি পালনের জন্য বিপুলসংখ্যক হিন্দু নারী ওই মন্দিরে সমবেত হন। ব্রত পালন করেন।
কারকুন বাড়ির সামনের পুকুর বা দিঘিটি কত বছর আগে খনন করা হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য জানা না গেলেও বোদার প্রবীণ লোকদের ধারণা, কমপক্ষে দুই শ বছর আগে পুকুরটি খনন করা হয়ে থাকতে পারে। প্রায় ১৮ বিঘা জমির ওপর ওই বিশাল পুকুরটি একসময় হয়তো শুধু কারকুন বাড়ি নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদেরও দৈনন্দিন জলের সমস্যা মেটাত। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, পুকুরের পাড়জুড়ে কত গাছগাছালি। পুকুরে তখনো ছিল গভীর জল। পুকুরজুড়ে শাপলা ও পদ্ম যখন ফুটত, তখন চমৎকার লাগত দেখতে।
নানা গল্প চালু আছে এই পুকুর নিয়ে। একসময় নাকি মানুষের পূজা-পার্বণ কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানাদির জন্য থালা-বাসন দরকার হলে ওই পুকুরপাড়ে চাহিদাপত্র দিলে পুকুরই তা সরবরাহ করত। মানুষ প্রয়োজন শেষে সেগুলো আবার পুকুরে দিয়ে আসত। আমরা অবশ্য এমন মানুষের সন্ধান পাইনি, যে বা যারা পুকুর থেকে বাসনকোসন নিয়ে প্রয়োজন মিটিয়েছেন! মানুষ এসব ‘গল্প’ একটা সময় পর্যন্ত বিশ্বাস করত বলেই এগুলো চালু ছিল। এখন বিশ্বাস করে না বলেই শোনা যায় না। কথায় আছে: বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহু দূর।
আচ্ছা, শুধু বিশ্বাসের ওপর ভর করে কি সত্যি কিছু অর্জন করা যায়? আমরা কিছু হলেই ‘দোয়া’ ‘প্রার্থনা’ করি। দোয়া কি কাউকে রোগ বা বিপদমুক্ত করতে পারে? জানি না। তবে দোয়ার সঙ্গে ‘দাওয়া’ বলেও একটা কথা আছে। দোয়ার গুণের চেয়ে দাওয়ার গুণ টের পাওয়া যায় বেশি।
কারকুন বাড়িতে আম-কাঁঠালের অনেক গাছ ছিল। ঝড়ের দিনে শুধু মামার বাড়ি আম কুড়াতে সুখ ছিল না, কারকুন বাড়িতেও সে সুখ ছিল। কারকুন বাড়ির ব্যাপার ছিল আরও আলাদা। গাছেরটা খাওয়া এবং তলারটা কুড়ানো—দুটোই চলত। অর্থাৎ, যেগুলো গাছ থেকে ঝরে পড়ত সেগুলো যেমন যে কেউ নিতে পারত, তেমনি গাছের পাকা ফলও চাইলেই পাওয়া যেত। কারকুন বাড়ি থেকে পাকা আম-কাঁঠালের বোঝা আমিও বহন করেছি।
আমাদের ছোটবেলার সময়টা ছিল অন্য রকম। বাড়ি, পরিবার, গ্রামগুলো কেমন সুন্দর মমতায় জড়ানো ছিল। মানুষের মনে এবং চোখে অন্ধকার ছিল। অর্থাৎ, শিক্ষিতের হার কম ছিল, আবার বিদ্যুৎও ছিল না। চোখের অন্ধকার দূর করত কেরোসিনের বাতি। কিন্তু মনের অন্ধকার? সেটা ছিল বলেই মানুষ অলৌকিকতায় বিশ্বাস করত। জিন-ভূতের গল্প বেশি শোনা যেত। এই পথে সন্ধ্যায় যাওয়া যাবে না—ভূতের ভয় আছে, এই পুকুরের এই ক্ষমতা আছে—এসব মানুষ অবলীলায় বিশ্বাস করত।
এখন মানুষের মন এবং চোখ দুটোতেই আলো। কিন্তু কোনো কোনো মানুষকে পেয়ে বসছে এক নতুন ধরনের অন্ধত্ব, যার নাম ধর্মান্ধতা। আমাদের সেইকালে ধর্মবিশ্বাস ছিল, ধর্মান্ধতা ছিল কম। সে জন্য চমৎকার সম্প্রীতির পরিবেশ ছিল। কারকুন বাড়ি ছিল সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের এক মিলনক্ষেত্র।
কারকুনবাড়ির অনেক কিছুই আজ আর নেই। জীবন কারকুন এবং অচিন্ত্য কারকুন—দুই ভাই দিদি শর্বাণীকে নিয়ে আছেন। শর্বাণীদির বিয়ে হয়নি। কিন্তু জীবন-অচিন্ত্য বিয়ে করেছে। জীবনের এক পুত্র সন্তান, অচিন্ত্যর তিন মেয়ে। ওরা নিশ্চয়ই এখন এক হাঁড়িতে খায় না। কত দিন ওই বাড়িতে যাই না। বছর তিনেক আগে বোদা গিয়ে বন্ধু বিজন দত্তকে নিয়ে কারকুন বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে এসেছি। কিন্তু ভেতরে ঢুকিনি। একসময়ের প্রাণময় বাড়িটি কেমন নিষ্প্রাণ মনে হলো। জীবন সম্ভবত আগের ভিটায় আছে। অচিন্ত্য সামনের দিকে নতুন পাকা বাড়ি বানিয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অচিন্ত্য ছিল আমার প্রয়াত ছোট ভাই নিরঞ্জনের ক্লাসফ্রেন্ড। ওরা খুব ভালো বন্ধু ছিল।
আগে বাড়িতে গেলে শোনা যেতো প্রাণের স্পন্দন, এখন মনে হয় ঘুমঘোর।
ভেতরের লম্বা ঘরটি, যেটার বিভিন্ন কক্ষে মাসিমা এবং দিদিরা থাকতেন, সেটাও সেভাবেই আছে, নাকি সেখানেও নতুন ঘর উঠেছে, জানি না। বাইরের পরিবর্তন দেখে মনে হয়েছে, ভেতরেও নিশ্চয়ই অনেক অদলবদল হয়েছে।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো, সেই নানা গল্পগাথার পুকুরটি আর আগের মতো নেই। যে পুকুর খননের সময় পানি না ওঠায় নাকি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নরবলি দিতে হয়েছিল, যে পুকুরের মাঝখানে নাকি ছিল একটি রহস্যময় বড় সিন্দুক জাতীয় কিছু, সেই পুকুরের ওপর দিয়ে এখন হয়েছে মহাসড়ক। পুকুরটি দুই ভাগ হয়েছে, ছোট হয়েছে। আগে পুকুরপাড়ে গেলে কখনো কখনো যেমন গা ছমছম করত, এখন আর তা করে না। অসংখ্য মানুষের যাতায়াত, যোগাযোগ সহজতর করার জন্য একটি পরিবারের ঐতিহ্য, স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করা হয়েছে। এটাই বোধ হয় আধুনিক সভ্যতার নিয়ম। পুরাতনকে আঁকড়ে থাকা নয়, নতুনকে আবাহন করাই যেন প্রগতি ও অগ্রগতির লক্ষণ।
কারকুন বাড়ির বড় ছেলে অনুপ কারকুন, আমাদের দুলালদা, যিনি ছোট-বড় সবার কাছেই একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন, সবাইকে ছেড়ে শেষ বিদায় নেন ১৯৮১ সালে। প্রায় দশ বছরের ব্যবধানে পিতা ও পুত্রের মৃত্যু কারকুন বাড়িতে ভাঙনের যে সুর বাজিয়েছিল, তা কিছুটা দূর হয়েছে ছোট দুই কারকুন বিয়ে করে সংসার শুরুর পর।
পিসিমা, ঊষারানী কারকুন বেঁচে থাকতে ওই বাড়িতে আগের ধারা, মানুষের যাতায়াত, আহার-বিহার অব্যাহত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর সে রকম আছে কি-না, জানি না। পিসির মৃত্যু হয়েছে ২০০৪ সালে। কী আশ্চর্যের ব্যাপার যে, তাঁর বিদায়ের দিনেও আমি বোদায় ছিলাম এবং বিজনকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম।
কারকুন বাড়ির দুই উত্তরাধিকার জীবন ও অচিন্ত্য ওদের ছেলেমেয়ে নিয়ে আর আগের অবস্থায় যেতে চায় কি-না, যেতে চাইলেও আর যেতে পারবে কি-না, জানি না।
শর্বাণী কারকুন, আমাদের বাণীদি, কত দিন তাঁকে দেখি না। কত দিন তাঁর আপ্যায়নবঞ্চিত। কেমন আছেন বাণীদি? বয়স কি তাঁর সৌন্দর্য আড়াল করতে পেরেছে? এর পর বোদা গেলে বাণীদিকে অবশ্যই এক নজর দেখে আসব।
একদিন ভোরবেলা জাকারবার্গ লক্ষ করলেন যে পৃথিবীতে একটা ছোট্ট দেশে তাঁর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা হচ্ছে। সামনের ফ্লোরটায় দেখলেন দেশটা ছোট বটে, কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। আর এই দেশের জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। ফেসবুকে দেখতে পেলেন অসংখ্য বার্তা—সবই রাজনৈতিক এবং ছবিতে এ বিষয়ে বিপুল জনগণের
৪ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৩ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তাদের নেতা-কর্মীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে অসংখ্য আন্দোলনকারীকে হত্যা ও অনেকের জীবন বি
৪ ঘণ্টা আগেবেশ কিছুদিন ধরেই অস্থির হয়ে আছে মোহাম্মদপুর। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপর এই অঞ্চলে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে না থাকায় একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী বাড়িতে বাড়িতে ডাকাতি করতে উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। এলাকাবাসী তখন রাত জেগে নিজেদের এলাকা পাহারা দিয়েছিলেন।
৪ ঘণ্টা আগে৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সংস্কারের আহ্বান শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। সব ক্ষেত্রে। চলচ্চিত্রাঙ্গনেও এই সংস্কারের জোয়ার এসে লেগেছে। জোয়ারের আগে মূলধারার চলচ্চিত্রের লোকজন নানাভাবে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে। অভ্যুত্থান শুরুর পর তাঁদের মনে হয়েছে ভবিষ্যৎ বুঝি অন্ধকারে প্রবেশ করতে যাচ্
১ দিন আগে