বিভুরঞ্জন সরকার
আজ বিশ্ব নিরামিষ দিবস। এ বিষয়ে একটি রচনা লেখার জন্য আদিষ্ট হয়ে এখন মাথার চুল ছিঁড়তে গিয়ে খেয়াল হলো, আরে, আমি তো এখন টেকো, চুল ছিঁড়ব কী করে! যে কয়খানা এখনো টিকে আছে, ওগুলো ছিঁড়লে রোদে বড় কষ্ট পাব। আচ্ছা, এই যে আমার মাথার চুল বিরল হলো, এ জন্য কি আমিষের প্রতি আমার অধিক টানই দায়ী? আমার মাথাটা তো সব সময় এমন ছিল না। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ না হলেও আমারও একদিন মাথাভরা কেশদল তুমুলভাবেই উপস্থিতি জানান দিত। পকেটে টাকা না থাকলেও মাথায় টাক ছিল না। তো, আমি বিরলকেশী হলাম কী করে?
এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে যদ্দূর মনে পড়ে ভাতের ওপর চাপ কমানোর জন্য বেশি করে আলু খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন এক সময় একজন শাসক। আমি তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে টানা তিন মাস আলুনির্ভর হয়েছিলাম। একদিন এক বন্ধু আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘কী রে, তোর মাথা দেখি পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে! ব্যাপার কী?’ আয়নায় মুখ দেখা বন্ধ করেছিলাম একজনের কাছে একটি প্রতিজ্ঞা করে। বন্ধুর ‘মাথা পরিষ্কার' শব্দদ্বয় আমাকে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে বাধ্য করল। আয়নায় মুখ রেখে আমি তো হতভম্ব। আহা সাধের চুল, তুমি গেলা কই? অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না যে ‘চুল উঠতে সাহায্য করে’—এমন বিজ্ঞাপন পাঠ করে আমি মাথায় কোনো ভেষজ ওষধি মেখেছিলাম কি না! হঠাৎ মনে হলো, আরে এটা আলুর গুণ নয় তো? ওই যে আলুর প্রতি বিরাগ তৈরি হলো, এত দিনেও আর আলু-অনুরাগী হতে পারলাম না।
আচ্ছা বলুন তো, নিরামিষ দিবস নিয়ে লিখতে বসে কী সব ছাইপাঁশ লিখছি? মূল প্রসঙ্গে আসি। বিশ্বে এখন দিবসের ছড়াছড়ি। প্রথম যেদিন ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস' উপলক্ষে গিন্নির জন্য হাত ধোয়ার উপকারিতা সংবলিত একটি পুস্তিকা নিয়ে গেলাম, তিনি তো ‘রেগে আগুন, তেলে বেগুন’। ‘মিনসের বুড়োকালে ভীমরতি ধরেছে। এতকাল কি আমি হাত না ধুয়ে থেকেছি?’ তাই তো? ভালোবাসা দিবস ঠিক হওয়ার আগে কি বিশ্বে ভালোবাসা ছিল না? ঘটা করে দিবস পালনের নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ মাজেজা আছে। কোনো বিষয়ের গভীরে গিয়ে ভাবার মতো বিদ্যাবুদ্ধি আমার নেই। একটু সাধারণ আলোচনার মধ্যেই থাকা যাক।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও নিরামিষ দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। নিরামিষ বা শাক-সবজিজাতীয় খাদ্যের উপকারিতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন ও উৎসাহিত করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালন করা হয়। বাংলাদেশেও দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। পুষ্টিবিদেরা জানান, নিরামিষ জাতীয় খাবার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। নিরামিষভোজীরা আমিষভোজীদের চেয়ে নাকি দীর্ঘায়ু হন।
আমিষ আর নিরামিষের ব্যাপারটা অবশ্য বেশ জটিল। হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, ভেড়া হচ্ছে আমিষজাতীয় খাবার। অথচ এরা ঘাস-লতাপাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। যারা নিজেরা নিরামিষভোজী, জীবনভর শাক-লতাপাতা শস্যদানা ইত্যাদি খেয়ে বড় হয়, সেগুলোই আমাদের কাছে প্রধান আমিষজাতীয় খাবার।
নিরামিষ খেলে নাকি হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতাজনিত শারীরিক সমস্যা কম হয়। এ খাবারে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ তন্তু, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ফোলিক অ্যাসিড, ম্যাগনেশিয়াম, সম্পৃক্ত স্নেহ পদার্থ ও প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ রাসায়নিক পদার্থ থাকে। নিরামিষভোজীদের উচ্চ কোলেস্টেরলজনিত বা নিম্ন রক্তচাপজনিত রোগ সাধারণত দেখা যায় না। তাদের হৃদ্রোগের আশঙ্কাও কম থাকে। খাদ্যতালিকায় বেশি ফল বা সবুজ শাকসবজি রাখলে শরীরে কম রাসায়নিক ও বিষাক্ত পদার্থের প্রভাব তৈরি হবে।
এটিই বহুদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। উদ্ভিজ্জ ফ্যাটে কোনো রকম কোলেস্টেরল থাকে না। যদিও কোলেস্টেরল মানুষের কোষের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়, তবু শুধু নিরামিষ খাবারের ওপর বেঁচে থাকলে শরীরের বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না। শরীর সবুজ শাকসবজি থেকে প্রয়োজনীয় কোলেস্টেরল জোগাড় করে নেয়। সতেজ সবজি গ্রহণে শরীর ও মনে অনেক বেশি সতেজতা বজায় থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরামিষভোজী মানুষের ক্ষেত্রে রেস্টিং মেটাবলিজম রেট অনেক বেশি। নিরামিষ শুধু সহজপাচ্যই নয়, এটি শারীরিক ফ্যাট বিপাকেও যথেষ্ট সহায়তা করে। যদিও আমাদের দেশে নিরামিষ খাওয়া অনেকেরই ধাতে সয় না।
আপনি নিরামিষ খেয়ে বেশি ভালো থাকেন? মাছ মাংস খেলে শরীরে অস্বস্তি হয়? গন্ধ লাগে? দেহ উষ্ণ হয়? মনের কোণে অপরাধবোধ জন্মায়? তাহলে খাবেন না মাছ মাংস, শরীরের কথা শুনে চলুন।
আর আপনি? কয়জন বাঙালিকে চেনেন, যিনি সরষে ইলিশ পছন্দ করেন না? কাচ্চি বিরিয়ানি ছাড়া কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান এখন কল্পনা করতে পারেন? গরুর রেজালা ছাড়া বাঙালি মুসলমানের রসনা তৃপ্ত হয়? কথায় আছে, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। নিরামিষই যদি বেঁচে থাকার বড় নিদান হয়, তাহলে নিরামিষ নিয়ে কোনো প্রবাদপ্রবচন নেই কেন? নাকি আছে, আমি জানি না?
প্রশ্ন তো আরও আছে। বাঁচার জন্য খাওয়া? নাকি খাওয়ার জন্য বাঁচা? ব্যক্তিগতভাবে আমি অবশ্য তর্কপ্রিয় নই। আমি বরং মনে করি, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর’।
এক-একদিন একটু মাছ-মাংস খেতে সাধ হয়? খেলে বেশ তৃপ্তি হয়? শরীর বেশ তরতাজা থাকে তো? ধ্যান জপ বা নিজের কাজ কর্ম করতে কোনো ক্লান্তি বা তামসিক ভাব আসে না তো? তাহলে খাবেন মাঝেমধ্যে। ‘যার পেটে যা সয়’—ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি।
লক্ষণীয় যে, আমিষাশীদের কিছুটা উন্নসিকতা আছে নিরামিষীদের প্রতি; কিন্তু তেমন বিদ্বেষ নেই। এদিকে নিরামিষবাদীরা যেন সদাই খড়্গহস্ত, ঘৃণায় সিঁটিয়ে থাকেন আমিষভোজীদের ওপর। নিরামিষ খেলে নাকি হিংসা দ্বেষ থাকে না? শরীর মন ঠান্ডা থাকে? এ কী সত্যিই ধর্মীয় মূল্যবোধ; অথবা অবলা প্রাণীর প্রতি দরদ, নাকি গোপন ঈর্ষা? পারিবারিক সংস্কার বা ধর্মীয় ফরমান বা পরিস্থিতির দাবি বা নেহাত চক্ষুলজ্জার খাতিরে বহুকালের অবদমিত ইচ্ছার বিকার নয় তো?
জাতিসংঘের এক হিসাবমতে, মানুষ খাদ্যের জন্য প্রতি সেকেন্ডে মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী বাদে ২ হাজার প্রাণী হত্যা করে। গরু, ছাগল, উট, দুম্বা, সাপ, ব্যাঙ, ইত্যাদি। আচ্ছা আমিষ আর নিরামিষ খাদ্য নির্ধারিত হয় কীভাবে? প্রাণিজ খাদ্য যদি আমিষ হয়, তাহলে অপ্রাণিজ খাদ্য কোনটি? গাছ বা উদ্ভিদেরও তো প্রাণ আছে? না, এত জটিল ভাবনা ভাবতে ভালো লাগে না। কাটলে বা জবাই করলে রক্ত বের হয় না—সেটা যদি নিরামিষ খাদ্য হয়, তাহলে চিংড়ি কি নিরামিষ? চিংড়ি অবশ্য মাছ নয়, পানি বা জলের পোকা।
এবার একটু অন্য দিকে তাকানো যাক। মানুষের জীবনে খাদ্য যেমন জরুরি, বাঙালির জীবনে তেমনি রাজনীতি। আমাদের খাদ্যতালিকায় ইদানীং আমিষের সঙ্গে নিরামিষের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। সে জন্য রাজনীতিটাও কেমন যেন নিরামিষ হয়ে যাচ্ছে। কোথায় গেল পল্টন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর বড় বড় জনসমাবেশ? আন্দোলন, ঘেরাও, হরতাল, অবরোধ নেই, জ্বালাও-পোড়াও নেই। পুলিশের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ককটেল, গ্রেনেড, বোমা হামলা নেই। আছে রুটিন-মাফিক বক্তৃতা, বিবৃতি, আর পুলিশি ধাওয়া, হামলা-মামলা দিয়ে ঠাসা কিছু সাধারণ রাজনৈতিক কার্যক্রম। এটাও যে খুব বেশি, তা নয়। এতে মন ভরে না। কত আর ওবায়দুল কাদের ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাহাস সহ্য করা যায়?
খাতা-কলমে দেশের কোথাও গণ-আন্দোলনের কারণে সভা-সমিতি-মিছিল করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়নি। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা সব সময়ই বিরোধী দলের আন্দোলন করতে পুলিশকে ব্যবহার করে নিরামিষ আন্দোলনকে আমিষে পরিণত করেন। কিন্তু এখন তাও সম্ভব হচ্ছে না। নিরামিষ দিবস আমাদের সবাইকে নিরামিষাশী বানাতে না পারলেও আমাদের রাজনীতিকে কি নিরামিষ বানিয়ে ফেলল?
পরিশেষে একটি অন্য রকম কথা
নিরামিষ দিবসে বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক কর্মী মনে মনে ভাবলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের খাদ্যতালিকা দেখে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন, তিনি নিরামিষভোজী হবেন কি না। যথা চিন্তা, তথা কাজ। তিনি একজন সরকারপ্রধান পেলেন, যিনি নিরামিষভোজী। নিজ ধর্মের প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধাভক্তি অপরিসীম। তাঁর চেহারাও সাধুসন্তের মতো। তিনি সরকারপ্রধান হয়ে দেশে হিংসার রাজনীতির বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মী স্বস্তি বোধ করলেন এটা ভেবে যে, খাদ্য দিয়ে আসলে মানুষ চেনা যায় না। মানুষ চেনা যায় মানুষের কাজ দিয়ে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আজ বিশ্ব নিরামিষ দিবস। এ বিষয়ে একটি রচনা লেখার জন্য আদিষ্ট হয়ে এখন মাথার চুল ছিঁড়তে গিয়ে খেয়াল হলো, আরে, আমি তো এখন টেকো, চুল ছিঁড়ব কী করে! যে কয়খানা এখনো টিকে আছে, ওগুলো ছিঁড়লে রোদে বড় কষ্ট পাব। আচ্ছা, এই যে আমার মাথার চুল বিরল হলো, এ জন্য কি আমিষের প্রতি আমার অধিক টানই দায়ী? আমার মাথাটা তো সব সময় এমন ছিল না। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ না হলেও আমারও একদিন মাথাভরা কেশদল তুমুলভাবেই উপস্থিতি জানান দিত। পকেটে টাকা না থাকলেও মাথায় টাক ছিল না। তো, আমি বিরলকেশী হলাম কী করে?
এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে যদ্দূর মনে পড়ে ভাতের ওপর চাপ কমানোর জন্য বেশি করে আলু খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন এক সময় একজন শাসক। আমি তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে টানা তিন মাস আলুনির্ভর হয়েছিলাম। একদিন এক বন্ধু আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘কী রে, তোর মাথা দেখি পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে! ব্যাপার কী?’ আয়নায় মুখ দেখা বন্ধ করেছিলাম একজনের কাছে একটি প্রতিজ্ঞা করে। বন্ধুর ‘মাথা পরিষ্কার' শব্দদ্বয় আমাকে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে বাধ্য করল। আয়নায় মুখ রেখে আমি তো হতভম্ব। আহা সাধের চুল, তুমি গেলা কই? অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না যে ‘চুল উঠতে সাহায্য করে’—এমন বিজ্ঞাপন পাঠ করে আমি মাথায় কোনো ভেষজ ওষধি মেখেছিলাম কি না! হঠাৎ মনে হলো, আরে এটা আলুর গুণ নয় তো? ওই যে আলুর প্রতি বিরাগ তৈরি হলো, এত দিনেও আর আলু-অনুরাগী হতে পারলাম না।
আচ্ছা বলুন তো, নিরামিষ দিবস নিয়ে লিখতে বসে কী সব ছাইপাঁশ লিখছি? মূল প্রসঙ্গে আসি। বিশ্বে এখন দিবসের ছড়াছড়ি। প্রথম যেদিন ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস' উপলক্ষে গিন্নির জন্য হাত ধোয়ার উপকারিতা সংবলিত একটি পুস্তিকা নিয়ে গেলাম, তিনি তো ‘রেগে আগুন, তেলে বেগুন’। ‘মিনসের বুড়োকালে ভীমরতি ধরেছে। এতকাল কি আমি হাত না ধুয়ে থেকেছি?’ তাই তো? ভালোবাসা দিবস ঠিক হওয়ার আগে কি বিশ্বে ভালোবাসা ছিল না? ঘটা করে দিবস পালনের নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ মাজেজা আছে। কোনো বিষয়ের গভীরে গিয়ে ভাবার মতো বিদ্যাবুদ্ধি আমার নেই। একটু সাধারণ আলোচনার মধ্যেই থাকা যাক।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও নিরামিষ দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। নিরামিষ বা শাক-সবজিজাতীয় খাদ্যের উপকারিতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন ও উৎসাহিত করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালন করা হয়। বাংলাদেশেও দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। পুষ্টিবিদেরা জানান, নিরামিষ জাতীয় খাবার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। নিরামিষভোজীরা আমিষভোজীদের চেয়ে নাকি দীর্ঘায়ু হন।
আমিষ আর নিরামিষের ব্যাপারটা অবশ্য বেশ জটিল। হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, ভেড়া হচ্ছে আমিষজাতীয় খাবার। অথচ এরা ঘাস-লতাপাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। যারা নিজেরা নিরামিষভোজী, জীবনভর শাক-লতাপাতা শস্যদানা ইত্যাদি খেয়ে বড় হয়, সেগুলোই আমাদের কাছে প্রধান আমিষজাতীয় খাবার।
নিরামিষ খেলে নাকি হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতাজনিত শারীরিক সমস্যা কম হয়। এ খাবারে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ তন্তু, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ফোলিক অ্যাসিড, ম্যাগনেশিয়াম, সম্পৃক্ত স্নেহ পদার্থ ও প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ রাসায়নিক পদার্থ থাকে। নিরামিষভোজীদের উচ্চ কোলেস্টেরলজনিত বা নিম্ন রক্তচাপজনিত রোগ সাধারণত দেখা যায় না। তাদের হৃদ্রোগের আশঙ্কাও কম থাকে। খাদ্যতালিকায় বেশি ফল বা সবুজ শাকসবজি রাখলে শরীরে কম রাসায়নিক ও বিষাক্ত পদার্থের প্রভাব তৈরি হবে।
এটিই বহুদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। উদ্ভিজ্জ ফ্যাটে কোনো রকম কোলেস্টেরল থাকে না। যদিও কোলেস্টেরল মানুষের কোষের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়, তবু শুধু নিরামিষ খাবারের ওপর বেঁচে থাকলে শরীরের বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না। শরীর সবুজ শাকসবজি থেকে প্রয়োজনীয় কোলেস্টেরল জোগাড় করে নেয়। সতেজ সবজি গ্রহণে শরীর ও মনে অনেক বেশি সতেজতা বজায় থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরামিষভোজী মানুষের ক্ষেত্রে রেস্টিং মেটাবলিজম রেট অনেক বেশি। নিরামিষ শুধু সহজপাচ্যই নয়, এটি শারীরিক ফ্যাট বিপাকেও যথেষ্ট সহায়তা করে। যদিও আমাদের দেশে নিরামিষ খাওয়া অনেকেরই ধাতে সয় না।
আপনি নিরামিষ খেয়ে বেশি ভালো থাকেন? মাছ মাংস খেলে শরীরে অস্বস্তি হয়? গন্ধ লাগে? দেহ উষ্ণ হয়? মনের কোণে অপরাধবোধ জন্মায়? তাহলে খাবেন না মাছ মাংস, শরীরের কথা শুনে চলুন।
আর আপনি? কয়জন বাঙালিকে চেনেন, যিনি সরষে ইলিশ পছন্দ করেন না? কাচ্চি বিরিয়ানি ছাড়া কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান এখন কল্পনা করতে পারেন? গরুর রেজালা ছাড়া বাঙালি মুসলমানের রসনা তৃপ্ত হয়? কথায় আছে, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। নিরামিষই যদি বেঁচে থাকার বড় নিদান হয়, তাহলে নিরামিষ নিয়ে কোনো প্রবাদপ্রবচন নেই কেন? নাকি আছে, আমি জানি না?
প্রশ্ন তো আরও আছে। বাঁচার জন্য খাওয়া? নাকি খাওয়ার জন্য বাঁচা? ব্যক্তিগতভাবে আমি অবশ্য তর্কপ্রিয় নই। আমি বরং মনে করি, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর’।
এক-একদিন একটু মাছ-মাংস খেতে সাধ হয়? খেলে বেশ তৃপ্তি হয়? শরীর বেশ তরতাজা থাকে তো? ধ্যান জপ বা নিজের কাজ কর্ম করতে কোনো ক্লান্তি বা তামসিক ভাব আসে না তো? তাহলে খাবেন মাঝেমধ্যে। ‘যার পেটে যা সয়’—ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি।
লক্ষণীয় যে, আমিষাশীদের কিছুটা উন্নসিকতা আছে নিরামিষীদের প্রতি; কিন্তু তেমন বিদ্বেষ নেই। এদিকে নিরামিষবাদীরা যেন সদাই খড়্গহস্ত, ঘৃণায় সিঁটিয়ে থাকেন আমিষভোজীদের ওপর। নিরামিষ খেলে নাকি হিংসা দ্বেষ থাকে না? শরীর মন ঠান্ডা থাকে? এ কী সত্যিই ধর্মীয় মূল্যবোধ; অথবা অবলা প্রাণীর প্রতি দরদ, নাকি গোপন ঈর্ষা? পারিবারিক সংস্কার বা ধর্মীয় ফরমান বা পরিস্থিতির দাবি বা নেহাত চক্ষুলজ্জার খাতিরে বহুকালের অবদমিত ইচ্ছার বিকার নয় তো?
জাতিসংঘের এক হিসাবমতে, মানুষ খাদ্যের জন্য প্রতি সেকেন্ডে মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী বাদে ২ হাজার প্রাণী হত্যা করে। গরু, ছাগল, উট, দুম্বা, সাপ, ব্যাঙ, ইত্যাদি। আচ্ছা আমিষ আর নিরামিষ খাদ্য নির্ধারিত হয় কীভাবে? প্রাণিজ খাদ্য যদি আমিষ হয়, তাহলে অপ্রাণিজ খাদ্য কোনটি? গাছ বা উদ্ভিদেরও তো প্রাণ আছে? না, এত জটিল ভাবনা ভাবতে ভালো লাগে না। কাটলে বা জবাই করলে রক্ত বের হয় না—সেটা যদি নিরামিষ খাদ্য হয়, তাহলে চিংড়ি কি নিরামিষ? চিংড়ি অবশ্য মাছ নয়, পানি বা জলের পোকা।
এবার একটু অন্য দিকে তাকানো যাক। মানুষের জীবনে খাদ্য যেমন জরুরি, বাঙালির জীবনে তেমনি রাজনীতি। আমাদের খাদ্যতালিকায় ইদানীং আমিষের সঙ্গে নিরামিষের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। সে জন্য রাজনীতিটাও কেমন যেন নিরামিষ হয়ে যাচ্ছে। কোথায় গেল পল্টন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর বড় বড় জনসমাবেশ? আন্দোলন, ঘেরাও, হরতাল, অবরোধ নেই, জ্বালাও-পোড়াও নেই। পুলিশের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ককটেল, গ্রেনেড, বোমা হামলা নেই। আছে রুটিন-মাফিক বক্তৃতা, বিবৃতি, আর পুলিশি ধাওয়া, হামলা-মামলা দিয়ে ঠাসা কিছু সাধারণ রাজনৈতিক কার্যক্রম। এটাও যে খুব বেশি, তা নয়। এতে মন ভরে না। কত আর ওবায়দুল কাদের ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাহাস সহ্য করা যায়?
খাতা-কলমে দেশের কোথাও গণ-আন্দোলনের কারণে সভা-সমিতি-মিছিল করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়নি। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা সব সময়ই বিরোধী দলের আন্দোলন করতে পুলিশকে ব্যবহার করে নিরামিষ আন্দোলনকে আমিষে পরিণত করেন। কিন্তু এখন তাও সম্ভব হচ্ছে না। নিরামিষ দিবস আমাদের সবাইকে নিরামিষাশী বানাতে না পারলেও আমাদের রাজনীতিকে কি নিরামিষ বানিয়ে ফেলল?
পরিশেষে একটি অন্য রকম কথা
নিরামিষ দিবসে বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক কর্মী মনে মনে ভাবলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের খাদ্যতালিকা দেখে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন, তিনি নিরামিষভোজী হবেন কি না। যথা চিন্তা, তথা কাজ। তিনি একজন সরকারপ্রধান পেলেন, যিনি নিরামিষভোজী। নিজ ধর্মের প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধাভক্তি অপরিসীম। তাঁর চেহারাও সাধুসন্তের মতো। তিনি সরকারপ্রধান হয়ে দেশে হিংসার রাজনীতির বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মী স্বস্তি বোধ করলেন এটা ভেবে যে, খাদ্য দিয়ে আসলে মানুষ চেনা যায় না। মানুষ চেনা যায় মানুষের কাজ দিয়ে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
একদিন ভোরবেলা জাকারবার্গ লক্ষ করলেন যে পৃথিবীতে একটা ছোট্ট দেশে তাঁর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা হচ্ছে। সামনের ফ্লোরটায় দেখলেন দেশটা ছোট বটে, কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। আর এই দেশের জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। ফেসবুকে দেখতে পেলেন অসংখ্য বার্তা—সবই রাজনৈতিক এবং ছবিতে এ বিষয়ে বিপুল জনগণের
১০ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৩ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তাদের নেতা-কর্মীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে অসংখ্য আন্দোলনকারীকে হত্যা ও অনেকের জীবন বি
১০ ঘণ্টা আগেবেশ কিছুদিন ধরেই অস্থির হয়ে আছে মোহাম্মদপুর। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপর এই অঞ্চলে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে না থাকায় একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী বাড়িতে বাড়িতে ডাকাতি করতে উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। এলাকাবাসী তখন রাত জেগে নিজেদের এলাকা পাহারা দিয়েছিলেন।
১০ ঘণ্টা আগে৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সংস্কারের আহ্বান শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। সব ক্ষেত্রে। চলচ্চিত্রাঙ্গনেও এই সংস্কারের জোয়ার এসে লেগেছে। জোয়ারের আগে মূলধারার চলচ্চিত্রের লোকজন নানাভাবে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে। অভ্যুত্থান শুরুর পর তাঁদের মনে হয়েছে ভবিষ্যৎ বুঝি অন্ধকারে প্রবেশ করতে যাচ্
১ দিন আগে