অবরুদ্ধ দেশের সাংবাদিকতা
জাহীদ রেজা নূর
তথ্যের অফুরন্ত ভান্ডার থাকা সত্ত্বেও আজ লেখাটির ইতি টানব। আশা করব, ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্মের কেউ একজন আমার হাত থেকে রিলে রেসের ব্যাটনটি তুলে নেবেন এবং ইতিহাসের এই স্বল্প আলোকপাত করা বিষয়টি নিয়ে গভীর গবেষণা করবেন।
কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী এখন বলার চেষ্টা করছেন, একাত্তরে শহীদ হওয়া ছাড়া বুদ্ধিজীবীদের কোনো অবদান নেই। যাঁরা এসব কথা বলছেন, তাঁরা প্রতিভাবান মানুষ বটে, কিন্তু তাঁরা মনে করে থাকেন, যা খুশি বলার লাইসেন্স রয়েছে তাঁদের। গায়ের জোরে মিথ্যাকে সত্য ও সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করতেও এঁদের বাধে না। এঁরা মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী নেতৃত্বের কারণে নাখোশ হয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নতুন বয়ান তৈরি করতে গিয়ে তথ্য-উপাত্ত উপেক্ষা করে নিজেদের মতো করে খোশগল্প তৈরি করতে চাইছেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী চৈনিক বাম, জামায়াতে ইসলামীসহ অনেক দলের লোকজনই এই যজ্ঞে শামিল হয়েছেন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা যেভাবে বাড়তে থাকে, তাতে স্রোতের খড়ের মতো ভেসে গিয়েছিলেন অন্য দলগুলোর বড় নেতারা। ‘এক নেতা এক দেশ—বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’ স্লোগানটার জন্ম এমনি এমনি হয়নি। সে সময়কার দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে খোঁজ করলেই জানা যাবে, আওয়ামী লীগ সে সময় রাজনীতির কোন উচ্চতায় পৌঁছেছিল।
আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলগুলোয় অনেক ভুল করেছে, বঙ্গবন্ধুকে বড় করতে গিয়ে অন্যদের অবদানকে খাটো করেছে, সেটা সত্য, সেই আলোচনাও হতে হবে। কিন্তু ১৯৭১ সাল নিয়ে চৈনিক বাম বা জামায়াতি রূপকথার কাছে আগামী প্রজন্ম পরাজিত হবে—এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই।
এ কথাও মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা লাভের পর যে দলগুলো ক্ষমতায় এসেছে, সেই দলগুলোই ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে এবং মেয়াদের সময় অনুযায়ী যেটুকু সম্ভব স্বৈরাচার হয়ে উঠেছে। জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্রশিবির ক্ষমতার পরশ পেয়ে এবং না পেয়েও যে নৃশংসতা চালিয়েছে, সে কথাও মনে রাখতে হবে। ফ্যাসিবাদ ঠেকাতে একের পর এক নব্য ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে এ দেশে, যা দেশের জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। সুতরাং কোনো একদিন এই বিষয়গুলোও গবেষণায় উঠে আসা দরকার।
১৯৭১ সালের অবরুদ্ধ নগরীর ভয়ার্ত পরিবেশে সাংবাদিকেরা কীভাবে নিরন্তর সংবাদ প্রচার করার দায়িত্ব পালন করেছেন, তার কিছু নমুনা এই ধারাবাহিক লেখায় দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আজ দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংগ্রামের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ে কিছু কথা বলা হবে। যাঁরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া ছাড়া বৃদ্ধিজীবীদের আর কোনো অবদান নেই বলে বয়ান তৈরি করছেন, তাঁদের গালে এ হবে এক বিশাল থাপ্পড়।
জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পাকিস্তানের পক্ষে লিখে গেছে একাত্তরজুড়ে। তাদের লেখাতেই পাকিস্তানি দালালদের কর্মকাণ্ডের বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। একাত্তরের সংগ্রাম পত্রিকা অনুসরণ করলেই পাকিস্তান-দরদি বাঙালিদের চরিত্রের ব্যাখ্যা করতে পারবেন সচেতন পাঠক। একবিংশ শতাব্দীর নতুন মানুষেরা সেই সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে দালালি মানসিকতার নমুনা পেতে পারেন।
সিরাজুদ্দীন হোসেন ১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ শিরোনামে একটি রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখেছিলেন। কী ছিল সেই নিবন্ধে? সিরাজুদ্দীন হোসেন সেই নিবন্ধে প্রমাণ করেছিলেন, যে বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই বিচ্ছিন্নতাবাদী বয়ান পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডেই প্রতিফলিত হচ্ছে। তাহলে শুধু আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করা কেন?
নিবন্ধের কয়েকটি চুম্বক জায়গা তুলে ধরা যাক।
‘বিগত নির্বাচন প্রমাণ করিয়াছে যে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনই দেশপ্রেমের সুনিশ্চিত সার্টিফিকেট নয়। কথাটি বলিয়াছেন জামায়াতে ইসলামীর অস্থায়ী আমির মিয়া তোফায়েল। বলা বাহুল্য, কথাটি তিনি বলিয়াছেন পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলির প্রতি ইঙ্গিত করিয়া। স্বভাবতই আশা করা গিয়াছিল, এবার পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকদের নিকট হইতে প্রকৃত দেশপ্রেম সম্পর্কে দেশবাসী অনেক কিছু শিখিতে পারিবে এবং এই “দেশপ্রেমিক রাজনীতিক”রাই দেশকে বর্তমান সংকট-সন্ধিক্ষণ হইতে মুক্ত করিয়া দেশবাসীর সামনে একটি উজ্জ্বল নজির প্রতিষ্ঠা করিবেন। কিন্তু বিগত কয়েক মাসে আইনসিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর কথাবার্তা ও চালচলনে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের যে চেহারা দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে দেশের শুভাকাঙ্ক্ষীমাত্রেই প্রমাদ না গুনিয়া পারেন না।’
... ‘দেশবাসী মুখ না খুলিলেও রাজনীতিকেরা যে নিয়মে আজ মুখ খুলিয়াছেন, তাহাতে “দেশপ্রেমিক রাজনীতিক” বলিতে দেশে আজ কে আছেন, এই প্রশ্নই আজ বড় হইয়া দেখা দিতেছে।
‘সামান্য স্মৃতিচারণা করিলেই দেখা যাইবে কাইয়ুম লীগ প্রধান জনাব আবদুল কাইয়ুম খানই রাজনীতিকদের দেশপ্রেমের প্রশ্নে সর্বাধিক প্রগলভ। পূর্বাঞ্চলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দেশপ্রেমের অভাবই সব অনর্থের মূল জানিয়াই জনাব কাইয়ুম প্রমুখ আগাইয়া আসিয়াছেন দেশের সংকট মুক্তির পথনির্দেশ করিতে।’
নিবন্ধটির পরতে পরতে প্রমাণ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ছাড়াও পাকিস্তানের উভয় অংশের রাজনৈতিক দলগুলোও একে অন্যের ব্যাপারে বিচ্ছিন্নতাবাদেরই অভিযোগ আনছে। কিংবা নিজেরা ছাড়া আর কেউ দেশপ্রেমী নয়, সে কথা প্রমাণ করতে চাইছে।
সেটা বোঝার জন্য সংবাদ প্রতিবেদনের আরও কিছু অংশ তুলে ধরছি:
‘...নাম করিয়া না বলিলেও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য দল সম্পর্কে তার বক্তব্য রহিয়াছে। তার মতে, “পাখতুনিস্তান”, “জিয়ে সিন্ধ”, “বৃহত্তর বেলুচিস্তান”, এবং “ছয় দফা পাঞ্জাবের জন্য কল্যাণকর”—পাঞ্জাবের একশ্রেণির রাজনীতিকের এ ধরনের চিন্তাধারা “বাংলাদেশ” স্লোগানের মতোই পাকিস্তানের মৌলিক আদর্শের পরিপন্থী।’ তার মতে, ‘পশ্চিম পাকিস্তানেও এমন দল ও লোক রহিয়াছে, বিদেশের সহিত যাহাদের যোগসাজশ রহিয়াছে এবং তাহাদের অর্থানুকূল্যেই তাহারা লালিত (রাওয়ালপিন্ডি, ২৬ জুন)।
‘...জনাব ভুট্টোর মতে, ‘যেহেতু সিন্ধু পাকিস্তানেরই অংশ, সেইহেতু “জিয়ে সিন্ধ” স্লোগান তোলার অধিকার ছাত্রদের রহিয়াছে এবং এই উত্তোলন হইতে কেহই তাহাদিগকে বিরত করিতে পারেন না।’ (শুক্কুর, ১০ সেপ্টেম্বর)।
মুসলিম লীগ নেতাদের সম্পর্কে জনাব ভুট্টোর বিস্ময়ের কারণ হইল, ‘সেই একই মুসলিম লীগ নেতারা, যারা অন্যান্য স্বার্থের পাবন্দি করিয়া সব সময়ে পাকিস্তানের স্বার্থ বিপর্যস্ত করিয়া আসিয়াছেন, তাহারা কি করিয়া জাতীয় আদর্শ সংরক্ষণ করিবেন তাহা তিনি ভাবিয়া পান না। (করাচি, ১১ আগস্ট)।
অন্যদিকে, কাউন্সিল লীগ নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানার মতে, পশ্চিম পাকিস্তানেও রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিদের অবশ্যই দমন করা দরকার। ইহারা এখনো সমানে সক্রিয় রহিয়াছে এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পক্ষে সব সময়েই বিপদের কারণ হিসেবে বিরাজ করিতেছে।’ (নবাব শাহ, ২১ আগস্ট)
তাঁর মতে, ‘যাহারা দেশের সমাজতান্ত্রিক অথবা অন্য কোনো বিদেশি জীবনপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করিতে চান, উহাদের অন্য দেশে হিজরত করিতে হইবে। কেননা, পাকিস্তানে তাদের স্থান নাই। (শিয়ালকোট ৩০ জুলাই)।
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের নেতা (হাজারভী গ্রুপ) মুফতি মাহমুদের মতে, ‘যেসব দল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করিয়াছে এবং এখনো করিতেছে, তাহাদিগকে বেআইনি ঘোষণা করিতে হইবে’ (১৪ মে)। খান কাইয়ুমের মতে অবশ্য ‘জমিয়ত নেতারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করিয়াছেন এবং সেই চিন্তাধারা তারা আজও বিসর্জন দেন নাই।’
জামায়াতে ইসলামীর নেতা জাতীয় পরিষদ সদস্য করাচির আব্দুল গফুর ও মাহমুদ আজম ফারুকী অবশ্য চান, সরকার অবিলম্বে পিপিপির গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে তদন্তের ব্যবস্থা করুন এবং ভুট্টো ও অন্যান্য পিপিপি নেতার বিরুদ্ধে সামরিক বিধিমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। (করাচি ১১ জুলাই)।
সিরাজুদ্দীন হোসেন তাঁর এই লেখায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তাতে দেখা যায় যে এরা একে অন্যকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলছে অথবা বিদেশের ষড়যন্ত্রের অংশী হিসেবে তাদের দায়ী করছে। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কোনো কথা না বলেও তিনি বলে দিয়েছেন, যে কারণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে সেই একই অভিযোগ আনছে। তাই সিরাজুদ্দীন হোসেন নিবন্ধটি শেষ করেছেন এই কথা বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা-উত্তর দেশের “দেশপ্রেমিক” রাজনীতিক মহলের ইহাই হইল চেহারা।’
সিরাজুদ্দীন হোসেনের ঊর্ধ্ব কমার ব্যবহার লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, তিনি পাকিস্তানের ‘দেশপ্রেমিক’ রাজনীতিবিদদের কীভাবে বিদ্রূপ করছেন।
এরই প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাদের পত্রিকায়। সেখানে সরাসরি ইত্তেফাককে হুমকি দেওয়া হয়। নিবন্ধটি তারা শেষ করেছিল এই কথা বলে, ‘...তাই আপামর জনতার আজকের দাবি হচ্ছে, ঠগ বাছতে গিয়ে গাঁ উজাড় হয়েও যদি দেশ বাঁচে, তবুও ভালো।’
জামায়াতে ইসলামী যে দেশকে বাঁচাতে চেয়েছিল, সে দেশ আর সেভাবে বাঁচেনি। নতুন দেশ বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এবং সেই বাংলাদেশ জন্মের সমস্ত যন্ত্রণা বুকে করে নিয়ে শহীদ হয়েছেন সেই সাংবাদিকেরা, যাঁদের রক্তে তৈরি হয়েছে একটি মানচিত্র।
নতুন প্রজন্মের তরুণেরা সেই ইতিহাসের কাছেই ফিরে যাবে বলে আমি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
তথ্যের অফুরন্ত ভান্ডার থাকা সত্ত্বেও আজ লেখাটির ইতি টানব। আশা করব, ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্মের কেউ একজন আমার হাত থেকে রিলে রেসের ব্যাটনটি তুলে নেবেন এবং ইতিহাসের এই স্বল্প আলোকপাত করা বিষয়টি নিয়ে গভীর গবেষণা করবেন।
কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী এখন বলার চেষ্টা করছেন, একাত্তরে শহীদ হওয়া ছাড়া বুদ্ধিজীবীদের কোনো অবদান নেই। যাঁরা এসব কথা বলছেন, তাঁরা প্রতিভাবান মানুষ বটে, কিন্তু তাঁরা মনে করে থাকেন, যা খুশি বলার লাইসেন্স রয়েছে তাঁদের। গায়ের জোরে মিথ্যাকে সত্য ও সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করতেও এঁদের বাধে না। এঁরা মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী নেতৃত্বের কারণে নাখোশ হয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নতুন বয়ান তৈরি করতে গিয়ে তথ্য-উপাত্ত উপেক্ষা করে নিজেদের মতো করে খোশগল্প তৈরি করতে চাইছেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী চৈনিক বাম, জামায়াতে ইসলামীসহ অনেক দলের লোকজনই এই যজ্ঞে শামিল হয়েছেন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা যেভাবে বাড়তে থাকে, তাতে স্রোতের খড়ের মতো ভেসে গিয়েছিলেন অন্য দলগুলোর বড় নেতারা। ‘এক নেতা এক দেশ—বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’ স্লোগানটার জন্ম এমনি এমনি হয়নি। সে সময়কার দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে খোঁজ করলেই জানা যাবে, আওয়ামী লীগ সে সময় রাজনীতির কোন উচ্চতায় পৌঁছেছিল।
আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলগুলোয় অনেক ভুল করেছে, বঙ্গবন্ধুকে বড় করতে গিয়ে অন্যদের অবদানকে খাটো করেছে, সেটা সত্য, সেই আলোচনাও হতে হবে। কিন্তু ১৯৭১ সাল নিয়ে চৈনিক বাম বা জামায়াতি রূপকথার কাছে আগামী প্রজন্ম পরাজিত হবে—এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই।
এ কথাও মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা লাভের পর যে দলগুলো ক্ষমতায় এসেছে, সেই দলগুলোই ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে এবং মেয়াদের সময় অনুযায়ী যেটুকু সম্ভব স্বৈরাচার হয়ে উঠেছে। জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্রশিবির ক্ষমতার পরশ পেয়ে এবং না পেয়েও যে নৃশংসতা চালিয়েছে, সে কথাও মনে রাখতে হবে। ফ্যাসিবাদ ঠেকাতে একের পর এক নব্য ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে এ দেশে, যা দেশের জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। সুতরাং কোনো একদিন এই বিষয়গুলোও গবেষণায় উঠে আসা দরকার।
১৯৭১ সালের অবরুদ্ধ নগরীর ভয়ার্ত পরিবেশে সাংবাদিকেরা কীভাবে নিরন্তর সংবাদ প্রচার করার দায়িত্ব পালন করেছেন, তার কিছু নমুনা এই ধারাবাহিক লেখায় দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আজ দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংগ্রামের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ে কিছু কথা বলা হবে। যাঁরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া ছাড়া বৃদ্ধিজীবীদের আর কোনো অবদান নেই বলে বয়ান তৈরি করছেন, তাঁদের গালে এ হবে এক বিশাল থাপ্পড়।
জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পাকিস্তানের পক্ষে লিখে গেছে একাত্তরজুড়ে। তাদের লেখাতেই পাকিস্তানি দালালদের কর্মকাণ্ডের বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। একাত্তরের সংগ্রাম পত্রিকা অনুসরণ করলেই পাকিস্তান-দরদি বাঙালিদের চরিত্রের ব্যাখ্যা করতে পারবেন সচেতন পাঠক। একবিংশ শতাব্দীর নতুন মানুষেরা সেই সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে দালালি মানসিকতার নমুনা পেতে পারেন।
সিরাজুদ্দীন হোসেন ১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ শিরোনামে একটি রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখেছিলেন। কী ছিল সেই নিবন্ধে? সিরাজুদ্দীন হোসেন সেই নিবন্ধে প্রমাণ করেছিলেন, যে বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই বিচ্ছিন্নতাবাদী বয়ান পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডেই প্রতিফলিত হচ্ছে। তাহলে শুধু আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করা কেন?
নিবন্ধের কয়েকটি চুম্বক জায়গা তুলে ধরা যাক।
‘বিগত নির্বাচন প্রমাণ করিয়াছে যে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনই দেশপ্রেমের সুনিশ্চিত সার্টিফিকেট নয়। কথাটি বলিয়াছেন জামায়াতে ইসলামীর অস্থায়ী আমির মিয়া তোফায়েল। বলা বাহুল্য, কথাটি তিনি বলিয়াছেন পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলির প্রতি ইঙ্গিত করিয়া। স্বভাবতই আশা করা গিয়াছিল, এবার পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকদের নিকট হইতে প্রকৃত দেশপ্রেম সম্পর্কে দেশবাসী অনেক কিছু শিখিতে পারিবে এবং এই “দেশপ্রেমিক রাজনীতিক”রাই দেশকে বর্তমান সংকট-সন্ধিক্ষণ হইতে মুক্ত করিয়া দেশবাসীর সামনে একটি উজ্জ্বল নজির প্রতিষ্ঠা করিবেন। কিন্তু বিগত কয়েক মাসে আইনসিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর কথাবার্তা ও চালচলনে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের যে চেহারা দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে দেশের শুভাকাঙ্ক্ষীমাত্রেই প্রমাদ না গুনিয়া পারেন না।’
... ‘দেশবাসী মুখ না খুলিলেও রাজনীতিকেরা যে নিয়মে আজ মুখ খুলিয়াছেন, তাহাতে “দেশপ্রেমিক রাজনীতিক” বলিতে দেশে আজ কে আছেন, এই প্রশ্নই আজ বড় হইয়া দেখা দিতেছে।
‘সামান্য স্মৃতিচারণা করিলেই দেখা যাইবে কাইয়ুম লীগ প্রধান জনাব আবদুল কাইয়ুম খানই রাজনীতিকদের দেশপ্রেমের প্রশ্নে সর্বাধিক প্রগলভ। পূর্বাঞ্চলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দেশপ্রেমের অভাবই সব অনর্থের মূল জানিয়াই জনাব কাইয়ুম প্রমুখ আগাইয়া আসিয়াছেন দেশের সংকট মুক্তির পথনির্দেশ করিতে।’
নিবন্ধটির পরতে পরতে প্রমাণ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ছাড়াও পাকিস্তানের উভয় অংশের রাজনৈতিক দলগুলোও একে অন্যের ব্যাপারে বিচ্ছিন্নতাবাদেরই অভিযোগ আনছে। কিংবা নিজেরা ছাড়া আর কেউ দেশপ্রেমী নয়, সে কথা প্রমাণ করতে চাইছে।
সেটা বোঝার জন্য সংবাদ প্রতিবেদনের আরও কিছু অংশ তুলে ধরছি:
‘...নাম করিয়া না বলিলেও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য দল সম্পর্কে তার বক্তব্য রহিয়াছে। তার মতে, “পাখতুনিস্তান”, “জিয়ে সিন্ধ”, “বৃহত্তর বেলুচিস্তান”, এবং “ছয় দফা পাঞ্জাবের জন্য কল্যাণকর”—পাঞ্জাবের একশ্রেণির রাজনীতিকের এ ধরনের চিন্তাধারা “বাংলাদেশ” স্লোগানের মতোই পাকিস্তানের মৌলিক আদর্শের পরিপন্থী।’ তার মতে, ‘পশ্চিম পাকিস্তানেও এমন দল ও লোক রহিয়াছে, বিদেশের সহিত যাহাদের যোগসাজশ রহিয়াছে এবং তাহাদের অর্থানুকূল্যেই তাহারা লালিত (রাওয়ালপিন্ডি, ২৬ জুন)।
‘...জনাব ভুট্টোর মতে, ‘যেহেতু সিন্ধু পাকিস্তানেরই অংশ, সেইহেতু “জিয়ে সিন্ধ” স্লোগান তোলার অধিকার ছাত্রদের রহিয়াছে এবং এই উত্তোলন হইতে কেহই তাহাদিগকে বিরত করিতে পারেন না।’ (শুক্কুর, ১০ সেপ্টেম্বর)।
মুসলিম লীগ নেতাদের সম্পর্কে জনাব ভুট্টোর বিস্ময়ের কারণ হইল, ‘সেই একই মুসলিম লীগ নেতারা, যারা অন্যান্য স্বার্থের পাবন্দি করিয়া সব সময়ে পাকিস্তানের স্বার্থ বিপর্যস্ত করিয়া আসিয়াছেন, তাহারা কি করিয়া জাতীয় আদর্শ সংরক্ষণ করিবেন তাহা তিনি ভাবিয়া পান না। (করাচি, ১১ আগস্ট)।
অন্যদিকে, কাউন্সিল লীগ নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানার মতে, পশ্চিম পাকিস্তানেও রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিদের অবশ্যই দমন করা দরকার। ইহারা এখনো সমানে সক্রিয় রহিয়াছে এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পক্ষে সব সময়েই বিপদের কারণ হিসেবে বিরাজ করিতেছে।’ (নবাব শাহ, ২১ আগস্ট)
তাঁর মতে, ‘যাহারা দেশের সমাজতান্ত্রিক অথবা অন্য কোনো বিদেশি জীবনপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করিতে চান, উহাদের অন্য দেশে হিজরত করিতে হইবে। কেননা, পাকিস্তানে তাদের স্থান নাই। (শিয়ালকোট ৩০ জুলাই)।
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের নেতা (হাজারভী গ্রুপ) মুফতি মাহমুদের মতে, ‘যেসব দল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করিয়াছে এবং এখনো করিতেছে, তাহাদিগকে বেআইনি ঘোষণা করিতে হইবে’ (১৪ মে)। খান কাইয়ুমের মতে অবশ্য ‘জমিয়ত নেতারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করিয়াছেন এবং সেই চিন্তাধারা তারা আজও বিসর্জন দেন নাই।’
জামায়াতে ইসলামীর নেতা জাতীয় পরিষদ সদস্য করাচির আব্দুল গফুর ও মাহমুদ আজম ফারুকী অবশ্য চান, সরকার অবিলম্বে পিপিপির গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে তদন্তের ব্যবস্থা করুন এবং ভুট্টো ও অন্যান্য পিপিপি নেতার বিরুদ্ধে সামরিক বিধিমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। (করাচি ১১ জুলাই)।
সিরাজুদ্দীন হোসেন তাঁর এই লেখায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তাতে দেখা যায় যে এরা একে অন্যকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলছে অথবা বিদেশের ষড়যন্ত্রের অংশী হিসেবে তাদের দায়ী করছে। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কোনো কথা না বলেও তিনি বলে দিয়েছেন, যে কারণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে সেই একই অভিযোগ আনছে। তাই সিরাজুদ্দীন হোসেন নিবন্ধটি শেষ করেছেন এই কথা বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা-উত্তর দেশের “দেশপ্রেমিক” রাজনীতিক মহলের ইহাই হইল চেহারা।’
সিরাজুদ্দীন হোসেনের ঊর্ধ্ব কমার ব্যবহার লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, তিনি পাকিস্তানের ‘দেশপ্রেমিক’ রাজনীতিবিদদের কীভাবে বিদ্রূপ করছেন।
এরই প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাদের পত্রিকায়। সেখানে সরাসরি ইত্তেফাককে হুমকি দেওয়া হয়। নিবন্ধটি তারা শেষ করেছিল এই কথা বলে, ‘...তাই আপামর জনতার আজকের দাবি হচ্ছে, ঠগ বাছতে গিয়ে গাঁ উজাড় হয়েও যদি দেশ বাঁচে, তবুও ভালো।’
জামায়াতে ইসলামী যে দেশকে বাঁচাতে চেয়েছিল, সে দেশ আর সেভাবে বাঁচেনি। নতুন দেশ বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এবং সেই বাংলাদেশ জন্মের সমস্ত যন্ত্রণা বুকে করে নিয়ে শহীদ হয়েছেন সেই সাংবাদিকেরা, যাঁদের রক্তে তৈরি হয়েছে একটি মানচিত্র।
নতুন প্রজন্মের তরুণেরা সেই ইতিহাসের কাছেই ফিরে যাবে বলে আমি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিজয় দিবস এক অনন্য দিন। স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের সব দিন সমান গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিজয় দিবস সবচেয়ে বেশি গৌরবের। কেন জানি না, দিনটি তেমনভাবে উদ্যাপিত হয় না। তেমন আলোড়নও দেখি না, যা সত্যিকার অর্থে ছিল বিজয়ের প্রাপ্য। অথচ আমি এমন দুজন বিদেশির কথা জানি, যাঁরা আমার সঙ্গে...
৮ ঘণ্টা আগেবিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রতিবছর উদ্যাপনের যেমন উদ্যোগ-আয়োজন দেখা যায়, এবার তেমন দেখা যায়নি। আমার কাছে অন্তত তা-ই মনে হয়েছে। গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পালাবদল কি সত্যি আমাদের চিন্তাচেতনায় বড় পরিবর্তন এনেছে? গণতন্ত্রের ঢং দেখিয়ে টানা ক্ষমতায় থাকা শাসকগোষ্ঠীকে পরাভূত করা নিশ্চয়ই গৌরবের। কিন্তু সে গৌরব কি...
৮ ঘণ্টা আগে১৯ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কে এক মাতাল চালকের গাড়ির ধাক্কায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী মুহতাসিম মাসুদ নিহত হন। আহত হন মেহেদী হাসান খান ও অমিত সাহা নামের বুয়েটের সিএসই বিভাগের আরও দুই শিক্ষার্থী। মেহেদী রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে এবং অমিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ
৮ ঘণ্টা আগে১৫ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বলার চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দরকার। ফ্যাসিবাদী কাঠামো থেকে বের হওয়ার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত খুব প্রয়োজন। সেই বন্দোবস্তের রূপরেখাটা কেমন হবে, সেটা নিয়ে বহু বছর ধরে কথা হচ্ছে।
১ দিন আগে