বিজন সাহা
অনেক দিন আগে বন্ধু পেনকভ বলেছিল, যদি আমেরিকান, ভারতীয়, বাংলাদেশি—এসব ‘তুমি কে’ সেই প্রশ্নের উত্তর হয়, তাহলে রুস্কি—এটা শুধু ‘কে’ নয়, ‘কেমন’ সেই প্রশ্নেরও উত্তর। মানে রুস্কি শুধু জাতি, দেশ—এসবের সাথেই সম্পর্কিত নয়। এটা মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। রুস্কি চেলাভেক—রুশ মানুষ; এটা এক ধরনের বিশেষ মনোভাবের মানুষ। এ জন্যই হয়তো বলে রাশিয়াকে বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না।
আজ দু মাসের বেশি যুদ্ধ চলছে। কিন্তু লোকজনের মধ্যে তেমন উত্তেজনা নেই। সবাই কাজকর্ম করছে। অফিসে এ নিয়ে তেমন কথা হয় না। সাঁতার কাটতে গিয়ে সুইমিং পুলে, সাওনায় অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। তবে যুদ্ধ নিয়ে তেমন কোনো কথা হয় না। রাস্তাঘাট, দোকানপাট—সব একই রকম। তবে হাজার হাজার শরণার্থী আসছে। সবাই যে যেভাবে পারছে সাহায্য করছে। আমি কয়েক ব্যাগ ভর্তি জামাকাপড়, জুতা, জ্যাকেট—এসব দিয়ে এসেছি। মানে মানুষের অংশগ্রহণ যে নেই, তা নয়। আসলে এ দেশের মানুষ এমনই। সাধারণত কারও ব্যাপারে নাক গলায় না, কাউকে পছন্দ না হলে সেটা বুঝতে দেয়। আমাদের মতো ‘মুখে হাসি মনে বিষ’—এমন নয়। সরকারকে নিয়েও এদের তেমন মাথা ব্যথা নেই। জানে নিজেরটা নিজেরই করে খেতে হবে।
তবে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখব, এরা শক্ত হাত পছন্দ করে। আগেই লিখেছি এরা নিজে থেকেই নভগোরাদের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাজা রিউরিককে ডেকে এনে নিজেদের নেতা করে। পরবর্তীতে এই বংশের পতন ঘটলে নিজেরা পঝারস্কি ও কুজমা মিনিনের নেতৃত্বে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পোল্যান্ডের হাত থেকে দেশ মুক্ত করে রোমানভ বংশের পত্তন ঘটায়। গণতান্ত্রিক না হলেও কী রিউরিক, কী মিখাইল রোমানভ—জনগণ দ্বারাই নির্বাচিত। আগেই বলেছি, যখনই এ দেশে শক্তিশালী নেতার আবির্ভাব ঘটেছে—এ দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। এরা শক্ত হাতে ক্ষমতার ভার দিয়ে নিজেদের কাজে নেমে পড়ে। সোভিয়েত আমলেও ভিন্ন কিছু ছিল না। তবে একটা ব্যাপারে এরা এক–দেশ যখন বিদেশি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়, এরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সোভিয়েত আমলে চার্চের ওপর শত অত্যাচারের পরও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চ যুদ্ধে নামে। এরা এসব যুদ্ধকে বলে মহান পিতৃভূমির যুদ্ধ। এরা নেতাদের সব দোষ ক্ষমা করতে পারে; কিন্তু পরাজয় ক্ষমা করতে পারে না। এই দেশের ওপর, এ দেশের নেতৃত্বের ওপর যত বেশি বাইরের চাপ আসে, তত বেশি এরা নেতার পেছনে এককাট্টা হয়ে দাঁড়ায়। সেটা দেখেছি স্তালিনের সময়; ক্যারিবিয়ান সংকটে। আবার কোনো নেতার প্রতি বাইরের দেশ খুব বেশি সদয় হলে এরা তাদের সন্দেহ করে। নিকট অতীতে এমনটা ঘটেছে গর্বাচভের সঙ্গে, ইয়েলৎসিনের সঙ্গে। কিন্তু যখনই প্রিমাকভ আটলান্টিকের মাঝপথ থেকে বিমান ঘুরিয়েছেন বা রুশ সেনারা ন্যাটোর আগে প্রিস্টিনা বিমানবন্দর দখল করেছে; দেশের মানুষ সেটাকে সমর্থন করেছে। রুশদের সাইকোলজি বুঝতে পশ্চিমের ব্যর্থতাই বারবার তাদের নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ ব্যর্থ করে দিচ্ছে। আসলে আমাদের দেশে যদি পাপ-পুণ্য, পশ্চিমা বিশ্বে আইনসংগত-বেআইনি—এসব ধারণা জনগণের চিন্তায় প্রথম সারিতে থাকে। এদের ক্ষেত্রে সেটা ন্যায়-অন্যায়। আর এ কারণেই হয়তো পশ্চিমা বিশ্বের মানবতার মুখোশ এরা বারবার খুলে দিচ্ছে, আর সেখান থেকে বারবার বেরিয়ে আসছে মধ্যযুগীয় জানোয়ার।
যুদ্ধ শুরুর পর শিল্পী, অভিনেতাসহ অনেক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব রাশিয়া ত্যাগ করেছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন মত আছে। তবে তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের ডাক ক্রেমলিন খারিজ করে দিয়েছে। আসলে এই যুদ্ধের পর সমাজে মেরুকরণ ঘটেছে, সবার মুখোশ খুলে গেছে। এখানে আমার চিন্তা-ভাবনা এমন। আমি নিজে দেশের বাইরে ১৯৮৩ থেকে। এ রকম অনেক লোককে জানি, যারা দেশের বাইরে থাকেন। কিন্তু এরা সত্যিকার অর্থেই হৃদয়ে বাংলাদেশ ধারণ করেন। তারা দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবেন, এর সুখে সুখী, দুঃখে দুঃখী হন। এদের অনেকেই দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখেন। আবার অনেকেই আছে, যারা দেশে বাস করেন, উপার্জন করেন, আর অর্থ পাচার করেন উন্নত বিশ্বে। এরা আর যাই হোক দেশ নিয়ে ভাবে না, দেশ তাদের জন্য উপার্জনের জায়গা। একইভাবে আজ যারা রাশিয়া থেকে চলে যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই এই দেশে উপার্জন করতেন, আর শপিং করতেন মিলান, প্যারিস, লন্ডন ও নিউইয়র্কে। এদের অনেকেই এ দেশের মানুষের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করতেন না। অনেকেই সরকারি অনুদান পেতেন। তাই এদের অনুপস্থিতি রাশিয়া খুব একটা অনুভব করবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এরা কি পারবে নিজেদের সেখানে মানিয়ে নিতে? তাদের পণ্যের মূল ক্রেতা ছিল রুশ জনগণ। এসব শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতারা ওখানে কী করবেন? বর্তমানে যুদ্ধের কারণে হয়তো সেসব দেশে ফ্লোর পাবেন, কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। তখন? তা ছাড়া এখন যেভাবে রুশোফোবিয়া পশ্চিমা বিশ্বে শেকড় গেড়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ সেখানে তাদের কতটা গ্রহণ করবে সেটাও ভাবার বিষয়।
বর্তমানে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যত কম কার্যকর হচ্ছে, ন্যাটো ততই আগ্রাসী হচ্ছে। নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে, নতুন নতুন অস্ত্র পাঠাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য যুদ্ধ যত দূর সম্ভব দীর্ঘায়িত করা। তবে এতে যে শুধু রাশিয়াই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নয়। ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। তখন দেখা যাবে, কার সহ্যশক্তি কত বেশি। আর তার ওপরই নির্ভর করবে যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র রাখঢাক না করেই স্বীকার করছে, তারা বিগত বছরগুলোতে ইউক্রেনের সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার। আজোভ ব্যাটালিয়নের যারা ধরা পড়ছে, নাম শুনে মনে হয় তাদের অধিকাংশই জাতিগতভাবে রুশ। তবে যুদ্ধ না করে যারা আত্মসমর্পণ করছে, তাদের বেশির ভাগই পশ্চিম ইউক্রেনের। কেন? আসলে পশ্চিম ইউক্রেনের লোকেরা কখনোই তেমন একটা যুদ্ধ করেনি। তারা সব সময়ই যখন যে রাজা এসেছে, তাদের আনুগত্য স্বীকার করেছে। ফলে তারা পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ইউরোপে।
এমনও শুনেছি পূর্ব ইউক্রেন থেকে যারা পালিয়ে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে, পশ্চিম ইউক্রেনের লোকেরা তাদের কাছে বাসা ভাড়া দিয়ে নিজেরা ইউরোপের দিকে যাচ্ছে। আর এদের অনেকেই, বিশেষ করে এলিটদের অনেকেই পালিয়ে যাচ্ছে বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করে। এমন অনেকে ধরা পড়েছে হাঙ্গেরি, রোমানিয়ার সীমান্তে। পালিয়ে বাঁচাদের তালিকায় রয়েছে সেসব লোকজন, যাদের কথা ছিল দেশের হয়ে যুদ্ধ করার। এ নিয়ে ইউরোপে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তারা ইউরোপে গিয়ে বিভিন্ন অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়েছে। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা যৌনকর্মীর খাতার নাম লেখাতে বাধ্য হচ্ছে। এ নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। এ ছাড়া ইউক্রেনের অনেকেই বিভিন্ন দেশে রুশদের ওপর হামলা করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মদানকারী সোভিয়েত সেনাদের মনুমেন্ট ভাঙচুর করছে। তাই যুদ্ধ হচ্ছে মূলত রুশদের সঙ্গে রুশদের। এভাবেই পশ্চিমা বিশ্ব এদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লাগিয়ে নিজেদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করছে। আত্মসমর্পণ করা ইউক্রেন সেনারা বলছে, আত্মসমর্পণ করলে ওদের মেরে ফেলা হবে বলে ভয় দেখানো হয়েছিল। এখন তারা বুঝতে পারছে, এটাই জীবন বাঁচানোর একমাত্র পথ। তা ছাড়া মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছে বলেও অনেকে জানিয়েছে।
পশ্চিমা বয়ানই কি শেষ কথা
আমরা কথায় কথায় স্বাধীনতার কথা বলি, মুক্ত চিন্তার কথা বলি। আচ্ছা আজ কতটি দেশ স্বাধীন? সত্যের কোনো একক রূপ নেই। একজনের দৃষ্টিতে যা সত্য, অন্যের দৃষ্টিতে তা মিথ্যা হতে পারে। তা ছাড়া পশ্চিমা বয়ানই যে শেষ কথা, তার তো কোনো মানে নেই। এখন এই যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আনা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে। আমি জানি গতকাল কেউ কোনো ঘটনার প্রতিবাদ না করলেও আজ সে অনুরূপ ঘটনার বিরুদ্ধে বলতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়, এর পর থেকে এ ধরনের যেকোনো ঘটনার প্রতিবাদ করা। সবাই জানে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা। যে বাইডেন পুতিনকে খুনি বলছেন, তিনিই ১৯৯২ সালে বেলগ্রাদ আক্রমণের পক্ষে ওকালতি করেন। ইরাক ও লিবিয়ার যুদ্ধেও তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এর প্রতিবাদ করে আজ জেলের ভাত খাচ্ছেন। আজ যে কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে, তার শতগুণ অপরাধে অপরাধী যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু সব সময়ই বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে। এটা আমাদের দেশে কিছু কিছু বিশেষ আসামির মতো। ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাসকারী অনেক বাংলাদেশিকে দেখি দেশে এমন কিছু ঘটলে বিষ উগরে দেন, অথচ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় হজম করে যান, দরকারে হজমি খেয়ে সেটা করেন। এদের দেখে আমি বুঝি, কেন বাংলাদেশের অনেক লোক ভারতে কোনো মুসলমানের ওপর অত্যাচার হলে প্রতিবাদে সোচ্চার হন, অথচ তারাই বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর অত্যাচার দেখেও মুখ খোলে না। ঠিক এর উল্টোটা ঘটে ভারতে; যারা পাকিস্তান বা বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করে, তারা ভারতে মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে। আসলে এটা এক ধরনের মানসিক রোগ, যখন আগে থেকেই ঠিক করা হয় কাদের প্রতি আমরা সহানুভূতিশীল হব, আর কাদের প্রতি নিস্পৃহ।
আচ্ছা কেউ কি মনে করেন, ব্রিটিশেরা ভারতীয়দের পছন্দ করত? আমার তো মনে হয়, তারা হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষ সমস্ত ভারতীয়দের একই রকম অবজ্ঞার চোখে দেখত। কিন্তু কখনো হিন্দুদের, কখনো মুসলমানদের মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করত। ফলাফল—দেশভাগ। তবে তার চেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু। আজ পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের ভালোবেসে নয়, তাদের হাত দিয়ে যত বেশি সম্ভব রুশ হত্যার জন্য। তারা ভালোভাবেই জানে রুশ, বেলারুশ ও ইউক্রেনীয়—এরা প্রায় একই জাতি। এখন তারা মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে এদের বিভক্ত করছে। ডিভাইড অ্যান্ড রুল—এটা তাদের অমূল্য আবিষ্কার।
অনেককেই দেখি, শুধু পুতিন বিরোধিতা থেকে পশ্চিমের সবকিছু জায়েজ করে দেয়। পুতিনের প্রতি বিভিন্ন মনোভাব থাকতেই পারে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যদি অন্ধ ঘৃণা হয়, তাহলে বিপদ। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর অনেক কিছুই অপছন্দ করি। সত্যি বলতে কি আমি কারওই সবকিছু পছন্দ করি না। কারও মধ্যে পছন্দ করার মতো কিছু থাকলে পছন্দ করি, ঘৃণা করার মতো কিছু থাকলে, সেটা করতেও পিছ-পা হই না। আমার কাছে কোনো কিছুর ভালোমন্দ কে করল তার ওপর নির্ভর করে না, কী করল সেটাই বড় কথা।
পুতিনের সবচেয়ে বড় অবদানগুলোর একটি হচ্ছে রাশিয়াকে অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও যে দাঁড়ানো যায়, সেটা দেখানো। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একচ্ছত্র অধিকারী হয়ে ওঠে। কেউই তখন তার প্রতিবাদ করতে পারত না। যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ছিল আইন। তাই বেলগ্রাদ আক্রমণ থেকে শুরু করে সবাই হজম করতে হয়। করবেই-বা না কেন? যদি ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে অসংখ্য মার্কিন ঘাঁটি থাকে, তবে তার কথা না মেনে উপায় আছে? ঠিক এ রকম এক সময়ে ২০০৭ সালে পুতিন মিউনিখে দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করেন। সবাই হেসেছিল। কারণ, রাশিয়া তখন তাদের চোখে ছিল পেট্রল পাম্প। পুতিন সবাইকে দেখিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমত না হয়েও বেঁচে থাকা যায়।
এর অনেক পরে ২০১৫ সালে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কথায় ইউক্রেন সে দেশের প্রসিকিউটর জেনারেলকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তাই শুধু সুযোগ থাকলেই হবে না, সেটা ব্যবহারের মনোবল থাকতে হবে। মতিলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘গান্ধীর সঙ্গে দ্বিমত করার ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি–উই এগ্রিড টু ডিস্যাগ্রি’। আসলে গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র হলো দ্বিমত প্রকাশের অধিকার। কিন্তু এখন আমরা কী দেখি? যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একযোগে রাশিয়ার নিন্দা করতে অস্বীকার করছে, তাদের ওপর নেমে আসছে প্রচণ্ড চাপ। এবার সে যে দেশই হোক—চীন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা যে-ই হোক। এই বিশ্বে কি আমরা বাস করতে চাই? আমার বিশ্বাস যদি এই যুদ্ধে রাশিয়া হারে, তবে যুক্তরাষ্ট্র হবে সেই দানব, যার দুপুরের খাবারের জন্য প্রতিদিন একটা করে দেশ পাঠাতে হবে। তাই এই যুদ্ধ শুধু রাশিয়ার অস্তিত্বের যুদ্ধ নয়, এটা বিশ্বের প্রতিটি দেশের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারের যুদ্ধ। তাই এই যুদ্ধে বিজয়ের কোনোই বিকল্প নেই বলে মনে করছে মস্কো।
নিষেধাজ্ঞায় পশ্চিমও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
যুদ্ধ শুরুর অনেক আগে থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনবরত হুমকি দিয়ে আসছিল। তাদের ধারণা ছিল, কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা দিয়েই রাশিয়ার অর্থনীতিতে ধস নামানো যাবে। যুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে এক ধরনের প্যানিক যে সৃষ্টি হয়নি, তা নয়। সেই এক দিনে মানুষ এক ট্রিলিয়ন রুবল ব্যাংক থেকে নামিয়ে নেয়। তবে এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সবাই সেটা করতে পেরেছে, কোথাও কোথাও লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। একের পর এক বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছু কিছু জিনিস কেনার হিড়িক লাগে। মনে আছে, ওই সময় মেয়ে বলল ও স্যানিটারি প্যাড খুঁজে পাচ্ছে না (একেবারে নেই তা নয়, ও যে কোম্পানির প্যাড ব্যবহার করে সেটা নেই)। আমি দোকানে গিয়ে কিছু কিনে আনলাম, ওয়াইল্ড বেরিতে কিছু অর্ডার দিলাম। মাঝে চিনির অভাব ছিল।
পরে ব্যবসায়ী বন্ধুদের কাছে শুনলাম, যেহেতু প্রথম দিকে ডলারের দাম প্রতিদিন বাড়ছিল, তাই অনেক কোম্পানি ইচ্ছা করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করেনি। পরে অবশ্য অ্যান্টিমনোপলি সংস্থা এসব ধরে প্রচুর জরিমানা করে। এরই মধ্যে ডলারের দাম কম-বেশি স্ট্যাবল হওয়ায় জিনিসপত্র দোকানে ফিরে এসেছে। তবে এটা ঠিক হাইটেকের অনেক জিনিসপত্রের অভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে, কিছুদিন পর যখন স্টক শেষ হয়ে যাবে। মনে আছে, সোভিয়েত আমলে এ দেশে কম্পিউটার আমদানির ওপর বিদেশি নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে বিদেশি শিক্ষার্থীরা তখন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া—এসব দেশ থেকে কম্পিউটার কিনে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিক্রি করত। তাই আমার ধারণা চীন বাদেও অন্য অনেক দেশের মাধ্যমে সেই সমস্যা অনেকটাই সমাধান হবে। মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাদ লাভ খোঁজে। তাই নিষেধাজ্ঞার ফাঁদে পড়ে সরাসরি এ দেশে বিভিন্ন জিনিস রপ্তানি বন্ধ করলেও তারা অলিগলি খুঁজবে। এখনই ইরানের তেলের সাথে রাশিয়ার তেল মিশিয়ে নাকি বিক্রি হচ্ছে!
রাশিয়া এক বিশাল মার্কেট। যেসব কোম্পানি চলে যাচ্ছে, সেসব জায়গা ফাঁকা থাকবে না। ইতিমধ্যে রাশিয়া থেকে চলে যাওয়া প্রায় হাজারখানেক কোম্পানির স্থান দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অনেক দেশি কোম্পানি এত দিন বিদেশি কোম্পানির সাথে পাল্লা দিয়ে হেরে যাচ্ছিল, হেরে যাচ্ছিল চীনের বিভিন্ন কোম্পানি। এখন এরা সেই জায়গা দখল করবে। তবে রুশ ক্রেতা এখন যেহেতু ভালো জিনিসের কদর বোঝে, তাই এসব কোম্পানিকে বাধ্য হয়েই নিজেদের প্রোডাক্টের মান উন্নত করতে হবে।
নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশে যাতে কোনো পণ্যের অভাব না হয়, সে জন্যে সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। এটাকে এরা বলে আমদানি বিকল্প। আশির দশকের পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্তের মতোই এই ইম্পরতোজামেশেনিয়ে বা আমদানি বিকল্প বর্তমান রাশিয়ায় প্রচণ্ড জনপ্রিয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১৪ সাল থেকেই যখন পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিচ্ছিল, তখন থেকেই এখানে শুরু হয় স্বনির্ভর হওয়ার প্রক্রিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সমস্ত কলকারখানা যখন রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে ব্যক্তি মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেই বেসরকারিকরণের মূল লক্ষ্য ছিল এ দেশের শিল্প চিরতরে ধ্বংস করা। সেই প্রক্রিয়ার পরিচালক আনাতলি চুবাইস, যিনি কিছুদিন আগ পর্যন্তও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন, আর যুদ্ধ শুরুর পরপর দেশ ছেড়ে চলে যান; বলেছিলেন, ‘আমাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, সোভিয়েত সমাজ, তার শিল্প—সবকিছু ধ্বংস করা, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর কোনো দিন পুনর্জন্ম নিতে না পারে।’
এর ফল হিসেবে আমরা দেখেছি, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এরা বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল রাশিয়া। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে এখানে শুরু হয় নতুন করে সবকিছু ভেবে দেখা। আর এর সূত্র ধরে কয়েক বছর আগ পর্যন্ত শস্যের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল রাশিয়া আজ অন্যতম প্রধান শস্য রপ্তানিকারক দেশ। সোভিয়েত আমলের শক্তিশালী বিভিন্ন জীবাণু ও ভাইরাস রিসার্চ সেন্টার নতুন উদ্যোগে কাজ শুরু করে। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথিবী পায় করোনার প্রথম ভ্যাকসিন। উড়োজাহাজ তৈরিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পর। কিন্তু নতুন রাশিয়ায় সেটা ধ্বংস হয়ে যায়। ২০১৪ সালের পর থেকে শুরু হয় নতুন করে উড়োজাহাজ উৎপাদন। বর্তমানে রাশিয়ার সিভিল এয়ার পার্কের প্রায় অর্ধেক বোয়িং ও এয়ারবাসের দখলে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর তারা এসব উড়োজাহাজের লিজিং স্থগিত রাখে। ফলে প্রায় এক হাজার উড়োজাহাজ এখন মাটিতে বেকার পড়ে আছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার ফলে এদের নিজ নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারছে না। ফলে পশ্চিমা অনেক লিজিং কোম্পানি বন্ধ হওয়ার পথে।
এদিকে এই সমস্যা সমাধানে রাশিয়া নিজেই উড়োজাহাজ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে সময় লাগবে। তবে সেটা ভবিষ্যতে যেকোনো নিষেধাজ্ঞায় দেশটিকে বাঁচাবে। বাড়তি পাওয়া হিসেবে এর ফলে তৈরি হবে নতুন কর্মস্থান, উড়োজাহাজ নির্মাণের মতো বিষয়গুলো আবার ফিরে আসবে এদের শিক্ষা ব্যবস্থায়। তবে এসব যে খুব সহজে হবে, তা কিন্তু নয়।
সোভিয়েত আমলে রাশিয়ায় প্রায় সব ধরনের ফসলের সিলেকশন হতো। দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশ থেকে কম পয়সায় আমদানির কারণে এখানে সমস্যা দেখা দিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত আগামী মৌসুমের জন্য বীজ সংরক্ষিত আছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বছর দু-এক পর সমস্যায় পড়তে হতে পারে। চীন, ভারত সহায়তা করতে পারে। তবে তবে এরা এখন থেকেই চাইছে জিন পুলের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে। এককথায় যুদ্ধের পাশাপাশি রাশিয়া তার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক—সব ব্যবস্থাকেই ঢেলে সাজাচ্ছে। রুশরা বলে, ‘শান্তি ছিল না, অশান্তি সাহায্য করল’। অনেক দিন ধরে ব্যবসা, বিশেষ করে মধ্যমানের পুঁজির জন্য বেশ কিছু জরুরি আইন এদের সংসদ বা দুমায় পড়ে ছিল, এখন সেগুলো পাস হয়ে গেছে।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
অনেক দিন আগে বন্ধু পেনকভ বলেছিল, যদি আমেরিকান, ভারতীয়, বাংলাদেশি—এসব ‘তুমি কে’ সেই প্রশ্নের উত্তর হয়, তাহলে রুস্কি—এটা শুধু ‘কে’ নয়, ‘কেমন’ সেই প্রশ্নেরও উত্তর। মানে রুস্কি শুধু জাতি, দেশ—এসবের সাথেই সম্পর্কিত নয়। এটা মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। রুস্কি চেলাভেক—রুশ মানুষ; এটা এক ধরনের বিশেষ মনোভাবের মানুষ। এ জন্যই হয়তো বলে রাশিয়াকে বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না।
আজ দু মাসের বেশি যুদ্ধ চলছে। কিন্তু লোকজনের মধ্যে তেমন উত্তেজনা নেই। সবাই কাজকর্ম করছে। অফিসে এ নিয়ে তেমন কথা হয় না। সাঁতার কাটতে গিয়ে সুইমিং পুলে, সাওনায় অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। তবে যুদ্ধ নিয়ে তেমন কোনো কথা হয় না। রাস্তাঘাট, দোকানপাট—সব একই রকম। তবে হাজার হাজার শরণার্থী আসছে। সবাই যে যেভাবে পারছে সাহায্য করছে। আমি কয়েক ব্যাগ ভর্তি জামাকাপড়, জুতা, জ্যাকেট—এসব দিয়ে এসেছি। মানে মানুষের অংশগ্রহণ যে নেই, তা নয়। আসলে এ দেশের মানুষ এমনই। সাধারণত কারও ব্যাপারে নাক গলায় না, কাউকে পছন্দ না হলে সেটা বুঝতে দেয়। আমাদের মতো ‘মুখে হাসি মনে বিষ’—এমন নয়। সরকারকে নিয়েও এদের তেমন মাথা ব্যথা নেই। জানে নিজেরটা নিজেরই করে খেতে হবে।
তবে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখব, এরা শক্ত হাত পছন্দ করে। আগেই লিখেছি এরা নিজে থেকেই নভগোরাদের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাজা রিউরিককে ডেকে এনে নিজেদের নেতা করে। পরবর্তীতে এই বংশের পতন ঘটলে নিজেরা পঝারস্কি ও কুজমা মিনিনের নেতৃত্বে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পোল্যান্ডের হাত থেকে দেশ মুক্ত করে রোমানভ বংশের পত্তন ঘটায়। গণতান্ত্রিক না হলেও কী রিউরিক, কী মিখাইল রোমানভ—জনগণ দ্বারাই নির্বাচিত। আগেই বলেছি, যখনই এ দেশে শক্তিশালী নেতার আবির্ভাব ঘটেছে—এ দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। এরা শক্ত হাতে ক্ষমতার ভার দিয়ে নিজেদের কাজে নেমে পড়ে। সোভিয়েত আমলেও ভিন্ন কিছু ছিল না। তবে একটা ব্যাপারে এরা এক–দেশ যখন বিদেশি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়, এরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সোভিয়েত আমলে চার্চের ওপর শত অত্যাচারের পরও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চ যুদ্ধে নামে। এরা এসব যুদ্ধকে বলে মহান পিতৃভূমির যুদ্ধ। এরা নেতাদের সব দোষ ক্ষমা করতে পারে; কিন্তু পরাজয় ক্ষমা করতে পারে না। এই দেশের ওপর, এ দেশের নেতৃত্বের ওপর যত বেশি বাইরের চাপ আসে, তত বেশি এরা নেতার পেছনে এককাট্টা হয়ে দাঁড়ায়। সেটা দেখেছি স্তালিনের সময়; ক্যারিবিয়ান সংকটে। আবার কোনো নেতার প্রতি বাইরের দেশ খুব বেশি সদয় হলে এরা তাদের সন্দেহ করে। নিকট অতীতে এমনটা ঘটেছে গর্বাচভের সঙ্গে, ইয়েলৎসিনের সঙ্গে। কিন্তু যখনই প্রিমাকভ আটলান্টিকের মাঝপথ থেকে বিমান ঘুরিয়েছেন বা রুশ সেনারা ন্যাটোর আগে প্রিস্টিনা বিমানবন্দর দখল করেছে; দেশের মানুষ সেটাকে সমর্থন করেছে। রুশদের সাইকোলজি বুঝতে পশ্চিমের ব্যর্থতাই বারবার তাদের নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ ব্যর্থ করে দিচ্ছে। আসলে আমাদের দেশে যদি পাপ-পুণ্য, পশ্চিমা বিশ্বে আইনসংগত-বেআইনি—এসব ধারণা জনগণের চিন্তায় প্রথম সারিতে থাকে। এদের ক্ষেত্রে সেটা ন্যায়-অন্যায়। আর এ কারণেই হয়তো পশ্চিমা বিশ্বের মানবতার মুখোশ এরা বারবার খুলে দিচ্ছে, আর সেখান থেকে বারবার বেরিয়ে আসছে মধ্যযুগীয় জানোয়ার।
যুদ্ধ শুরুর পর শিল্পী, অভিনেতাসহ অনেক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব রাশিয়া ত্যাগ করেছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন মত আছে। তবে তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের ডাক ক্রেমলিন খারিজ করে দিয়েছে। আসলে এই যুদ্ধের পর সমাজে মেরুকরণ ঘটেছে, সবার মুখোশ খুলে গেছে। এখানে আমার চিন্তা-ভাবনা এমন। আমি নিজে দেশের বাইরে ১৯৮৩ থেকে। এ রকম অনেক লোককে জানি, যারা দেশের বাইরে থাকেন। কিন্তু এরা সত্যিকার অর্থেই হৃদয়ে বাংলাদেশ ধারণ করেন। তারা দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবেন, এর সুখে সুখী, দুঃখে দুঃখী হন। এদের অনেকেই দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখেন। আবার অনেকেই আছে, যারা দেশে বাস করেন, উপার্জন করেন, আর অর্থ পাচার করেন উন্নত বিশ্বে। এরা আর যাই হোক দেশ নিয়ে ভাবে না, দেশ তাদের জন্য উপার্জনের জায়গা। একইভাবে আজ যারা রাশিয়া থেকে চলে যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই এই দেশে উপার্জন করতেন, আর শপিং করতেন মিলান, প্যারিস, লন্ডন ও নিউইয়র্কে। এদের অনেকেই এ দেশের মানুষের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করতেন না। অনেকেই সরকারি অনুদান পেতেন। তাই এদের অনুপস্থিতি রাশিয়া খুব একটা অনুভব করবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এরা কি পারবে নিজেদের সেখানে মানিয়ে নিতে? তাদের পণ্যের মূল ক্রেতা ছিল রুশ জনগণ। এসব শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতারা ওখানে কী করবেন? বর্তমানে যুদ্ধের কারণে হয়তো সেসব দেশে ফ্লোর পাবেন, কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। তখন? তা ছাড়া এখন যেভাবে রুশোফোবিয়া পশ্চিমা বিশ্বে শেকড় গেড়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ সেখানে তাদের কতটা গ্রহণ করবে সেটাও ভাবার বিষয়।
বর্তমানে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যত কম কার্যকর হচ্ছে, ন্যাটো ততই আগ্রাসী হচ্ছে। নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে, নতুন নতুন অস্ত্র পাঠাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য যুদ্ধ যত দূর সম্ভব দীর্ঘায়িত করা। তবে এতে যে শুধু রাশিয়াই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নয়। ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। তখন দেখা যাবে, কার সহ্যশক্তি কত বেশি। আর তার ওপরই নির্ভর করবে যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র রাখঢাক না করেই স্বীকার করছে, তারা বিগত বছরগুলোতে ইউক্রেনের সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার। আজোভ ব্যাটালিয়নের যারা ধরা পড়ছে, নাম শুনে মনে হয় তাদের অধিকাংশই জাতিগতভাবে রুশ। তবে যুদ্ধ না করে যারা আত্মসমর্পণ করছে, তাদের বেশির ভাগই পশ্চিম ইউক্রেনের। কেন? আসলে পশ্চিম ইউক্রেনের লোকেরা কখনোই তেমন একটা যুদ্ধ করেনি। তারা সব সময়ই যখন যে রাজা এসেছে, তাদের আনুগত্য স্বীকার করেছে। ফলে তারা পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ইউরোপে।
এমনও শুনেছি পূর্ব ইউক্রেন থেকে যারা পালিয়ে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে, পশ্চিম ইউক্রেনের লোকেরা তাদের কাছে বাসা ভাড়া দিয়ে নিজেরা ইউরোপের দিকে যাচ্ছে। আর এদের অনেকেই, বিশেষ করে এলিটদের অনেকেই পালিয়ে যাচ্ছে বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করে। এমন অনেকে ধরা পড়েছে হাঙ্গেরি, রোমানিয়ার সীমান্তে। পালিয়ে বাঁচাদের তালিকায় রয়েছে সেসব লোকজন, যাদের কথা ছিল দেশের হয়ে যুদ্ধ করার। এ নিয়ে ইউরোপে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তারা ইউরোপে গিয়ে বিভিন্ন অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়েছে। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা যৌনকর্মীর খাতার নাম লেখাতে বাধ্য হচ্ছে। এ নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। এ ছাড়া ইউক্রেনের অনেকেই বিভিন্ন দেশে রুশদের ওপর হামলা করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মদানকারী সোভিয়েত সেনাদের মনুমেন্ট ভাঙচুর করছে। তাই যুদ্ধ হচ্ছে মূলত রুশদের সঙ্গে রুশদের। এভাবেই পশ্চিমা বিশ্ব এদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লাগিয়ে নিজেদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করছে। আত্মসমর্পণ করা ইউক্রেন সেনারা বলছে, আত্মসমর্পণ করলে ওদের মেরে ফেলা হবে বলে ভয় দেখানো হয়েছিল। এখন তারা বুঝতে পারছে, এটাই জীবন বাঁচানোর একমাত্র পথ। তা ছাড়া মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছে বলেও অনেকে জানিয়েছে।
পশ্চিমা বয়ানই কি শেষ কথা
আমরা কথায় কথায় স্বাধীনতার কথা বলি, মুক্ত চিন্তার কথা বলি। আচ্ছা আজ কতটি দেশ স্বাধীন? সত্যের কোনো একক রূপ নেই। একজনের দৃষ্টিতে যা সত্য, অন্যের দৃষ্টিতে তা মিথ্যা হতে পারে। তা ছাড়া পশ্চিমা বয়ানই যে শেষ কথা, তার তো কোনো মানে নেই। এখন এই যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আনা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে। আমি জানি গতকাল কেউ কোনো ঘটনার প্রতিবাদ না করলেও আজ সে অনুরূপ ঘটনার বিরুদ্ধে বলতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়, এর পর থেকে এ ধরনের যেকোনো ঘটনার প্রতিবাদ করা। সবাই জানে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা। যে বাইডেন পুতিনকে খুনি বলছেন, তিনিই ১৯৯২ সালে বেলগ্রাদ আক্রমণের পক্ষে ওকালতি করেন। ইরাক ও লিবিয়ার যুদ্ধেও তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এর প্রতিবাদ করে আজ জেলের ভাত খাচ্ছেন। আজ যে কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে, তার শতগুণ অপরাধে অপরাধী যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু সব সময়ই বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে। এটা আমাদের দেশে কিছু কিছু বিশেষ আসামির মতো। ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাসকারী অনেক বাংলাদেশিকে দেখি দেশে এমন কিছু ঘটলে বিষ উগরে দেন, অথচ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় হজম করে যান, দরকারে হজমি খেয়ে সেটা করেন। এদের দেখে আমি বুঝি, কেন বাংলাদেশের অনেক লোক ভারতে কোনো মুসলমানের ওপর অত্যাচার হলে প্রতিবাদে সোচ্চার হন, অথচ তারাই বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর অত্যাচার দেখেও মুখ খোলে না। ঠিক এর উল্টোটা ঘটে ভারতে; যারা পাকিস্তান বা বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করে, তারা ভারতে মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে। আসলে এটা এক ধরনের মানসিক রোগ, যখন আগে থেকেই ঠিক করা হয় কাদের প্রতি আমরা সহানুভূতিশীল হব, আর কাদের প্রতি নিস্পৃহ।
আচ্ছা কেউ কি মনে করেন, ব্রিটিশেরা ভারতীয়দের পছন্দ করত? আমার তো মনে হয়, তারা হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষ সমস্ত ভারতীয়দের একই রকম অবজ্ঞার চোখে দেখত। কিন্তু কখনো হিন্দুদের, কখনো মুসলমানদের মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করত। ফলাফল—দেশভাগ। তবে তার চেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু। আজ পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের ভালোবেসে নয়, তাদের হাত দিয়ে যত বেশি সম্ভব রুশ হত্যার জন্য। তারা ভালোভাবেই জানে রুশ, বেলারুশ ও ইউক্রেনীয়—এরা প্রায় একই জাতি। এখন তারা মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে এদের বিভক্ত করছে। ডিভাইড অ্যান্ড রুল—এটা তাদের অমূল্য আবিষ্কার।
অনেককেই দেখি, শুধু পুতিন বিরোধিতা থেকে পশ্চিমের সবকিছু জায়েজ করে দেয়। পুতিনের প্রতি বিভিন্ন মনোভাব থাকতেই পারে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যদি অন্ধ ঘৃণা হয়, তাহলে বিপদ। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর অনেক কিছুই অপছন্দ করি। সত্যি বলতে কি আমি কারওই সবকিছু পছন্দ করি না। কারও মধ্যে পছন্দ করার মতো কিছু থাকলে পছন্দ করি, ঘৃণা করার মতো কিছু থাকলে, সেটা করতেও পিছ-পা হই না। আমার কাছে কোনো কিছুর ভালোমন্দ কে করল তার ওপর নির্ভর করে না, কী করল সেটাই বড় কথা।
পুতিনের সবচেয়ে বড় অবদানগুলোর একটি হচ্ছে রাশিয়াকে অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও যে দাঁড়ানো যায়, সেটা দেখানো। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একচ্ছত্র অধিকারী হয়ে ওঠে। কেউই তখন তার প্রতিবাদ করতে পারত না। যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ছিল আইন। তাই বেলগ্রাদ আক্রমণ থেকে শুরু করে সবাই হজম করতে হয়। করবেই-বা না কেন? যদি ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে অসংখ্য মার্কিন ঘাঁটি থাকে, তবে তার কথা না মেনে উপায় আছে? ঠিক এ রকম এক সময়ে ২০০৭ সালে পুতিন মিউনিখে দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করেন। সবাই হেসেছিল। কারণ, রাশিয়া তখন তাদের চোখে ছিল পেট্রল পাম্প। পুতিন সবাইকে দেখিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমত না হয়েও বেঁচে থাকা যায়।
এর অনেক পরে ২০১৫ সালে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কথায় ইউক্রেন সে দেশের প্রসিকিউটর জেনারেলকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তাই শুধু সুযোগ থাকলেই হবে না, সেটা ব্যবহারের মনোবল থাকতে হবে। মতিলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘গান্ধীর সঙ্গে দ্বিমত করার ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি–উই এগ্রিড টু ডিস্যাগ্রি’। আসলে গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র হলো দ্বিমত প্রকাশের অধিকার। কিন্তু এখন আমরা কী দেখি? যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একযোগে রাশিয়ার নিন্দা করতে অস্বীকার করছে, তাদের ওপর নেমে আসছে প্রচণ্ড চাপ। এবার সে যে দেশই হোক—চীন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা যে-ই হোক। এই বিশ্বে কি আমরা বাস করতে চাই? আমার বিশ্বাস যদি এই যুদ্ধে রাশিয়া হারে, তবে যুক্তরাষ্ট্র হবে সেই দানব, যার দুপুরের খাবারের জন্য প্রতিদিন একটা করে দেশ পাঠাতে হবে। তাই এই যুদ্ধ শুধু রাশিয়ার অস্তিত্বের যুদ্ধ নয়, এটা বিশ্বের প্রতিটি দেশের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারের যুদ্ধ। তাই এই যুদ্ধে বিজয়ের কোনোই বিকল্প নেই বলে মনে করছে মস্কো।
নিষেধাজ্ঞায় পশ্চিমও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
যুদ্ধ শুরুর অনেক আগে থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনবরত হুমকি দিয়ে আসছিল। তাদের ধারণা ছিল, কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা দিয়েই রাশিয়ার অর্থনীতিতে ধস নামানো যাবে। যুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে এক ধরনের প্যানিক যে সৃষ্টি হয়নি, তা নয়। সেই এক দিনে মানুষ এক ট্রিলিয়ন রুবল ব্যাংক থেকে নামিয়ে নেয়। তবে এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সবাই সেটা করতে পেরেছে, কোথাও কোথাও লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। একের পর এক বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছু কিছু জিনিস কেনার হিড়িক লাগে। মনে আছে, ওই সময় মেয়ে বলল ও স্যানিটারি প্যাড খুঁজে পাচ্ছে না (একেবারে নেই তা নয়, ও যে কোম্পানির প্যাড ব্যবহার করে সেটা নেই)। আমি দোকানে গিয়ে কিছু কিনে আনলাম, ওয়াইল্ড বেরিতে কিছু অর্ডার দিলাম। মাঝে চিনির অভাব ছিল।
পরে ব্যবসায়ী বন্ধুদের কাছে শুনলাম, যেহেতু প্রথম দিকে ডলারের দাম প্রতিদিন বাড়ছিল, তাই অনেক কোম্পানি ইচ্ছা করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করেনি। পরে অবশ্য অ্যান্টিমনোপলি সংস্থা এসব ধরে প্রচুর জরিমানা করে। এরই মধ্যে ডলারের দাম কম-বেশি স্ট্যাবল হওয়ায় জিনিসপত্র দোকানে ফিরে এসেছে। তবে এটা ঠিক হাইটেকের অনেক জিনিসপত্রের অভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে, কিছুদিন পর যখন স্টক শেষ হয়ে যাবে। মনে আছে, সোভিয়েত আমলে এ দেশে কম্পিউটার আমদানির ওপর বিদেশি নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে বিদেশি শিক্ষার্থীরা তখন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া—এসব দেশ থেকে কম্পিউটার কিনে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিক্রি করত। তাই আমার ধারণা চীন বাদেও অন্য অনেক দেশের মাধ্যমে সেই সমস্যা অনেকটাই সমাধান হবে। মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাদ লাভ খোঁজে। তাই নিষেধাজ্ঞার ফাঁদে পড়ে সরাসরি এ দেশে বিভিন্ন জিনিস রপ্তানি বন্ধ করলেও তারা অলিগলি খুঁজবে। এখনই ইরানের তেলের সাথে রাশিয়ার তেল মিশিয়ে নাকি বিক্রি হচ্ছে!
রাশিয়া এক বিশাল মার্কেট। যেসব কোম্পানি চলে যাচ্ছে, সেসব জায়গা ফাঁকা থাকবে না। ইতিমধ্যে রাশিয়া থেকে চলে যাওয়া প্রায় হাজারখানেক কোম্পানির স্থান দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অনেক দেশি কোম্পানি এত দিন বিদেশি কোম্পানির সাথে পাল্লা দিয়ে হেরে যাচ্ছিল, হেরে যাচ্ছিল চীনের বিভিন্ন কোম্পানি। এখন এরা সেই জায়গা দখল করবে। তবে রুশ ক্রেতা এখন যেহেতু ভালো জিনিসের কদর বোঝে, তাই এসব কোম্পানিকে বাধ্য হয়েই নিজেদের প্রোডাক্টের মান উন্নত করতে হবে।
নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশে যাতে কোনো পণ্যের অভাব না হয়, সে জন্যে সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। এটাকে এরা বলে আমদানি বিকল্প। আশির দশকের পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্তের মতোই এই ইম্পরতোজামেশেনিয়ে বা আমদানি বিকল্প বর্তমান রাশিয়ায় প্রচণ্ড জনপ্রিয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১৪ সাল থেকেই যখন পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিচ্ছিল, তখন থেকেই এখানে শুরু হয় স্বনির্ভর হওয়ার প্রক্রিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সমস্ত কলকারখানা যখন রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে ব্যক্তি মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেই বেসরকারিকরণের মূল লক্ষ্য ছিল এ দেশের শিল্প চিরতরে ধ্বংস করা। সেই প্রক্রিয়ার পরিচালক আনাতলি চুবাইস, যিনি কিছুদিন আগ পর্যন্তও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন, আর যুদ্ধ শুরুর পরপর দেশ ছেড়ে চলে যান; বলেছিলেন, ‘আমাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, সোভিয়েত সমাজ, তার শিল্প—সবকিছু ধ্বংস করা, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর কোনো দিন পুনর্জন্ম নিতে না পারে।’
এর ফল হিসেবে আমরা দেখেছি, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এরা বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল রাশিয়া। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে এখানে শুরু হয় নতুন করে সবকিছু ভেবে দেখা। আর এর সূত্র ধরে কয়েক বছর আগ পর্যন্ত শস্যের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল রাশিয়া আজ অন্যতম প্রধান শস্য রপ্তানিকারক দেশ। সোভিয়েত আমলের শক্তিশালী বিভিন্ন জীবাণু ও ভাইরাস রিসার্চ সেন্টার নতুন উদ্যোগে কাজ শুরু করে। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথিবী পায় করোনার প্রথম ভ্যাকসিন। উড়োজাহাজ তৈরিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পর। কিন্তু নতুন রাশিয়ায় সেটা ধ্বংস হয়ে যায়। ২০১৪ সালের পর থেকে শুরু হয় নতুন করে উড়োজাহাজ উৎপাদন। বর্তমানে রাশিয়ার সিভিল এয়ার পার্কের প্রায় অর্ধেক বোয়িং ও এয়ারবাসের দখলে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর তারা এসব উড়োজাহাজের লিজিং স্থগিত রাখে। ফলে প্রায় এক হাজার উড়োজাহাজ এখন মাটিতে বেকার পড়ে আছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার ফলে এদের নিজ নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারছে না। ফলে পশ্চিমা অনেক লিজিং কোম্পানি বন্ধ হওয়ার পথে।
এদিকে এই সমস্যা সমাধানে রাশিয়া নিজেই উড়োজাহাজ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে সময় লাগবে। তবে সেটা ভবিষ্যতে যেকোনো নিষেধাজ্ঞায় দেশটিকে বাঁচাবে। বাড়তি পাওয়া হিসেবে এর ফলে তৈরি হবে নতুন কর্মস্থান, উড়োজাহাজ নির্মাণের মতো বিষয়গুলো আবার ফিরে আসবে এদের শিক্ষা ব্যবস্থায়। তবে এসব যে খুব সহজে হবে, তা কিন্তু নয়।
সোভিয়েত আমলে রাশিয়ায় প্রায় সব ধরনের ফসলের সিলেকশন হতো। দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশ থেকে কম পয়সায় আমদানির কারণে এখানে সমস্যা দেখা দিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত আগামী মৌসুমের জন্য বীজ সংরক্ষিত আছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বছর দু-এক পর সমস্যায় পড়তে হতে পারে। চীন, ভারত সহায়তা করতে পারে। তবে তবে এরা এখন থেকেই চাইছে জিন পুলের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে। এককথায় যুদ্ধের পাশাপাশি রাশিয়া তার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক—সব ব্যবস্থাকেই ঢেলে সাজাচ্ছে। রুশরা বলে, ‘শান্তি ছিল না, অশান্তি সাহায্য করল’। অনেক দিন ধরে ব্যবসা, বিশেষ করে মধ্যমানের পুঁজির জন্য বেশ কিছু জরুরি আইন এদের সংসদ বা দুমায় পড়ে ছিল, এখন সেগুলো পাস হয়ে গেছে।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
আমার শিক্ষক, শিক্ষাগুরু ও পথপ্রদর্শক প্রফেসর মো. আনিসুর রহমান ৫ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ১৯৭২ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, তখন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য প্রফেসর আনিসুর রহমান তাঁর কমিশনের কর্মপরিধি কিছুটা...
১২ ঘণ্টা আগেগাজীপুরের কোনাবাড়ীতে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী ৪০ বছরের পুরোনো একটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার সকালে কারখানার মূল ফটকে বন্ধ ঘোষণার নোটিশ সাঁটিয়ে দেওয়া হয়। কারখানাটির নাম পলিকন লিমিটেড।
১২ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে সংবিধানের কী দরকার? কার জন্য দরকার? নাগরিকের জন্য, নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য? যে সংবিধানে দেশের একজন মানুষের জনগণ থেকে নাগরিক হওয়ার সুযোগ নেই, সেই সংবিধান দিয়ে আমরা কী করব? আমরা যখন জনগণ থেকে নাগরিক হতে যাই, তখন নাগরিক অধিকার সামনে আসে। সংবিধানে আমাদের নাগরিক অধিকার আদৌ আছে? উত্তর জানতে..
১২ ঘণ্টা আগেব্রিটিশ লেবার পার্টির সংসদ সদস্য রূপা হক একটি ব্রিটিশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশে এসেছেন। বিটিএমএর এক আয়োজনে অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে তিনি পরিবারতন্ত্রের ব্যাপারে কিছু কথা বলেছেন। আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, তিনি বলেছেন, একজন নেতার কন্যা, আরেকজন নেতার বেগম এবং তাঁদের...
১২ ঘণ্টা আগে