মুহাম্মদ হাবিল উদ্দীন
বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ এবং উৎপাদন থেকে ভোগের প্রয়োজনে প্রায় সব পণ্যই আমদানি হয়ে থাকে। আর এই আমদানির মাধ্যমে ওভার ইনভয়েসিং করে ডলার পাচার হওয়ার বিষয়টি বহুল কথিত, পরিলক্ষিত ও আলোচিত একটি ইস্যু। এটি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে।
এটি রোধ বা নিরসন করতে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উল্লেখযোগ্য দৃশ্যমান পদক্ষেপ ইতিপূর্বে সেভাবে নিতে দেখা যায়নি। কিন্তু এ বছর যখন আমদানি ব্যয় মেটাতে দেশ সত্যি সত্যি ডলার-সংকটে পড়ে গেল এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন ঊর্ধ্বশ্বাসে ভরে উঠল, তখন অসাধু ব্যবসার বিরুদ্ধে সরকারকে কিছু কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখা গেল। এরই সাম্প্রতিকতমটি হলো, ডলার পাচার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরোক্ষ নির্দেশ। এই নির্দেশ অনুযায়ী পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য যাচাই করে সঠিক মূল্যে ঋণগ্রহীতার এলসি খুলে বিধিবদ্ধ ট্রানজেকশন করতে হবে। এ ধরনের মৌলিক নির্দেশনা যে একেবারেই ছিল না, তা নয়; এবার একটা নির্দিষ্ট ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে শক্ত আকারে এসেছে। যদিও নাগরিক এবং ব্যাংকের মতো গণপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার ওপর আপনাআপনি দাপ্তরিক দায়িত্ব অর্পিত হয় যে দেশের মৌলিক আইন ও স্বার্থ বিঘ্নিত না করে কাজ করা। তবে এ দেশে নিচ থেকে উদ্যোগ নেওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয় না। তাই প্রায় সব কাজে প্রায়জনই ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফলে নির্দেশ পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক ক্ষেত্রে মাঠ খালি হয়ে যায়।
শুধু নতুন কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশ নয়। ব্যাংক হোক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হোক—সবই পরিচালিত হচ্ছে টপ-ডাউন প্রসেসে। সিদ্ধান্ত হয় ওপর থেকে হাইপোথেটিক্যালি, প্রফেশনাল এনালাইসিসে নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নয়। অন্য সব ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল কোম্পানি। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আবার জনপ্রতিষ্ঠানও; কারণ, সরকারি ব্যাংকের মালিক জনগণ। আর বেসরকারি ব্যাংকের স্পনসর পরিচালকদের বাইরের শেয়ারহোল্ডার ও ডিপোজিটারও লক্ষ লক্ষ জনসাধারণ। অধিকাংশ অর্থ তাঁদের, কিন্তু ব্যাংক চলে স্পনসর পরিচালকদের মাধ্যমে; যার বেশির ভাগই ব্যবসায়ী। ব্যাংক যেহেতু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সেহেতু ব্যবসা করবে এবং মুনাফা ছাড়া ব্যবসা বাঁচবে না। আর এই ব্যাংকিং ব্যবসার বাজারে ব্যাংকের প্রধান গ্রাহকেরা হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তাই ব্যবসায়ীদের সন্তুষ্টিকে আস্থায় রেখেই ব্যাংক ব্যবসা করে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব ব্যাংকের কার্যকলাপ দেখভাল করে। দেশ ও জনগণের আর্থিক সুরক্ষা এবং টেকসই অগ্রগতির জন্য নীতি, নির্দেশ ও পরিবীক্ষণের মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক—এটাই মৌলিক বা স্বাভাবিক নীতি ও রীতি।
ব্যবসার প্রথম উদ্দেশ্য হলো কেনাবেচার প্রক্রিয়ায় অর্থ উপার্জন করে মুনাফা করা। এই উদ্দেশ্যের যাত্রায় একটা সময় লোভের মাত্রা চড়তেই থাকে মুক্তবাজার অর্থনীতির উন্মুক্ত ভোগের আয়েশি আয়োজনের পসরা দেখে। মালিক, পরিচালকদের মধ্যে অল্প সময়ে অতি আয়ের অস্থির আকাঙ্ক্ষা-উদ্যোগ তৈরি হয়। আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় আর বাজার ব্যবস্থাপনার পরিবেশে ব্যবসার জগতে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। প্রতিযোগিতা নানাভাবেই হতে পারে—পেশাদার দক্ষতার, উৎকর্ষতার ও প্রযুক্তির। কিন্তু এ দেশে তা অনেকটা অপেশাদার। অনেক ক্ষেত্রে এমন হয় যে ‘কী করবেন জানি না। ব্যবসা আনুন, প্রফিট দিন, তারপর বেতন নিন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এ রকম পরিস্থিতি ও পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ভবিষ্যৎ ঝুঁকির ভয়-ভাবনা চিন্তা না করে চটজলদি মুনাফা আনতে পারাকেই ব্যাংক ও করপোরেট জগতে দক্ষতা ও যোগ্যতা হিসেবে একটা সময় ধরে দেখা হয়েছে, উৎসাহিত করা হয়েছে। এর কুফল ও ভোগান্তি পরবর্তী সময়ে অনেকে পেলেও সেই অস্থির তাড়না অনেক ব্যাংক থেকেই তিরোহিত হয়নি।
এখন চলছে প্রাইভেট ইকোনমির যুগ। প্রাইভেট ইকোনমির দাপট বাজারে এবং বাজারের বাইরে। ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতেও প্রাইভেট ব্যাংকেরই শেয়ার বেশি। ব্যাংক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মালিক-পরিচালকেরাও ব্যবসায়ী-প্রাইভেট ইকোনমিরও প্লেয়ার। সরকারি যে কটি ব্যাংক আছে আমলা পরিচালকদের বাইরে, সেখানে রাজনীতিক ও পেশাজীবীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই রাজনীতিক ও পেশাজীবীদের হয় ছোটখাটো ব্যবসা আছে, না হয় কোনো না কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তারা জড়িত আছেন জীবিকা নির্বাহের জন্য। সুতরাং প্রথম এবং প্রধান বিবেচ্য হলো ব্যাংক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনগত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ কোন স্তর থেকে কিসের ভিত্তিতে হচ্ছে? ব্যাংকে কাদের আবদার থাকছে, আর কাদের আবেদন মূল্য পাচ্ছে না?
ব্যাংকিং জগতে সনাতন কাল থেকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে—‘Banks deal with Documents not with Goods.’ কিন্তু গ্লোবালাইজেশনের যুগে মানুষ যখন গ্লোবাল পিপল হয়ে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সামনে গেল, তখন আর সে সনাতন সত্যবাদিতা নিয়ে বাণিজ্যে বসত গাড়া সুবিধার মনে করল না। মানুষের মনের সীমানা ছাড়ার শখই তাকে ক্রস বর্ডার ট্রেডের ছাতার আড়ালে বিশ্বে বসতি গড়ার পন্থা বের করে দিল। আমদানি-রপ্তানির বাণিজ্যের Document-এর মাধ্যমে ব্যাংককে অসত্য তথ্য দিয়ে বড় বড় শহরে ডলার রাখা শুরু হলো। সরকারি দপ্তর এবং ব্যাংকের কেউ কেউ কিন্তু জানেন, কোন ব্যবসায়ী দুবাই, কানাডা, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ায় থাকেন এবং কোন কোন ব্যবসার নামে কোন দেশের ডলার তাঁরা সেখানে নিয়েছেন।
প্রশ্ন হলো, নিজেরা জানার পরও আটকায় না বা দাপ্তরিকভাবে জানায় না কেন। কারণ, ব্যাংকে বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকে এ ধরনের কর্মসংস্কৃতি তৈরি হয়নি, আচার নেই, অনুভবও নেই। নেই সেই ধরনের মানবসম্পদ। বড় বড় কর্মকর্তাদের মধ্যে হয় কেউ সুবিধাভোগী, নয়তো বা কেউ পরিচালকদের আত্মীয় বা বন্ধু। আরেকটা বড় কারণ হলো—অর্থনীতির আকার, তথা শিল্প খাতের টার্নওভারের আর্থিক আকারের চেয়ে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি, কিন্তু বাজার ছোট। ব্যবসার প্রয়োজনে বাস্তবে তাই একই প্রতিষ্ঠানকে একাধিক ব্যাংক এগিয়ে গিয়ে আমন্ত্রণ জানায় এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোও সেই সুযোগের সুবিধা নেয়। যে ব্যাংকে বেশি স্বাধীনতা ও সুযোগ পায়, সেই ব্যাংককে তারা বেশি ব্যবসা দেয়।
ব্যাংকের ব্যবসা দরকার। ব্যবসা ছাড়া ব্যাংক বাঁচবে না। কোনো কর্মকর্তা যদি বেশি নিয়মকানুন, কমপ্লায়েন্স খাটান, তবে পার্টি চলে গিয়ে ব্যবসা কমলে ব্যবস্থাপক ও পরিচালকেরা অখুশি হবেন। সেই কর্মকর্তার চেয়ার যাবে অন্যত্র, চাকরি হবে অঋদ্ধ। ব্যবসা বা মুনাফার অতি আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় সব ব্যাংক যুগপৎ কঠোর কমপ্লায়েন্ট হয় না বা হতে পারে না তাই।
একই কোম্পানি একাধিক ব্যাংকে ঋণ সুবিধা নেওয়ায় অনেকের আর্থিক ও বাণিজ্যিক তথ্য একেক ব্যাংকে একেক রকম হওয়ার সুযোগ থেকে যায়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের আলোচ্য সার্কুলার বাস্তবায়নে গ্রাহক কোম্পানির দেওয়া ডকুমেন্ট ও তথ্যের ওপর ব্যাংকারদের আরও মনোযোগ দিতে হবে। ভুল বা গরমিল তথ্য দেওয়ার প্রবণতা হয়তো তখন কমে আসবে, তবে সুবিধা নেওয়ার ইচ্ছায় এ ব্যাংক থেকে ও ব্যাংকে শিফট করার প্রবণতা বেড়ে যাবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিবাচক এই নির্দেশ পরিপালনে প্রায় সব ব্যাংকই নিম্নরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে:
১. খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যের স্পেসিফিকেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মূল্যের তথ্য অনেক ওয়েবসাইটে স্বচ্ছ ও সরলভাবে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। যেসব তথ্য পাওয়া যাবে, তা থেকে একটা কনক্লুসিভ ধারণা টানার মতো কারিগরি জ্ঞান ও বাজার বিশ্লেষণ করার মতো কর্মকর্তার সংকট।
২. স্পেসিফিকেশন, মূল্য আর সংখ্যা/পরিমাণের হেরফের করে গ্রাহক থেকে তথ্য ও কাগজপত্রাদি পাওয়া। আমদানিকারক অহরহ পণ্যের নতুন নতুন স্পেসিফিকেশন/নাম, রপ্তানিকারক, মূল্যসংক্রান্ত ইনভয়েস জমা দেবে। ফলে যাচাই-বাছাই সংশোধনে বিদ্যমান থেকে বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়বে। কমপ্লায়েন্স করে কম সময়ে এলসি খোলে—এমন ব্যাংকের খোঁজে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে গ্রাহক ছুটে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
এরূপ পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা অর্জনে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক যা যা করতে পারে:
১. কারিগরি জ্ঞান ও বাজার বিশ্লেষণ করার মতো কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে ভোগ্য ও শিল্পপণ্য এবং বিভিন্ন বাজার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান।
২. আমদানি পণ্যের বিভিন্ন উৎস বাজার, স্পেসিফিকেশন, মূল্য ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা সেল গঠন।
৩. আন্তব্যাংক যোগাযোগ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্কের নেটওয়ার্কিং সুষম করে তথ্য বিনিময় গতিশীল করা।
পরিশেষে বলতে চাই, সবচেয়ে ভালো হয় বাংলাদেশ ব্যাংক যদি তাদের ব্যবস্থাপনায় একাধিক ব্যাংকের ঋণগ্রহণকারী কোম্পানি, আমদানি পণ্যের উৎস বাজার, স্পেসিফিকেশন, মূল্য ইত্যাদি তথ্যসংক্রান্ত সেল গঠন করে সব ব্যাংককে অনলাইনে সরাসরি তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করে; কারণ, বাণিজ্যিক ব্যাংকের পক্ষে বিবিধ বাস্তবতায় এ ধরনের সেল গঠন করে ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনা সম্ভব না-ও হতে পারে।
লেখক: প্রকৌশলী ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার
বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ এবং উৎপাদন থেকে ভোগের প্রয়োজনে প্রায় সব পণ্যই আমদানি হয়ে থাকে। আর এই আমদানির মাধ্যমে ওভার ইনভয়েসিং করে ডলার পাচার হওয়ার বিষয়টি বহুল কথিত, পরিলক্ষিত ও আলোচিত একটি ইস্যু। এটি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে।
এটি রোধ বা নিরসন করতে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উল্লেখযোগ্য দৃশ্যমান পদক্ষেপ ইতিপূর্বে সেভাবে নিতে দেখা যায়নি। কিন্তু এ বছর যখন আমদানি ব্যয় মেটাতে দেশ সত্যি সত্যি ডলার-সংকটে পড়ে গেল এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন ঊর্ধ্বশ্বাসে ভরে উঠল, তখন অসাধু ব্যবসার বিরুদ্ধে সরকারকে কিছু কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখা গেল। এরই সাম্প্রতিকতমটি হলো, ডলার পাচার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরোক্ষ নির্দেশ। এই নির্দেশ অনুযায়ী পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য যাচাই করে সঠিক মূল্যে ঋণগ্রহীতার এলসি খুলে বিধিবদ্ধ ট্রানজেকশন করতে হবে। এ ধরনের মৌলিক নির্দেশনা যে একেবারেই ছিল না, তা নয়; এবার একটা নির্দিষ্ট ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে শক্ত আকারে এসেছে। যদিও নাগরিক এবং ব্যাংকের মতো গণপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার ওপর আপনাআপনি দাপ্তরিক দায়িত্ব অর্পিত হয় যে দেশের মৌলিক আইন ও স্বার্থ বিঘ্নিত না করে কাজ করা। তবে এ দেশে নিচ থেকে উদ্যোগ নেওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয় না। তাই প্রায় সব কাজে প্রায়জনই ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফলে নির্দেশ পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক ক্ষেত্রে মাঠ খালি হয়ে যায়।
শুধু নতুন কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশ নয়। ব্যাংক হোক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হোক—সবই পরিচালিত হচ্ছে টপ-ডাউন প্রসেসে। সিদ্ধান্ত হয় ওপর থেকে হাইপোথেটিক্যালি, প্রফেশনাল এনালাইসিসে নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নয়। অন্য সব ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল কোম্পানি। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আবার জনপ্রতিষ্ঠানও; কারণ, সরকারি ব্যাংকের মালিক জনগণ। আর বেসরকারি ব্যাংকের স্পনসর পরিচালকদের বাইরের শেয়ারহোল্ডার ও ডিপোজিটারও লক্ষ লক্ষ জনসাধারণ। অধিকাংশ অর্থ তাঁদের, কিন্তু ব্যাংক চলে স্পনসর পরিচালকদের মাধ্যমে; যার বেশির ভাগই ব্যবসায়ী। ব্যাংক যেহেতু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সেহেতু ব্যবসা করবে এবং মুনাফা ছাড়া ব্যবসা বাঁচবে না। আর এই ব্যাংকিং ব্যবসার বাজারে ব্যাংকের প্রধান গ্রাহকেরা হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তাই ব্যবসায়ীদের সন্তুষ্টিকে আস্থায় রেখেই ব্যাংক ব্যবসা করে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব ব্যাংকের কার্যকলাপ দেখভাল করে। দেশ ও জনগণের আর্থিক সুরক্ষা এবং টেকসই অগ্রগতির জন্য নীতি, নির্দেশ ও পরিবীক্ষণের মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক—এটাই মৌলিক বা স্বাভাবিক নীতি ও রীতি।
ব্যবসার প্রথম উদ্দেশ্য হলো কেনাবেচার প্রক্রিয়ায় অর্থ উপার্জন করে মুনাফা করা। এই উদ্দেশ্যের যাত্রায় একটা সময় লোভের মাত্রা চড়তেই থাকে মুক্তবাজার অর্থনীতির উন্মুক্ত ভোগের আয়েশি আয়োজনের পসরা দেখে। মালিক, পরিচালকদের মধ্যে অল্প সময়ে অতি আয়ের অস্থির আকাঙ্ক্ষা-উদ্যোগ তৈরি হয়। আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় আর বাজার ব্যবস্থাপনার পরিবেশে ব্যবসার জগতে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। প্রতিযোগিতা নানাভাবেই হতে পারে—পেশাদার দক্ষতার, উৎকর্ষতার ও প্রযুক্তির। কিন্তু এ দেশে তা অনেকটা অপেশাদার। অনেক ক্ষেত্রে এমন হয় যে ‘কী করবেন জানি না। ব্যবসা আনুন, প্রফিট দিন, তারপর বেতন নিন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এ রকম পরিস্থিতি ও পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ভবিষ্যৎ ঝুঁকির ভয়-ভাবনা চিন্তা না করে চটজলদি মুনাফা আনতে পারাকেই ব্যাংক ও করপোরেট জগতে দক্ষতা ও যোগ্যতা হিসেবে একটা সময় ধরে দেখা হয়েছে, উৎসাহিত করা হয়েছে। এর কুফল ও ভোগান্তি পরবর্তী সময়ে অনেকে পেলেও সেই অস্থির তাড়না অনেক ব্যাংক থেকেই তিরোহিত হয়নি।
এখন চলছে প্রাইভেট ইকোনমির যুগ। প্রাইভেট ইকোনমির দাপট বাজারে এবং বাজারের বাইরে। ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতেও প্রাইভেট ব্যাংকেরই শেয়ার বেশি। ব্যাংক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মালিক-পরিচালকেরাও ব্যবসায়ী-প্রাইভেট ইকোনমিরও প্লেয়ার। সরকারি যে কটি ব্যাংক আছে আমলা পরিচালকদের বাইরে, সেখানে রাজনীতিক ও পেশাজীবীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই রাজনীতিক ও পেশাজীবীদের হয় ছোটখাটো ব্যবসা আছে, না হয় কোনো না কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তারা জড়িত আছেন জীবিকা নির্বাহের জন্য। সুতরাং প্রথম এবং প্রধান বিবেচ্য হলো ব্যাংক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনগত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ কোন স্তর থেকে কিসের ভিত্তিতে হচ্ছে? ব্যাংকে কাদের আবদার থাকছে, আর কাদের আবেদন মূল্য পাচ্ছে না?
ব্যাংকিং জগতে সনাতন কাল থেকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে—‘Banks deal with Documents not with Goods.’ কিন্তু গ্লোবালাইজেশনের যুগে মানুষ যখন গ্লোবাল পিপল হয়ে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সামনে গেল, তখন আর সে সনাতন সত্যবাদিতা নিয়ে বাণিজ্যে বসত গাড়া সুবিধার মনে করল না। মানুষের মনের সীমানা ছাড়ার শখই তাকে ক্রস বর্ডার ট্রেডের ছাতার আড়ালে বিশ্বে বসতি গড়ার পন্থা বের করে দিল। আমদানি-রপ্তানির বাণিজ্যের Document-এর মাধ্যমে ব্যাংককে অসত্য তথ্য দিয়ে বড় বড় শহরে ডলার রাখা শুরু হলো। সরকারি দপ্তর এবং ব্যাংকের কেউ কেউ কিন্তু জানেন, কোন ব্যবসায়ী দুবাই, কানাডা, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ায় থাকেন এবং কোন কোন ব্যবসার নামে কোন দেশের ডলার তাঁরা সেখানে নিয়েছেন।
প্রশ্ন হলো, নিজেরা জানার পরও আটকায় না বা দাপ্তরিকভাবে জানায় না কেন। কারণ, ব্যাংকে বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকে এ ধরনের কর্মসংস্কৃতি তৈরি হয়নি, আচার নেই, অনুভবও নেই। নেই সেই ধরনের মানবসম্পদ। বড় বড় কর্মকর্তাদের মধ্যে হয় কেউ সুবিধাভোগী, নয়তো বা কেউ পরিচালকদের আত্মীয় বা বন্ধু। আরেকটা বড় কারণ হলো—অর্থনীতির আকার, তথা শিল্প খাতের টার্নওভারের আর্থিক আকারের চেয়ে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি, কিন্তু বাজার ছোট। ব্যবসার প্রয়োজনে বাস্তবে তাই একই প্রতিষ্ঠানকে একাধিক ব্যাংক এগিয়ে গিয়ে আমন্ত্রণ জানায় এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোও সেই সুযোগের সুবিধা নেয়। যে ব্যাংকে বেশি স্বাধীনতা ও সুযোগ পায়, সেই ব্যাংককে তারা বেশি ব্যবসা দেয়।
ব্যাংকের ব্যবসা দরকার। ব্যবসা ছাড়া ব্যাংক বাঁচবে না। কোনো কর্মকর্তা যদি বেশি নিয়মকানুন, কমপ্লায়েন্স খাটান, তবে পার্টি চলে গিয়ে ব্যবসা কমলে ব্যবস্থাপক ও পরিচালকেরা অখুশি হবেন। সেই কর্মকর্তার চেয়ার যাবে অন্যত্র, চাকরি হবে অঋদ্ধ। ব্যবসা বা মুনাফার অতি আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় সব ব্যাংক যুগপৎ কঠোর কমপ্লায়েন্ট হয় না বা হতে পারে না তাই।
একই কোম্পানি একাধিক ব্যাংকে ঋণ সুবিধা নেওয়ায় অনেকের আর্থিক ও বাণিজ্যিক তথ্য একেক ব্যাংকে একেক রকম হওয়ার সুযোগ থেকে যায়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের আলোচ্য সার্কুলার বাস্তবায়নে গ্রাহক কোম্পানির দেওয়া ডকুমেন্ট ও তথ্যের ওপর ব্যাংকারদের আরও মনোযোগ দিতে হবে। ভুল বা গরমিল তথ্য দেওয়ার প্রবণতা হয়তো তখন কমে আসবে, তবে সুবিধা নেওয়ার ইচ্ছায় এ ব্যাংক থেকে ও ব্যাংকে শিফট করার প্রবণতা বেড়ে যাবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিবাচক এই নির্দেশ পরিপালনে প্রায় সব ব্যাংকই নিম্নরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে:
১. খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যের স্পেসিফিকেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মূল্যের তথ্য অনেক ওয়েবসাইটে স্বচ্ছ ও সরলভাবে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। যেসব তথ্য পাওয়া যাবে, তা থেকে একটা কনক্লুসিভ ধারণা টানার মতো কারিগরি জ্ঞান ও বাজার বিশ্লেষণ করার মতো কর্মকর্তার সংকট।
২. স্পেসিফিকেশন, মূল্য আর সংখ্যা/পরিমাণের হেরফের করে গ্রাহক থেকে তথ্য ও কাগজপত্রাদি পাওয়া। আমদানিকারক অহরহ পণ্যের নতুন নতুন স্পেসিফিকেশন/নাম, রপ্তানিকারক, মূল্যসংক্রান্ত ইনভয়েস জমা দেবে। ফলে যাচাই-বাছাই সংশোধনে বিদ্যমান থেকে বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়বে। কমপ্লায়েন্স করে কম সময়ে এলসি খোলে—এমন ব্যাংকের খোঁজে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে গ্রাহক ছুটে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
এরূপ পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা অর্জনে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক যা যা করতে পারে:
১. কারিগরি জ্ঞান ও বাজার বিশ্লেষণ করার মতো কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে ভোগ্য ও শিল্পপণ্য এবং বিভিন্ন বাজার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান।
২. আমদানি পণ্যের বিভিন্ন উৎস বাজার, স্পেসিফিকেশন, মূল্য ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা সেল গঠন।
৩. আন্তব্যাংক যোগাযোগ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্কের নেটওয়ার্কিং সুষম করে তথ্য বিনিময় গতিশীল করা।
পরিশেষে বলতে চাই, সবচেয়ে ভালো হয় বাংলাদেশ ব্যাংক যদি তাদের ব্যবস্থাপনায় একাধিক ব্যাংকের ঋণগ্রহণকারী কোম্পানি, আমদানি পণ্যের উৎস বাজার, স্পেসিফিকেশন, মূল্য ইত্যাদি তথ্যসংক্রান্ত সেল গঠন করে সব ব্যাংককে অনলাইনে সরাসরি তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করে; কারণ, বাণিজ্যিক ব্যাংকের পক্ষে বিবিধ বাস্তবতায় এ ধরনের সেল গঠন করে ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনা সম্ভব না-ও হতে পারে।
লেখক: প্রকৌশলী ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার
শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। যাঁরা পালাতে পারেননি তাঁদের জনাকয়েক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের দুঃশাসনকালে বিএনপিসহ অন্য নেতাদের যেভাবে হেলমেট পরিয়ে জেলখানা থেকে আদালতে হাজির করা হতো, এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের একই কায়দায়
১৮ ঘণ্টা আগেপ্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের দিন যত যাচ্ছে, ততই নতুন নতুন কিছু প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে। প্রশ্নগুলো যে গভীরতর রাজনৈতিক বিষয়সংশ্লিষ্ট, তা বলাই বাহুল্য। অনেক সময়ই প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে সংবাদ সম্মেলন বা সংবাদ ব্রিফিং করে বিষয়গুলো খোলাসার চেষ্টা করা হয়েছে।
১৯ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ও জনমনে আস্থার সংকটের প্রেক্ষাপটে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
১৯ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তিন দিনের মধ্যে অটোরিকশা বন্ধের প্রস্তাবে চালকদের রাস্তায় নেমে আসা এবং শহর কার্যত অচল হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ অবরোধে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়।
১ দিন আগে