মামুনুর রশীদ
সাত মাস ধরে অর্থ পাচারসহ নানান দুর্নীতির সংবাদ প্রতিদিনই খবরের কাগজে আসছে। বিশেষ করে অর্থ পাচারের বিষয়টি। গত সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ে পত্রপত্রিকায় বালুমহাল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি—এসবের সংবাদে পত্রিকা ভরে থাকত। শুধু তা-ই নয়, অতীতেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর এসব সংবাদ পত্রপত্রিকায় আলোচিত হয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আসামি হয়ে জেলখানা ভরে যেত। এর মধ্যে অনেক ভিআইপি রাজনীতিকও থাকতেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মধ্যে কী করে যেন একধরনের ধারণা জন্মেছে যে টাকা লাগবে। টাকা ছাড়া রাজনীতি হবে না! অনেক ব্যবসায়ী তাঁদের বিপুল অর্থ নিয়ে রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু তাঁদেরও টাকার প্রয়োজনটা কমেনি, তাঁরাও খুঁজছেন কোথায় টাকা পাওয়া যায়। অবশ্য তাঁদের হাতে ছিল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ব্যবস্থা, মানুষের জীবনে একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। সেই প্রবণতা গত সাত মাসেও কমেনি। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য যাঁরা উৎপাদন করেন, সেই কৃষকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যে কারণে ক্ষোভে-অভিমানে-দুঃখে তাঁরা সদ্য উৎপাদিত সবজি বিভিন্ন হাটে-বাজারে ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছেন।
বিষয় হচ্ছে, আমরা যাঁরা এসব ব্যাপারে নিয়মিত লিখি এবং খবরের কাগজে সেগুলো ছাপাও হয়। দেখা যায় যাঁরা এইসব ঘটনা ঘটান, তাঁরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথা একটিবারের জন্যও ভাবেন না। আমি একবার বাধ্য হয়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত এক জনপ্রতিনিধির বাড়িতে গিয়েছিলাম কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে। আমি কথা বলতে বলতে বারবার অমনোযোগী হয়ে পড়ছিলাম তাঁর প্রাসাদটি দেখে। প্রায় গ্রামীণ ওই উপজেলাটিতে প্রাসাদপ্রতিম বাড়ির আসবাব এবং ডুপ্লেক্স ডিজাইনের বাড়িটি দেখে বারবার অমনোযোগী হওয়ারই কথা। যে সংবাদটি নেওয়ার জন্য তাঁর ওখানে আমার যাওয়া সেটি আর হয়নি। কারণ, সঠিক সংবাদটি তিনিও দিলেন না। কথার মারপ্যাঁচে আসল সত্যটি এড়িয়ে গেলেন। তাঁর চাতুর্য দেখে আমি অবাকই হয়েছিলাম, উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতা কী অসাধারণ বক্তব্যে আসল বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল শিখে ফেলেছেন! এক মেয়াদ ক্ষমতায় থেকে তাঁর এই সম্পদ আহরণ—এটিও একটি ভাববার বিষয়। ভাবি, ওই গ্রামপর্যায়ে কতগুলো প্রকল্প হলে তিনি এই সম্পদ আহরণ করেছেন?
যাই হোক, পরবর্তীকালে দেখলাম তাঁর বাড়িটি ভস্মীভূত হয়েছে এবং পরিবার-পরিজনসহ তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন। এই চিত্র আজকের নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতিবিদদের ভাগ্যে তা ঘটে আসছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অর্থে রূপান্তর করার কৌশল তাঁরা শিখে ফেলেছেন। কিন্তু পরিণতিতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। কারণ অতি দ্রুতই অন্য একটি দলের আহ্বান চলে আসছে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আবার নতুন করে হিসাবনিকাশ শুরু হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত সবকিছু আবার ফিরে পাওয়া যায় এবং নতুন করে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস হয়। শিক্ষার ন্যূনতম আদর্শ তাঁদের কাছে পৌঁছায় না। বহুবার বহুভাবে তাঁদের কানে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে টাকা দিয়েই সবকিছু হয় না। টাকা দিয়ে যাঁরা সুখ অর্জন করতে চান, তাঁরা চিরকালই বোকার স্বর্গে বসবাস করেন।
আমাদের দেশে অনেক উদাহরণ ছিল যাঁরা চিরজীবন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছেন, যাঁরা বিস্তর সম্পদকে দান করে দিয়ে সর্বহারা মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। অনেক জমিদার তাঁদের আভিজাত্য এবং জমিদারি ছেড়ে দারিদ্র্যের জীবন যাপন করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াও যাঁরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছেন, এমনকি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করেছেন, তাঁরাও এক কাপড়ে এক জোড়া জুতায় এক বেলা খেয়ে মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। অন্যদিকে রাজনীতিবিদদের একটা বড় অংশ এই সোনারখনি সোনার বাংলার বিপুল সম্পদকে নানাভাবে লুণ্ঠন করে, পাচার করে প্রবাসে এক অদ্ভুত জীবনযাপন করছেন। কালক্রমে ওইসব নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিকেরা পেছনের সারিতে থেকে গেছেন ও বর্ণাঢ্য জীবনযাপনকারীরাই রাষ্ট্রক্ষমতাকে আগলে রেখেছেন।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমলাতন্ত্র। বড় বড় আমলা অবসর নেওয়ার পর তাঁরা আর এ দেশে থাকছেন না, থাকলেও যেকোনো দলের উচ্চ পদে সমাসীন হয়ে এই লুণ্ঠনপর্বের একটা বড় অংশীদার হয়ে পড়ছেন। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজনবোধে ধর্মকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল, তাই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারটার সব সময়ই একটা নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। যখন পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের লড়াই চলছিল, ভাষার প্রশ্নে এ দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছিল, তখনো ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধিতা হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতিবিদেরাই পাকিস্তানের নৃশংস সেনাবাহিনীর পক্ষপাতিত্ব করেছেন।
যেহেতু এ দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ ও ধর্মভীরু, তাই রাজনীতিবিদেরাও সেই সুযোগটা ভালোভাবেই কাজে লাগান। অবৈধ অর্থ অর্জন করা টাকায় মসজিদ-মাদ্রাসা করে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে জায়গা করে নেন। রাজনীতিতে এসে সেই টাকা পুরোমাত্রায় উশুল করে নেন। আজকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক, দেখা যাবে সত্যিকার অর্থে কোনো দেশপ্রেমিক কল্যাণকামী কোনো মানুষের নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাঁদের দাবিয়ে রাখার জন্য পুলিশ-প্রশাসন সদা প্রস্তুত। এর মধ্যে দু-চারজন ব্যতিক্রমী মানুষ পাওয়াও যায়। আজ অবধি রাষ্ট্রক্ষমতার এই কার্যচক্রকে কিছুতেই বদলানো যাচ্ছে না। একদল বিদায় নিচ্ছে, আরেক দল নতুন পরিচয়ে এসে যাচ্ছে।
তবে মানুষ এখন বারবার প্রশ্ন তোলে—টাকা কোথা থেকে এল? অর্থাৎ টাকাই রাজনীতির নিয়ামক শক্তি। আদর্শ নয়, অঙ্গীকার নয়, কর্মতৎপরতা নয়, সঠিক কর্মসূচি নয়, জাতির শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোনো দিকনির্দেশনা নয়, সবকিছুর মূলে অর্থ। অর্থ দিয়েই সবকিছু হয়—মানুষকে রাতারাতি পাল্টে দেওয়া যায়, একটা মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। একটা মানুষের জীবনে কত অর্থ লাগে? রাজনীতিবিদেরা চিরদিনই জনগণের অর্থে রাজনীতি করেন, এ কথা সত্যি। কিন্তু এখন আর জনগণের অর্থে নয়, মোটা টাকাওয়ালা লুণ্ঠনকারীদের অর্থেই রাজনীতি করে থাকেন। তাই জনগণকে তোয়াক্কা করার তাঁদের প্রয়োজন পড়ে না।
সাধারণ জীবনযাপন এবং সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য যে সার্বক্ষণিক ক্রিয়াকর্ম—সেসব কথা এখন অর্থহীন। ছোটখাটো রাজনীতিবিদেরাও যে জীবনযাপন করেন, তাতে সন্দেহ জাগাটা খুব স্বাভাবিক যে এই অর্থের উৎস কোথায়? আবার এ কথাও বাস্তব—জীবনযাপনের প্রয়োজনটা এত বেড়ে গেছে যে খুব অল্প টাকায় সংসার চালানো সম্ভব নয়। তাই সব সময়ই ছোট রাজনীতিবিদেরা বড় রাজনীতিবিদ এবং বড় পুঁজিপতিদের করুণার পাত্র হয়ে থাকেন। কিন্তু এ কথাও তো সত্যি—‘কঠিনেরে আমি ভালোবাসিলাম’—যাঁরা দেশের জন্য কাজ করতে চান, তাঁদের কঠিন পথটাকেই বেছে নিতে হয়। সে পথে অনাহার আছে, দারিদ্র্য আছে, অনিশ্চয়তা আছে, সরকারের জেল-জুলুম আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে মানুষ হতে হবে। টাকা দিয়ে কেনা মানুষ নয়, একেবারে খাঁটি সত্যবাদী মানুষ। সেই মানুষের যে এ দেশে খুব অভাব আছে তা মনে হয় না। কিন্তু নেতা-কর্মীরা কি তাদের কাছে পৌঁছানোর কখনো চেষ্টা করেছেন?
মানুষের একটা বড় প্রত্যাশা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি। এখনো সেই প্রত্যাশা অমূলক নয়, কারণ চিরদিন এই কমিউনিস্টরা সঠিক রাজনীতি ও সঠিক পথের অনুসন্ধান দিয়েছেন। অবশ্য সেখানে যে ভুলভ্রান্তি নেই, তা নয়। কিন্তু শক্তি যদি এত বিভক্ত হয় তাহলেই সংকটটা বাড়ে। এমন দেশও আছে যেখানে নীতি-আদর্শ ও কৌশলের প্রশ্নে পার্টি বিভক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে তাদের খুব দ্রুতই ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আজকে একেবারে অকারণে কমিউনিস্ট পার্টির অফিস ধ্বংস করার যে ঘোষণা এসেছে, তা যেকোনোভাবে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে পরাভূত করা প্রয়োজন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সংকট থাকলেও পৃথিবীর অনেক দেশে এখনো কমিউনিস্ট মতাদর্শ মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। সত্যিকারের রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি...
লেখক:– নাট্যব্যক্তিত্ব
সাত মাস ধরে অর্থ পাচারসহ নানান দুর্নীতির সংবাদ প্রতিদিনই খবরের কাগজে আসছে। বিশেষ করে অর্থ পাচারের বিষয়টি। গত সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ে পত্রপত্রিকায় বালুমহাল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি—এসবের সংবাদে পত্রিকা ভরে থাকত। শুধু তা-ই নয়, অতীতেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর এসব সংবাদ পত্রপত্রিকায় আলোচিত হয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আসামি হয়ে জেলখানা ভরে যেত। এর মধ্যে অনেক ভিআইপি রাজনীতিকও থাকতেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মধ্যে কী করে যেন একধরনের ধারণা জন্মেছে যে টাকা লাগবে। টাকা ছাড়া রাজনীতি হবে না! অনেক ব্যবসায়ী তাঁদের বিপুল অর্থ নিয়ে রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু তাঁদেরও টাকার প্রয়োজনটা কমেনি, তাঁরাও খুঁজছেন কোথায় টাকা পাওয়া যায়। অবশ্য তাঁদের হাতে ছিল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ব্যবস্থা, মানুষের জীবনে একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। সেই প্রবণতা গত সাত মাসেও কমেনি। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য যাঁরা উৎপাদন করেন, সেই কৃষকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যে কারণে ক্ষোভে-অভিমানে-দুঃখে তাঁরা সদ্য উৎপাদিত সবজি বিভিন্ন হাটে-বাজারে ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছেন।
বিষয় হচ্ছে, আমরা যাঁরা এসব ব্যাপারে নিয়মিত লিখি এবং খবরের কাগজে সেগুলো ছাপাও হয়। দেখা যায় যাঁরা এইসব ঘটনা ঘটান, তাঁরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথা একটিবারের জন্যও ভাবেন না। আমি একবার বাধ্য হয়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত এক জনপ্রতিনিধির বাড়িতে গিয়েছিলাম কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে। আমি কথা বলতে বলতে বারবার অমনোযোগী হয়ে পড়ছিলাম তাঁর প্রাসাদটি দেখে। প্রায় গ্রামীণ ওই উপজেলাটিতে প্রাসাদপ্রতিম বাড়ির আসবাব এবং ডুপ্লেক্স ডিজাইনের বাড়িটি দেখে বারবার অমনোযোগী হওয়ারই কথা। যে সংবাদটি নেওয়ার জন্য তাঁর ওখানে আমার যাওয়া সেটি আর হয়নি। কারণ, সঠিক সংবাদটি তিনিও দিলেন না। কথার মারপ্যাঁচে আসল সত্যটি এড়িয়ে গেলেন। তাঁর চাতুর্য দেখে আমি অবাকই হয়েছিলাম, উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতা কী অসাধারণ বক্তব্যে আসল বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল শিখে ফেলেছেন! এক মেয়াদ ক্ষমতায় থেকে তাঁর এই সম্পদ আহরণ—এটিও একটি ভাববার বিষয়। ভাবি, ওই গ্রামপর্যায়ে কতগুলো প্রকল্প হলে তিনি এই সম্পদ আহরণ করেছেন?
যাই হোক, পরবর্তীকালে দেখলাম তাঁর বাড়িটি ভস্মীভূত হয়েছে এবং পরিবার-পরিজনসহ তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন। এই চিত্র আজকের নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতিবিদদের ভাগ্যে তা ঘটে আসছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অর্থে রূপান্তর করার কৌশল তাঁরা শিখে ফেলেছেন। কিন্তু পরিণতিতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। কারণ অতি দ্রুতই অন্য একটি দলের আহ্বান চলে আসছে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আবার নতুন করে হিসাবনিকাশ শুরু হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত সবকিছু আবার ফিরে পাওয়া যায় এবং নতুন করে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস হয়। শিক্ষার ন্যূনতম আদর্শ তাঁদের কাছে পৌঁছায় না। বহুবার বহুভাবে তাঁদের কানে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে টাকা দিয়েই সবকিছু হয় না। টাকা দিয়ে যাঁরা সুখ অর্জন করতে চান, তাঁরা চিরকালই বোকার স্বর্গে বসবাস করেন।
আমাদের দেশে অনেক উদাহরণ ছিল যাঁরা চিরজীবন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছেন, যাঁরা বিস্তর সম্পদকে দান করে দিয়ে সর্বহারা মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। অনেক জমিদার তাঁদের আভিজাত্য এবং জমিদারি ছেড়ে দারিদ্র্যের জীবন যাপন করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াও যাঁরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছেন, এমনকি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করেছেন, তাঁরাও এক কাপড়ে এক জোড়া জুতায় এক বেলা খেয়ে মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। অন্যদিকে রাজনীতিবিদদের একটা বড় অংশ এই সোনারখনি সোনার বাংলার বিপুল সম্পদকে নানাভাবে লুণ্ঠন করে, পাচার করে প্রবাসে এক অদ্ভুত জীবনযাপন করছেন। কালক্রমে ওইসব নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিকেরা পেছনের সারিতে থেকে গেছেন ও বর্ণাঢ্য জীবনযাপনকারীরাই রাষ্ট্রক্ষমতাকে আগলে রেখেছেন।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমলাতন্ত্র। বড় বড় আমলা অবসর নেওয়ার পর তাঁরা আর এ দেশে থাকছেন না, থাকলেও যেকোনো দলের উচ্চ পদে সমাসীন হয়ে এই লুণ্ঠনপর্বের একটা বড় অংশীদার হয়ে পড়ছেন। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজনবোধে ধর্মকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল, তাই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারটার সব সময়ই একটা নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। যখন পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের লড়াই চলছিল, ভাষার প্রশ্নে এ দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছিল, তখনো ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধিতা হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতিবিদেরাই পাকিস্তানের নৃশংস সেনাবাহিনীর পক্ষপাতিত্ব করেছেন।
যেহেতু এ দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ ও ধর্মভীরু, তাই রাজনীতিবিদেরাও সেই সুযোগটা ভালোভাবেই কাজে লাগান। অবৈধ অর্থ অর্জন করা টাকায় মসজিদ-মাদ্রাসা করে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে জায়গা করে নেন। রাজনীতিতে এসে সেই টাকা পুরোমাত্রায় উশুল করে নেন। আজকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক, দেখা যাবে সত্যিকার অর্থে কোনো দেশপ্রেমিক কল্যাণকামী কোনো মানুষের নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাঁদের দাবিয়ে রাখার জন্য পুলিশ-প্রশাসন সদা প্রস্তুত। এর মধ্যে দু-চারজন ব্যতিক্রমী মানুষ পাওয়াও যায়। আজ অবধি রাষ্ট্রক্ষমতার এই কার্যচক্রকে কিছুতেই বদলানো যাচ্ছে না। একদল বিদায় নিচ্ছে, আরেক দল নতুন পরিচয়ে এসে যাচ্ছে।
তবে মানুষ এখন বারবার প্রশ্ন তোলে—টাকা কোথা থেকে এল? অর্থাৎ টাকাই রাজনীতির নিয়ামক শক্তি। আদর্শ নয়, অঙ্গীকার নয়, কর্মতৎপরতা নয়, সঠিক কর্মসূচি নয়, জাতির শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোনো দিকনির্দেশনা নয়, সবকিছুর মূলে অর্থ। অর্থ দিয়েই সবকিছু হয়—মানুষকে রাতারাতি পাল্টে দেওয়া যায়, একটা মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। একটা মানুষের জীবনে কত অর্থ লাগে? রাজনীতিবিদেরা চিরদিনই জনগণের অর্থে রাজনীতি করেন, এ কথা সত্যি। কিন্তু এখন আর জনগণের অর্থে নয়, মোটা টাকাওয়ালা লুণ্ঠনকারীদের অর্থেই রাজনীতি করে থাকেন। তাই জনগণকে তোয়াক্কা করার তাঁদের প্রয়োজন পড়ে না।
সাধারণ জীবনযাপন এবং সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য যে সার্বক্ষণিক ক্রিয়াকর্ম—সেসব কথা এখন অর্থহীন। ছোটখাটো রাজনীতিবিদেরাও যে জীবনযাপন করেন, তাতে সন্দেহ জাগাটা খুব স্বাভাবিক যে এই অর্থের উৎস কোথায়? আবার এ কথাও বাস্তব—জীবনযাপনের প্রয়োজনটা এত বেড়ে গেছে যে খুব অল্প টাকায় সংসার চালানো সম্ভব নয়। তাই সব সময়ই ছোট রাজনীতিবিদেরা বড় রাজনীতিবিদ এবং বড় পুঁজিপতিদের করুণার পাত্র হয়ে থাকেন। কিন্তু এ কথাও তো সত্যি—‘কঠিনেরে আমি ভালোবাসিলাম’—যাঁরা দেশের জন্য কাজ করতে চান, তাঁদের কঠিন পথটাকেই বেছে নিতে হয়। সে পথে অনাহার আছে, দারিদ্র্য আছে, অনিশ্চয়তা আছে, সরকারের জেল-জুলুম আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে মানুষ হতে হবে। টাকা দিয়ে কেনা মানুষ নয়, একেবারে খাঁটি সত্যবাদী মানুষ। সেই মানুষের যে এ দেশে খুব অভাব আছে তা মনে হয় না। কিন্তু নেতা-কর্মীরা কি তাদের কাছে পৌঁছানোর কখনো চেষ্টা করেছেন?
মানুষের একটা বড় প্রত্যাশা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি। এখনো সেই প্রত্যাশা অমূলক নয়, কারণ চিরদিন এই কমিউনিস্টরা সঠিক রাজনীতি ও সঠিক পথের অনুসন্ধান দিয়েছেন। অবশ্য সেখানে যে ভুলভ্রান্তি নেই, তা নয়। কিন্তু শক্তি যদি এত বিভক্ত হয় তাহলেই সংকটটা বাড়ে। এমন দেশও আছে যেখানে নীতি-আদর্শ ও কৌশলের প্রশ্নে পার্টি বিভক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে তাদের খুব দ্রুতই ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আজকে একেবারে অকারণে কমিউনিস্ট পার্টির অফিস ধ্বংস করার যে ঘোষণা এসেছে, তা যেকোনোভাবে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে পরাভূত করা প্রয়োজন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সংকট থাকলেও পৃথিবীর অনেক দেশে এখনো কমিউনিস্ট মতাদর্শ মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। সত্যিকারের রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি...
লেখক:– নাট্যব্যক্তিত্ব
অন্তর্বর্তী সরকার ৮ আগস্ট ২০২৪ রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর সংবিধান সংস্কারের জন্য যে কমিশন গঠন করেছিল, তারা গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ওয়েবসাইটে তাদের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন...
১৯ ঘণ্টা আগেসংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে টানাপোড়েন আগে থেকেই চলে এসেছে। তারপর যত দিন যাচ্ছে ততই এই বিষয় নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নতুন একটি মেরুকরণের সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নতুন এই মেরুকরণের এক মেরুতে বিএনপি। সংস্কার ও নির্বাচনের প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে শতভাগ সহমত পোষণ করে অন্য কোন কোন দল তাদের সঙ্গে থাকবে...
১৯ ঘণ্টা আগেঈদে ঢাকা ছাড়বে অন্তত এক কোটি মানুষ। বিমান, রেলগাড়ি, লঞ্চ বা স্টিমারে এই যাত্রীদের একটা অংশ ঢাকা ছাড়বেন ঠিকই, কিন্তু মূল চাপটি থাকবে স্থলপথে। প্রতিবারের মতোই ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথগুলোয় ভোগান্তিতে পড়তে পারে শিকড়ের টানে বাড়ি ফেরার পথে থাকা মানুষ। এ নিয়ে ২০ মার্চ আজকের পত্রিকায় মূল শিরোনাম হয়েছে।
১৯ ঘণ্টা আগেআমরা আমাদের সমাজকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছি, যেখান থেকে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ আর নেই। কোন জায়গায় নিয়ে এসেছি? যে জায়গায় গণতান্ত্রিক চর্চা শূন্যের কোঠায়, যেখানে প্রতিক্রিয়াশীলতার বাড়বাড়ন্ত। একদিকে গণতন্ত্র খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাদের মরিয়া প্রচেষ্টা, অপরদিকে নারীরা সমাজে ধর্ষিত, যারপরনাই নিগৃহীত ও নিষ্পেষিত।
২ দিন আগে