ড. মো. গোলাম রহমান
মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে মনে পড়ে যায় সেইসব স্মৃতি, যা নাকি আমাদের শুধু গর্ব করতেই শেখায় না, বরং বিশ্বের বুকে জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে স্নাত, দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম এবং কোটি কোটি মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয়।
ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি পাকিস্তান আমলের শোষণ-বঞ্চনার ঘটনাবলি। আমরা দেখেছি সেই সময় দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে কত নির্মমভাবে বাংলার মানুষ নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত হয়েছে। চাকরি, ব্যবসা, প্রশাসন—সব ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য ছিল চরম আকারের। ‘বাজেটের ৭৫ শতাংশ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে, ২৫ শতাংশ ব্যয় হতো পূর্ব পাকিস্তানে, যদিও পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাজস্ব আয় ছিল বেশি, শতকরা ৬২ ভাগ। সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল সেনাবাহিনীর সংখ্যা, পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যের সংখ্যা ছিল ২৫ গুণ বেশি।’ (সূত্র: নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট)
এক উপমহাদেশে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার ব্যবধানে একই দেশের দুই প্রান্তে অবস্থিত—পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। শুধু ভৌগোলিক অবস্থানগত ব্যবধান নয়, এই দুই অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ সবই ছিল ভিন্ন। একমাত্র ইসলাম ধর্মই ছিল বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে মেলবন্ধনের একটি সূত্র। সেই ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা করার জন্য উভয়েরই প্রচেষ্টা কার্যকরভাবে রক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের একগুঁয়েমি এবং অর্থনৈতিক শোষণের কারণে ভিন্ন পরিণতি লাভ করেছিল।
ভাষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষের মনোজগৎ ছিল পুরো ভিন্ন প্রকৃতির। শুধু শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল না, সর্বসাধারণের আচার-আচরণেও এসব বড় রকমে ধরা পড়ত। কায়েমি স্বার্থবাদী পাকিস্তানের শাসকচক্র ছিল পূর্ব বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রেখে বাঙালি জাতিকে হেয় করার প্রচেষ্টায়। এইসব অন্যায়-অত্যাচার রুখে দাঁড়ানোর আন্দোলন চলছিল পাকিস্তানের গোড়াপত্তনের শুরু থেকে। রক্তস্নাত এই ইতিহাস দীর্ঘ এবং বাঙালি জাতির এক গৌরবময় অধ্যায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে কমান্ডো বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু সেই ঘোষণায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার আহ্বান জানান। ওয়্যারলেসে তাঁর ঘোষণাটি সেই সময়কার ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। ঘোষণাটি এমন একটি সময়ে প্রচারিত হয় যখন মধ্যরাত পার হয়ে ২৬ মার্চ হয়ে গেছে, তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস হচ্ছে ২৬ মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনাকালে ২৬ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাকে বোঝায়। পরের দিন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
পুরো জাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করল বাঙালি নিধন এবং ঘরে ঘরে ঢুকে নির্যাতন। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত হতে থাকে। প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কিছুসংখ্যক রাজাকার, আলবদর, আলশামস অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করে। এদিকে তাজউদ্দীন আহমদ অন্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। এপ্রিলের ১০ তারিখ মুজিবনগর থেকে ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সনদ ঘোষণা করা হয়। এই সনদটির মাধ্যমে বাংলাদেশ নৈতিক ও আইনগতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় উপরাষ্ট্রপতি। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনা করেন।
যাঁরা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কয়েকটি প্রজন্মের নাগরিক তাঁদের উপলব্ধির জন্য ইতিহাস থেকে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বকারী প্রায় প্রতিটি আসনে জয়লাভ করে, যা তাদের জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অবশ্য অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে তাদের ক্ষমতা গ্রহণ থেকে বিরত রাখেন।
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (মুজিবনগর নামকরণ করা হয়েছিল) বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে শপথ গ্রহণ করে তাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। তাদের প্রথম দায়িত্ব বাংলাদেশের মাটিতে রয়ে যাওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করা।
আজকের দিনে স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এই দেশে অনেক জল গড়িয়েছে পদ্মা মেঘনা যমুনায়। স্বাধীনতার পর দেশের পোড়া মাটি আর ভাঙাচোরা অবকাঠামোতে না ছিল মিল-ফ্যাক্টরিগুলোতে কোনো উৎপাদন, না ছিল কোনো মূলধন। কিন্তু তারপরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে পুরো জাতি এক হয়ে দেশের অর্থনীতিতে আত্মনিয়োগ করেছে। দেশকে অর্থনৈতিক দিক থেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। দেশকে ফুলে-ফসলে ভরিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে এই দেশের মানুষ। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভূত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, জীবনমান থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। স্বাধীনতার স্বাদ সবাই কম-বেশি গ্রহণ করেছে।
আজ পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, দেশের মানুষ তাদের অদম্য চেষ্টায় যার যার যা সহায় সম্বল আছে তার ওপর ভিত্তি করে নিজেদের অর্থনৈতিক দিক থেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নারী-পুরুষ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্বের এগিয়ে চলা দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো দেশ একাকী ভালো থাকতে পারে না; একাকী স্থায়ী উন্নয়ন করতে পারে না। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান রাখা অতি জরুরি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব ধারায়।
ধান উৎপাদন, মাছ চাষ, রবিশস্যের ফলন এবং নানাবিধ ফলের চাষ, দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদাকে জোগান দিয়ে চলেছে খেটে খাওয়া মানুষ। এতে করে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রে দেশের নিজস্ব সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতার এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের কৃষক আমাদের জাতির জন্য খাদ্য উৎপাদন করে আত্মনির্ভর জাতি হিসেবে গড়ে তোলার যে অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে, তাতে পুরো জাতি গর্ব বোধ করে। তৈরি পোশাক রপ্তানি, চা উৎপাদন এবং ওষুধশিল্পের প্রভূত উন্নতি সাধন হয়েছে দেশে। মানবসম্পদকে মর্যাদার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে বিদেশে শ্রমবাজার নিশ্চিত করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমাজে নানা পেশার নানা মতবাদের মানুষ দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ে বহুত্ববাদী চিন্তা-চেতনায় দেশকে ভালোবেসে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে চান কিংবা দেশের জন্য অবদান রাখতে চান। কিন্তু অনেকেরই দেশের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক এবং তথ্যগত জ্ঞানের অভাবের কারণে অথবা চটুল ও সস্তা আলোচনায় জড়িয়ে পড়ে তাঁদের বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। দৃষ্টিনিরপেক্ষ এবং নির্মোহ আলোচনার সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিভ্রান্তির শিকার হন। আজকের প্রজন্ম কিংবা যাঁদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই, তাঁদের জন্য আমাদের দায়বদ্ধতা হছে জাতিকে সঠিক ইতিহাস জানতে সহায়তা করা, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরে নবীন প্রজন্মকে এগিয়ে নেওয়া। সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস জানা যতটা প্রয়োজনীয়, সত্যকে অস্বীকার করা ততটাই অপমানজনক। মানুষের ভুলভ্রান্তি হতেই পারে কিন্তু ভুল স্বীকার করে তা জানার মধ্যে আমি কোনো অপমান দেখি না। বরং ভুল বা অপতথ্যকে আশকারা দিয়ে মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।
আজকের দিনে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন সাফল্যে নিজেদের অবদানকে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরতে চাই; যেহেতু আমরা নতুন প্রজন্মের অবদান নিয়ে গর্ব করতে চাই সেহেতু, ভুল বা বিভ্রান্তিমূলক অপতথ্যে নিজেদের যেন না জড়াই। আমরা যেন সত্যনিষ্ঠ হই; আমরা যেন সত্য অনুসন্ধানী হই। আমরা যেন চাটুকারের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে নিজেদের সম্ভাবনার ক্ষেত্রকে ছোট করে না ফেলি, যার যেখানে অবদান তা স্বীকার করতে দ্বিধাগ্রস্ত না হই; সমাজে শুধু হাত পেতে নেওয়ার কথা না ভাবি, হাতের মুঠো খুলে যেন অবারিতভাবে দেওয়ার কথাও ভাবতে পারি।
মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে মনে পড়ে যায় সেইসব স্মৃতি, যা নাকি আমাদের শুধু গর্ব করতেই শেখায় না, বরং বিশ্বের বুকে জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে স্নাত, দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম এবং কোটি কোটি মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয়।
ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি পাকিস্তান আমলের শোষণ-বঞ্চনার ঘটনাবলি। আমরা দেখেছি সেই সময় দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে কত নির্মমভাবে বাংলার মানুষ নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত হয়েছে। চাকরি, ব্যবসা, প্রশাসন—সব ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য ছিল চরম আকারের। ‘বাজেটের ৭৫ শতাংশ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে, ২৫ শতাংশ ব্যয় হতো পূর্ব পাকিস্তানে, যদিও পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাজস্ব আয় ছিল বেশি, শতকরা ৬২ ভাগ। সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল সেনাবাহিনীর সংখ্যা, পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যের সংখ্যা ছিল ২৫ গুণ বেশি।’ (সূত্র: নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট)
এক উপমহাদেশে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার ব্যবধানে একই দেশের দুই প্রান্তে অবস্থিত—পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। শুধু ভৌগোলিক অবস্থানগত ব্যবধান নয়, এই দুই অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ সবই ছিল ভিন্ন। একমাত্র ইসলাম ধর্মই ছিল বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে মেলবন্ধনের একটি সূত্র। সেই ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা করার জন্য উভয়েরই প্রচেষ্টা কার্যকরভাবে রক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের একগুঁয়েমি এবং অর্থনৈতিক শোষণের কারণে ভিন্ন পরিণতি লাভ করেছিল।
ভাষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষের মনোজগৎ ছিল পুরো ভিন্ন প্রকৃতির। শুধু শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল না, সর্বসাধারণের আচার-আচরণেও এসব বড় রকমে ধরা পড়ত। কায়েমি স্বার্থবাদী পাকিস্তানের শাসকচক্র ছিল পূর্ব বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রেখে বাঙালি জাতিকে হেয় করার প্রচেষ্টায়। এইসব অন্যায়-অত্যাচার রুখে দাঁড়ানোর আন্দোলন চলছিল পাকিস্তানের গোড়াপত্তনের শুরু থেকে। রক্তস্নাত এই ইতিহাস দীর্ঘ এবং বাঙালি জাতির এক গৌরবময় অধ্যায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে কমান্ডো বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু সেই ঘোষণায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার আহ্বান জানান। ওয়্যারলেসে তাঁর ঘোষণাটি সেই সময়কার ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। ঘোষণাটি এমন একটি সময়ে প্রচারিত হয় যখন মধ্যরাত পার হয়ে ২৬ মার্চ হয়ে গেছে, তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস হচ্ছে ২৬ মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনাকালে ২৬ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাকে বোঝায়। পরের দিন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
পুরো জাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করল বাঙালি নিধন এবং ঘরে ঘরে ঢুকে নির্যাতন। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত হতে থাকে। প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কিছুসংখ্যক রাজাকার, আলবদর, আলশামস অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করে। এদিকে তাজউদ্দীন আহমদ অন্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। এপ্রিলের ১০ তারিখ মুজিবনগর থেকে ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সনদ ঘোষণা করা হয়। এই সনদটির মাধ্যমে বাংলাদেশ নৈতিক ও আইনগতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় উপরাষ্ট্রপতি। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনা করেন।
যাঁরা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কয়েকটি প্রজন্মের নাগরিক তাঁদের উপলব্ধির জন্য ইতিহাস থেকে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বকারী প্রায় প্রতিটি আসনে জয়লাভ করে, যা তাদের জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অবশ্য অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে তাদের ক্ষমতা গ্রহণ থেকে বিরত রাখেন।
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (মুজিবনগর নামকরণ করা হয়েছিল) বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে শপথ গ্রহণ করে তাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। তাদের প্রথম দায়িত্ব বাংলাদেশের মাটিতে রয়ে যাওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করা।
আজকের দিনে স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এই দেশে অনেক জল গড়িয়েছে পদ্মা মেঘনা যমুনায়। স্বাধীনতার পর দেশের পোড়া মাটি আর ভাঙাচোরা অবকাঠামোতে না ছিল মিল-ফ্যাক্টরিগুলোতে কোনো উৎপাদন, না ছিল কোনো মূলধন। কিন্তু তারপরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে পুরো জাতি এক হয়ে দেশের অর্থনীতিতে আত্মনিয়োগ করেছে। দেশকে অর্থনৈতিক দিক থেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। দেশকে ফুলে-ফসলে ভরিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে এই দেশের মানুষ। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভূত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, জীবনমান থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। স্বাধীনতার স্বাদ সবাই কম-বেশি গ্রহণ করেছে।
আজ পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, দেশের মানুষ তাদের অদম্য চেষ্টায় যার যার যা সহায় সম্বল আছে তার ওপর ভিত্তি করে নিজেদের অর্থনৈতিক দিক থেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নারী-পুরুষ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্বের এগিয়ে চলা দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো দেশ একাকী ভালো থাকতে পারে না; একাকী স্থায়ী উন্নয়ন করতে পারে না। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান রাখা অতি জরুরি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব ধারায়।
ধান উৎপাদন, মাছ চাষ, রবিশস্যের ফলন এবং নানাবিধ ফলের চাষ, দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদাকে জোগান দিয়ে চলেছে খেটে খাওয়া মানুষ। এতে করে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রে দেশের নিজস্ব সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতার এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের কৃষক আমাদের জাতির জন্য খাদ্য উৎপাদন করে আত্মনির্ভর জাতি হিসেবে গড়ে তোলার যে অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে, তাতে পুরো জাতি গর্ব বোধ করে। তৈরি পোশাক রপ্তানি, চা উৎপাদন এবং ওষুধশিল্পের প্রভূত উন্নতি সাধন হয়েছে দেশে। মানবসম্পদকে মর্যাদার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে বিদেশে শ্রমবাজার নিশ্চিত করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমাজে নানা পেশার নানা মতবাদের মানুষ দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ে বহুত্ববাদী চিন্তা-চেতনায় দেশকে ভালোবেসে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে চান কিংবা দেশের জন্য অবদান রাখতে চান। কিন্তু অনেকেরই দেশের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক এবং তথ্যগত জ্ঞানের অভাবের কারণে অথবা চটুল ও সস্তা আলোচনায় জড়িয়ে পড়ে তাঁদের বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। দৃষ্টিনিরপেক্ষ এবং নির্মোহ আলোচনার সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিভ্রান্তির শিকার হন। আজকের প্রজন্ম কিংবা যাঁদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই, তাঁদের জন্য আমাদের দায়বদ্ধতা হছে জাতিকে সঠিক ইতিহাস জানতে সহায়তা করা, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরে নবীন প্রজন্মকে এগিয়ে নেওয়া। সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস জানা যতটা প্রয়োজনীয়, সত্যকে অস্বীকার করা ততটাই অপমানজনক। মানুষের ভুলভ্রান্তি হতেই পারে কিন্তু ভুল স্বীকার করে তা জানার মধ্যে আমি কোনো অপমান দেখি না। বরং ভুল বা অপতথ্যকে আশকারা দিয়ে মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।
আজকের দিনে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন সাফল্যে নিজেদের অবদানকে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরতে চাই; যেহেতু আমরা নতুন প্রজন্মের অবদান নিয়ে গর্ব করতে চাই সেহেতু, ভুল বা বিভ্রান্তিমূলক অপতথ্যে নিজেদের যেন না জড়াই। আমরা যেন সত্যনিষ্ঠ হই; আমরা যেন সত্য অনুসন্ধানী হই। আমরা যেন চাটুকারের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে নিজেদের সম্ভাবনার ক্ষেত্রকে ছোট করে না ফেলি, যার যেখানে অবদান তা স্বীকার করতে দ্বিধাগ্রস্ত না হই; সমাজে শুধু হাত পেতে নেওয়ার কথা না ভাবি, হাতের মুঠো খুলে যেন অবারিতভাবে দেওয়ার কথাও ভাবতে পারি।
আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে ‘বঞ্চিত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো’ কর্মকর্তাদের মধ্যে ১১৯ জন ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়ে সচিব হয়েছেন। গত মাসে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের কেউ কেউ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতিপূরণ পাবেন।
২৩ মিনিট আগেমার্চ মাস চলছে। এখনো লাখ লাখ শিক্ষার্থী তাদের সম্পূর্ণ পাঠ্যপুস্তক পায়নি। এটিকে যদি আমরা জাতীয় জরুরি অবস্থা না বলি, তাহলে আর কোনটাকে বলব? শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। প্রথম দিকে আমরা দেখলাম বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সমন্বয়কদের নামে হেনস্তা করা হচ্ছে।
৩০ মিনিট আগেপ্রবীণ বয়সে অনেকের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে এবং গুরুত্ব কমতে থাকে। দীর্ঘ জীবনলাভের মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন। সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে ভালো লাগে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের চোখের সামনে দেখলে জীবনের নানা চড়াই-উতরাইয়ের কথা মনে পড়ে।
৩৬ মিনিট আগেআন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিন প্রকাশিত পত্রিকায় যদি পড়তে হয় ৮ বছর বয়সী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তাহলে দিবসটির মূল প্রতিপাদ্যই ম্লান হয়ে পড়ে। ঘটনাটির নৃশংসতা বিবেচনা করুন। মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে এসেছে ৮ বছর বয়সী অভয়া (কল্পিত নাম)।
৪০ মিনিট আগে