বিধান রিবেরু
ধর্ম মানুষের জীবনে অপরিহার্য, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমি নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের কথা বলছি না। পৃথিবীতে মূলধারার ধর্মের সংখ্যাই প্রায় কুড়িটির মতো রয়েছে, এ ছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ঐতিহ্যগত ও স্থানীয় অনেক ধর্ম রয়েছে। ধর্মহীনতাও প্রকৃত অর্থে ধর্মই। কাজেই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ধর্ম মানুষকে একধরনের আশ্রয় দেয়। তবে এটাও সত্য, ধর্ম মানুষকে বিভাজিতও করে, কখনো কখনো অসহিষ্ণু ও হিংস্রও করে তোলে। আমরা ইতিহাস থেকে ক্রুসেড বা দাঙ্গার কথা জানি। আমার মতে, এই বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পকে কিছুটা হলেও দূর করা সম্ভব যদি দুটি পদক্ষেপ নেওয়া যায়। প্রথমটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, দ্বিতীয়টি সামাজিকভাবে।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা দূর করার বড় একটি জায়গা হলো বিদ্যালয়। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে নির্দিষ্ট ধর্মবই পড়ানোর বদলে একটি সমন্বিত ও পরিকল্পিত বই থাকা প্রয়োজন, যেখানে মূলধারার ধর্মের পাশাপাশি আঞ্চলিক ধর্মবিশ্বাস, নীতিশিক্ষা, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন নিয়ে আলাপ থাকবে। এবং সেটা শুরু হবে পঞ্চম শ্রেণি থেকে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে ইশপের গল্পই যথেষ্ট। এরপর ছেলেমেয়েরা ধর্মকে জানতে শুরু করবে মানবজাতির ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে। ধর্মকে আলাদা করে পাঠ করে নিজের ধর্মকে তথা নিজ সম্প্রদায়কে শ্রেষ্ঠ ভাবার কোনো অবকাশ নেই। দুনিয়াটা সবার। মানুষ থেকে কীটপতঙ্গ, সর্বপ্রাণীর। এই পৃথিবীতে প্রত্যেকেরই গুরুত্ব রয়েছে। এটাই হওয়া উচিত মানুষ হিসেবে মানবশিশুর গোড়ার শিক্ষা। কিন্তু আমরা ধর্মশিক্ষার নামে ‘আমরা আর তোমরা’ এই বিভেদরেখা টানতে শেখাই।
উন্নত বিশ্বের লেখাপড়ায় শিশু বয়সে আলাদা আলাদা ধর্মের বই পাঠ করানো এবং তাদের মানসিকভাবে বন্ধুদের সঙ্গে বিভেদ তৈরি করে দেওয়ার নজির নেই। সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তানসহ কিছু দেশে বাংলাদেশের মতোই বিদ্যালয়ে ধর্মশিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা সেই উদাহরণ কেন অনুসরণ করতে যাব? আমরা যদি উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চাই, আমার মনে হয় বিদ্যালয়ে পাঠদানের দিকে নজর দিতে হবে।
আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠ্যবইকে রাজনীতিকরণের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়। আজ অমুক ভালো, তো কাল তমুক খারাপ। এই ভালো আর খারাপের দোলাচলে কোমলমতি শিশুদের অবস্থা খারাপ। তাদের নিয়ে রাজনীতি করার কিছু নেই। ভিন্নভাবে বললে, তাদের মগজধোলাই করার যে খেলা প্রতিবার পরিলক্ষিত হয়, সেটি দুঃখজনক ও অন্যায়। রাজনীতি ও মতাদর্শের বাইরে রেখে তাদের আনন্দময় জগতে আপন ছন্দে বাড়তে দেওয়া উচিত। দুনিয়ার সব মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে বড় হয়ে ওঠার মন্ত্র শিখতে দিন তাদের। অযথা শিশুদের ওপর জোরাজুরি করবেন না। দেড় যুগ জোরাজুরি হয়েছে, তাতে কি কোনো লাভ হলো? এই দেড় যুগ থেকেও যদি কেউ শিখতে না পারে, পাঠ্যবই নিয়ে কুস্তি লড়ে এবং শিশুদের মগজধোলাইয়ে লিপ্ত হয়, তাহলে বলতে হয়, তারা ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। মজার বিষয়, যত সরকারই পরিবর্তন হোক না কেন, তারা কিন্তু একটা জিনিস অপরিবর্তিত রাখে, সেটি হলো ধর্মশিক্ষা। শিশুদের আলাদা আলাদা করে নিজ নিজ ধর্মশিক্ষা শ্রেণিকক্ষে শেখানোর কিছু নেই। ধর্মশিক্ষার জন্য পরিবারই যথেষ্ট। কোনো পরিবার যদি ধর্মীয় ভাবাদর্শে দীক্ষিত হয়ে সৎ ও সুন্দর পথে চলে, তাহলে সেই পরিবারের শিশুরা আপনা থেকেই সেই ধর্মকে অনুসরণ করবে। তার বাড়তি পাওনা হবে, বিদ্যালয়ে অন্য ধর্ম সম্পর্কেও জ্ঞানলাভ করা।
ধর্ম মানুষ পালন করবে তার জীবনাচরণে, কিন্তু একে আমরা পরীক্ষা আর নম্বরে নামিয়ে এনেছি। শিক্ষার্থীরা নিজ ধর্ম সম্পর্কে পড়ে পরীক্ষায় পাসের জন্য। অথচ বিষয়টি হওয়া উচিত ছিল—একটি শিশু সব ধর্ম সম্পর্কে জানবে, বিবিধ ধর্মের ভেতর মিল ও অমিল নিয়ে সচেতন হবে, সর্বোপরি সব ধর্মের বাণী যে মানবতা আর সততার কথা বলে, সেটা সে বুঝতে শিখবে। সবচেয়ে বড় কথা, সব ধর্মকে জানা-বোঝার মাধ্যমে তাদের ভেতর একধরনের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হবে এবং তারা যখন সব ধর্ম সম্পর্কে পড়ে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনায় মেতে উঠবে, তখন তারা বুঝতে পারবে মানবজাতি বিভাজনের জন্য নয়, সর্বদা প্রচেষ্টা করেছে মেলবন্ধনের, জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার। অথচ আমরা শিক্ষার্থীদের প্রারম্ভিক জীবনেই ধর্মশিক্ষার নামে এক বন্ধুর কাছ থেকে আরেক বন্ধুকে বিচ্ছিন্ন করে দিই। বীজ বুনে দিই সাম্প্রদায়িক চেতনার।
এই ভয়ংকর বীজ পুড়িয়ে ফেলার আরেকটি পথ হলো সামাজিক আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলনের ভেতর সর্বাগ্রে রাখতে চাই পরিবার ও পাড়া-মহল্লায় পাঠাগার গঠন। সেখানে ধর্মীয় বই নয়, বরং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ধ্রুপদি সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান, ভ্রমণ, রম্য ও কল্পবিজ্ঞানের বইপত্র থাকবে। শিশুদের মনে মানবিক বোধ গড়ে তোলা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক রসবোধ নির্মাণে এই পাঠাগার সহায়তা করবে। শুধু তা-ই নয়, এই পাঠাগারকে ব্যবহার করা প্রয়োজন সিনেমা প্রদর্শনের কেন্দ্র হিসেবেও। প্রতি সপ্তাহে শিশুদের বয়স অনুযায়ী চলচ্চিত্র দেখানো গেলে আনন্দ পাওয়ার পাশাপাশি শিশুরা দৃশ্যমাধ্যম সম্পর্কে শিক্ষিত হয়ে উঠবে। বইপাঠে তাদের কল্পনাশক্তি প্রখর হবে আর চলচ্চিত্র দর্শনে চিন্তাশীল হয়ে উঠবে তাদের মনন।
এই পাঠাগারকে কেন্দ্র করেই আয়োজন হতে পারে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। তারা নিজেরা তৈরি করতে পারে দেয়ালপত্রিকা। আজকাল বোধ হয় এই দেয়ালপত্রিকা তৈরির চলটা উঠেই গেছে। বইপাঠ, সিনেমা দেখা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা, দেয়ালপত্রিকা বানানো—কাজগুলো করা যেতে পারে পরিবারের ভেতরেও। ভাইবোন মিলে এসব কাজের ভেতর দিয়ে শিশুদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটবে। তাতে পরিবারের বাইরে থাকা অন্য ধর্মের বন্ধুদের ব্যাপারে তারা উদার হতে শিখবে। ইদানীং বলা হচ্ছে: ধর্ম যার, উৎসবও তার। অথচ এই কিছুদিন আগেও বলা হতো: ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। এই কথার ভেতর যে অসাম্প্রদায়িক ভাবনা আছে, সেটি কিন্তু এখন উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছে। অর্থাৎ সামাজিকভাবেই লোকজনকে প্ররোচিত করা হচ্ছে কেউ যেন কারও সামাজিক অনুষ্ঠানে মেলামেশা না করে। কী আশ্চর্য! ধর্ম বাদ দিয়ে সমাজ হয় না। আর সমাজে একজনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যদি অন্য ধর্মের মানুষ না আসে, তাহলে সেই সমাজও টিকে থাকে না। টিকে থাকলেও সেটি বিষময় হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে প্রতিক্রিয়াশীল।
কাজেই প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে চাই, তাহলে অনতিবিলম্বে পাঠ্যক্রম থেকে আলাদা আলাদা ধর্মের বই উঠিয়ে দিতে হবে। এর পরিবর্তে সবার জন্য অভিন্ন ধর্মের বই চালু করতে হবে। যে বইতে মোটামুটি সব ধর্ম সম্পর্কে আলাপ থাকবে এবং সে আলোচনা ধীরে ধীরে গভীরতর হবে উচ্চশ্রেণিতে। এতে করে ধর্ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে একটি শিশু বড় হবে। এটি স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। অর্থাৎ চাইলেই এই পরিকল্পনা আমরা প্রয়োগ করতে পারি। কিন্তু সামাজিক আন্দোলন শুরু না করে, পাঠ্যবইয়ে হাত দিলে বিপর্যয় ঘটবে। সমাজের ভেতর যে এরই মধ্যে গজিয়ে ওঠা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আছে, তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। তাই সামাজিক আন্দোলনের মতো দীর্ঘমেয়াদি একটি বিষয় শুরুর সমান্তরালেই পাঠ্যবই পরিবর্তনে হাত দিতে হবে। যেন সমাজের পক্ষ থেকে এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সম্মতি পাওয়া যায়।
সম্মতি উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশের বুদ্ধিজীবীরা তো বটেই, আমি মনে করি রাষ্ট্রকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। রাষ্ট্রের সদিচ্ছা ছাড়া অসাম্প্রদায়িক মানুষ ও সমাজ গঠন অসম্ভব। রাষ্ট্র যদি ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, রাষ্ট্র যদি ধর্মের নামে নিজের দেশের মানুষের মধ্যেই ভেদাভেদ তৈরি করে রাখতে চায়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের করুণ দশা কেউ ঠেকাতে পারবে না। এই অবস্থা নিরসনে সমাজের ভেতর থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রগতিশীল শক্তির প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে সঠিক দিশা খুঁজে বের করা।
ধর্ম মানুষের জীবনে অপরিহার্য, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমি নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের কথা বলছি না। পৃথিবীতে মূলধারার ধর্মের সংখ্যাই প্রায় কুড়িটির মতো রয়েছে, এ ছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ঐতিহ্যগত ও স্থানীয় অনেক ধর্ম রয়েছে। ধর্মহীনতাও প্রকৃত অর্থে ধর্মই। কাজেই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ধর্ম মানুষকে একধরনের আশ্রয় দেয়। তবে এটাও সত্য, ধর্ম মানুষকে বিভাজিতও করে, কখনো কখনো অসহিষ্ণু ও হিংস্রও করে তোলে। আমরা ইতিহাস থেকে ক্রুসেড বা দাঙ্গার কথা জানি। আমার মতে, এই বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পকে কিছুটা হলেও দূর করা সম্ভব যদি দুটি পদক্ষেপ নেওয়া যায়। প্রথমটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, দ্বিতীয়টি সামাজিকভাবে।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা দূর করার বড় একটি জায়গা হলো বিদ্যালয়। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে নির্দিষ্ট ধর্মবই পড়ানোর বদলে একটি সমন্বিত ও পরিকল্পিত বই থাকা প্রয়োজন, যেখানে মূলধারার ধর্মের পাশাপাশি আঞ্চলিক ধর্মবিশ্বাস, নীতিশিক্ষা, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন নিয়ে আলাপ থাকবে। এবং সেটা শুরু হবে পঞ্চম শ্রেণি থেকে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে ইশপের গল্পই যথেষ্ট। এরপর ছেলেমেয়েরা ধর্মকে জানতে শুরু করবে মানবজাতির ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে। ধর্মকে আলাদা করে পাঠ করে নিজের ধর্মকে তথা নিজ সম্প্রদায়কে শ্রেষ্ঠ ভাবার কোনো অবকাশ নেই। দুনিয়াটা সবার। মানুষ থেকে কীটপতঙ্গ, সর্বপ্রাণীর। এই পৃথিবীতে প্রত্যেকেরই গুরুত্ব রয়েছে। এটাই হওয়া উচিত মানুষ হিসেবে মানবশিশুর গোড়ার শিক্ষা। কিন্তু আমরা ধর্মশিক্ষার নামে ‘আমরা আর তোমরা’ এই বিভেদরেখা টানতে শেখাই।
উন্নত বিশ্বের লেখাপড়ায় শিশু বয়সে আলাদা আলাদা ধর্মের বই পাঠ করানো এবং তাদের মানসিকভাবে বন্ধুদের সঙ্গে বিভেদ তৈরি করে দেওয়ার নজির নেই। সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তানসহ কিছু দেশে বাংলাদেশের মতোই বিদ্যালয়ে ধর্মশিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা সেই উদাহরণ কেন অনুসরণ করতে যাব? আমরা যদি উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চাই, আমার মনে হয় বিদ্যালয়ে পাঠদানের দিকে নজর দিতে হবে।
আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠ্যবইকে রাজনীতিকরণের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়। আজ অমুক ভালো, তো কাল তমুক খারাপ। এই ভালো আর খারাপের দোলাচলে কোমলমতি শিশুদের অবস্থা খারাপ। তাদের নিয়ে রাজনীতি করার কিছু নেই। ভিন্নভাবে বললে, তাদের মগজধোলাই করার যে খেলা প্রতিবার পরিলক্ষিত হয়, সেটি দুঃখজনক ও অন্যায়। রাজনীতি ও মতাদর্শের বাইরে রেখে তাদের আনন্দময় জগতে আপন ছন্দে বাড়তে দেওয়া উচিত। দুনিয়ার সব মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে বড় হয়ে ওঠার মন্ত্র শিখতে দিন তাদের। অযথা শিশুদের ওপর জোরাজুরি করবেন না। দেড় যুগ জোরাজুরি হয়েছে, তাতে কি কোনো লাভ হলো? এই দেড় যুগ থেকেও যদি কেউ শিখতে না পারে, পাঠ্যবই নিয়ে কুস্তি লড়ে এবং শিশুদের মগজধোলাইয়ে লিপ্ত হয়, তাহলে বলতে হয়, তারা ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। মজার বিষয়, যত সরকারই পরিবর্তন হোক না কেন, তারা কিন্তু একটা জিনিস অপরিবর্তিত রাখে, সেটি হলো ধর্মশিক্ষা। শিশুদের আলাদা আলাদা করে নিজ নিজ ধর্মশিক্ষা শ্রেণিকক্ষে শেখানোর কিছু নেই। ধর্মশিক্ষার জন্য পরিবারই যথেষ্ট। কোনো পরিবার যদি ধর্মীয় ভাবাদর্শে দীক্ষিত হয়ে সৎ ও সুন্দর পথে চলে, তাহলে সেই পরিবারের শিশুরা আপনা থেকেই সেই ধর্মকে অনুসরণ করবে। তার বাড়তি পাওনা হবে, বিদ্যালয়ে অন্য ধর্ম সম্পর্কেও জ্ঞানলাভ করা।
ধর্ম মানুষ পালন করবে তার জীবনাচরণে, কিন্তু একে আমরা পরীক্ষা আর নম্বরে নামিয়ে এনেছি। শিক্ষার্থীরা নিজ ধর্ম সম্পর্কে পড়ে পরীক্ষায় পাসের জন্য। অথচ বিষয়টি হওয়া উচিত ছিল—একটি শিশু সব ধর্ম সম্পর্কে জানবে, বিবিধ ধর্মের ভেতর মিল ও অমিল নিয়ে সচেতন হবে, সর্বোপরি সব ধর্মের বাণী যে মানবতা আর সততার কথা বলে, সেটা সে বুঝতে শিখবে। সবচেয়ে বড় কথা, সব ধর্মকে জানা-বোঝার মাধ্যমে তাদের ভেতর একধরনের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হবে এবং তারা যখন সব ধর্ম সম্পর্কে পড়ে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনায় মেতে উঠবে, তখন তারা বুঝতে পারবে মানবজাতি বিভাজনের জন্য নয়, সর্বদা প্রচেষ্টা করেছে মেলবন্ধনের, জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার। অথচ আমরা শিক্ষার্থীদের প্রারম্ভিক জীবনেই ধর্মশিক্ষার নামে এক বন্ধুর কাছ থেকে আরেক বন্ধুকে বিচ্ছিন্ন করে দিই। বীজ বুনে দিই সাম্প্রদায়িক চেতনার।
এই ভয়ংকর বীজ পুড়িয়ে ফেলার আরেকটি পথ হলো সামাজিক আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলনের ভেতর সর্বাগ্রে রাখতে চাই পরিবার ও পাড়া-মহল্লায় পাঠাগার গঠন। সেখানে ধর্মীয় বই নয়, বরং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ধ্রুপদি সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান, ভ্রমণ, রম্য ও কল্পবিজ্ঞানের বইপত্র থাকবে। শিশুদের মনে মানবিক বোধ গড়ে তোলা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক রসবোধ নির্মাণে এই পাঠাগার সহায়তা করবে। শুধু তা-ই নয়, এই পাঠাগারকে ব্যবহার করা প্রয়োজন সিনেমা প্রদর্শনের কেন্দ্র হিসেবেও। প্রতি সপ্তাহে শিশুদের বয়স অনুযায়ী চলচ্চিত্র দেখানো গেলে আনন্দ পাওয়ার পাশাপাশি শিশুরা দৃশ্যমাধ্যম সম্পর্কে শিক্ষিত হয়ে উঠবে। বইপাঠে তাদের কল্পনাশক্তি প্রখর হবে আর চলচ্চিত্র দর্শনে চিন্তাশীল হয়ে উঠবে তাদের মনন।
এই পাঠাগারকে কেন্দ্র করেই আয়োজন হতে পারে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। তারা নিজেরা তৈরি করতে পারে দেয়ালপত্রিকা। আজকাল বোধ হয় এই দেয়ালপত্রিকা তৈরির চলটা উঠেই গেছে। বইপাঠ, সিনেমা দেখা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা, দেয়ালপত্রিকা বানানো—কাজগুলো করা যেতে পারে পরিবারের ভেতরেও। ভাইবোন মিলে এসব কাজের ভেতর দিয়ে শিশুদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটবে। তাতে পরিবারের বাইরে থাকা অন্য ধর্মের বন্ধুদের ব্যাপারে তারা উদার হতে শিখবে। ইদানীং বলা হচ্ছে: ধর্ম যার, উৎসবও তার। অথচ এই কিছুদিন আগেও বলা হতো: ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। এই কথার ভেতর যে অসাম্প্রদায়িক ভাবনা আছে, সেটি কিন্তু এখন উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছে। অর্থাৎ সামাজিকভাবেই লোকজনকে প্ররোচিত করা হচ্ছে কেউ যেন কারও সামাজিক অনুষ্ঠানে মেলামেশা না করে। কী আশ্চর্য! ধর্ম বাদ দিয়ে সমাজ হয় না। আর সমাজে একজনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যদি অন্য ধর্মের মানুষ না আসে, তাহলে সেই সমাজও টিকে থাকে না। টিকে থাকলেও সেটি বিষময় হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে প্রতিক্রিয়াশীল।
কাজেই প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে চাই, তাহলে অনতিবিলম্বে পাঠ্যক্রম থেকে আলাদা আলাদা ধর্মের বই উঠিয়ে দিতে হবে। এর পরিবর্তে সবার জন্য অভিন্ন ধর্মের বই চালু করতে হবে। যে বইতে মোটামুটি সব ধর্ম সম্পর্কে আলাপ থাকবে এবং সে আলোচনা ধীরে ধীরে গভীরতর হবে উচ্চশ্রেণিতে। এতে করে ধর্ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে একটি শিশু বড় হবে। এটি স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। অর্থাৎ চাইলেই এই পরিকল্পনা আমরা প্রয়োগ করতে পারি। কিন্তু সামাজিক আন্দোলন শুরু না করে, পাঠ্যবইয়ে হাত দিলে বিপর্যয় ঘটবে। সমাজের ভেতর যে এরই মধ্যে গজিয়ে ওঠা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আছে, তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। তাই সামাজিক আন্দোলনের মতো দীর্ঘমেয়াদি একটি বিষয় শুরুর সমান্তরালেই পাঠ্যবই পরিবর্তনে হাত দিতে হবে। যেন সমাজের পক্ষ থেকে এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সম্মতি পাওয়া যায়।
সম্মতি উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশের বুদ্ধিজীবীরা তো বটেই, আমি মনে করি রাষ্ট্রকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। রাষ্ট্রের সদিচ্ছা ছাড়া অসাম্প্রদায়িক মানুষ ও সমাজ গঠন অসম্ভব। রাষ্ট্র যদি ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, রাষ্ট্র যদি ধর্মের নামে নিজের দেশের মানুষের মধ্যেই ভেদাভেদ তৈরি করে রাখতে চায়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের করুণ দশা কেউ ঠেকাতে পারবে না। এই অবস্থা নিরসনে সমাজের ভেতর থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রগতিশীল শক্তির প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে সঠিক দিশা খুঁজে বের করা।
জাতি হিসেবে আমরা তিনটি বড় গণ-অভ্যুত্থানের সাক্ষী। ১৯৬৯, ১৯৯০ এবং সর্বশেষ ২০২৪-এ। তিনটি গণ-অভ্যুত্থানেরই উদগাতা ছাত্রসমাজ। পরে এগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের সম্পৃক্তি ঘটে এবং তা সফল পরিণতি লাভ করে। আজ ২৪ জানুয়ারি উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ৫৬তম বার্ষিকী।
৮ ঘণ্টা আগেনা, এটা কোনো সিনেমার নাম নয়। ‘বাবা কেন চাকর’ কিংবা ‘স্বামী কেন আসামি’ ইত্যাদি নাম দিয়ে চমক সৃষ্টি করা যেতে পারে এবং চলচ্চিত্রের শেষে সেই বাবা বা স্বামীর জয়জয়কারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, কিন্তু ‘কৃষক কেন কাঁদে’ বলা হলে সেই সুখস্বপ্ন দেখার কোনো উপায় নেই। কৃষককে চাইলেও এখন ইতিবাচক কোনো চরিত্রে...
৮ ঘণ্টা আগেগত শতাব্দীর ষাটের দশক ছিল আমাদের স্বপ্নের দশক। ওই দশকেই আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম এবং সব ক্ষেত্রেই সংস্কারের প্রয়োজন গভীরভাবে উপলব্ধ হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বঞ্চনা, সোনার বাংলাকে শ্মশান করার ষড়যন্ত্র, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এব
১ দিন আগেজনতা বিমুক্তি পেরামুনা (পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট) সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতা দখলের জন্য শ্রীলঙ্কায় দুইবার (১৯৭১ ও ১৯৮৭-৮৯) সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিল। এই বিদ্রোহে তাদের দলের মূল নেতা রোহানা উইজেভরাসহ ৪০ হাজার নেতা-কর্মীসহ প্রায় ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এই হঠকারী রাজনীতির কারণে দেশটিতে তাদের প্রচণ্ড সম
১ দিন আগে