সৌভিক রেজা
কার্তেজীয় পদ্ধতির জন্যে যিনি সারা দুনিয়ায় বিখ্যাত, সেই ফরাসি দার্শনিক রনে দেকার্ত মনে করতেন, মানুষের ‘শুভবুদ্ধি থাকাটাই যথেষ্ট নয়, আসল হচ্ছে সেটাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারা।’ কথাটির গুরুত্ব সবার কাছে হয়তো একরকম নয়, তবে এই উপমহাদেশে একজন মানুষের গোটা জীবনের মধ্যে দিয়ে সেটি মূর্ত হয়ে উঠতে পেরেছিল। তিনি কমরেড চারু মজুমদার।
১৯৬৭ সালের ৫ জুলাই চিনের ‘পিপলস ডেইলি’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, ‘প্রচণ্ড গর্জনে ভারতের বুকে ধ্বনিত হয়েছে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ। দার্জিলিং অঞ্চলের বিপ্লবী কৃষকেরা বিদ্রোহে ফেটে পড়েছেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি বিপ্লবী অংশের নেতৃত্বে গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রামের এক লাল এলাকা ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতীয় জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামের পক্ষে এটি এক প্রচণ্ড তাৎপর্যপূর্ণ বিকাশ।’
এই বিকাশ সেদিন সম্ভব হয়েছিল কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে, যাঁর হাত ধরে নকশালবাড়ি অভ্যুত্থান রণকৌশলগতভাবে একটি বিশেষ স্তরে উন্নীত হতে পেরেছিল। যে মতাদর্শ তাঁকে পথ চিনিয়ে দিতে পেরেছিল, সেটি হচ্ছে―মার্কসবাদ।
২.এই যে আজ নকশালবাড়ি আর চারু মজুমদার সমার্থক হয়ে উঠেছে, এর প্রধান কারণ কী? এই প্রশ্নে অনেকেই ব্যতিব্যস্ত থাকেন। খুব সহজ আর অল্প কথায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন, তারপরও যদি দিতেই হয়, তাহলে বলা দরকার যে, চারু মজুমদার ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি কমরেড মাও সে-তুঙের মতাদর্শকে, দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিকে একেবারে সামনে টেনে এনেছিলেন। যাকে বলা যায়, নির্ভুল চিন্তাধারা, চারু মজুমদার, সেই শিক্ষাটাকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।
‘মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে?’ মাও সে-তুঙ ভারি চমৎকারভাবে এর জবাবে বলেছিলেন, ‘মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কেবলমাত্র সামাজিক অনুশীলন থেকেই আসে।’ তাঁর কথাটিকে আরও খানিকটা ব্যাখ্যা করে মাও জানিয়েছিলেন, ‘সমাজের উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণিসংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা―এই তিনটা অনুশীলন থেকেই সেগুলো আসে।’ এই যে আয়ত্তে আনা, এটি চারু মজুমদারের বিখ্যাত ‘আটটি দলিলে’র মধ্যেই আমরা দেখতে পাই। প্রথম দলিলের শেষাংশে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক শিক্ষা কী হবে, সে সম্পর্কে তিনি বেশ স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন, ‘ভারতবর্ষের বিপ্লবের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে হচ্ছে কৃষি বিপ্লব। সুতরাং আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান বক্তব্য হবে―কৃষি বিপ্লব সফল কর।’ শুধুই তা-ই নয়, সেইসঙ্গে চারু মজুমদার জানাতে ভোলেননি যে, ‘কৃষি বিপ্লবের কার্যক্রমকে আমরা যতখানি শ্রমিক ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে প্রচার করতে ও তাঁদের শিক্ষিত করে তুলতে পারবো, ততোখানি তাঁরা রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠবেন।’ আর রাজনৈতিক শিক্ষিতজনেরা গোটা দুনিয়ায় কীভাবে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারেন, সেটি রাশিয়ায় কমরেড ভ. ই. লেনিন যেমন দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তেমনি কমরেড মাও দেখিয়েছিলেন তৎকালীন চীনে। ভারতবর্ষের মাটিতে কমরেড চারু মজুমদার সেই একই আগুন জ্বালানোর প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছিলেন।
৩.এটা তো ঠিক যে কমরেড চারু মজুমদার সশস্ত্র সংগ্রামের ওপর জোর দিয়েছিলেন। আমাদের একাত্তরের স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রক্তপাত অনিবার্য। আমরা যদি প্রকৃতির দিকে তাকাই, তাহলে দেখব সেখানেও, রক্তপাত জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। একজন মা যখন সন্তানের জন্ম দেন, তখন তাঁর রক্তপাত কেউই ঠেকাতে পারে না। এই রক্তপাত হচ্ছে একটি ইতিবাচক রক্তপাত, জীবনের জন্যে রক্তপাত। যে নারীর প্রতিমাসে রক্তপাত হয় না, বুঝতে হবে তাঁর সন্তানধারণের ক্ষমতা আর নেই।
কমরেড মাওয়ের মতে বিপ্লব হচ্ছে, সক্রিয়তার সঙ্গে শোষক শ্রেণিকে উৎখাত করা। সমাজের ৯৯ শতাংশের ক্ষমতা ও সম্পদ যখন এক শতাংশ শোষক শ্রেণির হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হবে, তখন তারাও তো বাধা দেবেই। সেই বাধা গুঁড়িয়ে দেওয়ার শক্তি ও সামর্থ্য যদি বিপ্লবীদের না থাকে, তাহলে তো বিপ্লব প্রাথমিক পর্যায়েই পরাস্ত হতে বাধ্য।
এই প্রসঙ্গে ‘খতমের রাজনীতির’ কথা সামনে চলে আসে। খুবই ভুলভাবে কমরেড চারু মজুমদারের খতমের রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করা হয়। অথচ কমরেড চারু মজুমদার দ্বিধাহীনভাবে বলেছিলেন, খতমের রাজনীতি মানে শুধুই ‘ব্যক্তিকে খতম করা নয়।’ সেই শত্রুটির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তিকেও খতম করা।’
৪.কমরেড মাও সে-তুঙ বলেছিলেন, ‘অস্ত্র হচ্ছে যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, কিন্তু নির্ধারক উপাদন নয়।’ তাহলে নির্ধারক উপাদান কোনটি বা কারা? মাওয়ের মতে, ‘নির্ধারক উপাদান হচ্ছে মানুষ, বস্তু নয়।’ তিনি জনগণের শক্তিকে কতোটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেটি তাঁর এই কথা থেকেই আমরা বুঝে নিতে পারি। মাও বলেছিলেন, ‘জনগণ, কেবলমাত্র জনগণই হচ্ছেন বিশ্ব-ইতিহাস সৃষ্টির চালক-শক্তি।’ শুধু এইটুকুতেই থামেননি তিনি, এ-ও বলেছিলেন যে, ‘জনসাধারণ হচ্ছেন প্রকৃত বীর’।
কেন জনসাধারণ প্রকৃত বীর? মাওয়ের মতে, এই জনসাধারণের মধ্যেই আছে ‘সীমাহীন সৃজনী শক্তি’। কমরেড চারু মজুমদার সেই জনগণের সৃজনী শক্তির উপর এর চেয়ে কোনো অংশে কম ভরসা করেননি কখনো। তিনি দৃঢভাবেই বিশ্বাস করতেন যে, ‘শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারাটাই কমিউনিস্ট হবার একমাত্র মাপকাঠি নয়।’ ‘কে প্রকৃত কমিউনিস্ট?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে চারু মজুমদার জানিয়েছিলেন, ‘যিনি জনগণের জন্য আত্মত্যাগ করতে পারেন এবং এই আত্মত্যাগ বিনিময়ের কোনো প্রত্যাশা করে নয়।’ এসবের পাশাপাশি কোনো রকম ছাড় না-দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘দুটো পথ―হয় আত্মত্যাগ, নয় আত্মস্বার্থ। মাঝামাঝি কোনো রাস্তা নেই।’ জনসাধারণের সক্রিয় সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছাড়া বিপ্লব যে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে কোনোভাবেই পৌঁছোতে পারে না, সেটি চারু মজুমদার তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকেই শিখেছিলেন। তাঁর সহযোদ্ধাদেরও সেই শিক্ষাটাই তিনি দিতে চেয়েছেন।
৫.উপমহাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির ক্ষেত্রে কমরেড চারু মজুমদারের আরও একটি বড় শিক্ষা এই যে, সংশোধনবাদকে চিহ্নিত করা এবং সেটির বিরুদ্ধে নিরন্তর ও আপোসহীন সংগ্রাম করে যাওয়া। সংশোধনবাদ কী? সংশোধনবাদ কখনোই একটি রাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করতে চায় না। সে অতীতের সংগ্রাম এবং সংগ্রামের ভুল-ত্রুটি থেকে শিক্ষা নেয় না। একইসঙ্গে বিপ্লবী লক্ষ্য, আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে অর্থনীতিবাদকেই বড়ো করে দেখে ও দেখায়।
এসবের বিপরীতে, নকশালবাড়ির গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে, কমরেড চারু মজুমদার বলেছিলেন, ‘এই প্রথম কৃষক শুধু তার ছোট দাবির জন্য আন্দোলন করলেন না, তিনি আন্দোলন করলেন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলেন জন্য।’ নিজের এই বক্তব্যকে আরও খানিকটা বিস্তারে নিয়ে গিয়ে চারু মজুমদার জানিয়েছেন, ‘নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন থেকে যদি অভিজ্ঞতা নিতে হয়, তবে সে অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই যে, জমি বা ফসল ইত্যাদির জন্য জঙ্গী সংগ্রাম নয়। জঙ্গী সংগ্রাম করতে হবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য।’ তাঁর মতে এখানেই নকশালবাড়ি আন্দোলনের নতুনত্ব। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কমরেড চারু মজুমদারের এই মূল্যায়নকে কোনোভাবেই অস্বীকার করবার উপায় নেই।
৬.কমরেড মাও সে-তুঙ বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন হলো উৎসাহী কিন্তু স্থিরচিত্ত মনোবৃত্তির। উত্তেজনাময় কিন্তু শৃঙ্খলাপূর্ণ কাজের।’ কমরেড চারু মজুমদার ছিলেন মাওয়ের সেই উৎসাহী ও স্থিরচিত্ত মনোবৃত্তির অধিকারী একজন মানুষ। যিনি একইসঙ্গে উত্তেজনা আর শৃঙ্খলাপূর্ণ কাজের মাধ্যমে জনসাধারণের সেবা করতে চেয়েছিলেন, ভারতবর্ষের মাটিতে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ আর বিপ্লবের গানকে একইসূত্রে মেলাতে পেরেছিলেন। কতটা সফল হয়েছিলেন, সেই প্রশ্নটিও উঠবে, উঠতে বাধ্য। কারণ সেটিকে অস্বীকার করে আজ এক পাও অগ্রসর হওয়া যাবে না।
১৫ই মে কমরেড চারু মজুমদারের জন্মদিন। তাঁকে জানাই শ্রদ্ধা ও লাল সালাম!
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
কার্তেজীয় পদ্ধতির জন্যে যিনি সারা দুনিয়ায় বিখ্যাত, সেই ফরাসি দার্শনিক রনে দেকার্ত মনে করতেন, মানুষের ‘শুভবুদ্ধি থাকাটাই যথেষ্ট নয়, আসল হচ্ছে সেটাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারা।’ কথাটির গুরুত্ব সবার কাছে হয়তো একরকম নয়, তবে এই উপমহাদেশে একজন মানুষের গোটা জীবনের মধ্যে দিয়ে সেটি মূর্ত হয়ে উঠতে পেরেছিল। তিনি কমরেড চারু মজুমদার।
১৯৬৭ সালের ৫ জুলাই চিনের ‘পিপলস ডেইলি’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, ‘প্রচণ্ড গর্জনে ভারতের বুকে ধ্বনিত হয়েছে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ। দার্জিলিং অঞ্চলের বিপ্লবী কৃষকেরা বিদ্রোহে ফেটে পড়েছেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি বিপ্লবী অংশের নেতৃত্বে গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রামের এক লাল এলাকা ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতীয় জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামের পক্ষে এটি এক প্রচণ্ড তাৎপর্যপূর্ণ বিকাশ।’
এই বিকাশ সেদিন সম্ভব হয়েছিল কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে, যাঁর হাত ধরে নকশালবাড়ি অভ্যুত্থান রণকৌশলগতভাবে একটি বিশেষ স্তরে উন্নীত হতে পেরেছিল। যে মতাদর্শ তাঁকে পথ চিনিয়ে দিতে পেরেছিল, সেটি হচ্ছে―মার্কসবাদ।
২.এই যে আজ নকশালবাড়ি আর চারু মজুমদার সমার্থক হয়ে উঠেছে, এর প্রধান কারণ কী? এই প্রশ্নে অনেকেই ব্যতিব্যস্ত থাকেন। খুব সহজ আর অল্প কথায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন, তারপরও যদি দিতেই হয়, তাহলে বলা দরকার যে, চারু মজুমদার ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি কমরেড মাও সে-তুঙের মতাদর্শকে, দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিকে একেবারে সামনে টেনে এনেছিলেন। যাকে বলা যায়, নির্ভুল চিন্তাধারা, চারু মজুমদার, সেই শিক্ষাটাকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।
‘মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে?’ মাও সে-তুঙ ভারি চমৎকারভাবে এর জবাবে বলেছিলেন, ‘মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কেবলমাত্র সামাজিক অনুশীলন থেকেই আসে।’ তাঁর কথাটিকে আরও খানিকটা ব্যাখ্যা করে মাও জানিয়েছিলেন, ‘সমাজের উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণিসংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা―এই তিনটা অনুশীলন থেকেই সেগুলো আসে।’ এই যে আয়ত্তে আনা, এটি চারু মজুমদারের বিখ্যাত ‘আটটি দলিলে’র মধ্যেই আমরা দেখতে পাই। প্রথম দলিলের শেষাংশে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক শিক্ষা কী হবে, সে সম্পর্কে তিনি বেশ স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন, ‘ভারতবর্ষের বিপ্লবের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে হচ্ছে কৃষি বিপ্লব। সুতরাং আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান বক্তব্য হবে―কৃষি বিপ্লব সফল কর।’ শুধুই তা-ই নয়, সেইসঙ্গে চারু মজুমদার জানাতে ভোলেননি যে, ‘কৃষি বিপ্লবের কার্যক্রমকে আমরা যতখানি শ্রমিক ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে প্রচার করতে ও তাঁদের শিক্ষিত করে তুলতে পারবো, ততোখানি তাঁরা রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠবেন।’ আর রাজনৈতিক শিক্ষিতজনেরা গোটা দুনিয়ায় কীভাবে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারেন, সেটি রাশিয়ায় কমরেড ভ. ই. লেনিন যেমন দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তেমনি কমরেড মাও দেখিয়েছিলেন তৎকালীন চীনে। ভারতবর্ষের মাটিতে কমরেড চারু মজুমদার সেই একই আগুন জ্বালানোর প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছিলেন।
৩.এটা তো ঠিক যে কমরেড চারু মজুমদার সশস্ত্র সংগ্রামের ওপর জোর দিয়েছিলেন। আমাদের একাত্তরের স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রক্তপাত অনিবার্য। আমরা যদি প্রকৃতির দিকে তাকাই, তাহলে দেখব সেখানেও, রক্তপাত জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। একজন মা যখন সন্তানের জন্ম দেন, তখন তাঁর রক্তপাত কেউই ঠেকাতে পারে না। এই রক্তপাত হচ্ছে একটি ইতিবাচক রক্তপাত, জীবনের জন্যে রক্তপাত। যে নারীর প্রতিমাসে রক্তপাত হয় না, বুঝতে হবে তাঁর সন্তানধারণের ক্ষমতা আর নেই।
কমরেড মাওয়ের মতে বিপ্লব হচ্ছে, সক্রিয়তার সঙ্গে শোষক শ্রেণিকে উৎখাত করা। সমাজের ৯৯ শতাংশের ক্ষমতা ও সম্পদ যখন এক শতাংশ শোষক শ্রেণির হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হবে, তখন তারাও তো বাধা দেবেই। সেই বাধা গুঁড়িয়ে দেওয়ার শক্তি ও সামর্থ্য যদি বিপ্লবীদের না থাকে, তাহলে তো বিপ্লব প্রাথমিক পর্যায়েই পরাস্ত হতে বাধ্য।
এই প্রসঙ্গে ‘খতমের রাজনীতির’ কথা সামনে চলে আসে। খুবই ভুলভাবে কমরেড চারু মজুমদারের খতমের রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করা হয়। অথচ কমরেড চারু মজুমদার দ্বিধাহীনভাবে বলেছিলেন, খতমের রাজনীতি মানে শুধুই ‘ব্যক্তিকে খতম করা নয়।’ সেই শত্রুটির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তিকেও খতম করা।’
৪.কমরেড মাও সে-তুঙ বলেছিলেন, ‘অস্ত্র হচ্ছে যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, কিন্তু নির্ধারক উপাদন নয়।’ তাহলে নির্ধারক উপাদান কোনটি বা কারা? মাওয়ের মতে, ‘নির্ধারক উপাদান হচ্ছে মানুষ, বস্তু নয়।’ তিনি জনগণের শক্তিকে কতোটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেটি তাঁর এই কথা থেকেই আমরা বুঝে নিতে পারি। মাও বলেছিলেন, ‘জনগণ, কেবলমাত্র জনগণই হচ্ছেন বিশ্ব-ইতিহাস সৃষ্টির চালক-শক্তি।’ শুধু এইটুকুতেই থামেননি তিনি, এ-ও বলেছিলেন যে, ‘জনসাধারণ হচ্ছেন প্রকৃত বীর’।
কেন জনসাধারণ প্রকৃত বীর? মাওয়ের মতে, এই জনসাধারণের মধ্যেই আছে ‘সীমাহীন সৃজনী শক্তি’। কমরেড চারু মজুমদার সেই জনগণের সৃজনী শক্তির উপর এর চেয়ে কোনো অংশে কম ভরসা করেননি কখনো। তিনি দৃঢভাবেই বিশ্বাস করতেন যে, ‘শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারাটাই কমিউনিস্ট হবার একমাত্র মাপকাঠি নয়।’ ‘কে প্রকৃত কমিউনিস্ট?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে চারু মজুমদার জানিয়েছিলেন, ‘যিনি জনগণের জন্য আত্মত্যাগ করতে পারেন এবং এই আত্মত্যাগ বিনিময়ের কোনো প্রত্যাশা করে নয়।’ এসবের পাশাপাশি কোনো রকম ছাড় না-দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘দুটো পথ―হয় আত্মত্যাগ, নয় আত্মস্বার্থ। মাঝামাঝি কোনো রাস্তা নেই।’ জনসাধারণের সক্রিয় সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছাড়া বিপ্লব যে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে কোনোভাবেই পৌঁছোতে পারে না, সেটি চারু মজুমদার তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকেই শিখেছিলেন। তাঁর সহযোদ্ধাদেরও সেই শিক্ষাটাই তিনি দিতে চেয়েছেন।
৫.উপমহাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির ক্ষেত্রে কমরেড চারু মজুমদারের আরও একটি বড় শিক্ষা এই যে, সংশোধনবাদকে চিহ্নিত করা এবং সেটির বিরুদ্ধে নিরন্তর ও আপোসহীন সংগ্রাম করে যাওয়া। সংশোধনবাদ কী? সংশোধনবাদ কখনোই একটি রাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করতে চায় না। সে অতীতের সংগ্রাম এবং সংগ্রামের ভুল-ত্রুটি থেকে শিক্ষা নেয় না। একইসঙ্গে বিপ্লবী লক্ষ্য, আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে অর্থনীতিবাদকেই বড়ো করে দেখে ও দেখায়।
এসবের বিপরীতে, নকশালবাড়ির গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে, কমরেড চারু মজুমদার বলেছিলেন, ‘এই প্রথম কৃষক শুধু তার ছোট দাবির জন্য আন্দোলন করলেন না, তিনি আন্দোলন করলেন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলেন জন্য।’ নিজের এই বক্তব্যকে আরও খানিকটা বিস্তারে নিয়ে গিয়ে চারু মজুমদার জানিয়েছেন, ‘নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন থেকে যদি অভিজ্ঞতা নিতে হয়, তবে সে অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই যে, জমি বা ফসল ইত্যাদির জন্য জঙ্গী সংগ্রাম নয়। জঙ্গী সংগ্রাম করতে হবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য।’ তাঁর মতে এখানেই নকশালবাড়ি আন্দোলনের নতুনত্ব। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কমরেড চারু মজুমদারের এই মূল্যায়নকে কোনোভাবেই অস্বীকার করবার উপায় নেই।
৬.কমরেড মাও সে-তুঙ বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন হলো উৎসাহী কিন্তু স্থিরচিত্ত মনোবৃত্তির। উত্তেজনাময় কিন্তু শৃঙ্খলাপূর্ণ কাজের।’ কমরেড চারু মজুমদার ছিলেন মাওয়ের সেই উৎসাহী ও স্থিরচিত্ত মনোবৃত্তির অধিকারী একজন মানুষ। যিনি একইসঙ্গে উত্তেজনা আর শৃঙ্খলাপূর্ণ কাজের মাধ্যমে জনসাধারণের সেবা করতে চেয়েছিলেন, ভারতবর্ষের মাটিতে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ আর বিপ্লবের গানকে একইসূত্রে মেলাতে পেরেছিলেন। কতটা সফল হয়েছিলেন, সেই প্রশ্নটিও উঠবে, উঠতে বাধ্য। কারণ সেটিকে অস্বীকার করে আজ এক পাও অগ্রসর হওয়া যাবে না।
১৫ই মে কমরেড চারু মজুমদারের জন্মদিন। তাঁকে জানাই শ্রদ্ধা ও লাল সালাম!
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
একদিন ভোরবেলা জাকারবার্গ লক্ষ করলেন যে পৃথিবীতে একটা ছোট্ট দেশে তাঁর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা হচ্ছে। সামনের ফ্লোরটায় দেখলেন দেশটা ছোট বটে, কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। আর এই দেশের জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। ফেসবুকে দেখতে পেলেন অসংখ্য বার্তা—সবই রাজনৈতিক এবং ছবিতে এ বিষয়ে বিপুল জনগণের
১০ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৩ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তাদের নেতা-কর্মীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে অসংখ্য আন্দোলনকারীকে হত্যা ও অনেকের জীবন বি
১০ ঘণ্টা আগেবেশ কিছুদিন ধরেই অস্থির হয়ে আছে মোহাম্মদপুর। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপর এই অঞ্চলে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে না থাকায় একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী বাড়িতে বাড়িতে ডাকাতি করতে উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। এলাকাবাসী তখন রাত জেগে নিজেদের এলাকা পাহারা দিয়েছিলেন।
১০ ঘণ্টা আগে৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সংস্কারের আহ্বান শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। সব ক্ষেত্রে। চলচ্চিত্রাঙ্গনেও এই সংস্কারের জোয়ার এসে লেগেছে। জোয়ারের আগে মূলধারার চলচ্চিত্রের লোকজন নানাভাবে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে। অভ্যুত্থান শুরুর পর তাঁদের মনে হয়েছে ভবিষ্যৎ বুঝি অন্ধকারে প্রবেশ করতে যাচ্
১ দিন আগে