একেএম শামসুদ্দিন
কয়েক দিন ধরেই সেনাবাহিনী নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ আলোচনা হচ্ছে। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ও আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) নামক অপর একটি দলের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদের কিছু বক্তব্য এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। তাঁদের বক্তব্য যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তেমনই দেশের মানুষের মনে আশঙ্কাও তৈরি করেছে। বিশেষ করে হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্যকে বক্তব্য না বলে অভিযোগ বলাই ভালো হবে। কারণ, তিনি ফেসবুকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ উত্থাপন করে চারদিকে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন, এর আগে কখনো এ রকম পরিস্থিতি হয়নি। তাঁর অভিযোগ কম-বেশি আমাদের সবারই জানা। এখানে উল্লেখ করে লেখার পরিসর বড় করে লাভ নেই। কিন্তু আমরা আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করেছি, দলটির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী সিলেটে তাঁর দলের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘হাসনাতের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা উচিত হয়নি। আমরা মনে করি, এটা শিষ্টাচারবর্জিত একটি স্ট্যাটাস হয়েছে।’ নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারীর বক্তব্যের ঠিক পরদিনই এনসিপির আরেক সংগঠক সারজিস আলম হাসনাতের বক্তব্যের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে আরেকটি বক্তব্য তাঁর ফেসবুকে পোস্ট করেন। সারজিস আলম ও হাসনাত দুজনেই ১১ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেনাপ্রধান ক্যান্টনমেন্টে তাঁদের ডেকে নিয়েছেন বলে হাসনাত যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সরাসরি নাকচ করে সারজিস আলম লিখেছেন, ‘সেদিন সেনানিবাসে আমাদের ডেকে নেওয়া হয়নি।’ সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজকে দেওয়া সেনাসদরের বক্তব্যেও বলা হয়েছে, এনসিপির সংগঠকদের আগ্রহেই সেনাপ্রধান তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ দেওয়ায় সম্মতি দিয়েছিলেন। অতএব এই বিষয়ে হাসনাতের বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
হাসনাত আরও লিখেছেন, ‘আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই (ইনক্লুসিভ নির্বাচন) প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদের বলা হয়, ইতিমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।...একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা নাকি ভালো।’ এ বিষয়েও সারজিস স্পষ্ট করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘আমার জায়গা থেকে আমি সেদিনের (সেনাবাহিনী প্রধান) বক্তব্যকে সরাসরি “প্রস্তাব” দেওয়ার আঙ্গিকে দেখি না বরং “সরাসরি অভিমত প্রকাশ”র মতো করে দেখি। “অভিমত প্রকাশ” এবং “প্রস্তাব দেওয়া” দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পাশাপাশি “রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ”র জন্য “চাপ দেওয়া”র যে বিষয়টি (হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য) এসেছে সেখানে “চাপ দেওয়া হয়েছে” এমনটি মনে হয়নি। বরং রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ না আসলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সমস্যার সৃষ্টি হবে, সেটা তিনি অতি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছিলেন।’ এ ছাড়া সারজিস জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে কি না, এই নির্বাচনে তারা থাকলে কী হবে; আবার না থাকলে কী হতে পারে—এসব সমীকরণে দেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে, স্থিতিশীলতা কিংবা অস্থিতিশীলতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, সেসব নিয়ে কথা হয়েছে। এরূপ অনেক বিষয়ের মধ্যে সারজিস আরও লিখেছেন, ‘কিন্তু যেই টোনে হাসনাতের ফেসবুক লেখা উপস্থাপন করা হয়েছে, আমি মনে করি কনভারসেশন ততটা এক্সট্রিম ছিল না। তবে অন্য কোনো দিনের চেয়ে অবশ্যই স্ট্রেইট-ফরওয়ার্ড এবং সো-কনফিডেন্ট ছিল। দেশের স্থিতিশীলতার রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের ইলেকশনে অংশগ্রহণ করা যে প্রয়োজনীয়, সেই বিষয়ে সরাসরি অভিমত ছিল।’
সারজিসের বক্তব্য শুনে মনে হয় সেনাবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে সেদিন তাঁদের অনেক বিষয় নিয়েই কথা হয়েছে, তার মধ্যে আওয়ামী লীগের বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে। দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কথায় কথায় আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গ আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পূর্বশর্ত হিসেবে সব দলের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিষয়টি আসতে পারে এবং সে প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান হয়তো অভিমত ব্যক্ত করেছেন। হাসনাত এই বিষয়টিকেই ফেসবুকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে সবার কাছে সেনাপ্রধান সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আমার বিশ্বাস, হাসনাত তাঁর অপরিপক্বতার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। এ কারণেই হয়তো সারজিসের ফেসবুক পোস্টের পর তিনি আর উচ্চবাচ্য করেননি।
হাসনাত ও সারজিসের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে মনে হয়েছে সাফল্যের সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিতে পারলেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় তাঁরা উভয়ে অনেক পিছিয়ে আছেন। একটি কথা মনে রাখতে হবে, তাঁরা এখন আর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক নন। তাঁরা একটি নবগঠিত রাজনৈতিক দলের সংগঠক। কাজেই তাঁদের চালচলনে-কথাবার্তায় পরিপক্বতা থাকতে হবে। সেনাবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করে সেখানে কী আলোচনা হলো, সে বিষয়ে কি তাঁরা দলীয় পর্যায়ে কোনো আলোচনাই করেননি? দলীয় পর্যায়ে আলোচনা করেই বিবৃতি দেওয়া উচিত ছিল। এ ব্যাপারটি যে ঘটেনি, তা সহজেই অনুমান করা যায়, সারজিসের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার পর দলের অন্য নেতাদের তির্যক মন্তব্যগুলো দেখে। যাঁরা মন্তব্য করেছেন তাঁরাও যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তা নয়। খালেদ সাইফুল্লাহ নামের এক নেতা হাসনাত ও সারজিসের প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেছেন, ‘ব্যক্তিগত রাজনীতি হাসিলের জন্য তারা যখন যা ইচ্ছে বলে বেড়াচ্ছেন; সেগুলো যে স্ববিরোধী হয়ে যাচ্ছে, সেটি নিয়েও তাদের কোনো উদ্বেগ নেই। যদি সেলিব্রিটি ফেইস, কন্ট্রোভার্সি আর পপুলিজম দিয়েই রাজনীতি করতে চান, তাহলে আমাদের পার্টি থেকে বাদ দিয়ে “টিকটকারদের” এনে বসিয়ে দেন।’ আরেক নেতা লিখেছেন, ‘দল গোল্লায় যাক, ওনাদের লাইম লাইটে থাকতে হবে।’ অন্যজন লিখেছেন, ‘যে যার মতো পোস্ট দিয়ে দিচ্ছেন, পাবলিক পোস্টে একজন অন্যজনের বক্তব্য খারিজ করছেন—এসব কী চলছে?’ তবে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে সারজিসের পোস্টের মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, ‘এসব কি ভাই। পাবলিকলিই বলছি—দুইজনের একজন মিথ্যা বলছেন।...সরি আর চুপ থাকতে পারলাম না।’
ওদিকে হাসনাত সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পর সেনাবাহিনী বলেছে, ‘হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্ট “সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি” বৈ অন্য কিছু নয়।’ হাসনাতের বক্তব্যকে ‘অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ব গল্পের সম্ভার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে সেনাবাহিনী।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমরা যে বাক্স্বাধীনতা পেয়েছি, তার সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে মনে হয় মাঝে মধ্যে কেউ কেউ বেহিসেবি হয়ে পড়ছি। যে যখন মুখে যা আসছে তা-ই বলে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় কেউ কেউ সেনাবাহিনীকে নিয়েও মাত্রাতিরিক্ত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, যা সত্যিই অশোভনীয়। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে এভাবে বক্তব্য রাখা বোধ হয় উচিত নয়। কিছুদিন যাবৎ সেনাবাহিনী নিয়ে এবি পার্টির ব্যারিস্টার ফুয়াদের কিছু বিকৃত রুচির বক্তব্য সবার দৃষ্টি কেড়েছে। আমি ভেবে অবাক হই একটি দলের সাধারণ সম্পাদক হয়ে একজন ব্যক্তি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে এমন অরুচিকর বক্তব্য দেন কী করে। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ‘চাকর-বাকর’-এর সঙ্গে তুলনা করে তিনি কী অর্জন করতে চান? কিছু কিছু ব্যক্তি মনে করেন বাক্স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নেগেটিভ কথা বলে অতি সহজেই জনপ্রিয় হওয়া যায়। আদতে তাই দেখছি, এ ধরনের সস্তা বক্তব্য দিয়ে অনেকেই সেলিব্রিটি হওয়ার পথ খুঁজে নিচ্ছেন। তবে এ কথা ঠিক, গত ১৫ বছর গদিচ্যুত শেখ হাসিনা, যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও দলীয় বিবেচনায় কিছু কিছু সেনা কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নিয়েছেন। এসব হঠাৎ পদ ও পদবি পাওয়া কর্মকর্তাদের কেউ কেউ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। যতদূর জেনেছি, স্বয়ং শেখ হাসিনাই তাঁদের দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, তাঁদের দুর্নীতির কথা জেনেও শেখ হাসিনা কোনো প্রকার ব্যবস্থা না নিয়ে, দলের স্বার্থেই তাঁদের অন্যায়ভাবে ব্যবহার করেছেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর এসব কর্মকর্তার দুর্নীতির সব তথ্যই ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা পুরো সেনাবাহিনীর মধ্যে শতকরা কতজন হবেন? তাই বলে কি পুরো সেনাবাহিনীকেই এভাবে গালমন্দ করতে হবে?
যাঁরা সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিষোদ্গার করছেন তাঁদের মনে রাখা উচিত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন হতো না, যদি সেদিন বাঙালি সেনাসদস্যরা নিজেদের আত্মবলিদান না দিতেন। নব্বইয়ের এরশাদের পতন হতো না, তরুণ কর্মকর্তারা যদি সেদিন মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করতে অস্বীকার না করতেন। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনারও এত সহজে পতন হতো না, যদি ছাত্র-জনতার পাশে সেনাবাহিনী না দাঁড়াত। সস্তা বক্তব্য দিয়ে যাঁরা সহজেই জনপ্রিয় হতে চান তাঁদের মনে রাখতে হবে, প্রকাশ্যে নির্ভয়ে-নির্দ্বিধায় যে বড় বড় বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তা তো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানেরই ফল। বিকৃত রুচির বক্তব্য দিয়ে কিছুই অর্জন করা যায় না, বরং তাতে বিকৃত মানসিকতারই পরিচয় পাওয়া যায়। কারোর বিরুদ্ধে আপত্তি থাকতে পারে, তাই বলে পুরো বাহিনীকে নিয়ে দোষারোপ করা ঠিক নয়। জাতীয় স্বার্থেই সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা উচিত নয়। কথা বলার আগে আমাদের সৌজন্যবোধ বজায় রেখে কথা বলা উচিত। শুধু সেনাবাহিনী বলে নয়, যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা বলার সময়েও ন্যূনতম সৌজন্য বজায় রাখা উচিত।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
কয়েক দিন ধরেই সেনাবাহিনী নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ আলোচনা হচ্ছে। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ও আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) নামক অপর একটি দলের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদের কিছু বক্তব্য এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। তাঁদের বক্তব্য যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তেমনই দেশের মানুষের মনে আশঙ্কাও তৈরি করেছে। বিশেষ করে হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্যকে বক্তব্য না বলে অভিযোগ বলাই ভালো হবে। কারণ, তিনি ফেসবুকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ উত্থাপন করে চারদিকে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন, এর আগে কখনো এ রকম পরিস্থিতি হয়নি। তাঁর অভিযোগ কম-বেশি আমাদের সবারই জানা। এখানে উল্লেখ করে লেখার পরিসর বড় করে লাভ নেই। কিন্তু আমরা আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করেছি, দলটির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী সিলেটে তাঁর দলের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘হাসনাতের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা উচিত হয়নি। আমরা মনে করি, এটা শিষ্টাচারবর্জিত একটি স্ট্যাটাস হয়েছে।’ নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারীর বক্তব্যের ঠিক পরদিনই এনসিপির আরেক সংগঠক সারজিস আলম হাসনাতের বক্তব্যের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে আরেকটি বক্তব্য তাঁর ফেসবুকে পোস্ট করেন। সারজিস আলম ও হাসনাত দুজনেই ১১ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেনাপ্রধান ক্যান্টনমেন্টে তাঁদের ডেকে নিয়েছেন বলে হাসনাত যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সরাসরি নাকচ করে সারজিস আলম লিখেছেন, ‘সেদিন সেনানিবাসে আমাদের ডেকে নেওয়া হয়নি।’ সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজকে দেওয়া সেনাসদরের বক্তব্যেও বলা হয়েছে, এনসিপির সংগঠকদের আগ্রহেই সেনাপ্রধান তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ দেওয়ায় সম্মতি দিয়েছিলেন। অতএব এই বিষয়ে হাসনাতের বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
হাসনাত আরও লিখেছেন, ‘আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই (ইনক্লুসিভ নির্বাচন) প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদের বলা হয়, ইতিমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।...একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা নাকি ভালো।’ এ বিষয়েও সারজিস স্পষ্ট করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘আমার জায়গা থেকে আমি সেদিনের (সেনাবাহিনী প্রধান) বক্তব্যকে সরাসরি “প্রস্তাব” দেওয়ার আঙ্গিকে দেখি না বরং “সরাসরি অভিমত প্রকাশ”র মতো করে দেখি। “অভিমত প্রকাশ” এবং “প্রস্তাব দেওয়া” দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পাশাপাশি “রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ”র জন্য “চাপ দেওয়া”র যে বিষয়টি (হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য) এসেছে সেখানে “চাপ দেওয়া হয়েছে” এমনটি মনে হয়নি। বরং রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ না আসলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সমস্যার সৃষ্টি হবে, সেটা তিনি অতি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছিলেন।’ এ ছাড়া সারজিস জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে কি না, এই নির্বাচনে তারা থাকলে কী হবে; আবার না থাকলে কী হতে পারে—এসব সমীকরণে দেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে, স্থিতিশীলতা কিংবা অস্থিতিশীলতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, সেসব নিয়ে কথা হয়েছে। এরূপ অনেক বিষয়ের মধ্যে সারজিস আরও লিখেছেন, ‘কিন্তু যেই টোনে হাসনাতের ফেসবুক লেখা উপস্থাপন করা হয়েছে, আমি মনে করি কনভারসেশন ততটা এক্সট্রিম ছিল না। তবে অন্য কোনো দিনের চেয়ে অবশ্যই স্ট্রেইট-ফরওয়ার্ড এবং সো-কনফিডেন্ট ছিল। দেশের স্থিতিশীলতার রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের ইলেকশনে অংশগ্রহণ করা যে প্রয়োজনীয়, সেই বিষয়ে সরাসরি অভিমত ছিল।’
সারজিসের বক্তব্য শুনে মনে হয় সেনাবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে সেদিন তাঁদের অনেক বিষয় নিয়েই কথা হয়েছে, তার মধ্যে আওয়ামী লীগের বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে। দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কথায় কথায় আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গ আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পূর্বশর্ত হিসেবে সব দলের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিষয়টি আসতে পারে এবং সে প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান হয়তো অভিমত ব্যক্ত করেছেন। হাসনাত এই বিষয়টিকেই ফেসবুকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে সবার কাছে সেনাপ্রধান সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আমার বিশ্বাস, হাসনাত তাঁর অপরিপক্বতার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। এ কারণেই হয়তো সারজিসের ফেসবুক পোস্টের পর তিনি আর উচ্চবাচ্য করেননি।
হাসনাত ও সারজিসের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে মনে হয়েছে সাফল্যের সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিতে পারলেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় তাঁরা উভয়ে অনেক পিছিয়ে আছেন। একটি কথা মনে রাখতে হবে, তাঁরা এখন আর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক নন। তাঁরা একটি নবগঠিত রাজনৈতিক দলের সংগঠক। কাজেই তাঁদের চালচলনে-কথাবার্তায় পরিপক্বতা থাকতে হবে। সেনাবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করে সেখানে কী আলোচনা হলো, সে বিষয়ে কি তাঁরা দলীয় পর্যায়ে কোনো আলোচনাই করেননি? দলীয় পর্যায়ে আলোচনা করেই বিবৃতি দেওয়া উচিত ছিল। এ ব্যাপারটি যে ঘটেনি, তা সহজেই অনুমান করা যায়, সারজিসের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার পর দলের অন্য নেতাদের তির্যক মন্তব্যগুলো দেখে। যাঁরা মন্তব্য করেছেন তাঁরাও যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তা নয়। খালেদ সাইফুল্লাহ নামের এক নেতা হাসনাত ও সারজিসের প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেছেন, ‘ব্যক্তিগত রাজনীতি হাসিলের জন্য তারা যখন যা ইচ্ছে বলে বেড়াচ্ছেন; সেগুলো যে স্ববিরোধী হয়ে যাচ্ছে, সেটি নিয়েও তাদের কোনো উদ্বেগ নেই। যদি সেলিব্রিটি ফেইস, কন্ট্রোভার্সি আর পপুলিজম দিয়েই রাজনীতি করতে চান, তাহলে আমাদের পার্টি থেকে বাদ দিয়ে “টিকটকারদের” এনে বসিয়ে দেন।’ আরেক নেতা লিখেছেন, ‘দল গোল্লায় যাক, ওনাদের লাইম লাইটে থাকতে হবে।’ অন্যজন লিখেছেন, ‘যে যার মতো পোস্ট দিয়ে দিচ্ছেন, পাবলিক পোস্টে একজন অন্যজনের বক্তব্য খারিজ করছেন—এসব কী চলছে?’ তবে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে সারজিসের পোস্টের মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, ‘এসব কি ভাই। পাবলিকলিই বলছি—দুইজনের একজন মিথ্যা বলছেন।...সরি আর চুপ থাকতে পারলাম না।’
ওদিকে হাসনাত সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পর সেনাবাহিনী বলেছে, ‘হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্ট “সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি” বৈ অন্য কিছু নয়।’ হাসনাতের বক্তব্যকে ‘অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ব গল্পের সম্ভার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে সেনাবাহিনী।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমরা যে বাক্স্বাধীনতা পেয়েছি, তার সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে মনে হয় মাঝে মধ্যে কেউ কেউ বেহিসেবি হয়ে পড়ছি। যে যখন মুখে যা আসছে তা-ই বলে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় কেউ কেউ সেনাবাহিনীকে নিয়েও মাত্রাতিরিক্ত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, যা সত্যিই অশোভনীয়। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে এভাবে বক্তব্য রাখা বোধ হয় উচিত নয়। কিছুদিন যাবৎ সেনাবাহিনী নিয়ে এবি পার্টির ব্যারিস্টার ফুয়াদের কিছু বিকৃত রুচির বক্তব্য সবার দৃষ্টি কেড়েছে। আমি ভেবে অবাক হই একটি দলের সাধারণ সম্পাদক হয়ে একজন ব্যক্তি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে এমন অরুচিকর বক্তব্য দেন কী করে। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ‘চাকর-বাকর’-এর সঙ্গে তুলনা করে তিনি কী অর্জন করতে চান? কিছু কিছু ব্যক্তি মনে করেন বাক্স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নেগেটিভ কথা বলে অতি সহজেই জনপ্রিয় হওয়া যায়। আদতে তাই দেখছি, এ ধরনের সস্তা বক্তব্য দিয়ে অনেকেই সেলিব্রিটি হওয়ার পথ খুঁজে নিচ্ছেন। তবে এ কথা ঠিক, গত ১৫ বছর গদিচ্যুত শেখ হাসিনা, যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও দলীয় বিবেচনায় কিছু কিছু সেনা কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নিয়েছেন। এসব হঠাৎ পদ ও পদবি পাওয়া কর্মকর্তাদের কেউ কেউ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। যতদূর জেনেছি, স্বয়ং শেখ হাসিনাই তাঁদের দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, তাঁদের দুর্নীতির কথা জেনেও শেখ হাসিনা কোনো প্রকার ব্যবস্থা না নিয়ে, দলের স্বার্থেই তাঁদের অন্যায়ভাবে ব্যবহার করেছেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর এসব কর্মকর্তার দুর্নীতির সব তথ্যই ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা পুরো সেনাবাহিনীর মধ্যে শতকরা কতজন হবেন? তাই বলে কি পুরো সেনাবাহিনীকেই এভাবে গালমন্দ করতে হবে?
যাঁরা সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিষোদ্গার করছেন তাঁদের মনে রাখা উচিত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন হতো না, যদি সেদিন বাঙালি সেনাসদস্যরা নিজেদের আত্মবলিদান না দিতেন। নব্বইয়ের এরশাদের পতন হতো না, তরুণ কর্মকর্তারা যদি সেদিন মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করতে অস্বীকার না করতেন। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনারও এত সহজে পতন হতো না, যদি ছাত্র-জনতার পাশে সেনাবাহিনী না দাঁড়াত। সস্তা বক্তব্য দিয়ে যাঁরা সহজেই জনপ্রিয় হতে চান তাঁদের মনে রাখতে হবে, প্রকাশ্যে নির্ভয়ে-নির্দ্বিধায় যে বড় বড় বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তা তো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানেরই ফল। বিকৃত রুচির বক্তব্য দিয়ে কিছুই অর্জন করা যায় না, বরং তাতে বিকৃত মানসিকতারই পরিচয় পাওয়া যায়। কারোর বিরুদ্ধে আপত্তি থাকতে পারে, তাই বলে পুরো বাহিনীকে নিয়ে দোষারোপ করা ঠিক নয়। জাতীয় স্বার্থেই সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা উচিত নয়। কথা বলার আগে আমাদের সৌজন্যবোধ বজায় রেখে কথা বলা উচিত। শুধু সেনাবাহিনী বলে নয়, যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা বলার সময়েও ন্যূনতম সৌজন্য বজায় রাখা উচিত।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
চীনের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা পাওয়া গেলে তিস্তা নদীর ড্রেজিং, নদী ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। চীনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের কৃষি, জ্বালানি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।
৬ ঘণ্টা আগেঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান।
১ দিন আগেই-মেইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামের যুগেও পাঠক সংবাদপত্রে চিঠি লেখেন—এটাই প্রমাণ করে, মুদ্রিত শব্দের আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। দ্রুত বদলে যাওয়া যোগাযোগের মাধ্যমের ভিড়েও কিছু কথা থাকে, যা কাগজে ছাপা হয়ে আলো ছড়ায়।
৩ দিন আগেঅপারেশন সার্চলাইটের নৃশংসতায় তখন আকাশে উড়ছে শকুন। রাজপথে চিৎকার করছে কুকুর। আকাশে ‘কা কা’ করে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে কাকেরা বুঝিয়ে দিচ্ছে, সোনার বাংলাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে পাকিস্তানি হানাদারেরা।
৩ দিন আগে