জাহীদ রেজা নূর
এই দেশে একটি নির্বাচন হতে হবে। সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব এখন অন্তর্বর্তী সরকারের। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই নানা রকম সমালোচনার মুখে পড়েছে। দেশ পরিচালনা করা যে সহজ কাজ নয়, সেটা এখন অনেকেই বুঝতে পারছেন। পূর্ববর্তী সরকারের কঠোর সমালোচনা করলেই জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন থাকবে, এটা যে একমাত্র সত্য নয়, বরং জনগণের প্রতিদিনের ন্যূনতম চাহিদা মেটানো যে তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ—সে কথাও হয়তো তাঁরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন। কেন বিপ্লবী সরকার গঠিত না হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার হলো, এই কথা বলতে গিয়ে শহীদ মিনারে মারপিটের শিকার হয়েছেন একজন রাজনীতিবিদ। সংবিধানের আওতায় শপথ নিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করার ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে কোনো কোনো উপদেষ্টার আচরণে। ফলে দেশ যে একটা মহা অনিশ্চয়তায় মধ্যে আছে, সে কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।
এর চেয়েও বড় যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো পরমতকে বরদাশত না করা। আওয়ামী লীগের সময়ে ভিন্নমতকে আমলে আনা হয়নি, এই অভিযোগ করত বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা শক্তি। যাঁরা জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরাও এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে একই আচরণ করছেন। আওয়ামী লীগের অনুসারীরা ট্যাগ লাগাতেন ‘রাজাকার’, এই সরকারের সমর্থকেরা ট্যাগ লাগাচ্ছেন ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’। অর্থাৎ ভাবনার জগতেও কোনো পরিবর্তন আসেনি।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা করলে তা ভালোভাবে গ্রহণ করা হতো না। এখনো কি অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করলে তা ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়? দেশে যেসব ঘটনা ঘটছে, তার সবকিছুই কি সংবাদপত্রে আসে? টেলিভিশনে আসে? কেন আসে না? তা কি শুধুই সেলফ সেন্সরশিপের কারণে? অন্য কোনো ভয় কি আছে? ইউটিউবের ছবিতে যখন এমন সব ঘটনা দেখতে হয়, যা টেলিভিশন বা সংবাদপত্রে দেখা যায় না, তখন বুঝতে হয়, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
২.
দেশে কী হতে যাচ্ছে? নানা রকম জল্পনা-কল্পনা চলছে ঠিকই, কিন্তু আদতে কোন পথে চলবে দেশ, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। আগস্টের অভ্যুত্থানের পর প্রাথমিক আলামত যা দেখা গিয়েছিল, তাতে স্পষ্ট হয়েছিল, এই অভ্যুত্থানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরাও ব্যাপক অংশ নিয়েছে। একটু সময় নিয়ে স্পষ্ট হয়েছিল, ঘাপটি মেরে থাকা মতলববাজদের লক্ষ্য ছিল, শুধু আওয়ামী লীগের ওপর আক্রোশ ফলানো নয়, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকেও অবজ্ঞা করা। ফলে আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের একপর্যায়ে দেখা গিয়েছিল স্বাধীনতার স্মারকগুলোর ওপর নগ্ন হামলা। বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবীরাও সেই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করতে শুরু করলেন। আঘাত করা হলো জাতীয় সংগীতকে, প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে। একসময় শোনা গেল, এটা শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ছিল না, এটা ছিল মেটিকুলাস প্ল্যানের অংশ।
আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, এই গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করা বামপন্থীদের একেবারে সাইডলাইনে রেখে দেওয়া হলো। অর্থাৎ, বামপন্থী ও মধ্যপন্থীদের জায়গা দেওয়া হয়নি, ডান ও চরম ডানপন্থীরাই এ সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে রাজনীতির মাঠে প্রগতিশীলরা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারত, কিন্তু বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, দেশজোড়া তাঁদের শক্তিশালী সংগঠন নেই কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোয় বাম পন্থা জনগণকে বড় স্বপ্ন দেখাতে পারছে না। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আন্দোলনে থাকা সত্ত্বেও বামপন্থীদের কেন অবজ্ঞা করা হলো, সেটা পরিষ্কার করে কেউ বলেনি। না সরকারের পক্ষ থেকে, না বামপন্থীদের দিক থেকে এ ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই মনে হচ্ছিল, বিএনপির হাতে ক্ষমতা চলে আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু এখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, বিএনপিকেও রাজনীতির মাঠ থেকে বিদায় করার একটা ষড়যন্ত্র চলছে। অনেকের মনেই আশঙ্কা, রাজনীতির মাঠ তাঁরাই দখল করবেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করেন না। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা সূত্র এসে যদি মেশে, তাহলে আদতে সংস্কার, সংবিধান, আইনশৃঙ্খলা, বাজারমূল্য, সিন্ডিকেট ইত্যাদি কোন অবস্থায় এসে দাঁড়াবে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা থেকে যাবে।
মুক্তিযুদ্ধকে মনে ধারণ করেন যে মানুষেরা, তাঁদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামী অপশাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, স্বৈরাচারের পতন চেয়েছিলেন, তাঁরাও এই নতুন বাস্তবতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। বিষয়টি মনে রেখেই ঘটমান বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করতে হবে।
৩.
এই বছরে কী কী ঘটতে পারে, তার একটা অনুমান করা যাক।
একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আসবে। ইতিমধ্যেই অনেক দেশ বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বলে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। এই চাপ অব্যাহত থাকবে। নির্বাচনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের একটি সহজ ‘এক্সিট রুট’ থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অনেকেই বুঝতে পারছেন, কোনো ছক অনুযায়ী ক্ষমতায় বসে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়াটা সব সময় সহজ নয়। যে ঐকমত্য কিংবা জাতীয় ঐক্যের কথা ভাবা হয় কিংবা বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলা হয়ে থাকে, বাস্তবে তার সবকিছুই সেভাবে ঘটে না। ফলে যাঁরা এখন নানা প্রশ্নে উচ্চকিত রয়েছেন, বিতর্কিত কথাবার্তা বলছেন, তাঁদের কারও কারও মনে এক্সিট রুট সম্পর্কে সংশয় থেকে যাচ্ছে।
আমাদের প্রশ্ন হলো, যদি সততার সঙ্গে নিজের কাজটি করা যায়, তাহলে এই ভয় থাকবে কেন? ক্ষমতার পরিবর্তন তো হতে হয় সহজভাবে। অন্তত গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। অন্য কোনো দেশে তো আমরা ক্ষমতা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে দখলদারত্বের পরিবর্তন দেখি না। এক দলের চাঁদাবাজের জায়গায় আরেক দল নতুন চাঁদাবাজের উত্থান দেখি না। আমাদের মধ্যেই কেন তা হয়? কেন ক্ষমতাসীন কোনো নেতাকে বলতে হয়, ক্ষমতা চলে গেলে পিঠের চামড়াও থাকবে না? আমরা রাজনীতি বলতে যদি ক্ষমতা হাতে পেয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করার স্বাধীনতা পেয়েছি বলে মনে করি, তাহলে কখনোই গণতন্ত্রের সঙ্গে বোঝাপড়া হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও থাকবে না।
৪.
আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে না থাকলে বিএনপিই এখন এককভাবে সবচেয়ে বড় দল। নির্বাচন হলে তারাই ক্ষমতায় আসবে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ছাত্রদের তাঁর নিয়োগকর্তা বলে স্বীকার করেছেন, সেই ছাত্রদের তরফ থেকেও এক বা একাধিক রাজনৈতিক দল হবে বলে আলোচনা হচ্ছে। এরাই যদি কিংস পার্টি হয়ে থাকে, তাহলে এ বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও কিংস পার্টির মধ্যে সংঘাত হতে পারে। জামায়াতে ইসলামীও তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে যাবে। তারা তো ইতিমধ্যে ঘোষণাই দিয়ে ফেলেছে, এই দেশে নাকি শুধু তাদের দল আর সেনাবাহিনীই প্রকৃত দেশপ্রেমিক। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, সে কথা কি ভুলে গেছে বাংলাদেশ? বাংলাদেশের তরুণেরা কি সেই ইতিহাস জানে?
খালেদা জিয়ার সঙ্গে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান কী বিষয়ে আলোচনা করেছেন, তা অনুমান করা কঠিন; তবে নির্বাচন এবং নির্বাচনের পরও ঐক্য বজায় রাখা নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকলে আমি বিন্দুমাত্র অবাক হব না। ছাত্ররা যে দলটি করতে চাইছে, সেই দল অতি অল্প পরিশ্রমেই জনসমর্থন পেয়ে যাবে, এ রকম আশাবাদী হয়ে ওঠার কোনো কারণ দেখি না। তা ছাড়া, আগস্ট মাসে সমন্বয়কদের যে শক্তি ছিল, এই পাঁচ মাসের মধ্যে তা অনেকটাই কমে গেছে, তাই ছাত্রদের দলকে ক্ষমতায় আনা কঠিন হবে। আমাদের দেশে অতীতেও বিভিন্ন সময় নির্বাচনে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’ করা হয়েছিল; সেই পথে কোনো দল যে ক্ষমতায় গিয়ে বসবে, এ রকম আশঙ্কা এবার কম। কারণ, গোটা বিশ্বের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। নির্বাচনের নামে প্রহসন করার কোনো সুযোগ অন্তত এবারের নির্বাচনে নেই।
৫.
নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দল ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত পরিস্থিতির বদল হবে না। তবে উগ্র কোনো মতবাদ যেন এই সময়ে বাংলাদেশের চিন্তার জগৎকে গ্রাস করে না ফেলে, সেদিকে সচেতন মহলের তীক্ষ্ণ নজর রাখা দরকার। সাধারণ মানুষ অরাজকতা চায় না, কোনো ধরনের মতবাদের প্রতি অন্ধ সমর্থন চায় না; তারা চায় কথা বলার স্বাধীনতা, চায় ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত দেশ।
তবে সবকিছুর ওপর ১৯৭১ সালে রক্তের দামে কেনা দেশটিকে শ্রদ্ধা করতে চায়। এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।
এই দেশে একটি নির্বাচন হতে হবে। সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব এখন অন্তর্বর্তী সরকারের। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই নানা রকম সমালোচনার মুখে পড়েছে। দেশ পরিচালনা করা যে সহজ কাজ নয়, সেটা এখন অনেকেই বুঝতে পারছেন। পূর্ববর্তী সরকারের কঠোর সমালোচনা করলেই জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন থাকবে, এটা যে একমাত্র সত্য নয়, বরং জনগণের প্রতিদিনের ন্যূনতম চাহিদা মেটানো যে তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ—সে কথাও হয়তো তাঁরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন। কেন বিপ্লবী সরকার গঠিত না হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার হলো, এই কথা বলতে গিয়ে শহীদ মিনারে মারপিটের শিকার হয়েছেন একজন রাজনীতিবিদ। সংবিধানের আওতায় শপথ নিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করার ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে কোনো কোনো উপদেষ্টার আচরণে। ফলে দেশ যে একটা মহা অনিশ্চয়তায় মধ্যে আছে, সে কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।
এর চেয়েও বড় যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো পরমতকে বরদাশত না করা। আওয়ামী লীগের সময়ে ভিন্নমতকে আমলে আনা হয়নি, এই অভিযোগ করত বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা শক্তি। যাঁরা জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরাও এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে একই আচরণ করছেন। আওয়ামী লীগের অনুসারীরা ট্যাগ লাগাতেন ‘রাজাকার’, এই সরকারের সমর্থকেরা ট্যাগ লাগাচ্ছেন ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’। অর্থাৎ ভাবনার জগতেও কোনো পরিবর্তন আসেনি।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা করলে তা ভালোভাবে গ্রহণ করা হতো না। এখনো কি অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করলে তা ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়? দেশে যেসব ঘটনা ঘটছে, তার সবকিছুই কি সংবাদপত্রে আসে? টেলিভিশনে আসে? কেন আসে না? তা কি শুধুই সেলফ সেন্সরশিপের কারণে? অন্য কোনো ভয় কি আছে? ইউটিউবের ছবিতে যখন এমন সব ঘটনা দেখতে হয়, যা টেলিভিশন বা সংবাদপত্রে দেখা যায় না, তখন বুঝতে হয়, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
২.
দেশে কী হতে যাচ্ছে? নানা রকম জল্পনা-কল্পনা চলছে ঠিকই, কিন্তু আদতে কোন পথে চলবে দেশ, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। আগস্টের অভ্যুত্থানের পর প্রাথমিক আলামত যা দেখা গিয়েছিল, তাতে স্পষ্ট হয়েছিল, এই অভ্যুত্থানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরাও ব্যাপক অংশ নিয়েছে। একটু সময় নিয়ে স্পষ্ট হয়েছিল, ঘাপটি মেরে থাকা মতলববাজদের লক্ষ্য ছিল, শুধু আওয়ামী লীগের ওপর আক্রোশ ফলানো নয়, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকেও অবজ্ঞা করা। ফলে আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের একপর্যায়ে দেখা গিয়েছিল স্বাধীনতার স্মারকগুলোর ওপর নগ্ন হামলা। বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবীরাও সেই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করতে শুরু করলেন। আঘাত করা হলো জাতীয় সংগীতকে, প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে। একসময় শোনা গেল, এটা শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ছিল না, এটা ছিল মেটিকুলাস প্ল্যানের অংশ।
আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, এই গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করা বামপন্থীদের একেবারে সাইডলাইনে রেখে দেওয়া হলো। অর্থাৎ, বামপন্থী ও মধ্যপন্থীদের জায়গা দেওয়া হয়নি, ডান ও চরম ডানপন্থীরাই এ সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে রাজনীতির মাঠে প্রগতিশীলরা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারত, কিন্তু বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, দেশজোড়া তাঁদের শক্তিশালী সংগঠন নেই কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোয় বাম পন্থা জনগণকে বড় স্বপ্ন দেখাতে পারছে না। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আন্দোলনে থাকা সত্ত্বেও বামপন্থীদের কেন অবজ্ঞা করা হলো, সেটা পরিষ্কার করে কেউ বলেনি। না সরকারের পক্ষ থেকে, না বামপন্থীদের দিক থেকে এ ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই মনে হচ্ছিল, বিএনপির হাতে ক্ষমতা চলে আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু এখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, বিএনপিকেও রাজনীতির মাঠ থেকে বিদায় করার একটা ষড়যন্ত্র চলছে। অনেকের মনেই আশঙ্কা, রাজনীতির মাঠ তাঁরাই দখল করবেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করেন না। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা সূত্র এসে যদি মেশে, তাহলে আদতে সংস্কার, সংবিধান, আইনশৃঙ্খলা, বাজারমূল্য, সিন্ডিকেট ইত্যাদি কোন অবস্থায় এসে দাঁড়াবে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা থেকে যাবে।
মুক্তিযুদ্ধকে মনে ধারণ করেন যে মানুষেরা, তাঁদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামী অপশাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, স্বৈরাচারের পতন চেয়েছিলেন, তাঁরাও এই নতুন বাস্তবতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। বিষয়টি মনে রেখেই ঘটমান বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করতে হবে।
৩.
এই বছরে কী কী ঘটতে পারে, তার একটা অনুমান করা যাক।
একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আসবে। ইতিমধ্যেই অনেক দেশ বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বলে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। এই চাপ অব্যাহত থাকবে। নির্বাচনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের একটি সহজ ‘এক্সিট রুট’ থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অনেকেই বুঝতে পারছেন, কোনো ছক অনুযায়ী ক্ষমতায় বসে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়াটা সব সময় সহজ নয়। যে ঐকমত্য কিংবা জাতীয় ঐক্যের কথা ভাবা হয় কিংবা বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলা হয়ে থাকে, বাস্তবে তার সবকিছুই সেভাবে ঘটে না। ফলে যাঁরা এখন নানা প্রশ্নে উচ্চকিত রয়েছেন, বিতর্কিত কথাবার্তা বলছেন, তাঁদের কারও কারও মনে এক্সিট রুট সম্পর্কে সংশয় থেকে যাচ্ছে।
আমাদের প্রশ্ন হলো, যদি সততার সঙ্গে নিজের কাজটি করা যায়, তাহলে এই ভয় থাকবে কেন? ক্ষমতার পরিবর্তন তো হতে হয় সহজভাবে। অন্তত গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। অন্য কোনো দেশে তো আমরা ক্ষমতা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে দখলদারত্বের পরিবর্তন দেখি না। এক দলের চাঁদাবাজের জায়গায় আরেক দল নতুন চাঁদাবাজের উত্থান দেখি না। আমাদের মধ্যেই কেন তা হয়? কেন ক্ষমতাসীন কোনো নেতাকে বলতে হয়, ক্ষমতা চলে গেলে পিঠের চামড়াও থাকবে না? আমরা রাজনীতি বলতে যদি ক্ষমতা হাতে পেয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করার স্বাধীনতা পেয়েছি বলে মনে করি, তাহলে কখনোই গণতন্ত্রের সঙ্গে বোঝাপড়া হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও থাকবে না।
৪.
আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে না থাকলে বিএনপিই এখন এককভাবে সবচেয়ে বড় দল। নির্বাচন হলে তারাই ক্ষমতায় আসবে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ছাত্রদের তাঁর নিয়োগকর্তা বলে স্বীকার করেছেন, সেই ছাত্রদের তরফ থেকেও এক বা একাধিক রাজনৈতিক দল হবে বলে আলোচনা হচ্ছে। এরাই যদি কিংস পার্টি হয়ে থাকে, তাহলে এ বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও কিংস পার্টির মধ্যে সংঘাত হতে পারে। জামায়াতে ইসলামীও তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে যাবে। তারা তো ইতিমধ্যে ঘোষণাই দিয়ে ফেলেছে, এই দেশে নাকি শুধু তাদের দল আর সেনাবাহিনীই প্রকৃত দেশপ্রেমিক। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, সে কথা কি ভুলে গেছে বাংলাদেশ? বাংলাদেশের তরুণেরা কি সেই ইতিহাস জানে?
খালেদা জিয়ার সঙ্গে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান কী বিষয়ে আলোচনা করেছেন, তা অনুমান করা কঠিন; তবে নির্বাচন এবং নির্বাচনের পরও ঐক্য বজায় রাখা নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকলে আমি বিন্দুমাত্র অবাক হব না। ছাত্ররা যে দলটি করতে চাইছে, সেই দল অতি অল্প পরিশ্রমেই জনসমর্থন পেয়ে যাবে, এ রকম আশাবাদী হয়ে ওঠার কোনো কারণ দেখি না। তা ছাড়া, আগস্ট মাসে সমন্বয়কদের যে শক্তি ছিল, এই পাঁচ মাসের মধ্যে তা অনেকটাই কমে গেছে, তাই ছাত্রদের দলকে ক্ষমতায় আনা কঠিন হবে। আমাদের দেশে অতীতেও বিভিন্ন সময় নির্বাচনে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’ করা হয়েছিল; সেই পথে কোনো দল যে ক্ষমতায় গিয়ে বসবে, এ রকম আশঙ্কা এবার কম। কারণ, গোটা বিশ্বের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। নির্বাচনের নামে প্রহসন করার কোনো সুযোগ অন্তত এবারের নির্বাচনে নেই।
৫.
নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দল ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত পরিস্থিতির বদল হবে না। তবে উগ্র কোনো মতবাদ যেন এই সময়ে বাংলাদেশের চিন্তার জগৎকে গ্রাস করে না ফেলে, সেদিকে সচেতন মহলের তীক্ষ্ণ নজর রাখা দরকার। সাধারণ মানুষ অরাজকতা চায় না, কোনো ধরনের মতবাদের প্রতি অন্ধ সমর্থন চায় না; তারা চায় কথা বলার স্বাধীনতা, চায় ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত দেশ।
তবে সবকিছুর ওপর ১৯৭১ সালে রক্তের দামে কেনা দেশটিকে শ্রদ্ধা করতে চায়। এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।
গত ডিসেম্বরের কথা। সকালের সূর্য সবে পূর্ব আকাশে উঁকি দিয়েছে। ছুটলাম কৃষকের মাঠের দিকে। আমি একা নই। সঙ্গে ২০ খুদে শিক্ষার্থী। তারা নতুন কিছু করবে ভেবে উত্তেজনায় উৎফুল্ল। যেতে যেতে আমরা কথা বলছিলাম বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক নিয়ে। নানা রকমের প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসা তাদের।
১৬ ঘণ্টা আগেআগামী ২২ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তিন বছর পেরিয়ে চার বছরে পদার্পণ করবে। বাংলাদেশে বসে এই সময়ে এই যুদ্ধের প্রতি এখন ততটা আগ্রহ দেখাবে না কেউ। দীর্ঘদিন এই যুদ্ধ চলার পর স্বাভাবিকভাবে মানুষ এটাকে নিত্যনৈমিত্তিক একটা ব্যাপার হিসেবে মেনে নিয়েছে।
১৬ ঘণ্টা আগে‘যে আগুন জ্বলেছিল’ বইটি হঠাৎ হাতে এসেছিল আমার। সে বইয়ে নিমগ্ন হতে সময় লাগেনি। মো. আনিসুর রহমান সম্পর্কে তখন থেকেই কৌতূহলী হয়ে উঠি। গুণী অর্থনীতিবিদ, বিকল্প উন্নয়ন দার্শনিক, রবীন্দ্র-গবেষক, শিল্পী এই মানুষটি একসময় স্বপ্ন দেখেছিলেন সাম্যের। আমরা যখন জিয়নকাঠি নামের আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম...
১৬ ঘণ্টা আগেব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কথা আমাদের জানা। এবার শোনা গেল করপোরেট কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেটের কথা। আজকের পত্রিকায় রোববার প্রকাশিত বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)-এর সংবাদ সম্মেলন থেকে জানা গেল ডিম ও মুরগির দাম বাড়ার আসল কারণ।
১৬ ঘণ্টা আগে