Ajker Patrika

একটি বাড়ির কথা

একটি বাড়ির কথা

উত্তরের ছোট্ট জেলা পঞ্চগড়। আগে অবশ্য জেলা ছিল না। ছিল দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার একটি থানা। গত শতকের আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতায় এসে অনেকগুলো নতুন জেলা বানালে পঞ্চগড় জেলার মর্যাদা পায়। এই জেলার একটি উপজেলা বোদা। এই নামটি নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের কারও কারও আপত্তি আছে। এতে বোদাবাসী কোনো পরোয়া করে না। কারণ, এই নামের একটি ইতিহাস আছে। এক সময় ছিল নদী বন্দর। পাথরাজ ও ঝিনাইকুড়ি নদীর তীরে বোদা বন্দর। ছোটবেলায় আমরাও শুনেছি গ্রামের মানুষ বলতেন, ‘বন্দর যামো’। এই বোদার একটি বাড়ির কথা ঈদের অবসরে পাঠকদের জানানোর লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।

আমাদের বালকবেলায় দূর অঞ্চলের কেউ এই এলাকায় বেড়াতে এসে যদি বোদার কোনো বিখ্যাত বাড়ির কথা জানতে চাইতেন, তাহলে তাঁকে নিশ্চিতভাবে বলা হতো ‘কারকুন বাড়ি’-এর কথা। এই বাড়ি নিয়ে কিছু কথা।

কারকুন বাড়ির কর্তা হিসেবে আমরা পেয়েছি যোগেন চন্দ্র কারকুনকে। যোগেন কারকুনের বাবার নাম ত্রৈলোক্যনাথ খাঁভাদুরী, ছোট ভাইয়ের নাম সুরেন্দ্রনাথ খাঁভাদুরী। এক পরিবারে দু-রকম পদবি হলো কী করে? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়ার লোক এখন আর পাওয়া যাবে কি-না, আমি জানি না। তবে আমার অনুসন্ধানে দুটি তথ্য বেরিয়েছে। ১. যোগেন বাবুও খাঁভাদুরী পদবি লিখতেন। কিন্তু কুচবিহার মহারাজা তাঁকে তাঁর জমিদারি তদারকির জন্য ‘কারকুন’ উপাধি দিয়েছিলেন বলে তিনি খাঁভাদুরী ত্যাগ করে কারকুন ব্যবহার শুরু করেন। ২. জনৈক কারকুন পদবিধারী জমিদার যোগেন বাবুকে তার বালকবেলায় দত্তক নিয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি কারকুন পদবি ব্যবহার করেন। ওই দত্তক গ্রহণকারীর জমিদারি যোগেন বাবু উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। তাঁর বাবার আসলে জমিদারি ছিল না।

এই দুই তথ্য নিয়ে এখন আর বিভ্রান্তি তৈরির কিছু নেই। আমরা যোগেন বাবুকে কারকুন হিসেবেই জানি এবং আমাদের কাছে তাঁর বাড়িটি কারকুন বাড়ি হিসেবেই পরিচিত।

ত্রৈলোক্যনাথ খাঁভাদুরীকে মানুষ ‘পাগলা মাস্টার’ বলে কেন ডাকত? সম্ভবত তিনি কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন। পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে কারও কারও নামের শেষে ‘পাগলা’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন ফইম পাগলা, সিরাজ পাগলা ইত্যাদি।

ত্রৈলোক্যনাথ বাবু ছিলেন পরোপকারী মানুষ। কেউ বিপদে পড়লে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। অভাবী মানুষকে সহায়তা করতেন। কখনো কখনো নিজের সামর্থ্যের কথা খুব একটা চিন্তা না করেও। দুটো ঘটনার কথা বললে তাঁর পাগলামির কিছুটা নমুনা পাওয়া যাবে। বোদা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের কথা বলেছি। স্কুলের আর্থিক সংকট দেখা দিলে তিনি স্থির থাকতে পারতেন না। বলতেন, ‘বেচাও গাছ, বাঁচাও স্কুল’। তাঁদের শাল বাগান ছিল। ওই বাগান থেকে শাল গাছ বিক্রি করে স্কুল তহবিলে টাকা দিতেন। তাঁদের শাল বাগানের কিছু অংশ আমরাও দেখেছি। এখন সম্ভবত কারকুনদের শাল গাছ আর নেই।

একবার যোগেন বাবু বোদা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। হয়তো সেটা দেশ ভাগের আগে। তখন পর্যন্ত সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা চালু হয়নি। মানুষ এক জায়গায় সমবেত হয়ে প্রার্থীর পক্ষের লাইনে দাঁড়ালে মাথা গুনে বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হতো। যোগেন বাবুর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ভাসাইনগরের মহিরউদ্দিন সরকার। ভোটের দিন দেখা গেল দুই প্রার্থীর লাইনে সমানসংখ্যক মানুষ দাঁড়িয়েছেন। যোগেন বাবুর বাবাকে এই খবর দেওয়া হলো। তিনি ভোট দিতে যাননি। তিনি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ছেলের লাইনে দাঁড়ালেই ছেলে প্রেসিডেন্ট; অর্থাৎ, চেয়ারম্যান হয়ে যাবেন। ত্রৈলোক্যনাথ বাবু দৌড়াতে দৌড়াতে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সময় বলছিলেন, ‘এক দিকে পুত্র, আর একদিকে ছাত্র। এখন কী করি?’

সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে তিনি গিয়ে মহিরউদ্দিন সরকারের লাইনে দাঁড়ালেন। ফলে তিনি বিজয়ী হলেন। যোগেন কারকুন পরাজিত হলেন। ত্রৈলোক্য বাবুকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘পুত্র তো প্রেসিডেন্ট হলেও আমার, না হলেও আমার। কিন্তু ছাত্রও যে আমার, সেটা প্রমাণের আর উপায় কী ছিল?’ এমন মানুষকে ‘পাগলা’ না বলে কী বলা হবে!

বাবার রক্তের ধারা বহন করছিলেন বলে যোগেন বাবুও কিছুটা কম বৈষয়িক ছিলেন বলেই মনে হয়। তিনি ছিলেন খুব শৌখিন ও রুচিবান মানুষ। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ ছিল। বাড়িতে নাচ-গানের প্রচলন ছিল। তিনি নিজেও একসময় মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। তাঁর বই পড়ার বাতিক এবং বাড়িতে বইয়ের সমৃদ্ধ সংগ্রহশালার কথা আগেই বলেছি। আর একটি কাজ তিনি করতেন, সেটা হলো ভ্রমণ। জীবনের প্রথম ভাগে তিনি ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করেছেন।

আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, কারকুন বাড়ি ছিল যেন বোদার অনেকের ‘ফুসফুস’। কারকুন বাড়ি কারও কারও কাছে ছিল মন ভালো করার ‘যন্তরমন্তর’। ওই বাড়িতে যাওয়া এবং পাতপেড়ে খাওয়া ছিল একটি নিত্য ঘটনা। কারকুন বাড়িতে গেছেন, অথচ কিছু না খেয়ে এসেছেন—এটা অবিশ্বাস্য। আমারও ছিল অবাধ যাতায়াত। কারণ, কারকুন-গিন্নি, ঊষারানী কারকুন ছিলেন আমার পিসিমা। মার চেয়ে আপনার মাসিমা নয়, মার চেয়ে আপনার পিসিমা। কীভাবে তিনি আমার পিসি হলেন? আমাদের তো কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না। তাহলে?

আমার বাবা-কাকারা ছিলেন তিন ভাই। তাঁদের আপন কোনো বোন ছিল না। সে হিসেবে আমার কোনো পিসি থাকার কথা নয়। তারপরও কারকুন বাড়ির ঊষারানী কারকুন, যোগেন চন্দ্র কারকুনের স্ত্রী, আমার পিসি হয়েছিলেন। আমার বাবা-কাকার কাকাতো বোন, আমার সুনীতি পিসির সঙ্গে ছিল তাঁর দারুণ হৃদ্যতা, বোনের মতো। পিসির বোন, তাই আমারও পিসি। আমার এই পিসি হলেন বোদার কার্তিক সরকার, জ্যোতিষ সরকারের মা। আমার পিসা মহাশয়ের নাম শরৎচন্দ্র সরকার। তিনি ছিলেন আবার যোগেন কারকুনের ভাইতুল্য। এই দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা, যোগাযোগের সূত্রেই আমাদের সঙ্গেও কারকুন পরিবারের পরিচয় ও প্রায়-আত্মীয়তার মতো সম্পর্ক।

কারকুনবাড়ির সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল না—এমন মানুষ অবশ্য সে সময় খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। ওই বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল বোদার গণ্যমান্য বলে পরিচিত সবারই। যোগেন বাবু মিশুকে স্বভাবের ছিলেন। তাঁর মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। ব্রাহ্মণ হলেও তাঁর মধ্যে কোনো গোঁড়ামি ছিল না। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার অবাধ যাতায়াত ছিল কারকুন বাড়িতে। ওই বাড়ির সবাই ছিলেন আধুনিক ও উদার মনের মানুষ। অথচ এই যোগেন বাবুকেও একবার (ষাটের দশকের মাঝামাঝি) বোদা হাইস্কুলের কিছু উগ্র ছাত্রের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল।

যোগেন কারকুন ছিলেন বোদা হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। কমিটির কোনো এক সভায় তিনি নাকি ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তার জের ধরে কয়েকজন শিক্ষক কিছু ছাত্রকে উসকে দিয়েছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে।

কারকুন পরিবারের একটি ট্র্যাজেডি হলো অতি রূপবতী-গুণবতী হওয়া সত্ত্বেও ওই বাড়ির মেয়েদের বিয়ে না হওয়া। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘অতি বড়ো ঘরনি না পায় ঘর, অতি বড়ো সুন্দরী না পায় বর’। কারকুন বাড়ির দিদিদের দেখেও আমার তাই মনে হতো। কিন্তু ব্যতিক্রম একটি ঘটেছিল, যেটা আবার পরিবারকে ফেলেছিল লজ্জায়। ষাটের দশকের শেষ দিকেই কারকুন বাড়ির দ্বিতীয় কন্যা, আমাদের ইরাদি (ইরা রাণী কারকুন) পালিয়ে বিয়ে করলেন বোদা থানা সার্কেল অফিসারকে (উন্নয়ন)। তখন মানুষ বলত সিও (ডেভ.)। আব্দুর রৌফ চৌধুরী ছিল সম্ভবত ভদ্রলোকের নাম। ইরাদির এই বিয়ে ছিল তখন এক ব্যাপক আলোচিত বিষয়। কারকুন পরিবার বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেনি।

মেয়ের এভাবে বিয়ে করা এবং ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার দুটি ঘটনা সম্ভবত যোগেন পিসা মহাশয়কে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল। মানসিকভাবে দারুণ আঘাত পেয়েছিলেন। এর পর তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বাজারে আসা-যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছিলেন। ঝড়ে বিশাল বৃক্ষ উপড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল তাঁর।

যোগেন কারকুন মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আগে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি এবং আমার প্রিয় বন্ধু বিজন দত্ত সকালেই ছুটে গিয়েছিলাম কারকুন বাড়িতে। তাঁকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল তুলসিতলায়। বিশাল দেহের সৌম্যকান্তি মানুষটির অমন শয্যা দেখে আমার ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠেছিল। তার আগে আমি কখনো কোনো মরদেহ দেখতে যাইনি। সে হিসেবে ওটাই আমার প্রথম কোনো মৃতদেহ দেখা। প্রাণহীন একজন মানুষকে ভূমিশয্যায় দেখে আমার ভেতরটা হাহাকার করে উঠেছিল এবং আরও যে বিচিত্র অনুভূতি হয়েছিল, তা এখন আর বর্ণনা করতে পারব না। জীবন-মৃত্যুর যিনি নিপুণ কারিগর সেই বিশ্বস্রষ্টার প্রতি আমার মধ্যে আগে থেকেই ছিল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। একজন প্রিয় ও পছন্দের মানুষের মৃত্যুর পর বিশ্বস্রষ্টার অপার ক্ষমতা সম্পর্কে বিশ্বাস যেন কিছুটা হলেও বেড়েছিল। সংসারের কর্তা চলে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই সব দায়িত্ব পিসিমার কাঁধে বর্তায়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সংসারের হাল ধরেছিলেন।

যোগেন কারকুনের মৃত্যুর অল্প পরেই শুরু হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দেশীয় সহযোগী-অনুচরদের হত্যা-নির্যাতনের মুখে অসংখ্য মানুষকে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। বোদা থেকেও আমরা অনেকেই বাধ্য হয়েই ভারতে গিয়ে শরণার্থীর জীবন বেছে নিয়েছিলাম। পাকিস্তানিদের আক্রমণের প্রধান টার্গেট ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক জনগোষ্ঠী। কারকুন বাড়ি দুই কারণেই টার্গেট ছিল। তারা একদিকে হিন্দু এবং অন্যদিকে বাড়ির বড় ছেলে অনুপ কুমার কারকুন দুলাল ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী, স্বাধীনতার পক্ষের একজন সংগঠক।

যেদিন বোদা প্রথম পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে যায়, সেদিনই তিনজনকে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের একজন আমার দাদাশ্বশুর (পরবর্তী সময়ে) যতীন্দ্র মোহন সাহা। প্রকৃতপক্ষে তিনিই বোদার প্রথম শহীদ। তার পর হত্যা করা হয়েছিল বোদার তখনকার পোস্টমাস্টার আব্দুল মান্নানকে। তৃতীয় যাঁকে হত্যা করা হয়, তিনি আব্দুল লতিফ। লতিফ মেম্বর বলেই তাঁকে সবাই চিনত। তিনি পাকিস্তানিদের সহযোগী হয় হিন্দু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িঘর, দোকানপাট চিনিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কেন পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, সেটা একটা রহস্য। কিছু দালাল হত্যা করে পাকিস্তানিরা বোধ হয় বুঝিয়েছিল যে, বিশ্বাসঘাতকদের বেঁচে থাকার অধিকার না থাকাই ভালো। পাকিস্তানিরা বোদা বাজারে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল ব্যাপক লুটপাট। আমাদের একটি গালা মালের দোকান ছিল। দোকানের সব মালামাল লুট হয়েছিল মুহূর্তের মধ্যে। ওই লুটেরার দল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরেই লুটপাট অব্যাহত রেখেছিল। আমার পরিবারের সবাই বলতে গেলে এক বস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বের হয়ে আর ফিরে আসা হয়নি। আমাদের তখনকার বাড়িটি ছিল দিনাজপুর-পঞ্চগড় হাইওয়ের পাশে পাথরাজ ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে আখ ক্রয়কেন্দ্রের লাগোয়া। আমাদের বাড়িটি একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

কারকুন বাড়ির ছেলেমেয়েরা দেশত্যাগ করলেও পিসিমা, ঊষারানী কারকুন জেদ ধরলেন তিনি কিছুতেই সদ্যপ্রয়াত স্বামীর ভিটা ছেড়ে কোথাও যাবেন না। বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র লুট হয়েছে। পাড়াপড়শিরাও লুটে অংশ নিয়েছে। রান্না-খাওয়ার বাসনকোসনও লুট হয়েছে। কিন্তু তাঁকে ভিটে ছাড়া করা যায়নি। তাঁর জেদ কিংবা মনোবলের কাছে ভয়ভীতি পরাজিত হয়েছিল।

তাঁকে হত্যার জন্য রাজাকার কমান্ডার চন্দনবাড়ির হবিবর রহমান একদিন কারকুন বাড়ি গিয়েও উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি। পিসিমা আগেই টের পেয়ে ঘর ছেড়ে বাড়ির পেছন দিকের ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়েছিলেন। তাঁকে খুঁজতে ওই ঝোপের দিকেও গিয়েছিলেন হবিবর রহমান। তিনি পিসিমাকে দেখতেও পেয়েছিলেন। রাইফেল তাক করে গুলি ছোড়ার আগে একটি সাপ তার দিকে ছোবল হানতে গেলে প্রাণভয়ে তিনি দৌড়ে পালান। জীবন রক্ষা হয় পিসিমার।

হবিবর রহমান ছিলেন আনসার কমান্ডার। সে জন্য তাঁকে মানুষ হবিবর কমান্ডার বলেই জানত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে তাঁকে কেউ ভয়াবহ চরিত্রের মানুষ বলে মনে করত না। ২৬ বা ২৭ মার্চ ঠাকুরগাঁও ইপিআর ছাউনি থেকে পালিয়ে আসা একজন পাকিস্তানি সৈনিককে পাকড়াও করে বোদা হাইস্কুল মাঠে বহু মানুষের উপস্থিতিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। যারা গুলি করেছিলেন, তাদের মধ্যে হবিবর কমান্ডারও ছিলেন। তিনি একসময় যাত্রা-নাটকে অভিনয় করতেন। বেশ হাসি-খুশি প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমার বাবা-কাকাদের সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। আমি তাঁকে চাচা বলতাম। তিনিও আমাকে নাম ধরে না ডেকে ‘বাবাজি’ বলে সম্বোধন করতেন। আমরা বন্ধুরা স্কুলে পড়ার সময়ই কিছুদিন বেশ নাটক পাগল হয়ে উঠেছিলাম। এক বছর আমরা চারটি নাটক মঞ্চস্থ করেছি। হবিবর চাচা দু-একটি নাটক নির্দেশনা বা পরিচালনার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। মনে আছে, রিহার্সালের জায়গা না পেয়ে আমরা রাতের বেলা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছে পাথরাজ ব্রিজের ওপরও রিহার্সাল করেছি। তখন অবশ্য জায়গাটি এখনকার মতে ঘিঞ্জি ছিল না।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হবিবর রহমান হয়ে ওঠেন এক ভয়ংকর মানুষ। বোদায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের মধ্য তাঁর নাম ওপরের দিকেই রাখতে হবে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, স্বাধীনতার পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর একসময় প্রকাশ্যে আসেন এবং বোদায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর বাড়ি ছিল বোদা বাজার থেকে কয়েক মাইল দূরের চন্দনবাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালন সত্ত্বেও স্বাধীন দেশে প্রথম স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তিনি বোদা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান বোদা গেলে তাঁর সভামঞ্চে হবিবর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হন। আবার ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ ফরহাদের পক্ষাবলম্বন করে আমাদের লজ্জায় ফেলেছিলেন।

হবিবর কমান্ডার কারকুন-গিন্নিকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর ওপর উপদ্রব একটু কমে আসে। একজন পাকিস্তানি মেজরও তাঁর দেশ ছেড়ে না যাওয়ার কথা শুনে তাঁকে দেখতে আসেন। ওই মেজরও তাঁকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমি পরবর্তী সময়ে জেনেছি যে, পিসিমাকে গোপনে নানাভাবে সাহায্য করেছেন মাঝগ্রাম নিবাসী দবিরউদ্দিন হাজী সাহেব। চাল-ডাল, এমনকি হাড়িপাতিলও দবির চাচাই কারকুন বাড়িতে সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোতে পাঠাতেন। আজিজার রহমানও (যিনি পরে বোদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন) গোপনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, খোঁজ-খবর দিতেন। শত্রুকবলিত দেশে পিসিমা শত্রুর সঙ্গে মিত্রও পেয়েছিলেন। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। সবাই শত্রু ছিল না, আবার মিত্রও সবাই নয়। আমরা আজ শত্রু-মিত্র একাকার করে এক বিপন্ন অবস্থা তৈরি করেছি।

কারকুন বাড়ির সামনের পুকুর এবং মন্দির নিয়ে কিছু মিথ বা কাহিনি শোনা যায়। মন্দিরে শিবের মূর্তি ছিল। সে জন্য শিব মন্দির হিসেবেই ওটা পরিচিতি পেয়েছিল। বোদার হিন্দু নারীরা ফাল্গুন মাসে শিব চতুর্দশীর রাতে সমবেতভাবে ওই মন্দিরে পূজা অর্চনা করতেন। শিব রাত্রিতে ভক্তরা যে বাসনা করেন, তা নাকি ভগবান শিব পূরণ করেন। এই মন্দিরে পূজা দিয়ে অনেকেরই নাকি মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। সে জন্য ওই মন্দিরকে একসময় জাগ্রত মন্দির বলা হতো। তবে এখন সে রামও নেই, নেই সে অযোধ্যাও। পাকিস্তান আমলেই একবার মন্দির থেকে শিবের বিগ্রহ চুরি যাওয়ায় ভক্তরা খুবই অসহায় বোধ করেছিলেন। অবিশ্বাসীরা তখন শিবের ‘ক্ষমতা’ নিয়ে বিদ্রূপ করতেও দ্বিধা করেননি! মন্দিরটি কিছুটা জীর্ণ দশা প্রাপ্ত হলেও এখনো শিবরাত্রি পালনের জন্য বিপুলসংখ্যক হিন্দু নারী ওই মন্দিরে সমবেত হন। ব্রত পালন করেন।

কারকুন বাড়ির সামনের পুকুর বা দিঘিটি কত বছর আগে খনন করা হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য জানা না গেলেও বোদার প্রবীণ লোকদের ধারণা, কমপক্ষে দুই শ বছর আগে পুকুরটি খনন করা হয়ে থাকতে পারে। প্রায় ১৮ বিঘা জমির ওপর ওই বিশাল পুকুরটি একসময় হয়তো শুধু কারকুন বাড়ি নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদেরও দৈনন্দিন জলের সমস্যা মেটাত। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, পুকুরের পাড়জুড়ে কত গাছগাছালি। পুকুরে তখনো ছিল গভীর জল। পুকুরজুড়ে শাপলা ও পদ্ম যখন ফুটত, তখন চমৎকার লাগত দেখতে।

নানা গল্প চালু আছে এই পুকুর নিয়ে। একসময় নাকি মানুষের পূজা-পার্বণ কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানাদির জন্য থালা-বাসন দরকার হলে ওই পুকুরপাড়ে চাহিদাপত্র দিলে পুকুরই তা সরবরাহ করত। মানুষ প্রয়োজন শেষে সেগুলো আবার পুকুরে দিয়ে আসত। আমরা অবশ্য এমন মানুষের সন্ধান পাইনি, যে বা যারা পুকুর থেকে বাসনকোসন নিয়ে প্রয়োজন মিটিয়েছেন! মানুষ এসব ‘গল্প’ একটা সময় পর্যন্ত বিশ্বাস করত বলেই এগুলো চালু ছিল। এখন বিশ্বাস করে না বলেই শোনা যায় না। কথায় আছে: বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহু দূর।

আচ্ছা, শুধু বিশ্বাসের ওপর ভর করে কি সত্যি কিছু অর্জন করা যায়? আমরা কিছু হলেই ‘দোয়া’ ‘প্রার্থনা’ করি। দোয়া কি কাউকে রোগ বা বিপদমুক্ত করতে পারে? জানি না। তবে দোয়ার সঙ্গে ‘দাওয়া’ বলেও একটা কথা আছে। দোয়ার গুণের চেয়ে দাওয়ার গুণ টের পাওয়া যায় বেশি।

কারকুন বাড়িতে আম-কাঁঠালের অনেক গাছ ছিল। ঝড়ের দিনে শুধু মামার বাড়ি আম কুড়াতে সুখ ছিল না, কারকুন বাড়িতেও সে সুখ ছিল। কারকুন বাড়ির ব্যাপার ছিল আরও আলাদা। গাছেরটা খাওয়া এবং তলারটা কুড়ানো—দুটোই চলত। অর্থাৎ, যেগুলো গাছ থেকে ঝরে পড়ত সেগুলো যেমন যে কেউ নিতে পারত, তেমনি গাছের পাকা ফলও চাইলেই পাওয়া যেত। কারকুন বাড়ি থেকে পাকা আম-কাঁঠালের বোঝা আমিও বহন করেছি।

আমাদের ছোটবেলার সময়টা ছিল অন্য রকম। বাড়ি, পরিবার, গ্রামগুলো কেমন সুন্দর মমতায় জড়ানো ছিল। মানুষের মনে এবং চোখে অন্ধকার ছিল। অর্থাৎ, শিক্ষিতের হার কম ছিল, আবার বিদ্যুৎও ছিল না। চোখের অন্ধকার দূর করত কেরোসিনের বাতি। কিন্তু মনের অন্ধকার? সেটা ছিল বলেই মানুষ অলৌকিকতায় বিশ্বাস করত। জিন-ভূতের গল্প বেশি শোনা যেত। এই পথে সন্ধ্যায় যাওয়া যাবে না—ভূতের ভয় আছে, এই পুকুরের এই ক্ষমতা আছে—এসব মানুষ অবলীলায় বিশ্বাস করত।

এখন মানুষের মন এবং চোখ দুটোতেই আলো। কিন্তু কোনো কোনো মানুষকে পেয়ে বসছে এক নতুন ধরনের অন্ধত্ব, যার নাম ধর্মান্ধতা। আমাদের সেইকালে ধর্মবিশ্বাস ছিল, ধর্মান্ধতা ছিল কম। সে জন্য চমৎকার সম্প্রীতির পরিবেশ ছিল। কারকুন বাড়ি ছিল সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের এক মিলনক্ষেত্র।

কারকুনবাড়ির অনেক কিছুই আজ আর নেই। জীবন কারকুন এবং অচিন্ত্য কারকুন—দুই ভাই দিদি শর্বাণীকে নিয়ে আছেন। শর্বাণীদির বিয়ে হয়নি। কিন্তু জীবন-অচিন্ত্য বিয়ে করেছে। জীবনের এক পুত্র সন্তান, অচিন্ত্যর তিন মেয়ে। ওরা নিশ্চয়ই এখন এক হাঁড়িতে খায় না। কত দিন ওই বাড়িতে যাই না। বছর তিনেক আগে বোদা গিয়ে বন্ধু বিজন দত্তকে নিয়ে কারকুন বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে এসেছি। কিন্তু ভেতরে ঢুকিনি। একসময়ের প্রাণময় বাড়িটি কেমন নিষ্প্রাণ মনে হলো। জীবন সম্ভবত আগের ভিটায় আছে। অচিন্ত্য সামনের দিকে নতুন পাকা বাড়ি বানিয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অচিন্ত্য ছিল আমার প্রয়াত ছোট ভাই নিরঞ্জনের ক্লাসফ্রেন্ড। ওরা খুব ভালো বন্ধু ছিল।

আগে বাড়িতে গেলে শোনা যেতো প্রাণের স্পন্দন, এখন মনে হয় ঘুমঘোর।

ভেতরের লম্বা ঘরটি, যেটার বিভিন্ন কক্ষে মাসিমা এবং দিদিরা থাকতেন, সেটাও সেভাবেই আছে, নাকি সেখানেও নতুন ঘর উঠেছে, জানি না। বাইরের পরিবর্তন দেখে মনে হয়েছে, ভেতরেও নিশ্চয়ই অনেক অদলবদল হয়েছে।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো, সেই নানা গল্পগাথার পুকুরটি আর আগের মতো নেই। যে পুকুর খননের সময় পানি না ওঠায় নাকি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নরবলি দিতে হয়েছিল, যে পুকুরের মাঝখানে নাকি ছিল একটি রহস্যময় বড় সিন্দুক জাতীয় কিছু, সেই পুকুরের ওপর দিয়ে এখন হয়েছে মহাসড়ক। পুকুরটি দুই ভাগ হয়েছে, ছোট হয়েছে। আগে পুকুরপাড়ে গেলে কখনো কখনো যেমন গা ছমছম করত, এখন আর তা করে না। অসংখ্য মানুষের যাতায়াত, যোগাযোগ সহজতর করার জন্য একটি পরিবারের ঐতিহ্য, স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করা হয়েছে। এটাই বোধ হয় আধুনিক সভ্যতার নিয়ম। পুরাতনকে আঁকড়ে থাকা নয়, নতুনকে আবাহন করাই যেন প্রগতি ও অগ্রগতির লক্ষণ।

কারকুন বাড়ির বড় ছেলে অনুপ কারকুন, আমাদের দুলালদা, যিনি ছোট-বড় সবার কাছেই একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন, সবাইকে ছেড়ে শেষ বিদায় নেন ১৯৮১ সালে। প্রায় দশ বছরের ব্যবধানে পিতা ও পুত্রের মৃত্যু কারকুন বাড়িতে ভাঙনের যে সুর বাজিয়েছিল, তা কিছুটা দূর হয়েছে ছোট দুই কারকুন বিয়ে করে সংসার শুরুর পর।

পিসিমা, ঊষারানী কারকুন বেঁচে থাকতে ওই বাড়িতে আগের ধারা, মানুষের যাতায়াত, আহার-বিহার অব্যাহত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর সে রকম আছে কি-না, জানি না। পিসির মৃত্যু হয়েছে ২০০৪ সালে। কী আশ্চর্যের ব্যাপার যে, তাঁর বিদায়ের দিনেও আমি বোদায় ছিলাম এবং বিজনকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম।

কারকুন বাড়ির দুই উত্তরাধিকার জীবন ও অচিন্ত্য ওদের ছেলেমেয়ে নিয়ে আর আগের অবস্থায় যেতে চায় কি-না, যেতে চাইলেও আর যেতে পারবে কি-না, জানি না। 

শর্বাণী কারকুন, আমাদের বাণীদি, কত দিন তাঁকে দেখি না। কত দিন তাঁর আপ্যায়নবঞ্চিত। কেমন আছেন বাণীদি? বয়স কি তাঁর সৌন্দর্য আড়াল করতে পেরেছে? এর পর বোদা গেলে বাণীদিকে অবশ্যই এক নজর দেখে আসব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যা করণীয়

সম্পাদকীয়
যা করণীয়

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন পর্যন্ত এতটাই সজীব যে, ইচ্ছে করলেই এই ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অতি সুকৌশলে এমন সব প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, যার উত্তর তারা নিজেরা জানলেও সে উত্তরকে আড়ালে রেখে নতুন বয়ান তৈরির ধূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর, আলশামসের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই কাজটি মূলত তারাই করতে চাইছে, যারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি এখনো হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বাংলাদেশের সূত্রের কাছে না গেলেও চলবে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এবং সে সময়ের ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠা রাও ফরমান আলী তাদের বইগুলোয় একে অপরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। নিয়াজির অফিসের সামনে রাও ফরমান আলী দেখেছেন কাদালেপা মাইক্রোবাস, রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। কেউ কেউ রাও ফরমান আলীকে অনুরোধ করে সেই তালিকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম কাটিয়েছেন বলেও প্রমাণ আছে। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশেরই শিক্ষিত কোনো মানুষ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না বলে মত প্রকাশ করলে তা সত্যের অপলাপই হয়। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ন্যক্কারজনক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।

বাংলা ও বাঙালির বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। দেশের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, সে-ই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস রচনা করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়, ইতিহাসের সত্যগুলো প্রকাশিত হবেই। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে আসা স্বাধীনতার সময়টিতে কার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কার ওপর দেশবাসী রেখেছিল আস্থা, পাকিস্তানিদের চালানো অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা পাওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাঙালির এই জনযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর মহিমাকীর্তন কোনো ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে পারবে না। সব পক্ষের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে আড়াল না করে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা।

আমাদের দেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। এই সময়টিতে পুরো জাতির ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এত বেশি বিভক্ত হয়ে রয়েছে যে তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় সব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আসবে—এমন আশা এখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে না। ন্যূনতম কিছু বিষয়ে একমত হতে হলে জাতিকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। সেদিকেই হতে হবে দেশের যাত্রা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

রাজিউল হাসান
কেরালার তিরুবনন্তপুরাম পৌরসভার নির্বাচনের ফলাফল বড় একটি বার্তা দিয়েছে বামদের। ছবি: সংগৃহীত
কেরালার তিরুবনন্তপুরাম পৌরসভার নির্বাচনের ফলাফল বড় একটি বার্তা দিয়েছে বামদের। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের মালয়ালমভাষী উপকূলীয় রাজ্য কেরালা জনসংখ্যার বিচারে দেশটির ১৪তম বৃহৎ রাজ্য। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে এই রাজ্যের একটি বড় পার্থক্য হলো, এখানে বাম মতাদর্শের প্রভাব বেশি। কংগ্রেসেরও আধিপত্য রয়েছে। সে তুলনায় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রভাব কিছুদিন আগেও বেশ কম ছিল।

বহু বছর ধরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই-মার্ক্সবাদী) নেতৃত্বে বাম মতাদর্শের জোট লেফট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এলডিএফ) আর কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) ভাগাভাগি করে কেরালা শাসন করছে। কিন্তু সে দুর্ভেদ্য রাজ্যে এবার বিজেপি চমক দেখিয়েছে। ৯ ডিসেম্বর কেরালার তিরুবনন্তপুরাম পৌরসভায় ভোট হয়েছে। এখানকার ১০১টি আসনের মধ্যে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট জিতেছে ৫০টিতে। আগের পর্ষদের চেয়ে এবার এই জোট ১৫টি বেশি আসন দখলে নিয়েছে। এলডিএফ বিজয়ী হয়েছে ২৯টি আসনে। আগেরবারের তুলনায় এবার তাদের আসন কমেছে ২৩টি। ইউডিএফ জিতেছে ১৯টি আসনে। আগেরবারের চেয়ে এবার তাদের ঝুলিতে আসন বেড়েছে ৯টি। দুটি আসনে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

ভূখণ্ডের আয়তনের বিচারে ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ। আর জনসংখ্যার বিচারে দেশটি এখন বিশ্বের শীর্ষে। ২৮টি রাজ্য আর ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের এমন বড় একটি দেশের একটি রাজ্যের একটি পৌরসভায় বিজেপির এমন বিজয় হয়তো সাদা চোখে খুব বড় কোনো সাফল্য নয়। তবে এ কথা একেবারে অনস্বীকার্য যে বামদের দুর্গে এবার খুব ছোট করে হলেও বিজেপির পদ্মফুল ফুটেছে। এ বিজয় বিজেপির জন্য যেমন উদ্‌যাপনের একটি মুহূর্ত নিয়ে এসেছে, একই সঙ্গে দেশটির অন্যান্য রাজনৈতিক দলের জন্যও নতুন করে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের উপলক্ষ তৈরি করেছে।

ভারতের ২৮টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে এখন ২৪টিই বিজেপি ও তার জোটের দখলে। এগুলো হলো অন্ধ্র প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, বিহার, ছত্তিশগড়, দিল্লি, গোয়া, গুজরাট, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মণিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ওডিশা, পদুচেরি, রাজস্থান, সিকিম, ত্রিপুরা, উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখন্ড। কংগ্রেস, তার মিত্র ও কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের শাসন চলছে সাতটি রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। পাঞ্জাবে চলছে আম আদমি পার্টির এবং মিজোরামে চলছে জোরাম পিপলস মুভমেন্ট (জেডপিএম) পার্টির শাসন। পশ্চিমবঙ্গ অনেক বছর ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস শাসন করছে।

অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি জোট যখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় আসে, তখনো দলটির এতটা বিস্তার ছিল না। দিনে দিনে দেশজুড়ে তাদের প্রভাব বেড়েছে, নিয়ন্ত্রণে এসেছে নতুন নতুন এলাকা। সে হিসাবে হয়তো বামদের দুর্গে বিজেপির ছোট্ট হানা স্বাভাবিক মনে হবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গসহ আরও যেসব রাজ্য বিজেপির নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে, সেসব রাজ্যের শাসক দলের জন্য এটি একটি অশনিসংকেত। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য কেরালার তিরুবনন্তপুরাম পৌর নির্বাচন আশু দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। কারণ, আর কয়েক মাস পরই এই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন।

যে কেরালা নিয়ে আজকের আলোচনা, সেখানেও আগামী এপ্রিলে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সে হিসাবে তিরুবনন্তপুরামের নির্বাচনের ফলাফল বড় একটি বার্তা দিয়েছে বামদের। এ নির্বাচনে এলডিএফ বড় মার খেয়েছে। ১০১ আসনের এই পৌর কাউন্সিলে ৫১ আসনে জিতলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়। বিজেপি মাত্র এক আসন কম পেয়েছে। এলডিএফ হারিয়েছে ২৩ আসন। অবশ্য কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ পৌরসভা ও পঞ্চায়েতগুলোয় বেশ ভালো করেছে।

কেরালায় হয়তো আজও এলডিএফ এবং ইউডিএফ জোটই বড় রাজনৈতিক খেলোয়াড়। তবে বিজেপিও যে আর তুচ্ছ নয়, তা তিরুবনন্তপুরামের ফলাফল বুঝিয়ে দিয়েছে। রাজ্যটি এলডিএফ এবং ইউডিএফ ভাগাভাগি করে শাসন করলেও তিরুবনন্তপুরাম ৪৫ বছর ধরে রেখেছিল বামেরাই। সেই দুর্গ এবার ছিনিয়ে নিয়েছে বিজেপি। শুধু তিরুবনন্তপুরামই নয়, কেরালার পালাক্কাড় পৌরসভা এবং ত্রিপুনিথুরা পৌরসভাও এখন বিজেপির দখলে।

কেরালায় আগের বিধানসভা নির্বাচনে ১৪০ আসনের মধ্যে ৯৯টিই দখলে নিয়েছিল এলডিএফ। বাকি ৪১টি আসন পেয়েছিল ইউডিএফ। তিরুবনন্তপুরামের নির্বাচন বলে দিচ্ছে, এবার ফলাফলটা এমন হবে না। এলডিএফ জোট ২০১৬ সাল থেকে টানা এ রাজ্যের ক্ষমতায়।

রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, কেরালার পঞ্চায়েতগুলোর মধ্যে দেড় হাজারের মতো ওয়ার্ড এখন বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের দখলে। তিরুবনন্তপুরামে জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য ছিল, ‘চোখে জল আনার মতো মুহূর্ত এটি।’

বিজেপির নেতাদের দাবি, কেরালায় ভবিষ্যতে বিজেপির অবস্থান আরও পোক্ত হবে এবং একসময় এখানে ইউডিএফ ও কংগ্রেসের ভোটাররা বিজেপিকেই সমর্থন করবেন। তাঁরা এ জন্য আগেভাগেই বিজেপির কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে রেখেছেন।

কংগ্রেস নেতা শশী থারুরও তিরুবনন্তপুরামের নির্বাচনের ফলাফলের পর স্বীকার করেছেন, কেরালায় ভোটারদের পছন্দে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে।

অবশ্য তিরুবনন্তপুরামে কিন্তু রাতারাতি বিজেপি এমন বিজয় অর্জন করেনি। বরং ১৫ বছর ধরে রাজনৈতিক ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা ধীরে ধীরে অগ্রগতি অর্জন করেছে। শুধু কেরালায়ই নয়, অন্যান্য রাজ্যেও বিজেপির পদ্মফুল ফুটেছে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়। আমরা শুধু জানি, বিজেপি ধর্মকে সামনে রেখে রাজনীতি করে চলেছে। সেটা হয়তো ঠিক। কিন্তু এই ইস্যুটি ছাড়াও বিজেপির রাজনৈতিক কৌশলের ঝুলিতে আরও অনেক কিছু আছে। বিজেপির সবচেয়ে বড় সুবিধাটা হলো, তারা যে রাজ্যের জন্য যে কৌশল প্রয়োজন, ঠিক সেটাই প্রয়োগ করছে। যেমন কেরালায় বামদের হটাতে তারা যে কৌশল প্রয়োগ করছে, আসাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিন্তু সেই একই কৌশলে তারা হাঁটছে না। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোয় বিজেপিতে আস্থা বাড়াতে যে পথে হাঁটছে তারা, দেশের মধ্যাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় সে পথে তারা নেই। কাশ্মীরে তাদের যে কৌশল, তামিলনাড়ুতে গিয়ে দেখা যাবে, ঠিক তার বিপরীত কৌশল বিজেপির। এবং এই যে রাজ্যভেদে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল, সেটা নির্ধারণ করা হচ্ছে একেবারে শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে। এই শীর্ষ নেতৃত্ব কিন্তু একজনের হাতে কুক্ষিগত নয়, বরং একদল বর্ষীয়ান-অভিজ্ঞ রাজনীতিক একসঙ্গে গড়ে তুলেছেন সে নেতৃত্ব।

ঠিক এই জায়গায় কংগ্রেস কিংবা অন্য দলগুলোর সঙ্গে বিজেপির ফারাক। কংগ্রেসের কথাই ধরা যাক। দলটি এখনো গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। পারিবারিক নেতৃত্ব থেকে দলটি বের হতে না পারার খেসারত দিচ্ছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। এ ছাড়া ভারতের বেশির ভাগ দলেও পরিবারতন্ত্র বেশ বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছে। আর ঠিক এ সুযোগেই বিজেপি ভারতজুড়ে ধীরে ধীরে পদ্মফুল ফুটিয়ে চলেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

রাফায়েল আহমেদ শামীম
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০: ৫২
ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্ব অস্বীকার বিশ্বকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করছে। ছবি: এএফপি
ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্ব অস্বীকার বিশ্বকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করছে। ছবি: এএফপি

ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের সাম্প্রতিক মন্তব্য কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির জন্য নয়, বরং পুরো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকাঠামোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, যদি জাতিসংঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগোতে থাকে; তবে ফিলিস্তিনি নেতাদের বেছে বেছে হত্যা করা উচিত। এটি কোনো উগ্রমনা ব্যক্তির অযৌক্তিক মন্তব্য নয়, এটি একজন রাষ্ট্রীয় মন্ত্রীর মুখ থেকে আসা রাজনৈতিক নির্দেশ, যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের জন্য এক চরম হুমকি।

এই মন্তব্যের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে রুখে দেওয়ার জন্য সুগঠিত নীতি অনুসরণ করছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতাদের দমন, ভূখণ্ড দখল, বসতি সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অবজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভোটে গাজা উপত্যকার স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক শান্তিবাহিনী গঠনের প্রস্তাব, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কার কার্যক্রম এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠনের সহায়তা ইসরায়েলকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। ফিলিস্তিনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মানে তাদের রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা, যা পশ্চিম তীরের দখলনীতি ও বসতি সম্প্রসারণকে আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এই ভীতিই বেন-গভিরের মতো উগ্র নেতাদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিতে প্রলুব্ধ করছে।

বেন-গভিরের বক্তব্যে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে অস্তিত্বহীন বলা, তাদের অন্য আরব দেশ থেকে আগত অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং সন্ত্রাসমূলক আখ্যায়িত করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও জাতিগত স্বীকৃতির নীতির পরিপন্থী। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে কোনো জাতিকে অবৈধ বা অস্তিত্বহীন হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে তার ওপর সহিংসতা প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন রুয়ান্ডার তুতসিদের ক্ষেত্রে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর এবং নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে। তাই এই ধরনের বক্তব্য কেবল হুমকি নয়, বরং বাস্তবায়নের প্রস্তুতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় নির্দেশনার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। তবে এই সহযোগিতাও ইসরায়েলের কাছে রাষ্ট্র স্বীকৃতির জন্য যথেষ্ট নয়। নেতানিয়াহু সরকারের ডানপন্থী জোটের নেতারা একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অর্থমন্ত্রী বেনজালেল স্মোট্রিচ পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের ভূখণ্ডের সঙ্গে একত্র করার চেষ্টা করছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন, যাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি না দেওয়া হয়। এই কৌশল দেখাচ্ছে, ইসরায়েলের নীতি কেবল নিরাপত্তার কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি নীরব থাকে, তবে এটি আন্তর্জাতিক আইনের জন্য একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে। যে রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে হত্যার হুমকি দিতে পারে, তাকে আইনি ও নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ করার কোনো কার্যকর ক্ষমতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেই, এটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।

ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের জন্য আলাদা কারাগারের কক্ষ প্রস্তুত রাখার কথাও ইসরায়েলি সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এটি শুধু হুমকি নয়, বরং সম্ভাব্য বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনার ইঙ্গিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে ইসরায়েল তার কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য চরম হুমকি ও সহিংসতা ব্যবহারে প্রস্তুত।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গাজা পুনর্গঠন, পিএর সংস্কার কার্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক শান্তিবাহিনী—সবই ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র গঠনের পথকে সহায়তা করছে। এই প্রক্রিয়ায় ইসরায়েল উদ্বিগ্ন, কারণ এটি তাদের একতরফা দখল নীতি ও বসতি সম্প্রসারণকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বেন-গভিরের মন্তব্য কেবল হুমকি নয়, বরং এই প্রক্রিয়ার প্রতি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

ইসরায়েলি নেতাদের উগ্র প্রতিক্রিয়ার কারণ হলো, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তাদের দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও নিরাপত্তাকাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা এটিকে ‘রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একবার জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে, পশ্চিম তীরের দখল, জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ এবং গাজার ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এই পরিস্থিতিই বেন-গভিরকে হত্যার হুমকি দিতে প্রলুব্ধ করেছে।

আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বেন-গভিরের বক্তব্য স্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যকর পদক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা কার্যকর হচ্ছে না। ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্র যখন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মিত্র শক্তির আশ্রয়ে থাকে, তখন আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে জাতিসংঘের মতো সংস্থা কার্যকর হুমকি প্রতিরোধ করতে পারছে না। ফিলিস্তিনের জনগণ এই হুমকির প্রভাবে ভয় ও অনিশ্চয়তায় দগ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না, তাতে ইসরায়েল আরও বেপরোয়া হচ্ছে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রীয় হুমকি এবং নীরব আন্তর্জাতিক সমাজ মিলিত হলে অত্যাচারী নীতি বাস্তবায়িত হয়। রুয়ান্ডা, মিয়ানমার, ইউক্রেন—সবই এই প্যাটার্নের উদাহরণ। তাই ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো সুরক্ষিত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় হস্তক্ষেপ অপরিহার্য।

ইসরায়েলি রাজনীতির উগ্রতা, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সীমিত প্রতিক্রিয়া মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন এক সংকট তৈরি করেছে, যেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা ধ্বংসের মুখে। এই অবস্থা শুধু ফিলিস্তিনের জন্য বিপজ্জনক নয়; এটি পুরো মধ্যপ্রাচ্য, কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক আইনকে চ্যালেঞ্জ করছে। রাষ্ট্রীয় হত্যার হুমকি, ফিলিস্তিনের জনগণের অস্তিত্ব অস্বীকৃতি এবং জাতিসংঘকে হুমকি—সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পরীক্ষা করছে। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব থাকে, জাতিসংঘ কার্যকর পদক্ষেপ না নিক, তবে ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্ররা জানবে যে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এতে ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্রহীন হবে, তাদের নেতৃত্ব দুর্বল হবে এবং আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের ধারণা অন্ধকারে ঢাকা পড়বে। এই সংকট কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বৈশ্বিক নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের কাঠামোর জন্য বড় পরীক্ষা।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি কেবল ভূরাজনৈতিক নয়; এটি নৈতিক, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ না করে, পরিস্থিতি আরও সংকীর্ণ ও বিপজ্জনক হবে। রাষ্ট্রীয় হত্যার হুমকি, জাতিসংঘের ওপর চাপ, ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব অস্বীকার—সব মিলিয়ে বিশ্বকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করছে। এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। নইলে শুধু ফিলিস্তিন নয়, বৈশ্বিক নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের ভিত্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সর্বোপরি ইসরায়েলের এই হুমকি শুধু একটি উগ্রমনা নেতার বক্তৃতা নয়; এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তির অমোঘ প্রভাবের উদাহরণ। এটি রাষ্ট্রীয় নীতি, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের কার্যকারিতা পুনর্মূল্যায়নের তাগিদ দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রাধান্য কি তারা নিশ্চিত করবে, নাকি শক্তিশালী রাষ্ট্রের উসকানি ও হত্যার হুমকি নিয়ে নীরব থাকবে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার
সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তন আর শুধুই পরিবেশ সংরক্ষণ বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার সীমিত পরিসরে আবদ্ধ কোনো ইস্যু নয়; বরং এটি ক্রমেই একটি কাঠামোগত বৈশ্বিক সংকটে রূপান্তরিত হয়েছে, যার প্রভাব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, সীমান্ত নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রচলিত নীতিমালার ওপর সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে। শিল্পায়ন-উত্তর বিশ্বব্যবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নিঃসরণ ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন আজ এমন এক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে, যা আধুনিক রাষ্ট্রের অস্তিত্বগত ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

বিশেষত, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে সমুদ্রস্তরের ক্রমবর্ধমান উত্থান বিশ্বের বহু নিম্নভূমি ও দ্বীপরাষ্ট্রের জন্য এক গভীর অস্তিত্ববাদী সংকটের জন্ম দিয়েছে। উপকূলীয় ক্ষয়, লবণাক্ততার বিস্তার, পানযোগ্য পানির ঘাটতি এবং ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস—এই সম্মিলিত প্রভাব দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জনবসতি, কৃষি উৎপাদনব্যবস্থা ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করছে। এর ফলে নিরাপত্তা-ধারণা আর শুধু সামরিক সক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং খাদ্যনিরাপত্তা, মানবনিরাপত্তা এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য উপাদানে পরিণত হচ্ছে।

মালদ্বীপ, কিরিবাতি, টুভালু, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ কিংবা বঙ্গোপসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলের মতো অঞ্চলগুলোতে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে ভূমি হারানোর আশঙ্কা নিছক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বিবেচ্য নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা, নাগরিকত্বের ধারাবাহিকতা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মতো মৌলিক রাষ্ট্রীয় প্রশ্ন উত্থাপন করছে। কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ড যদি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়, তবে সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, তার সমুদ্রসীমা, এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) এবং সামুদ্রিক সম্পদের ওপর অধিকার কীভাবে সংরক্ষিত থাকবে—এই প্রশ্নগুলোর সুস্পষ্ট উত্তর আন্তর্জাতিক আইনের বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে এখনো অনুপস্থিত।

পরিবেশগত সংকট থেকে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেলের বিভিন্ন মূল্যায়ন প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হয়েছে যে গত এক শতাব্দীতে বৈশ্বিক সমুদ্রস্তর উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও ত্বরান্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বরফগলন, তাপীয় সম্প্রসারণ এবং চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনাবলির ফলে উপকূলীয় ক্ষয় ও লবণাক্ততার বিস্তার দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর কৃষি, পানীয় জল এবং মানববসতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর পরিণতিতে কিছু রাষ্ট্র কার্যত ‘ডুবে যাওয়া রাষ্ট্র’তে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।

দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব সংকট

রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান—ভূখণ্ড, জনসংখ্যা, সরকার ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি—এর মধ্যে ভূখণ্ড যদি স্থায়ীভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের আইনগত অস্তিত্ব ও মর্যাদা কীভাবে নির্ধারিত হবে—এই প্রশ্ন আন্তর্জাতিক আইনের জন্য এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ। সমুদ্রস্তরের উত্থানের ফলে দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর স্থায়ী ভূখণ্ড সংকুচিত হলে তাদের সামুদ্রিক সীমানা, বিশেষত ইইজেড ও সামুদ্রিক সম্পদের অধিকার নিয়ে নতুন ধরনের আইনি ও ভূরাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সীমান্ত ও সম্পদকেন্দ্রিক বিরোধ এবং শক্তির পুনর্বিন্যাস অনিবার্য হয়ে ওঠে।

জলবায়ু শরণার্থী

সমুদ্রস্তরের উচ্চতার অন্যতম গভীর মানবিক পরিণতি হলো জলবায়ু শরণার্থী সংকটের উদ্ভব। দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠী যখন নিজ ভূমিতে বসবাসের সক্ষমতা হারায়, তখন তারা অভ্যন্তরীণ অথবা আন্তর্জাতিক অভিবাসনে বাধ্য হয়। তবে আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনে ‘জলবায়ু শরণার্থী’ নামে কোনো স্বীকৃত শ্রেণি না থাকায় এসব বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী আইনি সুরক্ষা, নাগরিক অধিকার ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে একধরনের আইনগত শূন্যতার মুখোমুখি হয়।

এই বাস্তুচ্যুতি শুধু মানবিক সংকটেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এটি গন্তব্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য সামাজিক চাপ, অর্থনৈতিক বোঝা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাঝুঁকিরও সৃষ্টি করে। দক্ষিণ এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকার উপকূলীয় দেশগুলোতে এর ভূরাজনৈতিক অভিঘাত ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতা

জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় জোট জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নীতিকাঠামো ও অর্থনৈতিক তহবিল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও, দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব সংকট মোকাবিলায় এখনো কোনো বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক আইনগত ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর ঐতিহাসিক কার্বন নিঃসরণের দায় স্বীকার এবং ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোর ন্যায্য ক্ষতিপূরণের দাবির মধ্যে দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে প্রায়ই অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে কিছু দ্বীপরাষ্ট্র বিকল্প কূটনৈতিক কৌশল অনুসরণ করছে—যেমন ডিজিটাল সার্বভৌমত্বের ধারণা, বিদেশে ভূমি ক্রয়, কিংবা ‘রাষ্ট্র নির্বাসনে’ থাকার তাত্ত্বিক প্রস্তাব। এসব উদ্যোগ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাকে নতুনভাবে পুনর্বিবেচনার সুযোগ সৃষ্টি করছে।

ভবিষ্যৎ ভূরাজনৈতিক অভিঘাত

সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি বিশ্বরাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য পুনর্গঠনের সম্ভাবনা বহন করে। সামুদ্রিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, নৌপথের নিরাপত্তা, সামরিক ঘাঁটির কৌশলগত অবস্থান এবং মানবিক হস্তক্ষেপ—সব ক্ষেত্রেই জলবায়ু পরিবর্তন এক নীরব কিন্তু গভীর ভূরাজনৈতিক চালিকাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ ও কূটনীতির প্রচলিত ধারণার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘জলবায়ু নিরাপত্তা’ নামক নতুন এক কৌশলগত বাস্তবতা।

কাজেই, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জন্য নিছক পরিবেশগত দুর্যোগ নয়; এটি তাদের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব, নিরাপত্তাকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মৌলিক ভিত্তিকে গভীরভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। জলবায়ু শরণার্থী সংকট এবং সমুদ্রসীমা ঘিরে উদ্ভূত বিরোধ ভবিষ্যৎ ভূরাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য অধ্যায়ে পরিণত হবে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব সহানুভূতিশীল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কার্যকর ও বাধ্যতামূলক আইনগত কাঠামো, ন্যায্য কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং দায়বদ্ধ বৈশ্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার দ্বীপরাষ্ট্রগুলো ইতিহাসের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে না গিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের পূর্ণ মর্যাদাসম্পন্ন অংশ হিসেবে টিকে থাকতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত