Ajker Patrika

ব্যাটারিচালিত রিকশা: সংকট ও সমাধান

আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১৫: ৫৬
হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকায় অটোরিকশা বন্ধ করায় চালকেরা বিক্ষোভ করছেন। ছবি: আজকের পত্রিকা
হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকায় অটোরিকশা বন্ধ করায় চালকেরা বিক্ষোভ করছেন। ছবি: আজকের পত্রিকা

বাংলাদেশে পরিবহন ক্ষেত্রে ব্যাটারিচালিত রিকশা স্বল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য একটি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী মাধ্যম হলেও বিভিন্ন যুক্তিসংগত কারণে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা একটি বড় সমস্যার রূপ নিয়েছে। অবৈধভাবে উৎপাদন, ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনগত অনিয়ম এবং এর ফলে সৃষ্ট দুর্ঘটনা ও যানজট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তিন দিনের মধ্যে অটোরিকশা বন্ধের প্রস্তাবে চালকদের রাস্তায় নেমে আসা এবং শহর কার্যত অচল হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ অবরোধে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়।

ব্যাটারিচালিত রিকশা সাধারণ মানুষের জন্য অপেক্ষাকৃত কম খরচে যাতায়াতের মাধ্যম ছাড়াও কয়েক লাখ মানুষ এ খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত হয়ে পড়েছেন। চালক, মেরামতকারী এবং যন্ত্রাংশ সরবরাহকারীদের জীবিকার একটি বড় উৎস এটি।

বাংলাদেশের অনেক শহরে অলিগলিতে বড় যানবাহনের প্রবেশ সম্ভব নয়। এই রিকশা সেখানে কার্যকর এবং জরুরি পরিবহন সেবা দেয়।

অটোরিকশার কারণে সৃষ্ট সংকট

  • কম মানের ব্যাটারি চার্জ করতে প্রচুর বিদ্যুৎ অপচয় হয়। গ্রামীণ বা লোডশেডিং-প্রবণ এলাকাগুলোতে এটি বিদ্যুৎ সংকট বাড়িয়ে তোলে।
  • লেড-অ্যাসিড ব্যাটারির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার পরিবেশে গুরুতর দূষণ ঘটাচ্ছে।
  • নির্দিষ্ট নীতিমালা বা লাইসেন্সিং না থাকায় রিকশার সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
  • অনেক চালক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়াই রিকশা চালাচ্ছেন। ফলে পথচারী ও যাত্রীদের নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে।
  • এই বাহনের কারণে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বেড়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনাটি একটি দুঃখজনক উদাহরণ।
  • সরকার ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের যে পরিকল্পনা করছে, তা শুধু পরিবেশগত ও অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধান নয়; বরং এটি আর্থসামাজিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
  • রিকশা নিষিদ্ধ হলে লক্ষাধিক চালক তাঁদের জীবিকা হারাবেন। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
  • সাধারণ যাত্রীরা কম খরচে যাতায়াতের একটি সহজ মাধ্যম হারাবেন।
  • পরিবহনের কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নতুন সমস্যা তৈরি করবে।

ব্যাটারিচালিত রিকশার সমস্যা সমাধানে নিষেধাজ্ঞা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এর পরিবর্তে পরিকল্পিত ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে:

  • প্রতিটি রিকশার নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা।
  • রিকশার সংখ্যা নির্ধারণ এবং নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।
  • রিকশার সর্বোচ্চ গতি ১৫-২০ কিমি/ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ করা।
  • উন্নত মানের ব্যাটারি, যেমন লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
  • সোলার চার্জিং স্টেশন স্থাপন করে বিদ্যুৎ খরচ কমানোর ব্যবস্থা করা।
  • ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করার আগে চালকদের জন্য পুনঃপ্রশিক্ষণ এবং বিকল্পকাজের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া বা নতুন বিনিয়োগে সরকারি প্রণোদনা প্রদান করা।
  • চালকদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স প্রদান করতে হবে।
  • রাস্তায় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চালকদের ট্রাফিক নিয়ম সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
  • রিকশায় জিপিএস বা স্মার্ট ট্র্যাকিং ডিভাইস স্থাপন করা।
  • নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রিকশা চালানোর অনুমতি দেওয়া।
  • পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে এই যানবাহনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা।
  • ব্যাটারিচালিত রিকশাকে পরিবহনব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে গ্রহণ করে যথাযথ সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া।

চীন ও ভারতে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে। উন্নত মানের প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব ব্যাটারি এবং লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব যানবাহনকে শহুরে পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করা হয়েছে। বাংলাদেশেও এমন নীতিমালা প্রণয়ন করলে এই যানবাহন নিষিদ্ধ না করেই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।

ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ করা সমস্যার সহজ কিন্তু অস্থায়ী সমাধান হতে পারে। এটি লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা ও দেশের পরিবহনব্যবস্থায় বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সুতরাং, সরকারকে দায়িত্বশীল নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে নাগরিক জীবন ও পরিবেশ উভয়ই সুরক্ষিত থাকে।

একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রতি সংবেদনশীল থেকে সংকট মোকাবিলার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। একটি কার্যকর সিদ্ধান্ত কেবল বর্তমান সংকট নয়, বরং পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত