জাহীদ রেজা নূর
খোলা চোখে কয়েকটি বিষয় দেখা যাক।
আওয়ামী লীগ সরকার হয়ে উঠেছিল স্বৈরাচারী সরকার। সেই সরকারকে হটিয়ে দিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ছাত্ররা। সেই আন্দোলনে ঢুকে পড়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। একসময় প্রকাশ পেল, এই আন্দোলন আসলে অনেক ধরনের দলের সম্মিলিত কিংবা বিচ্ছিন্ন প্রয়াসের সমষ্টি।
তবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল একটি মুক্ত সমাজের, যে সমাজে বাক্স্বাধীনতা থাকবে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে, বিচার বিভাগ স্বাধীনতা ভোগ করবে, নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে না। সেই ব্রিটিশ আমল কিংবা তারও আগে থেকে চলতে থাকা আমাদের ‘উন্নয়নের সঙ্গী’ ঘুষ-দুর্নীতিও বিদায় নেবে। নিশ্চয়ই দেশের নাগরিকেরা আশা করেছিল, চাঁদাবাজি, দখলদারি বন্ধ হবে। সেই সংস্কারগুলো হবে দেশে, যে সংস্কারের ফলে জনমনে স্বস্তি ফিরে আসবে।
এ কথা যখন বলি, তখন মূলত শহুরে মানুষের দৃষ্টিতে ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে থাকি। রাজনৈতিক অঙ্গনের বৃহত্তর সংকটগুলো নিয়েই তখন আলোচনা হয়। আর সেই আলোচনায় দেশের মূল শক্তি কৃষকের কথা থাকে না। আমরা যখন পেঁয়াজের দাম ১২০ টাকা কেন হবে বলে প্রতিবাদে মুখর হই, তখন সরু পথে সিন্ডিকেটকে হাঁটতে দেখি, কিন্তু সেই সিন্ডিকেট কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, সেই প্রশ্নেরও জবাব পাই না। সিন্ডিকেট যখন ফুলে-ফেঁপে হাজার-কোটি টাকার মালিক বনে যায়, তখন কৃষককে কে বাঁচাবে, সেই আলোচনায় মন দিই না। তেমনি যখন একটি ফুলকপি বিক্রি করে ৫ টাকা আসে কৃষকের হাতে, তখনো চাষবাসের হিসাব-নিকাশ মেলানোর কোনো চেষ্টা আমাদের থাকে না। বড়জোর বলে থাকি, ফসলের উৎপাদন খরচ তো উঠবে। একবারও ভাবি না, উৎপাদন খরচ না হয় উঠল, কিন্তু এই যে কয়েকটা মাস চাষবাস করা হলো কিছুটা লাভের আশায়, সেই লাভের গুড় কে খেয়ে নিল, সেটা কি প্রাসঙ্গিক আলোচনা নয়?
এ কথা যখন বলি, তখন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের কথাও আমরা ভাবি না। অনির্বাচিত যে সরকার এখন দেশের শাসনক্ষমতায়, তারা যখন হঠাৎ করেই কর বাড়িয়ে দেয়, তখন তারা বুঝতেও পারে না, এটা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে নেই। জনগণ খারাপ আছে, সে কথা বুঝতে হলে কল্পনায় অবগাহন করতে হয় না। সাদা চোখেই তা দৃশ্যমান।
২. রাজনৈতিক সরকারের পতনের পর তড়িঘড়ি করে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হলো, তার গঠনপ্রক্রিয়া নিয়েও প্রধান উপদেষ্টা তাঁর কথা বলেছেন। তাতে মনে হয়েছে, যে নামগুলো এসেছে আলোচনায়, সেই নামগুলো থেকেই পরিচিতজনদের বেছে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই সরকার। বিদগ্ধজনদের অনেকেই বলেছেন, আন্দোলনের সঙ্গে এই সরকারের উপদেষ্টাদের বেশির ভাগেরই কোনো সম্পর্ক ছিল না। কোন কারণে তাঁদের উপদেষ্টা করা হলো, সেই প্রশ্ন কিন্তু উঠতে শুরু করেছে। এর যোগ্য উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করা হলেই তেড়ে আসত একদল মানুষ। ভয়ে অনেকেই কথা বলা থামিয়ে দিয়েছিল। বর্তমানে সবাই কথা বলতে পারছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত বছরের আগস্ট মাসের শুরুতে যাকে বলা হচ্ছিল স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, সেই আন্দোলনের স্টেকহোল্ডাররা কিন্তু বের হতে শুরু হলো অচিরেই। এবং একসময় মনে হলো এই আন্দোলনের মূল শক্তি বিএনপি, একসময় মনে হলো জামায়াতে ইসলামী, একসময় মনে হলো হিযবুত তাহরীর। এ রকম অসংখ্য রাজনৈতিক দল ঝোলটা নিজের দিকে টেনে নিতে শুরু করল। বামপন্থী ছাত্রসংগঠন বা রাজনৈতিক দলগুলোও ছিল মূল স্রোতে। কিন্তু তারা হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে গেছে। যাদের বেশি সরব দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে এমন দলও রয়েছে, যারা সরাসরি স্বাধীনতাযুদ্ধে ছিল বিরোধীপক্ষ। এমনকি সেই বিরুদ্ধতা কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলে হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য তারা এখন পর্যন্ত জাতির কাছে ক্ষমাও চায়নি। এখন তারা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, তারা এই জাতিকে কথায় কথায় অপমানিত করেছে। এই ভুল স্রোতটি হঠাৎ করে মূল স্রোতে এসে মিশল যেভাবে, তার কারণ খতিয়ে দেখতে গেলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে নিজেদের নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত ছিল এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল যে সাধারণ জনগণ আওয়ামী শাসন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বিশ্বাসের যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, সেই শূন্যতার পথ ধরেই স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষের উত্থান হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের ব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহ ছিল জনগণের। কিন্তু ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে এসে দেখা যাচ্ছে, আলোড়নের সময় যে উন্মত্ততাকে সমীহ করে মানুষ, স্থির সমুদ্রে তার কথা কেউই মনে রাখে না। স্থির সময়ে ভাবনার গভীরতার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ সাধনের প্রশ্নটিই বড় হয়ে ওঠে। আন্দোলনের সময় বাস্তবতাবর্জিত আহ্বানও মানুষের সমর্থন পায়। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে সে ডাককে বড়ই স্থূল বলে মনে হতে পারে।
৩. যে প্রশ্নগুলোর উত্তর এড়ানো যাবে না, তার একটি হলো আওয়ামী লীগকে অগ্রাহ্য করার নামে আমাদের রাষ্ট্রের প্রতীকগুলো নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করার ঘটনা। সবচেয়ে আতঙ্কের ব্যাপার হলো, ১৯৭১ সালকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। এই ভূখণ্ডের সবচেয়ে বড় অর্জন যে স্বাধীনতা, তাকে অবজ্ঞা করার মাধ্যমে এই আন্দোলনের স্পিরিটকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার পাঁয়তারা করল কারা, তাদের কি চিহ্নিত করা হয়েছে? কিংবা জানার চেষ্টা হয়েছে, তাদের শিকড় কতটা গভীরে আছে?
অনেকেই বহুদিন ধরে মনে রাখবেন, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংস্কারের প্রশ্নটি যখন অনেক বড় হয়ে উঠল, তখন একশ্রেণির মানুষ প্রশ্ন তুলেছিল আমাদের জাতীয় পতাকা, আমাদের জাতীয় সংগীত নিয়ে। ১৯৭৫ সালের নৃশংস পটপরিবর্তনের পরও পাকিস্তানপন্থীদের এ রকমই উল্লম্ফন দেখা গিয়েছিল। সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের স্বৈরাচারবিরোধী অবস্থান দৃঢ় হবে বলে যাঁরা মনে করতেন, তাঁদের কপালেও এখন পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। আন্দোলনের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে এত বেশি বিভেদ দেখা যাচ্ছে যে কে আসল কে নকল, তা চেনা দায় হয়ে পড়ছে।
রাজধানী ঢাকা থেকে কেউ যদি বের হয়ে পড়েন, তাহলে ছোটখাটো উপশহরগুলোতে কিন্তু এখনো পোস্টার, ফেস্টুন দেখবেন। তবে তা আগেরগুলো নয়। ক্ষমতা পরিবর্তনের পর আগে যে তিনটি মাথার ছবি ওপরে রেখে পোস্টার-ফেস্টুন করা হতো, এখন শুধু সেগুলো বদলেছে। নতুন তিনটি মাথা যুক্ত হয়েছে সেখানে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ প্রশ্ন তুলতে পারে, আদতে সংস্কারটা হচ্ছে কিসের?
৪. শুরুতেই যে কথা বলেছিলাম, তাতে ফিরে আসি। এই দেশে শহুরে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে গ্রামে টেকা যাচ্ছে না বলে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই কেবল মানুষ ভিটেমাটি ছাড়ে। তখন সর্বহারা মানুষ যেকোনোভাবে যেকোনো জায়গায় এসে টিকে থাকার চেষ্টা করে। গ্রামের মানুষকে গ্রামে আবদ্ধ করে রাখতে হবে—সে কথা বলছি না। কিন্তু গ্রামে বসবাসযোগ্য পরিবেশ তো সৃষ্টি করতে হবে আগে। ফসল ফলাবেন যাঁরা, তাঁদের তো দফায় দফায় কেরানি বানানোর চিন্তা কোনো সৎ চিন্তা নয়। ফসল ফলানোর জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সুব্যবস্থা করা না হলে কোন সংস্কারের কথা আমরা বলছি? বড় বড় কমিশন গঠন করা হয় অথচ তাদের পরিকল্পনায় কৃষক নেই—ভাবা যায়?
আরও একটি স্পর্শকাতর জায়গা হলো শিক্ষা। আমাদের বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা এ রকম থাকলে প্রকৃত মেধার বিকাশ কী করে হবে? শিক্ষকতা পেশার বিশেষ মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে। আমরা এই পেশার আর্থিক কাঠামোকে যেমন নড়বড়ে করে রেখেছি, তেমনি এই পেশার মূল উদ্দেশ্যকেও কলুষিত করেছি। অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, ক্ষমতা রদবদলের পর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে একশ্রেণির শিক্ষার্থী কীভাবে শিক্ষকদের অপমান করল। শিক্ষকেরাও যদি তেলবাজ-তদবিরবাজে পরিণত হন, তাহলে তা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। এর প্রতিকারের জন্য নিয়মতান্ত্রিক পথ রয়েছে। কিন্তু কারণে বা অকারণে শিক্ষকেরা যদি মব জাস্টিসের শিকার হন, তাহলে বলতেই হবে, মব জাস্টিস দিয়ে যা হয়, তার নাম সংস্কার নয়। মানুষকে অসম্মান করে বাহবা পাওয়ার মধ্যে মেধার ছোঁয়া নেই।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
খোলা চোখে কয়েকটি বিষয় দেখা যাক।
আওয়ামী লীগ সরকার হয়ে উঠেছিল স্বৈরাচারী সরকার। সেই সরকারকে হটিয়ে দিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ছাত্ররা। সেই আন্দোলনে ঢুকে পড়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। একসময় প্রকাশ পেল, এই আন্দোলন আসলে অনেক ধরনের দলের সম্মিলিত কিংবা বিচ্ছিন্ন প্রয়াসের সমষ্টি।
তবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল একটি মুক্ত সমাজের, যে সমাজে বাক্স্বাধীনতা থাকবে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে, বিচার বিভাগ স্বাধীনতা ভোগ করবে, নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে না। সেই ব্রিটিশ আমল কিংবা তারও আগে থেকে চলতে থাকা আমাদের ‘উন্নয়নের সঙ্গী’ ঘুষ-দুর্নীতিও বিদায় নেবে। নিশ্চয়ই দেশের নাগরিকেরা আশা করেছিল, চাঁদাবাজি, দখলদারি বন্ধ হবে। সেই সংস্কারগুলো হবে দেশে, যে সংস্কারের ফলে জনমনে স্বস্তি ফিরে আসবে।
এ কথা যখন বলি, তখন মূলত শহুরে মানুষের দৃষ্টিতে ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে থাকি। রাজনৈতিক অঙ্গনের বৃহত্তর সংকটগুলো নিয়েই তখন আলোচনা হয়। আর সেই আলোচনায় দেশের মূল শক্তি কৃষকের কথা থাকে না। আমরা যখন পেঁয়াজের দাম ১২০ টাকা কেন হবে বলে প্রতিবাদে মুখর হই, তখন সরু পথে সিন্ডিকেটকে হাঁটতে দেখি, কিন্তু সেই সিন্ডিকেট কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, সেই প্রশ্নেরও জবাব পাই না। সিন্ডিকেট যখন ফুলে-ফেঁপে হাজার-কোটি টাকার মালিক বনে যায়, তখন কৃষককে কে বাঁচাবে, সেই আলোচনায় মন দিই না। তেমনি যখন একটি ফুলকপি বিক্রি করে ৫ টাকা আসে কৃষকের হাতে, তখনো চাষবাসের হিসাব-নিকাশ মেলানোর কোনো চেষ্টা আমাদের থাকে না। বড়জোর বলে থাকি, ফসলের উৎপাদন খরচ তো উঠবে। একবারও ভাবি না, উৎপাদন খরচ না হয় উঠল, কিন্তু এই যে কয়েকটা মাস চাষবাস করা হলো কিছুটা লাভের আশায়, সেই লাভের গুড় কে খেয়ে নিল, সেটা কি প্রাসঙ্গিক আলোচনা নয়?
এ কথা যখন বলি, তখন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের কথাও আমরা ভাবি না। অনির্বাচিত যে সরকার এখন দেশের শাসনক্ষমতায়, তারা যখন হঠাৎ করেই কর বাড়িয়ে দেয়, তখন তারা বুঝতেও পারে না, এটা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে নেই। জনগণ খারাপ আছে, সে কথা বুঝতে হলে কল্পনায় অবগাহন করতে হয় না। সাদা চোখেই তা দৃশ্যমান।
২. রাজনৈতিক সরকারের পতনের পর তড়িঘড়ি করে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হলো, তার গঠনপ্রক্রিয়া নিয়েও প্রধান উপদেষ্টা তাঁর কথা বলেছেন। তাতে মনে হয়েছে, যে নামগুলো এসেছে আলোচনায়, সেই নামগুলো থেকেই পরিচিতজনদের বেছে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই সরকার। বিদগ্ধজনদের অনেকেই বলেছেন, আন্দোলনের সঙ্গে এই সরকারের উপদেষ্টাদের বেশির ভাগেরই কোনো সম্পর্ক ছিল না। কোন কারণে তাঁদের উপদেষ্টা করা হলো, সেই প্রশ্ন কিন্তু উঠতে শুরু করেছে। এর যোগ্য উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করা হলেই তেড়ে আসত একদল মানুষ। ভয়ে অনেকেই কথা বলা থামিয়ে দিয়েছিল। বর্তমানে সবাই কথা বলতে পারছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত বছরের আগস্ট মাসের শুরুতে যাকে বলা হচ্ছিল স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, সেই আন্দোলনের স্টেকহোল্ডাররা কিন্তু বের হতে শুরু হলো অচিরেই। এবং একসময় মনে হলো এই আন্দোলনের মূল শক্তি বিএনপি, একসময় মনে হলো জামায়াতে ইসলামী, একসময় মনে হলো হিযবুত তাহরীর। এ রকম অসংখ্য রাজনৈতিক দল ঝোলটা নিজের দিকে টেনে নিতে শুরু করল। বামপন্থী ছাত্রসংগঠন বা রাজনৈতিক দলগুলোও ছিল মূল স্রোতে। কিন্তু তারা হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে গেছে। যাদের বেশি সরব দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে এমন দলও রয়েছে, যারা সরাসরি স্বাধীনতাযুদ্ধে ছিল বিরোধীপক্ষ। এমনকি সেই বিরুদ্ধতা কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলে হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য তারা এখন পর্যন্ত জাতির কাছে ক্ষমাও চায়নি। এখন তারা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, তারা এই জাতিকে কথায় কথায় অপমানিত করেছে। এই ভুল স্রোতটি হঠাৎ করে মূল স্রোতে এসে মিশল যেভাবে, তার কারণ খতিয়ে দেখতে গেলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে নিজেদের নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত ছিল এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল যে সাধারণ জনগণ আওয়ামী শাসন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বিশ্বাসের যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, সেই শূন্যতার পথ ধরেই স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষের উত্থান হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের ব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহ ছিল জনগণের। কিন্তু ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে এসে দেখা যাচ্ছে, আলোড়নের সময় যে উন্মত্ততাকে সমীহ করে মানুষ, স্থির সমুদ্রে তার কথা কেউই মনে রাখে না। স্থির সময়ে ভাবনার গভীরতার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ সাধনের প্রশ্নটিই বড় হয়ে ওঠে। আন্দোলনের সময় বাস্তবতাবর্জিত আহ্বানও মানুষের সমর্থন পায়। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে সে ডাককে বড়ই স্থূল বলে মনে হতে পারে।
৩. যে প্রশ্নগুলোর উত্তর এড়ানো যাবে না, তার একটি হলো আওয়ামী লীগকে অগ্রাহ্য করার নামে আমাদের রাষ্ট্রের প্রতীকগুলো নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করার ঘটনা। সবচেয়ে আতঙ্কের ব্যাপার হলো, ১৯৭১ সালকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। এই ভূখণ্ডের সবচেয়ে বড় অর্জন যে স্বাধীনতা, তাকে অবজ্ঞা করার মাধ্যমে এই আন্দোলনের স্পিরিটকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার পাঁয়তারা করল কারা, তাদের কি চিহ্নিত করা হয়েছে? কিংবা জানার চেষ্টা হয়েছে, তাদের শিকড় কতটা গভীরে আছে?
অনেকেই বহুদিন ধরে মনে রাখবেন, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংস্কারের প্রশ্নটি যখন অনেক বড় হয়ে উঠল, তখন একশ্রেণির মানুষ প্রশ্ন তুলেছিল আমাদের জাতীয় পতাকা, আমাদের জাতীয় সংগীত নিয়ে। ১৯৭৫ সালের নৃশংস পটপরিবর্তনের পরও পাকিস্তানপন্থীদের এ রকমই উল্লম্ফন দেখা গিয়েছিল। সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের স্বৈরাচারবিরোধী অবস্থান দৃঢ় হবে বলে যাঁরা মনে করতেন, তাঁদের কপালেও এখন পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। আন্দোলনের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে এত বেশি বিভেদ দেখা যাচ্ছে যে কে আসল কে নকল, তা চেনা দায় হয়ে পড়ছে।
রাজধানী ঢাকা থেকে কেউ যদি বের হয়ে পড়েন, তাহলে ছোটখাটো উপশহরগুলোতে কিন্তু এখনো পোস্টার, ফেস্টুন দেখবেন। তবে তা আগেরগুলো নয়। ক্ষমতা পরিবর্তনের পর আগে যে তিনটি মাথার ছবি ওপরে রেখে পোস্টার-ফেস্টুন করা হতো, এখন শুধু সেগুলো বদলেছে। নতুন তিনটি মাথা যুক্ত হয়েছে সেখানে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ প্রশ্ন তুলতে পারে, আদতে সংস্কারটা হচ্ছে কিসের?
৪. শুরুতেই যে কথা বলেছিলাম, তাতে ফিরে আসি। এই দেশে শহুরে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে গ্রামে টেকা যাচ্ছে না বলে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই কেবল মানুষ ভিটেমাটি ছাড়ে। তখন সর্বহারা মানুষ যেকোনোভাবে যেকোনো জায়গায় এসে টিকে থাকার চেষ্টা করে। গ্রামের মানুষকে গ্রামে আবদ্ধ করে রাখতে হবে—সে কথা বলছি না। কিন্তু গ্রামে বসবাসযোগ্য পরিবেশ তো সৃষ্টি করতে হবে আগে। ফসল ফলাবেন যাঁরা, তাঁদের তো দফায় দফায় কেরানি বানানোর চিন্তা কোনো সৎ চিন্তা নয়। ফসল ফলানোর জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সুব্যবস্থা করা না হলে কোন সংস্কারের কথা আমরা বলছি? বড় বড় কমিশন গঠন করা হয় অথচ তাদের পরিকল্পনায় কৃষক নেই—ভাবা যায়?
আরও একটি স্পর্শকাতর জায়গা হলো শিক্ষা। আমাদের বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা এ রকম থাকলে প্রকৃত মেধার বিকাশ কী করে হবে? শিক্ষকতা পেশার বিশেষ মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে। আমরা এই পেশার আর্থিক কাঠামোকে যেমন নড়বড়ে করে রেখেছি, তেমনি এই পেশার মূল উদ্দেশ্যকেও কলুষিত করেছি। অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, ক্ষমতা রদবদলের পর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে একশ্রেণির শিক্ষার্থী কীভাবে শিক্ষকদের অপমান করল। শিক্ষকেরাও যদি তেলবাজ-তদবিরবাজে পরিণত হন, তাহলে তা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। এর প্রতিকারের জন্য নিয়মতান্ত্রিক পথ রয়েছে। কিন্তু কারণে বা অকারণে শিক্ষকেরা যদি মব জাস্টিসের শিকার হন, তাহলে বলতেই হবে, মব জাস্টিস দিয়ে যা হয়, তার নাম সংস্কার নয়। মানুষকে অসম্মান করে বাহবা পাওয়ার মধ্যে মেধার ছোঁয়া নেই।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বাংলাদেশ ইতিহাসমুখী একটি দেশ। এর কারণ বুঝতে কঠিন কিছু জানতে হয় না। বায়ান্ন থেকে একাত্তর সেই ইতিহাসের পূর্ণ অধ্যায়। এই গৌরবময় অতীত যারা অস্বীকার করে, তারা ভুলে যায় এই হচ্ছে দেশ ও জাতির মূল ভিত্তি। এর সঙ্গে কোনো শাসক, অপশাসক বা রাজনীতিকে জড়িয়ে ফেললে বড় ভুল হবে।
১০ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন ও বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। আইয়ুববিরোধী এই আন্দোলনের মধ্যে রোপিত হয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতার বীজ। আসাদের এক রক্তমাখা শার্টে খুঁজে পাওয়া গেল মুক্তির পথ।
১০ ঘণ্টা আগেজুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, গণতন্ত্র মঞ্চ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন
১০ ঘণ্টা আগেআনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও অ্যাকটিভিস্ট। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক। দীর্ঘ সময় তিনি জাতীয় স্বার্থে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির অন্যতম সংগঠক।
১ দিন আগে