দেশটা কি হিন্দুশূন্য হবে?

চিররঞ্জন সরকার, কলাম লেখক
Thumbnail image

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও আমাদের ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’ ধর্ম–বর্ণ–শ্রেণি নির্বিশেষে সব মানুষের বেঁচে থাকার, সবার স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারল না।

সেই একই স্টাইল। প্রথমে কোনো একজন হিন্দুর বিরুদ্ধে ফেসবুকে ‘ধর্ম অবমাননা’-র অভিযোগ। তারপর সেই হিন্দুবাড়িতে আক্রমণের চেষ্টা। এরপর পুরো গ্রামে আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট। এই ঘটনার পর কিছু প্রশাসনিক তোড়জোড়। অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নামে কিছু মামলা। কিছু ব্যক্তি ও সংগঠনের রুটিনমাফিক বিবৃতি, সমাবেশ, প্রতিবাদ। এর মধ্যেই আরও কিছু এলাকায় হিন্দু পরিবারে হামলা।

কয়েক দিন গণমাধ্যম সরগরম থাকার পর নতুন কোনো ইস্যুর সন্ধান লাভ। এরপর হামলা-মামলাসহ যাবতীয় উত্তেজনার অবসান। কিছুদিন পর আকস্মিক নতুন কোনো জায়গায় একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে এই ধারার সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ঘটনাগুলো ঘটছে।

এবার আক্রমণের সূচনা হয় কুমিল্লায়। দুর্গাপূজার মধ্যে ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার একটি মণ্ডপে কোরআন শরিফ অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে বেশ কয়েকটি মণ্ডপ ও স্থাপনা ভাঙচুর হয়। তার জের ধরে তিন দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭০টি পূজামণ্ডপ ও অসংখ্য হিন্দুবাড়িতে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকজনের প্রাণহানিও ঘটেছে। কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় পাইকারি হারে হিন্দুবাড়ি ও মণ্ডব আক্রমণের ঘটনার রেশ না কাটতেই রংপুরের পীরগঞ্জে ধর্ম নিয়ে ফেসবুকে ‘আপত্তিকর পোস্ট’ দেওয়ার অভিযোগে একটি হিন্দুপল্লিতে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ একত্র হয়ে রাতের অন্ধকারে হিন্দুপল্লিতে আক্রমণ চালায়। তাদের মধ্যে তরুণ ও যুবকদের সংখ্যা ছিল বেশি। প্রায় সবার হাতে ছিল লাঠি, রামদা, ছুরি। কারও কাছে ছিল কেরোসিন। হামলাকারীরা বেশির ভাগই ছিলেন আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিচিত মুখ।

এমন আক্রমণ-হামলার ঘটনা কিন্তু নিয়মিতই ঘটছে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক পরিসংখ্যান মতে, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ বছর ৯ মাসে হিন্দুদের ওপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে।

এর মধ্যে ১ হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা রয়েছে। এই সময়ে হিন্দুদের ৪৪২টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৭৮টি। এসব হামলায় আহত হয়েছে ৮৬২ জন হিন্দুধর্মাবলম্বী। নিহত হয়েছে ১১ জন। এর বাইরে বেশ কয়েকজন নারী ধর্ষণের শিকার হন। জমি ও বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয় কয়েক ডজন পরিবারকে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এই তথ্যের বাইরেও বাংলাদেশে প্রচুর সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কারণ, বেশির ভাগ ঘটনা সংবাদপত্রে আসে না। প্রতিকারহীন বোবা কান্না নিয়ে সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত আক্রমণ, হামলা, নির্যাতনের ঘটনাগুলো চাপা দিয়ে রাখছে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই হামলাকারীরা এতটাই প্রভাবশালী যে, কেউ মুখ খোলার সাহস পান না। আর মুখ খুললেও তেমন কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। বরং তাতে আরও বিপদ বাড়ে। অপমান, হুমকি, নিপীড়ন-নির্যাতন ও মার খেয়ে তা হজম করার বিদ্যায় বাংলাদেশের হিন্দুরা সম্ভবত পৃথিবীর শীর্ষে রয়েছে।

মাঝে মাঝে খুবই বিপন্ন বোধ করি দেশের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অসহায়তা দেখে! তাদের অনেক কিছুই নেই, সবচেয়ে বড় ‘নেই’ হচ্ছে নাগরিক অধিকার! নিরাপত্তা। সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার। শাল্লার ঝুমন দাস, রামুর উত্তম, নাসিরনগরের রসরাজ, নারায়ণগঞ্জের শ্যামলকান্তি কিংবা গঙ্গাচড়ার টিটু রায়ের মতো যে কেউ যেকোনো সময় নিশানা হতে পারেন। কোনো একটা হুজুগ তুলে যেকোনো সময় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর যে কারও প্রতি হিংস্রতা নেমে আসতে পারে। মামলা হতে পারে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হতে পারে। এমন এক ভীতিকর পরিবেশে বাস করে কেন জানি তেমন দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না! সংখ্যালঘু মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে কেবলই মনে হয়, আমার দেশ আছে অধিকার নেই। আমার দেশের সংবিধান অলিখিতভাবে আমাকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ বানিয়ে রেখেছে। সব সময় আমাকে হুমকি-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতে হয়। আমার নিরাপত্তা নেই। মুষ্টিমেয় মানুষের আহ্লাদি স্বাধীনতা আমার জীবন থেকে সাম্প্রদায়িকতার খড়্গ চালিয়ে কেড়ে নিয়েছে দেশপ্রেমিক হওয়ার সেই নির্ভীক অহংকার। এই দেশে এখন আমার অলিখিত পরিচয়—সংখ্যালঘু, ‘বিধর্মী’ (বধযোগ্য প্রাণী)! যাকে যেকোনো নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করায় কোনো বাধা নেই। ইচ্ছে করলেই হামলা চালানো যায়। অপমান করা যায়। গাল দেওয়া যায়।

তখন মনে হয় আমরা সত্যিই কি স্বাধীন দেশের নাগরিক?

যারা রাষ্ট্রের কাছে নিশ্চিত নিরাপত্তা পায় না, সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবার বল-ভরসা পায় না, উচ্চারণ করতে পারে না ‘কৃতজ্ঞ’ শব্দটা, যেসব অধিকার–বঞ্চিত, সন্ত্রস্ত মানুষ কেবলই ভয়ের প্রহর গোনে, তারা কী করে গাইবে, ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো?’ কিংবা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি?’

মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, আমি কি তবে পরাধীন? ঠিক কাকে বলে স্বাধীনতা? স্বাধীনতা কার? ব্যক্তির? পুঁজির? সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর? সমাজের? আমাদের সংবিধানে লেখা আছে ব্যক্তির ধর্মীয় মতপ্রকাশের কথা, বাক্‌স্বাধীনতার কথা। কিন্তু যদি আমরা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর চোখে দেশকে দেখার চেষ্টা করি, তাদের ওপর নির্যাতনকারী গোষ্ঠীর পরিচয় প্রকাশ করতে চাই, তাহলে তার অনুমতি মিলবে? স্বাধীনতার পর যারা হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করেছে, ধারাবাহিক হামলা-নির্যাতন-অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের নাম-ঠিকানা কী নির্ভয়ে প্রকাশ করা যাবে? তার মানে রাষ্ট্রের, সরকারের চোখ দিয়ে আমাকে, আমাদের দেখতে হবে, সে মতো কথা বলতে হবে। রাষ্ট্রই ঠিক করে দেবে আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটা।

ছোটবেলায় প্রবীণদের মুখে খেদোক্তি শুনেছি, ‘ইংরেজ আমলই ভালো ছিল।’  তাদের সঙ্গে কত তর্ক করেছি, বলেছি, সুশাসনের চাইতে স্বশাসন দামি। কিন্তু আজ যখন দেখি লাল-সবুজ পতাকার চেতনা ফিকে হয়ে কেবল একটি বিশেষ শ্রেণির, বিশেষ ধর্মের লোকদের স্বার্থ রক্ষায় ক্রমেই বাউন্ডারি নির্মাণ করে, তখন বুঝি, দেশের গতি আমাদের স্বাধীনতার যে গতিমুখ ছিল, তার সঙ্গে ঠিক মানানসই নেই।  

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও আমাদের ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’ ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে সব মানুষের বেঁচে থাকার, সবার স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারল না। একদল অধিকতর গুরুত্ব ও মর্যাদা পেয়ে দাপট দেখাচ্ছে, শাসানি দিচ্ছে, আরেকদল কাচুমাচু হয়ে কোনোমতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। দারিদ্র্য আর অধিকারহীনতার মাপকাঠিতেই তারা বাঁধা থাকছে, আর ‘প্রিভিলেজ্ড’ শ্রেণিটি ধনী হতে হতে ১৮ তলা, ২০ তলা অট্টালিকা বানাচ্ছে! কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়া ইচ্ছে হলেই কোনো হিন্দুগ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। স্বাধীনতা যেন তাদেরই জন্য!

প্রায়ই প্রশ্ন জাগে, আসলে আমরা কোথায় চলেছি? ‘সত্যিই, কোথায় চলেছি’—এই প্রশ্নের উত্তর এখন কারও কাছেই পাওয়া যায় না। কারণ, উত্তরটি সহজ নয়। এককথায় বলা যায় না। কিন্তু মনে হয় বেশ কিছু ‘শিক্ষিত’ ও বিত্তশালী ক্ষমতাবান মানুষের হাতে দেশের সবকিছু চলে গেছে। তারা ও তাদের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল ও নেতারা ঠিক করছেন, দেশে কারা কতটুকু অধিকার ও সুযোগ নিয়ে টিকে থাকবেন। চেষ্টা করা হচ্ছে দেশে আগ্রাসী, সংখ্যালঘুবিরোধী একটি নতুন ও উগ্র ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ তৈরি করতে। কথায় কথায় ধর্মবিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় গালিগালাজ ও অপছন্দের ব্যক্তিদের চরিত্রহননের মচ্ছব তো আছেই। রাজনৈতিক হিসাবটাও পরিষ্কার। মেরুকরণের রাজনীতির ফলে যদি সমস্ত মুসলিম ভোটকে এককাট্টা করা যায়, তা হলে সংখ্যালঘু মানুষ কোণঠাসা বোধ করলেও তাদের বিরোধিতা করার কোনো ক্ষমতা থাকবে না। সেই সুযোগে তাদের সহায়-সম্পত্তি গ্রাস করে নেওয়া যাবে, ধর্মপরিচয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ আবার একটি ‘পাকিস্তান’ হয়ে পুনর্জন্ম নেবে!

কিছু মানুষের এমন খায়েশ এবং এই খায়েশ পূরণের পথে নীরব কিন্তু ব্যাপক অভিযাত্রা দেখে সত্যিই খুব আফসোস হয়! কবির ভাষায় কেবলই বলতে ইচ্ছে করে: ‘বেড়া ভেঙে বুনো মোষ খেয়েছে ফসল/স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ সবই কী বিফল?’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত