Ajker Patrika

স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যালট ছিনতাইয়ের প্রথম ঘটনা 

আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২: ১৬
স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যালট ছিনতাইয়ের প্রথম ঘটনা 

১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পরই ডাকসু বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথভাবে প্যানেল দিয়ে অংশ নিয়েও জয়লাভ করতে পারেনি। অথচ এক বছর আগে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল। বাহাত্তরের ডাকসু নির্বাচনে জয়ের পর ছাত্র ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা কমছিল, আর বাড়ছিল জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের। স্বাধীন দেশে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন ধারার ছাত্র আন্দোলনের যে ডাক ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল, তা সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি বা বলা যায়, সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি নিয়ে চলাটা ছাত্ররা ভালোভাবে নেয়নি। বরং ওই সময় জাসদ ছাত্রলীগের সরকার তথা বঙ্গবন্ধুবিরোধী গরম গরম বক্তব্য সাধারণ ছাত্রদের বেশি আকর্ষণ করতে থাকে। রোমান্টিকতা তারুণ্যের ধর্ম- এটা অস্বীকার করা যায় না।

একটি ঘটনা বেশ মনে পড়ে। আমাদের সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন সলিমুল্লাহ খান। তিনি বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ভালো ছাত্র এবং জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সলিমুল্লাহ খানকে সঙ্গে নিয়ে কলাভবনে চক্কর দিতেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফা তাঁর স্বাধীন ও ভিন্ন চিন্তার জন্য তখন অনেক তরুণ শিক্ষার্থীর কাছে ‘হিরো’ ছিলেন। ছফা ভাই সলিমুল্লাহ খানকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলতেন ‘সলিমুল্লাহর মতো মেধাবী ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কখনো আসেনি’। সলিমুল্লাহর কারণেও মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ জাসদ ছাত্রলীগের দিকে ঝুঁকতো বলে আমার ধারণা।

একসময় মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রগতিশীল ধারার প্রতি আকর্ষণ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের নামে আরও একটি সংগঠন যাত্রা শুরু করার পর মেধাবীদের একটি অংশ ওদিকে চলে যায়, ছাত্র ইউনিয়নে কিছুটা মেধার সংকট দেখা দেয়। এরপর ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি গুলিতে দুই কর্মীর মৃত্যু ও কয়েকজন আহত হওয়ার পর ছাত্র ইউনিয়ন আকস্মিকভাবে জ্বলে ওঠলেও আবার দপ করে নিভে যায়। এটা অনেকের কাছে ছাত্র ইউনিয়নের ‘আত্মসমর্পণ’ বলে মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের পাল্টা হামলা মোকাবিলায় ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃত্ব ‘সিপিবির পরামর্শে’ ভীরুতার পরিচয় দিয়েছে বলে, এমনকি, ছাত্র ইউনিয়নের অনেক কর্মী ও সাধারণ সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেছে। যেভাবে ও যেসব যুক্তিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমর্থন বা সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, সেটাও সাধারণ ছাত্ররা পছন্দ করেনি। স্বাধীনতার পর কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কঠিন কাজে হাত দিলেও কিছু মহলের ক্রমাগত অপপ্রচার বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কেও ভুল ধারণা তৈরি করতে থাকে। তাঁর অতি উদার মানবিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের বিরোধিতাকারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো অবাধে ষড়যন্ত্র-নাশকতা চালিয়ে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর নিজের দলের একটি অংশও এমন সব কাজে জড়াতে থাকেন, যেটা মানুষের মনে বিরক্তির সৃষ্টি করতে থাকে। নবসৃষ্ট জাসদ নেতৃত্ব এবং প্রবীণ নেতা মওলানা ভাসানীসহ আরও নানা শক্তির কঠোর মুজিববিরোধী ও ভারতবিরোধী রাজনীতি দেশের ভেতর একটি গুমোট ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তোলে।

১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা, গুপ্তহত্যা ও সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের জুন মাসের মধ্যে গুপ্ত ঘাতকদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর, থানা-ফাঁড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। সামাজিক অনাচার ও অর্থনৈতিক অনটনজনিত হতাশার শিকার তরুণদের একাংশ বিভ্রান্ত হয়ে সন্ত্রাসের পথে ধাবিত হয়। সুযোগ নেয় রাজাকার আলবদর আলশামসের সদস্যরাও।

এই বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথ প্যানেল দিয়ে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে সারাদিন ভোট গ্রহণ হয়। ডাকসুতে ভিপি পদে প্রার্থী ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নূহ উল আলম লেনিন এবং জিএস পদে ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামা। সংক্ষেপে বলা হতো লেনিন-গামা পরিষদ। অন্যদিকে ছিল জাসদ ছাত্রলীগের মাহবুব-জহুর পরিষদ। ভিপি পদে আ ফ ম মাহবুবুল হক ও জিএস পদে জহুর হোসেন।

নির্বাচনী প্রচার দেখে মনে হয়েছিল, লেনিন-গামা পরিষদের বিজয় ঠেকায় কে! কিন্তু আসলে তা হয়নি। ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেলে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী- সমর্থকেরা খুব ভালোভাবে নেয়নি বলেই আমার ধারণা। হয়তো বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকেই এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টির পছন্দের বাইরে হতো না, তাই ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী-সমর্থকদের মনোভাবের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে যৌথ প্যানেলে নির্বাচনে গিয়েছিল। এতে ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ ছাত্রদের কাছে প্রশংসিত হয়নি। আবার ছাত্রলীগের মধ্যেও ছাত্র ইউনিয়নবিরোধী মনোভাব ছিল। ফলে বাইরে বাইরে যৌথ প্যানেল নিয়ে যেরকম রমরমা ভাব ছিল, ভেতরে ভেতরে তেমন ছিল না।

অন্য হলের কথা আমি ভালো জানি না, কিন্তু জগন্নাথ হলে আমি ঐক্যবিরোধী মনোভাবই প্রবল দেখেছি। যৌথ প্যানেলের পক্ষে কর্মীদের বোঝানোর জন্য একাধিক মিটিং জগন্নাথ হলে হয়েছে। তার একটিতে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও উপস্থিত ছিলেন। আমি ওই সভায় শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থেকে দেখিছি, সেলিম ভাইয়ের মতো তুখোড় নেতা, যিনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতায় ছিলেন অতুলনীয়, তাঁকেও সাধারণ কর্মীদের প্রশ্নের জবাব দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত না মেনে উপায় নেই বলেই যৌথ প্যানেল হয়েছিল কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই এটা মেনে নেননি। জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল এবং শামসুন্নাহার হলে ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠন শক্তি ছিল মজবুত। এই তিন হলে ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়া অন্য সংগঠন থাকলেও সদস্য-সমর্থক বেশি ছিল না। একক নির্বাচন করলেও এই তিন হলে ছাত্র ইউনিয়নের বিজয় ছিল নিশ্চিত। এই অবস্থায় ছাত্রলীগকে আসন ছেড়ে দিতে আপত্তি ছিল সঙ্গত।

সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে এমন মনোভাব কেন তৈরি হয়েছিল তা বোঝার চেষ্টা না করাটি ছিল তখন একটি বড় ভুল। দেশে তখন দ্রুত এমন সব ঘটনা ঘটছিল যা ছিল অপ্রত্যাশিত। উচ্ছৃঙ্খল আচার-আচরণের কারণে ছাত্রলীগের বিচ্ছিন্নতা বাড়ছিল। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বিরোধ ছিল, গ্রুপিং ছিল। স্বাধীনতার পর শফিউল আলম প্রধানকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। শফিউল আলম প্রধানের বাবা গমিরউদ্দিন প্রধান ছিলেন মুসলিম লীগের ডাকসাইটে নেতা। তিনি শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক স্পিকার ছিলেন।

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে লিখতে গিয়ে এই পর্যায়ে হঠাৎ মনে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অল্প সময় পরই আমিও বাংলা বিভাগের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। আমি যে এ ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলাম তা নয়। কারণ যে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আমার ভয় ছোটবেলা থেকেই। আমি স্কুলে একবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। বিস্কুট দৌড় নামে একটি প্রতিযোগিতা ছিল। আমি এই ভেবে অংশ নিয়েছিলাম যে পুরস্কার না পেলেও দড়িতে ঝোলানো একটি বিস্কুট অন্তত মুখে পুড়তে পারব! অবশ্য ওই প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগী কম থাকায় একটি পুরস্কার আমিও পেয়েছিলাম। তিনজনের মধ্যে আমি তৃতীয় হয়েছিলাম। এমন বিপুল সাফল্যের পর প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলতাম কোনো না কোনো অজুহাত তুলে। পরে অবশ্য বাঙালির তিন হাতের কথা জেনেছি। ডান হাত, বাম হাতের চেয়েও আমাদের শক্তিশালী তৃতীয় হাতটির নাম অজুহাত।

বাংলা বিভাগের নির্বাচনে আমাকে কেন প্রার্থী করা হলো তার কারণ আমি জানি না। হয়তো মিছিল মিটিংয়ে নিয়মিত উপস্থিত থাকা এবং ততদিনে ছাত্র ইউনিয়নের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয়ধ্বনি’র কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়াই এর কারণ ছিল। আমি মনে করি, আমার চেয়ে যোগ্যপ্রার্থী ছিল জুলিয়াস, খোন্দকার শওকত হোসেন। সে ঢাকায় লেখাপড়া করেছে। জুবিলী স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। তাছাড়া ঢাকা নগর ছাত্র ইউনিয়নের কাজের সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। আমি মফস্বল থেকে আসা একটু সেকেলে ধরনের মানুষ। পোশাকেরও তেমন ছিরিছাঁদ ছিল না। মনোনয়নপত্র জমা দিলাম প্রচার সম্পাদক পদে।

মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে আমার ভয় দূর না হয়ে গেল বহুগুণে বেড়ে। হেরে গেলে তো লজ্জার ব্যাপার। আবার এটাও মনে হলো, কোথায় যেন শুনেছি, জয়ের চেয়ে নাকি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আনন্দই বেশি।

আনন্দের খবর পেতে অবশ্য আমাকে ভোটের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন জানা গেল আমি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মুজিববাদী ছাত্রলীগের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় আমার বিজয় নিশ্চিত হয়।

আমরা অবশ্য বিভিন্ন বর্ষের ক্লাসে গিয়ে প্যানেলের জন্য ভোট প্রার্থনা করেছি। ভিপি পদে আমাদের প্রার্থীর নাম কিছুতেই মনে করতে পারছি না। তবে জিএস প্রার্থী ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। তার বাড়িও দিনাজপুরের বীরগঞ্জে। মিজান ভাই দেখতে সুদর্শন ছিলেন। হাঁটতেন একটু খুড়িয়ে। সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে তিনি যখন করিডোরে হাঁটতেন, তখন তাকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর মতোই লাগতো। নামে যেমন মিল, দেখতেও যেন কিছুটা মিল ছিল।

মিজান ভাই ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন। তার কথায় মুগ্ধ হওয়ার অনেক উপাদান থাকতো। ক্লাসে ক্লাসে তিনি যখন ভোট চেয়ে বক্তৃতা করতেন তখন সবাই মনোযোগ দিয়েই শুনতেন। ফলে তিনি যে ভোটে জিতবেন- এটা আমি বুঝতে পারছিলাম। নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে জিএসসহ কয়েকজন এবং ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ভিপিসহ কয়েকজন জেতেন। একটি ঘটনার কথা বেশ মনে পড়ছে।

তখন আমাদের বিভাগীয় প্রধান ড. নীলিমা ইব্রাহিম। তিনি একই সঙ্গে রোকেয়া হলের প্রভোস্টও ছিলেন। আমাদের সংসদের প্রথম মিটিংয়ে ঘটলো এক মজার ঘটনা। সভা শুরু হওয়ার আগে প্রথমেই কথা বললেন জিএস মিজান ভাই। তিনি শুরু করলেন এভাবে: আমাদের সভা শুরু হলো। আজকের সভায় সভাপতিত্ব করছি আমি মিজানুর রহমান চৌধুরী।

ছাত্রলীগের থেকে নির্বাচিত ভিপি (নাম মনে নেই) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কি বলছেন আপনি? আমি ভিপি, সভায় সভাপতিত্ব করব আমি। ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত অন্যরাও বললেন, জিএস নয়, সভাপতিত্ব করবেন ভিপি।

মিজান ভাই এক অদ্ভুত যুক্তি হাজির করলেন। বললেন, দেশে এখন রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতি নেই। এখন প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারপ্রধান। কখনো শুনেছেন, এখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করেন? এখন মন্ত্রিসভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এখানে আমাদের এই সংসদেও ভিপি নন, জিএসই সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিতরা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো যুক্তি খুঁজে না পেয়েই বোধহয় মিজান ভাইয়ের প্রস্তাব মেনে নেন।

মিজান ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা কিন্তু বাংলা বিভাগের জন্য একটি ভালো লাইব্রেরি গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। আমার মনে আছে, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে আমরা প্রচুর বই সৌজন্য হিসেবে এনেছিলাম। বিভাগীয় প্রধান নীলিমা আপা ছাত্রলীগের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল হলেও আমাদেরও তিনি অসহযোগিতা করেননি।

মিজান ভাইয়ের ক্যারিশমার কারণে পরের বছর বিভাগীয় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের পুরো প্যানেল জয়লাভ করেছিল। সেবার ভিপি হয়েছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জিএস হয়েছিলেন উম্মে তুকা মোকাদ্দেসা আপা, পুরো নাম এখন পড়ছে না।

মিজান ভাই পরে বিটিভিতে অভিনয় করেছেন, বিটিভির জন্য একাধিক নাটকও লিখেছেন। তার লেখা একটি নাটক একসময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। শেষ দিকে মিজান ভাই ঢাকা থেকে বীরগঞ্জ চলে গিয়েছিলেন। বীরগঞ্জ কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন বেশ কয়েক বছর।

ডাকসু নির্বাচন প্রসঙ্গে ফিরি নির্বাচনের দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোটগ্রহণ শেষ হয়। প্রতিটি হলে ছিল ভোটারদের লম্বা লাইন। অধিকাংশ ভোটারের বুকে ঝুলছিল লেনিন-গামা পরিষদের ব্যাজ, মাহবুব-জহুর পরিষদের ব্যাজও ছিল, তবে তুলনামূলক কম। যৌথ প্যানেলের নেতা-কর্মীরা পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে চরকির মতো ঘুরছিলেন। আমি শুরুতে লেনিন-গামা পরিষদের বিজয়ের ব্যাপারে কিছুটা সন্দিহান থাকলেও শেষদিকে মনে হচ্ছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও এই প্যানেলই জিতবে। মাহবুব-জহুর পরিষদের উপস্থিতি নজর এড়ানোর মতো না থাকলেও কিছুটা নিষ্প্রভ তো ছিলই। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের মতো একটি সংগঠনের মিলিত প্যানেল জিতবে না– এটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য ছিল। তবে ভেতরে ভেতরে যে একটি চোরাস্রোত বইছিল, সেটা আমাদের অনেকের উপলব্ধিতে ছিল না।

ভোট শেষে আমি হল থেকে বেরিয়ে কলাভবনে গিয়েছিলাম ফলাফল ঘোষণার বিষয়ে জানতে। হলে হলে ভোট গননা হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ডাকসুর ফল ঘোষণা হবে মনে করে আমি কলাভবনের সামনে গিয়েছিলাম। কলাভবনের চারতলায় সম্ভবত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ করা হয়েছিল। জগন্নাথ হলে যে যৌথ প্যানেল জিতবে তাতে আমার একটুও সন্দেহ ছিল না। আমাদের হলে জাসদ ছাত্রলীগের সামান্য কয়েকজন সদস্য ছিলেন। তবে যারা হলে না থেকে বাইরে থাকতেন তাদের কিছু ভোট তারা পাবে কিন্তু সেটা শয়ের ঘর পেরুবে না বলে আমার ধারণা ছিল। মেয়েদের দুই হলে জেতার ব্যাপারেও আমার কোনো সংশয় ছিল না।

সন্ধ্যা হয় হয় সময় দেখলাম রোকেয়া হলের প্রভোস্ট নীলিমা ইব্রাহিম হন্তদন্ত হয়ে কলাভবনের সামনে এসে শেখ শহীদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, শেখ কামালসহ নেতাদের সঙ্গে সামান্য কিছু কথা বলে আবার হলে ফিরে গেলেন। নেতাদের একটু চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন মনে হলো। শেখ কামাল তার কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে একটি জিপে উঠে এসএম হলের দিকে গেলেন। কিছু একটা ঘটছে– এ আশঙ্কা থেকে আমি প্রায় দৌড়ে হলে ফিরলাম। জগন্নাথ হলের অ্যাসেমব্লি ভবনে ভোট গননা চলছিল। ছাত্ররা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে জটলা করছিল আর ফল শোনার অপেক্ষা করছিল।

আমি অ্যাসেমব্লির সামনে যেতে না যেতেই দেখি ১৫/২০ জনের একটি মিছিল পূর্ববাড়ির গেট দিয়ে ঢুকছে। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিচ্ছিল। দেখতে না দেখতেই তারা যেখানে ভোট গননা চলছিল সেখানে ঢুকে গেল এবং গুলি বা পটকা ফোটানোর শব্দ কানে এলো। ওই মিছিলকারীরা চিৎকার করে মুজিববাদীদের খুঁজছিল।

মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো যে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়েছে এবং সেটা করেছে জাসদ ছাত্রলীগ। দৌড়াদৌড়ি ধ্বস্তাধ্বস্তিও কিছু হলো। কে যে কাকে ধাওয়া করছে বুঝতে না পেরে আমি উত্তরবাড়ির দিকে একটি নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ভালোভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিছিল শুরু হলো। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের যৌথ মিছিল। স্লোগান দেওয়া হলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী তথা জাসদ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। অল্প সময়ের মধ্যে এটাও জানা গেল যে নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে জাসদ ছাত্রলীগ ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাই করেছে। ব্যালট ছিনতাইয়ের জন্য জাসদ ছাত্রলীগকে দায়ী করা হলেও ঘটনা যে উল্টো তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে আমি যাদের জগন্নাথ হলে ঢুকতে দেখেছি, তাদের দুয়েকজনকে আমি মুজিববাদী ছাত্রলীগের মিছিলে আগে দেখেছি। তাছাড়া ওই সময়ে যে অবস্থা ক্যাম্পাসে ছিল তাতে জাসদ ছাত্রলীগের পক্ষে ব্যালট ছিনতাই করা অসম্ভব বলেই আমার মনে হয়েছে। কিন্তু আমি আমার এই মনোভাব তাৎক্ষণিকভাবে কারো কাছে প্রকাশ করিনি।

দশে চক্রে ভগবান ভূত। সবাই মিলে তখন আমরা জাসদের গুষ্ঠি উদ্ধার শুরু করলাম। ভোটের পরদিন সকালেই সম্ভবত ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ও জয়ধ্বনি সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত আমাকে বললেন, সকাল ১১টায় জাসদ ছাত্রলীগের সংবাদ সম্মেলন। আমি যেন জয়ধ্বনির পক্ষ থেকে ওই সংবাদসম্মলনে উপস্থিত থেকে ওরা কি বলে তা ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে জানাই।

আদেশ শিরোধার্য করে আমি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বলাকা ভবনে জাসদ ছাত্রলীগ কার্যালয়ে উপস্থিত হলাম। একটু ভয় যে করছিল না, তা নয়। আমাকে ছাত্র ইউনিয়ন হিসেবে চিনে যদি গণধোলাই শুরু করে তাহলে কী হবে ভাবছিলাম। তবে আমি ঢাকায় তখনো ছাত্র ইউনিয়নের সামান্য কর্মীর মতোই ছিলাম। তাই আমাকে মেরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে চাইবে না- এটাও মনে হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে ডাকসুর ব্যালট ছিনতাইয়ের জন্য মূলত মুজিববাদী ছাত্রলীগকেই দায়ী করা হয়। বলা হয়, পরাজয় নিশ্চিত জেনেই ছাত্রলীগ এটা করেছে। রোকেয়া হলের ভোট গননা শেষ হয়েছিল। যৌথ প্যানেল হেরেছিল।

আমার তখনই আগের সন্ধ্যার ঘটনা মনে পড়ে যায়। যৌথ প্যানেল হেরেছে দেখে ফল ঘোষণা না করে নীলিমা আপা নেতাদের কাছে গিয়ে তাদের পরাজয়ের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। পরাজয় এড়ানোর জন্যই ব্যালট ছিনতাই নাটক।

সংবাদ সম্মেলনে জাসদ ছাত্রলীগ নেতারা আরও নানা তথ্যাদি উল্লেখ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে ঘটনাটি তারা ঘটাননি। যা হোক, সংবাদ সম্মেলন শেষে আমি ১০ নম্বর পুরানা পল্টনে ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে সবিস্তারে সব কিছু জানাই।

পরের দিন দৈনিক সংবাদে আব্দুল কাইয়ুম মুকুলের (এখন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক) একটি লেখা ছাপা হয়, যে লেখায় নানা তথ্য ও যুক্তি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা হয় যে জাসদ ছাত্রলীগই ডাকসুর ব্যালট ছিনতাই করেছে।

ডাকসুর ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনার দায় যেভাবে জাসদ ছাত্রলীগের ওপর চাপানো হয়েছিল, সেটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি। ছাত্রলীগের অপকর্মের ভাগ বহনের এই নীতি মেনে নিতে আমার কষ্ট হয়েছে। আমরা আমাদের ভালোত্ব দিয়ে ছাত্রলীগকে খারাপ কাজকর্ম থেকে বিরত করে ভালোর পথে নিয়ে আসব– এই ধারণা থেকেই তো তাদের সঙ্গে ঐক্যের বিষয়টি ভাবা হয়েছিল বলে আমি মনে করেছিলাম। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর আমরা তাদের খারাপটা শুধু মেনে নিলাম না, খারাপের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দিলাম।

নেতারা তখন যে সব যুক্তি দিয়েছিলেন, সেগুলো আমার কাছে অনেকটা কুযুক্তি মনে হয়েছে। ডাকসু জাসদ ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে গেলে দেশে কী এমন ওলটপালট হতো তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। কোনো সংগঠনের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল না আমার পরিচিত তেমন শিক্ষর্থীরা আমাকে বলতো, তোমরা হলে চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা!

জাসদ ছাত্রলীগই ব্যালট ছিনতাই করেছে বলে বোঝানোর চেষ্টা করতাম কিন্তু মন থেকে তেমন জোর পেতাম না। কারণ আসল সত্য তো আমি জানতাম। এ নিয়ে যারা বাঁকা কথা বলতো বা টিজ করতো তাদের এড়িয়ে চলতাম। আমার ধারণা, ওই নির্বাচনের পর আমার মতো আরও অনেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর মনের জোর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের দূরত্ব বাড়ছিল।

একবার কোনো সংগঠনের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লে তাতে আবার জোয়ার সৃষ্টি করা সহজ নয়। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি এবং একই বছরের সেপ্টেম্বরের ডাকসু নির্বাচন ছাত্র ইউনিয়নকে পেছনে ঠেলেছে, আর সামনে সেভাবে আগানোর কোনো উপলক্ষ তৈরি হয়নি বা বলা যায় ছাত্র ইউনিয়ন তেমন উপলক্ষ তৈরিও করতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরামর্শ শিরোধার্য করে কমিউনিস্ট পার্টি নীতিনির্ধারণ করায় কিছু সমস্যা হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থ আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির স্বার্থ নিশ্চয়ই অভিন্ন ছিল না। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্র ইউনিয়ন তার গণভিত্তি মজবুত করতে পেরেছিল এ কারণেই যে তখন কমিউনিস্ট পার্টির ওপর সোভিয়েতের সরাসরি নিয়মিত নির্দেশনা ছিল না। 

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যা করণীয়

সম্পাদকীয়
যা করণীয়

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন পর্যন্ত এতটাই সজীব যে, ইচ্ছে করলেই এই ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অতি সুকৌশলে এমন সব প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, যার উত্তর তারা নিজেরা জানলেও সে উত্তরকে আড়ালে রেখে নতুন বয়ান তৈরির ধূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর, আলশামসের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই কাজটি মূলত তারাই করতে চাইছে, যারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি এখনো হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বাংলাদেশের সূত্রের কাছে না গেলেও চলবে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এবং সে সময়ের ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠা রাও ফরমান আলী তাদের বইগুলোয় একে অপরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। নিয়াজির অফিসের সামনে রাও ফরমান আলী দেখেছেন কাদালেপা মাইক্রোবাস, রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। কেউ কেউ রাও ফরমান আলীকে অনুরোধ করে সেই তালিকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম কাটিয়েছেন বলেও প্রমাণ আছে। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশেরই শিক্ষিত কোনো মানুষ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না বলে মত প্রকাশ করলে তা সত্যের অপলাপই হয়। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ন্যক্কারজনক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।

বাংলা ও বাঙালির বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। দেশের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, সে-ই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস রচনা করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়, ইতিহাসের সত্যগুলো প্রকাশিত হবেই। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে আসা স্বাধীনতার সময়টিতে কার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কার ওপর দেশবাসী রেখেছিল আস্থা, পাকিস্তানিদের চালানো অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা পাওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাঙালির এই জনযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর মহিমাকীর্তন কোনো ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে পারবে না। সব পক্ষের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে আড়াল না করে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা।

আমাদের দেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। এই সময়টিতে পুরো জাতির ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এত বেশি বিভক্ত হয়ে রয়েছে যে তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় সব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আসবে—এমন আশা এখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে না। ন্যূনতম কিছু বিষয়ে একমত হতে হলে জাতিকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। সেদিকেই হতে হবে দেশের যাত্রা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

রাজিউল হাসান
কেরালার তিরুবনন্তপুরাম পৌরসভার নির্বাচনের ফলাফল বড় একটি বার্তা দিয়েছে বামদের। ছবি: সংগৃহীত
কেরালার তিরুবনন্তপুরাম পৌরসভার নির্বাচনের ফলাফল বড় একটি বার্তা দিয়েছে বামদের। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের মালয়ালমভাষী উপকূলীয় রাজ্য কেরালা জনসংখ্যার বিচারে দেশটির ১৪তম বৃহৎ রাজ্য। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে এই রাজ্যের একটি বড় পার্থক্য হলো, এখানে বাম মতাদর্শের প্রভাব বেশি। কংগ্রেসেরও আধিপত্য রয়েছে। সে তুলনায় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রভাব কিছুদিন আগেও বেশ কম ছিল।

বহু বছর ধরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই-মার্ক্সবাদী) নেতৃত্বে বাম মতাদর্শের জোট লেফট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এলডিএফ) আর কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) ভাগাভাগি করে কেরালা শাসন করছে। কিন্তু সে দুর্ভেদ্য রাজ্যে এবার বিজেপি চমক দেখিয়েছে। ৯ ডিসেম্বর কেরালার তিরুবনন্তপুরাম পৌরসভায় ভোট হয়েছে। এখানকার ১০১টি আসনের মধ্যে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট জিতেছে ৫০টিতে। আগের পর্ষদের চেয়ে এবার এই জোট ১৫টি বেশি আসন দখলে নিয়েছে। এলডিএফ বিজয়ী হয়েছে ২৯টি আসনে। আগেরবারের তুলনায় এবার তাদের আসন কমেছে ২৩টি। ইউডিএফ জিতেছে ১৯টি আসনে। আগেরবারের চেয়ে এবার তাদের ঝুলিতে আসন বেড়েছে ৯টি। দুটি আসনে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

ভূখণ্ডের আয়তনের বিচারে ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ। আর জনসংখ্যার বিচারে দেশটি এখন বিশ্বের শীর্ষে। ২৮টি রাজ্য আর ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের এমন বড় একটি দেশের একটি রাজ্যের একটি পৌরসভায় বিজেপির এমন বিজয় হয়তো সাদা চোখে খুব বড় কোনো সাফল্য নয়। তবে এ কথা একেবারে অনস্বীকার্য যে বামদের দুর্গে এবার খুব ছোট করে হলেও বিজেপির পদ্মফুল ফুটেছে। এ বিজয় বিজেপির জন্য যেমন উদ্‌যাপনের একটি মুহূর্ত নিয়ে এসেছে, একই সঙ্গে দেশটির অন্যান্য রাজনৈতিক দলের জন্যও নতুন করে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের উপলক্ষ তৈরি করেছে।

ভারতের ২৮টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে এখন ২৪টিই বিজেপি ও তার জোটের দখলে। এগুলো হলো অন্ধ্র প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, বিহার, ছত্তিশগড়, দিল্লি, গোয়া, গুজরাট, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মণিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ওডিশা, পদুচেরি, রাজস্থান, সিকিম, ত্রিপুরা, উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখন্ড। কংগ্রেস, তার মিত্র ও কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের শাসন চলছে সাতটি রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। পাঞ্জাবে চলছে আম আদমি পার্টির এবং মিজোরামে চলছে জোরাম পিপলস মুভমেন্ট (জেডপিএম) পার্টির শাসন। পশ্চিমবঙ্গ অনেক বছর ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস শাসন করছে।

অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি জোট যখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় আসে, তখনো দলটির এতটা বিস্তার ছিল না। দিনে দিনে দেশজুড়ে তাদের প্রভাব বেড়েছে, নিয়ন্ত্রণে এসেছে নতুন নতুন এলাকা। সে হিসাবে হয়তো বামদের দুর্গে বিজেপির ছোট্ট হানা স্বাভাবিক মনে হবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গসহ আরও যেসব রাজ্য বিজেপির নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে, সেসব রাজ্যের শাসক দলের জন্য এটি একটি অশনিসংকেত। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য কেরালার তিরুবনন্তপুরাম পৌর নির্বাচন আশু দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। কারণ, আর কয়েক মাস পরই এই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন।

যে কেরালা নিয়ে আজকের আলোচনা, সেখানেও আগামী এপ্রিলে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সে হিসাবে তিরুবনন্তপুরামের নির্বাচনের ফলাফল বড় একটি বার্তা দিয়েছে বামদের। এ নির্বাচনে এলডিএফ বড় মার খেয়েছে। ১০১ আসনের এই পৌর কাউন্সিলে ৫১ আসনে জিতলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়। বিজেপি মাত্র এক আসন কম পেয়েছে। এলডিএফ হারিয়েছে ২৩ আসন। অবশ্য কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ পৌরসভা ও পঞ্চায়েতগুলোয় বেশ ভালো করেছে।

কেরালায় হয়তো আজও এলডিএফ এবং ইউডিএফ জোটই বড় রাজনৈতিক খেলোয়াড়। তবে বিজেপিও যে আর তুচ্ছ নয়, তা তিরুবনন্তপুরামের ফলাফল বুঝিয়ে দিয়েছে। রাজ্যটি এলডিএফ এবং ইউডিএফ ভাগাভাগি করে শাসন করলেও তিরুবনন্তপুরাম ৪৫ বছর ধরে রেখেছিল বামেরাই। সেই দুর্গ এবার ছিনিয়ে নিয়েছে বিজেপি। শুধু তিরুবনন্তপুরামই নয়, কেরালার পালাক্কাড় পৌরসভা এবং ত্রিপুনিথুরা পৌরসভাও এখন বিজেপির দখলে।

কেরালায় আগের বিধানসভা নির্বাচনে ১৪০ আসনের মধ্যে ৯৯টিই দখলে নিয়েছিল এলডিএফ। বাকি ৪১টি আসন পেয়েছিল ইউডিএফ। তিরুবনন্তপুরামের নির্বাচন বলে দিচ্ছে, এবার ফলাফলটা এমন হবে না। এলডিএফ জোট ২০১৬ সাল থেকে টানা এ রাজ্যের ক্ষমতায়।

রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, কেরালার পঞ্চায়েতগুলোর মধ্যে দেড় হাজারের মতো ওয়ার্ড এখন বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের দখলে। তিরুবনন্তপুরামে জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য ছিল, ‘চোখে জল আনার মতো মুহূর্ত এটি।’

বিজেপির নেতাদের দাবি, কেরালায় ভবিষ্যতে বিজেপির অবস্থান আরও পোক্ত হবে এবং একসময় এখানে ইউডিএফ ও কংগ্রেসের ভোটাররা বিজেপিকেই সমর্থন করবেন। তাঁরা এ জন্য আগেভাগেই বিজেপির কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে রেখেছেন।

কংগ্রেস নেতা শশী থারুরও তিরুবনন্তপুরামের নির্বাচনের ফলাফলের পর স্বীকার করেছেন, কেরালায় ভোটারদের পছন্দে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে।

অবশ্য তিরুবনন্তপুরামে কিন্তু রাতারাতি বিজেপি এমন বিজয় অর্জন করেনি। বরং ১৫ বছর ধরে রাজনৈতিক ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা ধীরে ধীরে অগ্রগতি অর্জন করেছে। শুধু কেরালায়ই নয়, অন্যান্য রাজ্যেও বিজেপির পদ্মফুল ফুটেছে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়। আমরা শুধু জানি, বিজেপি ধর্মকে সামনে রেখে রাজনীতি করে চলেছে। সেটা হয়তো ঠিক। কিন্তু এই ইস্যুটি ছাড়াও বিজেপির রাজনৈতিক কৌশলের ঝুলিতে আরও অনেক কিছু আছে। বিজেপির সবচেয়ে বড় সুবিধাটা হলো, তারা যে রাজ্যের জন্য যে কৌশল প্রয়োজন, ঠিক সেটাই প্রয়োগ করছে। যেমন কেরালায় বামদের হটাতে তারা যে কৌশল প্রয়োগ করছে, আসাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিন্তু সেই একই কৌশলে তারা হাঁটছে না। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোয় বিজেপিতে আস্থা বাড়াতে যে পথে হাঁটছে তারা, দেশের মধ্যাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় সে পথে তারা নেই। কাশ্মীরে তাদের যে কৌশল, তামিলনাড়ুতে গিয়ে দেখা যাবে, ঠিক তার বিপরীত কৌশল বিজেপির। এবং এই যে রাজ্যভেদে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল, সেটা নির্ধারণ করা হচ্ছে একেবারে শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে। এই শীর্ষ নেতৃত্ব কিন্তু একজনের হাতে কুক্ষিগত নয়, বরং একদল বর্ষীয়ান-অভিজ্ঞ রাজনীতিক একসঙ্গে গড়ে তুলেছেন সে নেতৃত্ব।

ঠিক এই জায়গায় কংগ্রেস কিংবা অন্য দলগুলোর সঙ্গে বিজেপির ফারাক। কংগ্রেসের কথাই ধরা যাক। দলটি এখনো গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। পারিবারিক নেতৃত্ব থেকে দলটি বের হতে না পারার খেসারত দিচ্ছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। এ ছাড়া ভারতের বেশির ভাগ দলেও পরিবারতন্ত্র বেশ বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছে। আর ঠিক এ সুযোগেই বিজেপি ভারতজুড়ে ধীরে ধীরে পদ্মফুল ফুটিয়ে চলেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

রাফায়েল আহমেদ শামীম
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০: ৫২
ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্ব অস্বীকার বিশ্বকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করছে। ছবি: এএফপি
ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্ব অস্বীকার বিশ্বকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করছে। ছবি: এএফপি

ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের সাম্প্রতিক মন্তব্য কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির জন্য নয়, বরং পুরো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকাঠামোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, যদি জাতিসংঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগোতে থাকে; তবে ফিলিস্তিনি নেতাদের বেছে বেছে হত্যা করা উচিত। এটি কোনো উগ্রমনা ব্যক্তির অযৌক্তিক মন্তব্য নয়, এটি একজন রাষ্ট্রীয় মন্ত্রীর মুখ থেকে আসা রাজনৈতিক নির্দেশ, যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের জন্য এক চরম হুমকি।

এই মন্তব্যের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে রুখে দেওয়ার জন্য সুগঠিত নীতি অনুসরণ করছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতাদের দমন, ভূখণ্ড দখল, বসতি সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অবজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভোটে গাজা উপত্যকার স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক শান্তিবাহিনী গঠনের প্রস্তাব, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কার কার্যক্রম এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠনের সহায়তা ইসরায়েলকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। ফিলিস্তিনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মানে তাদের রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা, যা পশ্চিম তীরের দখলনীতি ও বসতি সম্প্রসারণকে আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এই ভীতিই বেন-গভিরের মতো উগ্র নেতাদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিতে প্রলুব্ধ করছে।

বেন-গভিরের বক্তব্যে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে অস্তিত্বহীন বলা, তাদের অন্য আরব দেশ থেকে আগত অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং সন্ত্রাসমূলক আখ্যায়িত করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও জাতিগত স্বীকৃতির নীতির পরিপন্থী। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে কোনো জাতিকে অবৈধ বা অস্তিত্বহীন হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে তার ওপর সহিংসতা প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন রুয়ান্ডার তুতসিদের ক্ষেত্রে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর এবং নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে। তাই এই ধরনের বক্তব্য কেবল হুমকি নয়, বরং বাস্তবায়নের প্রস্তুতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় নির্দেশনার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। তবে এই সহযোগিতাও ইসরায়েলের কাছে রাষ্ট্র স্বীকৃতির জন্য যথেষ্ট নয়। নেতানিয়াহু সরকারের ডানপন্থী জোটের নেতারা একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অর্থমন্ত্রী বেনজালেল স্মোট্রিচ পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের ভূখণ্ডের সঙ্গে একত্র করার চেষ্টা করছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন, যাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি না দেওয়া হয়। এই কৌশল দেখাচ্ছে, ইসরায়েলের নীতি কেবল নিরাপত্তার কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি নীরব থাকে, তবে এটি আন্তর্জাতিক আইনের জন্য একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে। যে রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে হত্যার হুমকি দিতে পারে, তাকে আইনি ও নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ করার কোনো কার্যকর ক্ষমতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেই, এটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।

ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের জন্য আলাদা কারাগারের কক্ষ প্রস্তুত রাখার কথাও ইসরায়েলি সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এটি শুধু হুমকি নয়, বরং সম্ভাব্য বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনার ইঙ্গিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে ইসরায়েল তার কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য চরম হুমকি ও সহিংসতা ব্যবহারে প্রস্তুত।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গাজা পুনর্গঠন, পিএর সংস্কার কার্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক শান্তিবাহিনী—সবই ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র গঠনের পথকে সহায়তা করছে। এই প্রক্রিয়ায় ইসরায়েল উদ্বিগ্ন, কারণ এটি তাদের একতরফা দখল নীতি ও বসতি সম্প্রসারণকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বেন-গভিরের মন্তব্য কেবল হুমকি নয়, বরং এই প্রক্রিয়ার প্রতি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

ইসরায়েলি নেতাদের উগ্র প্রতিক্রিয়ার কারণ হলো, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তাদের দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও নিরাপত্তাকাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা এটিকে ‘রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একবার জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে, পশ্চিম তীরের দখল, জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ এবং গাজার ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এই পরিস্থিতিই বেন-গভিরকে হত্যার হুমকি দিতে প্রলুব্ধ করেছে।

আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বেন-গভিরের বক্তব্য স্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যকর পদক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা কার্যকর হচ্ছে না। ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্র যখন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মিত্র শক্তির আশ্রয়ে থাকে, তখন আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে জাতিসংঘের মতো সংস্থা কার্যকর হুমকি প্রতিরোধ করতে পারছে না। ফিলিস্তিনের জনগণ এই হুমকির প্রভাবে ভয় ও অনিশ্চয়তায় দগ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না, তাতে ইসরায়েল আরও বেপরোয়া হচ্ছে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রীয় হুমকি এবং নীরব আন্তর্জাতিক সমাজ মিলিত হলে অত্যাচারী নীতি বাস্তবায়িত হয়। রুয়ান্ডা, মিয়ানমার, ইউক্রেন—সবই এই প্যাটার্নের উদাহরণ। তাই ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো সুরক্ষিত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় হস্তক্ষেপ অপরিহার্য।

ইসরায়েলি রাজনীতির উগ্রতা, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সীমিত প্রতিক্রিয়া মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন এক সংকট তৈরি করেছে, যেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা ধ্বংসের মুখে। এই অবস্থা শুধু ফিলিস্তিনের জন্য বিপজ্জনক নয়; এটি পুরো মধ্যপ্রাচ্য, কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক আইনকে চ্যালেঞ্জ করছে। রাষ্ট্রীয় হত্যার হুমকি, ফিলিস্তিনের জনগণের অস্তিত্ব অস্বীকৃতি এবং জাতিসংঘকে হুমকি—সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পরীক্ষা করছে। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব থাকে, জাতিসংঘ কার্যকর পদক্ষেপ না নিক, তবে ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্ররা জানবে যে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এতে ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্রহীন হবে, তাদের নেতৃত্ব দুর্বল হবে এবং আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের ধারণা অন্ধকারে ঢাকা পড়বে। এই সংকট কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বৈশ্বিক নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের কাঠামোর জন্য বড় পরীক্ষা।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি কেবল ভূরাজনৈতিক নয়; এটি নৈতিক, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ না করে, পরিস্থিতি আরও সংকীর্ণ ও বিপজ্জনক হবে। রাষ্ট্রীয় হত্যার হুমকি, জাতিসংঘের ওপর চাপ, ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব অস্বীকার—সব মিলিয়ে বিশ্বকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করছে। এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। নইলে শুধু ফিলিস্তিন নয়, বৈশ্বিক নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের ভিত্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সর্বোপরি ইসরায়েলের এই হুমকি শুধু একটি উগ্রমনা নেতার বক্তৃতা নয়; এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তির অমোঘ প্রভাবের উদাহরণ। এটি রাষ্ট্রীয় নীতি, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের কার্যকারিতা পুনর্মূল্যায়নের তাগিদ দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রাধান্য কি তারা নিশ্চিত করবে, নাকি শক্তিশালী রাষ্ট্রের উসকানি ও হত্যার হুমকি নিয়ে নীরব থাকবে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার
সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তন আর শুধুই পরিবেশ সংরক্ষণ বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার সীমিত পরিসরে আবদ্ধ কোনো ইস্যু নয়; বরং এটি ক্রমেই একটি কাঠামোগত বৈশ্বিক সংকটে রূপান্তরিত হয়েছে, যার প্রভাব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, সীমান্ত নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রচলিত নীতিমালার ওপর সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে। শিল্পায়ন-উত্তর বিশ্বব্যবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নিঃসরণ ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন আজ এমন এক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে, যা আধুনিক রাষ্ট্রের অস্তিত্বগত ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

বিশেষত, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে সমুদ্রস্তরের ক্রমবর্ধমান উত্থান বিশ্বের বহু নিম্নভূমি ও দ্বীপরাষ্ট্রের জন্য এক গভীর অস্তিত্ববাদী সংকটের জন্ম দিয়েছে। উপকূলীয় ক্ষয়, লবণাক্ততার বিস্তার, পানযোগ্য পানির ঘাটতি এবং ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস—এই সম্মিলিত প্রভাব দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জনবসতি, কৃষি উৎপাদনব্যবস্থা ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করছে। এর ফলে নিরাপত্তা-ধারণা আর শুধু সামরিক সক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং খাদ্যনিরাপত্তা, মানবনিরাপত্তা এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য উপাদানে পরিণত হচ্ছে।

মালদ্বীপ, কিরিবাতি, টুভালু, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ কিংবা বঙ্গোপসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলের মতো অঞ্চলগুলোতে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে ভূমি হারানোর আশঙ্কা নিছক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বিবেচ্য নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা, নাগরিকত্বের ধারাবাহিকতা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মতো মৌলিক রাষ্ট্রীয় প্রশ্ন উত্থাপন করছে। কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ড যদি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়, তবে সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, তার সমুদ্রসীমা, এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) এবং সামুদ্রিক সম্পদের ওপর অধিকার কীভাবে সংরক্ষিত থাকবে—এই প্রশ্নগুলোর সুস্পষ্ট উত্তর আন্তর্জাতিক আইনের বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে এখনো অনুপস্থিত।

পরিবেশগত সংকট থেকে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেলের বিভিন্ন মূল্যায়ন প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হয়েছে যে গত এক শতাব্দীতে বৈশ্বিক সমুদ্রস্তর উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও ত্বরান্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বরফগলন, তাপীয় সম্প্রসারণ এবং চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনাবলির ফলে উপকূলীয় ক্ষয় ও লবণাক্ততার বিস্তার দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর কৃষি, পানীয় জল এবং মানববসতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর পরিণতিতে কিছু রাষ্ট্র কার্যত ‘ডুবে যাওয়া রাষ্ট্র’তে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।

দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব সংকট

রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান—ভূখণ্ড, জনসংখ্যা, সরকার ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি—এর মধ্যে ভূখণ্ড যদি স্থায়ীভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের আইনগত অস্তিত্ব ও মর্যাদা কীভাবে নির্ধারিত হবে—এই প্রশ্ন আন্তর্জাতিক আইনের জন্য এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ। সমুদ্রস্তরের উত্থানের ফলে দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর স্থায়ী ভূখণ্ড সংকুচিত হলে তাদের সামুদ্রিক সীমানা, বিশেষত ইইজেড ও সামুদ্রিক সম্পদের অধিকার নিয়ে নতুন ধরনের আইনি ও ভূরাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সীমান্ত ও সম্পদকেন্দ্রিক বিরোধ এবং শক্তির পুনর্বিন্যাস অনিবার্য হয়ে ওঠে।

জলবায়ু শরণার্থী

সমুদ্রস্তরের উচ্চতার অন্যতম গভীর মানবিক পরিণতি হলো জলবায়ু শরণার্থী সংকটের উদ্ভব। দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠী যখন নিজ ভূমিতে বসবাসের সক্ষমতা হারায়, তখন তারা অভ্যন্তরীণ অথবা আন্তর্জাতিক অভিবাসনে বাধ্য হয়। তবে আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনে ‘জলবায়ু শরণার্থী’ নামে কোনো স্বীকৃত শ্রেণি না থাকায় এসব বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী আইনি সুরক্ষা, নাগরিক অধিকার ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে একধরনের আইনগত শূন্যতার মুখোমুখি হয়।

এই বাস্তুচ্যুতি শুধু মানবিক সংকটেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এটি গন্তব্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য সামাজিক চাপ, অর্থনৈতিক বোঝা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাঝুঁকিরও সৃষ্টি করে। দক্ষিণ এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকার উপকূলীয় দেশগুলোতে এর ভূরাজনৈতিক অভিঘাত ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতা

জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় জোট জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নীতিকাঠামো ও অর্থনৈতিক তহবিল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও, দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব সংকট মোকাবিলায় এখনো কোনো বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক আইনগত ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর ঐতিহাসিক কার্বন নিঃসরণের দায় স্বীকার এবং ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোর ন্যায্য ক্ষতিপূরণের দাবির মধ্যে দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে প্রায়ই অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে কিছু দ্বীপরাষ্ট্র বিকল্প কূটনৈতিক কৌশল অনুসরণ করছে—যেমন ডিজিটাল সার্বভৌমত্বের ধারণা, বিদেশে ভূমি ক্রয়, কিংবা ‘রাষ্ট্র নির্বাসনে’ থাকার তাত্ত্বিক প্রস্তাব। এসব উদ্যোগ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাকে নতুনভাবে পুনর্বিবেচনার সুযোগ সৃষ্টি করছে।

ভবিষ্যৎ ভূরাজনৈতিক অভিঘাত

সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি বিশ্বরাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য পুনর্গঠনের সম্ভাবনা বহন করে। সামুদ্রিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, নৌপথের নিরাপত্তা, সামরিক ঘাঁটির কৌশলগত অবস্থান এবং মানবিক হস্তক্ষেপ—সব ক্ষেত্রেই জলবায়ু পরিবর্তন এক নীরব কিন্তু গভীর ভূরাজনৈতিক চালিকাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ ও কূটনীতির প্রচলিত ধারণার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘জলবায়ু নিরাপত্তা’ নামক নতুন এক কৌশলগত বাস্তবতা।

কাজেই, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জন্য নিছক পরিবেশগত দুর্যোগ নয়; এটি তাদের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব, নিরাপত্তাকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মৌলিক ভিত্তিকে গভীরভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। জলবায়ু শরণার্থী সংকট এবং সমুদ্রসীমা ঘিরে উদ্ভূত বিরোধ ভবিষ্যৎ ভূরাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য অধ্যায়ে পরিণত হবে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব সহানুভূতিশীল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কার্যকর ও বাধ্যতামূলক আইনগত কাঠামো, ন্যায্য কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং দায়বদ্ধ বৈশ্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার দ্বীপরাষ্ট্রগুলো ইতিহাসের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে না গিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের পূর্ণ মর্যাদাসম্পন্ন অংশ হিসেবে টিকে থাকতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত