বিভুরঞ্জন সরকার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশকে উদ্ধৃত করে রাজনৈতিক আলোচনা করা পাঠকের কাছে ভালো না-ও লাগতে পারে। কারণ তাঁরা রাজনীতির মানুষ ছিলেন না। তারপরও আজ রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ উদ্ধৃত করেই রাজনীতির ওপর সামান্য আলোকপাতের চেষ্টা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজনীতির মানুষ না হয়েও রাজনৈতিক ইস্যুতে কথা বলেছেন, মতামত দিয়েছেন। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি:
‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস্, এবং নিজের বাক্চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।’
এই উক্তি শুধু সাহিত্যিক অভিব্যক্তি নয়, এটি এক গভীর আত্মসমালোচনা, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন কবি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল দুর্বলতাগুলোই যেন এখানে একে একে তুলে ধরেছেন—আমরা বড় বড় পরিকল্পনা করি, কিন্তু সেগুলো শেষ করতে পারি না; আড়ম্বর ও জাঁকজমকের বহর দেখাই, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে; আদর্শের কথা বলি, কিন্তু তা বিশ্বাস করি না, আর যদি বিশ্বাস করিও, তবে তা পালন করার মানসিকতা আমাদের থাকে না।
রাজনীতিতে বক্তৃতার বিশাল প্রভাব আছে, কিন্তু সেই বাক্যের পেছনে ত্যাগের মানসিকতা কম দেখা যায়। আমরা রাজনীতিবিদদের মধ্যে দায়িত্ব পালনের আগ্রহের চেয়ে নিজেদের প্রচার ও মর্যাদা রক্ষার প্রবণতাই বেশি লক্ষ করি। যোগ্যতাকে গুরুত্ব না দিয়ে আমরা অহংকার প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, নিজের স্বার্থ সংরক্ষণে অধিক মনোযোগ দিই। অথচ দেশের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যোগ্যতার বিকল্প নেই। যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়া সঠিক নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র ও আনুগত্যের ভিত্তিতেই নেতৃত্ব বাছাই হয়, ফলে প্রকৃত দক্ষ নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরনির্ভরতা একটি বড় সমস্যা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমরা প্রায়ই দেখেছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকার নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধানের চেয়ে বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটানোর জন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা, সমঝোতা বা কৌশল নির্ধারণের পরিবর্তে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ বা ইঙ্গিতের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকা হয়। এই মনোভাব আমাদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতাকে দুর্বল করে তোলে এবং একটি পরনির্ভরশীল মানসিকতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সত্যকে আড়াল করার প্রবণতাও প্রবল। জনগণের চাহিদা পূরণ না করেও একধরনের প্রচারনির্ভর রাজনীতি চর্চা করা হয়, যেখানে নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করে শুধু সাফল্যের গল্প প্রচার করা হয়। অধিকাংশ রাজনীতিবিদ ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন, বর্তমান নিয়ে মাতামাতি, দূরে নজর যায় না। বাস্তবতা যত কঠিনই হোক, প্রচারণায় তাকে উজ্জ্বল করে তোলা হয়, অথচ সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মানে তার কোনো প্রতিফলন থাকে না। এভাবে রাজনীতি অনেক সময় সত্যের বিকৃত উপস্থাপনে পরিণত হয়।
এই প্রবণতা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে যখন রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের কথার মায়াজালে নিজেরাই আবদ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করতে শুরু করেন এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গাটি হারিয়ে গিয়ে এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা ও আত্মতুষ্টির মধ্যে আটকে পড়েন। ফলে বাস্তব উন্নতির পরিবর্তে কেবল কথার ফুলঝুরি দেখা যায়, যার বাস্তব কোনো ভিত্তি থাকে না।
রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্লেষণ কেবল ব্যক্তিগত বা সামাজিক সমালোচনা নয়, এটি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীর অসংগতি তুলে ধরে। যদি আমরা সত্যিই রাজনীতিকে জনকল্যাণমুখী করতে চাই, তবে এই প্রবণতাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয় আনতে হবে, আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে তা অনুসরণ করতে হবে, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব বাছাই করতে হবে এবং পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে স্বনির্ভর রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা ও আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে মুক্তির মধ্য দিয়েই কেবল বাংলাদেশ সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও উন্নত রাজনৈতিক কাঠামোর দিকে এগিয়ে যেতে পারে। অন্যথায়, রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি শুধু অতীতের নয়, আমাদের ভবিষ্যতেরও নির্মম সত্য হয়ে থাকবে।
দুই. জীবনানন্দের সঙ্গে রাজনীতির সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা না করে তাঁর কবিতার কয়টি লাইন উদ্ধৃত করে সামান্য কিছু কথা।
‘আরম্ভ হয় না কিছু—সমস্তের তবু শেষ হয়—
কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলো মাটি ঘাসে
তারও বড় ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয়!
যা হয়েছে শেষ হয়; শেষ হয় কোনোদিন যা হবার নয়!’
জীবনানন্দ দাশের কবিতা চিরকালীন অস্তিত্বের হতাশা, ব্যর্থতা ও নশ্বরতার অনুরণন বহন করে। কিন্তু এই নিরাশার মধ্যেও রয়েছে এক গভীর জীবনবোধ, যেখানে রাজনীতির বাস্তবতাও মিশে যায়। রাজনীতির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বহু আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রতিশ্রুতি আর পরিকল্পনা কখনো বাস্তব রূপ নেয়নি বা শুরু হওয়ার আগেই থমকে গেছে। আবার কিছু কিছু ঘটনা একসময় পরিণতি লাভ করলেও তার স্বরূপ বদলে গেছে, উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে কেবল ক্ষমতার খেলা হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দের এই পঙ্ক্তিগুলোর আলোকে আমরা রাজনীতির এই চক্রটিকে আরও গভীরভাবে বুঝতে পারি।
‘আরম্ভ হয় না কিছু—সমস্তের তবু শেষ হয়’—এই চরণ রাজনীতির নিষ্ফল প্রচেষ্টা, অপূর্ণ সম্ভাবনা ও ব্যর্থ আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইতিহাসে বহুবার এমন হয়েছে যে, গণমানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা নেতারা পরিবর্তনের আশা জাগিয়েছেন, পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু জনপ্রত্যাশা পূরণ শেষ পর্যন্ত বাস্তব রূপ নেয়নি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বারবার গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও, ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা এবং একনায়কতন্ত্রের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা থেমে থাকেনি। যে নতুন রাজনৈতিক ধারার কথা বলা হয়, তা কখনোই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না। তেমনি কিছু কিছু রাজনৈতিক উদ্যোগ শুরু হওয়ার আগেই হারিয়ে যায়, ক্ষমতার লড়াই কিংবা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে।
‘কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলো মাটি ঘাসে তারও বড় ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয়’—এই পঙ্ক্তি গভীর হতাশার প্রতিচিত্র। সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র জীবনেও ব্যর্থতার ছায়া থাকে, কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে এই ব্যর্থতা বহুগুণ বড়, বহুগুণ নির্মম। প্রতিদিন মানুষ দেখে কীভাবে বড় বড় প্রতিশ্রুতি, বিপ্লবের স্লোগান, গণতন্ত্রের শপথ কেবলই কাগজে-কলমে থেকে যায়। একজন সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর হয়তো নিজের ব্যক্তিগত জীবনে সীমিত স্বপ্ন দেখেন, সীমিত পরিসরে ব্যর্থ হন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রভাব পড়ে গোটা জনগোষ্ঠীর ওপরে। জীবনানন্দের কথায় সেই ব্যর্থতারই গভীরতা ধরা পড়ে।
‘যা হয়েছে শেষ হয়; শেষ হয় কোনো দিন যা হবার নয়’—এই লাইনটি একধরনের চিরন্তন রাজনৈতিক সত্যকে প্রতিফলিত করে। অনেক কিছুর শেষ ঘটে, কিন্তু যা সত্যিকার অর্থে প্রয়োজন, যা সত্যিকার অর্থে হওয়া উচিত, তা কখনোই পরিপূর্ণতা পায় না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বারবার হয়েছে, কিন্তু কি সত্যিই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? স্বচ্ছ নির্বাচন, সুশাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এগুলো কি সত্যিই কোনো দিন পূর্ণতা পেয়েছে? বরং এগুলোর জন্য লড়াই চলতেই থাকে, শেষ হয় না। আবার, কিছু কিছু ঘটনা ঘটে, যেগুলোর শেষ হওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু তা চলতে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে—দুর্নীতি, স্বৈরাচার, নিপীড়ন, ক্ষমতার অপব্যবহার কখনোই পুরোপুরি বিলীন হয় না।
কবিকল্পনার এই পঙ্ক্তিগুলো শুধু কারও ব্যক্তিগত জীবন নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার এক নিরেট চিত্র হয়ে ওঠে। এখানে রয়েছে ইতিহাসের ব্যর্থতা, বর্তমানের হতাশা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা—যা আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার চক্রাকারে ঘুরতে থাকা নিয়তির কথাই মনে করিয়ে দেয়। এখন যাঁরা নতুন কিছুর স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হিসেবে আশা জাগাচ্ছেন, কিছুদিন পর আমাদের আবার বঙ্কিমচন্দ্রকে ধার করে বলতে হবে না তো—‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ’?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশকে উদ্ধৃত করে রাজনৈতিক আলোচনা করা পাঠকের কাছে ভালো না-ও লাগতে পারে। কারণ তাঁরা রাজনীতির মানুষ ছিলেন না। তারপরও আজ রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ উদ্ধৃত করেই রাজনীতির ওপর সামান্য আলোকপাতের চেষ্টা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজনীতির মানুষ না হয়েও রাজনৈতিক ইস্যুতে কথা বলেছেন, মতামত দিয়েছেন। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি:
‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস্, এবং নিজের বাক্চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।’
এই উক্তি শুধু সাহিত্যিক অভিব্যক্তি নয়, এটি এক গভীর আত্মসমালোচনা, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন কবি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল দুর্বলতাগুলোই যেন এখানে একে একে তুলে ধরেছেন—আমরা বড় বড় পরিকল্পনা করি, কিন্তু সেগুলো শেষ করতে পারি না; আড়ম্বর ও জাঁকজমকের বহর দেখাই, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে; আদর্শের কথা বলি, কিন্তু তা বিশ্বাস করি না, আর যদি বিশ্বাস করিও, তবে তা পালন করার মানসিকতা আমাদের থাকে না।
রাজনীতিতে বক্তৃতার বিশাল প্রভাব আছে, কিন্তু সেই বাক্যের পেছনে ত্যাগের মানসিকতা কম দেখা যায়। আমরা রাজনীতিবিদদের মধ্যে দায়িত্ব পালনের আগ্রহের চেয়ে নিজেদের প্রচার ও মর্যাদা রক্ষার প্রবণতাই বেশি লক্ষ করি। যোগ্যতাকে গুরুত্ব না দিয়ে আমরা অহংকার প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, নিজের স্বার্থ সংরক্ষণে অধিক মনোযোগ দিই। অথচ দেশের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যোগ্যতার বিকল্প নেই। যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়া সঠিক নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র ও আনুগত্যের ভিত্তিতেই নেতৃত্ব বাছাই হয়, ফলে প্রকৃত দক্ষ নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরনির্ভরতা একটি বড় সমস্যা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমরা প্রায়ই দেখেছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকার নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধানের চেয়ে বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটানোর জন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা, সমঝোতা বা কৌশল নির্ধারণের পরিবর্তে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ বা ইঙ্গিতের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকা হয়। এই মনোভাব আমাদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতাকে দুর্বল করে তোলে এবং একটি পরনির্ভরশীল মানসিকতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সত্যকে আড়াল করার প্রবণতাও প্রবল। জনগণের চাহিদা পূরণ না করেও একধরনের প্রচারনির্ভর রাজনীতি চর্চা করা হয়, যেখানে নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করে শুধু সাফল্যের গল্প প্রচার করা হয়। অধিকাংশ রাজনীতিবিদ ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন, বর্তমান নিয়ে মাতামাতি, দূরে নজর যায় না। বাস্তবতা যত কঠিনই হোক, প্রচারণায় তাকে উজ্জ্বল করে তোলা হয়, অথচ সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মানে তার কোনো প্রতিফলন থাকে না। এভাবে রাজনীতি অনেক সময় সত্যের বিকৃত উপস্থাপনে পরিণত হয়।
এই প্রবণতা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে যখন রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের কথার মায়াজালে নিজেরাই আবদ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করতে শুরু করেন এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গাটি হারিয়ে গিয়ে এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা ও আত্মতুষ্টির মধ্যে আটকে পড়েন। ফলে বাস্তব উন্নতির পরিবর্তে কেবল কথার ফুলঝুরি দেখা যায়, যার বাস্তব কোনো ভিত্তি থাকে না।
রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্লেষণ কেবল ব্যক্তিগত বা সামাজিক সমালোচনা নয়, এটি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীর অসংগতি তুলে ধরে। যদি আমরা সত্যিই রাজনীতিকে জনকল্যাণমুখী করতে চাই, তবে এই প্রবণতাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয় আনতে হবে, আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে তা অনুসরণ করতে হবে, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব বাছাই করতে হবে এবং পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে স্বনির্ভর রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা ও আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে মুক্তির মধ্য দিয়েই কেবল বাংলাদেশ সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও উন্নত রাজনৈতিক কাঠামোর দিকে এগিয়ে যেতে পারে। অন্যথায়, রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি শুধু অতীতের নয়, আমাদের ভবিষ্যতেরও নির্মম সত্য হয়ে থাকবে।
দুই. জীবনানন্দের সঙ্গে রাজনীতির সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা না করে তাঁর কবিতার কয়টি লাইন উদ্ধৃত করে সামান্য কিছু কথা।
‘আরম্ভ হয় না কিছু—সমস্তের তবু শেষ হয়—
কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলো মাটি ঘাসে
তারও বড় ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয়!
যা হয়েছে শেষ হয়; শেষ হয় কোনোদিন যা হবার নয়!’
জীবনানন্দ দাশের কবিতা চিরকালীন অস্তিত্বের হতাশা, ব্যর্থতা ও নশ্বরতার অনুরণন বহন করে। কিন্তু এই নিরাশার মধ্যেও রয়েছে এক গভীর জীবনবোধ, যেখানে রাজনীতির বাস্তবতাও মিশে যায়। রাজনীতির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বহু আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রতিশ্রুতি আর পরিকল্পনা কখনো বাস্তব রূপ নেয়নি বা শুরু হওয়ার আগেই থমকে গেছে। আবার কিছু কিছু ঘটনা একসময় পরিণতি লাভ করলেও তার স্বরূপ বদলে গেছে, উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে কেবল ক্ষমতার খেলা হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দের এই পঙ্ক্তিগুলোর আলোকে আমরা রাজনীতির এই চক্রটিকে আরও গভীরভাবে বুঝতে পারি।
‘আরম্ভ হয় না কিছু—সমস্তের তবু শেষ হয়’—এই চরণ রাজনীতির নিষ্ফল প্রচেষ্টা, অপূর্ণ সম্ভাবনা ও ব্যর্থ আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইতিহাসে বহুবার এমন হয়েছে যে, গণমানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা নেতারা পরিবর্তনের আশা জাগিয়েছেন, পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু জনপ্রত্যাশা পূরণ শেষ পর্যন্ত বাস্তব রূপ নেয়নি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বারবার গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও, ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা এবং একনায়কতন্ত্রের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা থেমে থাকেনি। যে নতুন রাজনৈতিক ধারার কথা বলা হয়, তা কখনোই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না। তেমনি কিছু কিছু রাজনৈতিক উদ্যোগ শুরু হওয়ার আগেই হারিয়ে যায়, ক্ষমতার লড়াই কিংবা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে।
‘কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলো মাটি ঘাসে তারও বড় ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয়’—এই পঙ্ক্তি গভীর হতাশার প্রতিচিত্র। সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র জীবনেও ব্যর্থতার ছায়া থাকে, কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে এই ব্যর্থতা বহুগুণ বড়, বহুগুণ নির্মম। প্রতিদিন মানুষ দেখে কীভাবে বড় বড় প্রতিশ্রুতি, বিপ্লবের স্লোগান, গণতন্ত্রের শপথ কেবলই কাগজে-কলমে থেকে যায়। একজন সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর হয়তো নিজের ব্যক্তিগত জীবনে সীমিত স্বপ্ন দেখেন, সীমিত পরিসরে ব্যর্থ হন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রভাব পড়ে গোটা জনগোষ্ঠীর ওপরে। জীবনানন্দের কথায় সেই ব্যর্থতারই গভীরতা ধরা পড়ে।
‘যা হয়েছে শেষ হয়; শেষ হয় কোনো দিন যা হবার নয়’—এই লাইনটি একধরনের চিরন্তন রাজনৈতিক সত্যকে প্রতিফলিত করে। অনেক কিছুর শেষ ঘটে, কিন্তু যা সত্যিকার অর্থে প্রয়োজন, যা সত্যিকার অর্থে হওয়া উচিত, তা কখনোই পরিপূর্ণতা পায় না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বারবার হয়েছে, কিন্তু কি সত্যিই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? স্বচ্ছ নির্বাচন, সুশাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এগুলো কি সত্যিই কোনো দিন পূর্ণতা পেয়েছে? বরং এগুলোর জন্য লড়াই চলতেই থাকে, শেষ হয় না। আবার, কিছু কিছু ঘটনা ঘটে, যেগুলোর শেষ হওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু তা চলতে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে—দুর্নীতি, স্বৈরাচার, নিপীড়ন, ক্ষমতার অপব্যবহার কখনোই পুরোপুরি বিলীন হয় না।
কবিকল্পনার এই পঙ্ক্তিগুলো শুধু কারও ব্যক্তিগত জীবন নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার এক নিরেট চিত্র হয়ে ওঠে। এখানে রয়েছে ইতিহাসের ব্যর্থতা, বর্তমানের হতাশা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা—যা আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার চক্রাকারে ঘুরতে থাকা নিয়তির কথাই মনে করিয়ে দেয়। এখন যাঁরা নতুন কিছুর স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হিসেবে আশা জাগাচ্ছেন, কিছুদিন পর আমাদের আবার বঙ্কিমচন্দ্রকে ধার করে বলতে হবে না তো—‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ’?
চীনের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা পাওয়া গেলে তিস্তা নদীর ড্রেজিং, নদী ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। চীনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের কৃষি, জ্বালানি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।
৬ ঘণ্টা আগেঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান।
১ দিন আগেই-মেইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামের যুগেও পাঠক সংবাদপত্রে চিঠি লেখেন—এটাই প্রমাণ করে, মুদ্রিত শব্দের আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। দ্রুত বদলে যাওয়া যোগাযোগের মাধ্যমের ভিড়েও কিছু কথা থাকে, যা কাগজে ছাপা হয়ে আলো ছড়ায়।
৩ দিন আগেঅপারেশন সার্চলাইটের নৃশংসতায় তখন আকাশে উড়ছে শকুন। রাজপথে চিৎকার করছে কুকুর। আকাশে ‘কা কা’ করে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে কাকেরা বুঝিয়ে দিচ্ছে, সোনার বাংলাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে পাকিস্তানি হানাদারেরা।
৩ দিন আগে