হুসাইন আহমদ
কোটা সংস্কার আন্দোলনের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানো নজিরবিহীন অভ্যুত্থান। এর অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে সবচেয়ে আলোচিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার ও জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে বেশ শোরগোল উঠলেও তা স্তিমিত হয়ে রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্কগুলো এখন মূলত জাতীয় নির্বাচন ঘিরেই হচ্ছে। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ দিয়ে আসছে। সেই চাপ আরও ঘনীভূত হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ওঠার পর।
অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অংশের নেতৃত্বে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠিত হয়েছে। তারপর দুটি সংগঠন মিলে অভ্যুত্থানের পক্ষের প্রধান শক্তি হিসেবে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনা থাকলেও দৃশ্যত বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর চাপের কারণে অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদাতাদের দল আনার ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করতে হয়েছে। এই শক্তির প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘমেয়াদি হবে এবং তারা সরকারে থেকেই ভেতরে-ভেতরে দল গোছাবে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক মহলের বুঝতে দেরি হয়নি। সংগত কারণে শুরু থেকেই সরকারের অংশ হয়ে বা ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে (যেটাকে ‘কিংস পার্টি’ বলা হয়) রাজনৈতিক দল গঠনের নৈতিকতা ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে অনেকটা তড়িঘড়ি করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে হচ্ছে। ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নাম ঠিক হয়েছে এই দলের। নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক করে দলের শীর্ষ পদগুলোও চূড়ান্ত হয়েছে। নাহিদ এরই মধ্যে তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সমন্বয়ে এই দলের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের শক্তির এই রাজনৈতিক দলটির চরিত্র কেমন হবে, এটি কি একটি গতানুগতিক দল হবে নাকি নতুন কোনো দল হবে, এটি আদর্শভিত্তিক হবে নাকি কৌশলভিত্তিক হবে—এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ আর কৌতূহল আছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক পরিসরে আশাবাদ ও শঙ্কা—দুটোই আছে।
দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে জর্জরিত আওয়ামী লীগের দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটার পর তরুণদের কাছে দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশা। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে এই শক্তি ভূমিকা রাখবে—বলা যায়, এটা সাধারণভাবে জনগণের প্রত্যাশা।
তবে গণ-অভ্যুত্থানের পর এই তরুণ নেতৃত্ব যেসব রাজনৈতিক বক্তব্য হাজির করেছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কার কমিশন সংবিধান সংস্কারের যেসব প্রস্তাব করেছে, তাতে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের মূলনীতি পরিবর্তনের আশঙ্কা করছেন অনেকে। বিশেষ করে ‘বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি’ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব বড় উদ্বেগের সৃষ্টি করছে।
আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দায় সংবিধানের ওপর চাপিয়ে বাঙালি জাতির দুই দশকের সংগ্রামের ফসল বাহাত্তরের সংবিধানকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন অনেকে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের দুর্নীতি-অনিয়ম, দুঃশাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর চাপানোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির ছায়া দেখছেন তাঁরা।
শুধু তা-ই নয়, এই তরুণ শক্তি-সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তা-ও খুব আশা জাগানোর মতো কিছু দেখাতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে দুরবস্থা মানুষের মনে ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে এই নেতৃত্ব কোন আদর্শ ও নীতিতে ভর করে নতুন রাজনৈতিক দল গড়বে, তা নিয়ে এখন জোর আলোচনা চলছে।
ইতিমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি নতুন সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটির ব্যানারে সংগঠিত হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সংগঠন দুটি এরই মধ্যে বলে দিয়েছে, তাদের নতুন দল হবে মধ্যমপন্থী।
এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো নেই। তবে দুটি সংগঠনের নেতারা গণমাধ্যমে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায়, এই দলটি আদর্শের চেয়ে হয়তো কৌশলকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ, বাস্তবতা বলছে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। সেই প্রেক্ষাপটে এই শক্তি যদি কোনো বিপ্লবী শক্তি না হয়, নিশ্চিতভাবেই তার লক্ষ্য হবে ভোটের রাজনীতি। নেতাদের বক্তব্যের মধ্যেও তেমন একটি কৌশলেরই আঁচ পাওয়া যায়।
তাঁরা ডানপন্থী ও বামপন্থী চিন্তাধারার বাইরে নতুন মধ্যপন্থী রাজনীতির কথা বলছেন, বাংলাদেশের স্বার্থের রাজনীতি ও স্বনির্ভর পররাষ্ট্রনীতির কথা বলছেন। দলটির সদস্যসচিব হিসেবে আখতার হোসেনের বক্তব্যে তা ফুটে উঠেছে। তার সঙ্গে মানুষের অধিকার ও মর্যাদার আদায়ের প্রচেষ্টাও কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। (বিডিনিউজ, ২৮ ফেব্রুয়ারি)
উদারপন্থী, ইসলামপন্থী, ডানপন্থী, বামপন্থী এবং রাষ্ট্র সংস্কারপন্থীদের সম্মিলন ঘটিয়ে মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলের ধারণা আগে থেকেই ছিল নাগরিক কমিটির। এর মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ‘বাঙালি-বাংলাদেশি’ বিভাজনকে তাঁরা সামনে আনতে চান না।
দলের নীতি-আদর্শ নিয়ে নাহিদ ইসলামের থেকে তেমন কোনো বক্তব্য আসেনি। এর বাইরে পুরো দলের সাংগঠনিক কাঠামোয় নানা মত, পথ ও রাজনৈতিক আদর্শের অনেকে যুক্ত হচ্ছেন। জাতীয়তাবাদী থেকে শুরু করে ধর্মীয়, এমনকি রাজনীতিতে ধর্ম চান না—এমন আদর্শের তরুণেরাও আছেন এর মধ্যে। আবার রাজনীতিতে দলগুলোর আদর্শিক বৈরিতাও প্রবল। ফলে আদর্শকে পাশ কাটিয়ে অনেকটা কৌশল আশ্রয়ী দল গঠনের প্রেক্ষাপট বোঝা কঠিন নয়।
আদর্শিক বিভাজন এড়াতে সেক্যুলারিজম, ধর্ম বা জাতীয়তাবাদ—এ রকম কোনো আদর্শিক ধারার মধ্যেই ঢুকতে চান না তাঁরা। আন্দোলনের প্রশ্নে এই ধরনের অবস্থান ‘সমঝোতা’ বলা হয়, কিন্তু একটা অভ্যুত্থানের শক্তির দল গঠনের ক্ষেত্রে এই অবস্থানকে ‘আপসকামী বা সুবিধাবাদী’ হিসেবে দেখার সুযোগ আছে। নতুন রাষ্ট্র পরিচালনাকারী শক্তির মধ্যে এই ধরনের দুর্বলতা থাকলে স্থিতিশীল রাষ্ট্র সম্ভব নয়। নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব বড় বিভক্তির কারণ যদি না-ও হয়, আদর্শিক বিভক্তির সমাধান খুঁজে পাওয়া কঠিন।
এটা যে কঠিন, তার আলামত এরই মধ্যে মিলেছে, পুরোটা সময় দল গঠনের প্রস্তুতি সুশৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে নিলেও শেষ দিকে এসে ছন্দপতন ঘটেছে। পদ ও নেতৃত্ব নিয়ে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কিছুটা টানাপোড়েন প্রকাশ্যে আসে। দল ঘোষণার আগের রাতেও ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ও ‘সম্মানজনক’ পদপ্রত্যাশী সতীর্থদের মধ্যে কিছুটা স্নায়বিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। এই শক্তির নতুন ছাত্রসংগঠনের আত্মপ্রকাশের দিন মারামারি হয়েছে এবং পরদিন এই কমিটি থেকে বেশ কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন। দলের ক্ষেত্রে সেটি যে ঘটবে না, তা বলা কঠিন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যেমন সব মত-পথ ও দলের নেতা-কর্মীরা অংশ নিয়েছিলেন, সেই নেতা-কর্মীদের একটা অংশই যুক্ত হচ্ছেন নতুন দলে। কিন্তু এর বাইরে সাবেক ছাত্রশিবির, বামপন্থী কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক ধারা থেকে আসা ব্যক্তিরাও যুক্ত হয়েছেন। ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের লোকজন এক দলে আসার পর সেটা নতুন দ্বন্দ্বের কারণ তৈরি করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন সেটা স্বীকারও করেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘বাম-ডানের বিভক্তি, ধর্মীয় বিভক্তি’ নিয়ে বাংলাদেশের সব মানুষকে একত্র করা যাবে না। মানুষের সংকট বুঝে একত্রিতভাবে অধিকারের জন্য লড়বেন তাঁরা। (বিবিসি বাংলা, ২৮ ফেব্রুয়ারি)। কিন্তু এর জন্য যে সমাধানের কথা বলা হচ্ছে, তা একটি দল গঠনের জন্য মোটেই পর্যাপ্ত নয়।
সামান্তা বলছেন, বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে ‘মতাদর্শ জরুরি না’। এই বক্তব্যের মধ্যে ফাঁক আছে। কারণ, ধর্মীয় বিভক্তি এড়াতে হলে রাষ্ট্রের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ চরিত্র জরুরি। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, সম্ভাব্য নতুন দলটি আদর্শের প্রশ্নকে দূরে রাখার কৌশল নিয়েছে। আদর্শগত জায়গায় বড় ফাঁক রেখে কি সুসংহত দল গঠন সম্ভব? এবং আদৌ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন সম্ভব কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। নতুন দল প্রকৃতপক্ষে আদর্শভিত্তিক হবে, নাকি গতানুগতিক ভোটের রাজনীতির কৌশল নেবে, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকবে বাংলাদেশের জনগণ।
লেখক:
সহকারী বার্তা সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
কোটা সংস্কার আন্দোলনের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানো নজিরবিহীন অভ্যুত্থান। এর অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে সবচেয়ে আলোচিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার ও জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে বেশ শোরগোল উঠলেও তা স্তিমিত হয়ে রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্কগুলো এখন মূলত জাতীয় নির্বাচন ঘিরেই হচ্ছে। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ দিয়ে আসছে। সেই চাপ আরও ঘনীভূত হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ওঠার পর।
অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অংশের নেতৃত্বে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠিত হয়েছে। তারপর দুটি সংগঠন মিলে অভ্যুত্থানের পক্ষের প্রধান শক্তি হিসেবে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনা থাকলেও দৃশ্যত বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর চাপের কারণে অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদাতাদের দল আনার ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করতে হয়েছে। এই শক্তির প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘমেয়াদি হবে এবং তারা সরকারে থেকেই ভেতরে-ভেতরে দল গোছাবে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক মহলের বুঝতে দেরি হয়নি। সংগত কারণে শুরু থেকেই সরকারের অংশ হয়ে বা ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে (যেটাকে ‘কিংস পার্টি’ বলা হয়) রাজনৈতিক দল গঠনের নৈতিকতা ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে অনেকটা তড়িঘড়ি করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে হচ্ছে। ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নাম ঠিক হয়েছে এই দলের। নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক করে দলের শীর্ষ পদগুলোও চূড়ান্ত হয়েছে। নাহিদ এরই মধ্যে তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সমন্বয়ে এই দলের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের শক্তির এই রাজনৈতিক দলটির চরিত্র কেমন হবে, এটি কি একটি গতানুগতিক দল হবে নাকি নতুন কোনো দল হবে, এটি আদর্শভিত্তিক হবে নাকি কৌশলভিত্তিক হবে—এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ আর কৌতূহল আছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক পরিসরে আশাবাদ ও শঙ্কা—দুটোই আছে।
দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে জর্জরিত আওয়ামী লীগের দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটার পর তরুণদের কাছে দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশা। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে এই শক্তি ভূমিকা রাখবে—বলা যায়, এটা সাধারণভাবে জনগণের প্রত্যাশা।
তবে গণ-অভ্যুত্থানের পর এই তরুণ নেতৃত্ব যেসব রাজনৈতিক বক্তব্য হাজির করেছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কার কমিশন সংবিধান সংস্কারের যেসব প্রস্তাব করেছে, তাতে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের মূলনীতি পরিবর্তনের আশঙ্কা করছেন অনেকে। বিশেষ করে ‘বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি’ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব বড় উদ্বেগের সৃষ্টি করছে।
আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দায় সংবিধানের ওপর চাপিয়ে বাঙালি জাতির দুই দশকের সংগ্রামের ফসল বাহাত্তরের সংবিধানকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন অনেকে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের দুর্নীতি-অনিয়ম, দুঃশাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর চাপানোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির ছায়া দেখছেন তাঁরা।
শুধু তা-ই নয়, এই তরুণ শক্তি-সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তা-ও খুব আশা জাগানোর মতো কিছু দেখাতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে দুরবস্থা মানুষের মনে ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে এই নেতৃত্ব কোন আদর্শ ও নীতিতে ভর করে নতুন রাজনৈতিক দল গড়বে, তা নিয়ে এখন জোর আলোচনা চলছে।
ইতিমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি নতুন সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটির ব্যানারে সংগঠিত হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সংগঠন দুটি এরই মধ্যে বলে দিয়েছে, তাদের নতুন দল হবে মধ্যমপন্থী।
এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো নেই। তবে দুটি সংগঠনের নেতারা গণমাধ্যমে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায়, এই দলটি আদর্শের চেয়ে হয়তো কৌশলকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ, বাস্তবতা বলছে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। সেই প্রেক্ষাপটে এই শক্তি যদি কোনো বিপ্লবী শক্তি না হয়, নিশ্চিতভাবেই তার লক্ষ্য হবে ভোটের রাজনীতি। নেতাদের বক্তব্যের মধ্যেও তেমন একটি কৌশলেরই আঁচ পাওয়া যায়।
তাঁরা ডানপন্থী ও বামপন্থী চিন্তাধারার বাইরে নতুন মধ্যপন্থী রাজনীতির কথা বলছেন, বাংলাদেশের স্বার্থের রাজনীতি ও স্বনির্ভর পররাষ্ট্রনীতির কথা বলছেন। দলটির সদস্যসচিব হিসেবে আখতার হোসেনের বক্তব্যে তা ফুটে উঠেছে। তার সঙ্গে মানুষের অধিকার ও মর্যাদার আদায়ের প্রচেষ্টাও কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। (বিডিনিউজ, ২৮ ফেব্রুয়ারি)
উদারপন্থী, ইসলামপন্থী, ডানপন্থী, বামপন্থী এবং রাষ্ট্র সংস্কারপন্থীদের সম্মিলন ঘটিয়ে মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলের ধারণা আগে থেকেই ছিল নাগরিক কমিটির। এর মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ‘বাঙালি-বাংলাদেশি’ বিভাজনকে তাঁরা সামনে আনতে চান না।
দলের নীতি-আদর্শ নিয়ে নাহিদ ইসলামের থেকে তেমন কোনো বক্তব্য আসেনি। এর বাইরে পুরো দলের সাংগঠনিক কাঠামোয় নানা মত, পথ ও রাজনৈতিক আদর্শের অনেকে যুক্ত হচ্ছেন। জাতীয়তাবাদী থেকে শুরু করে ধর্মীয়, এমনকি রাজনীতিতে ধর্ম চান না—এমন আদর্শের তরুণেরাও আছেন এর মধ্যে। আবার রাজনীতিতে দলগুলোর আদর্শিক বৈরিতাও প্রবল। ফলে আদর্শকে পাশ কাটিয়ে অনেকটা কৌশল আশ্রয়ী দল গঠনের প্রেক্ষাপট বোঝা কঠিন নয়।
আদর্শিক বিভাজন এড়াতে সেক্যুলারিজম, ধর্ম বা জাতীয়তাবাদ—এ রকম কোনো আদর্শিক ধারার মধ্যেই ঢুকতে চান না তাঁরা। আন্দোলনের প্রশ্নে এই ধরনের অবস্থান ‘সমঝোতা’ বলা হয়, কিন্তু একটা অভ্যুত্থানের শক্তির দল গঠনের ক্ষেত্রে এই অবস্থানকে ‘আপসকামী বা সুবিধাবাদী’ হিসেবে দেখার সুযোগ আছে। নতুন রাষ্ট্র পরিচালনাকারী শক্তির মধ্যে এই ধরনের দুর্বলতা থাকলে স্থিতিশীল রাষ্ট্র সম্ভব নয়। নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব বড় বিভক্তির কারণ যদি না-ও হয়, আদর্শিক বিভক্তির সমাধান খুঁজে পাওয়া কঠিন।
এটা যে কঠিন, তার আলামত এরই মধ্যে মিলেছে, পুরোটা সময় দল গঠনের প্রস্তুতি সুশৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে নিলেও শেষ দিকে এসে ছন্দপতন ঘটেছে। পদ ও নেতৃত্ব নিয়ে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কিছুটা টানাপোড়েন প্রকাশ্যে আসে। দল ঘোষণার আগের রাতেও ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ও ‘সম্মানজনক’ পদপ্রত্যাশী সতীর্থদের মধ্যে কিছুটা স্নায়বিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। এই শক্তির নতুন ছাত্রসংগঠনের আত্মপ্রকাশের দিন মারামারি হয়েছে এবং পরদিন এই কমিটি থেকে বেশ কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন। দলের ক্ষেত্রে সেটি যে ঘটবে না, তা বলা কঠিন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যেমন সব মত-পথ ও দলের নেতা-কর্মীরা অংশ নিয়েছিলেন, সেই নেতা-কর্মীদের একটা অংশই যুক্ত হচ্ছেন নতুন দলে। কিন্তু এর বাইরে সাবেক ছাত্রশিবির, বামপন্থী কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক ধারা থেকে আসা ব্যক্তিরাও যুক্ত হয়েছেন। ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের লোকজন এক দলে আসার পর সেটা নতুন দ্বন্দ্বের কারণ তৈরি করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন সেটা স্বীকারও করেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘বাম-ডানের বিভক্তি, ধর্মীয় বিভক্তি’ নিয়ে বাংলাদেশের সব মানুষকে একত্র করা যাবে না। মানুষের সংকট বুঝে একত্রিতভাবে অধিকারের জন্য লড়বেন তাঁরা। (বিবিসি বাংলা, ২৮ ফেব্রুয়ারি)। কিন্তু এর জন্য যে সমাধানের কথা বলা হচ্ছে, তা একটি দল গঠনের জন্য মোটেই পর্যাপ্ত নয়।
সামান্তা বলছেন, বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে ‘মতাদর্শ জরুরি না’। এই বক্তব্যের মধ্যে ফাঁক আছে। কারণ, ধর্মীয় বিভক্তি এড়াতে হলে রাষ্ট্রের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ চরিত্র জরুরি। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, সম্ভাব্য নতুন দলটি আদর্শের প্রশ্নকে দূরে রাখার কৌশল নিয়েছে। আদর্শগত জায়গায় বড় ফাঁক রেখে কি সুসংহত দল গঠন সম্ভব? এবং আদৌ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন সম্ভব কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। নতুন দল প্রকৃতপক্ষে আদর্শভিত্তিক হবে, নাকি গতানুগতিক ভোটের রাজনীতির কৌশল নেবে, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকবে বাংলাদেশের জনগণ।
লেখক:
সহকারী বার্তা সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
চীনের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা পাওয়া গেলে তিস্তা নদীর ড্রেজিং, নদী ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। চীনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের কৃষি, জ্বালানি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।
৭ ঘণ্টা আগেঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান।
১ দিন আগেই-মেইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামের যুগেও পাঠক সংবাদপত্রে চিঠি লেখেন—এটাই প্রমাণ করে, মুদ্রিত শব্দের আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। দ্রুত বদলে যাওয়া যোগাযোগের মাধ্যমের ভিড়েও কিছু কথা থাকে, যা কাগজে ছাপা হয়ে আলো ছড়ায়।
৩ দিন আগেঅপারেশন সার্চলাইটের নৃশংসতায় তখন আকাশে উড়ছে শকুন। রাজপথে চিৎকার করছে কুকুর। আকাশে ‘কা কা’ করে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে কাকেরা বুঝিয়ে দিচ্ছে, সোনার বাংলাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে পাকিস্তানি হানাদারেরা।
৩ দিন আগে