অবরুদ্ধ দেশের সাংবাদিকতা

প্রেক্ষিত একাত্তর-৫

জাহীদ রেজা নূর  
প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭: ৫৩
জাহীদ রেজা নূর।

করাচি থেকে স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়ার পরই কেবল তাঁর প্রতিবেদন ছাপা হবে—এই শর্তে দ্য সানডে টাইমস রাজি হয়। স্ত্রী ও সন্তানদের বিদেশ সফরের ব্যাপারে সরকার কোনো বাধা দিল না। তখন মাসকারেনহাস সাংকেতিক ভাষায় সানডে টাইমসের এক নির্বাহীকে টেলিগ্রাম পাঠালেন, ‘রপ্তানির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন। সোমবার মাল বোঝাই শুরু।’

এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল, কিন্তু পাকিস্তান সরকার মাসকারেনহাসের দেশত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিল। কীভাবে পাকিস্তান থেকে বের হওয়া যায়, সে চিন্তা করতে থাকলেন তিনি। অবশেষে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাহায্যে তিনি গোপনে একটি বিমানে চড়ে বসেন এবং নিরাপদে লন্ডনে পৌঁছে যান। ধর্মবিশ্বাসে মাসকারেনহাস ছিলেন গোয়ানিজ খ্রিষ্টান। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই তিনি পাকিস্তানের নাগরিক।

মাসকারেনহাস তাঁর দেশে মর্নিং নিউজ পত্রিকায় যে প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন, সেটি অন্য সাত সাংবাদিকতার মতোই দালালিতে পরিপূর্ণ। কারণ, এই প্রতিবেদন লেখার জন্যই পাকিস্তান সরকার তাঁদের পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে লেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলেন।

দ্য সানডে টাইমসে লেখা তাঁর প্রতিবেদনটি ছিল বেদনায় ভরা। ১৩ জুন সানডে টাইমসে মাসকারেনহাসের লেখাটি ছাপা হয় ‘জেনোসাইড’ নামে। বিশাল সে প্রতিবেদনটি পড়লে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটা জেনোসাইডের ব্যাপারে আর সংশয় থাকে না। মাসকারেনহাসের প্রতিবেদন থেকে কিছুটা অংশ তুলে দিচ্ছি।

তিনি লিখেছেন,

“...প্রায় ২০০ গজেরও কম দূরে একটি হাঁটুসমান উঁচু ধানখেতের ভেতর দিয়ে একজন লোককে দৌড়ে পালাতে দেখা যায়।

আমি চিৎকার করে উঠি, ‘আল্লাহর দোহাই, গুলি ছুড়ো না। লোকটি নিরস্ত্র, সে একজন গ্রামবাসী মাত্র।’

রাঠোর আমার দিকে ঘৃণাভরে তাকায় এবং সতর্কতামূলক একটি গুলি ছোড়ে।

লোকটি সবুজ ধানখেতের মাঝে মাথা গুঁজে গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে গেলে দুজন সেপাই তাকে ধরে আনতে ছুটে যায়। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করার আগেই তার কাঁধে রাইফেলের বাঁট দিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দেওয়া হলো।

‘কে তুই?’

‘দয়া করুন সাহেব, আমার নাম আব্দুল বারী। আমি ঢাকার নিউমার্কেটের একজন দর্জি।’

‘আমার কাছে মিথ্যা বলিস না। তুই হিন্দু, দৌড়াচ্ছিলি কেন?’

‘এখন প্রায় কারফিউ শুরুর সময়। আমি তাই বাড়িতে যাচ্ছিলাম।’

‘সত্যি বল, দৌড়াচ্ছিলি কেন?’

লোকটি জবাব দেওয়ার আগেই একজন সেপাই গোপন অস্ত্রের খোঁজে তার গায়ে হাত চালায়। আর অন্য একজন সৈন্য দ্রুত টান মেরে তার লুঙ্গি খুলে ফেলে। হাড় জিরজিরে লোকটি উলঙ্গ হয়ে পড়ায় তার খতনা করা লিঙ্গ দেখা যায়—যা মুসলমান মাত্রের জন্যই বাধ্যতামূলক।

এ থেকে খোলাখুলিভাবে বোঝা যায় যে বারী হিন্দু নয়।

এবার জেরা চলতে থাকে।”

(অনুবাদ সম্পাদনা: দাউদ হোসেন, মূল সংগ্রহ ও সম্পাদনা: ফজলুল কাদের কাদেরী, বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, সংঘ প্রকাশন, ২০০৩। )

এটা হচ্ছে ওই প্রতিবেদনের সবচেয়ে শান্তিময় অংশ। এ ছাড়া প্রতিবেদনে হত্যাকাণ্ডের, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়কে নিকেশ করে দেওয়ার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা নৃশংসতার চূড়ান্ত। যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তাদের বলব এই প্রতিবেদনটি পড়ে নিতে।

প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। ২১ জুন পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোয় ছাপা হয় রিপোর্টটির ব্যাপারে সরকারি মুখপাত্রের ভাষ্য।

সরকারি ভাষ্য ছিল এ রকম:

‘রাওয়ালপিন্ডি, ২০শে জুন, পিপিআই। আজ জনৈক সরকারি মুখপাত্র পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে করাচির মর্নিং নিউজ পত্রিকার সাবেক সহকারী সম্পাদক মিস্টার এন্টনি মাসকারেনহাসের বিবরণকে পূর্ণাঙ্গ নির্ভরযোগ্য বা ফাস্ট হ্যান্ড কোনোটিই নয় বলিয়া আখ্যায়িত করেন। গত ১৩ই জুন লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় এই বিবরণ প্রকাশিত হয়।

সরকারি মুখপাত্র দফাওয়ারীভাবে এই বিবরণ খণ্ডন করিয়া বলেন যে, কুমিল্লা ও ঢাকার আশেপাশের সীমিত এলাকা হইতে পরোক্ষভাবে সংগৃহীত স্রেফ শূন্য কথার উপর ভিত্তি করিয়াই মিস্টার ম্যাসকারেনহাস তাহার এই ডেসপ্যাচ তৈরি করেন।

সরকারি মুখপাত্র বলেন যে, বিদেশি সাংবাদিকরা ম্যাসকারেনহাসের ডেসপ্যাচের বহু আগেই তাহাদের ডেসপ্যাচ পাঠান। তাহাদের এইসব ডেসপ্যাচের সঙ্গে ম্যাসকারেনহাসের বিবরণের তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য রহিয়াছে। এইসব বিদেশী সাংবাদিকের পূর্ব পাকিস্তানের সকল এলাকায় অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল।

মুখপাত্র বলেন যে, গত ২রা মে ঢাকা হইতে প্রেরিত মিস্টার ম্যাসকারেনহাসের পূর্ববর্তী ডেসপ্যাচের সঙ্গে সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত তাহার পরবর্তী ডেসপ্যাচের কোনো সঙ্গতি নাই। ইহাতে প্রমাণিত হয় যে প্রথম ডেসপ্যাচটি চাপ প্রয়োগ করিয়া লেখা হয় নাই অথবা উহা বাস্তব ঘটনার দিক হইতে অসত্য ছিল না।’

আমরা এই অংশটি ২১ জুনের ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠা থেকে নিয়েছি।

মাসকারেনহাস যখন অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে মর্নিং নিউজে খবর পাঠিয়েছেন, তখন তিনি সরকারি ভাষ্যই লিখতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাইরে যাওয়ার পরই কেবল সত্য লিখতে পেরেছেন। এই তথ্য থেকে বোঝা সহজ হবে যে, অবরুদ্ধ বাংলায় বসে বাঙালি সাংবাদিকেরা জীবনের পরোয়া না করে কীভাবে সাংবাদিকতা করে গেছেন।

জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত