সুখবাদী দেশে ভাতের কষ্ট মেশে 

অর্ণব সান্যাল
প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ১১: ৫৫
আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ১৩: ২৪

মানবজীবনে আনন্দ যেমন থাকে, তেমনি থাকে কষ্টও। কিন্তু সুখের চেয়ে দুখের আতিশয্য কি বেশি? হ্যাঁ, আমাদের মতো উল্টো ঘোড়ার পিঠে চলার অঞ্চলে অন্তত তাই। এখানে সুখ আসে কায়ক্লেশে। আর দুখ থাকে রাজার হালে, বহাল তবিয়তে। সেই দুখে হাজারো গন্ধে মিশে থাকে ভাতের কষ্টও। কেউ কেউ মুখ ফুটে বলে, হাত পাতে। আর বাকি অধিকাংশ মুখ বুজে সহ্য করে ভাতের কষ্ট। আচ্ছা, ভাতের কষ্ট বোঝেন তো?

এটা আসলে এমন এক কষ্ট, যা নিজে অনুভব না করলে প্রতিক্রিয়া উগরে দিতে পারবেন না। না, না, অভিমান করে এক বেলা না খেয়ে থাকার কথা বলছি না। ভেবে দেখুন তো, কোনো দিন কি চূড়ান্ত বাধ্য হয়ে টাকার অভাবে না খেয়ে থাকতে হয়েছে? সেই শূন্য পকেটের অসহায়ত্ব চিত্রিত করা যায় না। যার হয়, সেই শুধু বোঝে। বিত্তের শ্রেণিভেদে এমন কষ্টের রূপ আবার রং পাল্টায় গিরগিটির মতো। বিত্তের সর্বনিম্ন শ্রেণি হাত পাততে পারে সব লাজ ভেঙে। কিন্তু মধ্যবিত্ত তা-ও পারে না। এই শ্রেণি খালি পেটে খালি পকেট নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কাজ খোঁজে। আর সূর্য ডোবার পর নিস্পৃহ মনে ভাবে, আহা, একটা দিন তো গেল! কালও কি এভাবেই যাবে? 

পেট ভরানোর জন্য তখন শুরু হয় ভাত খোঁজার অভিযান। আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে হয় ভাত। হ্যাঁ, সে লুকিয়ে থাকে বড্ড। খালি পকেটে পেট খালি রাখার নিয়মেই আমরা বাস করি। আমরাই বেছে নিয়েছি এই নিয়ম। আমরা বুঝতে শিখেছি, ‘এটাই সাইন্স’। রাষ্ট্র, সমাজ, স্কুল-কলেজের বইপত্র, এমনকি প্রায় গোটা বিশ্ব আমাদের শৈশব থেকে এ শিক্ষাই দিয়েছে। অন্যেরটা ‘কপি’ করতে গিয়ে আমরা কিছুটা অদল-বদল করেছি অবশ্য। আর তাতে পুরো বিষয়টা আরও পাশবিক বৈ মানবিক হয়নি। কে পশু আর কে মানুষ, সেই প্রশ্নে আর না যাই বরং। এর বদলে মো. আলমগীর কবিরের ভাতের কষ্টের গন্ধ শুঁকে নেওয়া যাক। তাতে আর কিছু না হোক, বৈষ্যম্যের কড়া ঝাল মিলবে বিলক্ষণ। 

আলমগীরও নেমেছেন ভাত খোঁজার অভিযানে। নিয়ত বিভিন্ন বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা শুনতে শুনতে কানের পোকা নড়ে যাওয়ার সময়েই আমরা দেখতে পাই তাঁর সাঁটানো ভাতের নিখোঁজ সংবাদ। সম্প্রতি এমনই এক বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। তাতে লেখা, ‘শুধুমাত্র দু-বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’। আজকের পত্রিকার খবরে প্রকাশ, টিউশনি পেতে এমন একটি পোস্টার লাগিয়েছেন বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থী মো. আলমগীর কবির। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। এখন লড়াই করে যাচ্ছেন চাকরির জন্য। তবে লড়াইটা যে শুধু চাকরির জন্য নয়, তা পুরো পোস্টারে স্পষ্ট। শুধু দেখার কিছুক্ষণ পর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, এই যা!

আলমগীর কবির তাঁর পোস্টারে লিখেছেন, ‘শুধুমাত্র দু-বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই।’ সকাল ও দুপুরের খাবারের বিনিময়ে তিনি পড়াবেন। এ ছাড়া তিনি লিখেছেন, প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত গণিত বাদে সবকিছুই পড়াবেন। সেই পোস্টারে নিজের পেশা হিসেবে লিখেছেন ‘বেকার’। এতে তাঁর নাম ও মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। 

আজকের পত্রিকার খবর অনুযায়ী, জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। সংসারে টানাটানি আগে থেকেই ছিল। করোনায় তা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। এতটাই যে, একজন উচ্চশিক্ষিত তরুণকে চাকরির পাশাপাশি ভাতও খুঁজতে হচ্ছে। তবে হোটেলে নয়, মানুষের ঘরে। সেই প্রাচীনের বিনিময় প্রথাকে অবলম্বন হিসেবে নিয়ে পেট ভরানোর এই যুদ্ধে শান্তির সাদা পতাকা ওড়াতে পারে শুধু ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের গন্ধ।

আপনাদের মনে হতে পারে, ‘আরে ব্যাটা, এ নিয়ে এত কাব্যের কী আছে?’ আসলে কাব্য নয়, একটু কান্না আর অনেকটা ‘রাগ’ হচ্ছে। এ রাগ উচ্চাঙ্গের নয়। একেবারে গবেট মাথার নিরেট ক্রোধ। যে গবেট মাথা নিয়মিত বিরতিতে বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলনের খবর গলাধঃকরণ করে যায়। তাতে কানে আসে, বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ২ লাখ ১৬ হাজার ৫৮০। আরও শোনে, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) নাকি ৪১১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নাকি ৫০ বিলিয়ন ডলার। সাক্ষরতার হার হয়েছে ৭৫ দশমিক ২ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। আর এতসব বুলি শুনে চোখ দিয়ে দেখতে হয় দুই বেলা ভাতের সন্ধান পেতে একজন স্নাতকোত্তরের লাগানো পোস্টার। আর রাস্তায় নেমে এড়াতে হয় আরও খান কতক বাড়িয়ে দেওয়া হাত।

কেন তাঁকে এমন পোস্টার লাগাতে হলো? আলমগীর বেশ কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন। সরকারি চাকরির পেছনে প্রাণান্ত বিস্কুটদৌড়ের বাস্তবতা দেখিয়েছেন। আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন নিয়োগে আর্থিক লেনদেন, পরিচয়, লবিং ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ের কথা। এসব শুনে পোস্টারে লেখা ‘বেকার’ পেশা গ্রহণে বাধ্য হওয়ার কারণ সহজেই অনুমেয়। আর বেসরকারি চাকরি তো অভিজ্ঞ ছাড়া লোকই নেয় না। নেবেই বা কেন? কাগুজে অভিজ্ঞতার মোড়কে যে ঢের অনভিজ্ঞতাকে গিলে ফেলা যায়। 

অর্ণব সান্যালআলমগীরের সামনে তাই শুধু টিউশনিই সহজলভ্য। সেখানে অন্তত নাশতার বদলে ভাত চাওয়া যায়। কিন্তু এক বেলার ভাতে তো তিন বেলার খিদে মেটে না! তাই নিরুপায় হয়েই পোস্টার সাঁটাতে হয়। কারণ খিদের জ্বালা যে টিকে থাকার অন্তরায় সামাজিক লোকলজ্জাকে ভুলিয়ে দেয়। আর এখানেই হেরে যায় লক্ষ লক্ষ টাকার মাথাপিছু আয়ের গর্ব। ও দিয়ে আর কী হবে? আলমগীরদের পেট তো তাতে ভরে না!

তবু এ দেশে সুখ আছে। কারণ আমরা এখন আছি সুখবাদী এক ব্যবস্থায়, যেখানে জিডিপি বাড়লে স্তুতির নহর বয়ে যায়। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হলেও শোনা লাগে, ‘এ আর এমন কী!’ সুখী হওয়া এখানে ‘লাইনে’ আসার মতো। ভাতের কষ্ট এখানে অচ্ছুতের হট্টগোল। তার পরও সুখের কলসির বেদম দামামার ভিড়ে নিচু স্বরে বেজে যায় অভুক্তের কান্নার সুর। সেখানে তাবৎ ‘স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ ভেংচি কাটে বিচ্ছিরিভাবে। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘সুখবাদী’ কবিতার পঙ্‌ক্তিতে সাজালে বলতে হয়, 

‘...দিগন্তপারে তরঙ্গ-আড়ে যারা হাবুডুবু খায়,
তাদের বেদনা ঢাকে কি বন্ধু, তরঙ্গ-সুষমায়?’   

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

আরও পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত