Ajker Patrika

কোথায় আছি, যাব কোন দিকে

দেশে নির্বাচন কবে হবে, সেটি নিশ্চিত করে কেউ জানে না। এমন অনিশ্চিত সময়ে মানুষ প্রত্যক্ষ করছে খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ। সাধারণ মানুষ কোণঠাসা ইঁদুরের মতো দিনানিপাত করছে। কোনো রকম খেয়েপরে বেঁচে থাকা। কারণ এই সমাজে মানুষ যেভাবে বেঁচে আছে তা বিস্ময়কর!

বিধান রিবেরু
দেশে নির্বাচন কবে হবে, সেটি নিশ্চিত করে কেউ জানে না। ফাইল ছবি
দেশে নির্বাচন কবে হবে, সেটি নিশ্চিত করে কেউ জানে না। ফাইল ছবি

আমরা আমাদের সমাজকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছি, যেখান থেকে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ আর নেই। কোন জায়গায় নিয়ে এসেছি? যে জায়গায় গণতান্ত্রিক চর্চা শূন্যের কোঠায়, যেখানে প্রতিক্রিয়াশীলতার বাড়বাড়ন্ত। একদিকে গণতন্ত্র খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাদের মরিয়া প্রচেষ্টা, অপরদিকে নারীরা সমাজে ধর্ষিত, যারপরনাই নিগৃহীত ও নিষ্পেষিত। আপনারা নিশ্চয় জানেন, সম্প্রতি একজন নারী নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামস, ৯ মাস মহাকাশে থেকে, মহাবিশ্বের অপার সৌন্দর্য ও বিশালত্বকে ছুঁয়ে, মানবসভ্যতার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ সব গবেষণা করে ফিরে এসেছেন ধরণিতে। আর একই সময়ে আমার প্রিয় বাংলাদেশ রক্তাক্ত ও শোকে ম্রিয়মাণ, ধর্ষণের শিকার নারী-শিশুদের মৃত্যু ও অপমানে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। পৈশাচিক ও বর্বরতা শুধু নয়, চলছে নারীর বিরুদ্ধে নানাবিধ নিষেধ ও আজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ার মচ্ছব। ধর্ষণবিরোধী সমাবেশে নারীদের ওপরই চলছে পুলিশি হামলা।

সমাজকে আমরা এমন এক বাগানে এনে দাঁড় করিয়েছি, যেখানে শতফুল ফোটার কোনো সুযোগ নেই। যে বাগানে গণতন্ত্র বলতে লোকে বোঝে ফুল ফুটবে, কিন্তু সবটার রং হবে অভিন্ন। এই প্রত্যাশা এটুকুতে আবদ্ধ থাকলে কোনো সমস্যা ছিল না, সংকট সৃষ্টি হয়েছে, আমরা কোনো ধরনের মতানৈক্য বা মতভেদ সহ্য করতে পারছি না। এমনকি সমাজে যে মতবিরোধগুলো রয়েছে, সেগুলোর ভেতর বিরাজ করছে চরমাবস্থা। বলা যেতে পারে একটি মত, অপর মতের ঠিক বিপরীতে অবস্থান করছে এবং তারা সর্বদা উদগ্রীব থাকছে একে অপরকে নিঃশেষ করে দিতে।

অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে যদি দেখেন, তাহলে দেখা যাবে ধনী-গরিবের বৈষম্য পরাকাষ্ঠা ছুঁয়েছে। রাস্তায় রিকশাচালক পারলে ব্যক্তিগত গাড়িকে ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেয়। সুযোগ পেলে গাড়ি থেকে লোক নামিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তাদের চোখে ক্রোধ, বঞ্চনার আগুন। অপরদিকে, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভেতর থাকা মানুষগুলো চায় রিকশাসমেত রিকশাচালককে পিষে মেরে ফেলতে। তাদের চোখে ঘৃণা, ধনশালী হওয়ার দম্ভ। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখবেন, এক মতাদর্শের লোক আরেক ভাবাদর্শের লোককে মৌখিকভাবে তো বটেই, পারলে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করে। ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে, প্রত্যেকেই ভাবছে তাদের ধর্মটাই শ্রেষ্ঠ, অপরগুলো লঘু, কাজেই তাদের সঙ্গে যা-ইচ্ছা-তাই করা যায়।

একটি সমাজে মতের অমিল থাকবে, মানুষ সেসব মিল ও অমিলের ভেতর ঐক্যের খোঁজ করবে, তারপর একটি মঙ্গলজনক সমাধান খুঁজে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে, সৌহার্দ্য বজায় রেখে সামনে এগিয়ে যাবে। এটাই গণতান্ত্রিক সমাজের রেওয়াজ। কিন্তু আমাদের সমাজের দিকে তাকালে দেখবেন, একদল মনেই করছে নারীর বুকে ওড়না থাকা আবশ্যিক এবং সেটা রাস্তাঘাটে ধরে ধরে নারীদের বলতে হবে। এটা যে ব্যক্তিগত পরিসরের সীমা লঙ্ঘন ও নারীদের উত্ত্যক্ত করা, সেই ধারণাটিই তাদের নেই। গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু নারীদের তারা পর্দার আড়ালে বন্দী করতে চায়। তার চেয়েও বিস্ময়কর, এই একবিংশ শতকে, নারীবিরোধী কূপমণ্ডূক মানসিকতাকে সমর্থন জানিয়ে বহু নারী রাস্তায় নেমে যায় মশাল মিছিল করতে। প্রগতিশীলতার কফিনে এখন শেষ পেরেকটা ঠোকার অপেক্ষা করছি মাত্র। সুনিতারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুরে আসছেন, আর আমরা আমাদের নারীদের যত প্রকারে সম্ভব বন্দী করার চেষ্টা করছি। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়, সমাজ সেটাকে অনুমোদন করছে এবং রাষ্ট্র নারীর প্রতি এহেন বিচার সমর্থন করছে বা মুখ ফুটে বিরোধিতা করছে না। এমনকি সদ্য জন্ম নেওয়া একটি রাজনৈতিক দলের নারী নেত্রীও নারী-পুরুষের সমতা বিষয়ে স্পষ্ট করে কথা বলতে পারছেন না, ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকার চেষ্টা করছেন। এ পরিস্থিতি সত্যিই হতাশাজনক।

সমাজে নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে মতবিরোধ এখন বলা যায় মারমুখী অবস্থার ভেতর আছে। পান থেকে চুন খসলেই তেড়ে আসছে নীতি-পুলিশের দল। ‘মব জাস্টিস’ নামের এক উৎপাত তো আছেই। ডাকাতি করেও এখন লোকে একে ‘মব জাস্টিস’ বলে পার পাওয়ার পাঁয়তারা করছে। অরাজকতাই যেন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অবস্থাও তথৈবচ। কারও ভেতর কোনো শ্রদ্ধা, সহিষ্ণুতা ও উদারতা নেই। একটি দেশে যে ধর্মের মানুষ বেশি থাকে, তাদের তত বেশি দায়িত্বশীল ও সহিষ্ণু হতে হয়। কিন্তু আমরা দেখলাম রমজান মাস চলছে—এই অজুহাতে একদল লোক, ধর্মের দোহাই দিয়ে আরেক দল দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষ, বৃদ্ধ-যুবাদের খাবারের দোকান থেকে টেনে বের করে এনে বেত্রাঘাত করছে, কান ধরে ওঠবস করিয়ে অপদস্থ করছে। এবং এটি করার জন্য প্রকারান্তরে উসকে দেওয়া হয়েছে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে। এটা তারা করতে পারছে কারণ সমাজে এমন জোরজবরদস্তি করার সম্মতি এরই ভেতর তৈরি হয়েছে। হয়েছে বলেই একদল লোক বিশ্বাসের লাঠি নিয়ে নেমে পড়েছে অন্যদের নিজেদের মতো করে ‘সাইজ’ করার অভিপ্রায়ে।

দেশে নির্বাচন কবে হবে, সেটি নিশ্চিত করে কেউ জানে না। এমন অনিশ্চিত সময়ে মানুষ প্রত্যক্ষ করছে খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ। সাধারণ মানুষ কোণঠাসা ইঁদুরের মতো দিনানিপাত করছে। কোনোরকমে খেয়েপরে বেঁচে থাকা। কারণ, এই সমাজে মানুষ যেভাবে বেঁচে আছে তা বিস্ময়কর! রাস্তাঘাটে বের হলেই বোঝা যায়, মানুষ চরম ক্ষিপ্ত, বিক্ষিপ্ত ও অধৈর্য হয়ে আছে। সমাজ যদি অসুস্থ হয়, তবে সমাজের মানুষ কি সুস্থ থাকতে পারে? তিক্ত হলেও আজ এটাই সত্যি—সমাজের লোকজনই এমন এক অসুস্থ সমাজ নির্মাণ করেছে বা নির্মাণে পরোক্ষভাবে মদদ দিয়েছে সঠিক সময়ে পদক্ষেপ না নিয়ে, প্রতিবাদ না করে। এবং শাসকগোষ্ঠী যখন ক্রমেই অন্ধকারের শক্তির সঙ্গে সখ্য বাড়াচ্ছিল, তখন তাদের সমালোচনা না করে, উল্টো চায়ের পেয়ালা ভাগাভাগি করে ক্ষমতার তরল পান করেছে। এখন যখন প্যান্ডোরার বয়াম খুলে গিয়ে ভীষণ বিভীষণ প্রত্যক্ষ করছে সবাই, তখন এই সমাজই পস্তাচ্ছে। এ যেন কর্কটরোগে আক্রান্ত কোনো রোগীর অন্তিম মুহূর্ত চলছে। আর আমরা অপেক্ষা করছি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের। কারণ, এই অপেক্ষা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।

আদতে আমাদের সমাজের ক্লিনিক্যাল ডেথ হয়ে গেছে। পুরোনো সমাজ মরে গেলে, নতুন সমাজ গঠনের আগে দানবিক সময় জন্ম নেয়। আমরা হয়তো সেই সময়টাই অতিক্রম করছি। এই মুহূর্তে নতুন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে পুরোনো সমাজের জন্য শোক করা বন্ধ করতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার দুটি পথ দেখি: এক, মানুষকে যুক্তিশীল ও বিজ্ঞানমনস্ক করতে বেশি বেশি করে গণিত ও বিজ্ঞান জানাতে হবে। এ-সংক্রান্ত আয়োজনে শিশু-কিশোর-যুবকদের যুক্ত করতে হবে। এটি রাষ্ট্র করে দেবে না। ব্যক্তির উদ্যোগেই করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বেশি বেশি করে ভালো ভালো সাহিত্য পড়ানো ও চলচ্চিত্র দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

সামাজিক এই আন্দোলন শুরুর পাশাপাশি এটা ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের সামাজিক বৈষম্য কমাতে হবে। মনে রাখতে হবে, ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে সামাজিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। যায়নি এত বছরেও। দরিদ্র মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। তারা যেন আরও বেশি পরিশ্রমী ও কর্মঠ হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। আজ চীনের পোশাকশ্রমিকেরা যে দক্ষতা অর্জন করেছে, সেটা যদি বাংলাদেশের শ্রমিকেরা করতে না পারে, আর শুধু ইন্ধন পেয়ে রাস্তায় আন্দোলন করতে থাকে, তাহলে আরও কারখানা বন্ধ হবে, লাখ লাখ লোক বেকার হবে এবং সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। সমাজে যা ঘটে তা কার্যকারণের সূত্র মেনেই ঘটে।

তাই সমাজ ও রাষ্ট্রে সহিষ্ণুতা, উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে যুক্তি ও জ্ঞানের আলোকে মানুষের মনোজগৎ গঠনের পাশাপাশি, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে আন্তরিক হতে হবে। লুটপাটতন্ত্রকে জীবিত রেখে, লোভ-লালসার সঙ্গে আপস করে কখনো ভালো সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা যায় না। আন্দোলন ও সচেতনতার ভেতর দিয়ে যদি আমরা নতুন প্রগতিশীল সমাজ সৃজন করতে পারি, তাহলে রাষ্ট্র স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভালো ফল দিতে শুরু করবে। আপাতত এই আশাই জারি রাখতে হচ্ছে।

লেখক: বিধান রিবেরু

প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হেলিকপ্টারে নেওয়ার অবস্থায় নেই, দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে তামিম

উসকানিতে প্রভাবিত না হতে বললেন সেনাপ্রধান

অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, পালানোকালে আটক ৫ পুলিশ সদস্য

বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের বিরুদ্ধে ৪৭ ব্রিটিশ এমপিকে ‘সন্দেহজনক’ ই-মেইল

১৭ বছরে ভোটার চান ড. ইউনূস, এনসিপির প্রস্তাব ১৬ বছর: যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত