আমিনুল ইসলাম নাবিল ও মৃত্তিকা পণ্ডিত, ঢাকা
‘মুই কথা কই মোর ভাষায়। কাউরে ডরায়া কথা কই না। ভাষা নিয়া ঝামেলার কিছু নাই। যে ঠকবে সে ঠকবে, আর যে জিতবে সে জিতবেই।’ আবদুর রহমান বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে কথাগুলো বললেন। তাঁর চোখ সামনের দিকে, ওপারে। বুড়িগঙ্গার কালো জল কেটে দক্ষ হাতে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন ওপারে। কোন পারে? তাঁর এই কথাগুলো নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। তাই তো, ভাষা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই।
আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শহীদবেদি ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। গোটা জাতি মাতৃভাষার দাবিতে প্রাণ দেওয়া, জীবনের সেরা সময়টি উৎসর্গ করা সব শহীদ ও ভাষাসংগ্রামীকে স্মরণ করছে। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ঢের। কিন্তু কোথায় যেন কী একটা নেই। সেটা কি বুড়িগঙ্গার মাঝি আবদুর রহমানের কণ্ঠে আছে? সম্ভবত।
‘ওপার ১০ টাকা, ওপার ১০...।’ নীল ফুল হাতা গেঞ্জি গায়ে মাঝবয়সের ওপারে থাকা লোকটি জানিয়ে দিচ্ছেন ওপার যেতে হলে ১০ টাকা গুনতে হবে। এটা অবশ্য তাঁর নৌকার বিষয় নয়। জায়গাটা ওয়াইজঘাট; আর ওপার মানে কেরানীগঞ্জ। যেতে ১০ টাকাই তো লাগবে; এটা সবাই জানে। মাথার ওপর আকাশে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব দেখে দ্রুত উঠে পড়ায় আবদুর রহমানের সঙ্গে আলাপটা হলো।
রাজধানী ঢাকা শহর তো বটেই গোটা দেশেই প্রমিত বা মান ভাষার দাপটে আঞ্চলিক ভাষার অনেকটা গুটিয়ে থাকার এই সময়ে আবদুর রহমান বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন, ‘মুই কথা কই মোর ভাষায়। কাউরে ডরায়া কথা কই না।’ এই ঘোষণাটি অনেকেই দিতে পারেন না।
রাজধানী ঢাকার কথাই ধরা যাক। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষেরা মিলেই এখানে নাগরিক সমাজ গড়েছে। কেউ এসেছে চট্টগ্রাম থেকে, কেউ সিলেট, কেউ বরিশাল, কেউ রংপুর, রাজশাহী তো কেউ নোয়াখালী, কুমিল্লা। কেউ এসেছেন পাহাড়ের স্মৃতি নিয়ে এই খটখটে শহরে। তাঁদের সবারই রয়েছে নিজেদের একটি করে ভাষা। না এ-ও বাংলাই, কিন্তু উচ্চারণ ও ব্যবহাররীতিতে কিছু তফাত আছে প্রমিতের থেকে। থাকবে না কেন?
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ১৫-২০ কিলোমিটার পরপর ভাষার পরিবর্তন দেখা দেয়। বাংলাদেশেও অঞ্চলভেদে ভাষার বৈচিত্র্য রয়েছে। নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে মানুষের আত্মার একটা মেলবন্ধন থাকে। আঞ্চলিক ভাষা মিশে থাকে মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে। জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে শিশু প্রথম ভাষা শেখে। সেই ভাষাতেই সে কথা বলা শুরু করে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানা কারণে ধীরে ধীরে মানুষ আর তার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করে না। দেখা গেল নিজস্ব পরিমণ্ডলে আঞ্চলিক ভাষায় অনায়াস লোকটিই আপনি ডাকার সঙ্গে সঙ্গে একেবারে প্রমিত উচ্চারণে সাড়া দিচ্ছেন।
এই যে সাধারণ জনপরিসরে আঞ্চলিক ভাষা বা মায়ের ভাষাটি ব্যবহার করে না, তা কেন। হাজারটা কারণ থাকে। তবে শুরুতেই অনেকে অজুহাত হিসেবে চিরপরিচিত সেই কথাই বলবে—এক দেশের বুলি অন্য দেশে গালি। এ নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে একজন বললেনও এমন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী রবিন ঘোষ। বললেন, ‘আমি বেশির ভাগ সময় আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলি। কিন্তু অনেক সময় আমার আঞ্চলিক ভাষা মানুষ বুঝতে পারে না। তাই তাদের জন্য আমার প্রমিত ভাষা ব্যবহার করতে হয়। কোনো দেশের বুলি অন্য দেশের গালি। মূলত এ জন্যই মানুষ প্রমিত ভাষাটা ব্যবহার করে।’
এটা এক অর্থে সত্য। কিন্তু আরও নানা কারণ নিশ্চয় আছে। একটা হলো জনপরিসরে গ্রহণযোগ্যতা। অনেক সময়ই আঞ্চলিক ভাষা সাধারণ জনপরিসরে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। এ জন্য এমনকি আঞ্চলিক ভাষায় বাউল গান গাওয়া মীনু পাগলীকেও প্রমিত ভাষাতেই যোগাযোগ করতে দেখা যায় সাধারণত। প্রান্তিক মানুষের কথা, গান, সুর, আর ভাষা নিয়ে যাঁর গান, সেই মীনু পাগলি বলেন, ‘ছোট বয়স থেকে আমি গান করি। আমার মনে হয়, আঞ্চলিক ভাষায় গান না গাইলে আমি হয়তো এত মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারতাম না।’
বাউল মীনু পাগলির আঞ্চলিক ভাষার গান মানুষ উপভোগ করলেও তাঁর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা কিন্তু মানুষ সেভাবে গ্রহণ করে না। তাই আঞ্চলিক ভাষায় গান গাইলেও এই শিল্পীকে অনেক সময় প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমি আমার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কিন্তু এখনকার মানুষ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললে ছোটলোক মনে করে। তারা মনে করে, আমি স্টাইল জানি না।’
এই শিল্পী বলেন, ‘আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে যে শান্তি, তা প্রমিত ভাষায় নেই।’ তাঁর মতে, মানুষ স্টাইলের জন্যই প্রমিত ভাষার ব্যবহার করে।
তবে অনেক সময়ই বিষয়টি প্রাত্যহিক জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। অফিস-আদালত তো বটেই ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রেও নিজ ভাষার প্রমিতকরণ করে নিতে হয় মানুষকে। এর যতটা যোগাযোগ, তার চেয়েও বেশি ওই আবদুর রহমান কথিত ‘ঠকা ও জেতার’ সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেকের টিকে থাকাটাই এই ভাষার ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিষয়টি সরাসরি বললেন পুরান ঢাকায় চশমার ব্যবসা করেন আলী আকবর। বিক্রমপুর থেকে ঢাকায় আসা এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘জীবিকার তাগিদে ঢাকায় এসেছি। এখানে এসে যদি সবার সঙ্গে মিলে না চলি তাহলে টিকে থাকা মুশকিল। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে গেলে অস্বস্তিতে ভুগতে হয়।’
আর অফিস-আদালতের যে কাঠামো, সেখানে প্রমিত ছাড়া অন্য কোনো ভাষা যেন ভাবাই যায় না। সেটা ব্যবহার করলে নিরীহ থেকে নিষ্ঠুর নানামাত্রিক টিটকারির মুখোমুখি হতে হয় মানুষকে। বেসরকারি চাকরিজীবী ওয়াহেদ নুর খোকন বলেন, ‘আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললে অনেকেই ভালো মনে করে না। গেঁয়ো মনে করে। আবার বাসা কিংবা এলাকায় গিয়ে প্রমিত ভাষায় কথা বললে মানুষ মনে করে ভাব বেড়েছে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই যখন বাড়ি কিংবা এলাকায় থাকি, তখন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি। আর যখন কর্মের তাগিদে ঢাকায় থাকি, তখন প্রমিত ভাষায় কথা বলি।’
ওয়াহেদ নূর খোকনের ভাষ্যটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কথাটি বিবেচনায় নিলে ভাষার একটা জাতীয় মান যদি থাকে, তবে এর নিশ্চয় আঞ্চলিক মানও আছে। অর্থাৎ বরগুনা গিয়ে সেখানকার ভাষা না বলে প্রমিত বললে, আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন সেখানকার মানুষ থেকে। এর হুজ্জতও তখন আপনাকে পোহাতে হবে। রয়েছে অর্থনৈতিক ব্যাপারও। ভাবুন চট্টগ্রাম গেছেন, আর সেখানকার ভাষায় আপনি রিকশা ঠিক করতে পারছেন না; ভাড়া একটু বেশি লাগাই কি স্বাভাবিক না। ঠিক একই কথা বিপরীতভাবেও সত্য। চট্টগ্রামের যে রিকশাচালক সেখানকার চালু ভাষাটি জানেন না, তিনি কি ভাড়া নিয়ে যাত্রীর দিক থেকে ঠকবেন না কখনো? ঠকতেই পারেন। এমন ছোট ছোট, কিন্তু অতিগুরুত্বপূর্ণ নানা দিক জড়িয়ে আছে ভাষার সঙ্গে।
ঠিক এমনই এক অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ব্যবসায়ী মো. মানিক হোসেন রাজু। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি চাঁদপুর। কিন্তু আমি দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে ছিলাম। সেখানে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতে না পারায় জিনিসপত্র কিনতে গেলে ঠকিয়ে দিত। দাম বেশি রাখত।’
আছে নিরাপত্তার প্রসঙ্গও। বিষয়টি সামনে আনলেন ব্যবসায়ী মো. মহিউদ্দিন তুহিন। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকার ছেলে। ব্যবসার কাজে আমার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয়। যখন যেখানে যাই তখন সেখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে যাই। সেসব জায়গায় আমি আমার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি না।’ কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মূলত নিরাপত্তার কথা ভেবে এ পন্থা অবলম্বন করি। তারা যদি বুঝতে পারে ঢাকা থেকে এসেছি, তাহলে ধরেই নেয় সঙ্গে অনেক টাকাপয়সা আছে। এতে করে ডাকাতি কিংবা ছিনতাইয়ের ঝুঁকি থাকে।’
তারপরও কেউ কেউ থাকেন, এসব ঝুঁকি মাথায় নিয়েই নিজের মায়ের ভাষাতে কথা বলতেই স্বচ্ছন্দবোধ করেন। এমনই একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর সামিউল হক। তিনি বলেন, ‘মাতৃভাষার মানে আমার মায়ের মুখের ভাষা। আমার মা তো প্রমিত ভাষায় কথা বলেননি। তাহলে ওই প্রমিত ভাষা কীভাবে আমার মাতৃভাষা হয়? আমার মা আমাকে যে ভাষায় সেই ছোটবেলা থেকে শিখিয়ে বড় করেছেন, সেটিই আমার ভাষা।’
কিংবা বলা যায় চায়ের দোকানদার রবিউলের কথা। তিনিও বললেন, ‘আমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টাও করি নাই কখনো। আমার ভাষা সবাই বোঝে। আর বড় কথা হচ্ছে, চা বিক্রি করতে তো ভাষা লাগে না।’
হ্যাঁ, দুজনই বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন বটে, তবে তা প্রমিততেই। নিজের অজান্তেই প্রমিত বা মান ভাষা কিন্তু আমাদের দিয়ে যোগাযোগটি করিয়ে নিচ্ছে। আঞ্চলিক ভাষা তোলা থাকছে চার দেয়ালে আপন মানুষদের বৃত্তে ব্যবহারের জন্য। এত সবের মাঝে আবদুর রহমান আর কতজন থাকে।
‘মুই কথা কই মোর ভাষায়। কাউরে ডরায়া কথা কই না। ভাষা নিয়া ঝামেলার কিছু নাই। যে ঠকবে সে ঠকবে, আর যে জিতবে সে জিতবেই।’ আবদুর রহমান বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে কথাগুলো বললেন। তাঁর চোখ সামনের দিকে, ওপারে। বুড়িগঙ্গার কালো জল কেটে দক্ষ হাতে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন ওপারে। কোন পারে? তাঁর এই কথাগুলো নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। তাই তো, ভাষা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই।
আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শহীদবেদি ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। গোটা জাতি মাতৃভাষার দাবিতে প্রাণ দেওয়া, জীবনের সেরা সময়টি উৎসর্গ করা সব শহীদ ও ভাষাসংগ্রামীকে স্মরণ করছে। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ঢের। কিন্তু কোথায় যেন কী একটা নেই। সেটা কি বুড়িগঙ্গার মাঝি আবদুর রহমানের কণ্ঠে আছে? সম্ভবত।
‘ওপার ১০ টাকা, ওপার ১০...।’ নীল ফুল হাতা গেঞ্জি গায়ে মাঝবয়সের ওপারে থাকা লোকটি জানিয়ে দিচ্ছেন ওপার যেতে হলে ১০ টাকা গুনতে হবে। এটা অবশ্য তাঁর নৌকার বিষয় নয়। জায়গাটা ওয়াইজঘাট; আর ওপার মানে কেরানীগঞ্জ। যেতে ১০ টাকাই তো লাগবে; এটা সবাই জানে। মাথার ওপর আকাশে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব দেখে দ্রুত উঠে পড়ায় আবদুর রহমানের সঙ্গে আলাপটা হলো।
রাজধানী ঢাকা শহর তো বটেই গোটা দেশেই প্রমিত বা মান ভাষার দাপটে আঞ্চলিক ভাষার অনেকটা গুটিয়ে থাকার এই সময়ে আবদুর রহমান বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন, ‘মুই কথা কই মোর ভাষায়। কাউরে ডরায়া কথা কই না।’ এই ঘোষণাটি অনেকেই দিতে পারেন না।
রাজধানী ঢাকার কথাই ধরা যাক। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষেরা মিলেই এখানে নাগরিক সমাজ গড়েছে। কেউ এসেছে চট্টগ্রাম থেকে, কেউ সিলেট, কেউ বরিশাল, কেউ রংপুর, রাজশাহী তো কেউ নোয়াখালী, কুমিল্লা। কেউ এসেছেন পাহাড়ের স্মৃতি নিয়ে এই খটখটে শহরে। তাঁদের সবারই রয়েছে নিজেদের একটি করে ভাষা। না এ-ও বাংলাই, কিন্তু উচ্চারণ ও ব্যবহাররীতিতে কিছু তফাত আছে প্রমিতের থেকে। থাকবে না কেন?
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ১৫-২০ কিলোমিটার পরপর ভাষার পরিবর্তন দেখা দেয়। বাংলাদেশেও অঞ্চলভেদে ভাষার বৈচিত্র্য রয়েছে। নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে মানুষের আত্মার একটা মেলবন্ধন থাকে। আঞ্চলিক ভাষা মিশে থাকে মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে। জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে শিশু প্রথম ভাষা শেখে। সেই ভাষাতেই সে কথা বলা শুরু করে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানা কারণে ধীরে ধীরে মানুষ আর তার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করে না। দেখা গেল নিজস্ব পরিমণ্ডলে আঞ্চলিক ভাষায় অনায়াস লোকটিই আপনি ডাকার সঙ্গে সঙ্গে একেবারে প্রমিত উচ্চারণে সাড়া দিচ্ছেন।
এই যে সাধারণ জনপরিসরে আঞ্চলিক ভাষা বা মায়ের ভাষাটি ব্যবহার করে না, তা কেন। হাজারটা কারণ থাকে। তবে শুরুতেই অনেকে অজুহাত হিসেবে চিরপরিচিত সেই কথাই বলবে—এক দেশের বুলি অন্য দেশে গালি। এ নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে একজন বললেনও এমন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী রবিন ঘোষ। বললেন, ‘আমি বেশির ভাগ সময় আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলি। কিন্তু অনেক সময় আমার আঞ্চলিক ভাষা মানুষ বুঝতে পারে না। তাই তাদের জন্য আমার প্রমিত ভাষা ব্যবহার করতে হয়। কোনো দেশের বুলি অন্য দেশের গালি। মূলত এ জন্যই মানুষ প্রমিত ভাষাটা ব্যবহার করে।’
এটা এক অর্থে সত্য। কিন্তু আরও নানা কারণ নিশ্চয় আছে। একটা হলো জনপরিসরে গ্রহণযোগ্যতা। অনেক সময়ই আঞ্চলিক ভাষা সাধারণ জনপরিসরে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। এ জন্য এমনকি আঞ্চলিক ভাষায় বাউল গান গাওয়া মীনু পাগলীকেও প্রমিত ভাষাতেই যোগাযোগ করতে দেখা যায় সাধারণত। প্রান্তিক মানুষের কথা, গান, সুর, আর ভাষা নিয়ে যাঁর গান, সেই মীনু পাগলি বলেন, ‘ছোট বয়স থেকে আমি গান করি। আমার মনে হয়, আঞ্চলিক ভাষায় গান না গাইলে আমি হয়তো এত মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারতাম না।’
বাউল মীনু পাগলির আঞ্চলিক ভাষার গান মানুষ উপভোগ করলেও তাঁর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা কিন্তু মানুষ সেভাবে গ্রহণ করে না। তাই আঞ্চলিক ভাষায় গান গাইলেও এই শিল্পীকে অনেক সময় প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমি আমার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কিন্তু এখনকার মানুষ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললে ছোটলোক মনে করে। তারা মনে করে, আমি স্টাইল জানি না।’
এই শিল্পী বলেন, ‘আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে যে শান্তি, তা প্রমিত ভাষায় নেই।’ তাঁর মতে, মানুষ স্টাইলের জন্যই প্রমিত ভাষার ব্যবহার করে।
তবে অনেক সময়ই বিষয়টি প্রাত্যহিক জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। অফিস-আদালত তো বটেই ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রেও নিজ ভাষার প্রমিতকরণ করে নিতে হয় মানুষকে। এর যতটা যোগাযোগ, তার চেয়েও বেশি ওই আবদুর রহমান কথিত ‘ঠকা ও জেতার’ সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেকের টিকে থাকাটাই এই ভাষার ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিষয়টি সরাসরি বললেন পুরান ঢাকায় চশমার ব্যবসা করেন আলী আকবর। বিক্রমপুর থেকে ঢাকায় আসা এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘জীবিকার তাগিদে ঢাকায় এসেছি। এখানে এসে যদি সবার সঙ্গে মিলে না চলি তাহলে টিকে থাকা মুশকিল। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে গেলে অস্বস্তিতে ভুগতে হয়।’
আর অফিস-আদালতের যে কাঠামো, সেখানে প্রমিত ছাড়া অন্য কোনো ভাষা যেন ভাবাই যায় না। সেটা ব্যবহার করলে নিরীহ থেকে নিষ্ঠুর নানামাত্রিক টিটকারির মুখোমুখি হতে হয় মানুষকে। বেসরকারি চাকরিজীবী ওয়াহেদ নুর খোকন বলেন, ‘আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললে অনেকেই ভালো মনে করে না। গেঁয়ো মনে করে। আবার বাসা কিংবা এলাকায় গিয়ে প্রমিত ভাষায় কথা বললে মানুষ মনে করে ভাব বেড়েছে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই যখন বাড়ি কিংবা এলাকায় থাকি, তখন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি। আর যখন কর্মের তাগিদে ঢাকায় থাকি, তখন প্রমিত ভাষায় কথা বলি।’
ওয়াহেদ নূর খোকনের ভাষ্যটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কথাটি বিবেচনায় নিলে ভাষার একটা জাতীয় মান যদি থাকে, তবে এর নিশ্চয় আঞ্চলিক মানও আছে। অর্থাৎ বরগুনা গিয়ে সেখানকার ভাষা না বলে প্রমিত বললে, আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন সেখানকার মানুষ থেকে। এর হুজ্জতও তখন আপনাকে পোহাতে হবে। রয়েছে অর্থনৈতিক ব্যাপারও। ভাবুন চট্টগ্রাম গেছেন, আর সেখানকার ভাষায় আপনি রিকশা ঠিক করতে পারছেন না; ভাড়া একটু বেশি লাগাই কি স্বাভাবিক না। ঠিক একই কথা বিপরীতভাবেও সত্য। চট্টগ্রামের যে রিকশাচালক সেখানকার চালু ভাষাটি জানেন না, তিনি কি ভাড়া নিয়ে যাত্রীর দিক থেকে ঠকবেন না কখনো? ঠকতেই পারেন। এমন ছোট ছোট, কিন্তু অতিগুরুত্বপূর্ণ নানা দিক জড়িয়ে আছে ভাষার সঙ্গে।
ঠিক এমনই এক অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ব্যবসায়ী মো. মানিক হোসেন রাজু। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি চাঁদপুর। কিন্তু আমি দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে ছিলাম। সেখানে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতে না পারায় জিনিসপত্র কিনতে গেলে ঠকিয়ে দিত। দাম বেশি রাখত।’
আছে নিরাপত্তার প্রসঙ্গও। বিষয়টি সামনে আনলেন ব্যবসায়ী মো. মহিউদ্দিন তুহিন। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকার ছেলে। ব্যবসার কাজে আমার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয়। যখন যেখানে যাই তখন সেখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে যাই। সেসব জায়গায় আমি আমার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি না।’ কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মূলত নিরাপত্তার কথা ভেবে এ পন্থা অবলম্বন করি। তারা যদি বুঝতে পারে ঢাকা থেকে এসেছি, তাহলে ধরেই নেয় সঙ্গে অনেক টাকাপয়সা আছে। এতে করে ডাকাতি কিংবা ছিনতাইয়ের ঝুঁকি থাকে।’
তারপরও কেউ কেউ থাকেন, এসব ঝুঁকি মাথায় নিয়েই নিজের মায়ের ভাষাতে কথা বলতেই স্বচ্ছন্দবোধ করেন। এমনই একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর সামিউল হক। তিনি বলেন, ‘মাতৃভাষার মানে আমার মায়ের মুখের ভাষা। আমার মা তো প্রমিত ভাষায় কথা বলেননি। তাহলে ওই প্রমিত ভাষা কীভাবে আমার মাতৃভাষা হয়? আমার মা আমাকে যে ভাষায় সেই ছোটবেলা থেকে শিখিয়ে বড় করেছেন, সেটিই আমার ভাষা।’
কিংবা বলা যায় চায়ের দোকানদার রবিউলের কথা। তিনিও বললেন, ‘আমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টাও করি নাই কখনো। আমার ভাষা সবাই বোঝে। আর বড় কথা হচ্ছে, চা বিক্রি করতে তো ভাষা লাগে না।’
হ্যাঁ, দুজনই বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন বটে, তবে তা প্রমিততেই। নিজের অজান্তেই প্রমিত বা মান ভাষা কিন্তু আমাদের দিয়ে যোগাযোগটি করিয়ে নিচ্ছে। আঞ্চলিক ভাষা তোলা থাকছে চার দেয়ালে আপন মানুষদের বৃত্তে ব্যবহারের জন্য। এত সবের মাঝে আবদুর রহমান আর কতজন থাকে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই রাজধানীর আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন শ্রমজীবীদের হাটে জড়ো হন শত শত শ্রমজীবী মানুষ। বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও নারী শ্রমিকেরা এই হাটে প্রতিদিন ভিড় করেন একটু কাজ পাওয়ার আশায়। তবে দিন যত যাচ্ছে, তাঁদের জীবনের লড়াই ততই কঠিন হয়ে উঠছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি তাঁদের জীবনকে দুর্বিষ
২৬ অক্টোবর ২০২৪ফেলুদার দার্জিলিং জমজমাট বইয়ে প্রথম পরিচয় দার্জিলিংয়ের সঙ্গে। তারপর অঞ্জন দত্তের গানসহ আরও নানাভাবে হিল স্টেশনটির প্রতি এক ভালোবাসা তৈরি হয়। তাই প্রথমবার ভারত সফরে ওটি, শিমলা, মসুরির মতো লোভনীয় হিল স্টেশনগুলোকে বাদ দিয়ে দার্জিলিংকেই বেছে নেই। অবশ্য আজকের গল্প পুরো দার্জিলিং ভ্রমণের নয়, বরং তখন পরিচয়
২৩ অক্টোবর ২০২৪কথায় আছে না—‘ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরেমেঘ দেখলেই ডরায়’! আমার হইছে এই অবস্থা। বাড়িতে এখন বাড়িআলী, বয়স্ক বাপ-মা আর ছোট মেয়ে। সকাল থেকে চার-পাঁচবার কতা বলিচি। সংসার গোচাচ্ছে। আইজকা সন্ধ্যার দিকে ঝড় আসপি শুনতিছি। চিন্তায় রাতে ভালো ঘুমাতে পারিনি...
২৬ মে ২০২৪প্রতিদিন ভোরে ট্রেনের হুইসেলে ঘুম ভাঙে রাকিব হাসানের। একটু একটু করে গড়ে ওঠা রেলপথ নির্মাণকাজ তাঁর চোখে দেখা। এরপর রেলপথে ট্রেন ছুটে চলা, ট্রেন ছুঁয়ে দেখা—সবই হলো; কিন্তু এখনো হয়নি চড়া। রাকিবের মুখে তাই ভারতীয় সংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লার বিখ্যাত গান। ‘আমার বলার কিছু ছিল না, চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪