লুটপাট চালাতে বুলডোজারে ধ্বংস করা হয় আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক স্থাপনা: গবেষণা

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৫: ৩৯
Thumbnail image

‘পদ্ধতিগত লুটপাট’ চালাতেই আফগানিস্তানের কয়েক ডজন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা বুলডোজারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বলেছেন, ২০২১ সালে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই এই লুটপাট চালানো হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে খবরটি দিয়েছে।

ধ্বংস হওয়া স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ১ হাজার বছর আগে, ব্রোঞ্জ যুগের শেষের দিকে এবং লৌহ যুগে তৈরি বেশ কিছু প্রাচীন জনবসতি। এই স্থাপনাগুলোর বেশির ভাগই উত্তর আফগানিস্তানের বালখ অঞ্চলে অবস্থিত—যেটি দুই হাজারেরও বেশি বছর আগে ব্যাকট্রিয়া নামক জায়গার কেন্দ্রস্থল ছিল।

স্যাটেলাইট ছবি এবং অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করে আফগানিস্তান জুড়ে ২৯ হাজারেরও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান খুঁজে পেয়েছে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কালচারাল হেরিটেজ প্রিজারভেশনের গবেষকেরা। কিন্তু ২০১৮ সালে বালখ অঞ্চলে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর নকশায় তারা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। যেভাবে অনেকগুলো স্থাপনা অদৃশ্য হয়েছে তাতে বুলডোজার ব্যবহারের ধারণাই শক্ত হয় তাদের।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কালচারাল হেরিটেজ প্রিজারভেশনের পরিচালক অধ্যাপক গিল স্টেইন ব্যাখ্যা করেছেন, বুলডোজারে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর এলাকাগুলোর নতুন ছবিতে দেখা গেছে খনন করা বেশ কয়েকটি গর্ত। এগুলো সম্ভবত লুটেরাদের কাজ। বিশাল এই এলাকা যেন পদ্ধতিগতভাবে ও সহজে লুট করা যায় সে জন্যই আগে সবকিছু গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

তার দল বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আশ্চর্যজনক হারে এক সপ্তাহেই ধ্বংস হয়েছিল ১৬২টি প্রাচীন জনবসতি। তালেবানের অধীনে এরপরও ৩৭টি ঐতিহাসিক স্থাপনায় এই কাজ অব্যাহত ছিল।

জায়গাটির অবস্থানের খোঁজ যেন আরও বেশি লুটেরারা জানতে না পারে সে জন্য এ সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি গবেষকেরা। স্থাপনাগুলোকে নথিভুক্ত করার কাজ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। তাই সেখানে আসলে কী কী ছিল সে সম্পর্কে জানেন না গবেষকেরা।

তবে জায়গাটির মাত্র ৯৭ কিলোমিটার (৬০ মাইল) দূরেই অবস্থিত তেলা টেপে নামক স্থান। সেখানে ১৯৭৮ সালে ২ হাজার বছরের পুরোনো ব্যাকট্রিয়ান সোনার একটি খনি আবিষ্কৃত হয়েছিল। ‘হিল অব গোল্ড’ বা সোনার পাহাড় নামে পরিচিত জায়গাটি থেকে সোনার গয়না, একটি বহুমূল্য মুকুট এবং কয়েনসহ প্রায় ২০ হাজার বিরল জিনিস পাওয়া গেছে।

প্রফেসর স্টেইনের মতে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে—প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির শাসনামল থেকেই নকশাটির পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়। আশরাফ ঘানি দেশের অনেক স্থানেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।

২০২১ সালের আগস্টে রাজধানী কাবুল দখল করার আগেই তালেবানদের হাতে পড়ে যাওয়া প্রথম এলাকাগুলোর মধ্যে একটি ছিল উত্তর আফগানিস্তানের বৃহত্তম শহর মাজার-ই-শরিফসহ বালখ। প্রফেসর স্টেইন বিশ্বাস করেন যে, ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো কেবল এমন লোকেরাই লুট করতে পারে যারা ধনী এবং পর্যাপ্ত ক্ষমতাবান। মাটি খননের সরঞ্জাম কেনা বা ভাড়া করতে সক্ষম এবং গ্রামীণ এলাকায় যাদের কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করবে না তারাই এ কাজ করে।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো সাইদ রেজা হুসেইনি বলেন, তিনি ২০১৯ সালে দেশ ত্যাগের আগেই দেখেছিলেন যে, কয়েকটা ঐতিহাসিক স্থানে তখনই লুটপাট চলছিল।

বামিয়ান প্রদেশে এখানেই ছিল ১,৫০০ বছরের পুরোনো বিশ্বের বৃহত্তম বুদ্ধ মূর্তি।হুসেইনি বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং সামরিক বাহিনীর অনুমতি ছাড়া কেউ খনন কাজ করতে পারে না। যারা এই কাজ করেছে তাদের কাছে স্থানগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য নেই। তারা মাটি খুঁড়ে জায়গাটা ধ্বংস করে কিছু পাওয়া যায় কিনা সেটাই খোঁজে। আমি নিজের চোখে দেখেছি—তারা জিনিসপত্র পরীক্ষা করার জন্য মাটির চালনিও ব্যবহার করে।

২০০১ সালে তালেবানরা ক্ষমতায় থাকাকালীন বামিয়ান প্রদেশে ১,৫০০ বছরের পুরোনো বিশ্বের বৃহত্তম বুদ্ধ মূর্তি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়েছিল। দুই দশক পর ক্ষমতায় ফিরে তালেবানরা বলেছিল যে, তারা দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যকে সম্মান করবে।

তালেবানের তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত উপমন্ত্রী আতিকুল্লাহ আজিজি লুটপাট হওয়ার দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি উল্টো দাবি করেন, ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখাশোনার জন্য একটি শক্তিশালী ইউনিট নিয়োগ করা হয়েছে। বিবিসিকে তিনি বলেন, কয়েকটি সংস্থা বুলডোজার দিয়ে ঐতিহাসিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়ার ছবি পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়ে। এরপর কয়েকটি অনুসন্ধানই দলকে সেসব স্থানে পাঠানো হয়েছিল। তারা জানিয়েছে, এ রকম একটি ঘটনাও ঘটেনি।

তালেবানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে যে, গত সেপ্টেম্বরে পুরাকীর্তি পাচারের চেষ্টার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল—মূর্তি, মমি, একটি সোনার মুকুট, একটি বই এবং তলোয়ারসহ প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ ডলার মূল্যের পুরাকীর্তি পাচারের চেষ্টা করছিলেন তারা। পুরাকীর্তিগুলো জাতীয় জাদুঘরে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং তদন্ত অব্যাহত রয়েছে বলে জানায় মন্ত্রণালয়।

তবে আতিকুল্লাহ আজিজির দাবির প্রসঙ্গে বিস্ময় প্রকাশ করে প্রফেসর স্টেইন বলেন, ‘আমরা দেখাতে পারব যে, দুটি ভিন্ন শাসনামলের মধ্যেও লুটপাট চলছিল।’

অধ্যাপক স্টেইন বিশ্বাস করেন যে, লুট করা প্রত্নসামগ্রী আফগানিস্তান থেকে ইরান, পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশের মাধ্যমে পাচার করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত যায় ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং পূর্ব এশিয়ায়। বিশ্বজুড়ে নিলাম এবং জাদুঘরে হয়তো লুটের এসব প্রত্নসামগ্রী প্রদর্শন করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত