বিপিএলে মাশরাফিকে নিয়ে সমালোচনা আর ফ্র্যাঞ্চাইজির চাওয়া

গোলাম ওয়াদুদ, ঢাকা
আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২: ১৬
Thumbnail image

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ১০ম আসরের ৮টি ম্যাচ ইতিমধ্যে শেষ। ঢাকার প্রথম পর্বের পাঠ চুকিয়ে দলগুলো এখন সিলেটে। প্রতি আসরের মতো এবারও বিপিএল নিয়ে আছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। আগের আসরগুলোয় কোনো না কোনো বিতর্ক লেগেই থাকত। এবার নানা বিতর্কের অবসান ঘটাতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। তবে এবার প্রথম থেকেই ভক্ত-সমর্থক বা কিছু ক্রিকেট-বোদ্ধা প্রশ্ন তুলছেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার ফিটনেস নিয়ে। 

এত কিছু থাকতে একজন খেলোয়াড়ের খেলা নিয়ে কেন অতি আলাপ? অবশ্যই কারণ রয়েছে। মাশরাফি প্রায় এক বছর খেলার বাইরে। রাজনীতিতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। হাঁটুর ব্যথা আছে তাঁর। সব মিলিয়ে ভালোভাবে খেলতে ফিট নন মাশরাফি। সেটার ছাপ দেখা গেছে মাঠেও। ঢাকা পর্বের দলের দুই ম্যাচেও স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে দেখা যায়নি তাঁকে। 

এসব বিষয়েই ভক্ত, হেটার্স ও কিছু ক্রিকেট-বোদ্ধা আলাপ তুলেছেন মাশরাফিকে নিয়ে। এই আলাপে আরও রসদ জুগিয়েছে সাবেক অধিনায়ক আশরাফুলের মন্তব্য। গত পরশু সিলেটের দ্বিতীয় ম্যাচের আগে একটি টিভি চ্যানেলে ম্যাচ-প্রিভিউ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এই টুর্নামেন্টে আসলে...সে (মাশরাফি) কিন্তু খেলতে চাইছিল না, মালিকেরা চাচ্ছে সে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকুক। এটা আমার মনে হয়, এই টুর্নামেন্টকে ছোট করা হচ্ছে। কারণ, এ ধরনের টুর্নামেন্ট পুরো বিশ্ব দেখছে। এখানে আমাদের আগামীর খেলোয়াড় আসবে। এই যে ছয় মাস পর আমাদের বিশ্বকাপ। তাদের (সিলেট স্ট্রাইকার্স) দলে কিন্তু রেজাউর রহমান রাজা বসে আছে, যার একটা সুযোগ ছিল। এই টুর্নামেন্টে ভালো করলে বিশ্বকাপে সম্ভাবনা থাকত। এই জায়গায় একটা মিসিং।’ 

নাজমুল হোসেন শান্তর সঙ্গে মাঠের কৌশল নিয়ে আলোচনা করছেন মাশরাফি। ছবি: আজকের পত্রিকা এরপর ম্যাচ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি যে ম্যাচ খেলার আইডিয়াল সিচুয়েশন নেই, সেটা নিজেই জানিয়েছেন মাশরাফি। বলেছেন, সব বিষয় ব্যাখ্যা করা যায় না। তাঁর কথায় বোঝা গেছে, মালিকপক্ষের চাওয়াতেই মাঠে থাকছেন তিনি। 
এটা অবশ্য সিলেট স্ট্রাইকার্সের মালিকপক্ষের কথায়ও স্পষ্ট। দলের অন্যতম স্বত্বাধিকারী জগলুল হায়দার টুর্নামেন্টের আগে বলেছিলেন, ‘মাশরাফি দাঁড়িয়ে থাকলেই চলবে তাঁদের।’ আশরাফুলের মন্তব্যের বিষয়ে সিলেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল বিন ইউসুফ শুভ্র বলেছেন, ‘আশরাফুল কী মন্তব্য করেছে, সেটা আমাদের কাছে কোনো ম্যাটার করে না।’

কেন খেলছে মাশরাফি বা খেলতে হচ্ছে মাশরাফিকে? কেন খেলছে এই আলাপের আগে আমাদের মনে রাখা উচিত, এটা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট। এই আলাপ একপ্রকার ‘অহেতুক’। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে কেন টাকা ঢালতে আসেন দলগুলোর মালিকেরা? অবশ্যই লাভের জন্য। এখানে জাতীয় দলের খেলোয়াড় তৈরি করে দেবে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো—এমনটা ভাবা একেবারে ‘অমূলক’। কারণ, এটা ব্যবসা। 
প্রথমত, এখানে যাঁরা ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা খরচ করে দল তৈরি করেন, তাঁরা নিশ্চয় জাতীয় দলের খেলোয়াড় তৈরির চিন্তা করেন না। স্রেফ ব্যবসা, স্রেফ লাভ। সুতরাং প্রথমে ক্রিকেটার তৈরির চিন্তা দূরে রাখতে হবে। ক্রিকেটার তৈরির জন্য জাতীয় ক্রিকেট লিগ আছে। সেখানে তৈরি হবে। কিন্তু ব্যবসার পর কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক চাইলে খেলোয়াড় তৈরির কাজ করতে পারেন। তবে তাঁর খেলোয়াড় তৈরি করতেই হবে এমন দায়বদ্ধতা নেই। 

দ্বিতীয়ত, আইপিএল বা অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে ক্রিকেট বোর্ড প্রতিটি দলকে লভ্যাংশ দেয়, কিন্তু বিপিএলে তা দেওয়া হয় না। এ কারণে দলগুলো পুরো নির্ভরশীল স্পনসরের ওপর। আর স্পনসরদের চাহিদা অনুযায়ী যদি দল গঠন না করে, তাহলে তারা টাকা দেবে কেন? স্পনসরের জন্য ব্র্যান্ড ভ্যালু অন্যতম। আমাদের মাথায় রাখা দরকার যে বাংলাদেশে অন্য সব খেলোয়াড়ের ব্র্যান্ড ভ্যালু আর মাশরাফি বা সাকিবের ব্র্যান্ড ভ্যালুর পার্থক্য অনেক। সাকিব রংপুরে খেলছে, তাই সেখানে অনেক স্পনসর। অন্য খেলোয়াড়দের জন্য নয়, সাকিবের জন্যই আসছে বেশির ভাগ স্পনসর ৷ সেটা অন্য কয়েকটি দলের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

তেমনি সিলেটের ১০-১১টা যে স্পনসর, সেগুলো মাশরাফির জন্যই এসেছে বলে জানা যায়। নিশ্চয়ই মিঠুন-জাকির-রেজাউর রাজাদের জন্য স্পনসর এত আগ্রহ দেখিয়ে আসেনি। সুতরাং যেখানে ব্যবসা মূল, সেখানে অন্য আবেগ আনা অমূলক। খেলোয়াড় বের করার দায়িত্ব ফ্র্যাঞ্চাইজির না। তারা সব সময় চাইবে ১০ কোটি বিনিয়োগ করে ১২ কোটি আয় করতে। সেখানে যাকে রাখলে তাদের ব্যবসা হবে, তাকেই রাখবে। 

তৃতীয়ত, ব্যবসায় যেহেতু ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের একমাত্র লক্ষ্য। তাই একে ব্যবসা, লাভ, ব্রান্ড ভ্যালু আর সময় পেলে খেলা দেখে আনন্দ উপভোগ করাই সমীচীন। 

চতুর্থত, যাকে পছন্দ হবে না, তার দলকে সমর্থন করব না। সাতটি দল রয়েছে, যাকে ইচ্ছে তাকে সমর্থন করব। ভক্তের আবেগ থাকতে পারে কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, ভক্তের আবেগের ফাঁদে পড়ে মাশরাফিকে খেলাচ্ছে না সিলেটের মালিকপক্ষ। তারা ব্যবসাটা ধরে রাখতেই খেলাচ্ছে বলে আমার ধারণা। আজ মাশরাফি দলে না থাকলে বা ওদিকে সাকিব না থাকলে এত এত স্পনসর থাকবে না। এটাই ব্যবসা...। আমার এই মতামতে দ্বিমত থাকতে পারে। 

বিপিএলকে আরও পেশাদার করা যেত, কিন্তু বিসিবি বা বিপিএলের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের অবহেলায় আজ বিপিএলের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশ্বের সেরা তিনটি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের তালিকায় থাকতে পারত বিপিএল। কেন থাকতে পারেনি, আরেক দিন লেখা যাবে।

লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত