আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতানো মেনোত্তি ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা

উপল বড়ুয়া, ঢাকা
প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৪, ১০: ৪২

সান্তোসে ছিলেন ‘ফুটবলের রাজা’ পেলের সতীর্থ। ‘ফুটবল ঈশ্বর’ ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তুলে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার জার্সি। বেশ জোর গলায় প্রশংসা করতেন মারিও বেনেদেত্তি, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, হোর্হে লুইস বোর্হেস, মারিও সাবাতো ও হোয়ান ম্যানুয়েল সেরেটের মতো লাতিন সাহিত্যিক, সংগীতশিল্পী ও চিত্রনির্মাতাদের। নিজেও কিসে কম ছিলেন সিজার লুইস মেনোত্তি? তাঁর মতন বর্ণাঢ্য ও বিচিত্র জীবন আর কেই-বা পেয়েছেন!

মেনোত্তি শুধু কোচই ছিলেন না; শুধু ডাগআউটে দাঁড়িয়ে জীবন পার করেননি। ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। আর্জেন্টিনার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ভালোবাসতেন বক্সিং। লম্বা-চিকন মানুষটির ঠোঁটে সিগারেট লেগেই থাকত। কোচ পেপ গার্দিওলাকে ফুটবলের ‘চে গেভারা’ উপাধিটিও দিয়েছিলেন তিনি। তবে সব ছাপিয়ে মেনোত্তি অমর হয়ে আছেন আর্জেন্টিনাকে প্রথম বিশ্বকাপ জিতিয়ে। এমন একজন মানুষকে হারাল বিশ্ব। গতকাল ৮৫ বছর বয়সী মেনোত্তির মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করেছে আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশন (এএফএ)। নিজের শহর রোজারিওর কিংবদন্তির মৃত্যুতে শোক জানিয়ে লিওনেল মেসি ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে লিখেছেন, ‘আমাদের অন্যতম ফুটবল কিংবদন্তিকে হারালাম।’

গুরু মেনোত্তি সম্পর্কে মৃত্যুর এক বছর আগে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘তিনি আমাদের জার্মানদের চেয়েও বেশি দৌড়াতে এবং ব্রাজিলিয়ানদের মতন খেলতে বাধ্য করতেন। ফ্লাকো, আমি তোমাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসি।’ প্রায় ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বার মানুষটিকে ভালো না বেসে উপায় কী! তিনিই যে ছিলেন আর্জেন্টিনার ফুটবলের ‘আর্কিটেক্ট’! লম্বা ও চিকন গড়নের জন্য তাঁকে সবাই ডাকত ‘এল ফ্লাকো’ বা ‘চিকনা’। ফুটবলকে শুধু মাঠের লড়াই নয়, শিল্প হিসেবে দেখতেন মেনোত্তি। এ কারণেই হয়তো তিনি এভাবে বলতে পেরেছিলেন, ‘শিল্প-সাহিত্যকে শৃঙ্খলা ও দুঃসাহসিক কাজ বলতেন বোর্হেস, তেমনি ফুটবলও। যদি আপনি খুব সংগঠিত হন, তবে দলটি বিরক্তিকর ঠেকবে, সংগীতের ক্ষেত্রেও এমনটা মনে হতে পারে।’

ফুটবলকে এমন হৃদয় দিয়ে আর কজনই-বা উপলব্ধি করতে পেরেছেন? বোর্হেসের প্রসঙ্গ যখন এল, মেনোত্তির শেষ সাক্ষাৎকারে এই আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি সাহিত্যিককে নিয়ে তাঁর একটি আলাপন শোনা যাক, ‘একবার আমি বোর্হেসের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার ধূমপান বিরক্ত করছে কি না। তিনি বললেন, যা আমাকে উত্তেজিত করে তা সিগারেট নয়, বোকা কথাবার্তা। তাই আমি সবকিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম...তবে ফুটবল ছাড়া। কারণ, আমি ফুটবল সম্পর্কে জানতাম।’

সিগারেটের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেই যেন অর্ধেক জীবন পার করেছেন মেনোত্তি। কার্লো আনচেলত্তি বা মাউরিসিও সারিকে টাচলাইনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ সুখটান দিতে নিশ্চয় দেখেছেন? ৩৭ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে এমন দৃশ্যকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন মেনোত্তি। আর লম্বা চুল ঝাঁকিয়ে বলতেন, ‘আমি কখনো সেলুনে যাই না। নিজের চুল নিজেই কাটি।’ ক্যানসারের কারণে ১৬ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন মেনোত্তি। সে সময় থেকে ‘চেইন স্মোকার’ হয়ে ওঠা মেনোত্তি ধূমপান সম্পর্কে সাফাই গেয়েছিলেন এভাবে, ‘একাকিত্বের সময়ে আমার বন্ধু’। তবে ২০১১ সালে ফুসফুস অপারেশনের পর সেই ‘বন্ধু’কে ছাড়তে হয়েছিল।

আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনা ও ২০২২ সালে বিশ্বকাপ এনে দেন মেসি। তাঁদের মনে সাফল্যের বীজমন্ত্র রুয়ে দিয়েছিলেন মেনোত্তিই। তাঁর অধীনে ঘরের মাটিতে ১৯৭৮ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে মারিও কেম্পেস-ড্যানিয়েল প্যাসারেলারা পান অমরত্বের স্বাদ। তবে এই বিশ্বকাপটিতে রয়ে গেছে ‘কলঙ্কের দাগ’। সে সময় আর্জেন্টিনার শাসনে জান্তা সরকার। আলবিসেলেস্তেদের বিশ্বকাপ জেতাতে প্রেসিডেন্ট হোর্হে রাফায়েল ভিদেলা প্রভাব খাটিয়েছিলেন বলেও শোনা যায়। ফাইনালের পর সামরিক শাসনের প্রতিবাদ জানিয়ে মেনোত্তি তাঁর সঙ্গে হাত পর্যন্ত মেলাননি।

আকর্ষণীয় ও আক্রমণাত্মক ফুটবলের ঘোর সমর্থক ছিলেন মায়েস্ত্রো মেনোত্তি। একেবারে কেতাদুরস্ত ফুটবল পছন্দ করতেন না। এখনকার খুব বেশি শৃঙ্খলিত ফুটবল দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘যখন তারা ৪-৩-৩, ৪-২-২, ৪-৩-১-২...আমার কাছে এসবকে মনে হয় ফোন নম্বর।’ নিজের অশৃঙ্খলিত বুনো সৌন্দর্য হয়তো তিনি পরে দেখেছিলেন ম্যারাডোনার মধ্যে। দুজনের সম্পর্ক যে খুব ভালো ছিল তা-ও নয়। ১৯৭৮ বিশ্বকাপের আগে ১৭ বছর বয়সী ম্যারাডোনাকে দল থেকে বাদ না দিলে হয়তো ছিয়াশির মহানায়কের পাশে লেখা থাকত দুটি বিশ্বকাপ। অবশ্য পরে গুরু-শিষ্য হিসেবে এক মৌসুম বার্সেলোনাতেও ছিলেন মেনোত্তি-ম্যারাডোনা। মেনোত্তি কাজ করেছেন মেসিদের সঙ্গেও। তিনি আর্জেন্টিনার ফুটবলের পরিচালক হওয়ার পরেই ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জেতে আকাশি-নীলরা। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত