পোশাকের নাম কেন ‘স্যান্ডো গেঞ্জি’

জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২১, ১০: ০০
আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২১, ১৮: ২৯

আসলে স্লিভলেস বা হাতা কাটা শার্ট বলা যেতে পারে। সেটিই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে স্যান্ডো গেঞ্জি নামে পরিচিত এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত। গরমকালে শরীরের প্রধান পোশাককে ঘামে ভেজা থেকে রক্ষা করতে এই অন্তর্বাস পরার চল কিন্তু খুব বেশি দিন আগে শুরু হয়নি। অনেকে মনে করেন, ব্রিটিশ আমলেই ভারতবর্ষে এই হাতাকাটা বিশেষ পোশাক পরার চল শুরু হয়। তবে এমন নামের পেছনে এক বিখ্যাত লোকের নাম জড়িয়ে আছে বলে ধারণা করা হয়। তিনি বিদেশি হলেও এক বিশেষ কারণেই ওই সময় ভারতবর্ষে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। 

এর আগে স্লিভলেস শার্ট নিয়ে দুটি কথা বলে নেওয়া যাক। এটি মূলত পশ্চিম থেকেই পরবর্তীতে প্রাচ্যে এসেছে। এ ধরনের পোশাকগুলোর শৈলী সাধারণত লিঙ্গের ওপর নির্ভর করে। এ ধরনের পোশাক আন্ডারশার্ট বা অন্তর্বাস হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। আবার ক্রীড়াবিদেরা ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড এবং ট্রায়থলনের মতো খেলায় পরে থাকেন। 

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এই পোশাক সাধারণত ট্যাংক টপ এবং ওয়াইফ বিটার (বউ পেটানো লোক), গিনি টি বা ডাগো টি নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে ইতালীয় বংশোদ্ভূত জাতিগোষ্ঠীকে ‘গিনি’ ও ‘ডাগো’ বলে তাচ্ছিল্য করা হতো। বিশেষ করে বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী শ্রমিকেরা সাধারণত এ ধরনের পোশাক পরতেন বলেই এমন নাম। আর এখান থেকেই মার্কিনদের ধারণা জন্মেছিল যে, এই পোশাক শুধু অভিবাসী এবং বিশেষ করে ইতালিয়ান-আমেরিকানরাই শুধু পরে। আর চিরাচরিত ধারণা হলো, শ্রমিক শ্রেণি বিশেষ করে যারা নির্দিষ্ট একটা জাতিগোষ্ঠী থেকে এসেছে, তারা সাধারণত সহিংস হয়। সারা দিন খেটেখুটে ঘরে এসে বউ পেটায়। এখান থেকেই আমেরিকানরা তাদের পোশাকের নাম দিয়েছে ওয়াইফ বিটার। 

আরেক নাম সিঙ্গলেট। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ঘানা, নাইজেরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও হাওয়াইয়ের কিছু অংশে এটি ব্যবহৃত হয়। 

অনেক বলেন, গেঞ্জির উৎস ইংরেজি guernsey বা gansey। ইংল্যান্ডের গুয়েরেন্সি দ্বীপপুঞ্জে জেলেরা নরম ও আরামদায়ক এক ধরনের পোশাক পরতেন। বৃষ্টি ও নোনা জলের ছাঁট থেকে বাঁচতে সহায়ক এই পোশাকের নাম ওই দ্বীপপুঞ্জের নামানুসারে প্রচলিত হয়। ব্রিটিশ নৌসেনারাও এই পোশাক ব্যবহার করতেন। 

ব্রিটিশদের মাধ্যমেই ভারতবর্ষে এই ঔপনিবেশিক অন্তর্বাসের আগমন ঘটেছে বলে ধারণা করা যায়। সেই সূত্রে ঢুকে গেছে বাংলা ভাষার শব্দসম্ভারে। কিন্তু গেঞ্জির সঙ্গে আমরা আবার স্যান্ডো বসাই। 

ফিলিপাইনে যখন এটি শার্টের নিচে পরা হয়, তখন নাম হয় ‘স্যান্ডো’। ফিলিপিনো ভাষায় স্যান্ডো মানেই ঊর্ধ্বভাগের অন্তর্বাস। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে একে বলে স্যান্ডো-গেঞ্জি। ভারতের অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যেও এটিকে বলে স্যান্ডো-গেঞ্জি। ভারতবর্ষে এটি একটি ফতুয়ার মতো পোশাক হিসেবে পরিচিত। এই স্যান্ডো গেঞ্জি ঘাম শোষণকারী এবং ওপরের পোশাকের বাইরের স্তর যেন শরীরে অস্বস্তি তৈরি করতে না পারে, সে জন্য আন্ডারশার্ট হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। 

ফ্রান্সে এই পোশাক মার্সেল আইজেনবার্গের নামে মার্সেল বলে ডাকা হয়। এই ব্যক্তি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম প্যারিসের কুলিদের জন্য ব্যাপকভাবে এই পোশাকের উৎপাদন শুরু করেছিলেন। এটি আবার ‘দিবাদো’ নামেও পরিচিত। এর অর্থ ডক শ্রমিক, কুলি বা জাহাজ ঘাটের কুলি। কিন্তু ফরাসি ভাষাভাষী বেলজিয়ামে এটিকে শুধু সিঙ্গলেট বলা হয়। 

ইউজেন স্যান্ডো গেঞ্জির মতো স্লিভলেস শার্ট পরতেনকিন্তু বাংলাতে এটি ‘স্যান্ডো গেঞ্জি’ নাম পেল কীভাবে? 

এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিখ্যাত জার্মান বডিবিল্ডার ইউজেন স্যান্ডোর নাম। ১৮৬৭ সালে তাঁর জন্ম। মারা গেছেন ১৯২৫ সালে। জার্মানির কনিগসবার্গে জন্মগ্রহণকারী স্যান্ডো ১০ বছর বয়সে ইতালি সফরের সময় শরীরচর্চায় আগ্রহী হন। সেই সময়ের বড় বড় তারকাদের সঙ্গে বিভিন্ন শোয়ে অংশ নিয়েছেন। বলা হয়, ১৯০১ সালে তিনিই প্রথম বিশ্বের বৃহত্তম বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। লন্ডনের রয়্যাল আলবার্ট হলে সেই আয়োজনে লেখক আর্থার কোনান ডয়েল এবং ক্রীড়াবিদ ও ভাস্কর চার্লস লয়েস-উইটেওরঞ্জের সঙ্গে বিচারকের আসনে ছিলেন স্যান্ডো। 

স্যান্ডোর বাইসেপস ছিল সাড়ে ১৯ ইঞ্চি! ঊরু ছিল বিখ্যাত ব্রিটিশ রেসিং ড্রাইভার ও সাইক্লিস্ট ক্রিস হোয়ের সমান। তাঁর শরীরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও অনন্য বিষয় ছিল সিক্স প্যাক বডি। প্রশস্ত ছাতি, ৪৮ ইঞ্চি। ফুলালে হতো ৬২ ইঞ্চি। সেই সময়কার আদর্শ পুরুষের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। মেয়েদের কাছে ছিলেন সেক্স সিম্বল। 

 ১৯০৫ সালে ভারত সফর করেন স্যান্ডো। বড় আয়োজন করে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে তাঁকে স্বাগত জানায় ভারতবাসী। অবশ্য এর আগে থেকেই ভারতে ‘সাংস্কৃতিক নায়ক’-এ পরিণত হয়েছিলেন স্যান্ডো। কারণটা খুব সহজ, ওই সময় ভারতে জাতীয়তাবাদী আবেগ তুঙ্গে। স্যান্ডো হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় যোগের একজন আন্তর্জাতিক আইকন। আমেরিকান নৃতাত্ত্বিক জোসেফ এস অলটারের মতে, শরীরচর্চা হিসেবে আধুনিক যোগের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিটি হলেন স্যান্ডো। 

বিভিন্ন শোয়ে ইউজেন স্যান্ডো স্লিভলেস শার্ট বা গেঞ্জি পরতেন। সেটি এখনকার স্যান্ডো গেঞ্জিরই কাছাকাছি। ধারণা করা হয়, বাংলার মানুষ আদর করে তাঁর নামেই রেখেছে তাদের নিত্য পরিধেয় পোশাকের নাম ‘স্যান্ডো গেঞ্জি’! 

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, কটোন্যাবল, বিবিসি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আবু সাঈদকে ৪–৫ ঘণ্টা পরে হাসপাতালে নেওয়া হয়—শেখ হাসিনার দাবির সত্যতা কতটুকু

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

বিমানবন্দরে সাংবাদিক নূরুল কবীরকে হয়রানির তদন্তের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

ভারত ও তরুণ প্রজন্মের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রসঙ্গে যা বললেন মির্জা ফখরুল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত