বিভাস রায় চৌধুরী
সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করতে ‘অস্ত্রের ধার’ আর ‘অর্থের ভার’ দুই–ই লাগে। আগেও লাগত, এখনো লাগে।
কিছু ধারালো ব্লেড বা অস্ত্র আছে, যা পৃথিবীর বুক চিরে ইতিহাস লিখেছে। এই ধারালো ব্লেডগুলো দুর্বল মানুষের মনে ভয় আর সবল জাতির ক্ষমতার মোহকে অনুপ্রাণিত করে এসেছে কয়েক হাজার বছর ধরে। তার কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যাক।
প্রাচীনকাল থেকেই সেনা অভিযানে ধারালো তরোয়াল, ছুরি ও ছুরির মতো কিছু অস্ত্র বিশ্বজুড়ে যোদ্ধাদের খুব পছন্দের। অস্ত্র, ক্ষমতা আর অর্থ এক সুতোয় বাঁধা, যার এক একপ্রান্তে থাকে নির্ভীক সাধারণ একজন সৈনিক, আর অন্য প্রান্তে থাকে শিল্পী। যুগে যুগে দেশে দেশান্তরে কামারশালার শিল্পীদের বানানো এ সমস্ত ক্ষুরধার ব্লেড বীর যোদ্ধা, রাজা, সেনাপতিদের মনে স্বপ্ন ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
খোপেশ
ব্রোঞ্জ যুগে আবিষ্কৃত প্রথম দিকের তরোয়ালগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। প্রাচীন মিসরীয় কাস্তে আকৃতির অস্ত্র খোপেশ, যার বাইরের প্রান্ত ধারালো থাকত। এ অস্ত্র মিসরে জন্ম নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত পৌঁছায়। অবশ্য ভারত ভূখণ্ডে এর দেখা মেলেনি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন বিশ্বজুড়ে মাথা চাড়া দিচ্ছে, তখন এই ধারালো অস্ত্র ফারাওদের সেনাবাহিনীকে সুসজ্জিত করে।
শিল্পীরা খোপেশে সুন্দর কারুকার্য করে ফারাওদের পিরামিড সাজাত। তুতেন খামেনের পিরামিডে দুটো দুই আকারের খোপেশ পাওয়া গেছে। এগুলো ‘সিঙ্গল পিস’ ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি। এর প্রথম অংশ বা হাতলের অংশটি কালো রঙের, আর দ্বিতীয় অংশটি হাতলের ওপরে—তাতে একটা পদ্মফুল খোদাই করা। তৃতীয় অংশ কাস্তের আকারে বাঁকানো। পরবর্তীতে আরও ভালো ধাতুবিদ্যা আর অস্ত্র তৈরির কৌশল আবিষ্কার হলে খোপেশকে স্বাভাবিকভাবেই রাস্তা ছেড়ে দিতে হয়। তবুও ইতিহাস একে মনে রেখেছে সভ্যতার শুরুর দিনে তার অনবদ্য অবদানের জন্য।
খুকরি
কয়েক শতাব্দী ধরে যুদ্ধের ইতিহাসে নেপালের এই ছোট্ট, একটু বাঁকা ছুরি এক ঐতিহ্যবাহী গোর্খা সেনা হাতিয়ার। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপীয়রা প্রথম খুকরির প্রেমে পড়ে। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নেপালি গোর্খা যোদ্ধাদের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্য বাহিনী সংঘর্ষে লিপ্ত হলে নেপালিদের খুকরি চালানোর দক্ষতা দেখে ব্রিটিশ কমান্ডার অকটারলোনি গোর্খাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অন্যতম শক্তিশালী সামরিক ইউনিটে পরিণত করেন।
খুকরি বর্তমান ব্রিটিশ ও ভারতীয় আর্মিতে ‘স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু’ অস্ত্র হিসেবে গোর্খাদের দেওয়া হয়। রয়্যাল গোর্খা বা ভারতীয় গোর্খা রেজিমেন্টের লোগো এই খুকরি। আর এই ব্লেডের স্বাদ সবচেয়ে ভালো পেয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান আফ্রিকা কোর এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী—বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও কারগিল যুদ্ধে।
ফালকাটা
ফালকাটা দুই ফুট লম্বা তরোয়াল, যা প্রাচীন স্পেনে সেল্টবেরিয়ান যোদ্ধারা ব্যবহার করত। ধাতুবিদ্যা উন্নত হওয়ার ফলে স্টিল বা লোহা নিয়ে চলতে থাকা নিরীক্ষার প্রাথমিক ফল এই অস্ত্র। হাতলের কাছে একদিকে ধার, কিন্তু মাথার দিকে দুদিকে ধারালো হয়ে থাকে ফালকাটা। একটু বাঁকা এই তরোয়াল একসঙ্গে কুঠারের চিরে দেওয়া, আর ধারালো তরোয়ালের কেটে ফেলার কাজ করত।
ফালকাটা ছিল কার্থেজের সেনাপতি হ্যানিবলের প্রিয় অস্ত্র। তিনি রোমের বিরুদ্ধে পিউনিক যুদ্ধ চলাকালে আফ্রিকান সেনাদের এই অস্ত্রে সজ্জিত করেছিলেন। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, হাতাহাতি যুদ্ধে তরোয়ালটির কার্যকারিতা হানিবল সেনার রোমানদের বিরুদ্ধে জয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
উলফবার্ট
এটি ভাইকিং তরোয়াল। অষ্টম শতাব্দীর শুরু থেকে ভাইকিং নৌ-যোদ্ধারা ইউরোপের সমুদ্র উপকূলীয় জনবসতিতে তাদের বর্বর আক্রমণ চালিয়ে সমগ্র এলাকায় আতঙ্ক ছড়ায়।
মোট ১৭০টি প্রাচীন উলফবার্ট তরোয়াল পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে চুয়াল্লিশটি নরওয়ে, আর একত্রিশটি ফিনল্যান্ড থেকে পাওয়া গেছে। পাগান সভ্যতার রীতি অনুযায়ী এগুলো বেশির ভাগ কবরস্থান থেকে পাওয়া। এ ছাড়া কিছু ইংল্যান্ডের মরা নদীর বুঁজে যাওয়া খাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
উদ্ধার করা প্রতিটি তরোয়ালে উলফবার্ট বা (+VLFBERHT+) খোদাই করা থাকত। হাতলে লেড বা দস্তার কাজ করা, আর এর ধারালো ব্লেডের অংশ হাই কার্বন স্টিল দিয়ে তৈরি। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের আগে কীভাবে এই উন্নত স্টিল এল, সেটাও একটা জিজ্ঞাসার বিষয়। অবশ্য কেউ বলেন, জার্মানির এক খনি থেকে; আবার কেউ বলেন আরব-পারস্য থেকে রপ্তানি করা হয়েছিল এই উন্নত স্টিল। তবে যেখান থেকেই আসুক, এই তরোয়াল কয়েক শ বছর পৃথিবীর একটা বিশাল অংশের মেরুদণ্ড দিয়ে শিরশিরে হাওয়া বইয়ে দিয়েছিল।
বোলো ছুরি
‘বোলো’ মূলত ঘাস, বাঁশ বা ফসল কাটার কাজে ব্যবহৃত ফিলিপাইনের একটি ‘মাল্টিপারপাস’ অস্ত্র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীদের হাতে এটি যুদ্ধের এক দুর্দান্ত অস্ত্রে পরিণত হয়।
১৮৯৬ সালে ফিলিপাইন বিপ্লব, স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ, আর ফিলিপাইন-আমেরিকান যুদ্ধে ফিলিপাইনের দেশীয় গেরিলারা মূল অস্ত্র হিসেবে এ বোলোকে ব্যবহার করে। গেরিলা যুদ্ধে রাইফেল-গুলি ফুরিয়ে গেলেও এই ‘বোলোমেন’ প্রায়ই তাদের ছুরি নিয়ে যুদ্ধের মাঠে হারজিতের লড়াইয়ে মারাত্মক প্রভাব ফেলত।
এক আমেরিকান সেনা লিখেছেন, ‘তারা মানুষের জীবন নেওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষ এবং গর্বিত। তাদের গর্বের কারণ হলো এক কোপে শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করা!’ এই ভয়ংকর ব্লেড পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবার অ্যাকশনে এসেছিল। বর্তমানে ফিলিপিনো মার্শাল আর্টে এটি একটি সাধারণ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়।
কাতানা
জাপানের মধ্যযুগীয় ইতিহাসের আইকোনিক অস্ত্র এটি। কয়েক শতাব্দী ধরে এই বাঁকা, এক ধারযুক্ত ব্লেডগুলো সামুরাই যোদ্ধাদের পছন্দের অস্ত্র ছিল। জাপানের বীর যোদ্ধারা তাদের রাজাদের দেশ জয়ের স্বপ্ন পূরণ করেছিল এই তরোয়াল দিয়ে। ৮০০ বছর আগে সেরা সামুরাই তার কাতানা তরোয়ালের হালকা-ক্ষিপ্র আঘাতে শত্রুর মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করার দক্ষতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল।
কিংবদন্তি ‘হোনজো মাসামুনে’কে শ্রেষ্ঠ কাতানা তরোয়াল বলে মনে করা হয়। সম্ভবত তেরো শতকে এর সৃষ্টি। তারপর অনেক বীরের হাত ঘুরে এই তরোয়াল ষোলো শতকে বীর যোদ্ধা হনজো শিগেনাগার হাতে আসে। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে অদৃশ্য হয়ে যায়। সম্ভবত কোনো আমেরিকান সেনা অফিসার সেটাকে চুরি করে নিয়ে যায় বা নষ্ট করে ফেলে। প্রচুর অনুসন্ধান করেও জাপানের এই মূল্যবান জাতীয় নিদর্শনটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বুয়ি নাইফ
জিম বুয়ি এক আমেরিকান-ইউরোপিয়ান দাস ব্যবসায়ী এবং মারপিটের জন্য বিখ্যাত মানুষ। তাঁর নামে এই চাকুও বিখ্যাত। জিম বুয়ি এ ধরনের একটা চাকু দিয়েই ডুয়েল বা হাতাহাতি লড়াইয় জেতেন।
‘বুয়ি নাইফ’ খবরের কাগজ আর বিজ্ঞাপনের দৌলতে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে ওঠে। আসলে এটা ‘বুচার নাইফ’ বা আমাদের কসাইদের হাতে যেমন ছুরি দেখি, সেই জিনিস। তবে এর একটি ‘স্পেশাল ডিজাইন’ বুয়ি নিজে এক কামারশালায় অর্ডার দিয়ে বানিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, সেখান থেকেই এই নাম।
টেক্সাস দখল করতে আমেরিকানরা যে যুদ্ধ করে, তাতে এই চাকুর বহুল ব্যবহার হয়। বুয়ি নিজেও টেক্সাস রেভ্যুলিউশনে যোগ দেন এবং নিহত হন। তারপরও ম্যাক্সিকান যুদ্ধ, ক্যালিফোর্নিয়ার সোনার খোঁজে ‘গোল্ডরাশ’, কানসাসে জনযুদ্ধ, পরে আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে ঝামেলা—এসবেও বুয়ি নাইফ কাজে লাগে। মজার ব্যাপার হলো, আব্রাহাম লিঙ্কনকে হত্যা করার সময় হত্যাকারী জন উইলকিস বুথ পালানোর সময় একটা বুয়ি নাইফ ফেলে পালিয়েছিল। পিস্তল বা রিভলবার সহজলভ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত আমেরিকান হাতাহাতি বা সাহিত্য সবখানেই এর উপস্থিতি একে কল্পনার জগতে নিয়ে গেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান মেরিন কোরের ‘কা-বার’ ছুরি এ বুয়ি নাইফের বংশধর। আমেরিকান অস্ত্র কোম্পানি আর্নেস্ট এমারশন বুয়ি নাইফের ছবি তাদের লোগোতে ব্যবহার করে। এই কোম্পানি নাসার মহাকাশ যাত্রীদের জন্য চাকু বানায়! আমেরিকান আর্মির ৩৯ নম্বর ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড টিমের লোগো এই বুয়ি নাইফ! ভারতের এয়ার ফোর্স পাইলটদের সার্ভাইভাল কিটের মধ্যেও এই বুয়ি নাইফ থাকে।
জাইফোস (ক্ষিপোস)
এটি দুদিকে ধারালো গ্রিক তরোয়াল। দৈর্ঘ্য দেড় থেকে দুই ফুট, সোজা, ওজন এক কেজির কম। আলেক্সান্ডার তাঁর ম্যাসিডনের আর্মি নিয়ে সারা মধ্যপ্রাচ্য লুট করে ভারত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন এই তরোয়াল হাতে নিয়েই।
আসলে গ্রিকদের কাছে এটা ছিল সাহায্যকারী অস্ত্র। স্পিয়ার বা বল্লম ওদের প্রধান অস্ত্র ছিল। কিন্তু কোনোভাবে বল্লম ভেঙে গেলে বা হাত থেকে ছিটকে গেলে, তখন কোমরে ঝোলানো জাইফোস বের করে, হা রে! রে! রে! করে শত্রুর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ত তারা।
শব্দটা যেমন মিসরের খোপেশের কাছাকাছি, তেমনি টেকনোলজিও। এই অস্ত্র ব্রোঞ্জ যুগের ডিজাইন। মাঝখানটা মোটা আর দুই ধার সরু। ব্লেড বেশি লম্বা নয়। কারণ ব্রোঞ্জের শক্তি কম। ভারতীয় যুদ্ধ শাস্ত্রে এ ধরনের অস্ত্র দেখা যায় না। এর কারণ হয়তো ভারতবর্ষের উন্নত ধাতুবিদ্যা। অবশ্য এখানকার খড়্গ বা খাঁড়া দেখতে অনেকটা এর কাছাকাছি।
স্পার্টার যোদ্ধারা যে গ্লডিয়াস ব্যবহার করত, সেটা এরই চাচাতো ভাই! যে কয়েকখানা জাইফোস উদ্ধার হয়েছে, তা প্রায় সবই কবরখানা থেকে। তার মানে যোদ্ধাদের সমাধিতে জাইফোস রাখা হতো। অর্থাৎ, গ্রিকদেরও ভূতের ভয় ছিল!
সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করতে ‘অস্ত্রের ধার’ আর ‘অর্থের ভার’ দুই–ই লাগে। আগেও লাগত, এখনো লাগে।
কিছু ধারালো ব্লেড বা অস্ত্র আছে, যা পৃথিবীর বুক চিরে ইতিহাস লিখেছে। এই ধারালো ব্লেডগুলো দুর্বল মানুষের মনে ভয় আর সবল জাতির ক্ষমতার মোহকে অনুপ্রাণিত করে এসেছে কয়েক হাজার বছর ধরে। তার কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যাক।
প্রাচীনকাল থেকেই সেনা অভিযানে ধারালো তরোয়াল, ছুরি ও ছুরির মতো কিছু অস্ত্র বিশ্বজুড়ে যোদ্ধাদের খুব পছন্দের। অস্ত্র, ক্ষমতা আর অর্থ এক সুতোয় বাঁধা, যার এক একপ্রান্তে থাকে নির্ভীক সাধারণ একজন সৈনিক, আর অন্য প্রান্তে থাকে শিল্পী। যুগে যুগে দেশে দেশান্তরে কামারশালার শিল্পীদের বানানো এ সমস্ত ক্ষুরধার ব্লেড বীর যোদ্ধা, রাজা, সেনাপতিদের মনে স্বপ্ন ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
খোপেশ
ব্রোঞ্জ যুগে আবিষ্কৃত প্রথম দিকের তরোয়ালগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। প্রাচীন মিসরীয় কাস্তে আকৃতির অস্ত্র খোপেশ, যার বাইরের প্রান্ত ধারালো থাকত। এ অস্ত্র মিসরে জন্ম নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত পৌঁছায়। অবশ্য ভারত ভূখণ্ডে এর দেখা মেলেনি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন বিশ্বজুড়ে মাথা চাড়া দিচ্ছে, তখন এই ধারালো অস্ত্র ফারাওদের সেনাবাহিনীকে সুসজ্জিত করে।
শিল্পীরা খোপেশে সুন্দর কারুকার্য করে ফারাওদের পিরামিড সাজাত। তুতেন খামেনের পিরামিডে দুটো দুই আকারের খোপেশ পাওয়া গেছে। এগুলো ‘সিঙ্গল পিস’ ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি। এর প্রথম অংশ বা হাতলের অংশটি কালো রঙের, আর দ্বিতীয় অংশটি হাতলের ওপরে—তাতে একটা পদ্মফুল খোদাই করা। তৃতীয় অংশ কাস্তের আকারে বাঁকানো। পরবর্তীতে আরও ভালো ধাতুবিদ্যা আর অস্ত্র তৈরির কৌশল আবিষ্কার হলে খোপেশকে স্বাভাবিকভাবেই রাস্তা ছেড়ে দিতে হয়। তবুও ইতিহাস একে মনে রেখেছে সভ্যতার শুরুর দিনে তার অনবদ্য অবদানের জন্য।
খুকরি
কয়েক শতাব্দী ধরে যুদ্ধের ইতিহাসে নেপালের এই ছোট্ট, একটু বাঁকা ছুরি এক ঐতিহ্যবাহী গোর্খা সেনা হাতিয়ার। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপীয়রা প্রথম খুকরির প্রেমে পড়ে। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নেপালি গোর্খা যোদ্ধাদের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্য বাহিনী সংঘর্ষে লিপ্ত হলে নেপালিদের খুকরি চালানোর দক্ষতা দেখে ব্রিটিশ কমান্ডার অকটারলোনি গোর্খাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অন্যতম শক্তিশালী সামরিক ইউনিটে পরিণত করেন।
খুকরি বর্তমান ব্রিটিশ ও ভারতীয় আর্মিতে ‘স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু’ অস্ত্র হিসেবে গোর্খাদের দেওয়া হয়। রয়্যাল গোর্খা বা ভারতীয় গোর্খা রেজিমেন্টের লোগো এই খুকরি। আর এই ব্লেডের স্বাদ সবচেয়ে ভালো পেয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান আফ্রিকা কোর এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী—বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও কারগিল যুদ্ধে।
ফালকাটা
ফালকাটা দুই ফুট লম্বা তরোয়াল, যা প্রাচীন স্পেনে সেল্টবেরিয়ান যোদ্ধারা ব্যবহার করত। ধাতুবিদ্যা উন্নত হওয়ার ফলে স্টিল বা লোহা নিয়ে চলতে থাকা নিরীক্ষার প্রাথমিক ফল এই অস্ত্র। হাতলের কাছে একদিকে ধার, কিন্তু মাথার দিকে দুদিকে ধারালো হয়ে থাকে ফালকাটা। একটু বাঁকা এই তরোয়াল একসঙ্গে কুঠারের চিরে দেওয়া, আর ধারালো তরোয়ালের কেটে ফেলার কাজ করত।
ফালকাটা ছিল কার্থেজের সেনাপতি হ্যানিবলের প্রিয় অস্ত্র। তিনি রোমের বিরুদ্ধে পিউনিক যুদ্ধ চলাকালে আফ্রিকান সেনাদের এই অস্ত্রে সজ্জিত করেছিলেন। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, হাতাহাতি যুদ্ধে তরোয়ালটির কার্যকারিতা হানিবল সেনার রোমানদের বিরুদ্ধে জয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
উলফবার্ট
এটি ভাইকিং তরোয়াল। অষ্টম শতাব্দীর শুরু থেকে ভাইকিং নৌ-যোদ্ধারা ইউরোপের সমুদ্র উপকূলীয় জনবসতিতে তাদের বর্বর আক্রমণ চালিয়ে সমগ্র এলাকায় আতঙ্ক ছড়ায়।
মোট ১৭০টি প্রাচীন উলফবার্ট তরোয়াল পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে চুয়াল্লিশটি নরওয়ে, আর একত্রিশটি ফিনল্যান্ড থেকে পাওয়া গেছে। পাগান সভ্যতার রীতি অনুযায়ী এগুলো বেশির ভাগ কবরস্থান থেকে পাওয়া। এ ছাড়া কিছু ইংল্যান্ডের মরা নদীর বুঁজে যাওয়া খাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
উদ্ধার করা প্রতিটি তরোয়ালে উলফবার্ট বা (+VLFBERHT+) খোদাই করা থাকত। হাতলে লেড বা দস্তার কাজ করা, আর এর ধারালো ব্লেডের অংশ হাই কার্বন স্টিল দিয়ে তৈরি। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের আগে কীভাবে এই উন্নত স্টিল এল, সেটাও একটা জিজ্ঞাসার বিষয়। অবশ্য কেউ বলেন, জার্মানির এক খনি থেকে; আবার কেউ বলেন আরব-পারস্য থেকে রপ্তানি করা হয়েছিল এই উন্নত স্টিল। তবে যেখান থেকেই আসুক, এই তরোয়াল কয়েক শ বছর পৃথিবীর একটা বিশাল অংশের মেরুদণ্ড দিয়ে শিরশিরে হাওয়া বইয়ে দিয়েছিল।
বোলো ছুরি
‘বোলো’ মূলত ঘাস, বাঁশ বা ফসল কাটার কাজে ব্যবহৃত ফিলিপাইনের একটি ‘মাল্টিপারপাস’ অস্ত্র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীদের হাতে এটি যুদ্ধের এক দুর্দান্ত অস্ত্রে পরিণত হয়।
১৮৯৬ সালে ফিলিপাইন বিপ্লব, স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ, আর ফিলিপাইন-আমেরিকান যুদ্ধে ফিলিপাইনের দেশীয় গেরিলারা মূল অস্ত্র হিসেবে এ বোলোকে ব্যবহার করে। গেরিলা যুদ্ধে রাইফেল-গুলি ফুরিয়ে গেলেও এই ‘বোলোমেন’ প্রায়ই তাদের ছুরি নিয়ে যুদ্ধের মাঠে হারজিতের লড়াইয়ে মারাত্মক প্রভাব ফেলত।
এক আমেরিকান সেনা লিখেছেন, ‘তারা মানুষের জীবন নেওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষ এবং গর্বিত। তাদের গর্বের কারণ হলো এক কোপে শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করা!’ এই ভয়ংকর ব্লেড পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবার অ্যাকশনে এসেছিল। বর্তমানে ফিলিপিনো মার্শাল আর্টে এটি একটি সাধারণ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়।
কাতানা
জাপানের মধ্যযুগীয় ইতিহাসের আইকোনিক অস্ত্র এটি। কয়েক শতাব্দী ধরে এই বাঁকা, এক ধারযুক্ত ব্লেডগুলো সামুরাই যোদ্ধাদের পছন্দের অস্ত্র ছিল। জাপানের বীর যোদ্ধারা তাদের রাজাদের দেশ জয়ের স্বপ্ন পূরণ করেছিল এই তরোয়াল দিয়ে। ৮০০ বছর আগে সেরা সামুরাই তার কাতানা তরোয়ালের হালকা-ক্ষিপ্র আঘাতে শত্রুর মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করার দক্ষতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল।
কিংবদন্তি ‘হোনজো মাসামুনে’কে শ্রেষ্ঠ কাতানা তরোয়াল বলে মনে করা হয়। সম্ভবত তেরো শতকে এর সৃষ্টি। তারপর অনেক বীরের হাত ঘুরে এই তরোয়াল ষোলো শতকে বীর যোদ্ধা হনজো শিগেনাগার হাতে আসে। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে অদৃশ্য হয়ে যায়। সম্ভবত কোনো আমেরিকান সেনা অফিসার সেটাকে চুরি করে নিয়ে যায় বা নষ্ট করে ফেলে। প্রচুর অনুসন্ধান করেও জাপানের এই মূল্যবান জাতীয় নিদর্শনটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বুয়ি নাইফ
জিম বুয়ি এক আমেরিকান-ইউরোপিয়ান দাস ব্যবসায়ী এবং মারপিটের জন্য বিখ্যাত মানুষ। তাঁর নামে এই চাকুও বিখ্যাত। জিম বুয়ি এ ধরনের একটা চাকু দিয়েই ডুয়েল বা হাতাহাতি লড়াইয় জেতেন।
‘বুয়ি নাইফ’ খবরের কাগজ আর বিজ্ঞাপনের দৌলতে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে ওঠে। আসলে এটা ‘বুচার নাইফ’ বা আমাদের কসাইদের হাতে যেমন ছুরি দেখি, সেই জিনিস। তবে এর একটি ‘স্পেশাল ডিজাইন’ বুয়ি নিজে এক কামারশালায় অর্ডার দিয়ে বানিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, সেখান থেকেই এই নাম।
টেক্সাস দখল করতে আমেরিকানরা যে যুদ্ধ করে, তাতে এই চাকুর বহুল ব্যবহার হয়। বুয়ি নিজেও টেক্সাস রেভ্যুলিউশনে যোগ দেন এবং নিহত হন। তারপরও ম্যাক্সিকান যুদ্ধ, ক্যালিফোর্নিয়ার সোনার খোঁজে ‘গোল্ডরাশ’, কানসাসে জনযুদ্ধ, পরে আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে ঝামেলা—এসবেও বুয়ি নাইফ কাজে লাগে। মজার ব্যাপার হলো, আব্রাহাম লিঙ্কনকে হত্যা করার সময় হত্যাকারী জন উইলকিস বুথ পালানোর সময় একটা বুয়ি নাইফ ফেলে পালিয়েছিল। পিস্তল বা রিভলবার সহজলভ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত আমেরিকান হাতাহাতি বা সাহিত্য সবখানেই এর উপস্থিতি একে কল্পনার জগতে নিয়ে গেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান মেরিন কোরের ‘কা-বার’ ছুরি এ বুয়ি নাইফের বংশধর। আমেরিকান অস্ত্র কোম্পানি আর্নেস্ট এমারশন বুয়ি নাইফের ছবি তাদের লোগোতে ব্যবহার করে। এই কোম্পানি নাসার মহাকাশ যাত্রীদের জন্য চাকু বানায়! আমেরিকান আর্মির ৩৯ নম্বর ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড টিমের লোগো এই বুয়ি নাইফ! ভারতের এয়ার ফোর্স পাইলটদের সার্ভাইভাল কিটের মধ্যেও এই বুয়ি নাইফ থাকে।
জাইফোস (ক্ষিপোস)
এটি দুদিকে ধারালো গ্রিক তরোয়াল। দৈর্ঘ্য দেড় থেকে দুই ফুট, সোজা, ওজন এক কেজির কম। আলেক্সান্ডার তাঁর ম্যাসিডনের আর্মি নিয়ে সারা মধ্যপ্রাচ্য লুট করে ভারত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন এই তরোয়াল হাতে নিয়েই।
আসলে গ্রিকদের কাছে এটা ছিল সাহায্যকারী অস্ত্র। স্পিয়ার বা বল্লম ওদের প্রধান অস্ত্র ছিল। কিন্তু কোনোভাবে বল্লম ভেঙে গেলে বা হাত থেকে ছিটকে গেলে, তখন কোমরে ঝোলানো জাইফোস বের করে, হা রে! রে! রে! করে শত্রুর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ত তারা।
শব্দটা যেমন মিসরের খোপেশের কাছাকাছি, তেমনি টেকনোলজিও। এই অস্ত্র ব্রোঞ্জ যুগের ডিজাইন। মাঝখানটা মোটা আর দুই ধার সরু। ব্লেড বেশি লম্বা নয়। কারণ ব্রোঞ্জের শক্তি কম। ভারতীয় যুদ্ধ শাস্ত্রে এ ধরনের অস্ত্র দেখা যায় না। এর কারণ হয়তো ভারতবর্ষের উন্নত ধাতুবিদ্যা। অবশ্য এখানকার খড়্গ বা খাঁড়া দেখতে অনেকটা এর কাছাকাছি।
স্পার্টার যোদ্ধারা যে গ্লডিয়াস ব্যবহার করত, সেটা এরই চাচাতো ভাই! যে কয়েকখানা জাইফোস উদ্ধার হয়েছে, তা প্রায় সবই কবরখানা থেকে। তার মানে যোদ্ধাদের সমাধিতে জাইফোস রাখা হতো। অর্থাৎ, গ্রিকদেরও ভূতের ভয় ছিল!
সাত বছর প্রেমের পর বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছিলেন। বাধা হয়ে দাঁড়াল হবু শাশুড়ির আপত্তি। না বিয়ে নয়, তাঁর আপত্তি অন্য বিষয়ে। পুত্রবধূকে ঘরে আনতে আপত্তি নেই, কিন্তু কোনোভাবেই তাঁর পোষা কুকুরকে ঘরে তুলবেন না পাত্রের মা। এই আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত বিয়েই ভেঙে দিলেন ভারতের এক তরুণী!
১ ঘণ্টা আগেরোমাঞ্চকর কোনো অভিযান বা কাজের প্রতি তরুণদের আগ্রহ নতুন কিছু নয়। আর সেই সঙ্গে যদি আকাশ থেকে বিস্তৃত এলাকা দেখার সুযোগ থাকে তাহলে তো কথাই নেই। চীনের ৩৭ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর মতো জায়গার অভাব নেই। তবে চীনা তরুণ পর্যটকদের এখন ঝোঁকটা আকাশ থেকে দেশ দেখায়।
১ ঘণ্টা আগেগত ৩০ অক্টোবর কেপ কোরাল শহরে আমেরিকার খুচরা পণ্য বিক্রয় প্রতিষ্ঠান টার্গেটের একটি স্টোর থেকে ৫০০ ডলার মূল্যের ১৬টি গৃহস্থালি পণ্য ও পোশাক চুরি করেন মার্লিনা। এই ঘটনাকে ‘ছোটখাটো চুরি’ বলা হলেও ৫০০ ডলার অর্থমূল্যের কারণে বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়া পর্যন্ত গড়িয়েছে।
২ ঘণ্টা আগে৯১১-তে ফোন দিয়ে কত জরুরি প্রয়োজনেই তো সাহায্য চায় মানুষ। তাই বলে নিশ্চয় আশা করবেন না কেউ অঙ্ক মিলিয়ে দিতে বলবে। কিন্তু ৯১১-তে ফোন দিয়ে এ আবদারই করে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনের ১০ বছরের এক বালক।
৩ দিন আগে