Ajker Patrika

নারী মানেই আনাড়ি নয়

সেলিম জাহান
নারী মানেই আনাড়ি নয়

তিনটি কথা প্রথমেই বলে নেই। প্রথমত আমি শিবরাম চক্রবর্তীর পরম ভক্ত। তাঁর শব্দের খেলা আমার ভারি ভালো লাগে। ওই যে, ‘ধার করি আমরা উদ্ধার পাওয়ার জন্য’ কিংবা ‘স্বামী মানেই আসামি’। এবার ভাবলাম আমিও সে রকম একটু চেষ্টা করে দেখি না! বেশ ধস্তাধস্তির পরে বোঝা গেল, ও আমার কম্ম নয়। এখন যেমন ‘লেজেগোবরে’ অবস্থা আমার, তখন আমাকে বাঁচিয়ে দিল আমাদের শামীম—সতীর্থ বন্ধু শামীম আজাদ।

সেটাই আমার দ্বিতীয় কথা, তাঁর একটা লেখার শিরোনাম দেখেছিলাম, ‘নারী মানেই আনাড়ি নয়’। সেটাই চেয়েচিন্তে নিলাম তাঁর কাছ থেকে। অনেকটা ধার করলাম উদ্ধার পাওয়ার জন্য। ‘বাহ্, দোষের কী হলো?’ ‘বন্ধুকে বন্ধু না দেখিলে আর কে দেখিত?’ ওই আবারও শিবরাম, ‘চক্কোত্তিকে চক্কোন্তি না দেখিলে আর কে দেখিবে?’

আর তৃতীয়ত, হাসি-ঠাট্টা ছেড়ে দিয়ে গুরুগম্ভীরতার সঙ্গে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা প্রয়োজন। পুত্রবধূ নির্বাচনী পরীক্ষা নিচ্ছেন এক ভদ্রলোক। ‘রান্না জানো?’ ‘সামান্য’, মেয়েটির শান্ত উত্তর। ‘বড়ি দিয়ে কুমড়োশাক কী করে রাঁধতে হয়?’ কিছু একটা বলল মেয়েটি। কিন্তু নিঃসন্দেহে সেটি সঠিক উত্তর নয়। ‘সেলাই করতে পারো?’ প্রশ্নের রেলগাড়ি চলতেই থাকে। ‘না’—চোখভরা জল মেয়েটির। ‘তুমি তো দেখছি একেবারেই আনাড়ি’—রায় ঘোষিত হয়ে গেল।

বড় মায়া হয় মেয়েটির জন্য আমার—আমারই তো এক ভ্রাতুষ্পুত্রী সে। ‘আপনি আবৃত্তি করতে পাবেন?’ জানতে চাই আমি ভদ্রলোকটির কাছে। সারা ঘরের সব কথা থেমে যায়। ভদ্রলোক হতবাক! ‘না’, অবাক গলায় বলেন তিনি। ‘পিরিচে একটুকুও চা না ফেলে ভরা কাপ চা নিয়ে আসতে পারেন?’ আমার ভাবির রক্তচক্ষু সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রশ্নবান ছুড়ে দিই আমি ওই ভদ্রজনের প্রতি। ‘চেষ্টা করিনি কখনো!’ তাঁর কণ্ঠের কাঠিন্য টের পাই আমি। ‘ছোট্ট একটা হাতুড়ি দিয়ে দেয়ালে একটুও ক্ষত না করে এক বাড়িতে পেরেক লাগাতে পারেন?’ ভদ্রলোকের চোখে চোখ রেখে বলি আমি। রাগে ভদ্রলোক কথা পর্যন্ত কন না। এবার শক্ত গলায় বলি আমি, ‘আপনি তো ওর চাইতেও আনাড়ি। ও তো এই সবকিছু পারে অনায়াসে।’

ওই পক্ষ চলে গেলে তিরস্কারের বন্যা বয়ে যায় আমার ওপর দিয়ে। ভাই-ভাবি আমার সঙ্গে এক মাস কথা কননি। আমার বাচালতায় বিরক্ত হয়েছিলেন আমার খালা। শুধু যখন চলে আসি, তখন মেয়েটি আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, ‘চাচা, আজ একমাত্র তুমিই আমার সম্মান রক্ষা করলে।’ ওর চিবুকে আলতো করে আদর করে বেরিয়ে আসি।

এই আখ্যানের একটি পাদটীকা আছে। সেদিনের সেই তরুণী পশ্চিমের এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগে। সেখানে বিভাগীয় প্রধানও সে। যে দক্ষতায় সে বিভাগীয় প্রশাসন চালায়, সেই একই দক্ষতায় সে অনেক সুরম্য ভবনের নকশা করেছে! দুর্দান্ত রাঁধুনি সে, সূচিকর্মেও তার জুড়ি নেই, বড়ির পাঁচ রকমের রান্না সে আমাকে খাইয়েছে। সে নারী নিঃসন্দেহে, কিন্তু আনাড়ি নয় কোনোমতেই।

নারী যে আনাড়ি নয়, তার প্রচুর প্রমাণ ইতিহাসে আছে, আছে গল্পগাথায়, আছে আমাদের চোখের সামনে নিত্যদিন। নারী শুধু রাজ্য শাসন করেনি, ‘রাজারে শাসিছে নারী’, ঘরে-বাইরে জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর ধ্যানধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা, কর্মধারা প্রতিনিয়তই প্রমাণ করেছে যে তারা আনাড়ি নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার মতো সামষ্টিক ব্যাপারেই শুধু নয়, জীবন ও জগতের নানা ক্ষেত্রে নারীর দক্ষতা অর্জন সুবিদিত।

কী না করেছে নারী? তথাকথিত পুরুষের কাজের ক্ষেত্রেও তারা প্রমাণ করেছে যে, কোনো অংশেই তারা আনাড়ি নয়। তাদের সক্ষমতা বাড়ালে এবং তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হলে তারা যে আনাড়ি নয়, তা তারা প্রমাণ করতে পারে। ‘নারী আনাড়ি’—এজাতীয় একটি বায়বীয় ধারণা সৃষ্টি করার জন্য পুরুষ কতগুলো কল্পকথা বানিয়েছে:

এক. নারী দুর্বল, তাই বহু কাজ তাদের সাধ্যের বা আয়ত্তের বাইরে।

দুই. তথাকথিত পুরুষের কাজগুলো নারী করতে পারবে না।

তিন. নারী আবেগপ্রবণ। অতএব, শান্ত ও জটিল চিন্তার কাজগুলো তাদের জন্য নয়।

চার. ঘরের ভেতরের কাজগুলো নারীদের উপযোগী, সুতরাং সেখানেই তাদের অবস্থান কাম্য।

পাঁচ. নারীর বুদ্ধি কম, সুতরাং বিজ্ঞান বা প্রকৌশলের মতো ব্যাপারগুলো তাদের আয়ত্তের বাইরে।

এই পাঁচটি যুক্তি যে শুধু খোঁড়া তাই নয়, নারীর প্রতি এগুলো অত্যন্ত অবমাননাকরও বটে। প্রথমত, নারী-পুরুষের শারীরিক গঠন ও মনোজগতে নানান পার্থক্য আছে। সে কারণে নানান কাজ করার আয়াসসাধ্যতারও হেরফের আছে। কিন্তু তার মানে এই নয়, নারী আনাড়ি। পুরুষের আনাড়িপনার তালিকা যদি প্রস্তুত করা যায়, তাহলে এক ইতিহাস লেখা যাবে। নারীকে দুর্বল করে তার মনে একধরনের হীনম্মন্যতা সৃষ্টি করাই এই বক্তব্যের মূল লক্ষ্য।

দ্বিতীয়ত, তথাকথিত ‘পুরুষের কাজগুলো’ নারীরা করছে শুধু দক্ষতার সঙ্গে নয়, সৌষ্ঠব্য নিয়েও। বিমান চালনা থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীতে, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ থেকে মহাকাশযাত্রা, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা—সব ক্ষেত্রেই নারী প্রমাণ করেছে যে, তথাকথিত ‘পুরুষের কাজগুলো’ তারা সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করতে পারে—চাই শুধু সুযোগের, সক্ষমতা বৃদ্ধির এবং কর্মের পরিধি বিস্তারের। সর্বত্র নারী প্রমাণ করেছে যে ‘নারীর কাজ’, ‘পুরুষের কাজ’ বলে কোনো বিভাজন নেই, ওটা পুরুষের সৃষ্টি তার তথাকথিত ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রমাণের জন্য। একটা কথা বলি, ‘পুরুষের কাজ’ বলে যেগুলো পুরুষ সনাতন কাল ধরে চিহ্নিত করেছে, সেগুলোর দেয়াল নারী এক এক করে ভেঙে দিচ্ছে। কিন্তু ‘নারীর কাজ’ বলে পুরুষ যে কাজগুলো চিহ্নিত করেছে, তার কতটুকু করার দক্ষতা পুরুষ অর্জন করেছে? তার একটি কাজ তো পুরুষ কখনোই করতে পারবে না। পুরুষকে যদি সন্তান ধারণ করতে হতো, তাহলে পৃথিবীর জনসংখ্যা চল্লিশের বেশি হতো না।

তৃতীয়ত, ‘আবেগ’ ও ‘সংবেদনশীলতা’ এক বস্তু নয়। নারীর ‘সংবেদনশীলতা’কে ভুল করে ‘আবেগ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। নারী ‘সংবেদনশীল’, কিন্তু ‘অতি আবেগপ্রবণ’ নয় নিঃসন্দেহে। আসলে সত্যিকারের আবেগপ্রবণ হচ্ছে পুরুষেরা। এবং তাদের আবেগ বড়ই তীব্র। তাদের অতি আবেগপ্রবণতার ভার নারীকেই বহন করতে হয়। নারীর আবেগের প্রমাণ হিসেবে তাদের কান্নাকে চিহ্নিত করা হয়। ওটা তাদের সংবেদনশীলতার প্রমাণ, অতি আবেগপ্রবণ পুরুষের আবেগের জল যদি ধরে রাখা হয়, তাহলে তা দিয়ে আরেকটি গঙ্গা বইয়ে দেওয়া যাবে।

চতুর্থত, ‘ঘরের কাজগুলো’ নারীর উপযোগী—এ ব্যাপারটিও পুরুষের সৃষ্টি। নারীকে গৃহাভ্যন্তরে আটকে রাখার এক চমকপ্রদ ফন্দি। ঘরের কাজগুলো যে পুরুষ করতে পারে অতি সুন্দরভাবে, তার প্রমাণ বহু পুরুষ দিয়েছে। আসলে ঘরের ভেতরের কাজগুলোর বিরাট ভার যদি পুরুষ সহভাগ করে নেয়, তাহলে নারীর পক্ষে বহু উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল কাজ করা সম্ভব। গৃহাভ্যন্তরের কাজগুলোতে পুরুষের সহভাগ নারীমুক্তির আবশ্যিক শর্ত, পর্যাপ্ত শর্ত নয় অবশ্য।

পঞ্চমত, ‘নারীর বুদ্ধি কম, সুতরাং বিজ্ঞান তাদের আয়ত্তের বাইরে’, এমন একটি অকল্পনীয় কথা বলেছিলেন একদা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান, বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী লরেন্স সামার্স। আমার পরিচিত এক অর্থনীতিবিদের এমন একটি অশোভন উক্তিতে লজ্জায় মুখ লুকাই। তবে এমন নির্বোধ অবমাননাকর উক্তির জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এমন উক্তি উত্তরের যোগ্য নয়।

এখন মোক্ষম প্রশ্ন হচ্ছে, এত সব যুক্তি ও সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নারীকে আনাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করার এবং সেটাই প্রতিষ্ঠিত করার ক্রমাগত প্রয়াসের কারণটা কী? আমার মনে হয়, সে কারণের একটি মনস্তাত্ত্বিক দিক আছে এবং সেই সঙ্গে একটি বাস্তবতার দিকও আছে। মনে রাখা দরকার যে, ‘নারী মানেই আনাড়ি’ এমন কথা কিন্তু নারীরা বলছে না, বলবেও না। কথাটি উচ্চারিত হচ্ছে প্রবলভাবে পুরুষের দ্বারা। এবং এই পর্যবেক্ষণের মধ্যে উল্লেখিত প্রশ্নটির উত্তর লুকিয়ে আছে।

আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে অবদমন করাটা জরুরি পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য। সেই অবদমনের একটি সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক মাত্রিকতা আছে। নারীকে যদি জীবনের বহু ক্ষেত্রে ক্রমাগতভাবে আনাড়ি বলে পরিহাস করা হয়, তিরস্কার করা হয়, তাহলে তার মধ্যে একটি হীনম্মন্যতাবোধের জন্ম হবে। একটা সময়ে তার মনে হবে, সে বোধ হয় অযোগ্য, অদক্ষ এবং আনাড়ি। তার প্রত্যয়ের ভিতে ফাটল ধরবে এবং তার ক্ষমতায় সে আর আস্থা রাখতে পারবে না। নারীর এই সংশয়িত অবস্থান তাকে অবদমনের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্ষেত্রে বড় প্রয়োজন।

কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি ছাড়াও ‘নারী মানেই আনাড়ি’ বক্তব্যটির একটি বাস্তবভিত্তিক প্রায়োগিক দিকও আছে। একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবদমনের জন্য গৃহের বাইরের বহু কাজেই নারী যোগ্য নয় কথাটির ধুয়ো তুলেই বলা হয়, নারীর প্রকৃত অবস্থান গৃহের অভ্যন্তরে, গৃহকাজই তার যোগ্য কাজ। এই বক্তব্যের দুটো দিক আছে। এক, এমন একটি কথা বলে আমরা নারীকে ঘরের মধ্যে আটকে ফেলি, বাইরের বিশাল পৃথিবীতে তার সক্ষমতার প্রয়োগ এবং তা থেকে প্রাপ্তব্য সুফলের ক্ষেত্রকে আমরা সীমিত করে ফেলি। দুই, নারী গৃহকর্মই সবচেয়ে ভালো করতে পারে—এমন কথা বলে গৃহাভ্যন্তরেই সব রকমের মজুরিবিহীন কাজ আমরা নারীকে দিয়েই করিয়ে নিই। বিনা মূল্য শ্রমের এমন নজির খুব বেশি নেই। প্রায়োগিক দিক থেকে পুরুষের গৃহবহির্ভূত কাজের জন্য এজাতীয় শ্রম একান্ত প্রয়োজনীয়। নারী ঘরের ভেতরে, সেবামূলক কাজে ব্যাপৃত থাকে বলেই পুরুষ ঘরের বাইরের কাজ করতে পারে। নিজেদের কাজের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুরুষ তার ঘরের বাইরের কাজকে সংজ্ঞায়িত করেছে ‘উৎপাদনশীল কাজ’ হিসেবে, যেন ঘরের ভেতরে নারীর কাজটি অনুৎপাদনশীল!

নারীকে আনাড়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তাকে অবদমনের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চেষ্টার অন্ত নেই। নারীর সক্ষমতা বাড়তে দিও না, সুযোগ গ্রহণের আগেই তাকে আটক ফেলো। তাই ১৮ বছর হওয়ার আগেই সারা বিশ্বে ১ কোটি ৫০ লাখ মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। প্রতি দুই মিনিটে একটি বালিকাবধূ। নারীর বাইরের কাজ করার সুযোগকে আটকাও, যে কারণে বিশ্বের ১৮টি দেশে ঘরের বাইরের কাজ করার জন্য নারীকে স্বামীর অনুমতি নিতে হয়। নারীর বহির্বিশ্ব পরিভ্রমণের সুযোগও নিয়ন্ত্রণ করো—৩২টি দেশে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য তাই নারীর ক্ষেত্রে বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া ভিন্ন। নারীকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করো, যার জন্য উন্নয়নশীল বিশ্বে মাত্র ১০ শতাংশ নারীর ভূমির মালিকানা আছে।

নারীকে আনাড়ি প্রমাণের লক্ষ্যে অবদমন পন্থার আরও তো অস্ত্র আছে। সহিংসতা তেমনই একটি অস্ত্র। সেই অস্ত্র ব্যবহৃত হয় নানানভাবে। বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে গৃহাভ্যন্তরে সহিংসতার শিকার হয়েছে। ২০ কোটি নারী শিকার হয় যৌনাঙ্গচ্ছেদের মতো ক্ষতিকর প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর। পরিবারের তথাকথিত সম্মান রক্ষার জন্য প্রতিবছর ৫ হাজার নারীকে আত্মাহুতি দিতে হয় বিভিন্ন দেশে।

নারীর প্রতি পুরুষের সহিংসতার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, যুক্তি ও বাস্তব বিচার-বুদ্ধি হচ্ছে নারীর অস্ত্র আর পেশিশক্তি হচ্ছে পুরুষের অস্ত্র, যার যা ‘অস্ত্র পিত, তা তার সম্বল’—এটা পুরুষ খুব ভালো করেই জানে। তাই নারীর বুদ্ধিবৃত্তি, যুক্তি আর বাস্তব চিন্তার সঙ্গে পুরুষ যখন পেরে ওঠে না, তখনই সে হিংস্র হয়ে ওঠে পেশিশক্তি প্রয়োগ করে এবং সহিংসতার আশ্রয় নেয়।

নারীর প্রতি সহিংসতার একটি চরম রূপ হচ্ছে ধর্ষণ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে দেখা হয় পুরুষের উপভোগের পণ্য হিসেবে। নারী মহলে থাকবে, তাই সে মহিলা। নারী রমণযোগ্য, তাই সে রমণী। নারী যেহেতু উপভোগের সামগ্রী ও পণ্য, তাই তাকে উপভোগ করা যেতে পারে, সেই প্রক্রিয়া স্বেচ্ছাকৃতই হোক কিংবা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই হোক—এই ধারণা বহু পরুষের চিন্তা-চেতনায় বিদ্যমান। ধর্ষণের মনস্তত্ত্বের একটি কেন্দ্রবিন্দু সেখানেই।

 ‘নারী যে আনাড়ি নয়’—এই সত্য প্রমাণ করার জন্য কী করা যেতে পারে? এর মূল কাজটি নারীরাই করছে তাদের অতুলনীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। জীবন ও জগতের প্রতিটি অঙ্গনে তাদের দৃপ্ত পদক্ষেপ। ‘শার্সি উপতল’ তারা এখনো ভাঙতে পারেনি তা ঠিক, কিন্তু ফাটল তো ধরিয়েছে আস্তে আস্তে। জানি, বিশ্বের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উচ্চতম পদগুলোতে দুই-তৃতীয়াংশ এখনো পুরুষের দখলে, কিন্তু সেখানেও ধীরে ধীরে নারীর আরও আগমন ঘটছে।

দ্বিতীয়ত সন্দেহ নেই, যখন আমরা নারীকে জায়া-জননী-আত্মজা হিসেবে চিহ্নিত করি, তখন আমরা তাদের মহিমান্বিত করি। কিন্তু এর কোনোটাই নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় নয়। নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ। নারীর মানুষ পরিচয় পেছনে রেখে আমরা যদি তার জায়া-জননী-আত্মজা পরিচয়কেই তাদের একমাত্র আত্মসত্তা হিসেবে চিহ্নিত করি, তখন কিন্তু মানুষ হিসেবে তাদের সক্ষমতা, সম্ভাবনা ও আত্মপরিচয়কে আমরা সীমাবদ্ধ করে ফেলি। সে অবস্থায় জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে ও মানবিকতার বিভিন্ন মাত্রিকতায় নারীর ঘাটতিকে বড় করে দেখানো সহজ, তাদের আনাড়িপনার প্রমাণ দেওয়া কষ্টকর নয়। সুতরাং নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার মতো দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে।

তৃতীয়ত, একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর জীবনের বহু বাস্তবতা নির্ধারিত হয় পুরুষের কর্মকাণ্ডের দ্বারা। কখনো ইতিবাচকভাবে, কখনো নেতিবাচকভাবে। যেমন—রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কথাই ধার করা যাক। তাঁকে লিখতে-পড়তে শিখিয়েছিলেন তাঁর অগ্রজ একজন। সুতরাং তাঁর জীবনের ইতিবাচক বাস্তবতার শুরু একজন পুরুষের হাত ধরেই। অন্যদিকে, একজন পুরুষের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড একজন নারীকে ‘আনাড়ি’ নামক হীনম্মন্যতার সৃষ্টি করতে পারে। নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মকাণ্ডের পরিবর্তন একান্তই আবশ্যক।

চতুর্থত, একজন পুরুষকে বুঝতে হবে যে তার পৌরুষের উৎস তার পেশিশক্তি নয়; তার সংবেদনশীলতা, তার বিবেচনাবোধ, তার বিবেক। ক্রোধ নয়, মমতা; ঔদাসীন্য নয়, বিবেচনা; স্পর্শকাতরতা নয়, সংবেদনশীলতা; সন্দেহ নয়, আস্থা একজন পুরুষকে সত্যিকারের পুরুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তাই আমি বলি, একজন পুরুষের মধ্যে কিছুটা নারীসত্তা থাকা একান্ত প্রয়োজন; একজন নারীর যেমন কিছুটা পুরুষালি হওয়া ভালো তার শক্তিকে প্রকাশের জন্য।

নারী আনাড়ি নয়, তাকে আনাড়ি বলে ভাবা বা উপস্থাপনের চেষ্টাও অনভিপ্রেত। পুরুষের বুঝতে হবে, এই লক্ষ্যে নারীকে অবদমন তার যাত্রাকেও ব্যাহত করবে। সমাজের অর্ধেক অংশকে অবদমিত করে সমাজ এগোবে না। নারীকে তার আপন শক্তিতে জাগতে দিতে হবে, আর সেই ক্ষেত্র তৈরি করার দায়িত্ব পুরুষেরও। পুরুষের মন-মানসিকতা আর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এখানে অত্যাবশ্যক।

লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

বাসস, ঢাকা  
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি

গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে সর্বশেষ (৫৪ তম) সাক্ষীর জেরা শুরু হয়েছে। এই মামলাটির বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ।

আজ সোমবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) মো. আলমগীরের জেরা শুরু করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমীর হোসেন। আইনজীবী আমীর হোসেন পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানি করছেন। এর আগে গত মঙ্গলবার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আলমগীরের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়।

এই মামলার শুনানিতে এর আগে গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রতীক শহীদ আবু সাঈদের বাবাসহ স্বজনহারা পরিবারের একাধিক সদস্য সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ ছাড়া মামলার গুরুত্বপূর্ণ ‘স্টার উইটনেস’ হিসেবে সাক্ষ্য দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক এবং জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, তাদের দলীয় ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে অভিযোগ ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১।

পরবর্তীকালে, এই মামলার অন্যতম আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্‌ঘাটনে রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রোভার) হওয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন। ট্রাইব্যুনাল তাঁর আবেদন মঞ্জুর করলে তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে এই মামলায় সাক্ষ্য দেন।

মামলার প্রসিকিউশন পক্ষে শুনানি করছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম এবং গাজী এসএইচ তামিম। শুনানিতে তাঁদের সঙ্গে অপর প্রসিকিউটররাও উপস্থিত ছিলেন।

অন্যদিকে, এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে আছেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলা ছাড়াও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সংঘটিত গুম-খুনের ঘটনায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হলো রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ড নিয়ে। এই তিনটি মামলার বিচারকাজই বর্তমানে দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

  • এবার ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার।
  • গতকাল দিনভর ছিল উপকূলের জেলে পল্লিগুলোতে ব্যস্ততা।
মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে বুধবার রাতে। এর আগে দিনভর সাগরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন জেলেরা। অনেকে দেখে নেন ট্রলার ঠিকঠাক আছে কি না। কেউ আবার জালের ছেঁড়া অংশ সেলাই করেন। ছবিটি কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের খুরেরমুখ এলাকার। ছবি: আজকের পত্রিকা
মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে বুধবার রাতে। এর আগে দিনভর সাগরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন জেলেরা। অনেকে দেখে নেন ট্রলার ঠিকঠাক আছে কি না। কেউ আবার জালের ছেঁড়া অংশ সেলাই করেন। ছবিটি কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের খুরেরমুখ এলাকার। ছবি: আজকের পত্রিকা

‘দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে পাথরঘাটায় চলে এসেছি। এখন পুরোনো জাল সেলাই করছি। এক সপ্তাহের বাজারও করে এনেছি। আজ বিকেলে সাগর মোহনায় যাব, গভীর রাত থেকে জাল ফেলব।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদরের বাইনচটকী এলাকার জেলে হোসেন আলী। গতকাল বুধবার সকালে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

মাছের সুষ্ঠু প্রজনন, উৎপাদন, মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য সমুদ্রে সব ধরনের মাছ শিকার ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা গতকাল বুধবার দিবাগত মধ্যরাতে শেষ হয়েছে। তাই গতকাল দিনভর ছিল উপকূলের জেলেপল্লিগুলোতে ব্যস্ততা। অনেকে দেখে নিচ্ছিলেন ট্রলার ঠিকঠাক আছে কি না, কেউ জালের ছেঁড়া অংশ সেলাই করছিলেন, কেউ আবার প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীসহ অন্য সরঞ্জাম গুছিয়ে নিচ্ছিলেন।

বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র এবং ফকিরহাট উপ-মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে গতকাল শত শত ট্রলার নোঙর করে রাখা ছিল। জেলেদের উপস্থিতিতে ঘাট এলাকা সরগরম হয়ে ওঠে। ফকিরহাটের মুদি-মনিহারি দোকানগুলোতে জেলেরা কেনাকাটা করতে ভিড় জমান। ফকিরহাট এলাকার বিসমিল্লাহ ট্রলারের মাঝি রহিম মিয়া বলেন, ‘সাগরে মাছ শিকারে যেতে সকল প্রস্তুতি নিয়েছি। নিষেধাজ্ঞার সময় শেষ হওয়ামাত্রই সাগরে নামব।’

জেলে নুরসাইদ ও ফোরকান মিয়া বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার সময় পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশ কষ্টে কেটেছে। ওই সময়ে বেশ টাকা ঋণ করেছি। এখন সাগরে যাব। দেখি আল্লাহ ঋণ পরিশোধ করতে দেন কি না।’

নোয়াখালীর হাতিয়ার সূর্যমুখী, বাংলাবাজার, কাজিরবাজার, পাইতান মার্কেট চেয়ারম্যান ঘাটসহ বেশ কয়েকটি ঘাটে গতকাল জেলেদের ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে। অনেকে নৌকায় জাল তুলছিলেন, আবার অনেকে জ্বালানি তেল মজুতসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ট্রলারে নিয়ে যান। সূর্যমুখী ঘাটের এমভি মায়ের দোয়া ট্রলারের মাঝি জাফর উল্যা বলেন, ‘সাগরে ৮-১০ দিন থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সন্ধ্যায় সাগরের উদ্দেশে রওনা দেব।’

সূর্যমুখী ঘাট জেলে সমিতির সভাপতি জবিয়ল হক বলেন, ‘সাগরে নামতে প্রস্তুত নোয়াখালীর হাতিয়ার ২০টি ঘাটের লক্ষাধিক জেলে। এসব ঘাটে প্রায় ১০ হাজার ছোট-বড় ফিশিং ট্রলার রয়েছে। প্রতি ট্রলারে ১০ জন হলেও লক্ষাধিক জেলে এই মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত। তাঁদের সবাই গত ৫৮ দিন তীরে বেকার ছিলেন।’

পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার পাড়েরহাট মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকার জেলেরা গতকাল দিনভর সাগরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। এ ছাড়া মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা, খেতাচিড়া, বড়মাছুয়া, ছোটমাছুয়া, ভান্ডারিয়া উপজেলার চরখালী, হেতালিয়া, কাউখালী উপজেলার সোনাকুর এলাকার জেলেরা, সদর উপজেলা এবং নেছারাবাদ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার জেলেরা প্রস্তুতি শেষে গত রাতে বঙ্গোপসাগরে রওনা হন।

কয়েক দিন ধরে কক্সবাজার উপকূলের জেলেপল্লিগুলোতে নৌকা, জাল মেরামতসহ বিভিন্ন প্রস্তুতি সেরেছেন জেলেরা। গতকাল মেরিন ড্রাইভের টেকনাফের খুরেরমুখ, সাবরাং ও বাহারছড়া এলাকায় দেখা গেছে, সড়কে দাঁড় করিয়ে রাখা সারি সারি ট্রলারে জাল ও রসদ তোলেন জেলেরা।

একটি ট্রলারের মাঝি আবু তাহের জানান, এবার ভারতের সঙ্গে মিল রেখে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় কেউ সাগরে মাছ শিকারে নামেনি। এতে উপকূলের কাছাকাছি সাগরে জাল ফেললেই ইলিশসহ অন্য মাছ পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী তিনি।

কক্সবাজার শহরের ফিশারি ঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক জুলফিকার আলী জানান, কক্সবাজার উপকূলে ছোট-বড় ৭ হাজারের মতো যান্ত্রিক ট্রলার রয়েছে। এসব ট্রলারে প্রায় এক লাখ জেলে ও শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন। অধিকাংশ ট্রলার নিষেধাজ্ঞা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সাগরে রওনা হবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বরগুনা ও আমতলী, পিরোজপুর, কক্সবাজার এবং হাতিয়া প্রতিনিধি]

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

  • ক্রয়াদেশের চালান নিয়ে বাড়ছে দুশ্চিন্তা
  • সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা
  • আজ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডেকেছে জরুরি বৈঠক
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২০ মে ২০২৫, ০২: ৪৪
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।

ভারতের নিষেধাজ্ঞার এক দিন পরই গত রোববার লালমনিরহাটের বুড়িমারী ও যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরসহ বিভিন্ন বন্দরে পণ্যের ট্রাক আটকে দেয় ভারত। সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা যায়, রোববার ভারতের আমদানি বিধিনিষেধের কারণে বুড়িমারী সীমান্তে প্রাণের ১৭ ট্রাক খাদ্যপণ্য আটকে যায়। এ ছাড়া বেনাপোলে ৩৬টি পোশাক বোঝাই ট্রাকসহ অন্যান্য পণ্যের শতাধিক ট্রাক ঢুকতে পারেনি।

গতকাল সোমবার পর্যন্ত বুড়িমারী থেকে প্রাণের পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলোর অর্ধেকের বেশি ফেরত নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া বেনাপোলে পোর্টের ভেতরে ২৪টি ট্রাক ছাড়া বাকিগুলো ফেরত চলে যায়।

বেনাপোল বন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাজেদুর রহমান গতকাল সোমবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, গতকাল পোর্টের ভেতর ও বাইরে শতাধিক ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল। আজ পোর্টের ভেতরের ২৪টি ছাড়া বাকিগুলো ফেরত নিয়ে গেছেন মালিকেরা। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, পোর্টের ভেতরের ট্রাকগুলোও ফেরত নিতে হবে।

জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের হাতে ৬ মিলিয়ন ডলারের ক্রয় আদেশ রয়েছে। তার মধ্য থেকে রোববার বুড়িমারী দিয়ে ১৭ ট্রাকবোঝাই পণ্য পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সেগুলো ঢুকতে পারেনি। ট্রাকগুলো ফেরত আনা হচ্ছে। নতুন করে কাগজপত্র তৈরি করে অন্য পথ দিয়ে পণ্য পাঠাতে হবে।’

বেনাপোল স্থলবন্দর সূত্রে জানা যায়, ওই ২৪টি ট্রাক পোর্টের ভেতরে থাকায় এখনো তারা ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের আশা, যেহেতু নিষেধাজ্ঞার আগে এই পণ্যগুলোর এলসি করা হয়েছিল, তাই এগুলো প্রবেশে অনুমতি পাবে। তবে এটি নির্ভর করবে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনার ওপর।

এমন পরিস্থিতিতে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ইতিমধ্যে অনেক রপ্তানিকারক রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সঙ্গে আলোচনা করে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছে।

স্থলবন্দরের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জসমূহ এবং আশু করণীয় নির্ধারণে বাণিজ্যসচিবের সভাপতিত্বে আজ মঙ্গলবার আন্তমন্ত্রণালয়ের সভা ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্থলবন্দরের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জসমূহ এবং আশু করণীয় নির্ধারণে বাণিজ্যসচিবের সভাপতিত্বে বিকেল ৪টায় আন্তমন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এই সভা অনুষ্ঠিত হবে।

সভায় নৌপরিবহন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ী প্রতিনিধি হিসেবে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিদের উপস্থিতির জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত শনিবার হঠাৎ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করে। শুধু ভারতের নবসেবা ও কলকাতা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে দেশটির আমদানিকারকেরা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারবেন বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম, পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্দা ও ফুলবাড়ী শুল্ক স্টেশন দিয়ে ফল, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা, সুতার উপজাত, আসবাব রপ্তানিও নিষিদ্ধ করা হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে।

আমদানি ও রপ্তানিসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের ২৪টি বন্দরের মধ্যে ১৬টি বন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য হয়ে থাকে। তবে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হওয়ায় বেনাপোল ও ভারতের পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য হয়। এর পরিমাণ ৮০ শতাংশ। বেনাপোল বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ভারতে ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে শতাধিক ট্রাক পণ্য থাকে তৈরি পোশাক।

এর আগে গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে ভারত। ফলে ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে পারছে না বাংলাদেশ। অন্যদিকে প্রায় এক মাস আগে ভারত থেকে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা, বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুযোগ বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, এই পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে তুলনামূলকভাবে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ওপর। তাই ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখাই সরকারের উচিত বলে মনে করছেন তিনি।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং ভারতের বিরোধপূর্ণ বিষয়সমূহ মিটিয়ে ফেলতে হবে এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটাই হবে উভয় দেশের জন্য কল্যাণকর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

১৮৯৮ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি ধূলিধূসর টিলা খুঁড়ে পাওয়া মূল্যবান এই রত্নগুলো এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে একটি বেসরকারি ব্রিটিশ সংগ্রহাগারে প্রায় দৃষ্টিচক্ষুর আড়ালে ছিল। এখন যেহেতু রত্নগুলোর হাতবদলের সময় এসেছে, তাই নতুন সংগ্রাহকেরা আগ্রহ নিয়ে এগুলো সংগ্রহের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু এখানে একটা অস্বস্তিও তৈরি হয়েছে।

গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনীর কাছাকাছি, বর্তমানে ভারতের উত্তর প্রদেশে একটি ইটের ঘরের ভেতর থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০টি মুক্তা, রুবি, টোপাজ, নীলা ও নকশা করা সোনার পাত সংগ্রহ করা হয়েছিল। তবে এই রত্নগুলোর সঙ্গে সঙ্গে একটি খোদাই করা পাত্রে হাড়ের টুকরাও পাওয়া যায়, যেগুলোকে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষ বলে শনাক্ত করা হয়। এই আবিষ্কার তখন প্রত্নতত্ত্বের জগতে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।

সাদাবি’স এশিয়ার চেয়ারম্যান নিকোলাস চাউ মনে করেন, স্মরণকালের বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর মাঝে এই রত্নসম্ভার অন্যতম। তবে এগুলো নিলামে তোলার কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আর তা হচ্ছে—ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকা এবং বৌদ্ধদের কাছে পবিত্র এই সম্পদ বিক্রি করা কি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য?

১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ এস্টেট ম্যানেজার উইলিয়াম ক্ল্যাক্সটন পেপ্পে লুম্বিনির ঠিক দক্ষিণে পিপ্রাওয়ায় অবস্থিত একটি ঢিবি খনন করেন। সেখান থেকেই প্রায় ২ হাজার বছর আগের ওই নির্দশনগুলো খুঁজে পাওয়া যায়।

ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাপ্ত রত্নসম্ভার ও দেহাবশেষ, যা তখনো পর্যন্ত অক্ষত ছিল, সেগুলো গৌতম বুদ্ধের শাক্য বংশের এবং বিশ্বব্যাপী বৌদ্ধদের ঐতিহ্য। হাড়ের নিদর্শনগুলো থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের মতো দেশগুলোতে বিতরণ করা হয়েছে। এসব দেশে এখনো সেগুলোর পূজা করা হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত