জাহীদ রেজা নূর
কাফকার গ্রেগর সামসা হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেয়েছিল সে পোকা হয়ে গেছে। ৭০ বছরের সোভিয়েত শাসনের পর সমাজতন্ত্র ভেঙে গণতন্ত্র কায়েম হলে রুশ বুড়ো-বুড়িরা হঠাৎ একদিন দেখল, তাদের পেনশনের টাকা কাগজে পরিণত হয়ে গেছে। দুটো ঘটনার মধ্যে আমি মিল খুঁজে পাই। পোস্ট অফিসে টাকা জমা রাখতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বর্ষীয়ান মানুষেরা। ভাবতেন, অবসরগ্রহণের পর জীবন চালিয়ে নেওয়ার জন্য এ টাকাই দেবে নির্ভরতা। কিন্তু যেভাবে মুদ্রাস্ফীতি হতে থাকল, যেভাবে সমাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মাঝে টাগ অব ওয়ার শুরু হলো, তাতে আসলে পিষে মারা হলো বুড়ো-বুড়িদের। ওই গ্রেগর সামসার মতোই।
পেনশনভোগীদের বহুদিনের স্বপ্ন গচ্ছিত ছিল পোস্ট অফিসের সঞ্চয়ে, তা হঠাৎ করে নিছক কাগজে পরিণত হলে তাঁরা চোখে সর্ষে ফুল দেখেছিলেন। তেমনি একটা ঘটনার সাক্ষী আমি। আমার চোখের সামনে ঘটেছিল সেই ঘটনা। আমার তো অভ্যাস ছিল ক্লাস ছাড়া অন্য সময়টা বাজারে বাজারে ঘুরে ভালো কিছু পেলে কিনে ফেলা। যেকোনো সময় চড়ে বসতাম ট্রামে, চলে যেতাম ভাস্তোচনোয়ে দিপো, কো-অপারেতিভনি রিনোক অথবা কালখোজনি রিনোকে।
যে সময়ের কথা বলছি, সেটা বোধ হয় ১৯৯১ সালের শেষ অথবা তার পরের বছরের শুরু।
ট্রাম থেকে নেমে কো-অপারেতিভনি রিনোকের দিকে যাচ্ছি, এ সময় দেখি এক বুড়ো-বুড়ি দম্পতি ট্রামলাইন পার হচ্ছেন। সে সময় হঠাৎ করেই রাস্তায় রাস্তায় দোকানের ঘনঘটা দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে খাবারের দোকান। সে এক আজব সময়। একদিকে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ, আরেক দিকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে আরেক দল মানুষ। এই নব্য রুশদের পকেটভর্তি টাকা। নানা ধরনের ব্যবসা করে তারা এই টাকা কামিয়েছে। তাদের ব্যবসাগুলো মোটেই বৈধ ছিল না। কিন্তু পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন বৈধ-অবৈধের সীমারেখা গিয়েছিল উঠে।
সত্যের খাতিরে অবশ্য বলতে হয়, এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগে। কমিউনিস্ট পার্টির বড় একটা অংশ নানাভাবে অবৈধ আয়ের অধিকারী হয়েছিল। ক্ষমতা যে মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে, তা সোভিয়েত আমলাদের জীবনাচরণ পদ্ধতির দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়। তারাই নানাভাবে এই সময়কে কাজে লাগিয়েছে। ভোল পাল্টে নিমেষে তারা হয়ে গেছে গণতন্ত্রী। অথচ একসময় সমাজতন্ত্রের জন্য জীবন বাজি রাখার শপথ নিয়েছিল এরা।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ে যাদের হাতে অনেক টাকা এসে গেল, তাদের সবার অতীত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ, সেই সময়ের আইনশৃঙ্খলাসহ নানা বিষয়ে যে বাধা আসার শঙ্কা ছিল, সেগুলো পার্টির ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এড়িয়ে যাওয়া গেছে। এই আলোচনা আর না বাড়িয়ে আমরা বরং ট্রামলাইনের পাশ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া বুড়োবুড়ির কথোপকথনের দিকে কান পাতি।
তার আগে একটা কথা বলে রাখি। তখন গরুর মাংসের কেজি ছিল ৬০ রুবল।
বুড়ো বলছিলেন, ‘বুড়ি, খিদে পেয়ে গেছে। কিছু খাবে তুমি?’
‘খেলে অনেকগুলো টাকা বেরিয়ে যাবে। তার চেয়ে অপেক্ষা করি। কিছুক্ষণ পর বাড়ি গিয়ে খাব। কিছু না কিছু তো পেয়েই যাব। খাওয়া যাবে।’
বুড়োর মনে সম্ভবত বুড়ির প্রতি ভালোবাসা আর আদরের জন্ম হলো। তিনি বললেন, ‘এক দিনই তো বাইরে খেতে বলছি! এত হিসাব করে চললে কি আর বাঁচা যাবে?’
বুড়ির মনে আনন্দ জেগে উঠল। তিনি বললেন, ‘তাহলে এসো শাশলিক খাই! কখনো তো খাইনি! দেখি না খেতে কেমন!’
বড়লোকদের জন্য নতুন পয়দা হওয়া রাস্তার পাশের দোকানগুলোর দিকে এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধ। কয়লার লকলকে জিহ্বার ওপর শিক কাবাবের মতো সুগন্ধি শাশলিক দেখা যাচ্ছে।
বৃদ্ধ কাছে গিয়ে দাম দেখলেন। সেখানে লেখা, ‘১০০ গ্রাম ৬০ রুবল’।
কিছুক্ষণ পাথরের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন বৃদ্ধ। সম্ভবত হিসাব করলেন, স্রেফ আগুনের ওপর কিছু মাংস রেখেই ১০ গুণ বাড়িয়ে নিয়েছে দাম! আসলে তখন বুড়ো-বুড়িদের আর্থিক যে অবস্থা ছিল, তাতে মাংস কেনা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল।
বুড়োকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুড়ি তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। শাশলিকের দাম দেখলেন। তারপর বোকার মতো হাসতে হাসতে বিড়বিড় করে বুড়োকে বললেন, ‘আরে! আমি তো মজা করেছি! আমি কি সত্যিই শাশলিক খেতে চাই? আমার দাঁতগুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে। মাংস চিবাতে পারব না। এত শক্ত মাংস খেলে দাঁতই পড়ে যাবে!’
বুড়োর মেজাজ তখন চড়ে গেছে। তিনি অস্থির হয়ে অভিশাপ দিতে থাকলেন শাশলিকওয়ালাদের। বুড়ি তাঁকে টানতে টানতে অন্যদিকে নিয়ে গেলেন।
এই দৃশ্য কোনো দিন ভোলার নয়। আর কোনো দিন এই দম্পতিকে দেখিনি। কিন্তু শাশলিকের দিকে চোখ গেলে এখনো মনে পড়ে তাঁদের কথা।
কাফকার গ্রেগর সামসা হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেয়েছিল সে পোকা হয়ে গেছে। ৭০ বছরের সোভিয়েত শাসনের পর সমাজতন্ত্র ভেঙে গণতন্ত্র কায়েম হলে রুশ বুড়ো-বুড়িরা হঠাৎ একদিন দেখল, তাদের পেনশনের টাকা কাগজে পরিণত হয়ে গেছে। দুটো ঘটনার মধ্যে আমি মিল খুঁজে পাই। পোস্ট অফিসে টাকা জমা রাখতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বর্ষীয়ান মানুষেরা। ভাবতেন, অবসরগ্রহণের পর জীবন চালিয়ে নেওয়ার জন্য এ টাকাই দেবে নির্ভরতা। কিন্তু যেভাবে মুদ্রাস্ফীতি হতে থাকল, যেভাবে সমাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মাঝে টাগ অব ওয়ার শুরু হলো, তাতে আসলে পিষে মারা হলো বুড়ো-বুড়িদের। ওই গ্রেগর সামসার মতোই।
পেনশনভোগীদের বহুদিনের স্বপ্ন গচ্ছিত ছিল পোস্ট অফিসের সঞ্চয়ে, তা হঠাৎ করে নিছক কাগজে পরিণত হলে তাঁরা চোখে সর্ষে ফুল দেখেছিলেন। তেমনি একটা ঘটনার সাক্ষী আমি। আমার চোখের সামনে ঘটেছিল সেই ঘটনা। আমার তো অভ্যাস ছিল ক্লাস ছাড়া অন্য সময়টা বাজারে বাজারে ঘুরে ভালো কিছু পেলে কিনে ফেলা। যেকোনো সময় চড়ে বসতাম ট্রামে, চলে যেতাম ভাস্তোচনোয়ে দিপো, কো-অপারেতিভনি রিনোক অথবা কালখোজনি রিনোকে।
যে সময়ের কথা বলছি, সেটা বোধ হয় ১৯৯১ সালের শেষ অথবা তার পরের বছরের শুরু।
ট্রাম থেকে নেমে কো-অপারেতিভনি রিনোকের দিকে যাচ্ছি, এ সময় দেখি এক বুড়ো-বুড়ি দম্পতি ট্রামলাইন পার হচ্ছেন। সে সময় হঠাৎ করেই রাস্তায় রাস্তায় দোকানের ঘনঘটা দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে খাবারের দোকান। সে এক আজব সময়। একদিকে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ, আরেক দিকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে আরেক দল মানুষ। এই নব্য রুশদের পকেটভর্তি টাকা। নানা ধরনের ব্যবসা করে তারা এই টাকা কামিয়েছে। তাদের ব্যবসাগুলো মোটেই বৈধ ছিল না। কিন্তু পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন বৈধ-অবৈধের সীমারেখা গিয়েছিল উঠে।
সত্যের খাতিরে অবশ্য বলতে হয়, এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগে। কমিউনিস্ট পার্টির বড় একটা অংশ নানাভাবে অবৈধ আয়ের অধিকারী হয়েছিল। ক্ষমতা যে মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে, তা সোভিয়েত আমলাদের জীবনাচরণ পদ্ধতির দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়। তারাই নানাভাবে এই সময়কে কাজে লাগিয়েছে। ভোল পাল্টে নিমেষে তারা হয়ে গেছে গণতন্ত্রী। অথচ একসময় সমাজতন্ত্রের জন্য জীবন বাজি রাখার শপথ নিয়েছিল এরা।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ে যাদের হাতে অনেক টাকা এসে গেল, তাদের সবার অতীত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ, সেই সময়ের আইনশৃঙ্খলাসহ নানা বিষয়ে যে বাধা আসার শঙ্কা ছিল, সেগুলো পার্টির ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এড়িয়ে যাওয়া গেছে। এই আলোচনা আর না বাড়িয়ে আমরা বরং ট্রামলাইনের পাশ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া বুড়োবুড়ির কথোপকথনের দিকে কান পাতি।
তার আগে একটা কথা বলে রাখি। তখন গরুর মাংসের কেজি ছিল ৬০ রুবল।
বুড়ো বলছিলেন, ‘বুড়ি, খিদে পেয়ে গেছে। কিছু খাবে তুমি?’
‘খেলে অনেকগুলো টাকা বেরিয়ে যাবে। তার চেয়ে অপেক্ষা করি। কিছুক্ষণ পর বাড়ি গিয়ে খাব। কিছু না কিছু তো পেয়েই যাব। খাওয়া যাবে।’
বুড়োর মনে সম্ভবত বুড়ির প্রতি ভালোবাসা আর আদরের জন্ম হলো। তিনি বললেন, ‘এক দিনই তো বাইরে খেতে বলছি! এত হিসাব করে চললে কি আর বাঁচা যাবে?’
বুড়ির মনে আনন্দ জেগে উঠল। তিনি বললেন, ‘তাহলে এসো শাশলিক খাই! কখনো তো খাইনি! দেখি না খেতে কেমন!’
বড়লোকদের জন্য নতুন পয়দা হওয়া রাস্তার পাশের দোকানগুলোর দিকে এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধ। কয়লার লকলকে জিহ্বার ওপর শিক কাবাবের মতো সুগন্ধি শাশলিক দেখা যাচ্ছে।
বৃদ্ধ কাছে গিয়ে দাম দেখলেন। সেখানে লেখা, ‘১০০ গ্রাম ৬০ রুবল’।
কিছুক্ষণ পাথরের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন বৃদ্ধ। সম্ভবত হিসাব করলেন, স্রেফ আগুনের ওপর কিছু মাংস রেখেই ১০ গুণ বাড়িয়ে নিয়েছে দাম! আসলে তখন বুড়ো-বুড়িদের আর্থিক যে অবস্থা ছিল, তাতে মাংস কেনা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল।
বুড়োকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুড়ি তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। শাশলিকের দাম দেখলেন। তারপর বোকার মতো হাসতে হাসতে বিড়বিড় করে বুড়োকে বললেন, ‘আরে! আমি তো মজা করেছি! আমি কি সত্যিই শাশলিক খেতে চাই? আমার দাঁতগুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে। মাংস চিবাতে পারব না। এত শক্ত মাংস খেলে দাঁতই পড়ে যাবে!’
বুড়োর মেজাজ তখন চড়ে গেছে। তিনি অস্থির হয়ে অভিশাপ দিতে থাকলেন শাশলিকওয়ালাদের। বুড়ি তাঁকে টানতে টানতে অন্যদিকে নিয়ে গেলেন।
এই দৃশ্য কোনো দিন ভোলার নয়। আর কোনো দিন এই দম্পতিকে দেখিনি। কিন্তু শাশলিকের দিকে চোখ গেলে এখনো মনে পড়ে তাঁদের কথা।
১৭০০ সালের ফ্রান্সে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো প্রকাশ্যে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দৃশ্য দেখতে রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে পড়ত মানুষ। তবে এখানেও ছিল শ্রেণিবৈষম্য! গরিব অপরাধীদের জন্য সাধারণ শাস্তি ছিল কোয়ার্টারিং। কোয়ার্টারিং এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে অপরাধীর চার হাত-পা চারটি গরুর সঙ্গে বাঁধা হতো।
৩ দিন আগেখুবই অস্থিতিশীল অবস্থায় আছি আমরা। এই অবস্থাকে বাইরে থেকে মনে হবে আইন-শৃঙ্খলার [পরিস্থিতির] অবনতি। তা তো বটেই। রাষ্ট্রের যে তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ, তারা কেউই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছে না। তবে তার মধ্যে সমাজের আদর্শিক বাস্তবতাও প্রতিফলিত হচ্ছে।
৩ দিন আগেদিনে কোন শব্দটি আপনি সবচেয়ে বেশিবার ব্যবহার করেন? নিঃসন্দেহে ‘ওকে (Ok)’। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এই শব্দটি কিন্তু সহজে ‘জাতে’ উঠতে পারেনি! প্রথমবারের মতো ১৮৩৯ সালের আজকের এই দিনে (২৩ মার্চ) লিখিতরূপে বোস্টন মর্নিং পত্রিকায় প্রকাশিত হয় দুই অক্ষরের।
৮ দিন আগে২১ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ঢাকায় এলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি এসে বললেন, ‘সব কুছ ঠিক হো যায়ে গা।’ ২২ মার্চ ভুট্টোর উপস্থিতিতে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক হলো। সবাই ভাবছিল, এইবার বুঝি একটা বোঝাপড়ার দিকে এগোচ্ছে আলোচনা।
৯ দিন আগে