ড. তৈফুর রহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যখন সেখানে পড়তাম, তখন খুব আগ্রহ হতো মন্দিরটির বিষয়ে। শুনেছিলাম অনেক আগের ছোট্ট এক গ্রিক মেয়ের কবর আছে সেখানে। কেমন একটা বিষাদমাখা মায়া কাজ করত তার জন্য।
সম্প্রতি ফেসবুকের একটি পোস্টে প্রথমবারের মতো মন্দিরের অন্দর কক্ষ ও সেখানে সংরক্ষিত নয়টি অক্ষত, একটি আধভাঙা এপিটাফ এবং সমাধিফলক দেখে প্রায় ভুলে যাওয়া সেই স্মৃতি আবার মাথায় কড়া নাড়ল। এই অন্তর্জালের দুনিয়াতে তথ্য বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের এক গ্রিক কনসালট্যান্ট হেলেন আবাদজী আর জাপানি গবেষক কানদা সায়াকো—এর দুটি গবেষণাপত্রের তথ্য জোড়া লাগিয়ে একটা ছবি দাঁড় করিয়েছি—পলাশী যুদ্ধের সমসাময়িক বাংলায়, বিশেষ করে ঢাকায় গ্রিকদের আগমন, তাঁদের বাণিজ্য, পেশা, পারিবারিক-সামাজিক জীবন এবং ঢাকার বুকেই তাঁদের শেষশয্যা নিয়ে।
ঢাকায় গ্রিকদের গল্প
বাংলায় গ্রিকরা আসে ১৭৫০ সালের দিকে—আজকের গ্রিস এবং গ্রিক-অধ্যুষিত অঞ্চল, যেমন আধুনিক তুর্কি ও ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো থেকে। ভাগ্য ফেরানো ওসমানিয়া শাসন বলয় থেকে বের হওয়া, ধর্মপ্রচার ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের দিকে এরা আসতে শুরু করে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি বাংলায় ভালোভাবে আসন গেঁড়ে বসার পর। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আলেক্সিওসি (আলেক্সান্ডার) আর্গাইরি। বুলগেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী এই গ্রিক কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর কারবার ছিল বসরা আর লেভান্তে (সিরিয়া-লেবানন) অঞ্চলের সঙ্গে। ১৭৭০ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরার পথে বঙ্গোপসাগরে নিশ্চিত জাহাজডুবি থেকে বেঁচে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, কলকাতায় একটা চার্চ বানাবেন। তখন সবে কলকাতার গভর্নর হয়েছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তাঁকে গিয়ে আর্গাইরি ধরলেন চার্চ নির্মাণের অনুমতির জন্য। হেস্টিংস জানতেন, গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যবসায় উন্নতি করছে, তাই অনুমতি দিলেন। আর্গাইরি আর অন্যান্য ধনী গ্রিকরা চার্চ বানানোর তোড়জোড় শুরু করলে তিনি তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য হাজির হলেন ঢাকায়, ১৭৭১ সালে। এ থেকে অনুমান করা যায় আর্গাইরির আগমনের আগে থেকেই গ্রিক বণিকেরা ঢাকায় ডেরা বেঁধেছিল।
এই প্রস্তরখণ্ডের নিচে মিসেস সুলতানা আলেক্সান্ডার, আলেক্সান্ডারের স্ত্রীর (আলেক্সান্ডার ইস্তাম্বুলের কারিয়াকোস ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র) নশ্বর দেহাবশেষ শায়িত আছে, যিনি এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন, মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৪ বছর। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
আর্গাইরির সঙ্গে ঢাকায় আসে তাঁর ২১ বছর বয়সী বড় ছেলে পানিয়তি। ১৭৭৭ সালে আর্গাইরি মৃত্যুবরণ করেন ঢাকাতেই। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিকে পুঁজি করে ১৮ শতকের শেষার্ধে এসে এই পানিয়তি ব্যবসা বাড়িয়ে বাংলায় গ্রিক বণিক সম্প্রদায়ের প্রধান হয়ে ওঠেন। ঢাকা ও সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জে গ্রিকদের প্রধান বাণিজ্য ছিল চুন ও লবণকে ঘিরে। সিলেটের খাসিয়া-অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলে উৎকৃষ্ট মানের চুনাপাথর পাওয়া যেত (এবং এখনো যায়), যা থেকে তৈরি করা হতো চুন। সে চুন দরকার হতো বড় বড় ইমারত তৈরিতে। নৌপথে বজরায় করে সে চুনের চালান যেত নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে নদীপথে সহজেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার পদ্মা-মেঘনার সংগমস্থল দিয়ে উত্তর-পশ্চিম বা দক্ষিণ-পূর্বে নৌযাত্রা করা যেত। সে জন্য ভোলা ও চাটিগাঁ থেকে আসা লবণের বিরাট মোকাম গড়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জে।
এইখানে শায়িত আছেন ইস্তাম্বুলের জর্জ ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র থিওডোরের স্ত্রী থিওডোসিয়া। ১০ এপ্রিল ১৮০৫ সালে। তাঁর স্মৃতি অমর হোক। এই দুই নারীর সমাধিফলকেই একটা কথা আছে, যা আমাদের অবাক করে, ‘ঢাকার প্রতি তিনি ঋণী’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
চুন ও লবণ—এই দুই অতিপ্রয়োজনীয় বাণিজ্যের মূল অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ ইংরেজদের হাতে থাকলেও তাতে কলকাতার বাঙালি হিন্দু (যারা বউবাজার-বাগবাজার-বড়বাজারের ‘ভদ্দরলোক’ নামে পরিচিতি পায়), আর গ্রিকরা মিলে মোটা মুনাফা আয় করে যাচ্ছিল। এর মধ্যে গ্রিক বণিক মভ্রদি কেরিয়াকোস একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন চাটিগাঁও, আর ভোলার উৎপাদিত মোট লবণের এক-তৃতীয়াংশ। তখন এক ভোলা থেকেই বছরে ১ হাজার টনেরও বেশি লবণ আসত নারায়ণগঞ্জে। আর তাতে নিয়োজিত ছিল ১৬০টি বজরা। এই বণিকদের একজন ছিলেন নিকোলাস দিমিত্রিওস। টিএসসির সেই গ্রিক মন্দিরের ভেতরে অনেকের সঙ্গে সমাহিত আছেন সেই দিমিত্রিওসও।
বিষাদমাখা এক অর্থনীতির গল্প
টিএসসির সে মন্দিরের যে আকার ও আয়তন, তাতে করে বড়জোর এক বা দুজনের সমাধি হতে পারে। অথচ সেখানে আটটি স্মৃতিফলকে একজন করে আটজন এবং অন্য আরেকটা ফলকে একসঙ্গে তিন ভাইয়ের কথা উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এই ছোট একটি জায়গায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। এই ১১ জনের মৃত্যু কাছাকাছি সময়ে হয়নি। হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে। দুটি স্মৃতিফলকে উল্লেখিত দুই নারীর মধ্যে একটা সম্পর্ক (তাঁদের দুজনের শ্বশুর সম্ভবত দুই ভাই) অনুমান করা যায়। অন্য দুজন নারী আরেক গ্রিকের দুই স্ত্রী ও এক পরিবারের তিন ভাই। এ ছাড়া আরও চারজনের সঙ্গে একে অন্যের কোনো ধরনের আত্মীয়তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে সত্যি নয়।
মিসেস মাগদালেন, সোফিয়া জর্ডান এবং তাঁদের স্বামী মি. জোসেফ জর্ডানের (কেসারিয়া, তুর্কি থেকে আগত, নারায়ণগঞ্জের বণিক) স্মৃতির উদ্দেশে। জর্ডান ১০ ফেব্রুয়ারি ১৮১৯ সালে ৬০ বছর বয়সে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন। তাঁদের সবার স্মৃতির প্রতি অনুরাগ-আপ্লুত এই স্মারক নিবেদন করলেন তাঁদের অভাগা এতিম সন্তানেরা। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
তাহলে প্রথমে যে প্রশ্ন আসে, তাঁরা সবাই এক জায়গায় সমাহিত হলেন কীভাবে? কীভাবে তাঁদের মৃত্যুর প্রায় শতাব্দীকাল পরে এসে ঠাঁই পেলেন এই ছোট্ট সমাধি-মন্দিরে? আমরা এর উত্তর খুঁজব সমাধিফলকের গায়ে উৎকীর্ণ বাণী ও তৎকালীন বাংলায় গ্রিক বণিকদের ওপর করা গবেষণালব্ধ তথ্যের মধ্যে।
নিকোলাস দিমিত্রিওসের (জন্ম ১৭৯৭, মৃত্যু ১৮৪৩) সমাধিফলক লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। মৃত্যুর ১৬ বছর পর এসে ফলকটি উৎসর্গ করেছেন বাসিল দিমিত্রিওস। পারিবারিক নাম এক হলেও বাসিল নিজের পরিচয় দিয়েছেন নিকোলাসের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে। এই এপিটাফে একটা উর্দু কবিতা (সম্ভবত মির্জা গালিবের) ইংরেজি হরফে লেখা আছে, যার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম:
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
বোঝা যাচ্ছে নিকোলাসের কাব্যপ্রীতি ছিল, যা তাঁর বন্ধু বাসিলের অজানা ছিল না। হয়তো নিকোলাস ও বাসিল দুজনই ভারতবর্ষে, হয়তো ঢাকাতেই জন্মেছিলেন। বাল্যসখা ছিলেন। ঢাকার নবাবদের মধ্যে উর্দুর প্রচলন ছিল। সেখান থেকেই শিখেছিলেন এই ভাষা। খুব সম্ভব তাঁরা বাংলাও বলতে পারতেন, যেহেতু ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন।
দিমিত্রিওস এলিয়াসের জ্যেষ্ঠ পুত্র নিকোলাস দিমিত্রিওসের স্মৃতির উদ্দেশে। মৃত্যু ৫ মার্চ ১৮৪৩, বয়স ৪৬। তাঁর প্রিয় কবিতার ছত্র—
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু বাসিল দিমিত্রিওস এই ফলক স্থাপন করলেন ১৮৫৯ সালে। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
বন্ধুর জন্য এপিটাফের ব্যবস্থা করার এক বছরের মাথায় ১৮৬০ সালে মারা যান বাসিল দিমিত্রিওস, মাত্র ৬০ বছর বয়সে। ইংরেজি জানা বাসিল জীবনভর বিচিত্র পেশায় জড়িত ছিলেন। কমিশনারের সহকারী ছিলেন ৯ বছর, সেন্ট টমাস চার্চের (১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠিত) করণিক ছিলেন ৪০ বছর—জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আর ১০ বছর ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন ঢাকা কলেজে (১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত)। এর মানে জীবন চালানোর জন্য একসঙ্গে বেশ কিছু চাকরি করেছেন সমান্তরালে। ছাপোষা এমন একজন মানুষের বন্ধু ছিলেন ধনী বণিক নিকোলাস। সম্ভবত দুজনই সমবয়সী, একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন ও বেড়ে উঠেছেন।
প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল ফাদার নাথানিয়েলের স্মৃতিফলক। আমরা জানতে পারি, ১৭৩৬ সালে সুদূর আজিয়ান সাগরের ছোট্ট দ্বীপ সিফোনেসে জন্ম নেওয়া নাথানিয়েল শেষশয্যা নিয়েছেন ঢাকায়, ১৮১০ সালে। আমরা পুলকভরে অবগত হই যে তিনি তাঁর জন্মস্থান ও ঢাকা—দুই জায়গাকেই নিজের স্বদেশ বলে গণ্য করতেন! তিনি হয়তো ধর্ম প্রচারে এসে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বুড়িগঙ্গার ধারের এই নগরকে।
এইখানে শায়িত প্রয়াত কেসারিয়ার (তুরকিস্তান) জ্যাকব ইস্সাই লাকোবোগলাস। মৃত্যু ২২ জুন, ১৮১৯ সালে, বয়স হয়েছিল ৪৮। ওপর থেকে যিনি তাকিয়ে আছেন, হে ঈশ্বর, তাঁকে ক্ষমা করুন। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
নাথানিয়েলের চার বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন এক ব্যবসায়ী, কনস্টানটিন। তাঁর স্ত্রী এই সমাধিফলক বানান প্রয়াত সহধর্মীর জন্য—তাঁর নাম আমরা জানতে পারি না। কিন্তু তাঁর বেদনামথিত আবেগের কথা লেখা আছে মাতৃভাষা গ্রিকে।
ফিলিস্তিন থেকে আসা জোসেফ জর্ডান (১৭৫৯-১৮১৯), আর তাঁর দুই স্ত্রী মাগদালেন ও সোফিয়ার জন্য ইংরেজিতে ফলক লিখে রেখে গেছেন তাঁদের শোকগ্রস্ত সন্তানেরা। এতে অনুমান করা যায়, দ্বিতীয় প্রজন্মের গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য আর চাকরির সুবিধার্থে ইংরেজিকে তাঁদের প্রতিদিনের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
বাসিল দিমিত্রিওসের (সেন্ট থমাস চার্চের করণিক) পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে। জন্ম ১৮০০ সালে। তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ৯ বছর কমিশনের সহকারী, ১০ বছর ঢাকা কলেজের ইংরেজির শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন এবং ৪০ বছর সেন্ট থমাস চার্চে সেবা প্রদান করেছেন। ‘বিশুদ্ধ প্রাণ যাদের, তারাই তো দেখা পায় ঈশ্বরের’ (বাইবেল: ম্যাথিউ), ১৮৬০। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, সেদিন ছিল রোববার। ছুটির দিন। ঢাকা থেকে ২৫ মাইল দূরের মির্জাপুরে সেই দিন বাঘ শিকারে গিয়েছেন জন দিমিত্রিওস ইলিয়াস। সেখানেই বাঘের থাবায় তাঁর করুণ মৃত্যু হয় মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। যিনি বাঘ শিকারের মতো রোমাঞ্চকর ও দামি শখ মেটানোর ক্ষমতা রাখেন, তিনি যে ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ইংরেজিতে লেখা সে স্মৃতিপ্রস্তরে তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের কথাও বলা হয়েছে, তাঁরাও শিকারি ছিলেন। তাঁদের দেহাবশেষ একসঙ্গে করে তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁদের এক মামাতো বা খালাতো ভাই ম্যানুয়েল এই ফলকের ব্যবস্থা করেন।
এটি ফাদার নাথানিয়েলের সমাধি; পবিত্র এবং সাধু; যিনি পবিত্র এক সাধুর ন্যায় যিশুর কথা প্রচার করেছেন, তাঁর জীবনাচার এবং বাণীর মাধ্যমে। অনবদ্য এক আনন্দধাম এই ঢাকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বিতীয় সেন্ট থমাস*। তাঁর পিতৃভূমি ছিল সিফনোস (আজিয়ান সাগরের এক দ্বীপ), যেখানে তিনি ১৭৩৬ সালে প্রথম আলো দেখেছেন এবং ঢাকা—এই দুই স্থানকেই তিনি স্বদেশ বলে গণ্য করতেন। ১২ মার্চ ১৮১০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘তিনিই সুখী হন, যিনি অন্যকে ভক্তিময় সম্মান দান করেন’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮২০ সালের পর নানা কারণে ইংরেজ-কলকাতার ‘ভদ্দরলোক’ গ্রিকদের ত্রিমুখী বাণিজ্য প্রণয় আর আগের মতো থাকেনি, মুনাফাতেও টান পড়তে শুরু করে। চুন আর লবণের ব্যবসা ছেড়ে টাকাওয়ালা গ্রিকেরা জমিদারি কিনতে লাগলেন (বরিশাল অঞ্চলেও এদের একটা জমিদারি ছিল)। আর যাঁরা অতটা বিনিয়োগ করতে পারলেন না, তাঁরা ইংরেজদের সওদাগরি কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত ইংরেজ লেখক জেমস টেইলরের বই ‘A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca’ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৩৮ সালে ঢাকায় মাত্র ১২টি গ্রিক পরিবারের বসবাস ছিল। জন দিমিত্রিওস এলিয়াস আত্মীয়স্বজন সেই ১২ পরিবারের একজন হওয়ার কথা। আরও বোঝা যাচ্ছে যে গ্রিকদের ব্যবসা পড়তির দিকে থাকলেও তখন ঢাকায় অবস্থাসম্পন্ন কয়েকজন গ্রিকের বসবাস ছিল।
জর্জ মাভরোডোগ্লোর পুত্র কনস্টানটাইনের স্ত্রী, যিনি ছিলেন স্বামীপরায়ণা নারী, তাঁর চিরজাগরুক ভালোবাসার স্মারক হিসেবে এই ফলকখানি স্থাপন করেছেন। তাঁর (স্বামীর) জন্মস্থান ছিল ইস্তাম্বুল। একজন বণিক হিসেবে তিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন। ১৮০৬ সালের ২৪ জুলাই তিনি জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এই ঢাকায়। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
একই পরিবারের দুই বউ থিওডোসিয়া (মৃত্যু ১৮০৫) ও সুলতানার (জন্ম ১৭৬৬) দেহাবশেষ পাশাপাশি রাখা আছে। সুলতানা সম্ভবত অধুনা তুর্কি দেশের মেয়ে ছিলেন, শুধু নামেই তার ইঙ্গিত মেলে না, তাঁর শ্বশুর কারিয়াকোস ফিলিপ্পো নিজেও এসেছিলেন ইস্তাম্বুল থেকে। তিনি হয়তো ছেলের বিয়ের জন্য নিজের জন্মস্থানের মেয়েই খুঁজে এনেছিলেন। কেমন দেখতে ছিলেন সুলতানা? তিনি কি কখনো শাড়ি পরেছিলেন? সুলতানার মৃত্যু হয় ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে, আজ থেকে ২২২ বছর আগে, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে।
এই স্থাপনায় আরও আছে আধভাঙা এক সমাধিফলক, যার বাকি অংশ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। সেখানে আমরা দেখতে পাই, এক পিতা ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বরের কোনো এক দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন। একই সমাধিতে পরে তাঁর কন্যাকেও সমাহিত করা হয়। কন্যার জন্ম ১৮১৫ সালে। তাঁর মৃত্যুর বছর আমরা হয়তো জানতে পারব না কোনো দিনই; হয়তো পিতৃশোকাতুর মেয়েও বেশি দিন বাঁচেনি। শুধু জানব ঢাকায় বসবাসকারী এই গ্রিক পিতা এবং কন্যার শেষশয্যা হয়েছিল রমনার সবুজ গালিচার নিচে। নাম না জানা সেই মেয়ে তার বাবার কোলে শুয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে, পরম নিশ্চিন্তে।
দিমিত্রিওস এলিয়াস এস্কোয়ারের দ্বিতীয় পুত্র জন দিমিত্রিওসের পবিত্র স্মৃতির প্রতি। ১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, রবিবার ঢাকার উত্তর-পশ্চিমের মির্জাপুরে বাঘ শিকারে গিয়ে নিহত হন। এখানে তিন মহান ভাই নিকোলাস, জন ও কনস্টানটিন একসঙ্গে শায়িত হয়েছেন। এখানে যূথবদ্ধ হয়ে আছেন সাহসী শিকারি ও খেলাধুলায় পারদর্শী তিন উচ্ছল জীবন। ফলক স্থাপনায় (খালাতো/মামাতো) ভাই মানুয়েল এলিয়াস মিচো। ফলকের একদম নিচে লেখা আছে, ‘মারডক’, যা সম্ভবত কলকাতার সমাধিফলক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
যে কয়জন গ্রিকের সমাধিফলক এখানে আছে, তাঁরা একজন আরেকজনের সঙ্গে সরাসরি আত্মীয়তার সম্বন্ধে সংযুক্ত নন। তাঁদের দেহাবসান হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় দশক ধরে। অথচ তাঁরা মিললেন একই ছাদের নিচে!
১৮০০ সালের দিকে রমনা অঞ্চলে (তখন নাম ছিল সুজাতপুর) আগে থেকেই গ্রিকদের একটা সমাধি ছিল। ইংরেজরা রমনা অঞ্চলে নানা রকম স্থাপনা বানানো শুরু করলে এবং ১৮৫০ সালের পরে ঢাকায় ধনী গ্রিকদের আধিপত্য কমতে থাকলে এই সমাধি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হতে থাকে। শেষে এমন অবস্থা হয় যে এলাকার লোকজন সমাধিফলক, ইট-পাথর পর্যন্ত খুলে নিয়ে নির্মাণকাজে লাগানো শুরু করে একসময়। তাই দেখে অবশিষ্ট প্রভাবশালী গ্রিক (যাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী রাল্লি ব্রাদার্সের বংশধরেরা অন্যতম) বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের কাছে আরজি করলেন, অন্তত কিছু সমাধি, দেহাবশেষ এবং সমাধিফলক তুলে নিয়ে এসে একত্র করে একটা মন্দিরে স্থাপন করার অনুমতি দেওয়া হোক।
আধভাঙা স্মৃতিফলক: বাবা ও মেয়ের। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ ও গ্রিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯১৫ সালে তৈরি হয় টিএসসির এই সমাধি-মন্দির। ধারণা করা হয়, টিএসসির সবুজ গালিচার নিচেও শুয়ে আছেন উল্লেখিত মানুষগুলোর কেউ কেউ। এর ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এই মন্দির ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের অংশই হয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে এটির অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর সৌন্দর্য ও সৌকর্য নবায়ন হয়েছে ১৯৯৭ সালে দিল্লির গ্রিক দূতাবাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের যৌথ উদ্যোগে।
শুনতে পাচ্ছি, টিএসসি নতুন করে বিনির্মাণ করা হবে। তখন হয়তো এই সমাধি আবারও সরানো হবে। সেখানে চিরনিদ্রায় থাকা অভিবাসীরা হয়তো ভাবতে থাকবেন, তাঁদের অভিবাসনের কোনো শেষ নেই—না তাঁদের জীবদ্দশায়, না মরণের পর।
তথ্যসূত্র:
‘Glimpses of the Greek Community from the Dhaka University Gravestones’. Helen Abadzi. Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, 40, 101-116,1995
‘From Thrace to Bengal: Greek Merchants in Early Colonial Bengal’. KANDA Sayako. The Memoirs of Toyo Bunko, 77, 2019
লেখক: প্রযুক্তিবিদ, ইনফিনিয়াম ইউকে লিমিটেড, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য
*যিশুখ্রিষ্টের ১২ জন শিষ্যের একজন ছিলেন সেন্ট থমাস, যিনি প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি এক সময়ে দক্ষিণ ভারতে আসেন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য। তিনি সেখানেই দেহ রাখেন। নাথানিয়েলকে দ্বিতীয় সেন্ট থমাস বলা হচ্ছে, কেননা তিনিও সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষের এক নগর, ঢাকায় এসেছিলেন যেমন করে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এসেছিলেন আরেক ধর্মপ্রচারক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যখন সেখানে পড়তাম, তখন খুব আগ্রহ হতো মন্দিরটির বিষয়ে। শুনেছিলাম অনেক আগের ছোট্ট এক গ্রিক মেয়ের কবর আছে সেখানে। কেমন একটা বিষাদমাখা মায়া কাজ করত তার জন্য।
সম্প্রতি ফেসবুকের একটি পোস্টে প্রথমবারের মতো মন্দিরের অন্দর কক্ষ ও সেখানে সংরক্ষিত নয়টি অক্ষত, একটি আধভাঙা এপিটাফ এবং সমাধিফলক দেখে প্রায় ভুলে যাওয়া সেই স্মৃতি আবার মাথায় কড়া নাড়ল। এই অন্তর্জালের দুনিয়াতে তথ্য বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের এক গ্রিক কনসালট্যান্ট হেলেন আবাদজী আর জাপানি গবেষক কানদা সায়াকো—এর দুটি গবেষণাপত্রের তথ্য জোড়া লাগিয়ে একটা ছবি দাঁড় করিয়েছি—পলাশী যুদ্ধের সমসাময়িক বাংলায়, বিশেষ করে ঢাকায় গ্রিকদের আগমন, তাঁদের বাণিজ্য, পেশা, পারিবারিক-সামাজিক জীবন এবং ঢাকার বুকেই তাঁদের শেষশয্যা নিয়ে।
ঢাকায় গ্রিকদের গল্প
বাংলায় গ্রিকরা আসে ১৭৫০ সালের দিকে—আজকের গ্রিস এবং গ্রিক-অধ্যুষিত অঞ্চল, যেমন আধুনিক তুর্কি ও ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো থেকে। ভাগ্য ফেরানো ওসমানিয়া শাসন বলয় থেকে বের হওয়া, ধর্মপ্রচার ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের দিকে এরা আসতে শুরু করে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি বাংলায় ভালোভাবে আসন গেঁড়ে বসার পর। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আলেক্সিওসি (আলেক্সান্ডার) আর্গাইরি। বুলগেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী এই গ্রিক কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর কারবার ছিল বসরা আর লেভান্তে (সিরিয়া-লেবানন) অঞ্চলের সঙ্গে। ১৭৭০ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরার পথে বঙ্গোপসাগরে নিশ্চিত জাহাজডুবি থেকে বেঁচে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, কলকাতায় একটা চার্চ বানাবেন। তখন সবে কলকাতার গভর্নর হয়েছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তাঁকে গিয়ে আর্গাইরি ধরলেন চার্চ নির্মাণের অনুমতির জন্য। হেস্টিংস জানতেন, গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যবসায় উন্নতি করছে, তাই অনুমতি দিলেন। আর্গাইরি আর অন্যান্য ধনী গ্রিকরা চার্চ বানানোর তোড়জোড় শুরু করলে তিনি তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য হাজির হলেন ঢাকায়, ১৭৭১ সালে। এ থেকে অনুমান করা যায় আর্গাইরির আগমনের আগে থেকেই গ্রিক বণিকেরা ঢাকায় ডেরা বেঁধেছিল।
এই প্রস্তরখণ্ডের নিচে মিসেস সুলতানা আলেক্সান্ডার, আলেক্সান্ডারের স্ত্রীর (আলেক্সান্ডার ইস্তাম্বুলের কারিয়াকোস ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র) নশ্বর দেহাবশেষ শায়িত আছে, যিনি এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন, মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৪ বছর। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
আর্গাইরির সঙ্গে ঢাকায় আসে তাঁর ২১ বছর বয়সী বড় ছেলে পানিয়তি। ১৭৭৭ সালে আর্গাইরি মৃত্যুবরণ করেন ঢাকাতেই। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিকে পুঁজি করে ১৮ শতকের শেষার্ধে এসে এই পানিয়তি ব্যবসা বাড়িয়ে বাংলায় গ্রিক বণিক সম্প্রদায়ের প্রধান হয়ে ওঠেন। ঢাকা ও সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জে গ্রিকদের প্রধান বাণিজ্য ছিল চুন ও লবণকে ঘিরে। সিলেটের খাসিয়া-অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলে উৎকৃষ্ট মানের চুনাপাথর পাওয়া যেত (এবং এখনো যায়), যা থেকে তৈরি করা হতো চুন। সে চুন দরকার হতো বড় বড় ইমারত তৈরিতে। নৌপথে বজরায় করে সে চুনের চালান যেত নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে নদীপথে সহজেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার পদ্মা-মেঘনার সংগমস্থল দিয়ে উত্তর-পশ্চিম বা দক্ষিণ-পূর্বে নৌযাত্রা করা যেত। সে জন্য ভোলা ও চাটিগাঁ থেকে আসা লবণের বিরাট মোকাম গড়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জে।
এইখানে শায়িত আছেন ইস্তাম্বুলের জর্জ ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র থিওডোরের স্ত্রী থিওডোসিয়া। ১০ এপ্রিল ১৮০৫ সালে। তাঁর স্মৃতি অমর হোক। এই দুই নারীর সমাধিফলকেই একটা কথা আছে, যা আমাদের অবাক করে, ‘ঢাকার প্রতি তিনি ঋণী’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
চুন ও লবণ—এই দুই অতিপ্রয়োজনীয় বাণিজ্যের মূল অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ ইংরেজদের হাতে থাকলেও তাতে কলকাতার বাঙালি হিন্দু (যারা বউবাজার-বাগবাজার-বড়বাজারের ‘ভদ্দরলোক’ নামে পরিচিতি পায়), আর গ্রিকরা মিলে মোটা মুনাফা আয় করে যাচ্ছিল। এর মধ্যে গ্রিক বণিক মভ্রদি কেরিয়াকোস একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন চাটিগাঁও, আর ভোলার উৎপাদিত মোট লবণের এক-তৃতীয়াংশ। তখন এক ভোলা থেকেই বছরে ১ হাজার টনেরও বেশি লবণ আসত নারায়ণগঞ্জে। আর তাতে নিয়োজিত ছিল ১৬০টি বজরা। এই বণিকদের একজন ছিলেন নিকোলাস দিমিত্রিওস। টিএসসির সেই গ্রিক মন্দিরের ভেতরে অনেকের সঙ্গে সমাহিত আছেন সেই দিমিত্রিওসও।
বিষাদমাখা এক অর্থনীতির গল্প
টিএসসির সে মন্দিরের যে আকার ও আয়তন, তাতে করে বড়জোর এক বা দুজনের সমাধি হতে পারে। অথচ সেখানে আটটি স্মৃতিফলকে একজন করে আটজন এবং অন্য আরেকটা ফলকে একসঙ্গে তিন ভাইয়ের কথা উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এই ছোট একটি জায়গায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। এই ১১ জনের মৃত্যু কাছাকাছি সময়ে হয়নি। হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে। দুটি স্মৃতিফলকে উল্লেখিত দুই নারীর মধ্যে একটা সম্পর্ক (তাঁদের দুজনের শ্বশুর সম্ভবত দুই ভাই) অনুমান করা যায়। অন্য দুজন নারী আরেক গ্রিকের দুই স্ত্রী ও এক পরিবারের তিন ভাই। এ ছাড়া আরও চারজনের সঙ্গে একে অন্যের কোনো ধরনের আত্মীয়তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে সত্যি নয়।
মিসেস মাগদালেন, সোফিয়া জর্ডান এবং তাঁদের স্বামী মি. জোসেফ জর্ডানের (কেসারিয়া, তুর্কি থেকে আগত, নারায়ণগঞ্জের বণিক) স্মৃতির উদ্দেশে। জর্ডান ১০ ফেব্রুয়ারি ১৮১৯ সালে ৬০ বছর বয়সে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন। তাঁদের সবার স্মৃতির প্রতি অনুরাগ-আপ্লুত এই স্মারক নিবেদন করলেন তাঁদের অভাগা এতিম সন্তানেরা। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
তাহলে প্রথমে যে প্রশ্ন আসে, তাঁরা সবাই এক জায়গায় সমাহিত হলেন কীভাবে? কীভাবে তাঁদের মৃত্যুর প্রায় শতাব্দীকাল পরে এসে ঠাঁই পেলেন এই ছোট্ট সমাধি-মন্দিরে? আমরা এর উত্তর খুঁজব সমাধিফলকের গায়ে উৎকীর্ণ বাণী ও তৎকালীন বাংলায় গ্রিক বণিকদের ওপর করা গবেষণালব্ধ তথ্যের মধ্যে।
নিকোলাস দিমিত্রিওসের (জন্ম ১৭৯৭, মৃত্যু ১৮৪৩) সমাধিফলক লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। মৃত্যুর ১৬ বছর পর এসে ফলকটি উৎসর্গ করেছেন বাসিল দিমিত্রিওস। পারিবারিক নাম এক হলেও বাসিল নিজের পরিচয় দিয়েছেন নিকোলাসের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে। এই এপিটাফে একটা উর্দু কবিতা (সম্ভবত মির্জা গালিবের) ইংরেজি হরফে লেখা আছে, যার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম:
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
বোঝা যাচ্ছে নিকোলাসের কাব্যপ্রীতি ছিল, যা তাঁর বন্ধু বাসিলের অজানা ছিল না। হয়তো নিকোলাস ও বাসিল দুজনই ভারতবর্ষে, হয়তো ঢাকাতেই জন্মেছিলেন। বাল্যসখা ছিলেন। ঢাকার নবাবদের মধ্যে উর্দুর প্রচলন ছিল। সেখান থেকেই শিখেছিলেন এই ভাষা। খুব সম্ভব তাঁরা বাংলাও বলতে পারতেন, যেহেতু ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন।
দিমিত্রিওস এলিয়াসের জ্যেষ্ঠ পুত্র নিকোলাস দিমিত্রিওসের স্মৃতির উদ্দেশে। মৃত্যু ৫ মার্চ ১৮৪৩, বয়স ৪৬। তাঁর প্রিয় কবিতার ছত্র—
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু বাসিল দিমিত্রিওস এই ফলক স্থাপন করলেন ১৮৫৯ সালে। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
বন্ধুর জন্য এপিটাফের ব্যবস্থা করার এক বছরের মাথায় ১৮৬০ সালে মারা যান বাসিল দিমিত্রিওস, মাত্র ৬০ বছর বয়সে। ইংরেজি জানা বাসিল জীবনভর বিচিত্র পেশায় জড়িত ছিলেন। কমিশনারের সহকারী ছিলেন ৯ বছর, সেন্ট টমাস চার্চের (১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠিত) করণিক ছিলেন ৪০ বছর—জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আর ১০ বছর ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন ঢাকা কলেজে (১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত)। এর মানে জীবন চালানোর জন্য একসঙ্গে বেশ কিছু চাকরি করেছেন সমান্তরালে। ছাপোষা এমন একজন মানুষের বন্ধু ছিলেন ধনী বণিক নিকোলাস। সম্ভবত দুজনই সমবয়সী, একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন ও বেড়ে উঠেছেন।
প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল ফাদার নাথানিয়েলের স্মৃতিফলক। আমরা জানতে পারি, ১৭৩৬ সালে সুদূর আজিয়ান সাগরের ছোট্ট দ্বীপ সিফোনেসে জন্ম নেওয়া নাথানিয়েল শেষশয্যা নিয়েছেন ঢাকায়, ১৮১০ সালে। আমরা পুলকভরে অবগত হই যে তিনি তাঁর জন্মস্থান ও ঢাকা—দুই জায়গাকেই নিজের স্বদেশ বলে গণ্য করতেন! তিনি হয়তো ধর্ম প্রচারে এসে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বুড়িগঙ্গার ধারের এই নগরকে।
এইখানে শায়িত প্রয়াত কেসারিয়ার (তুরকিস্তান) জ্যাকব ইস্সাই লাকোবোগলাস। মৃত্যু ২২ জুন, ১৮১৯ সালে, বয়স হয়েছিল ৪৮। ওপর থেকে যিনি তাকিয়ে আছেন, হে ঈশ্বর, তাঁকে ক্ষমা করুন। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
নাথানিয়েলের চার বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন এক ব্যবসায়ী, কনস্টানটিন। তাঁর স্ত্রী এই সমাধিফলক বানান প্রয়াত সহধর্মীর জন্য—তাঁর নাম আমরা জানতে পারি না। কিন্তু তাঁর বেদনামথিত আবেগের কথা লেখা আছে মাতৃভাষা গ্রিকে।
ফিলিস্তিন থেকে আসা জোসেফ জর্ডান (১৭৫৯-১৮১৯), আর তাঁর দুই স্ত্রী মাগদালেন ও সোফিয়ার জন্য ইংরেজিতে ফলক লিখে রেখে গেছেন তাঁদের শোকগ্রস্ত সন্তানেরা। এতে অনুমান করা যায়, দ্বিতীয় প্রজন্মের গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য আর চাকরির সুবিধার্থে ইংরেজিকে তাঁদের প্রতিদিনের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
বাসিল দিমিত্রিওসের (সেন্ট থমাস চার্চের করণিক) পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে। জন্ম ১৮০০ সালে। তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ৯ বছর কমিশনের সহকারী, ১০ বছর ঢাকা কলেজের ইংরেজির শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন এবং ৪০ বছর সেন্ট থমাস চার্চে সেবা প্রদান করেছেন। ‘বিশুদ্ধ প্রাণ যাদের, তারাই তো দেখা পায় ঈশ্বরের’ (বাইবেল: ম্যাথিউ), ১৮৬০। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, সেদিন ছিল রোববার। ছুটির দিন। ঢাকা থেকে ২৫ মাইল দূরের মির্জাপুরে সেই দিন বাঘ শিকারে গিয়েছেন জন দিমিত্রিওস ইলিয়াস। সেখানেই বাঘের থাবায় তাঁর করুণ মৃত্যু হয় মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। যিনি বাঘ শিকারের মতো রোমাঞ্চকর ও দামি শখ মেটানোর ক্ষমতা রাখেন, তিনি যে ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ইংরেজিতে লেখা সে স্মৃতিপ্রস্তরে তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের কথাও বলা হয়েছে, তাঁরাও শিকারি ছিলেন। তাঁদের দেহাবশেষ একসঙ্গে করে তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁদের এক মামাতো বা খালাতো ভাই ম্যানুয়েল এই ফলকের ব্যবস্থা করেন।
এটি ফাদার নাথানিয়েলের সমাধি; পবিত্র এবং সাধু; যিনি পবিত্র এক সাধুর ন্যায় যিশুর কথা প্রচার করেছেন, তাঁর জীবনাচার এবং বাণীর মাধ্যমে। অনবদ্য এক আনন্দধাম এই ঢাকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বিতীয় সেন্ট থমাস*। তাঁর পিতৃভূমি ছিল সিফনোস (আজিয়ান সাগরের এক দ্বীপ), যেখানে তিনি ১৭৩৬ সালে প্রথম আলো দেখেছেন এবং ঢাকা—এই দুই স্থানকেই তিনি স্বদেশ বলে গণ্য করতেন। ১২ মার্চ ১৮১০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘তিনিই সুখী হন, যিনি অন্যকে ভক্তিময় সম্মান দান করেন’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮২০ সালের পর নানা কারণে ইংরেজ-কলকাতার ‘ভদ্দরলোক’ গ্রিকদের ত্রিমুখী বাণিজ্য প্রণয় আর আগের মতো থাকেনি, মুনাফাতেও টান পড়তে শুরু করে। চুন আর লবণের ব্যবসা ছেড়ে টাকাওয়ালা গ্রিকেরা জমিদারি কিনতে লাগলেন (বরিশাল অঞ্চলেও এদের একটা জমিদারি ছিল)। আর যাঁরা অতটা বিনিয়োগ করতে পারলেন না, তাঁরা ইংরেজদের সওদাগরি কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত ইংরেজ লেখক জেমস টেইলরের বই ‘A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca’ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৩৮ সালে ঢাকায় মাত্র ১২টি গ্রিক পরিবারের বসবাস ছিল। জন দিমিত্রিওস এলিয়াস আত্মীয়স্বজন সেই ১২ পরিবারের একজন হওয়ার কথা। আরও বোঝা যাচ্ছে যে গ্রিকদের ব্যবসা পড়তির দিকে থাকলেও তখন ঢাকায় অবস্থাসম্পন্ন কয়েকজন গ্রিকের বসবাস ছিল।
জর্জ মাভরোডোগ্লোর পুত্র কনস্টানটাইনের স্ত্রী, যিনি ছিলেন স্বামীপরায়ণা নারী, তাঁর চিরজাগরুক ভালোবাসার স্মারক হিসেবে এই ফলকখানি স্থাপন করেছেন। তাঁর (স্বামীর) জন্মস্থান ছিল ইস্তাম্বুল। একজন বণিক হিসেবে তিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন। ১৮০৬ সালের ২৪ জুলাই তিনি জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এই ঢাকায়। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
একই পরিবারের দুই বউ থিওডোসিয়া (মৃত্যু ১৮০৫) ও সুলতানার (জন্ম ১৭৬৬) দেহাবশেষ পাশাপাশি রাখা আছে। সুলতানা সম্ভবত অধুনা তুর্কি দেশের মেয়ে ছিলেন, শুধু নামেই তার ইঙ্গিত মেলে না, তাঁর শ্বশুর কারিয়াকোস ফিলিপ্পো নিজেও এসেছিলেন ইস্তাম্বুল থেকে। তিনি হয়তো ছেলের বিয়ের জন্য নিজের জন্মস্থানের মেয়েই খুঁজে এনেছিলেন। কেমন দেখতে ছিলেন সুলতানা? তিনি কি কখনো শাড়ি পরেছিলেন? সুলতানার মৃত্যু হয় ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে, আজ থেকে ২২২ বছর আগে, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে।
এই স্থাপনায় আরও আছে আধভাঙা এক সমাধিফলক, যার বাকি অংশ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। সেখানে আমরা দেখতে পাই, এক পিতা ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বরের কোনো এক দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন। একই সমাধিতে পরে তাঁর কন্যাকেও সমাহিত করা হয়। কন্যার জন্ম ১৮১৫ সালে। তাঁর মৃত্যুর বছর আমরা হয়তো জানতে পারব না কোনো দিনই; হয়তো পিতৃশোকাতুর মেয়েও বেশি দিন বাঁচেনি। শুধু জানব ঢাকায় বসবাসকারী এই গ্রিক পিতা এবং কন্যার শেষশয্যা হয়েছিল রমনার সবুজ গালিচার নিচে। নাম না জানা সেই মেয়ে তার বাবার কোলে শুয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে, পরম নিশ্চিন্তে।
দিমিত্রিওস এলিয়াস এস্কোয়ারের দ্বিতীয় পুত্র জন দিমিত্রিওসের পবিত্র স্মৃতির প্রতি। ১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, রবিবার ঢাকার উত্তর-পশ্চিমের মির্জাপুরে বাঘ শিকারে গিয়ে নিহত হন। এখানে তিন মহান ভাই নিকোলাস, জন ও কনস্টানটিন একসঙ্গে শায়িত হয়েছেন। এখানে যূথবদ্ধ হয়ে আছেন সাহসী শিকারি ও খেলাধুলায় পারদর্শী তিন উচ্ছল জীবন। ফলক স্থাপনায় (খালাতো/মামাতো) ভাই মানুয়েল এলিয়াস মিচো। ফলকের একদম নিচে লেখা আছে, ‘মারডক’, যা সম্ভবত কলকাতার সমাধিফলক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
যে কয়জন গ্রিকের সমাধিফলক এখানে আছে, তাঁরা একজন আরেকজনের সঙ্গে সরাসরি আত্মীয়তার সম্বন্ধে সংযুক্ত নন। তাঁদের দেহাবসান হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় দশক ধরে। অথচ তাঁরা মিললেন একই ছাদের নিচে!
১৮০০ সালের দিকে রমনা অঞ্চলে (তখন নাম ছিল সুজাতপুর) আগে থেকেই গ্রিকদের একটা সমাধি ছিল। ইংরেজরা রমনা অঞ্চলে নানা রকম স্থাপনা বানানো শুরু করলে এবং ১৮৫০ সালের পরে ঢাকায় ধনী গ্রিকদের আধিপত্য কমতে থাকলে এই সমাধি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হতে থাকে। শেষে এমন অবস্থা হয় যে এলাকার লোকজন সমাধিফলক, ইট-পাথর পর্যন্ত খুলে নিয়ে নির্মাণকাজে লাগানো শুরু করে একসময়। তাই দেখে অবশিষ্ট প্রভাবশালী গ্রিক (যাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী রাল্লি ব্রাদার্সের বংশধরেরা অন্যতম) বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের কাছে আরজি করলেন, অন্তত কিছু সমাধি, দেহাবশেষ এবং সমাধিফলক তুলে নিয়ে এসে একত্র করে একটা মন্দিরে স্থাপন করার অনুমতি দেওয়া হোক।
আধভাঙা স্মৃতিফলক: বাবা ও মেয়ের। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ ও গ্রিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯১৫ সালে তৈরি হয় টিএসসির এই সমাধি-মন্দির। ধারণা করা হয়, টিএসসির সবুজ গালিচার নিচেও শুয়ে আছেন উল্লেখিত মানুষগুলোর কেউ কেউ। এর ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এই মন্দির ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের অংশই হয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে এটির অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর সৌন্দর্য ও সৌকর্য নবায়ন হয়েছে ১৯৯৭ সালে দিল্লির গ্রিক দূতাবাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের যৌথ উদ্যোগে।
শুনতে পাচ্ছি, টিএসসি নতুন করে বিনির্মাণ করা হবে। তখন হয়তো এই সমাধি আবারও সরানো হবে। সেখানে চিরনিদ্রায় থাকা অভিবাসীরা হয়তো ভাবতে থাকবেন, তাঁদের অভিবাসনের কোনো শেষ নেই—না তাঁদের জীবদ্দশায়, না মরণের পর।
তথ্যসূত্র:
‘Glimpses of the Greek Community from the Dhaka University Gravestones’. Helen Abadzi. Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, 40, 101-116,1995
‘From Thrace to Bengal: Greek Merchants in Early Colonial Bengal’. KANDA Sayako. The Memoirs of Toyo Bunko, 77, 2019
লেখক: প্রযুক্তিবিদ, ইনফিনিয়াম ইউকে লিমিটেড, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য
*যিশুখ্রিষ্টের ১২ জন শিষ্যের একজন ছিলেন সেন্ট থমাস, যিনি প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি এক সময়ে দক্ষিণ ভারতে আসেন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য। তিনি সেখানেই দেহ রাখেন। নাথানিয়েলকে দ্বিতীয় সেন্ট থমাস বলা হচ্ছে, কেননা তিনিও সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষের এক নগর, ঢাকায় এসেছিলেন যেমন করে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এসেছিলেন আরেক ধর্মপ্রচারক।
প্রকৃত নাম জন গ্রিফিথ চেইনে হলেও জ্যাক লন্ডন নামে খ্যাতি পেয়েছেন এই বিখ্যাত মার্কিন লেখক। তাঁর জন্ম ১৮৭৬ সালের ১২ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়।
৪ ঘণ্টা আগেআবদুস সালাম ছিলেন বিজ্ঞানে নোবেল পাওয়া প্রথম মুসলিম এবং প্রথম পাকিস্তানি বিজ্ঞানী। পাকিস্তানি এই তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ইলেক্ট্রোউইক ইউনিফিকেশন থিওরির জন্য নোবেল পুরস্কার পান।
১ দিন আগেঢাকা কলেজ, এ দেশের শিক্ষা ইতিহাসেই শুধু নয়, জাতির ইতিহাসেরও এক অনন্য অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত এক নাম। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ কলেজের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। এ কলেজের কৃ
২ দিন আগে‘ভাষাকন্যা’ হিসেবে খ্যাত সুফিয়া আহমেদের জন্ম ১৯৩২ সালের ২০ নভেম্বর ফরিদপুরে। ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্রী একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের মধ্যে অন্যতম। সেদিন তিনি পুলিশি নির্যাতনে আহত হন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য...
২ দিন আগে