বুরকিনা ফাসোতে সেনা অভ্যুত্থান, জঙ্গি উত্থান নিয়ে চিন্তিত পশ্চিমারা

ইয়াসিন আরাফাত 
আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২২, ১৯: ৪২
Thumbnail image

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসো এখন সেনাদের দখলে। সব সেনা অভ্যুত্থানের মতো এই অভ্যুত্থান নিয়েও শুরুতে ধোঁয়াশা ছিল। গত রোববার বুরকিনা ফাসোর বেশ কয়েকটি সেনা ব্যারাকে গোলাগুলির ঘটনার পর অভ্যুত্থানের শঙ্কা তৈরি করে। সরকার প্রথমেই গুজব বলে উড়িয়ে দেয়। সোমবার (২৪ জানুয়ারি) জাতীয় টেলিভিশনে বিবৃতি দিয়ে ক্ষমতা দখলের কথা জানায় সেনাবাহিনীর একাংশ। পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট রোচ মার্ক ক্রিশ্চিয়ান কাবোরেকে আটকের কথাও জানানো হয়।

এই অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছে বুরকিনা ফাসোর মানুষ। রাস্তায় নেমে আনন্দ মিছিল করেছে তারা। কিন্তু বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই অভ্যুত্থান সাহেল অঞ্চলে জঙ্গিদের শক্তিবৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে। 

সরকারের পতনের পরপরই সংবিধান স্থগিত করা হয়েছে। সীমান্তও বন্ধ। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন লেফটেন্যান্ট-কর্নেল পল-হেনরি সান্দাওগো দামিবা। 

২০২০ সালের পর বুরকিনা ফাসোর প্রতিবেশী দেশ মালিতে দুই দফা সেনা অভ্যুত্থান হয়। সেখানে জঙ্গি তৎপরতা ঠেকাতে সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেই অভ্যুত্থানগুলো হয়। বুরকিনা ফাসোতেও সরকারের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ। ফলে এই অভ্যুত্থানকে অপ্রত্যাশিত মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। পশ্চিম আফ্রিকায় ১৭ মাসে চারবার সফল অভ্যুত্থান হয়েছে। আর এসব অভ্যুত্থান সাহেল অঞ্চলে পশ্চিমাদের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। 

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুরকিনা ফাসোতে আল কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেটপন্থী (আইএস) জঙ্গিরা সক্রিয়। পুরো সাহেল অঞ্চলে ফ্রান্সের ৫ হাজার ১০০ সেনা সদস্য রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর কিছু কমান্ডো। এ ছাড়া জাতিসংঘের প্রায় ১৫ হাজার শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য রয়েছে মালিতে। যারা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। 

সাহেল অঞ্চলের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ বুরকিনা ফাসো, মালি ও নাইজারে গত তিন বছরে আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটপন্থী জঙ্গিদের তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বুরকিনা ফাসোর ২ কোটি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ১৫ লাখ মানুষই গত তিন বছরে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দেশটিতে প্রায় ৭ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। 

পশ্চিমা দেশগুলোর দাবি, তারা সাহেল অঞ্চলে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দুর্নীতি ও শাসন ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে এসব অঞ্চলে সরকারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটছে। ফ্রান্স একসময় বন্ধুত্বপূর্ণ স্বৈরশাসকদের সমর্থন দিত। তারাও এখন জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে। ফলে এ অঞ্চলে যুদ্ধরত সেনার সংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা করছে ফ্রান্স। 

সাহেল অঞ্চলে জঙ্গিদের তৎপরতাযুক্তরাষ্ট্রও এই অঞ্চলে সেনাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। সাহেল অঞ্চলে বেসামরিক ও সামরিক সম্পর্ক নিয়ে পশ্চিমা ধারণা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। যেখানে সেনাবাহিনী বেসামরিক নেতাদের প্রতি অনুগত থাকবে ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবে। 

সাম্প্রতিক সময়ের অভ্যুত্থানগুলো পশ্চিমাদের এই প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলছে। মালিতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। এর ফলে প্রতিবেশী দেশগুলো মালির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। পাশাপাশি সীমান্তও বন্ধ করে দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রাশিয়ার সহায়তা নিয়ে মালিতে সেনাদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। এর ফলে বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ সেনা প্রত্যাহারের হুমকি দিচ্ছে। 

এদিকে বারবার অভ্যুত্থানে সাহেল অঞ্চলের জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হালকা হচ্ছে। 

২০১৪ সালে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আফ্রো ব্যারোমিটারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৪ শতাংশ বুরকিনা ফাসোর বাসিন্দা সেনা সরকারকে সমর্থন করে। তবে ২০১৮ সালের আরেকটি জনমত জরিপে দেখা যায়, ৫০ শতাংশ বাসিন্দাই চায় সেনা সরকার আবার আসুক। গত ২৪ জানুয়ারি যখন সেনারা ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দেয় তখন জনগণকে রাস্তায় নেমে উল্লাস করতে দেখা গেছে। 

উত্থাপনকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন আলিউ ওয়েড্রাওগো। তিনি বলেন, নতুন শাসকেরা আগের সরকারের চেয়ে খারাপ হতে পারে না। 

জনগণ খুশি হলেও বুরকিনা ফাসোর এই অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে এমনটি জানানো হয়েছে। 

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস একটি টুইট বার্তায় বলেন, ‘অভ্যুত্থানের নেতাদের অবশ্যই অস্ত্র জমা দিতে হবে এবং রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ও দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।’ 

যুক্তরাষ্ট্রও সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে সেনাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন ও অর্থনৈতিক সংগঠন ইকোনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটসের পক্ষ থেকে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানানো হয়েছে। 

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট ব্লেইস কমপাওরেকে গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরানো হয়। ব্লেইস ১৯৮৭ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই বুরকিনা ফাসোর ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০১৫ সালে দেশটিতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায় সেনাবাহিনী। এ নিয়ে সেনাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়। ওই বছর দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার আশায় কাবোরেকে নির্বাচিত করে জনগণ। 

প্রেসিডেন্ট রোচ মার্ক ক্রিশ্চিয়ান কাবোরে ১৯৬০ সালে ফ্রান্স থেকে স্বাধীন হওয়ার পর বুরকিনা ফাসোতে আটবার সফল সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। বহুবার ব্যর্থ অভ্যুত্থান হয়েছে। গত ডিসেম্বরে মার্ক ক্রিশ্চিয়ান তাঁর মন্ত্রিসভায় রদবদল করেন। তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে একজন সেনা কর্মকর্তাকে আনেন। গত ১১ জানুয়ারি সরকার আট সেনা কর্মকর্তাকে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। তখন থেকে দেশটিতে অভ্যুত্থানের শঙ্কা দেখা দেয়। 

তবে এই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বুরকিনা ফাসোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি। গত বছরের জুনে দেশটির সোলহান গ্রামে শতাধিক মানুষকে গলা কেটে  হত্যা করা হয়। গত নভেম্বরে ইনাতা শহরে ৪৯ সেনা ও চারজন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে জঙ্গিরা। সেনাদের একটি মেমোতে দেখা গেছে, সেনারা খাদ্য সংকটে ছিল। হত্যার আগে তাঁদের গবাদিপশু চরাতে বাধ্য করেছিল জঙ্গিরা। এরপর কাবোরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের জন্য বাজেটে কিছু বরাদ্দ বাড়ায় সরকার। ইনাতার ঘটনার পর রাজধানীতে বিক্ষোভ করে জনগণ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অভ্যুত্থানের কারণে সবচেয়ে সুবিধা পাবে সন্ত্রাসবাদীরা। কারণ অভ্যুত্থানবিরোধী সেনাদের একটি অংশ লড়াই চালিয়ে যাবে। এতে দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থায় শূন্যতা তৈরি হবে। এই সুযোগেই শক্তিবৃদ্ধি করবে সন্ত্রাসবাদীরা। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত